#মহুয়া
#শারমিন_আক্তার_সাথী
পর্ব: ১১
তিথিদের ঘর থেকে বাইরে এসে প্রিয়ম, প্রিয়তিকে কল করল। এসব বিষয়ে প্রিয়তিই সর্বদা ওকে বন্ধুর মত সাপোর্ট করেছে। আজও হয়তো প্রিয়তিই ওকে সাহায্য করতে পারবে। প্রিয়তি আর রিদু বসে চা খাচ্ছিলো। রিদু কিছুক্ষণ আগে অফিস থেকে ফিরেছে। আজ অফিসে কাজের চাপ কম থাকায় বিকালেই বাড়ি ফিরেছে রিদু। প্রিয়তিও রিদুকে চা নাস্তা দিয়ে ওর পাশে বসে চায়ে চুমুক দিলো। তখন ওর ফোনটা বেজে উঠল। প্রিয়তি চায়ের কাপ রেখে ফোনটা রিসিভ করে সালাম দিলো।
” আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া। কেমন আছিস?”
” ওয়ালাইকুম আসসালাম। ভালো তুই?”
” এই তো আল্লাহ ভালো রাখছে।”
” তা তোর শরীর কেমন এখন?”
” এই তো মোটামুটি। তোর কী খবর?”
” আর খবর। রকিব নামে তোর কোনো খালাতো দেবর আছে?”
” হ্যাঁ।”
” সে কি পুলিশ অফিসার?”
” হ্যাঁ।”
” রকিবের পরিবার ওর জন্য তিথিকে পছন্দ করেছে তা কী তুই জানিস?”
” শুধু রকিবের পরিবার নয়, রকিব নিজেই প্রথমে তিথিকে দেখে পছন্দ করেছে। ওর পছন্দ হবার পর খালামনিকে বলেছেন, তিনি আমাদের বাড়ি মাসে চাচির কাছে বিয়ে প্রস্তাব রেখেছেন।”
” চাচি যে বিয়েতে এক রকম রাজি তা কী তুই জানিস?”
” হ্যাঁ। জানবো না কেন? গতকালও তো চাচির সাথে কথা হয়েছে এ বিষয়ে। আমি প্রথমে এটা বলেছিলাম তিথির বয়স খুব কম। পরে ভেবে দেখলাম, চাচা কবে সুস্থ হয় না হয়, তার ঠিক নেই। তারমধ্যে পাড়ার ছেলেরা বা তিথির কলেজের ছেলেরা ওকে যেভাবে বিরক্ত করে, তাতে বিয়ে হয়ে গেলে মেয়েটার একটা সুরক্ষার জায়গা হবে। তাছাড়া রকিব পুলিশ অফিসার। সেদিক থেকে তিথির দিকে চোখ তুলে তাকাতেও লোকে কয়েকবার ভাববে।”
প্রিয়ম হালকা রেগে বলল,
” বাংলাদেশের সব স্বামীরা কি পুলিশ?”
” মানে?”
” মানে তুই যেভাবে বলছিস তাতে মনে হয়, পুলিশ ব্যতিত অন্য কেউ মেয়েদের নিরাপত্তা দিতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশে কয়জন স্বামী পুলিশ? আর সাধারণ স্বামী কয়জন? তোর স্বামীও তো সাধারণ চাকরিজীবি। সে কী তোকে নিরাপত্তা দিতে পারে না? রকিব পুলিশ দেখে তুই চাচিকে রাজি হতে বললি?”
” তোকে কে বলল রকিব পুলিশ দেখে রাজি হতে বলেছি?”
” তোর কথায় তেমন মনে হচ্ছে।”
” না রকিবের জন্য নয়। আমি রাজি হতে বলেছি রকিবের মায়ের কথা ভেবে।”
” তিনি আবার কী করলেন?”
প্রিয়তি বেশ উৎসাহের সাথে বলল,
” তার মতো অমায়িক মহিলা আমি জীবনে খুব কমই দেখেছি। চমৎকার মানসিকতার অধিকারিনী। চমৎকার ব্যক্তিত্ব, দারুণ বুদ্ধিমত্তা, সাথে প্রচন্ড ভালো একজন মানুষ। এমন শাশুড়ি পেতে গেলে মেয়েদের বহু পুণ্য করতে হয়। তিনি সর্বদা বলেন তার যে পুত্রবধূ হবে তাকে পুতুলের মত যত্ন করে রাখবেন। একটা মেয়ে তার পরিবার ছেড়ে তার পরিবারে আসবে, তার মানে মেয়েটাকে বুঝতে দেয়া যাবে না যে, সে তার নিজের পরিবার ছেড়ে শ্বশুর বাড়িতে আসছে। তাকে এটা বোঝাতে হবে এটা তার নতুন পরিবার। তাকে তার প্রাপ্য সম্মান ভালোবাসা দিতে হবে, তার ইচ্ছা অনিচ্ছার মূল্য দিতে হবে। তার মতামতকে প্রধান্য দিতে হবে। তাকে আপন করে নিতে হবে, তার স্বপ্নগুলোকে আপন করে নিতে হবে। সে আত্মর্নিভরশীল হতে চাইলে তাকে অনুপ্রেরণা দিতে হবে। তাকে বোঝাতে হবে শ্বশুর বাড়ি মানে পরের বাড়ি নয়, বরং একটা মেয়ের নিজের আসল বাড়ি। যতদিন শ্বশুর বাড়ির লোক একটা মেয়েকে ঘরের বউ মানবে ততদিন মেয়েটা বউ হয়ে থাকবে, ধরাবাঁধা দায়িত্বে আটকে থাকবে। কিন্তু যখন থেকে তাকে পুত্রবধূ নয় বরং কন্যা মানা হবে তখন থেকে সে ঘরের বউয়ের মত শুধু দায়িত্ব পালন করবে না, বরং মেয়ের মত সবাইকে পরম মমতায়, দুষ্টুমিতে আপন করে নিবে, ভালোবাসবে। আমি আমার পুত্রবধূকে ততটা ভালোবাসবো যতটা আমার মেয়েকে ভালোবাসি, ততটা স্নেহ, যত্ন, শাসন করব, যতটা আমার মেয়েকে করি। আর ভাইয়া যেখানে রকিবের কথা, রকিব শুধু পুলিশ হিসাবে নয়, মানুষ হিসাবেও চমৎকার। যার মা এত উন্নত মানসিকতার, সে নিজেও তো এমনই হবে তাই না ভাই! এখন বল ভাইয়া এমন পরিবার আর এমন শাশুড়ির সংসার কী হাতছাড়া করা উচিত হবে? তিথি এখানে সুখী হবে কিনা বল?”
প্রিয়ম বেশ হতাশ গলায় বলল,
” সবই বুঝলাম। কিন্তু তুই তো জানিস আমি তিথিকে——-!”
” ভাই শুধু তুই পছন্দ করলে তো হবে না, তোর যা পরিবার, পুরা মার্কা মারা।”
” আমার পরিবার কী তোর পরিবার নয় প্রিয়তি?”
” ছিলো একসময়, এখন নেই! যেদিন আমার কোল খালি করেছে সেদিন থেকে তারা আমার কেউ নয়। শোন ভাই তুই জেনে শুনে একটা মেয়েকে ঐ নরকে কেন ফেলতে চাস? যেখানে প্রচন্ড দাম্ভিক একজন শ্বশুর, ভয়ংকর শাশুড়ি, আর অসভ্য, বেয়াদপ, রাক্ষসী টাইপের একটা ননদ আছে সে ঘরে কী কোনো মেয়ে শান্তি পাবে? আর তিথির কথা না হয় বাদ দিলাম, ও আমাদের মতামতের বাইরে যাবে না। কিন্তু তোর কি মনে হয় চাচি রাজি হবে? কখনো না। চাচা বিছানায় পড়তেই তোর মা বাড়ির কাজের লোক তাড়িয়ে সে কাজের দায়িত্ব চাচি আর তিথির উপর দিয়ে দিয়েছে। চাচিকে ছোট বেলা থেকে জানি, প্রচন্ড শান্ত আর নীরব মানুষ। কিন্তু বর্তমানে চাচি কিন্তু আগের মত শান্ত নেই। তোর মা বোন তাকে শক্ত হতে বাধ্য করেছে। চাচিদের আমাদের সব কিছুতে বরাবর অধিকার থাকা সত্ত্বেও তোর মা তার সাথে কাজের লোকের মত ব্যবহার করেছেন, তিথির মত ফুটফুটে মেয়েটার সাথে কেমন ব্যবহার করেছেন।
আর তোর বোন প্রেমা। বাপরে বাপ ওমন দাজ্জাল মেয়ে পৃথিবী দ্বিতীয় আরেকটা আছে নাকি? মনে তো হয় না! শোন ভাই তোর জীবনের সাথে তিথিকে জড়ালে তুই হয়ত সুখী হবি কিন্তু ঐ বাচ্চা মেয়েটা নরক যন্ত্রনা ভোগ করবে। ছোট বেলা থেকে তিথি ওর বাবা মায়ের পর আমাকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করে। আমি তোর পরিবারে ওর বিয়ে দেয়ার কথা বলে, ওর জীবন নষ্ট করতে পারব না। তাছাড়া তিথির স্বপ্ন মেডিকেলে পড়বে। কিন্তু তোর সাথে বিয়ে হলে মেডিকেলে পড়বে না, বরং মেডিকেলের রুগী হয়ে রোজ রোজ মেডিকেলে ভর্তি হতে হবে। চিকিৎসা করার জন্য নয়; করানোর জন্য। ওর জন্য রকিবের পরিবার বেস্ট। রকিবের মা নিজেও একজন বড় গাইনোক্লোজিস্ট। ওর বোন বিয়ে হয়েছে কয় মাস আগে, সে কিন্তু এখন মেডিকেলে তৃতীয়বর্ষে পড়ছে। ঐ পরিবারে গেলে তিথির স্বপ্ন সত্যি হবার সম্ভবনা খুব বেশি। আর রকিবের সাথে তিথির বিয়ে না হলেও, আমি চাইবো না তোর সাথে অন্তত ওর বিয়ে হোক! ”
প্রিয়তির কথা শুনে প্রিয়ম দমে গেলো একদম। ভেবে দেখলো প্রিয়তি যা বলছে তার প্রতিটা কথা সত্যি। প্রিয়ম কথা বলার মতো আর কোনো কথা না পেয়ে চুপ করে ফোনটা কেটে দিলো। প্রিয়তি ফোনের স্ক্রিনের দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর চায়ের কাপে চুুমুক দিলো। চা’টা ঠান্ডা পানি হয়ে গেছে। মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
” ভাই তুই খুব ভালো। জানি তিথিকে খুব ভালোবাসিস। কিন্তু তোর সাথে বিয়ে হবার পর মেয়েটার জীবনে সুখ আসবে না। বরং দুঃখের একটা বড়সর ঢেউ আসবে। যে ঢেউতে তিথির সব স্বপ্ন ধুলিসাৎ হয়ে যাবে।”
রিদু প্রিয়তির হাত ধরে বলল,
” প্রিয়ম ভাইয়াকে এতগুলো কথা বলা কী ঠিক হলো?”
” জানি ঠিক হয়নি। কিন্তু যা বলেছি সত্যি বলেছি এবং এখন ভাইয়া ভালো করে ভাবতে পারবে এবং নিজে নিজে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। ভাই হয়তো কষ্ট পাবে কিন্তু কদিন পর নিজেকে সামলে নিতে পারবে। একবার ভাবো আমাদের ভুল সিদ্ধান্তে তিথির জীবন নষ্ট হলে তখন তার দায়ভার কে নিবে?”
” তবে তিথি তুমি যাই বলো প্রিয়ম ভাইয়া মানুষ হিসাবে কিন্তু অমায়িক।”
” ও অমায়িক হলে কি আসে যায়? ঘোড়ার ডিম! একটা মেয়ে শুধু ভালো স্বামী পেলেই জীবনে সুখী হয় না। পুরো একটা ভালো পরিবার পেলে সুখী হয়।”
“ কিভাবে?”
” তবে তোমায় কারণটা বলি। তুমি সারাদিনে আমার সাথে কয় ঘন্টা থাকো? বেশিরভাগ দিন রাত কয়েকঘন্টা। সকালে তাড়াহুড়া করে নাস্তা করে বেড়িয়ে যাও, রাতে ফিরো, তারপর খেয়ে শুয়ে পড়ো। যেদিন জলদি ফিরো সেদিন বা ছুটির দিনে আমাকে মোটামুটি সময় দিতে পারো। কিন্তু একটা মেয়ে দিন এবং রাতের বেশিরভাগ সময় কাটায় স্বামীর পরিবারের সাথে মানে, শ্বাশুড়- শাশুড়ি, ননদ-দেবরের সাথে। এখন তারা যদি সারাদিন মেয়েটার সাথে খিটখিট করে, বাজে ব্যবহার করে তবে কী মেয়েটা সুখী হতে পারবে? তাতে স্বামী যতই ভালোবাসুক না কেন? হ্যাঁ যারা আলাদা থাকে তাদের বিষয়টা একটু আলাদা। জাস্ট একটু আলাদা বেশি না কিন্তু! কারণ কাউকে জ্বালানোর হলে, কষ্ট দেয়ার হলে তার কাছে থাকতে হবে তেমন কোনো কথা নেই। দূর থেকেও কলকাঠি নাড়া যায়। আর প্রযুক্তির এ যুগে কলকাঠি নাড়া তো খুব সহজ। কলকাঠি নেড়ে সুন্দর জীবনকে জ্বালিয়ে কয়লার মত করে দেয়া যায়। আর আমার পরিবারে কলকাঠি নাড়ার মত লোকের তো অভাব নেই।”
” তা অবশ্য ঠিক। তুমি খুব বুঝদার গো প্রিয়তি।”
” কতটা?”
” যতটা বুঝদার হলে একজন স্ত্রী তার স্বামীর জীবনকে স্বর্গ বানাতে পারে ঠিক ততটা।”
” তবে এবার অবুঝের মত একটা আবদার করি!”
” কী?”
প্রিয়তি বলতে খানিক লজ্জা পেলেও, লম্বা একটা নিশ্বাস নিয়ে বলল,
” আবার বাচ্চা নেয়ার পরিকল্পনা করি?”
” কী বলছো! তোমার মিসক্যারেজ হলো মাত্র দুই মাস হলো। এত দ্রুত আবার বাচ্চা? তোমার অসুবিধা হবে।”
” কিছু হবে না। আজকাল ডাক্তাররাই তো বলেন মিসক্যারেজ হবার পর যত দ্রুত সম্ভব বাচ্চা নিতে। নয়তো পরে কনসিভ করতে প্রবলেম হয়।”
” হ্যাঁ জানি কিন্তু তা বলে মাত্র দুই মাস হতে না হতেই? তাছাড়া আমাদের বিয়ের বয়স তো কেবল ছয় মাস।”
” তো! কোন গ্রন্থে লেখা আছে যে বিয়ের ছয় মাসের মধ্যে পর পর দুটো বাচ্চা নেয়া যাবে না! মানে মিসক্যারেজ হলে দ্রুত বাচ্চা নেয়া যাবে না!”
” কোনো গ্রন্থে নেই। আমি তোমার সুস্থতার চিন্তা করছি।”
” সেটা ডাক্তার দেখবেন। আর তুমি এমনভাবে কথা বলছো যেনো তুমি আজই আমাকে বাচ্চার মা বানিয়ে ফেলবে। আরে প্রস্তুতি নিতে বা কনসিভ করতে তো কিছুটা সময় লাগে। এতদিন বা সপ্তাহে তো এসব সম্ভব না।”
” তা ঠিক। তবে—–।”
” চুপ করো তো।”
প্রিয়তির ধমকে রিদু দমে গেলো। তবে মনে ভালো লাগছে প্রিয়তি আবার আগের মত স্বাভাবিক হচ্ছে দেখে।
১৫!!
র্নিমল বাতাসে প্রাণ জুড়ে যাচ্ছে। সমুদ্রের ঘ্রানে হৃদয় সিক্ত হচ্ছে। ভালোবাসাময় দুটো প্রাণ ভালোবাসার সন্ধান করছে সমুদ্র মাঝে। দূর থেকে কালো ছাঁয়া তাদের রেখেছে নজরবন্দী।
চলবে________