#মন_বিনিময়
#পর্বঃ২৩
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা
গাড়ির পেছনে ব্যাগপত্র সব রেখে এসে ড্রাইভিং সিটে বসলো স্বপ্নিল। সামনে ওর পাশের সিটে রাহিতা বসে আছে, পেছনে দিলারা বেগম ও সামিরা। স্বপ্নিলের নানিবাড়ি বগুড়া, ঢাকা থেকে খুব বেশি দূরে নয়। বড়োজোর ঘণ্টা পাচেঁকের দূরত্ব মাত্র। গাড়ি চালু হতেই তিন রমণীর মুখে কথার খই ফুটলো। বেশ কিছুক্ষণ যাবত এটা-সেটা গল্প চললো। স্বপ্নিলের নানিবাসায় কে কে আছে না আছে, দিলারা বেগমরা কয় ভাইবোন- নানিবাড়ি যাওয়ার আগে রাহিতাকে এসব বিষয়ে অবগত করতে ভুললেন না তিনি। এদিকে স্বপ্নিল গাড়ি চালানোর মাঝে মাঝে নিশ্চুপভাবেই তাদের কথা শুনে যাচ্ছিলো শুধু। ঢাকার ভেতর খানিকটা জ্যাম পেলেও গাজীপুর পার হতেই রাস্তা ফাকা পেলো তারা। এরপর ঘণ্টা দুয়েক পেরিয়ে বঙ্গবন্ধু সেতু ওরফে যমুনা সেতুতে পৌঁছে গেলো স্বপ্নিলদের গাড়ি।
রাহিতার উত্তরবঙ্গে আসা হয়নি কখনো। সেভাবেই বলা চলে আজ তার প্রথম এদিকে আসা। সেতুর কাছে আসতেই চোখেমুখে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে জানালা দিয়ে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করছিলো সে। সেতুর নিচ দিয়ে যমুনা নদীর বুকে ঘুরে বেড়ানো ছোট-বড় নৌকা, একিসাথে ইঞ্জিনচালিত স্টিমার চলছে। দমকা হাওয়ার সাথে নদীর উত্তাল ঢেউ মিলেমিশে যেন প্রকৃতির আসল সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে৷ রাহিতার মুগ্ধতা তার অভিব্যক্তিতে স্পষ্ট!
এদিকে পেছনে বসা মা-মেয়ে দুজনই সিটে হেলান দিয়ে আছে। উভয়ের চোখজোড়া ঘুমে নিভু নিভু। লুকিং মিররে একবার তাদের দিক চোখ বুলিয়ে পুনরায় উচ্ছাসিত রাহিতার দিকে নজর দিলো স্বপ্নিল। ধীম আওয়াজে জিজ্ঞেস করলো,
—তুমি মেইবি এই প্রথম এলে না এদিকে?
—হ্যাঁ, এর আগে কখনো আসা হয়নি৷ এই সেতুর নাম শুনেছিলাম আগে, উঠার সু্যোগ হয়নি কখনো! আজ এদিকে এসে বেশ ভাল্লাগছে। কি সুন্দর আপনাদের উত্তরবঙ্গ!
—হুম বেশ সুন্দর। জানিনা সময় হবে কিনা, তবে সুযোগ পেলে তোমায় একবার ঘুরিয়ে দেখাবো শহর।
—সত্যি? আমি অপেক্ষা করবো!
খুশিতে গদগদ হয়ে জবাব দেয় রাহিতা। আড়চোখে ওর ভাবান্তর দেখে মনে মনে হাসে স্বপ্নিল। সেতু পার হয়ে আরেকটু দূর যেতেই সিরাজগঞ্জ এর এক হোটেলে যাত্রাপথের খানিকটা বিরতির জন্য থামে তারা। গাড়ি থামতেই পেছন থেকে জেগে উঠে দুই মা-মেয়ে। ততক্ষণে দুপুর হয়ে এসেছে প্রায়। কিছুক্ষণ হোটেলের বাইরে হাটাহাটি করে গাড়ি ওঠার আগে আশেপাশে আরেকবার দেখছিলো রাহিতা। সেদিকে লক্ষ্য করে স্বপ্নিল ওর কাছে যেয়ে মিহি স্বরে বললো,
—আইসক্রিম খাবে না কোক?
—লাগবেনা।
—আচ্ছা, আইসক্রিম খাবে তাই তো? কোন ফ্লেভার বলো?
—বললাম তো লাগবেনা!
লাজুক হেসে বলে রাহিতা। সেদিক চেয়ে স্বপ্নিল আবারো বলে,
—ওহ ভ্যানিলা ফ্লেভার? ঠিকাছে আনছি।
কথাটি বলেই পেছন ফিরতেই আলতোভাবে ওর হাত চেপে ধরে রাহিতা। ওর দিক না ফিরেই স্বপ্নিল ঘাড় কাত করতেই মিনমিনিয়ে বলে,
—চকলেট ফ্লেভার।
এবার ওর কথায় হেসে উঠে স্বপ্নিল। এরই মাঝে কানে প্রতিধ্বনিত হয় সামিরার কণ্ঠ,
—ভাই, আমার জন্য ভ্যানিলা।
পেছন ফিরে বোনের দিক তাকায় স্বপ্নিল। আইসক্রিমের নাম শুনে সামিরার জ্ব’লজ্ব’লে মুখের দিক তাকিয়ে শয়তানি হেসে বলে,
—তোর জন্য কিছুই আনবোনা। আমাদের তিনজনের জন্য আনবো শুধু!
—উফফ ভাই, তুমি সবসময় আমার সাথে এমন করো কেন?
—সারাজীবন করবো। তোর সমস্যা?
—তুমি একটা অসহ্য!
মেকি রাগ দেখিয়ে চেচিয়ে উঠে সামিরা। ভাইবোনের খুনসুটি দেখে হেসে ওঠেন দিলারা বেগম ও রাহিতা। সেদিক পাত্তা না দিয়ে স্বপ্নিল চলে যায় আইসক্রিম আনতে। যেতে যেতেই মনে মনে ভাবে, এবার লাইনে এসেছে রাহিতা। মূলত এতক্ষণ রাহিতার দৃষ্টি লক্ষ্য করছিলো সে। কিছুদূর দাঁড়ানো কয়েকটা বাচ্চাদের আইসক্রিম খাওয়ার দিক তাকিয়ে ছিলো সে, এতেই স্বপ্নিলের মনে হয়েছে সে হয়তো আইসক্রিম খেতে চায়। তাইতো আন্দাজে ঢিল মারছিলো এবং সে সফল! কিন্তু স্বপ্নিল ভেবে পায়না রাহিতার যদি কোনোকিছু নিতে ইচ্ছে হয় তবে সেটা সে ওকে সরাসরি বলেনা কেন? এখন তো এটলিস্ট ওদের মধ্যকার সম্পর্কটা যথেষ্ট স্বাভাবিক হয়েছে, পুরোপুরি মিলেমিশে না গেলেও তারা দুজনই যে নিজেদের দিক থেকে ঠিকি চেস্টা করছে নিজেদের সম্পর্ক মজবুত করার। তবে কি রাহিতার মাঝেও কোনো জড়তা কাজ করছে? আনমনে ভাবে দ্বিধাগ্রস্ত স্বপ্নিল। মনে মনে ভাবে মেয়েটা ওর জন্য অনেক কস্ট পেয়েছে কিন্তু আর নয়! এবার নিজের পাশাপাশি সে চেস্টা করবে রাহিতাকে ওর সাথে পুরোপুরি সহজ করার। এসব ভাবনার মাঝেই সবার জন্য আইসক্রিম নিয়ে ফিরে আসে স্বপ্নিল। অতঃপর সবাই আবার যাত্রার উদ্দেশ্যে বের হলো। বগুড়া যাওয়ার বেশিক্ষণ যে বাকি নেই আর!
___________________
প্রশস্ত এক বাড়ির সামনে এসে থামে গাড়ি। জানালা দিয়ে সেদিক তাকিয়ে না চিনেও রাহিতা বুঝলো এটাই স্বপ্নিলের নানিবাড়ি। তার ভাবনা শেষ না হতেই গাড়ি থেকে নামতে শুরু করলো সবাই। রাহিতা বের হবে ততক্ষণে স্বপ্নিল নিজের সিট থেকে বের হয়ে এসেছে ইতোমধ্যে। ফলে সে নিজেই রাহিতার জন্য গাড়ির দরজা খুলে দিলো। সেদিক চেয়ে মুচকি হেসে বের হলো রাহিতা। এমন সময় দিলারা বেগম কাছে এসে বললেন,
—এটাই আমার বাপের বাড়ি। বুঝলি রাহি? অনেক মাস পর আসা হলো এখানে। ভেতরে চল তাড়াতাড়ি। আর মাথায় আঁচল টেনে নে। বিয়ের পর প্রথমবার আসছিস নতুন বউ। সবাই অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য!
উনার কথায় সায় নাড়িয়ে সবাই বাড়ির ভেতর ঢুকবে এমন সময় স্বপ্নিল বলে,
—মা, তোমরা যাও। আমি লাগেজ নিয়ে আসছি।
—তোকে লাগেজ নিতে কে বলেছে? দীপ্তদের ডাকলেই তো ওরা নিয়ে যাবে। এই প্রথমবার তোর বউ আসছে এখানে, তুই কোথায় বউয়ের সাথে ঢুকবি তা না। যত্তসব!
দিলারা বেগমের কথা শেষ না হতেই একটা ছেলের কণ্ঠ শুনা যায় বাসার সামনে থেকে৷ স্বাস্থ্যবান এক যুবক ছেলেকে আসতে দেখা যায় এদিকে৷ মুখে যার লেগে আছে মুচকি হাসি, এক গালে টোল। তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে সে। ওকে আসতে দেখেই স্বপ্নিল একগাল হেসে বলে,
—আরে দীপ্ত যে? কেমন আছিস? অনেকদিন পর দেখা তোর সাথে। রাহি, এটা হলো দীপ্ত। আমার মামাতো ভাই।
স্বপ্নিলের কথা শুনে রাহিতা হালকা হেসে সালাম দেয় তাকে। রাহিতাকে সালামের উত্তর দিয়ে স্বপ্নিলের দিক চেয়ে দীপ্ত বলে,
—ফুপি তো ঠিকি বলেছে, ভাইয়া। তুমি ভাবীর সাথে ভেতরে যাও। আমি তোমাদের লাগেজ নিয়ে যাচ্ছি ভেতরে। মা সেই কখন থেকে অপেক্ষায় আছে তোমাদের! যাও।
দীপ্তর কথায় সবাই ভেতরে ঢুকে। দরজা খোলাই ছিলো। সদরদরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই মধ্যবয়সী এক মহিলা হাসিমুখে এগিয়ে আসেন। দিলারা বেগমকে জড়িয়ে ধরে বলেন,
—কেমন আছেন, আপা? এতদিন পর আমাদের কথা মনে পড়লো বুঝি? আমাদের নতুন বউমা কোথায় দেখি!
শাশুড়ির ইশারায় উনার সামনে এগিয়ে এলো রাহিতা। তাকে দেখেই মুগ্ধ চোখে তাকালেন মহিলা। রাহিতার গালে হাত রেখে আদুরে কণ্ঠে বললেন,
—মাশাআল্লাহ! তুমি তো আসলেই সুন্দর। আমি স্বপ্নিলের বড় মামি! চিনেছো আমায়? সেই যে বিয়ের দিন দেখেছিলাম তোমায় বিয়ের সাজে। এখন তো দেখছি এমনিতেও তুমি কম সুন্দর নও, আমাদের স্বপ্নিলের সাথে বেশ মানিয়েছে মাশাল্লাহ!
মামির কথায় লজ্জায় মাথা নুইয়ে যায় রাহিতার। পর পর স্বপ্নিলের নানী, ছোটমামি দের সাথে দেখা হয় তার। সবার সাথে দেখাসাক্ষাৎ ও কুশল বিনিময় শেষে সোফায় রেস্ট নেওয়ার জন্য বসে তারা। জার্নির ক্লান্তি দূর করতে ঠান্ডা শরবত পরিবেশন করা হয় তাদের। সবে মাত্র শরবত খেয়ে খানিকটা জিরিয়েছিলো রাহিতা। লম্বা এক জার্নির পর সকলের সাথে কুশল বিনিময় করতে করতে বেশ ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলো সে। ওকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে স্বপ্নিল প্রশ্ন করে,
—কি হয়েছে? মন খারাপ?
—কই? না তো!
—তাহলে এমন চুপচাপ বসে আছো কেন?
ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করে স্বপ্নিল। ওর কথায় বিরক্ত হয় রাহিতা। সে নতুন বউ হিসেবে এসেছে মাত্র বাড়িতে। কাউকে চিনেও না এখনো ঠিকমতো। চুপচাপ থাকবেনা তো কি করবে? নাচবে? বিরক্তি না দমিয়ে দাতে দাত চেপে স্বপ্নিলের দিক তাকিয়ে বলে,
—তো কি করতে বলছেন আমায়? নাচবো এখানে?
ওর কথায় হুহা করে হেসে উঠে স্বপ্নিল। সকলের অগোচরে রাহিতার নাক টেনে দিয়ে নিচু স্বরে বলে,
—এত ক্ষে’পছো কেন, এংরি বার্ড? আমি তো এমনিই জিজ্ঞেস করছিলাম। তবে তুমি নাচতে চাইলে আমি কিন্তু সঙ্গ দিতেই পারি তোমায়। কি বলো? নাচবে নাকি?
স্বপ্নিলের দুস্টু হাসি ও মশকরা কথায় নাক ফুলিয়ে শ্বাস ছাড়ে রাহিতা। স্বপ্নিলের থেকে মুখ ঘুরিয়ে সামিরার সাথে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। স্বপ্নিলও হাসিখুশি ভাবে ওর মামাতো ভাইবোনদের সাথে কথা বলছিলো। এমন সময় দীপ্তকে আসতে দেখা যায়। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে খানিকটা চিন্তিত। ওকে এভাবে দেখে স্বপ্নিল জিজ্ঞেস না করে পারেনা,
—কি হয়েছে তোর, দীপ্ত? এনিথিং রং?
—আমার কিছু হয়নি, ভাই। এখন যা বলতে যাচ্ছি তা শুনলে তোমারই মুড অফ হবে।
—মানে? কেন? স্পিক আপ!
দীপ্তকে তাড়া দেয় স্বপ্নিল। জানার আগ্রহ বেড়েই চলেছে মনে। ধীরে সুস্থে দীপ্তর জবাব আসে,
—সীমা ফুপি আসছে, স্বপ্নিল ভাই। মাত্র খবর পেলাম। আজ রাতেই নাকি পৌছানোর কথা এখানে।
দীপ্তর কথায় ভ্রুযুগল কুচকে যায় রাহিতার। এই সীমা ফুপি আবার কে? ওর চিন্তার মাঝেই সামিরা আঁতকে ওঠে,
—সীমা খালামনি? ওহ নো!
এবার সামিরার দিক তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে স্বপ্নিলের দিক তাকাতেই চোখ আটকে যায় রাহিতার। স্বপ্নিলের এতক্ষণের হাসিমুখ অন্ধকারে নিমজ্জিত প্রায়। তার পরিবর্তে শক্ত চোয়াল, মুস্টিবদ্ধ হাতের মুঠো। সবার এমন রিয়েকশন দেখে কপালে চিন্তার ভাজ বেড়ে যায় রাহিতার। হচ্ছেটা কি এখানে? কে এই মহিলা যার আসার কারণে সবাই এমন চিন্তিত?
আসলেই ভাবনার বিষয়!
#চলবে