মন মহুয়া পর্ব-০২

0
811

#মন মহুয়া

রাইটার – Farhana Rahaman আয়াত

পার্ট -০২

রাত ১২ টা হতে ১০ মিনিট বাকি।
মিনারের আসার কোন খোঁজ নেই।ফোন ও তুলছে না।মিনারের মা বাবা অপেক্ষা করতে করতে এক এক করে সবাই ঘুমাতে চলে যায়। ওর মা না খেয়ে অপেক্ষা করছে এখনো। বেশ চিন্তা হচ্ছে।মিনার তো কখনো এত রাত করে না।আর আজ কোথাও যাওয়ার কথাও ছিল না।তাহলে দেরি হচ্ছে কেন ভাবছে।
১ টার দিকে মিনার বাসায় ফিরে।মা খেতে বলে তাও খেল না।বাইরে খেয়েছে বলে নিজের রুমে চলে যায় মিনার।ওর চোখ মুখ এর অবস্থা আর মেজাজ কোন কিছু ভাল লাগলো না ওর মায়ের তাই বিয়ের কথা সকালে বলবে ভেবে ঘুমাতে চলে যায়।

মাথা যন্ত্রনায় অসহ্য লাগছে মিনারের। রাগে চোখমুখ লাল হয়ে আছে। ঘড়িতে রাত দুইটা বাজে।এত রাতেও মিনার শাওয়ার নিল।পকেটে সিগারেট আর লাইটার নিয়ে ছাদে উঠে আসে।
সিগারেটে টান দিতে দিতে ভাবতে থাকে আজকের সব ঘটনাগুলো। কত কিছু ভেবে ছিল আজকের দিনটা নিয়ে।ভেবেছিল সব পাবে। হল তার উল্টো সব।একটা পাওয়ার আশা করলো আর দুটো হারিয়ে ফেলেছে।ভালবাসার মানুষ তার সাথে প্রিয় বন্ধুকেও। যাকে পাগলের মতো ভালবাসলো সেও ধোকা দিয়েছে আর যার সাথে সেই ছোট বেলার বন্ধুত্ত্ব সেও। কি হতো সত্য টা বলে দিলে?ওদের মাঝখানে থাকতোই না।প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা খুব দরকার।তারপর সব মুছে ফেলবে মন থেকে।কস্ট হলেও করবে।
আজ সবার সামনে নিলা কে প্রপোজ করেছিল মিনার।
কিন্তু নিলা সবার সামনে মিনার কে ইন্সাল্ট করে মিনারের বেস্টফ্রেন্ড রেহান কে প্রপোজ করে। আর রেহান একগাল হেঁসে নিলাকে জড়িয়ে ধরে আই লাভ ইউ বলে।
মিনার হতবাক হয়ে ওদের দেখছিল।সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছিলো মিনারের।নিলা আর রেহান কেন এমন করলো তা জানা খুব দরকার। মিনার সারারাত জেগে ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পরে।
মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙে ওর।ফ্রেস হয়ে নাস্তার টেবিলে গিয়ে বসে মিনার।ওর মা বাবা বারবার ওর দিকে থাকাচ্ছে।
মিনার কিছুটা বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করছে,কিছু বলবে আম্মু?
মিনারের মা আমতা আমতা করছে কি বলবে।কারন মিনার কিছুটা একরোখা মনোভাব এর।আর কিছু টা জেদী ও।
মিনারের বাবাই কথা টা ওকে বলে দিলো।মিনার একমাত্র ওর বাবাকেই ভয় পায়।
মিনার এর যেন গলায় খাবার আটকে গেছে।এমনিতেই আছে নিজের দুঃখে তার উপর মা বাবা বিয়ের কথা বলে যেন লবন মরিচ ছিটিয়ে দিলো।
কি বলবে বুঝতে পারছেনা।মাথা নিচু করেই বলে
আমার এখনও পড়াশুনা ,,
বাবা কথা টা শেষ করতে দিল না।বলে,জানি তোমার পরীক্ষা শেষ হয়নি।কিছু করোনা।কাল থেকে আমার সাথে অফিস জয়েন করবে।আর কলেজ পাশাপাশি করা যাবে।চিন্তার কিছু নেই।অফিস এ এখন থেকে গিয়ে শিখে বুঝে নাও।
বাবা উঠে চলে যায়। মিনার ও কিছু না বলে বেরিয়ে পড়ে।
ক্যাম্পাসে ঢুকতে ইচ্ছে করছে না মিনারের।তাই বাইরে অপেক্ষা করছে রেহান এর। রেহান ইচ্ছে করেই বাইরে আসছে না।বিল্ডিংয়ের ছাদে দাড়িয়ে মজা নিচ্ছে। বেশ একটা বিশ্বজয়ের হাসি মুখে।পিছন থেকে জয় এসে রেহান কে বলে,যা করছিস ভেবে করছিস তো?
– হ্যা। ভেবেই করছি।ভালবেসে আমি যতটা কস্ট পেয়েছি ওকেও পেতে হবে।তবেই আমার শান্তি।
– জীবনে আমরা যা ভাবি তা হয়না।জীবন নিজের গতিতে চলে আর কারো জন্য আটকে থাকে না।
– তা থাকেনা তবে আঘাতের চিহ্ন আর যন্ত্রনা থাকে।
– আর যদি নির্দোষ মানুষকে আঘাত করিস তাহলে,,
– কি বলতে চাস তুই?আমি মিনারকে বিনা কারণে কস্ট দিচ্ছি?তুই সব জেনেও এসব বলছিস?
– আমি তুকেও জানি আর মিনার কেও। তাই তোকে অনেকবার বলেছি ওর সাথে কথা বলে সব ক্লিয়ার কর।তুই ইগো নিয়ে আছিস।
– তুই বুঝবিনা।যা এখান থেকে।
– যাচ্ছি।তবে একটা কথা বলি?এখনো বলছি কথা বলে নে একবার।নাহলে আরো বড় ভূল করলে সংশোধন করার সময় থাকবেনা।
জয় চলে আসে।
রেহান এর রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।ও যে ভুল করছেনা তা আজকেই প্রমান করবে।রেহান বেরিয়ে মিনারের সামনে আসে।

মিনার যতটা রাগি ততই ধৈর্যশীল।খুব শান্ত গলায় বললো কারন টা বল তাহলে আর কিছু জিজ্ঞেস করবো না।
– কারন টা তুই,শুধু মাত্র তুই।তুই জানিস না?
মিনার- জানিনা বলেই এসেছি জিজ্ঞেস করতে।
রেহান- রিদির কথা মনে আছে?
মিনার- রিদি? ওর সাথে এসবের কি?
রেহান- আমি ওকে নিজের থেকেও বেশি ভালবাসতাম
তুই সেটা ভালো করে জানতি তারপর ও তুই কি করে ওকে প্রপোজ করলি?রিদির সাথে রুম ডেট ও করেছিলি।মনে নেই তুর?একবার বলতে পারতি তুই ওকে চাস। আমি বন্ধুর জন্য নিজের ভালবাসা টুকু দিয়ে দিতাম।

রাগে গিজগিজ করে বলছে রেহান কথাগুলো।
মিনার চুপচাপ ওর কথাগুলো শুনে। মিনার কে চুপ থাকা দেখে রেহান এর রাগ বেরে যাচ্ছে।চেচিয়ে বলে কি হলো বল?

মিনার- তোর বলা শেষ?
রেহান চুপ।
মিনার – এবার আমি বলব তুই শুনবি।
কে রিদি?কয়দিন চিনিস?আমাকে কয়দিন চিনিস?
আমি জানতাম তুই ওকে পছন্দ করিস।আমার কোনো সমস্যা ছিলনা। সমস্যা এটাই ছিল যে রিদি তোকে ঠকাচ্ছিল।ও তোর সাথে খেলছিলো।
রেহান – হুম এখন তো এসব বলবি।
মিনার – তাই।এক্টু ওয়েট।

মিনার ফোন টা বের করে সিক্রেট ডক্যুমেন্টস ফাইল থেকে কিছু ছবি আর ভিডিও বের করে রেহান এর সামনে তুলে ধরে।
রিদির কিছু অর্ধনগ্ন ছবি তাও একাধিক ছেলের সাথে প্রায় তাদের ব্যাচমেট। মিনার এর সাথে ভিডিও টা অন করে।যেখানে রিদি মিনার এর কাছে যাওয়ার চেস্টা করছে কিন্তু মিনার ওকে চড় বসিয়ে দেয়।বাকি অংশ দেখার আগেই ফোন টা হাত থেকে পরে যায়।

মিনার – আমি ভেবেছিলাম তুই রিদির আসল জেনে,, কিন্তু তুই তো এতটায় ভালবাসলি যে ভাল আর খারাপ এর তফাৎ ভূলে গেছিস।আমি ওর সাথে রুমডেটে গেছি রিদিকে শিক্ষা দিতে।একবার জিজ্ঞেস তো করতে পারতি।একটা মেয়ের জন্য আমাকে ভুল বুঝলি?
আসলেই আমার ভূল।তোকে সবটা জানানো উচিত ছিল।ভাবছি সব মিটে গেছে। ভূল ছিলাম আমি।তবে আজ সব মিটিয়ে দিয়ে যাচ্ছি। আরও প্রমান লাগে তো বলিস।ভালো থাক বলেই মিনার চলে আসে। রেহান কিছু বলতে গিয়েও পারল না।রাগ আর জেদের জন্য ভালো বন্ধু কে হারিয়ে ফেলেছে আজ।একটা মেয়ের জন্য এতসব।নিজের উপর নিজের রাগ হচ্ছে।

মিনার আজও দেরি করে বাসায় ফিরে।মা জেগে আছে দেখে মাকে ঘুমাতে যাওয়ার কথা বলে নিজে রুমে চলে যায়। অনেক চেস্টা করেও ঘুমাতে পারছে না।ছাদে গিয়ে একটা কোনায় দাড়িয়ে আছে।সবকিছু জটিল মনে হচ্ছে।কি করবে বুঝতে পারছে না।নিলা কে ভালবেসে কস্ট পাচ্ছে তা না কস্ট হচ্ছে রেহান এর থেকে পাওয়া ব্যবহার থেকে।রেহান এর জন্য কত কিনা করেছে।
সিড়ি দিয়ে কারো আসার শব্দ শুনে জলন্ত সিগারেট টা ফেলে দেয় মিনার।
মিনারের মা মিনারের কাছে এসে বলে, তোর কি কিছু হয়েছে? দুদিন ধরে দেখছি।
মিনার- না আম্মু। তুমি এত রাতে না ঘুমিয়ে আছো যে?
মা – ঘুম যে আসছে না। কথা ছিল কিছু।
মিনার – বিয়ের কথা বলবে তো?সব তো করেই ফেলেছো না জিজ্ঞেস করে। আর কি বলবে।
মা – এভাবে বলছিস কেন?তোর কি কোনো পছন্দ আছে?
মিনার কি আর বলবে,সদ্য ব্রেকাপ হলো।নিলা যদি রাজি থাকতো তাহলে সাহস করে বলেই ফেলতো মা কে।
মিনার – না মা এমন না।এখন ও আমি প্রস্তুত না বিয়ের জন্য।বাবাকে বুঝাও।
মা- আমার কথাগুলো আগে শুন তারপর নাহয় সিধান্ত নিস।
তুই তোর রাশেদ আংকেল কে তো চিনিস।আর মহুয়া কেও।
মিনার – হুম।
মা – মহুয়ার মা তো ছোট বেলায় মারা গেছে মহুয়াকে রেখে।আর এখন তোর আংকেল ও হয়তো বেশিদিন বাচবেনা।ওনার ব্রেইন টিউমার ধরা পরেছে।অপারেশন করলেও বাচার সম্ভাবনা খুব কম তাই ওনি চায় মহুয়ার বিয়ে টা দিয়ে যেতে।ওনি আমাদের বলেছে কারন মহুয়ার মার ইচ্ছে ছিল তোর আর মহুয়ার বিয়ে হোক। শুধু ওর না আমার ও ইচ্ছে ছিল। ওয়াদা করেছিলাম।তারপর ও রাশেদ ভাই জোর করছেনা।তুই না করলেও মহুয়ার বিয়ে অন্য কোথাও দিয়ে দিবে।কিন্তু আমি আর তোর বাবা বড় মুখ করে কথা দিয়ে এসেছি।তুর যদি আপত্তি থাকে বলে দে।কাল ফোন করে জানিয়ে দিব আর তোর বাবাকেও বুঝাব।
মেয়েটা খুব ভালো রে।অনেক কস্ট পেয়েছে এখনো পাচ্ছে।
মিনার – আম্মু তুমি ঘুমাতে যাও।সকালে জানাচ্ছি।
মিনারের মা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে চলে আসে।
মিনার কি বলবে। মহুয়ার কথাগুলো শুনে বড্ড মায়া হচ্ছে।না করলে মা বা কস্ট পাবে।ওয়াদা ভাঙবে।বাসায় অশান্তি হবে।কিন্তু মাত্র যা হলো এতে কিছু টা সময় দরকার নিজেকে সামলে নেওয়ার জন্য। অন্য কাউকে জীবনে জায়গা দেওয়ার জন্য নিজেকে সময় দেওয়া উচিৎ। মহুয়া কে বিয়ে করলে ওর দায়িত্ব নিতে হবে।স্ত্রীর অধিকার দিতে হবে যার জন্য এখন মোটেও প্রস্তুত না মিনার।অনেক্ষন ভাবতে ভাবতে মিনার সিধান্ত নেয়।

সকালে নাস্তার টেবিলে সবাই অপেক্ষা করছে মিনার কি বলবে তার।মিনারের বাবা কিছু বলতেই যাচ্ছিলো ঠিক তখনি মিনার বলে, তোমরা যা ভালো বুঝ তাই করো।
মিনারের মা বলে, তুই রাজি?
মিনার খেতে খেতে বলে, হুম।মিনারের মা বাবার মুখে হাসি ফুটে।কিন্তু আবার ফ্যাকাসে হয়ে যায় মিনারের কথা শুনে।
মিনার বলে,আমার একটা শর্ত আছে।আমি তোমাদের কথা রাখছি তাই আমার কথাও তোমাদের রাখতে হবে।আমি বিয়ে করব ঠিক।কিন্তু যতদিন আমার এক্সাম এর রেজাল্ট না দেয় আর আমি সেটেল্ড না হচ্ছি ততদিন এই বিয়ের ব্যাপার টা আমাদের ফ্যামিলির বাইরে কেও জানবে না।
মিনারের বাবা বলেন,এটা কেমন কথা।বিয়ে হলে তো সবাই জানবেই।
মিনার – জানালেই জানবে।আর না জানালে কেউ জানবে না। আর তোমরাই তো বলছো মহুয়ার ১৮ হয়নি।কাবিন কি হবে?বরং ঝামেলাই বাড়বে।আর তোমরা ভূলে যাচ্ছো দুমাস পর মিরা আপুর এনগেজমেন্ট।মামুন ভাইয়া দেশে ফিরবে।আপুর আগে আমার বিয়ে কি হবে জানলে?
মিনারের কথায় যুক্তি আছে তাই বাবা মা চিন্তায় পড়ে গেলো। মিনারের মা বলে ঠিক আছে এমন টাই হবে।এখন আকদ হোক তারপর পরে কাবিন আর অনুষ্টান হবে।
মিনারের ফুফু বলে,এমন হলে মহুয়া কই থাকবে?
মিনারের বাবা বলেন, মহুয়া এবাড়ির বউ এখানেই থাকবে।
ওর ফুফু বলে তাহলে সবাই তো জানবে।কে, কেন এখানে থাকে প্রশ্ন উঠবে।
মিনারের বাবা বলে কিছু হবে না।মহুয়া তো আমাদের
মেয়ের মতো। মিমির বয়সি।এখানে থাকবে মেয়ে হয়ে আর পড়াশুনা করবে এখান থেকে।এর বাইরে কিছু বলার দরকার নেই।পরে দেখা যাবে।
মিনারের মা বলে তাহলে রাশেদ ভাই কে কল করে জানিয়ে দেন আপনি। আমরাও বিয়ের জোগার শুরু করি।

মিনার এর খুব খারাপ লাগছে কিন্তু ভেবেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ও।নিজে যাকে ভালবাসতো সে তো ওকে কস্ট দিল।তাই মা বাবার পছন্দের মান রাখা হোক।হয়তো মহুয়ার সাথেই ওর বিয়ে ঠিক ছিল তাই আল্লাহ এমন করেছে।নিজেকে মুভ অন করতে হবে এটাই মিনার ভাবছে।

চলবে,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে