মন ফড়িং ৩১.
নিদ্র ঘুমুচ্ছে। এতো সুন্দর লাগছে ওকে, যেন কোনো এক নীল আকাশের দেবদূত!
এতো সুন্দর একজন বর পাবে অদ্রি কোনোদিন ভাবতেই পারেনি।
এক হাত দিয়ে অদ্রির কোমড় ধরে আছে। আরেক হাত বিছানার উপর পরম যত্নে রাখা। অদ্রির এই বাঁধন থেকে ছুটতে ইচ্ছে করছেনা কিন্তু ছুটতে তো হবেই। ঘড়ির ঘণ্টার কাটা ৯ টা ছুঁই ছুঁই করছে। যদিও তার এরচেয়ে বেলা করে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস। প্রায় প্রতিরাতেই তার ঘুম হয়না।
ঘুম আসে ভোরের দিকে।
অসম্ভব সুন্দর এক সকাল উপহার দিয়েছে নিদ্র তাকে! এর বিনিময়ে সমতুল্য কিছু দেয়ার ক্ষমতা তার নেই। গতকাল রাতে ইখলাস সাহেবকে ঠিক নিদ্রের পাশেই সে দেখেছে। মানুষটা নিদ্রকেও শান্তি দিবেনা। ইখলাস সাহেবের জন্যই নিদ্রকে কষ্ট দিয়েছে সে।
নিদ্রের কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে মনে মনে ভাবলো
– হয়তোবা বেশিদিন কপালে থাকবেনা এই সুখ! যতদিন পাবো ততদিন একটু বেশি করে সুখকে আলিঙ্গন করে নিবো। যেন মৃত্যুর সময় আফসোস না থেকে যায়! প্রিয় মানুষকে হারানোর ব্যথা এতোদিনে সে পেয়েছে। নিদ্রও পেয়েছে। এই কষ্ট কি তারা আজীবন বয়ে বেড়াবে?
গাল বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝড়ছে।
জীবন তাকে শুধুই মেকি সুখ দেখিয়েছে।
এখন যাও একটু পেয়েছে তাও হারাতে হবে তাকে।
মনের এককোনায় কেউ একজন বলছে
– ফুটফুটে মেয়ে আর নিদ্রকে রেখে তাকে মরতে হবে।
মৃত্যুর কষ্ট, মা ডাক না শোনার কষ্ট আর নিদ্রকে একা ফেলে চলে যাওয়ার কষ্ট। এতো কষ্ট নিয়ে সে মরবে কীভাবে?
অদ্রি নিজেকে বোঝালো, এসব ভুল ভাবনা। শুধু শুধু চিন্তা করে দিনটাই নষ্ট করার চেষ্টা সে করছে।
নিদ্রের ঘুম থেকে ওঠার আগে নাস্তা রেডি করতে হবে। যদিও খালামনি আছেন। তারপরও লিলি চলে যাবার পরে কাজের চাপ অনেক বেড়েছে তার।
সাবধানে নিদ্রের হাত সরিয়ে দিলো যেন ঘুম ভেঙে না যায়।
গোসল সেরে চুলগুলো গামছা দিয়ে পেঁচিয়ে নিলো। চুলের পানিতে কোমড়ের দিকে কামিজ ভিজে যায়। আবার ফ্লোরও ভিজে যায়।
রান্নাঘরে গিয়ে দেখলো রীতা চায়ের পানি চুলায় দিচ্ছে। অদ্রি জিজ্ঞেস করলো
– খালামনি নাস্তা করেছেন?
রীতা চায়ের কৌটা হাতে নিয়ে বললেন
– আজকে একটু ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে। আবহাওয়া ঠান্ডা ছিলো তো।
কেবল চা বানাচ্ছি।
– তাহলে আমি রুটি না বানিয়ে খিচুড়ি রান্না করি। বাহিরে এখনো বৃষ্টি হচ্ছে। এই সময় খিচুড়ির তুলনা হয়না। আর রশীদ সাহেবকে বলবেন, কাজের জন্য দুইজন লোক যেন ঠিক করেন। পরশুদিন থেকে বাসায় মেহমান আসবে। এতো কাজ আমার আর আপনার দ্বারা করা সম্ভব হবেনা।
– খিচুড়ির সাথে আর কী করবেন?
– কালিজিরা, মেথি, শুটকি মাছ ভর্তা হলে কেমন হয়?
– ভালো হয়। কিন্তু এতো আইটেম করতে করতে সবার খিদে লেগে যাবেনা?
– নিদ্র তো ঘুমুচ্ছে। ওর চিন্তা বাদ। না ঘুমালেও এক কাপ চা আর বিস্কুট হলেও ওর চলবে। নাজমুল সাহেব….. না মানে বাবাও তো মনে হয় ঘুমুচ্ছেন। ওই বাপ – ছেলে একরকম। আর দাদীর কথা জানিনা।
– উনি ভার ভার হয়ে আছেন। একটু আগে নিজেই চা করে নিয়ে গেলেন।
– আমার জন্য।
– না। সে নিজের কথার কাছে হেরে গেছেন তাই।
– বুঝলাম না।
– উনি ভেবেছিলেন তুমি খারাপ চরিত্রের মেয়ে কিন্তু ভুল প্রমাণিত হওয়ায়…. বুঝতেই পারছো।
রীতা অদ্রির চুলের দিকে তাকিয়ে বললেন
– চুল গুলো খুলে দাও। বাতাসে শুকিয়ে যাবে তা নাহলে চুলে উঁকুন হবে। পরে জামাইয়ের কাছে লজ্জা পাবা।
অদ্রি দ্রুত চুল খুলে দিয়ে পিঠের ওপর ছড়িয়ে দিলো।
অদ্রি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো ১১ টা বাজে। ট্রে তে দু’কাপ চা আর ব্রেড নিয়ে দোতলার সিড়ি বেয়ে উঠছে। হঠাৎ সামনের দিকে চোখ চলে গেলো। অদ্রির বরাবর সামনে ইখলাস সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। মুখে সেই বিকট হাসি। অদ্রির পা কাঁপতে লাগলো। সে কী করবে? সামনে এগিয়ে যাবে নাকি ফিরে যাবে?
এদিকে নিদ্রের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। মনে হয় তাকেই ডাকছে।
অদ্রি চোখ মুখ শক্ত করে ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো। ইখলাস সাহেবের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় ফিসফিসানি শুনতে পেলো অদ্রি। যতটুকু বুঝতে পারলো তাতে অদ্রির পুরো শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠলো।
দরজা খুলে রুমে ঢুকতেই দেখলো নিদ্র বিছানা থেকে নামছে।
অদ্রিকে দেখেই নিদ্র প্রায় দৌঁড়ে এসে বললো
– আপনি আমাকে না জানিয়ে কোথায় গেছিলেন?
অদ্রি ট্রে বিছানার উপর রেখে বললো
– রান্নাঘরে।
– আমাকে বলে যাবেননা?
– আপনি ঘুমুচ্ছিলেন তাই ডাকিনি।
অদ্রি জাপটে ধরে নিদ্র বললো
– প্লিজ কখনো এমন করবেন না। অন্ততপক্ষে না ডাকলেন একটা চিরকুট রেখে যাবেন।
– কিছু হয়েছে?
– রাতে আপনি যা বলেছেন আর করেছেন তাতে কিছু না হয়ে পারে? আপনাকে তো এখন চোখের আড়াল করতেই ভয় লাগছে।
অদ্রি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বললো
– ঘুমের ঘোরে আবোলতাবোল বলেছি। ওসব কানে দিবেন না।
নিদ্র অবাক হয়ে বললো
– মোটেও আপনি ঘুমের ঘোরে ছিলেননা। ঘুমের ঘোরে থাকলে ভয়েছে বোঝা যায়।
টপিক চেঞ্জ করার জন্য অদ্রি বললো
– চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। চা খেয়ে নিন তারপর কথা বলা যাবে।
নিদ্র চায়ের কাপ হাতে নিলো ঠিকই কিন্তু মন অন্য কোথাও।
অন্যদিন হলে চা পান করতে হয় খেতে নয় বলতো কিন্তু আজকে তেমন কোনো রেসপন্স করছেনা।
তার ঠিক হয়নি রাতে নিদ্রকে ওসব বলা। নিদ্র যেমন করছিলো তাতে না বলেও উপায় ছিলোনা। না, ভুল উপায় ছিলো।
– নিদ্র!
– হ্যাঁ বলুন
– একটু হাসবেন? সকালের ওই সময়ের মতো করে?
– আপনাকে লাভ বাইট দেয়ার পরে যখন আপনি উঁহু করে শব্দ করলেন তখনকার মতো করে?
– হুম।
অদ্রির খুব লজ্জা লাগছিলো কথাটা বলতে কিন্তু নিদ্রকে স্বাভাবিক করার এছাড়া অন্য কোনো উপায় জানা নেই।
নিদ্র চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বললো
– একটা কন্ডিশন আছে???
নিদ্রের চোখমুখে দুষ্ট হাসি হেসে বেড়াচ্ছে!
অদ্রি নিশ্চিন্ত মনে বললো
– বলে ফেলুন!
চলবে……!
© Maria Kabir