#মাইনাসে_মাইনাসে_প্লাস (পর্ব ১৩)
নুসরাত জাহান লিজা
কফিশপে মুখোমুখি বসেছে লিলি আর নওরীন। সেদিনের কথা দুজনের কেউই আর তুলল না। তাদের পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে আড্ডা জমে উঠল। যদিও সময় অল্প।
“তোর প্রিয় রঙ লাল, ওদিকে নেহালেরও লাল রঙ প্রিয়।”
“ছেলেদের লাল ভালো লাগে না বলেই জানতাম?”
“কী জানি! নেহাল বলে, লাল রঙের সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক আছে, রক্তের রঙও তো লাল! ছোটবেলায় একবার একটা বিয়েতে গিয়ে তো যা তা অবস্থা! কী কাণ্ডটাই না করেছিল।”
লিলি কৌতূহলী গলায় জিজ্ঞেস করল, “কী কাণ্ড?”
“তখন ওর বয়স সাত কী আট। বিয়ের কণে লাল টুকটুকে শাড়ি পরা। সে জেদ ধরেছিল বিয়ে করার৷ তাহলে ওরও ওমন লাল টুকটুকে একটা বউ হবে! অনেক বুঝিয়ে টুঝিয়ে ক্ষান্ত করা গেছে। একটু বড় হলে এটা নিয়ে ক্ষ্যাপাতাম ওকে। কখনো তেড়ে আসত, কখনো লজ্জায় লাল হয়ে যেত। এখনো এই কাহিনী নেহালকে মনে করিয়ে দিলে লজ্জা পায়।” নওরীন হাসতে হাসতে নেহালের হাঁড়ির খবর ফাঁস করে দিল।
লিলির মন খারাপের মেঘ ধীরে ধীরে কাটছিল কথা বলতে বলতে।
“আপু, তোমার তো আবার ক্লাস আছে। আমিও আম্মুর সাথে দেখা করতে যাব একটু।”
“তুই আজ আমার বাসায় যাবি। আরেকটা ক্লাস আছে। শেষ করেই বেরুব।”
“না আপু। আজ নয়। অন্য একদিন, একা একা না যাই।”
“নেহাল সাথে নেই বলে? ওকে ফোন করে দিলে অফিস থেকে সরাসরি আমার ওখানে চলে যাবে।”
“আপু, আজ প্রিপারেশন নেই।”
নওরী হয়তো আরও জোর করত, কিন্তু লিলি দিকটা বুঝতে পেরে বলল, “ঠিক আছে, আজ যা। পরে কিন্তু কোনো কথা শুনব না।”
“পরে আমি নিজেই বারবার যাব। তুমি বিরক্ত হয়ে যাবে তখন।”
“মোটেও না। তোর সাথে কথা বলতে কখনো বিরক্ত হব না।”
একটু থেমে নওরীন প্রশ্ন করল, “আমার ভাইকে কেমন দেখলি রে? কী মনে হলো এই কয়দিনে?”
লিলি অন্যমনস্ক হয়ে গেল, নেহালকে সে সত্যিই এখন অব্দি দেখেছে তো! মানুষটার সম্পর্কে তেমন কিছুই তো সে জানে না। আবার নওরীনের মন রক্ষার জন্য সে মিথ্যে করে প্রসংশাও করতে পারছে না। এসব ওর ধাতে নেই। নওরীন হয়তো লিলির দোলাচল উপলব্ধি করতে পারল।
হাসিমুখে বিদায় নিল পরস্পরের কাছ থেকে।
***
নেহালের মনে পৃথিবীর সবটুকু অনুশোচনা এসে যেন আজ ভর করেছে। নিজের সীমাবদ্ধতা ভুলে লিলির দিকে অবচেতনেই দুই পা এগিয়ে গিয়েছিল বলে বিষাদটুকুও আজ বড্ড পোড়াচ্ছে।
কাজের প্রতি অত্যন্ত সচেতন নেহাল আজ বারবার মনোযোগ থেকে বিচ্যুত হচ্ছিল। লিলির কথাগুলো শেলের মতো ওর হৃদপিণ্ডে এসে আঘাত হানছিল। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হবার ব্যথা সে এই প্রথম অনুভব করল। কী ভীষণ ব্যাথা।
যে দুই পা সে এগিয়েছিল, সে মনকে কড়া শাসনে বেঁধে চার পা পিছিয়ে এলো।
“কী ব্যাপার নেহাল সাহেব, নতুন বিয়ে করেছেন। এখন তো হাসিখুশি থাকার কথা। তা মন মরা কেন?”
আতিক সাহেব মধ্যবয়সী মানুষ। তবে লোকটাকে নেহালের একেবারেই পছন্দ নয়। অন্যের পেছনে নানারকম কথা বলে বেড়ানো এই লোকের কাজ। ওর কাছে কখনো তেমন পাত্তা পায় না। আজও অল্পে এড়িয়ে যাবার পায়তারা করে বলল,
“কাজের চাপটা বেশি পরে যাচ্ছে তাই।”
“ভাবিকে সময় কম দিচ্ছেন বলে নিশ্চয়ই অভিযোগ করছে? তাই আপনার মন খারাপ বুঝতে পারছি। নতুন নতুন বিয়ের পরে সবাই রোমান্টিসিজমের ঘোরে থাকে। দুই একটা বাচ্চা কাচ্চা হয়ে গেলে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে যাবে। তখন আপনি আবার ফ্রি-বার্ড হয়ে যেতে পারবেন। সে খোঁজও নেবে না।”
লোকটার এই অযাচিত কথাবার্তায় ভারি বিরক্ত হলো নেহাল। কিন্তু মুখের উপরে কটু কথা বলতে ওর ভীষণ বাধোবাধো লাগে। লিলির কাছ থেকে বিষয়টা রপ্ত করতে পারলে একটা কাজের কাজ হতো। কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয়। মেয়েটা ওকে সহ্যই করতে পারছে না।
শুকনো মুখে নেহাল বলল, “আতিক ভাই, আমার মন খারাপ না। আপনার কনসার্নের জন্য ধন্যবাদ।”
লোকটা আরেকবার কিছু বলতেই যাচ্ছিল, বাঁচিয়ে দিল আরেক কলিগ। সে বসের চেম্বার থেকে বেরিয়ে এদিকে এসে বলল,
“নেহাল ভাই, স্যার আপনাকে দেখা করতে বললেন।”
নেহাল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে উঠে সেদিকে চলে গেল। সবার সাথে ব্যক্তিগত কথাবার্তা বলতে ওর ভারি অনীহা। সে কতবার বুঝিয়ে দেয়, তবুও বোঝে না লোকটা নাকি না বুঝতে পেরেও বিরক্ত করে মজা পায়! কে জানে কোন মানুষের কেমন প্রকৃতি!
***
তৌহিদা কিছু পড়ার সময় আর সেলাই ফোড়াই করলে কেবল চশমা পরেন। প্রায় দুই বছর থেকে চম্পা তার কাজে সাহায্য করে। লিলির বিয়ের পর থেকে তার সাথেই থাকছে।
স্বামী আরেকটা বিয়ে করেছে, ওর সাথে বনিবনা হয় না, তিনি প্রস্তাব দিতেই লুফে নিয়েছে৷ একটু কথা বেশি বলে, কিন্তু সময় কেটে যায়।
তার আজ সকাল থেকেই মন বলছিল লিলি হয়তো আজ আসতে পারে। গত কিছুদিন থেকে তার রান্না করতে একদমই ইচ্ছে করে না। চম্পা যা রান্না করে তাই খেয়ে নেন।
আজ বেশকয়েকদিন পরে তিনি নিজে রান্নাঘরে এলেন। লিলির খুব পছন্দের কিছু খাবার রান্না করলেন। রান্না যখন প্রায় শেষের দিকে তখন কলিং বেল বাজল।
দরজা খুলে লিলিকে দেখে তিনি একদমই আশ্চর্য হলেন না, খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে মেয়ের হাত ধরে ভেতরে নিয়ে এলেন। লিলির মনে হলো রোমেনার সাথে কথা হয়েছে কিনা।
“তুমি জানতে?”
“হঠাৎ করে কেন যেন মনে হলো আজ তুই আসবি। রোমেনাকে ফোন করে জানতে ইচ্ছে হলো না। নিজের মনে আসা অনুভূতিটা ঠিক কিনা দেখতে ইচ্ছে হলো।”
“খাবারের গন্ধে তো বাড়ি একেবারে ভরে গেছে!”
“তোর জন্য করেছি। তুই না এলে পাঠিয়ে দিতাম।”
লিলি মাকে গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে কয়েক মুহূর্ত স্থির দাঁড়িয়ে রইল। মা মেয়েতে এটা-সেটা গল্প হলো।
খাবার সময় তৌহিদা নিজের হাতে লিলিকে যত্ন করে খাইয়ে দিলেন। লিলি তার শরীরের খোঁজ নিল, ওষুধ ঠিকঠাক চলছে কিনা চেক করল।
এরপর হুট করে বলল, “এখন যাই আম্মু।”
“সে কী! আজ থেকে যা।”
“সন্ধ্যায় ফিরব বলে এসেছি।”
“আমি রোমেনাকে বলে দিচ্ছি।”
লিলি ম্লান হাসল, এরপর খুব কঠিন গলায় বলল, “তুমি নিজেই আমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছ। আমিও তোমার কথামতো চলে গিয়েছি। এখন মায়াকান্না কীসের এত তোমার? আপদ বিদায় হয়েছে, শান্তি এবার তোমার।”
লিলি আর দাঁড়ালো না৷ নিজের ঘরে একবার উঁকি দিয়েই বেরিয়ে গেল বাইরে। তৌহিদার চোখ ভিজে যাচ্ছে। লিলি আজ আসার পর থেকেই বড্ড বেশি স্বাভাবিক আচরণ করছিল, এটাই তার কাছে অস্বাভাবিক ঠেকছিল।
শেষবেলায় এসে স্পষ্ট হলো কারণটা। লিলির আগে রাগ হলে চিৎকার চেঁচামেচি করত, ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকত, মাথা ঠান্ডা হলে এসে তার কোলে আশ্রয় খুঁজে নিত। কিন্তু এবার মেয়েটা ভেতরের রাগ বাইরে আনেনি। তাই বোধহয় ভেতরে ভেতরে দানা বাঁধছে সবটা।
তিনি সবসময় চেয়েছেন লিলি একটু ঘরমুখো হোক, উড়নচণ্ডীপনা কমুক। কিন্তু এভাবে নিজের সত্তাকে মে রে ফেলুক সেটা তিনি কোনোদিন চাননি।
অভিমানের গাঢ় চাদরে নিজেকে আবৃত করে নিয়েছে লিলি, তিনি কী আর কোনোদিন সে চাদর ভেদ করে মেয়ের অন্তরে আরেকবার প্রবেশ করতে পারবেন! কত সময় লাগবে, এত সময় কী তার আছে! আশঙ্কায় দম বন্ধ হয়ে আসে তৌহিদার, বুক ভারি হয়ে আসে গভীর দুঃখী এক দীর্ঘশ্বাসে।
………..
(ক্রমশ)
#মাইনাসে_মাইনাসে_প্লাস (পর্ব ১৪.১)
নুসরাত জাহান লিজা
আজ বেশ অনেকদিন পরে লিলি ইউনিভার্সিটিতে এসেছে। তরীদেরও জানায়নি আসার ব্যাপারটা। পরশু মা আর নেহালের সাথে নিজের মেজাজের ঝাল উগরানোর পর থেকে অস্বস্তি বাড়ছিল। দু’জনের কারোর সাথেই এরপর আর একটা কথাও বলেনি এখন অব্দি।
রোমেনা খুব উৎসাহ দিলেন ক্লাস শুরুর ব্যাপারে। ওরও মনে হলো, পরিচিত পরিবেশে এলে হয়তো গোমট মন খানিকটা হলেও হালকা হতে পারে৷
ক্লাস শুরু হতে তখনও সাত মিনিট বাকি৷ কয়েকটা আলাদা আলা জটলা পাকিয়ে আড্ডা জমেছে। লিলির মনে হলো এর আগে শেষ যেদিন এসেছিল, সেদিন ওর জীবনটা অন্যরকম ছিল৷ মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানেই মনে হলো সে অন্য মানুষ। আগের লিলির সাথে এই লিলির দূরত্ব যেন কয়েক আলোকবর্ষ। জীবন কতটা আনপ্রেডিক্টেবল! চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেল সে।
তরীই প্রথম দেখল ওকে, সে সোল্লাসে চিৎকার করে উঠল লিলির নাম ধরে। সবগুলো জটলা মুহূর্তের জন্য থমকে ওর দিকে ঘুরে তাকালো। তরী আর মিতুর সাথে আরও কয়েকজন এসে ওকে আলিঙ্গন করল। বাকিদের মধ্যেও অনেকেই এসে কথাবার্তা বলল।
নতুন জীবন, বর কেমন, শ্বশুর বাড়ি আর তার মানুষজন কেমন, বরের সাথে ভাব কতটা নানারকম কৌতূহলী প্রশ্ন ছুঁড়ে এলো ওর দিকে। লিলির সবার কৌতূহল মেটানোর দায় নিয়ে বসেনি নিশ্চয়ই। ভীষণ বিরক্ত লাগছিল। তবে আজ সে নিজের স্বভাব বহির্ভূত ধৈর্যের পরিচয় দিল।
মিষ্টি হেসে সবাইকে আস্বস্ত করে বলল, “এত প্রশ্ন করিস না তোরা? আরও কারও প্রশ্ন করার থাকলে করে ফেল। একসাথে সবার উত্তর দেই৷ কারণ এখন যতগুলো প্রশ্ন করলি, সবগুলোর উত্তর পজিটিভ।”
বাকি কথা বলার আগেই ক্লাসের সময় চলে এলো। আজকের প্রথম ক্লাসটাই সাদেক স্যারের। তার মতো বোরিং ক্লাস লিলি আজ অব্দি কোনোদিন করেনি। প্রথম ক্লাসেই বেশ কয়েকবার হাই তুলল সে। অন্যসময় এই ক্লাসে সময় কাটানোর জন্য ওরা তিনজন কাটাকুটি খেলত। স্যারের চোখ এড়িয়ে খাতায় একটা করে দাগ কাটত। আজ ইচ্ছে হলো না।
লিলি অন্যমনস্ক হয়ে গেল, মা’য়ের সকরুণ মুখটা মনে পড়তেই ভেতরটা হুহু করে উঠল। রাগ ভুলে বারবার ইচ্ছে করে মায়ের মমতামাখা বুকে একটু মাথাটা রাখতে। কিন্তু কোথাও একটা অদৃশ্য দেয়াল ওর পথরোধ করছে বারংবার।
***
নেহালের ফ্রেন্ড সার্কেলের সবাই এখন বিবাহিত। সে-ই কেবল বাকি ছিল, অন্যরা আরও আগে এই কাজ শেষ করেছে। সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে যারযার নিজের জীবন পরিক্রমায়। তবুও শত ব্যস্ততার মধ্যেও মাসের একটা দিন ওরা একসাথে আড্ডা দেয়। দুজন ঢাকার বাইরে থাকে কর্মসূত্রে, একজন দেশের বাইরে। বাকিরা সকলেই এই আড্ডার নিয়মিত অংশ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়কার মতো লাগামহীন কথার তুবড়ি ছুটে কখনো, আবার কখনো পরিস্থিতি হয়ে উঠে বিতর্ক মঞ্চ তো কখনো ভারিক্কি।
“এখন তাহলে আমরা সকলেই বিবাহিত জনগোষ্ঠীর সামিল। ওয়েলকাম টু দ্য ক্লাব দোস্ত।”
নাটকীয় ঢঙে বলল আসিফ। ওদের সার্কেলের সবচাইতে বাকপটু মানুষ। আটজনের এই দলটার সকলেই হৈ হৈ করে উঠল। এবারের আড্ডা হচ্ছে রাতুলের বাসায়।
“আমি তো ভাবছিলাম তুই সন্ন্যাসব্রত পালন করবি সারাজীবন। অবশেষে সুমতি হইল।”
“তা এই সন্নাসীর ধ্যান ভাঙালো কে? আমাদের লিলি ভাবি।”
এবার আরেকবার রৈ রৈ রব উঠল।
“তোরা একেবারে যাচ্ছেতাই।” নেহাল হাসতে হাসতে বলল।
“এসব বলে পার পাবি না ব্যাটা। আজকের সমস্ত খরচা তোর পকেট থেকে যাবে।”
“বিয়েও করলাম আমি, বিয়ের দাওয়াতও দিয়েছিলাম, এখন আবার আলাদা করে আমাকেই খরচ করতে হবে? বরং আমাকে আজকে তোদের ট্রিট দেয়া উচিত ছিল সবার। আমি বিয়ে না করলে তোদের এই ম্যারিড ক্লাব অপূর্ণ থেকে যেত।”
“এসব কিপ্টামি ছাড় শালা, এখন তো তোর পকেট কা”টা”র দিন।”
অন্তু একটা সিগারেট এগিয়ে দিয়ে বলল, “চলবে নাকি?”
নেহাল বলল, “না রে৷ আমার পোষায় না ঠিক এগুলা।”
ওদিক থেকে রাতুল বলল, “আরে লিলির ভিডিওগুলা দারুন হয়। আমার বউ তো নিয়মিত দেখে।”
“কীসের ভিডিও?” নেহাল বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করে।
“কীসের মানে? লিলির কথা বললাম।”
“সেটাই তো জিজ্ঞেস করলাম। কীসের?”
“আরে ব্যাটা, তুই তো এখনো হাফ সন্ন্যাসী রে। বউ সম্পর্কে কিছুই জানিস না। ইউটিউবে ঢুকে বন্ধুতা লিখে সার্চ কর।”
নেহাল ভেতরে ভেতরে আগ্রহী হলেও প্রথমে তা বাইরে দেখালো না। নিতান্ত অনিচ্ছায় এমন ভঙ্গিতে নিজের ফোন বের করে ইউটিউবে এসে ‘বন্ধুতা’ লিখে সার্চ করল। উপরে আরও কিছু অন্যান্য ভিডিওর সাথে এই চ্যানেলের একটা ভিডিও এসেছে। উপরে তিনটা মেয়ের হাস্যোজ্জ্বল মুখের ছবি। লিলির মুখে ওর চোখ আটকে গেল।
আনমনেই ভিডিওটা ওপেন করল। ধীরলয়ের মিউজিকের সাথে লিলির কথা যেন কলকলিয়ে উঠল নেহালের কানে। ভীষণ চপলতা ভরা উচ্ছ্বাস নিয়ে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে। কোনো একটা দীঘির ধারে বানানো ভিডিও। বাকি দুজনও যোগ্য সঙ্গ দিচ্ছে এখানে।
“কী রে, মামা, বউকে তো চোখের সামনেই দেখিস। এখন আমাদের সময় দে। ভিডিও দেখে মজনু হলেও আমাদের ট্রিট দেয়া থেকে বাঁচতে পারবি না কিন্তু।”
নেহাল অস্ফুটস্বরে বলল, “সামনে থাকলেও এভাবে কোনোদিন দেখিনি তো।”
কেউ শুনতে পেল না ওর কথা, “কী বলিস বিরবির করে?”
“ট্রিট অবশ্যই পাবি। আমি কিন্তু কিপ্টা না তোদের মতো।”
“হ্যাহ্! তুই কৃপণের দাদা।”
“তুই জানতি না ভিডিওর কথা?”
রাতুলের প্রশ্নের কোনো উত্তর দেয় না নেহাল। লিলির সম্পর্কে সে তো কিছুই জানে না তেমন।
হুট করে মেয়েটাকে জানতে ইচ্ছে হলো ওর। ওই মনের গভীরতায় ডুবে সেখানে কী আছে তার প্রতিটি অলিগলিতে বিচরণ করার একটা তৃষ্ণাবোধ ওকে পেয়ে বসল।
(ক্রমশ)
#মাইনাসে_মাইনাসে_প্লাস (পর্ব ১৪.২)
নুসরাত জাহান লিজা
লিলিকে রোমেনা পুরোনো এ্যালবাম বের করে দিয়েছেন। স্মৃতি রোমন্থন চলছিল। একটা ছবিতে লিলির চোখ আটকে গেল।
ছবিটা বারো-তেরো বছরের ভীষণ মিষ্টি দেখতে একটা ছেলের, ছেলেটার চোখে কান্নার ছাপ স্পষ্ট, কিন্তু বহু কষ্টে সেটা চেপে রেখেছে বোঝাই যাচ্ছে, যদিও চেষ্টা বৃথা গেছে। এই কান্নামাখা মুখটায় অদ্ভুত মায়া জমে আছে যেন। ভঙ্গিটা লিলির খুব পরিচিত মনে হলো। সে রোমেনাকে জিজ্ঞেস করল,
“মা, এটা কার ছবি?”
“কোনটা? এদিকে দেখা দেখি।”
লিলি হাতের এ্যালবামটাকে তার দিকে বাড়িয়ে ধরল।
“এটা তোর বর।”
এভাবে সরাসরি বলায় লিলি কিছুটা যেন অপ্রতিভ হলো। কিঞ্চিৎ লজ্জাও পেল যেন। যদিও সে স্বীকার করতে চাইল না।
“ছবিটা দেখে মনে পড়ল, নওরীনের সাথে কিছু একটা নিয়ে ঝগড়া লেগেছিল। হেরে গিয়ে এভাবে বসে ছিল। আশফাকের ছবি তোলার শখ ছিল বলে ক্যামেরা ছিল বাসায়। নওরীনও দুষ্টুমি করে তুলতে এসেছিল ছবি। নেহাল সেটা বুঝতে পেরে আপ্রাণ চেষ্টা করেছে যেন কান্নাকাটি ক্যামেরায় না আসে। ছবি তোলার পরে কেন তুলল, সেটা নিয়েও আরেক প্রস্থ হয়ে গিয়েছিল দুটোতে।”
হাসতে হাসতে বললেন রোমেনা। ওর কটু কথা সহ্য করার সময়ও এইরকম অভিব্যক্তি দেখেছিল ছেলেটার চোখেমুখে।
লিলির সহসা মনে বলো ওর একটা ভাই কিংবা বোন থাকলে বোধহয় আরও ভালো হতো। নওরীন আর নেহালের মধ্যে চমৎকার বোঝাপড়ার সাথে খুঁনসুটিতে মাখা যে সম্পর্ক, এটা ওর ভীষণ ভালো লেগেছে। নেহালকে হিংসে হলো, লোকটার কী দারুণ ভাগ্য।
“নেহালটা খুব চাপা স্বভাবের। খুব ছোট্ট যখন ছিল, তখনই যেটুকু দুষ্টুমি করেছে। যত বুঝতে শিখেছে তত শান্ত হয়ে গেছে। আমাকে যারা চেনে তারা বলে, ‘তোর মুখে কথার খই ফুটে, ছেলে অমন লক্ষ্মীমন্ত কী করে হলো?'”
“তুমি উত্তর দাও না?”
“উত্তর না দিয়ে আমি থাকতে পারি নাকি! মজা করে বলি, ‘কুড়িয়ে যে পাইনি কনফার্ম। এতগুলো মাস পেটে ধরেছি। তবে আমি এত বেশি কথা বলেছি যে ছেলের ভাগের কথাসহ বলে ফেলেছি। তাই ওমন।”
“নওরীন আপু কেমন ছিল ছেলেবেলায়?”
“দুরন্ত ছিল খুব। সত্যি বলতে আমার স্বভাবের খানিকটা ও পেয়েছে। এখন অবশ্য ততটা দুরন্ত নেই। পারিপার্শ্বিকতায় কিছুটা চাপা পড়ে গেছে।”
এই প্রথম রোমেনাকে বিষণ্ণ হতে দেখল লিলি। সে সান্ত্বনা সূচক কিছু বলবে কিনা ভাবতে ভাবতে তিনি আশ্চর্য দ্রুততায় সামলে নিলেন। মুখ ভরা হাসি নিয়ে তিনি লিলির হাত ধরে বললেন,
“জীবনটা অত্যন্ত ছোট। দেখতে দেখতে সময় হারিয়ে যায়। একবার যেই সময় আমাদের জীবন থেকে চলে যায় তা একেবারেই যায়। কোনোদিন সেটাকে ফেরত পাওয়া যায় না, কোনো কিছুর বিনিময়েও না। জীবনে সবকিছু আমাদের সাজানো ছকে ঘটে না, অপ্রত্যাশিত অনেককিছুর সম্মুখীন হতে হয় চলার পথে। যা হলো না, সেটা ভেবে এখন যা ঘটেছে তার সাথে যদি মানিয়ে চলতে চেষ্টা করি আমরা, তাহলে অপ্রাপ্তিগুলো ধীরে ধীরে মুছে যায় মন থেকে, জানিস তো? নওরীন সেটাকে এক্সেপ্ট করে নেবার চেষ্টা করছে, আমরাও। তুইও একবার ভেবে দেখতে পারিস কথাগুলো৷ নেহালের কাছ থেকে ঠকবি না মা। ওর মা হিসেবে এই আত্মবিশ্বাসের সাথে এটুকু আশ্বাস তোকে দিতে পারি। বাকিটা তোর উপরে।”
লিলি আরেকবার অপ্রতিভ হলো আজ। কথার প্রসঙ্গ কোত্থেকে কোথায় চলে গেল, সে ঠাহর করে উঠতে পারল না। তবে রোমেনার কথাগুলো ওকে স্পর্শ করল ভীষণভাবে। হাসিখুশি, প্রাণবন্ত একইসাথে অত্যন্ত বিচক্ষণ এই ভদ্রমহিলার জন্য ওর শ্রদ্ধাবোধের জায়গাটা দিন দিন গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছিল।
নিজের ছেলের সাথে লিলির ব্যবহার সম্পর্কে অবগত হবার পরেও ওকে কোনো কটু কথা শোনাননি তিনি। বরং স্নেহ দিয়ে, মমতায় বেঁধে ওকে ভাবার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন।
লিলি অধোমুখে বলল, “আমি চেষ্টা করব মা।”
রোমেনা লিলির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “তৌহিদার কথাটাও ভেবে দেখিস। পৃথিবীর কোনো মা সন্তানের অমঙ্গল চায় না।”
“আমি তোমার কোলে একটু আমার মাথাটা রাখতে পারি মা?”
রোমেনা মাথা নেড়ে সম্মতি দিতেই লিলি প্রায় ঝাপিয়ে পড়ল। লিলির চোখের জলের আভাস পাচ্ছেন রোমেনা।
“মায়ের কথা মনে পড়ছে বুঝি?”
লিলি ডুকরে কেঁদে উঠল। অনেকদিন থেকে একটা পাথর ভার যেন বুকে জমে ছিল। আজ নিজেকে উজাড় করে কাঁদতে পারায় সেই ভারটুকু নেমে গেলে যেন৷
***
নেহাল গল্পের বই পড়তে ভালোবাসে। কিন্তু সেভাবে সময় করে উঠতে পারছে না ইদানিং। অফিসে কাজের চাপ, বাড়িতে অন্য চাপ। নানামুখী চাপে সে যেন চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছিল।
আজ একটা বই হাতে বসেছে। হুট করে শুনল কেউ ডাকছে।
“এই যে কোহিনূর হীরা? শুনছেন?”
নেহাল মুখ তুলে চাইল লিলির দিকে। কিন্তু ওকে ডাকছে কিনা দ্বিধায় ভুগল।
“আমাকে ডাকছো?”
লিলি আশেপাশে তাকিয়ে বলল, “আমি তো এই ঘরে আর কাউকে দেখছি না। আপনি দেখছেন? সুপারন্যাচারাল পাওয়ার টাওয়ার আছে নাকি আপনার?”
“সুপারন্যাচারাল পাওয়ার কেন থাকতে যাবে?”
“তাহলে আপনাকে ডাকছি, এটুকু বোঝার মতো কমনসেন্স থাকার কথা, তাই না?”
নেহালের মুখে আবারও সে কষ্ট চেপে রাখার অভিব্যক্তি দেখে লিলি সশব্দে হেসে ফেলল।
“আপনার বয়স এখনো বারো-তেরোতেই আটকে আছে বুঝলেন?”
“আমাকে তো তুমি বুড়ো বলো!”
“বয়সে বুড়ো, মনে পুঁচকে ছোকরা। এটাকে আবার কমপ্লিমেন্ট হিসেবে নিয়েন না কিন্তু। আমি কখন কী করি, বলি তার কোনো ঠিক ঠিকানা থাকে না। আপনার মা যেমন আপনাকে বলে কোহিনূর হিরা, আমি তেমন আমড়া কাঠের ঢেঁকি।”
“এসব কেন বলছো?”
“ইচ্ছা হলো তাই বললাম। সব কথার কারণ থাকতে হবে, এমন কোনো বিধিনিষেধ আছে নাকি?”
“না, নেই।”
“তাহলে এটুকু সহ্য করতেই হবে।”
“আচ্ছা, করলাম।”
“ভালো ছেলে।”
নেহাল কথা খুঁজে পেল না। এই মেয়ে তো সাংঘাতিক ধরনের তো! কথা দিয়ে মানুষকে অপ্রস্তুত করে দেবার কায়দা ভালো জানে, যেটায় সে ভীতিবোধ করল এক ধরনের!
হঠাৎ করে লিলির ফুরফুরে মেজাজের কারণ সে ধরতে পারছে না। কী মতলব, কে জানে!
“আপনি কিন্তু ছেলেবেলায় কিউট ছিলেন। ছবিটা সুন্দর হয়েছে, এক্সপ্রেশনটা আরও সুন্দর।”
লিলির দুষ্টু হাসিতে সে বিভ্রান্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কোন ছবি?”
লিলি হাতে লুকিয়ে রাখা ছবিটা বের করে নেহালের সামনে ধরল।
“এই ছবি কোথায় পেয়েছ?”
“মা দিয়েছে।”
“এটা এক্ষুণি ফেরত দাও।”
“দিলে কী হবে? আমি তো দেখেই ফেলেছি। এখন কী স্মৃতি ফেরত চাইবেন?” ভ্রু নাচিয়ে বলল লিলি।
নেহাল অসহায়বোধ করল। মা না শত্রু কে জানে! এই ছবিটাই দিতে হলো, তাও আবার এই মেয়েকে!
“আল্লাহ! মানসম্মান যেটুকু আছে, তুমি রক্ষা করো।” মনে মনে কয়েকবার যপলো নাজেহাল নেহাল।
…….
(ক্রমশ)