#মাইনাসে_মাইনাসে_প্লাস (পর্ব ১৭)
নুসরাত জাহান লিজা
পূরবী সেদিনের পরে আর মাত্র দুইদিন ছিল পৃথিবীতে, এরপর সব মায়া কাটিয়ে তাকে চলে যেতে হয়েছে ওপারে। এরমধ্যে একদিন অল্পস্বল্প কথা বলতে পেরেছে, পরেরদিন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল পুষ্পিতার দিকে। মুখে কথা না থাকলেও চোখে অজস্র বোবা আকুতি মাখা ছিল। ছোট্ট পুষ্পিতা অবশ্য সেই ভাষা বুঝতে পারেনি।
তবে নওরীনের হাত ধরে রেখেছিল কিছু সময়ের জন্য, যেন অব্যক্ত ভাষায় বোবা আর্জিতে বলতে চাইছিল,
“আমার মেয়েটাকে ভবিষ্যতে একটু মমতার আশ্রয় দিও বোন।”
সেই অভিব্যক্তি নওরীন যেন স্পষ্ট শুনতে পেল, নাকি এমন কিছু শুনতে চাইছিল বলে ভেবে নিল নিজের মতো করে। সে জানে না, জানতে চায় না। কেবল আর্জিটুকু সে প্রাণপণে ধরে রাখতে চায়।
নওরীন স্কুল শেষ হলেই ছুটে আসত এখানে। কীসের যেন একটা অদ্ভুত টান তৈরি হয়েছিল এই অসহায় মায়ের জন্য, ছোট্ট ফুলের মতো মেয়েটার জন্য।
অনেকেই হয়তো অবিশ্বাস করে বলতে পারে, না চেনা একজন মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের জন্য আবার এমন আদিখ্যেতা কীসের! কিন্তু মানুষের মন ভারি অদ্ভুত, কখন কার জন্য কী অনুভূতি তৈরি হয় কেউ জানে না৷ এসব কারণ খুঁজেও বের করতে চায় না নওরীন। ওর মনে হয় পূরবী যদি আরেকটু বেঁচে যেত!
কিন্তু ওর চাওয়া পূরণ হয় না। মাকে ঠিকঠাক বুঝতে পারার আগেই পুষ্পিতা মাতৃহীন হয়ে গেল। মেয়েটা ঠিকঠাক বুঝতেও পারল না পৃথিবীতে তার আসলে নিজের বলতে কেউ রইল না। বৃদ্ধা নানী নিজেই বয়সের ভারে ন্যুব্জ। ওর বাবাও এই সম্পর্ক নিয়ে অত্যন্ত উদাসীন।
মেয়েটার ভবিষ্যৎ চিন্তায় কাতর হয় নওরীন। মনে একটা সুপ্ত বাসনা উঁকি দেয়, কিন্তু এভাবে কি সেটা সম্ভব! অন্য একজনের সন্তান চাইলেই কী ওকে দিয়ে দেবে!
তবে সে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করছে। আপাতত এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে কেবল মেয়েটার পাশে রইল অতৃপ্ত মাতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। কিছুটা অন্তত ভরসা তো দিতে পারে।
পূরবী যেন ওর নিজের বোন হয়ে গিয়েছিল। ওকে ভরসা করেছিল। ওর নানীর কাছ থেকে আজ এসে শুনল পুষ্পিতার বাবা এসেছিল মেয়ের ব্যবস্থা করতে। একটা ট্রাস্টের সাথে কথা হয়েছে নাকি! অরফানেজে রেখে আসার ব্যাপারে। সে নাকি দেশের বাইরে যাচ্ছে তাই মেয়ের দায়িত্ব নেয়া সম্ভব নয়। তবে পাঁচ হাজার টাকা নাকি দিয়ে গেছে।
একটা অচেনা রাগ নওরীন নিজের মধ্যে অনুভব করল। নিজের জন্ম দেয়া সন্তানের প্রতি এতটুকু দায়বদ্ধতা নেই, ভালোবাসা নেই! স্ত্রীর সাথে তার সম্পর্ক স্থায়ী হয়নি, কিন্তু পুষ্পিতা তো তার নিজেরই রক্ত! কীভাবে মানুষের মধ্যে এমন অমানুষ বাসা বাধে!
রিয়াদের সাথে পরামর্শ করতে হবে ভাবল নওরীন।
***
নেহাল প্রতি মাসে বেতন পেয়েই সবার জন্য টুকিটাকি কেনাকাটা করে। ওর এটা খুব ভালো লাগে। বাবাকেও দেখেছে সবসময় এটা করতে। পরিবারের প্রতি ভালোবাসা, কর্তব্য এসব পরিবারের অগ্রজদের মধ্য থেকেই পরবর্তী প্রজন্মের ভেতরে ছড়িয়ে পড়ে বলেই বোধটুকু ওর মধ্যে প্রোথিত হয়ে গেছে।
একজনের জন্য অন্যের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো এভাবে মুখে না বলেও প্রকাশ করা যায় ছোট্ট ছোট্ট কাজের মাধ্যমে। এমন নয় যে সেই উপহারগুলো খুব দামী। কিন্তু অনুভূতির দাম তো আর বাহ্যিক দরদামের মধ্যে পড়ে না। সেটা কেবল যত্ন আর মমতায় ধরা পড়ে। নেহাল করে ওর ব্যক্তিগত ভালোলাগার জায়গা থেকে। গিফটগুলো হাতে পেয়ে তাদের মুখে যে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে, সেটা তো কোনো মূল্য দিয়ে সে মাপতে পারবে না!
আজও সবার জন্য কেনাকাটা শেষ করে লিলির কথা মাথায় এলো। ওর জন্য কী কেনা যায় ভাবতে ভাবতে একটা শাড়ি কিনে ফেলল। লাল রঙের তাঁতের শাড়ি। দেখতে খুব ভালো লাগল। মনে হলো লিলিকে ভীষণ মানাবে। এই প্রথম উপহার কিনল স্ত্রীর জন্য, কেনার সময় কেন যেন অন্যরকম একটা আন্দোলন হলো বুকে। কীসের সে জানে না।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে অবশ্য অন্য একটা ভাবনায় ভালোলাগাটুকু দ্বিধা আর সংশয়ে বদলে গেল। লিলি কি পছন্দ করবে! যা মেয়ে, যদি রেগে যায়। মনে হলো এটা সে কিছুতেই নিজের হাতে লিলিকে দিতে পারবে না।
আশফাক আর রোমেনার ঘরে এসে তাদের জন্য আনা উপহারগুলো তাদেরকে দিল নেহাল।
রোমেনা জিজ্ঞেস করলেন, “তা বউয়ের জন্য কিছু এনেছিস তো?”
নেহাল সলজ্জ হেসে বলল, “এনেছি।”
“বাহ্! এই তো বুদ্ধি খুলেছে।”
নেহাল ইতস্তত ভঙ্গিতে বলল, “কিন্তু মা, একটা বিপদে পড়েছি। তোমার হেল্প লাগবে।”
“কী বিপদ?” উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন করলেন রোমেনা।
“একটা শাড়ি কিনেছিলাম লিলির জন্য।”
“এখানে বিপদের কী হলো?”
নেহাল রোমেনার হাত ধরে কাতর গলায় বলল, “মা, তুমি এটা একটু ওকে দিয়ে দিও, প্লিজ।”
“আগের কমপ্লিমেন্ট উইথড্র করলাম। তোর একটুও বুদ্ধিশুদ্ধি হয়নি৷ এটা কেমন কথা হলো?”
“মা, প্লিজ, ও যদি কিছু মনে করে? রেগে গেলে পরে দেখা যাবে…”
“বউকে ভয় পাস নাকি? ছি ছি বাবু, তুই তো ফ্যামিলির রেপুটেশন বঙ্গোপসাগরের ঢেউয়ে ভাসিয়ে দিলি রে!”
“বউকে ভয় পেলে সমস্যা কী? আমিও তোমাকে ভয় পাই, যা মানুষ তুমি, ভয় না পেয়ে উপায় আছে?” পাশ থেকে আশফাক স্ত্রীকে টিপ্পনী কেটে বললেন, মুখে হাসি।
“চাপাবাজী কম করো তো। ছেলেটা এমন বোকা বোকা কথাবার্তা বলছে, আর তুমি মজা নিচ্ছো? ছেলেটা কি আমার একার?”
“আরে, আমি তো ওর সমব্যথী হতেই সত্যি কথাটা বললাম।”
“বলে আমাকে উদ্ধার করেছো!”
“সেটা বহুবছর ধরেই করে আসছি।
রোমেনা, আশফাকের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ততোধিক কঠিন প্রতি উত্তর দেবার জন্য মুখ খুলতে যাচ্ছিল। নেহাল তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“মা, তোমরা এটা পরে কন্টিনিউ কোরো। এখন আমার একটা ব্যবস্থা করো।”
রোমেনা আশফাকের দিকে তাকিয়ে থেকেই বললেন, “বিরতি থাকল, পরে দেখছি তোমার ব্যাপারটা।”
এবার ছেলের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, “তুই কিনেছিস, তুইই দে। বিয়ে দিয়েছি ঘটকালি করে। ঘটক তকমা গায়ে মেখেছি। ছেলে আর ছেলের বউয়ের গিফট দেয়া-নেয়ার জন্য এখন ডাকপিয়ন হতে পারব না।”
নেহালের মুখ জুড়ে হতাশা নেমে এলো, রোমেনা ছেলের হাত ধরে আবার মুখ খুললেন, “মেয়েরা ডিরেক্ট একশন পছন্দ করে ভায়া বা মেসেঞ্জার না। বুঝলি?”
নেহাল হার মেনে নিয়ে কেবল মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করল। এরপর নিজের ঘরে ফিরে এলো।
লিলি তখন নিজের মুঠোফোনে কী যেন করছিল৷ সারাক্ষণ ফোনে এত সময় নষ্ট করে মেয়েটা, মনে হলো ওর৷
নেহালের ভয় হলো কী করে জিনিসটা দেবে কাঙ্খিত হাতে! সে শপিং ব্যাগটা বিছানার পাশের টেবিলটায় রাখল। লিলি একবার মুখ তুলে তাকিয়ে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ল নিজের জগতে।
নেহাল হাত-মুখ ধুয়ে এসে পায়চারি শুরু করল। পায়চারি করলে নাকি মাথা খুলে যায়। প্রায় মিনিট দশেক এই টেকনিক এপ্লাই করেও কোনো ফল পেল না। ডাহা ফ্লপ টেকনিক। ধূর!
লিলি এই পর্যায়ে ফোন স্ক্রল করতে করতেই প্রশ্ন করল, “কী ব্যাপার? যু দ্ধে র প্রস্তুতি নিচ্ছেন নাকি?”
নেহাল এবার থামল, কিন্তু এতটুকু সুস্থির হতে পারল না।
“আমি আজ পুডিং বানিয়েছিলাম। খাবেন?” মোলায়েম শোনায় লিলির গলাটা।
“ঠিক আছে।” মৃদু গলায় বলল নেহাল।
লিলি উঠে দাঁড়িয়ে নেহালকে অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করল। এরপর বলল,
“আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে, আপনি নতুন নতুন প্রেমে পড়েছেন। প্রেমটা এক তরফা। কী করে মেয়েটাকে প্রপোজ করবেন সেই ভাবনায় পড়ে গেছেন।”
নেহালের হৃদযন্ত্র ক্ষণেকের জন্য থেমে গেল যেন! নিঃশ্বাস ফেলতে ভুলে গেল। ওকে পড়ে ফেলছে নাকি! সর্বনাশ!
“শুনুন, একটা ওয়ার্নিং দেই, আমাদের সম্পর্ক যেমনই থাকুক, স্ত্রী বর্তমান থাকা অবস্থায় অন্য কোনো মেয়ের জন্য এসব ভাবনা এলে আমি কিন্তু আপনার চোখ গেলে দেব। মনে থাকবে?”
নেহালের বলতে ইচ্ছে করল, “অন্য মেয়ের প্রেমে পড়লে আগেই পড়তাম৷ আমি আমার একমাত্র বিয়ে করা বউয়ের প্রেমে পড়েছি।”
কিন্তু কথাটা মুখে বলার মতো দুর্ধর্ষ সাহস হয়ে উঠল না। নাক বরাবর যদি একটা ঘুষি মেরে বসে মেয়েটা! অবচেতনেই নিজের নাকে হাত চলে গেল নিমিষেই।
লিলি খানিকটা এগিয়ে এসে গাঢ় স্বরে বলল, “আমি কিন্তু ভীষণ ডেঞ্জারাস! মনে থাকবে?”
বলেই বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। তা আর বলতে! এই মেয়ে সাক্ষাৎ টর্নেডো।
বুদ্ধি বের করার অন্য কোনো উপায় না পেয়ে গুগলের দ্বারস্থ হলো নেহাল। সেখানে তো সব কিছুর সমাধান থাকে। এটার থাকবে নিশ্চয়ই।
সে গুগলে তাড়াহুড়ো করে সার্চ করল ‘কীভাবে ভয়ংকর স্ত্রীকে উপহার দেয়া যায়?’
লোডিং হচ্ছিল, ঠিক সেই মুহূর্তেই লিলি পেছন থেকে এসে প্রশ্ন করল, ‘কী করেন?”
প্রবল আতঙ্কে নেহালের হাত থেকে মোবাইলটা নিচে পড়ে গেল। ওর মুখের রঙ্গ উড়ে গেল, ইতিকর্তব্য ঠিক করার আগেই লিলি তড়িৎ বেগে ফোনটা কুড়িয়ে নিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকাল।
নেহালে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। এভাবেই তাহলে ওর মান-ইজ্জত সব ভূলুণ্ঠিত হওয়ার ছিল! সে মনে মনে প্রার্থনা করল, ইন্টারনেট যেন কাজ না করে।
কিন্তু মোবাইলের দিকে লিলির বিস্ফারিত দৃষ্টি বলে দিচ্ছিল ওর প্রার্থনা কবুল হয়নি।
নিজেকে ছেলেবেলায় বিটিভিতে দেখা মীনা কার্টুনে দেখা সেই মুরগি চোর বলে মনে হলো! নিজেকে একবার কল্পনায় সেভাবে দেখতেও পেল।
পড়বি তো পড়, সোজা মালির ঘাড়েই পড়তে হলো! ওর ভাগ্যটা এত খারাপ কেন! গ্যাঁড়াকলে ফেঁসে যাওয়া ইঁদুরও মনে হয় ওর চাইতে ভালো অবস্থায় থাকে!
নিজের নির্বুদ্ধিতায় রাগ হলো ভীষণ, এমন বোকা বোকা বুদ্ধি নিয়ে সে এই মেয়েকে কী করে পটাবে!
মনে মনে বলল, “আল্লাহ, আমার প্রতি একটু দয়া করে সদও হও। এই মেয়ের হাত থেকে রক্ষা করো আল্লাহ্। আমার ইজ্জত, সম্মান যেন কিছুটা হলেও অবশিষ্ট থাকে।”
…….
(ক্রমশ)
#মাইনাসে_মাইনাসে_প্লাস (পর্ব ১৮)
নুসরাত জাহান লিজা
লিলির হাতে নেহালের মোবাইলটা ধরে রাখা, চোখ তাতে নিবন্ধ। মুহূর্ত কয়েক সময় লাগল বুঝতে যে আসলে কী হয়েছে! ওর ব্রেইন এই জিনিসটাকে ধরতে পারা মাত্র সশব্দে হেসে ফেলল লিলি। হাসতে হাসতে বিছানায় বসে পেট চেপে ধরল। হাসির দমকে সে কথাই বলতে পারছে না। একটা শব্দের অর্ধেক বলে হাসিতেই বাকিটুকু হারিয়ে যাচ্ছে। চোখের কোণে পানি জমে গেছে হাসির তীব্রতায়। বহু কষ্টে নিজেকে সংবরণ করে অবশেষে সে বলল,
“আপনি কি সত্যিই এতটা ইনোসেন্ট?” তখনও সে স্ট্রাগল করছিল হাসির সাথে।
নেহাল ততক্ষণে কিছুটা হলেও ধাতস্থ হয়ে গেছে। লিলির স্বতঃস্ফূর্ত হাসি যেন টনিকের মতো কাজ করেছে নেহালের জন্য।
“তোমার কি মনে হয়?”
“আমার মনে হওয়ার উপরে ডিপেন্ড করে এটা?”
“আশেপাশের কাছের মানুষদের মতামতের উপরে নির্ভর করে।”
“আমি আপনার কাছের মানুষ বুঝি?”
“দূরের তো নও, তাই না!”
লিলির হাসি আচমকা একেবারে মিলিয়ে গেল। সে চকিতে চোখ তুলে চাইল নেহালের দিকে। এতক্ষণে খেয়াল করল একটু আগের বোকাটে অভিব্যক্তির সিংহভাগ ছেলেটার মধ্যে আর নেই। বরং ঘোরলাগা একটা দৃষ্টি, যে দৃষ্টি ভীষণ অন্যরকম। একটা কোমলতার পাশাপাশি তাতে যেন কিছুটা মুগ্ধতা জড়িয়ে আছে। কীসের মুগ্ধতা ভাবতেই লিলির ভেতরটা যেন কেঁপে উঠল। কিন্তু এতটুকু রাগ হলো না, যা এতদিন পুষে রেখেছিল সেটা আজ যেন কোন গহ্বরে বিলীন প্রায়! এই ভাবনাটাই ওর নিজস্ব বিশ্বাস আর অনুভূতির ভিত সমূলে নাড়িয়ে দিল যেন।
লিলি রোমেনার সাথে গল্প করতে তার ঘরে যাচ্ছিল, তখনই নেহালের ওর জন্য উপহার আনার কথাটা এবং তাদের কথোপকথনের অনেকটা শুনতে পায়।
এমন আশঙ্কা নিয়ে উপহারটা ওর হাতে কী করে দেয়, সেটা দেখার জন্য ভেতরের প্রবল কৌতূহল সে উপেক্ষা করতে পারে না। নিজের ঘরে এসে বিছানায় নির্বিকার মুখে বসে রইল। নেহাল যখন টেবিলে সেটা রেখে ফ্রেশ হতে গেল, তখন সে শাড়িটা দেখেও ফেলেছে।
নেহালের চিন্তাক্লিষ্ট মুখের সাথে, ওর জন্য উপহার কেনার উত্তেজনা উপভোগ করছিল লিলি ভীষণভাবে। এরপর সেই বোকাবোকা কাণ্ড। নিজের এতক্ষণের করা কাজের কোনো ব্যাখ্যা সে এখন অব্দি খুঁজতে যায়নি। এটাকে আসলে আলাদা করে ভাবার বিষয় বলেও মনে হয়নি। খুব দৈনন্দিন কিছুই যেন মনে হচ্ছিল। কিন্তু এখন হুট করে মনে হলো, নেহালের কাছ থেকে উপহার পাবার একটা উত্তেজনা সে ভেতরে ভেতরে অনুভব করছে, যা নিছকই মজা পাবার জন্য নয়!
নেহালের আজকের কাণ্ডে ওর যতই মজা লাগুক সে অস্থির হয়ে উঠছে কখন সে শাড়িটা হাতে পাবে। অথচ শাড়ি পরা নিয়ে ওর আলাদা করে কোনো ফ্যান্টাসি নেই একেবারেই। জীবনে প্রথমবার ওর হৃদযন্ত্র যেন ঝনঝনিয়ে বেজে উঠে কিছু একটা জানান দিতে চাইল। লিলি জেনেও গেল, কিন্তু ধরা দিল না!
এত সহজে ধরা দিলে যদি সহজলভ্য ভেবে বসে নেহাল? লিলি নিজের সাথে যুদ্ধ করে নিজেকে ধাতস্থ করল। এরপর স্বভাবসুলভ চপলতা ফুটিয়ে সে বলল,
“শুনেছিলাম প্রেমে পড়লে মানুষ বোকা হয়। আপনি বিয়ে করে বোকা হয়ে গেছেন? নাকি আজন্মই এমন?”
“আমি মোটেও বোকা নই!”
“আপনার সাহস দেখে অবাক হলাম৷ আপনি আমাকে বিপজ্জনক বলেছেন।”
“তুমি নিজেই তো বললে একটু আগে।”
“আমি নিজেকে যা খুশি বলতেই পারি। আপনি কেন বলবেন?”
“তুমিও তো আমাকে বোকা বললে।”
“ও আচ্ছা, হ্যাঁ তাই তো বলেছি। তাই না? ভুল বলেছি তাহলে। পাগলকে যেমন পাগল বলতে হয় না, তেমনি বুদ্ধুকেও বুদ্ধু বলাটা অন্যায়। ভারি অন্যায়। এবার বলুন কীভাবে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে?”
“আবারও বুদ্ধু বললে কিন্তু।”
“সবসময় বলব। যে যা তাকে তাই বলতে পিছপা হই না আমি।”
“ঠিক আছে, বলে যদি শান্তি পাও তাই বলো।”
“এখন আর বলব না। ইচ্ছা করছে না।” নেহালের সামনে এসে দাঁড়িয়ে লিলি আবার বলল,
“তা কী উপহার দিতে চান যার জন্য গুগুল মামার হেল্প লাগবে? দেয়ার হলে এক্ষুণি দিন।”
নেহাল শপিং ব্যাগটা এনে লিলির দিকে বাড়িয়ে দিল। লিলি সেটা না নিয়ে বলল, “কী আছে এতে? খুলে উপহার বের করে হাতে দিন।”
নেহাল তাই করল। একটা টকটকে শাড়ি লিলির দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বলল, “শাড়িটা তোমার জন্য পছন্দ করেছি। তোমার পছন্দ হবে কিনা সেটা বুঝতে পারছি না। যদি ভালো না লাগে, না পরতে চাও, তবুও রেখে দিও। আমি প্রথমবার তোমার জন্য কিছু কিনলাম।”
লিলি আজও কিছু কথা বলতে যাচ্ছিল যাতে নেহালকে কষ্ট দেয়া যায়৷ কিন্তু মন থেকে কিছুতেই সাড়া পেল না। ছেলেটার গলার কাতর আকুতিতে সব যেন উল্টেপাল্টে গেল ওর।
লিলি শাড়িটার ভাজ খুলে হাত দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে দেখতে সত্যি কথাই বলল,
“শাড়িটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আমি যদিও শাড়ি তেমন একটা পরি না, কিন্তু সামনের কোনো একটা বিশেষ দিনে এটা অবশ্যই পরব। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।”
নেহাল আকর্ণ হাসল, লিলি খেয়াল করল ছেলেটাকে হাসলে চমৎকার দেখায়। সরল, সহজ, সুন্দর হাসি। এমন হাসি দেখলে মন ভালো হয়ে যায়।
লিলির মাথায় আরেকবার দুষ্টুমি এসে ভিড় করল, কেন যেন নেহালকে অপ্রস্তুত করতে সে ভীষণ মজা পায়।
“হৃদয় ঘটিত ব্যাপার স্যাপারের সমাধান স্বয়ং বিজ্ঞান যেখানে দিতে পারেনি, সেখানে আপনি গুগল থেকে তার সমাধান খুঁজতে চান? আমি টিপস দেই, হৃদয়ের কথা হৃদয়কেই জিজ্ঞেস করুন, সমাধান পেয়ে যাবেন৷ জায়গায় অজাগায় এসব প্রশ্ন করলে গ্যাঁড়াকলে আরও ফাঁসবেন। কোথায় কীসের সল্যুশন খুঁজতে হয় এই সেন্স গ্রো করুন নিজের মধ্যে।”
“তোমার অনেক এক্সপেরিয়েন্স আছে মনে হচ্ছে? হৃদয় ঘটিত ব্যাপারের বিশেষজ্ঞ নাকি?”
“এক্সপেরিয়েন্স লাগে না, সেন্স দরকার। সেদিক থেকে আমি অবশ্যই বিশেষজ্ঞ, আপনার মতো বিশেষ অজ্ঞ নই, বুঝলেন?”
“তাহলে বুঝে নাও।” নেহালের ইঙ্গিত বুঝতে লিলির সময় লাগল না। তবুও সে উত্তর দিল,
“সব কথা বুঝে নিতে নেই। মুখে বলবেন, ভেবে দেখব।”
“বলতেই হবে?”
“হ্যাঁ, হবে। তবে এখন আমার পড়া আছে৷ পড়তে বসব।” হঠাৎ করেই যেন পড়তে বসার তাড়া দেখা গেল সারাজীবন পড়াশোনাকে ফাঁকি দিয়ে আসা লিলর মধ্যে।
“তোমাকে কখনো পড়তে বসতে দেখিনি।”
“যা ঘটেনি তা কী করে দেখবেন? আপনি তো মানুষের বাইরের কিছু নন। সিম্পল, পড়িনি, তাই দেখেননি। আজ দেখবেন। আমার সেমিস্টার ফাইনাল শুরু হচ্ছে এই সপ্তাহ থেকেই।” লিলি আজ একই কথাই যেন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলছে, ওর স্বভাবসুলভ ফুলঝুরি খুঁজে পাচ্ছে না।
নেহাল প্রশ্ন করল, “সে কী! তাহলে এতদিন পড়লে না কেন?”
“আমি অনেক ব্রিলিয়ান্ট তো৷ তাই পরীক্ষার আগে পড়লেই হয়। সারাবছর বইতে মুখ গুঁজে রাখতে হয় না।”
“তোমার কনফিডেন্স লেভেল তো অসাধারণ বলে মনে হচ্ছে।”
“আমি অলওয়েজ কনফিডেন্ট।”
লিলি কথাটা বলেই টেবিলে গিয়ে তাড়াহুড়ো করে বসল, সে এখনই নেহালের কাছ থেকে চূড়ান্ত কিছু শোনার জন্য প্রস্তুত নয়। সে বুঝতে পারছে এবার একবার শুনে ফেললে সে ফেরাতে পারবে না৷ তাই তেমন পরিস্থিতি এড়াতেই নিরাপদ পন্থা হিসেবে পড়ার অযুহাত বেছে নিল।
নেহাল পেছন থেকে ডাকল, “লিলি?”
লিলি ঘুরে নেহালের দিকে তাকাতে সে বলল, “গুড লাক।”
লিলি একটা বই সামনে নিয়ে পাতা উল্টাতে শুরু করল। মুখে ফুটে উঠল এক চিলতে হাসি।
***
রিয়াদ, নওরীন আর নেহাল এসেছে পুষ্পিতার বাড়িতে। ওর নানি আজ আসতে বলেছিলেন, পুষ্পিতার বাবা আসবে বলে। রোমেনা আর আশফাকও আসতেন, কিন্তু হঠাৎ করে আশফাকের শরীরটা খারাপ লাগছিল বলে তারা আসতে পারেননি।
লোকটার কথাবার্তা আর আচরণ দেখেই ওদের বিরক্ত লাগছিল।
“দেখেন, আমি একটা ট্রাস্টের সাথে কথা ফাইনাল করে ফেলসি। তাই এখন আবার আপনাদের কীভাবে কী করব।”
“দেখুন, আমাদের কাছে থাকলে আপনার মেয়ে ভালো কেয়ার পাবে, ভালো পরিবেশ পাবে বেড়ে উঠার জন্য।” রিয়াদ বলল।
“সেটা তো বুঝলাম। আমার দুই লাখ টাকা লাগবে। দিলে ওদের সাথে কথা কইতে পারি।”
নেহাল রেগে গিয়ে বলল, “টাকা আমরা এমনিতেই আপনাকে দিতাম৷ কিন্তু নিজের মেয়েকে নিয়ে টাকা নিয়ে এমন দরদাম করতে আপনার লজ্জা লাগছে না?”
“না, আপনারা আমার মেয়েরে নিবেন। আপনাদের সন্তানের অভাব। আমার অভাব টাকার। সন্তান মাশাল্লাহ আমার আরও দুইটা আছে। যার যেইটার অভাব, সে সেইটার মর্ম বুঝে। আপনেরা যেমন বাচ্চার জন্য এমন উতলা হইসেন, কারণ আপনাদের সেই ক্ষমতা নাই। আমার এত টাকা উপার্জনের ক্ষমতা নাই, তাই আমি টাকার জন্য উতলা। এইটা সহজ হিসাব।”
উপস্থিত সকলের গা ঘিনঘিন করে উঠল উত্তর শুনে। শেষের কথা শুনে নওরীনের কান্না পাচ্ছিল, কিন্তু এমন লোভী, জঘন্য লোকের কথা গুরুত্ব দিতে নেই ভাবতেই মনটা শক্ত হয়ে এলো।
পুষ্পিতা ফ্যালফ্যাল করে সবার কথা শুনছে। কতটা বুঝতে পারছে কেউ জানে না। যদি বুঝতে নাও পারে, আরেকটু বড় হলেই এসব ধরতে পারবে। তখন কতটা হীনমন্যতা গ্রাস করবে মেয়েটাকে ভাবতেই কষ্ট হলো ওদের। নানি আঁচল চেপে কাঁদছেন ফুঁপিয়ে।
“আমরা টাকা দেব, কিন্তু আপনাকে একটা স্ট্যাম্পে সই করতে হবে যে আর কোনোদিন কোনো অবস্থায় মেয়ের সাথে দেখা করতে যেতে পারবেন না কিংবা কোনো প্রকার দাবী রাখতে পারবেন না।” নেহাল সরোষে প্রস্তাব দিলো।
এমন কোনো পরিকল্পনা ওদের ছিল না লিখেপড়ে নেবার। কিন্তু লোকটা পরবর্তী সময়ে ঝামেলা করতে পারে ভেবে নেহাল তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিল।
“আপত্তির কিছু নাই তো। তবে এহন মনে হইতাসে, টাকার অঙ্ক আরেকটু বাড়াইয়ে চাইলে ভালো হইত। কী আর করার, সুযোগ হারাইলাম।”
এসব কথার উত্তর কেউ দিল না। নেহালের এক বন্ধু আছে উকিল। তাকে নিয়ে এসে সব সেই সাবুদ করে সমস্ত টাকা পরিশোধ করা হলো। চেক নিয়ে পুষ্পিতার বাবা চলে গেল। নেহালের মনে হলো মানুষের খোলসে আদ্যোপান্ত এক পশু যেন হেঁটে যাচ্ছে।
নওরীন পুষ্পিতাকে বুকে জড়িয়ে নিল।
“ম্যাডাম, মা নাকি আর আসবে না। আমি কার কাছে থাকব?”
“আমাকে মা বলে ডাকতে পারবি না? আমার সাথে থাকবি তো এখন?”
পুষ্পিতা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “মা।”
নওরীন ওকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিল। অপূর্ণতার মেঘ যেন ধীরে ধীরে সূর্যের আলোয় হারিয়ে যাচ্ছে। অদ্ভুত এক তৃপ্তিময় সুখ ওকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কত অশ্রুসিক্ত অপেক্ষা পেরিয়ে সেও মা হলো অবশেষে।
পাশের চেয়ারে বসে রিয়াদ নিজের চোখ মুছল, বহুদিন নওরীনকে এমন তৃপ্ত দেখেনি সে। আজ ভালো লাগছে তারও।
নেহালের চোখও আর্দ্র হয়ে এলো। তবুও সেভাবেই সে হাসল। বোনকে সে কতটা ভালোবাসে এটা তো ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এমন একটা প্রাপ্তির দিনে সুখে যদি কয়েক ফোঁটা জল গড়ায় তো মন্দ কী!
সম্পর্ক তো শুধু রক্তের হয় না, আত্মার যোগাযোগ লাগে, ভালোবাসার আদানপ্রদান লাগে। তবেই না সম্পর্ক সম্পর্ক হয়ে উঠে!
একটা সন্তানহীন মা, আরেকজন সদ্য মাতৃহারা সন্তান যেন সমস্ত সীমারেখা ভেদ করে সত্যিকারের মা-মেয়ে হয়ে উঠতে পারে, দু’জনের অপূর্ণতা যেন মিলেমিশে পূর্ণতায় ভরে উঠে। সেই প্রার্থনা করল নেহাল।
***
লিলি ইউনিভার্সিটি থেকে ক্লাস শেষ করে বাসায় ফিরল একটা ছোট্ট অঘটন ঘটিয়ে। গেটের সামনে রিকশা থেকে নেমে হাঁটতে গিয়ে পড়ে থাকা একটা ইটে বেখেয়ালে পা দিয়েছিল। তাতেই উল্টে পড়ে পা মচকে গেল। রোমেনা অস্থির হয়ে ওকে নিয়ে এক্সরে করাতে গেলেন। দেখা গেল ভাঙেনি, তবে মচকেছে ভালো মতন। পা ফুলে গেছে অনেকটা।
ওকে শুইয়ে দিয়ে তৌহিদাকে কল দিলেন। পুষ্পিতাকে নিয়ে নওরীনরা এখানেই প্রথমে এলো। প্রায় সাথে সাথে তৌহিদাও এলেন। তিনি এসেই মেয়ের ঘরে গেলেন।
“তোর এই বাজে অভ্যাস এখনো গেল না! আর কবে সাবধান হবি বল তো? নিজের প্রতি একটু খেয়াল রাখা এখনো শিখলি না।”
“এতদিন তো তুমি এসবের খেয়াল রাখতে আম্মু। এখন তো তুমি থাকো না। আমাকে এত তাড়াতাড়ি দূরের মানুষ করে দিলে। হয়তো শিখে ফেলব আস্তে আস্তে। কত কিছু শিখছি, এটাও শিখব।”
তৌহিদা থমকে গিয়ে কিছুক্ষণ মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন৷ পায়ে হাত দিয়ে জায়গাটা দেখলেন পরম মমতায়।
তার প্রতি লিলির অভিমান কেন এতটা গাঢ় হলো! এই ভাবনা তাকে এতটা যন্ত্রণা দেয়, যা তিনি আর সইতে পারছেন না। অসহনীয় ব্যথায় ভেতরটায় যেন নীল নীল প্রলেপ জমে গেছে।
……..
(ক্রমশ)
শব্দসংখ্যা – ১৫০০+