মরীচিকাময় ভালোবাসা পর্ব-০৩

0
724

#মরীচিকাময়_ভালোবাসা
#পর্বঃ৩
#লেখিকাঃদিশা_মনি

ঘুমন্ত প্লাবণের মুখপানে ঝুঁকে তার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দেয় মৌরী। এই মুহুর্তে প্লাবণের নিষ্পাপ চেহারা দেখে কে বলবে জেগে থাকলে এই ছেলে কি ক্ষ্যা’পামোটাই না করে!

মৌরী প্লাবণের দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসে। এরমধ্যে প্লাবণের ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম থেকে উঠে মৌরীকে নিজের সামনে দেখে প্লাবণ লাফিয়ে উঠে পড়ে। ঘুমের ঘোর কা’টিয়ে রাগী স্বরে বলে,
‘তুই এত রাতে আমার রুমে কি করছিস?’

মৌরী ঘাবড়ালো না। বেশ স্বাভাবিক ভাবে বলল,
‘তোমাকে দেখার ইচ্ছা করছিল খুব। তাই চলে এলাম।’

প্লাবণের রাগের পারদ বাড়লো। মৌরীর এমন খামখেয়ালিপনা তার মোটেই ভালো লাগছে না। প্লাবণ রেগে কিছু কড়া কথা শোনাতে যাবে তার আগেই মৌরী বসা থেকে উঠে পড়ে। উঠে দাঁড়িয়ে রুম থেমে বেরিয়ে যেতে লাগে। দরজার কাছে গিয়ে থেমে গিয়ে আবার পিছনে ঘুরে বলে,
‘এখনকার মতো তো চলে যাচ্ছি কিন্তু তোমার পিছু আমি কখনো ছাড়ব না। তোমাকে নিজের করে নিয়ে তবেই আমি দম নেবো।’

কথাটা বলা শেষ করে মৌরী আর এক মুহুর্ত সময় নষ্ট না করে চলে যায়। প্লাবণ বোকার মতো মৌরীর যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে। মৌরী চলে যাওয়ার পর প্লাবণ ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে থাকে। প্রথমদিকে মৌরীর এমন ব্যবহারকে বয়সের দো’ষ,আবেগ হিসেবে আখ্যা দিলেও এখন পরিস্থিতি দিনকে দিন হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। মৌরীর আচার-আচরণে এটা স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে সে কতোটা ডেসপারেট। প্লাবণ ভেবে দেখল এখনই লাগাম না টেনে ধরলে মৌরীকে আর কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। প্লাবণের মনে মৌরীর জন্য অনুভূতি রয়েছে কিনা এটা সে নিজেও নিশ্চিত নয়। তবে ক’দিন থেকে মৌরীর বাড়াবাড়িগুলো তার ভালো লাগছে না। রাতজেগে অনেক ভেবে প্লাবণ একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হলো। এখন শুধু সকাল হওয়ার অপেক্ষা।

★★★
আজকের দিনটা শুধুই হলো বর্ষণের মাধ্যমে। সেই ভোরবেলা থেকে মুশুলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। বারকয়েক বিজলিও চমকেছে।

প্লাবণ কফি নিয়ে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টি দেখতে দেখতে কফি খাচ্ছে সাথে মনে মনে কোন ভাবনাতেও মগ্ন সে। হঠাৎ করে কারো স্পর্শে পিছনে ফিরে তাকায় প্লাবণ। পিছন ফিরে আতিফা বেগমকে দেখে খানিকটা স্বস্তি পায়। নম্রভাবে বলে ওঠে,
‘আম্মু তুমি কিছু বলবে?’

‘আজ বৃষ্টি হচ্ছে জন্য সকালে খিচুড়ি আর বেগুনভাজা করেছি৷ তোর তো গরম গরম খিচুড়ি খেতে ভালো লাগে। তাই ডাকতে এলাম।’

প্লাবণ কফির মগে শেষ চুমুক দিয়ে কফি শেষ করে মগটা পাশে রাখল। অতঃপর আতিফা বেগমের দিকে স্বাভাবিকভাবে তাকিয়ে বলল,
‘তোমার সাথে একটা জরুরি কথা ছিল।’

‘কি বলবি বল।’

‘আমি বিয়ে করতে চাই।’

সকাল সকাল প্লাবণের মুখে এমন কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন আতিফা বেগম। ওনার যেই ছেলে বিয়ের কথা শুনলেই রেগে যেত সে কিনা নিজে থেকে বিয়ের কথা বলছে, এই ব্যাপারটা ভেবেই ওনার তো নিজের কানকেও বিশ্বাস হচ্ছে না। তিনি হাতে আলতো করে চিমটি কে’টে পরখ করে দেখলেন কোন স্বপ্ন দেখছেন কিনা। স্বপ্ন নয় নিশ্চিত হয়ে প্লাবণের কপালে হাত দিয়ে চেক করলেন তার জ্বর হয়েছে কিনা। প্লাবণ এসবে বিরক্ত হয়ে কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
‘উফ,আম্মু। তুমি এমন করছ কেন? আমি একটা সিরিয়াস ব্যাপার নিয়ে কথা বলছি।’

আতিফা বেগম খুশি হলেন। তার তো খুশি হওয়ারই কথা। ছেলে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রত্যেক মাই চান একজন সুযোগ্যা মেয়ের সাথে তার বিয়ে দিতে। আতিফা বেগমও ব্যতিক্রম নন। শুধুমাত্র নিজের ছেলের জেদের জন্যই এতদিন তিনি বিয়ের কথা তুলতে পারেন নি। আজ প্লাবণ নিজে থেকে বিয়ের কথা বলছে দেখে তিনি খুশি হয়ে বললেন,
‘হ্যাঁ, বল কি বলবি।’

‘আমি পাত্রিও অলরেডি ঠিক করে রেখেছি। আমি মৌরীকে বিয়ে করতে চাই।’

আতিফা বেগমের খুশির মাত্রা বাড়তে লাগল। সকালে উঠে যে এভাবে একটার পর একটা খুশির খবর পাবেন সেটা কস্মিনকালেও ভাবেন নি তিনি। উত্তেজনার বসে বলে দিলেন,
‘তাহলে তো সোনায় সোহাগা। তুই বললে এখনই কাজি ডেকে বিয়েটা পড়িয়ে দেই।’

মায়ের মুখে এমন কথা শুনে প্লাবণের কপালে বিরক্তির ভাঁজ পড়ল। সে ধীর গলায় বলল,
‘এত তাড়াহুড়োর কিছু নেই। আগে আব্বু আর চাচ্চুকে কথাটা জানাও। তারপর সবাই মিলে বসে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।’

আতিফা বেগম বুঝলেন তিনি একটু বেশি তাড়াহুড়ো করছিলেন। নিজেকে সামলে বললেন,
‘ঠিক আছে। তুই নিচে আয়। খাবার টেবিলে এই নিয়ে বিস্তারিত কথা হবে।’

★★★
খাবার টেবিলে সবাই থমথমে মুখ নিয়ে বসে আছে সকলেই। মৌরী তখনো খেতে আসে নি। প্লাবণ আতিফা বেগমকে ইশারা করায় তিনি ইনিয়ে বিনিয়ে প্লাবণ ও মৌরীর বিয়ের প্রসঙ্গটা তুলেছেন। আমিনুল চৌধুরী আজাদ চৌধুরীর অভিব্যক্তি বোঝার জন্য তার দিকে তাকিয়েছেন। ওনার মনে ভয় কাজ করছিল যে ওনার ভাই আবার রেগে গিয়ে কোন বাজে কথা না শুনিয়ে দেয়। কিন্তু আমিনুল চৌধুরীকে অবাক করে আজাদ চৌধুরী বলে উঠলেন,
‘প্রস্তাবটা মন্দ নয়। প্লাবণ ছেলে হিসেবে খারাপ নয়, সুপ্রতিষ্ঠিতও। তবে আমি একান্তে কোন কথা এগিয়ে নিতে চাই না। মৌরীর মত না নিয়ে তাই আমি কোন কথা দিতে পারছি না।’

আজাদ চৌধুরীর কথা শুনে আমিনুল চৌধুরীর মুখ বিস্ময়ে থ হয়ে গেল। এদিকে আতিফা বেগম খুশি হলেন। কারণ তিনি জানেন মৌরী এই কথা শুনলে নাচতে নাচতে বিয়েতে রাজি হয়ে যাবে।

এরইমধ্যে মৌরীও খাবার টেবিলে চলে আসল। তার দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে প্লাবণ চোখ নামিয়ে নিলো। তবে মৌরী ঠিকই ব্যাপারটা খেয়াল করেছে। প্লাবণ তার দিকে তাকিয়েছে ভেবে মনটা খুশিতে ভড়ে ওঠে।

অতঃপর এগিয়ে এসে ডাইনিং টেবিলে বসে মৌরী। আতিফা বেগম সুপ্রসন্ন মনে মৌরীর পাতে খাবার বেড়ে দিতে দিতে বলেন,
‘তোর জন্য একটা খুশির খবর আছে মৌরী।’

‘কি খুশির খবর বড়মা?’

‘প্লাবণ আর তোর বিয়ে নিয়ে কথা হচ্ছিল। তোর আব্বু বলেছে তুই রাজি থাকলে তারও কোন আপত্তি নেই।’

মৌরী প্লাবণের দিকে তাকায়। প্লাবণ নিজের মতো খেতে ব্যস্ত। মৌরীর থেকে কোন রেসপন্স না পেয়ে আতিফা বেগম বলেন,
‘কি রে কিছু বলছিস না কেন?’

মৌরী তৎক্ষণাৎ বলে,
‘আমি এই বিয়েতে রাজি তবে আমার একটা শর্ত আছে।’

প্লাবণ খাওয়া থামিয়ে মৌরীর দিকে তাকায়। মৌরী প্লাবণের দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে বলে,
‘প্লাবণ ভাইয়াকে সবার সামনে আমাকে বিয়ের জন্য প্রপোজ করতে হবে।’

একথা শুনে প্লাবণের বিষম লাগে। আতিফা বেগম তার পিঠে আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে পানি খেতে দিয়ে বলে,
‘আস্তে খাবি তো।’

প্লাবণ আর দেরি না করে খাওয়া থেকে উঠে যায়। এরপর নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায়। মৌরী কিছু বুঝে উঠতে পারে না। একটু পরেই প্লাবণ আবার ফিরে আসে। তার হাতে একটা আংটি। প্লাবণ মৌরীর হাতে আংটিটা পড়িয়ে দিয়ে বলে,
‘উইল ইউ ম্যারি মি মৌরী?’

মৌরী যেন আকাশের চাঁদ পেয়ে গেছে। খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলে,
‘আই উইল।’

বাড়ির বড়রা এমন কান্ড দেখে অপ্রস্তুত হয়ে যায়। তবে আতিফা বেগমের খুব ভালো লাগে ব্যাপারটা। প্লাবণ মৌরীর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলে,
‘এত খুশি হওয়ার কিছু নেই। তোকে শুধু আমি ৬ মাসের জন্যই বিয়ে করব। ৬ মাস পর তোর আর আমার পথ হবে সম্পূর্ণ আলাদা।’

মৌরী মনে মনে বলে,
‘আমার নিজের ভালোবাসার উপর ভরসা আছে। এই ৬ মাসে তুমি আমার প্রেমে হাবুডুবু খাবে এটা আমার বিশ্বাস।’

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে