#মন পায়রা
#মাশফিয়াত_সুইটি(ছদ্মনাম)
পর্ব:১৩
‘আপু সর্বনাশ হয়ে গেছে ইফাত ভাইয়ার বড় এক্সিডেন্ট হয়েছে।’
পায়রা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে,
– কি যা তা বলছিস?
– যা তা নয় সত্যি কথা গতকাল এখান থেকে বের হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই এক্সিডেন্ট হয় অবস্থা খুব খারাপ।
পায়রার মাথা যেন ঝিমঝিম করছে। ঘুম থেকে উঠতে অনেক বেলা হয়ে গেছে বাড়ির সবার ডাকে বাধ্য হয়েই দরজা খুলে দেয়। আসমা বেগম জোর করে খাবার খাইয়ে চলে যেতেই বিছানায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে ছিল পায়রা,কিন্তু সাবিহার এমন কথায় মাথা কাজ করছে না চোখ দিয়ে পানি পড়ছে আর ছটফট বেড়ে গেছে। পায়রা বিছানা থেকে নেমে গিয়ে,
– কোন হাসপাতালে আছে ইফাত? এখনি যেতে হবে আমায়।
– তুই গিয়ে কি করবি কাল তো কম অপমান করিসনি তাহলে এখন কেন যেতে চাইছিস?
– পাকামি করবি না এমনিতেই খুব চিন্তা হচ্ছে।
– আমি পাকামি করছি না তোর কি মনে হয় না আজ ইফাত ভাইয়ার এমন অবস্থার জন্য তুই দায়ী। তোকে ভালোবেসে নিজের করে চেয়েছিল এটা কি অন্যায়?
পায়রার মনেও যেন এখন এই কথাই ঘুরছে নিজেকে দোষী মনে হচ্ছে।সাবিহা পায়রার ঘর থেকে চলে গেল, পায়রা মাথা থেকে সবকিছু ঝেড়ে ফেলে দ্রুত নিচে নামলো বাড়ি থেকে বের হতে যাবে তখনি পলাশ শেখ পেছন থেকে ডেকে,
– কোথায় যাচ্ছিস পায়রা?
পায়রার চোখ এখনও ভিজে আছে, কাঁপা কাঁপা গলায়,
– বাবা ইফাতের এক্সিডেন্ট হয়েছে।
পলাশ শেখ ব্রু কুঁচকে,
– কবে?
– গতকাল রাতে।
– এখন কেমন আছে?
– অবস্থা খুব খারাপ।
– আচ্ছা তুই ঘরে যা।
– না বাবা আমি ইফাতের কাছে যাবো নিয়ে যাবে?
কোত্থেকে যেন আবরার চলে এলো পায়রার কাছাকাছি যেতে যেতে,
– কালকের কথা তোর মনে নেই পায়রা? ওই খারাপ ছেলেটাকে আজ দেখতে যেতে চাইছিস।
– আমি কিছু মনে করতে চাই না আমি শুধু ইফাতের কাছে যেতে চাই।
বলেই পায়রা সদর দরজার দিকে যাওয়া ধরলো কিন্তু যেতে পারলো না আবরার পায়রার হাত ধরে নিয়েছে। আবরার রাগ দেখিয়ে,
– তুই কোথাও যাচ্ছিস না ইফাত ম’রে যাক তাতে আমাদের কি? ইফাতের সঙ্গে আমি তোকে দেখা করতে দিবো না।
– আবরার ভাইয়া বেশি হয়ে যাচ্ছে তোমার সাহস হয় কি করে আমার হাত ধরার?
আবরার পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য পলাশ শেখের দিকে তাকিয়ে,
– খালু পায়রাকে যেতে দেওয়া উচিত হবে না কালকের ঘটনা আমরা সবাই দেখেছি এর পরেও…
পলাশ শেখ একটু ভেবে,
– হুম পায়রা ঘরে যা কোথাও যাওয়া হচ্ছে না তোর ইফাতের নাম মুখেও আনবি না আর।
– বাবা এমনটা বলো না আমার ইফাতের কাছে যেতেই হবে।
কেউ আর পায়রার কথা কানে নিলো না আবরার টানতে টানতে পায়রাকে ঘরে নিয়ে গেল। পায়রাকে ঘরে রেখে বাইরে থেকে দরজা আটকে দিলো আবরার। আবরার কিছুতেই চায় না পায়রার সঙ্গে ইফাতের দেখা হোক।
______________
কিছুক্ষণ আগেই ইফাতের জ্ঞান ফিরেছে, মাথা আর হাতে ব্যান্ডজ করা পায়েও কিছুটা আঘাত লেগেছে, হাতে স্যালাইন লাগানো। ইতি বেগম ভেতরে প্রবেশ করেই ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। এনায়েত মির্জা পাশে বসে,
– অনেক কষ্ট হচ্ছে তাই না রে?
ইফাত জোরপূর্বক হেসে,
– না বাবা।
– আরও দু’দিন হাসপাতালে থাকতে হবে তারপর বাড়ি।
ইফাত কিছু বলল না।ইতি বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে,
– দেখে গাড়ি চালাতে পারিস না? কিছু হয়ে গেলে আমার কি হতো?
– দেখেই চালাচ্ছিলাম কিন্তু উল্টো পাশ থেকে একটা ট্রাক এসে ধাক্কা মা’রে গাড়িতে, গাড়ির সাথে সাথে আমার অবস্থাও এমন হয়ে গেল।
একটা নার্স আর ডাক্তার ভেতরে প্রবেশ করে,
– পেশেন্টের সঙ্গে আর কথা বলা যাবে না এখন বিশ্রামের সময়।
ইফাতকে একটা ইনজেকশন পুশ করে ডাক্তার,নার্স চলে গেল।ইতি বেগম এনায়েত মির্জাও কিছুক্ষণ থেকে বেরিয়ে গেল।
ইফাতের দাদী নাতির এক্সিডেন্টের খবর শুনে অসুস্থ হয়ে গেছেন হাসপাতালে আসার জন্য অনেক বলেছেন কিন্তু এনায়েত মির্জা আনেননি যদি আরও অসুস্থ হয়ে যায় এই ভয়ে।
ইতি বেগম বাধ্য হয়ে বাড়িতে চলে গেছেন একদিকে ছেলে হাসপাতালে ভর্তি আরেকদিকে শাশুড়িও অসুস্থ। এনায়েত মির্জা এবং আরাফ হাসপাতালে বসে আছে ইনানকে ইতি বেগমের সঙ্গে পাঠানো হয়েছে।
এনায়েত মির্জা আরাফকে ডেকে,
– যেই ট্রাকের জন্য ইফাতের এক্সিডেন্ট হয়েছে সেই ট্রাক আর ট্রাক মালিকের পুরো ডিটেইলস আমার চাই।
– আমি সকালেই লোক লাগিয়ে দিয়েছি বড় স্যার।
– খুব ভালো,তুমি অনেক উপকার করেছ আরাফ।
– এটা আমার কর্তব্য ইফাত স্যারকে আমিও আপনাদের মতো ভালোবাসি, স্যারের সঙ্গে অনেক দিন ধরে আছি এটুকু সামান্য।
এনায়েত মির্জা আরাফের কাধে হাত রাখলেন।
পায়রা পুরো ঘর উলোট পালোট করে ফেলেছে দরজা ধাক্কানোর পরেও কেউ খুলেনি। কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলে গেছে , হঠাৎ করেই কিছু একটা ভেবে মোবাইল হাতে নিলো।ইনানের নাম্বার পায়রার কাছে আছে তাই ইনানকে কল দিলো কিন্তু ইনান কল ধরছে না অনেকবার কল দেওয়ার পরেও একই অবস্থা। আর কোনো উপায় না পেয়ে এবার সাবিহাকে কল দিতেই সাবিহা রিসিভ করে,
– কি হয়েছে বল?
– আমাকে ঘরে আটকে রেখেছে প্লিজ বের কর এখান থেকে ইফাতের সঙ্গে আমার দেখা করতেই হবে আমি নিজের ভুল শুধরে নিতে চাই একটা সুযোগ করে দে।
– তোর কষ্ট বুঝতে পারছি কিন্তু তোকে ঘর থেকে বের করা সম্ভব নয় আবরার ভাইয়া এখনও আমাদের বাড়িতেই ঘরে তালা দেওয়া চাবিও তার কাছে।
– আমি কি ইফাতকে দেখতে পারবো না?
– আমি দেখছি কি করা যায় আর চিন্তা করিস না ইফাত ভাইয়ার জ্ঞান ফিরেছে এখনও হাসপাতালে। হাসপাতাল থেকে রিলিজ হলে না হয় দেখা করবি।
পায়রা আর কিছু বলল না ফোনটা রেখে দিলো ইফাতের জ্ঞান ফেরার কথা শুনে ভয় কিছুটা কমেছে তবে চোখ থেকে পানি পড়া বন্ধ হয়নি।
আবরার নিজের বাড়িতে যেতেই আতিফা বেগম ছেলেকে ডেকে,
– এভাবে পায়রাকে আটকে রাখা তোর উচিত হয়নি।
– ওকে আটকে না রাখলে ইফাতের কাছে চলে যেত।
– জোর করে কোনো কিছুই হয় না নিজ যোগ্যতায় অর্জন করে নিতে হয় তোর কি মনে হয় এভাবে আটকে রাখলেই পায়রা ইফাতকে ভুলে যাবে?
– ভুলতে ও বাধ্য না ভুললেও সমস্যা নেই বিয়ের পর ঠিক হয়ে যাবে।
– তোর ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলের কারণে ওই সময় তোদের বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলাম এখন বুঝতে পারছি কতবড় ভুল করেছি হয়তো আমাকেও ভোগতে হবে।
– এতকিছু চিন্তা করো না তো আমি ঘরে গেলাম।
আতিফা বেগম নাস্তা নিয়ে আবরারের ঘরে গেছিলেন আবরার ফোনে কারো সঙ্গে কথা বলছিল আর তখনি সবটা তিনি শুনেন।আবরারকে অনেক বুঝান কিন্তু আবরার কিছু বুঝলো না বরং উনাকে বলল,’তুমি যদি এসব কাউকে বলে দাও তাহলে আমি নিজের ক্ষতি করে ফেলব মা।’
ছেলের প্রতি ভালোবাসায় অন্যায় চুপ করে মেনে নিয়েছেন।
_______________
দু’দিন কেটে গেল ইফাতের অবস্থা আগের থেকে বেশ ভালো কিন্তু ঠিক মতো হাঁটতে পারে না পায়ের ক্ষত এখনও পুরোপুরি ভালো হয়নি ডাক্তার বলে দিয়েছে এক মাস বিশ্রাম নিতে হবে। ইফাতকে ইনান আর আরাফ মিলে বাড়িতে নিয়ে এসেছে।ড্রয়িং রুমে দাদীর সঙ্গে দেখা করে তার অভিমান ভাঙিয়ে তারপর নিজের ঘরে গেছে বলতে গেলে আরাফ দিয়ে এসেছে।
তিনদিন ধরে খাঁচার বন্দি পাখিদের মতো পায়রাও বন্দি হয়ে আছে নিজের ঘরে।মেয়ের কান্নাকাটি, অভিমানে পলাশ শেখের মন গললেও আবরারের বিভিন্ন যৌক্তিক কথায় আবারো কঠোর হয়ে গেছেন। আবরারের পরামর্শে এনায়েত মির্জার সঙ্গে পার্টনারশিপ বিজনেসটাও শেষ করে দিয়েছেন, ইফাতের কানেও খবরটা পৌঁছে গেছে।
একটা ভুল বোঝাবুঝিতেই দুই পরিবারের এতদিনের সম্পর্ক মুহূর্তেই শেষ হয়ে গেছে।
রাত সাড়ে দশটা ছুঁইছুঁই বাড়ির সবাই রাতের খাবার খেয়ে যে যার ঘরে চলে গেছে আবরার নিজে এসে পায়রার খাবার দিয়ে পুনরায় ঘরে তালা দিয়ে চলে গেছে। আবরারক সহ্য হচ্ছে না পায়রার খাবার যেমন রেখে গেছে তেমনি আছে। পায়রার মোবাইলে সাবিহার নাম্বার থেকে ফোন আসতেই পায়রা রিসিভ করে কানে ধরল। সাবিহা অপরপাশ থেকে,
– আপু এক কাজ করলে কেমন হয় ইফাত ভাইয়া যেভাবে তোর সঙ্গে দেখা করতে আসতো তুইও সেভাবেই ঘর থেকে বেরিয়ে যা কেউ টের পাবে না।
পায়রার কথা শুনতেই মনে মনে নিজেকে তিরষ্কার করে,’ এই বুদ্ধিটা কেন তোর মাথায় আসলো না পায়রা’?
পায়রার সাড়াশব্দ না পেয়ে সাবিহা অধৈর্য হয়ে,
– আপু শুনতে পাচ্ছিস?
– হ্যা বল।
– ইফাত ভাইয়ার বাসা তো চিনিসই, ইনানকে সব বলে দিয়েছি। ইনান তোকে লুকিয়ে ভাইয়ার সঙ্গে দেখা করিয়ে দিবে সাবধানে যাস যাতে ওদের বাড়ির কেউ জানতে না পারে।
– আচ্ছা ধন্যবাদ রে।
– ধন্যবাদ দিতে হবে না যা বলছি তাই কর সাথে মোবাইল আর টাকা নিয়ে যাস, টাকা আছে তো তোর কাছে?
– হুম আছে।
পায়রা দরজা ভেতর দিয়ে আটকে দিলো যাতে তালা খুলেও ভেতরে কেউ প্রবেশ করতে না পারে তারপর কাধ ব্যাগ নিয়ে বারান্দার পাশের পাইপ বেয়ে নিচে নেমে গেল। ইনান গেটের কাছে পায়রার জন্য অপেক্ষা করছে সাবিহা তাকে সবটা বলেছে প্রথমে রাজি না হলেও নিজের ভাইয়ের কথা ভেবে পরে রাজি হয়েছে।
ইফাতদের বাড়ির সামনে আসতে আসতে প্রায় বারোটা বেজে গেছে। লুকিয়ে হেঁটে হেঁটে আসতেই এতোটা সময় লেগেছে আর রাতে গাড়িও ঠিক মতো পাওয়া যায় না পাওয়া গেলেও খালি গাড়িতে একা উঠা অনেক ঝুঁকি।
সবাই গভীর ঘুমে মগ্ন শুধু ঘুম নেই ইফাতের চোখে বিছানায় সোজা হয়ে শুয়ে আছে অন্ধকার ঘর কি ভাবনায় মত্ত হয়ে আছে তা সেই জানে। দরজা চাপানো রয়েছে হেঁটে গিয়ে দরজা আটকানোর মতো শক্তি পায়ে নেই তবে ডাক্তার বলেছে ঠিক মতো ওষুধ খেলে এবং বিশ্রাম নিলে ঠিক হয়ে যাবে শিঘ্রই।
পায়রা ইফাতের বাড়ির সামনে এসে ইনানকে ফোন দিলো। ইনান পায়রার ফোন পেয়ে গেইটের কাছে এগিয়ে গিয়ে পায়রাকে দেখতে পেয়ে,
– যখন সময় ছিল তখন অবহেলা করলে এখন সবাই তোমাদের সম্পর্কের বিরুদ্ধে তখন এসেছ।
– আমি ইফাতের কাছে যাবো।
– ভাইয়ার কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্যই তো ঝুঁকি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি বাবা-মা দেখলে আমাকে কি যে করবে কে জানে।
পায়রা ইনানের পিছু পিছু যাচ্ছে। ইনান ইচ্ছে মতো সুযোগ পেয়ে পায়রাকে কথা শুনাচ্ছে আর সামনে এগুচ্ছে।
– ভাইয়ার সম্পর্কে জেনেও ভুল বুঝে চরিত্রহীন উপাধি দিলে এখন আবার কি মতলবে দেখা করতে এসেছ বলো তো? সাবিহার কথা ফেলতে পারি না তাই বাধ্য হয়ে রাজি হয়েছি নইলে কখনও তোমার সঙ্গে ভাইয়ার দেখা করাতাম না।
অন্য সময় হলে হয়তো পায়রা রেগে যেত কিন্তু আজ পায়রা একটুও রাগছে না কারণ সে জানে দোষটা সম্পূর্ণ তার। পায়রা ভেবে নিয়েছে যা হওয়ার হোক আজ সব সত্য ইফাতকে বলে দিয়ে সব ভুল বোঝাবুঝি ঠিক করে নিবে।
পায়রা ইনানকে প্রশ্ন করল,
– ইফাত কি জানে আমি ওর সঙ্গে দেখা করতে আসছি?
– না।
– জানলে কি দেখা করতো না ইফাত কি আমার উপর রেগে আছে?
– জানি না।
পায়রা আর কিছু জিজ্ঞাসা করল না বাড়ির ভেতরে তারা প্রবেশ করেছে ইনান ভালো করে আবারো চারিদিক দেখে নিলো কেউ আছে কিনা কিন্তু না কাউকে দেখা গেল না। সবাই ঘুমাচ্ছে ভেবে মনে মনে খুশি হলো ইনান পায়রাকে ফিসফিস করে বলল,
– শুনো পায়রা আস্তে আস্তে পা ফেলে আসবে কেউ দেখে ফেললেই বিপদ।
পায়রা মাথা ঝাকালো তারপর দু’জনে সিঁড়ির কাছাকাছি গেল তৎক্ষণাৎ ড্রয়িং রুমের বড় ঝাড়বাতি জ্বলে উঠলো ইনানের ভেতরটা ভয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে।ইনান আর পায়রা পেছনে ঘুরেই ভয় পেয়ে গেছে ইনান রীতিমত ঘামতে শুরু করে দিয়েছে।
চলবে….