#মন পায়রা
#মাশফিয়াত_সুইটি(ছদ্মনাম)
পর্ব:০৯
দু’দিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে তবে মুষলধারে নয় হঠাৎ করেই আকাশ কালো রঙ ধারণ করে বৃষ্টি শুরু হয় আবার কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি শেষ হয়ে রোদ নামে।আজও হঠাৎ করেই বৃষ্টি পড়া শুরু হয়ে গেছে সকাল থেকে আবহাওয়া বেশ ভালো ছিল কিন্তু মুহূর্তেই খারাপ। ভার্সিটি ছুটি হয়েছে দশ মিনিট আগে কিন্তু ভার্সিটির চারিপাশ জনমানবে ভরা। আজ আবরার পায়রা এবং অশমিকে নিতে এসেছিল পায়রার বৃষ্টি খুব পছন্দের তাই আবরারকে দেখা মাত্র লুকিয়ে পড়েছে। অশমি গাড়িতে উঠে গেছে কিন্তু পায়রাকে এখনও দেখতে পায়নি আবরার।অশমিও অনেকবার খুঁজেছে পায়নি আবরার একনাগাড়ে পায়রাকে কল দিচ্ছে পায়রা এবার বিরক্ত নিয়ে কল ধরে,
– কি হয়েছে ভাইয়া?
– কোথায় তুই?তোর জন্য কখন ধরে অপেক্ষা করছি।
– আমি বেরিয়ে গেছি তোমরাও চলে যাও।
– বেরিয়ে গেছিস মানে? আমি যে নিতে এলাম।
– তুমি তো অশমিকে নিতে এসেছিলে নিয়ে চলে আসো রাখলাম।
পায়রা কল কেটে দিল।আবরারের রাগ হচ্ছে বুঝতে পারছে পায়রা তাকে ইগনোর করছে।অশমি জিজ্ঞেস করল,
– কি বলল পায়রা?
– ও নাকি চলে গেছে।
– এই বৃষ্টির মধ্যে কখন গেল?
– জানি না কি আর করার চলে গেছে যখন।
আবরার গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বোনকে নিয়ে চলে গেল।আবরারের গাড়ি যেতেই পায়রা ভিড় থেকে বের হয়ে বাইরে বের হল। বৃষ্টিতে ভিজতে গেলে সবসময় কেউ না কেউ বাঁধা দেয় কিন্তু আজ যেন সব বাঁধা অতিক্রম করে পায়রা বৃষ্টিতে ভিজছে মনে মনে ভেবে নিয়েছে আজ ভিজতে ভিজতে বাড়িতে যাবে।
রাস্তায় তেমন কোনো মানুষ নেই বৃষ্টি শুরু হতেই রাস্তার কিছু পথচারীরা দোকানের ছাউনিতে আশ্রয় নিয়েছে যাদের কাছে ছাতা ছিল তারা ছাতা মাথায় দিয়ে যাতায়াত করছে। পায়রা পুরোপুরি ভিজে গেছে কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটাও ভিজে গেছে কিন্তু তাতে কোনো হেলদোল নেই সে তো বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আপনমনে হাঁটছে।
পায়রার সামনে আচমকা একটা গাড়ি এসে থেমে যায় হুট করে এমন হওয়ায় কিছুটা হকচকিয়ে গেছে পায়রা কিন্তু গাড়ি দেখেই বুঝে গেছে এটা কার গাড়ি। গাড়ির কাঁচ নামিয়ে ইফাত পায়রার দিকে তাকিয়ে,
– এভাবে বৃষ্টিতে ভিজছো কেন? অসুস্থ হয়ে যাবে তো।
– তাতে আপনার কি সবসময় পেছনে পরে থাকে।
– আমার অনেক কিছু তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠো।
পায়রা কিছু না বলে গাড়ির পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে ইফাত আর কোনো উপায় না পেয়ে গাড়ির পেছনের সিট থেকে ছাতা নিয়ে নেমে পড়লো। দ্রুত গিয়ে পায়রার মাথার উপর ছাতা ধরে,
– গাড়িতে চলো আমি বাড়িতে দিয়ে আসছি।
– আপনাকে কি আমি বলেছি বাড়িতে দিয়ে আসতে এত মাতবরি করেন কেন?
– আমার যা ইচ্ছে করবো।
– আমিও।
– উহু আমি যা বলবো তুমি তাই করবে।
– জোর জবরদস্তি নাকি?
– যা মনে করো।
– সরুন সামনে থেকে আমাকে যেতে দিন।
– মাথা গরম করো না জানো তো আমার রাগ উঠলে আমি কি করতে পারি তাই চুপচাপ গাড়িতে উঠো।
পায়রাও ইফাতের হাত থেকে ছাতাটা টেনে ফেলে দিয়ে রাগ দেখিয়ে,
– যা করার করে নিন আমি আপনাকে মুটেও ভয় পাইনা।
ছাতা ফেলে দেওয়ার কারণে ইফাতও অনেকটা ভিজে গেছে।পায়রা আবারও ইফাতকে পাশ কাটিয়ে চলে যাবে সাথে সাথে ইফাত পায়রার হাত ধরে টেনে গাড়ির কাছে নিয়ে যাওয়া শুরু করল পায়রা ছাড়ানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে।
ইফাত গাড়ি চালাচ্ছে পায়রা পাশের সিটে বসে আছে। মুখে অন্ধকার নেমে এসেছে ইফাত কোনো কথা বলল না কারণ হিতে বিপরীত হবে। পায়রার বাড়ির সামনে গাড়ি থামতেই গাড়ি থেকে নেমে কোনদিকে না তাকিয়ে পায়রা ভেতরে চলে গেল ইফাতও গাড়ি ঘুরিয়ে নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে চলে গেল।
ভেজা অবস্থায় বাড়িতে ঢুকতেই মায়ের ঝাড়ি খেতে হয়েছে পায়রার এতে রাগ বেড়ে গেছে ঘরে গিয়ে জামা-কাপড় পাল্টে বিছানায় শুয়ে পড়েছে।
ইফাত চুপিসারে বাড়িতে এসে নিজের ঘরে চলে গেল ভেবেছে মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে দ্রুত চেঞ্জ করে ফেলবে কিন্তু তার আসায় পানি ঢেলে দিল তার মা। নিজের ঘরে প্রবেশ করতেই ইতি বেগমকে দেখে চমকে গেছে ইফাত।ইতি বেগম ছেলের এমন অবস্থা দেখে ব্রু কুঁচকে,
– কিরে তুই ভিজলি কিভাবে?
– বৃষ্টিতে ভিজে গেছি।
– কিভাবে?
– তোমায় এখন দেখাব কি করে!
– দেখাতে হবে কেন আমি বলতে চাইছি গাড়িতে ছাতা থাকার পরেও ভিজলি কিভাবে?
– এত প্রশ্ন করছো কেন মা তুমি কি গোয়েন্দা হয়ে গেছো?
– তোদের দুই ভাইয়ের জন্য হতে হয়েছে।
– তুমি আমার ঘরে এ সময়?
– গুছাতে এসেছিলাম।
– ওহ।
– দাঁড়িয়ে না থেকে জামা-কাপড় পাল্টে আয় আমি গরম কফি আনছি তোর তো বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর আসে।
ইফাত দ্রুত ওয়াশরুমে চলে গেল একেবারে শাওয়ার নিয়ে বের হয়েছে। ঘরে আসতেই টেবিলে ধুঁয়া উঠা কফির কাপ চোখে পড়তেই ইফাত সোফায় বসে কফি পুরোটা শেষ করল। বসে থাকতে আর ভালো লাগছে না শরীরটা কেমন যেন ব্যথা লাগছে ইফাতের। বিছানায় গিয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল। বিছানায় শুতেই ঘুমিয়ে গেছে ইফাত, ইতি বেগম খাবার নিয়ে এসেছিলেন কিন্তু খাওয়াতে পারেননি।
________________
অশমি টিভি দেখছিল আবরার পাশে বসে একটা খাম এগিয়ে দিল অশমিও খামটা নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখে,
– এতে কি আছে ভাইয়া?
আবরার বাঁকা হেসে,
– খুলে দেখ।
অশমি খামটা খুলতেই ভেতরে কিছু ছবি দেখতে পেল ছবিগুলো বের করে ভালো ভাবে দেখতেই চমকে গেল ভাইয়ের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আবরার হেসে,
– এইভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?
– এই ছবিগুলো কিভাবে কি আমি তো কখনও..
– আরে বোকা এগুলো আমার পরিচিত এক স্টুডিও থেকে এডিট করিয়েছি।
– কিন্তু এগুলো দিয়ে কি হবে? মা-বাবা দেখলে আমাকে মে’রে’ই ফেলবে।
– ওরা কেউ দেখবে না এই ছবিগুলো শুধু পায়রার জন্য।
– পায়রার জন্য!
– হ্যা এই ছবিগুলোর মাধ্যমেই আমাদের চাওয়া পূরণ হবে তুই কাল একান্তে ছবিগুলো নিয়ে পায়রার কাছে যাবি তারপর আমি যা যা শিখিয়ে দিব ঠিক তাই তাই বলবি ব্যস তারপরেই কাজ শেষ।
অশমি খুশিতে গদগদ হয়ে,
– উফ ভাইয়া তোর কি বুদ্ধি।
আবরার হাসলো।অশমিকে কি কি করতে হবে সব বুঝিয়ে দিল অশমিও ভালো করে বুঝে নিলো এখন শুধু কালকের অপেক্ষা।
_______________
‘তুমি আমার কল রিসিভ করতে দেরি করলে কেন? এখন কি আমাকে ভালো লাগে না? সারাদিন কোন মেয়ের কাছে ছিলে উওর দাও।
– সাবিহা তুমি আমাকে সন্দেহ করছো? এই তোমার ভালোবাসা? আমি তো খাওয়ার সময়ও তোমার কথা ভাবি ঘুমানোর সময় তোমাকে কল্পনা করি আর তুমি কিনা।
– তাহলে আমার কল ধরছিলে না কেন?
– একটা কাজে খুব ব্যস্ত ছিলাম তাই ধরতে পারিনি তবে এখন পুরোপুরি ফ্রি আজ সারারাত তোমার সঙ্গে কথা বলবো।
– কাল কলেজে যেতে হবে ইনান।দেরি করে ঘুমালে সকালে উঠতে দেরি হয়ে যাবে কলেজেও যেতে পারবো না তখন মা আমাকে বকবে।
– আচ্ছা ঘুমাও গুড নাইট কাল দেখা হবে আমাদের।
– ঠিক আছে গুড নাইট।
সাবিহা আর ইনান দু’জন দু’জনের সঙ্গে ফোনে কথা বলে ঘুমাতে চলে গেল।
_____________
মাঝরাতে ইফাতের ঘুম ভেঙ্গে গেল শরীর এখনও দুর্বল এবং গরম।ইতি বেগম এতক্ষণ ইফাতের ঘরেই ছিলেন জ্বর কমার জন্য মাথায় পানি ঢেলেছেন। ইফাতের জ্বর কমতেই দরজা চাপিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেছেন।ইফাত ফ্রেশ হয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে মাথাটা এখনও ধরে আছে তৎক্ষণাৎ কিছু একটা ভেবে,
– সামান্য একটু বৃষ্টিতে ভিজেই আমার এমন হাল তাহলে পায়রা তো অনেকক্ষণ ভিজেছে। পায়রা ঠিক আছে তো?
পায়রার জন্য ইফাতের অনেক চিন্তা হচ্ছে মোবাইল হাতে নিয়ে পায়রার নাম্বারে কল দিল কিন্তু আশাহত হল পায়রা পুনরায় তার নাম্বার ব্লক লিস্টে রেখে দিয়েছে। ইফাতের চিন্তা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে কোনো উপায় না পেয়ে আলমারি থেকে একটা শার্ট বের করে গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।
পায়রারও অনেক জ্বর এসেছিল আসমা বেগম জোর করে খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে দিয়েছিলেন যার কারণে জ্বর তেমন কাবু করতে পারেনি পায়রাকে। পায়রা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে, ইফাত এর আগেও পায়রার ঘরে পাইপ বেয়ে আসায় একটা অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে আজও ঠিক সেভাবেই পায়রার ঘরে প্রবেশ করেছে। ঘরটা পুরো অন্ধকার ইফাত মোবাইলের ফ্লাশ লাইট জ্বালিয়ে ভেতরে গেল। পায়রার ঘরের দরজা খোলা ইফাত গিয়ে দ্রুত লাগিয়ে দিল যাতে কেউ তাকে না দেখে। বিছানার একপাশে বসে পায়রার কপালে হাত রাখল তেমন জ্বর নেই তবে শরীরটা একটু গরম।কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে পায়রার ঘুম হালকা হয়ে গেছে পিটপিট করে চোখ খুলে সামনে তাকাতেই অবাক হয়ে,
– আপনি!!
ইফাত পায়রার ঠোঁটে আঙুল রেখে,
– আসতে কথা বলো কেউ শুনে ফেলবে।
পায়রা উঠে বসে,
– আপনি কেন আসলেন? আজ তো দেখা হয়েছে আমাদের।
– দেখা করার জন্য আসিনি।
– তাহলে?
– বৃষ্টিতে ভেজার কারণে আমার জ্বর এসেছিল তাই মনে হল তোমারও যদি জ্বর আসে এসব ভেবেই দেখতে চলে এসেছি কল করেছিলাম কিন্তু তুমি তো আবার ব্লক করে দিয়েছো।
পায়রা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সে ভেবে পাচ্ছে না এই লোকটার কি মাথায় সমস্যা নাকি তাকে একটু বেশিই ভালোবাসে।পায়রা ইফাতের কপালে হাত রাখতেই ইফাত বলল,
– কি হয়েছে?
– আপনার শরীর তো এখনও গরম জ্বর পুরোপুরি কমেনি আগে এসেছেন ঠিক আছে তাই বলে অসুখ নিয়ে আসতে হবে?
– বললাম তো চিন্তা হচ্ছিল না আসলে চিন্তার কারণে আরও বেশি অসুস্থ হয়ে যেতাম।
– আপনি কি পাগল? কোনো মানুষ এভাবে নিজের কথা না ভেবে এমন পাগলামি করে?
– পাগল নাকি জানি না তবে তোমার মতে তো আমি পাগলই।
বাইরে থেকে পায়রার দরজায় টোকা পরলো। পায়রা আর ইফাত দু’জন দু’জনের মুখের দিকে চাওয়া চাওয়ি করল। বাইরে থেকে পলাশ শেখ বলে উঠলেন,
– পায়রা মা কার সঙ্গে কথা বলছিস? জ্বর কমেছে?
পায়রা উঁচু গলায়,
– কই কারো সঙ্গে কথা বলছি না তো।
– দরজাটা খোল।
– বাবা আমি শুয়ে আছি ঘুম পাচ্ছে কাল কথা হবে গুড নাইট।
পলাশ শেখ আর কিছু বললেন না সোজা নিজের ঘরে চলে গেলেন।ইফাত পায়রার দিকে তাকিয়ে,
– তুমি তাহলে ঘুমাও আমি আসি।
ইফাত উঠতে যাচ্ছিল পায়রা হাত ধরে বসিয়ে দিয়ে,
– যাচ্ছেন মানে এখনি তো এলেন।যাবেন যখন এলেন কেন?
– আমি তো তোমায় দেখতে এসেছিলাম কিন্তু তুমি জেগে যাবে বুঝতে পারিনি দেখা শেষ এখন চলে যাব।
– সাবধানে যাবেন পৌঁছে একটা কল দিয়েন।
– বললাম তো তুমি ব্লক করে রেখেছ।
– ব্লক খুলে দিচ্ছি কল দিতে ভুলবেন না কিন্তু।
ইফাত প্রতিত্ত্যুরে মৃদু হাসল তারপর যেভাবে উঠেছিল সেভাবেই নেমে গেছে। পায়রা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ইফাতের যাওয়া দেখছে।ইফাত চলে যেতেই ঘরে এসে বিছানায় বসে, ‘সত্যি এই লোকটাকে নিয়ে পারা যায় না এতদিন পাগল মনে হতো এখন পুরোপুরি অদ্ভুত মনে হয় নাহলে কেউ অসুস্থতা নিয়ে এভাবে আসে।’
ইফাত আজও ইতি বেগমের কাছে ধরা খেয়ে গেছে।ইতি বেগম ইফাতের দিকে তাকিয়ে আছে দেখেই বুঝা যাচ্ছে রেগে আছে।ইফাত ঢুক গিলে,
– মা…
– একদম চুপ অসুস্থ শরীর নিয়ে কোথায় গিয়েছিলি? নিশ্চই পায়রার কাছে আচ্ছা কাল কি দেখতে পারতি না অসুখ নিয়ে কেন যেতে হবে?
– আসলে মা ও বৃষ্টিতে ভিজেছিল তাই আর কি
– তাই আর কি নিজের কথা ভুলে ওর সেবা করতে গেলে।
– উহু দেখতে গিয়েছিলাম।
– দেখা হয়ে গেছে?
– হুম।
– জ্বর কমেছে পায়রার?
– হুম।
– তাহলে এখনও দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়।
ইফাত মায়ের ধমক খেয়ে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়লো।
চলবে……..