#মন_গোপনের_কথা
#পর্ব_৪৮
লেখনীতে, পুষ্পিতা প্রিমা
সকাল সাতটা বেজে গেছে। ছিকুর জন্য ফিমেল টিউটর রাখা হয়েছে। যাতে আদর করে করে পড়ায়। মেয়েটার নাম শিমুল। চিকনচাকন পাতলা গড়নের হাসিখুশি মেয়ে। ছিকুর সাথে প্রথম দিন বেশ ভালো ভাব হয়েছে। ভাব বলতে অবশ্য ছিকুর কেন কেন প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাওয়া। অন্য কিছু নয়। মানে পড়ালেখার কোনো বিষয় নিয়ে নয়। আজ দুদিন হয়েছে পড়াতে আসছে। পরী বলেছে সকালে পড়িয়ে যেতে। সকালে যাও পড়তে চায়। কিন্তু বিকেলে খেলা ছাড়া কিছু বুঝেনা। হাত থেকে বল নিয়ে ফেললে মেঝেতে গড়াগড়ি খেয়ে কাঁদবে। মারলে ও পড়বেনা। বরং কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়বে।
শিমুল এসেছে অনেকক্ষণ হলো। ছিকুর খাওয়া এখনো শেষ হয়নি। নিজের হাতে সে পুডিং খাচ্ছে। পরী বলল
তাড়াতাড়ি করেন। টিচার এসেছে।
ছিকু ভুরু কুঁচকে তাকালো। খেতে খেতে বলল
পরী খেতি দেয় না কেন? দিরি হবে কেন?
দেরী হবে না। তাড়াতাড়ি খান ৷ এদিকে দেন আমি খাইয়ে দেই।
ছিকু পেয়ালা নিয়ে সোফা থেকে নেমে পড়লো। হেঁটে হেঁটে খেতে খেতে বলল
পুডি মুজা মুজা।
পরী তার পেছন পেছন ঘ্যানঘ্যান করতেই আছে। রেহান অফিসে বের হবে। পরীকে ছিকুর পেছনে দৌড়াদৌড়ি করতে দেখলো। সে গিয়ে ছিকুকে কোলে তুলে নিল। পানি খাইয়ে মুখ মুছে দিয়ে টিচারের কাছে নিয়ে গেল। বলল
টিচারকে সালাম দাও।
ছিকু হাত কপালে ঠেকিয়ে টিচারের দিকে তাকিয়ে থাকলো। শিমুল হেসে বলল
আচ্ছা আপনারা যান ভাইয়া। পড়া শুরু করি।
রেহান তাকে আদর করে বেরিয়ে পড়লো। ছিকু তাকে ডেকে বলল
বিশিবিশি ললিপপ, বিশিবিশি চকলেট।
রেহান বলল
আচ্ছা। বিশিবিশি আনব। কিন্তু আপনাকে পড়তে হবে।
ছিকু হাত নাড়িয়ে টা টা দিল। শিমুল বলল
গতদিন পড়তে বসার পর টিচারকে কি জিজ্ঞেস করতে বলেছিলাম রাহিয়ান?
ছিকু কপাল কুঁচকে কিছু একটা ভাবলো। তারপর মনে পড়তেই খিক করে হেসে বল
হাউ আর ইউ, আয়েম ফেন টেংকিউ।
শিমুল চোখ তুলে তাকালো।
ওহহো। এইভাবে না।
বলবেন, হাউ আর ইউ টিচার?
আম ফেন টেংকিউ চিটার।
শিমুল হাসি চাপা দিল। বলল
ঠিক করে শুনুন। বলবেন হাউ আর ইউ টিচার?
আমি বলব, আ’ম ফাইন। থেংকিউ। এন্ড ইউ?
তুমি বলবে,
আম অলসো ফাইন।
যাইহোক আমরা এখন অ আ শিখব। দেন এলপাবেট শিখবো।
বলো সরিঅ (অ), সরাইয়া ( আ)।
ছিকু শিমুলের মুখে মুখে বলল,
চনিঅ, চনাইয়া। চিটার পুঁচাইয়া।
শিমুল বলল
কিহ?
ছিকু ভড়কে গেল। শিমুল পরীর দেয়া বেতটা দেখিয়ে দেখিয়ে বলল
খুব মারব দুষ্টুমি করলে।
ছিকু কিছুক্ষণ থম মেরে চেয়ে রইলো শিমুলের দিকে। শিমুল বলল
পড়ুন।
ছিকু নিচের ঠোঁট উল্টে বলল
চবাইকে বুলে দিবো।
একদম চুপ। চুপচাপ পড়ুন।
দাদুউউউ চিটার বুকা দিচে। দাদুউউ। কিউ নাই কেন?
হা করে গালটা ছেড়ে দিয়ে কাঁদতে লাগলো ছিকু। শিমুল মাথায় হাত দিল। এ ধরণের কত বাচ্চা সে পড়িয়েছে। এরকম তো কেউ ছিল না। এটা এত বিচ্ছু কেন?
রাইনা ছুটে আসতেই পরী আটকালো। বলল
তুমি ওকে লাই দিয়ে দিয়ে বাঁদড় বানাচ্ছ মা। যেওনা।
ওকে কি মারতেছে নাকি?
মারছেনা। বকেছে তাই চিল্লাচ্ছে। কেউ না গেলে চিল্লিয়ে আপনাআপনি ঠিক হয়ে যাবে।
যাই না? একটু আদর করে দিয়ে আসি। কিভাবে ডাকতেছে আমাকে।
ডাকুক। এ সময় কে লাই দেবে সেটা সে জানে তাই ডাকছে। তুমি যেতে পারবে না। ওর পাপা বারণ করেছে পড়ার সময় কাউকে না যেতে।
এটা কোনো কথা হলো? আমার নাতিটা কিভাবে কাঁদে। একটু কম বকাঝকা করতে বলিস।
রাইনা বকবক করতে করতে চলে গেল। পরী রুমে উঁকি দিয়ে দেখলো কান্না থেমে গিয়েছে। শিমুল মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে দিয়ে আদর করে পড়াচ্ছে। নিজের অজান্তেই হাসলো পরী। এটুকুনি এটাকে এত পাম্প দিতে হয়। বড় হলে কিভাবে পড়াতে হবে কে জানে?
পিহু এসে বলল
ও কোথায়?
পড়ছে। শিমুল এসেছে। তুমি যেওনা।
পিহু উঁকি দিল সেই ঘরে। দেখলো শিমুলের মুখে মুখে পড়ছে ছিকু। পিহু ফিসফিসিয়ে ডাকলো
কলিজা!
ছিকু চট করে দরজার কাছে চোখ দিল। পরী বলল
আহা কি করছ?
পিহু কথা শুনলো না। বলল
মন দিয়ে পড়েন। পড়া শেষ হলে এত্তগুলা আদর দিবো।
আদর খিতে মন চায় না কেন?
তো কি খাবেন?
ললিপপ খিতে মন চায় কেন?
আচ্ছা মিহিকে বলব ললিপপ আনার জন্য । এখন পড়েন মন দিয়ে। টা টা।
চি ইউ।
শিমুল গালে হাত দিয়ে ছিকুর দিকে তাকালো। গালে আদর হাত বুলিয়ে গালটা টেনে দিয়ে বলল
পাকা পাকা কথা তো কাউকে শিখিয়ে দিতে হয় না। পড়া কেন শিখিয়ে দিতে হয়?
ছিকু বলল
চনিঅ। চনাইয়া।
এভাবে না।
সরি অ। সরাইয়া।
চরাইয়া।
শিমুল হেসে উঠলো। ছিকু বলল
চিটার বিটিফুল কেনন?
শিমুল এবার জোরে হেসে ফেলল।
_____________
ইশা প্লেটে করে ভাত নিয়ে আসলো। পিহুর ঘরে প্রবেশ করে বলল
মাহি কই তুই?
মাহিদ ঘাড় ঘুরিয়ে চাইলো। পিহু ঘড়িটা এনে মাহিদকে দিল। বলল
ভাত খাবে না বলছে।
কেন খাবেনা। নাশতা ও তো বেশি খাইনি। মাহি আমি খাইয়ে দেই।
না না খাব না। সকালে ভাত খাইনা আমি।
ইশা বলল
না খাহ। এখানে খেতে হবে। তোর মা কি বলবে? বলবে আমার ছেলেটাকে খালি পেটো পাঠিয়ে দিয়েছে।
মাহিদ খাবেনা মানে খাবে না। ইশা বলল
এটা তোর শ্বশুরবাড়ি এখন। আর আমি তোর শ্বাশুড়ি। শ্বাশুড়ির কথা শুনতে হয়।
মাহিদ ভুরু কুঁচকে তাকালো। ইশা বলল
এভাবে দেখছিস কেন? ঠিকই বলেছি।
পিহু হেসে ফেলল। ইশা বলল
এদিকে আয়। খাহ। নইলে যেতে পারবি না। আয়। খাবার ফিরিয়ে দিতে নেই।
মাহিদ ইশার জোরাজোরিতে খেল। খেতে খেতে ধনেপাতা পেঁয়াজ দেখিয়ে বলল
এগুলো সাইডে সরাও।
ইশা হেসে বলল
এত বদঅভ্যেস কেন তোর?
কত বদঅভ্যেস সবই তো জানো। তারপরেও মেয়ে দিছো কেন?
ইশা চোখ ছোট ছোট করে তাকালো। পিহুকে এক লোকমা খাইয়ে দিয়ে বলল
সেটা তুই নিজেকে জিজ্ঞেস কর। উত্তর পেয়ে যাবি।
মাহিদ হাসলো। বলল
ঠিক আছে।
দুজনকে পানি খাইয়ে দিয়ে ইশা চলে গেল। মাহিদ পেটে হাত বুলিয়ে বলল
তোর বাপের বাড়ি দুইদিন থাকলে আমি ঢোল হয়ে যামু বাপ।
পিহু নাকমুখ কুঁচকে বলল
আমি তোমার বাপ না। কথায় কথায় একদম বাপ বাপ বলবানা মাহিদ ভাই।
মাহিদ চোখ সরু করে চাইলো। পিহু জিভে কামড় দিয়ে দু পা পিছিয়ে গিয়ে বলল
সরি।
মাহিদ নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে এগিয়ে গিয়ে বলল
কি বললি?
পিহু হেসে উঠে পালাতে গেল। মাহিদ খপ করে ধরে টেনে এনে বলল
তোর বাচ্চাকাচ্চা আমারে মামু ডাকবো। সমস্যা কি? তুই ভাই ডাকতে থাক।
আরেহ সরি বলছি তো। তো কি ডাকবো তোমাকে? আমি তো ওটাই ডেকে আসছি।
কি ডাকবি? আমারে কি আমার মা বাপে নাম দেইনাই?
পিহু লজ্জা পেয়ে বলল
যাহ। আমি জীবনে ও নামটাম ধরে ডাকতে পারব না।
মাহিদ ভঙ্গিমা করে বলল
কেন? ডাকতে পারবেন না কেন?
যাহহ।
মাহিদ হো হো করে হাসতে হাসতে বলল
আচ্ছা, তোর বেশি কিছু ডাকা লাগবো না। তুই আমারে ছিকু শালার শ্বশুর ডাকিস। বুঝছোস?
পিহু জিভে কামড় দিয়ে বলল
শ্বশুর?
মাহিদ মাথা নাড়লো। পিহু বলল
তারমানে ছিকুর বউ। তো ছিকুর বউ কে?
মাহিদ হেসে পিহুর মাথা টেনে এনে বুকে রাখলো। হাতের বাঁধনে পিষ্ট করে বলল
আমার বাপের নাতিন। তোর বাপের নাতিন।
পিহু উঃ উঃ করে মাথা তুলতে চাইলো। মাহিদ চেপে ধরে হেসে পিহুর মাথার উপর থুঁতনি রেখে বলল
না বাপ তোরে আমি ভিলেন হইতে দিমু না। আমি ছিকুশালারে জামাই বানামু মানে বানামু। শালা বহুত কিউট। বহুত পাকা।
পিহু শেষমেশ মুখ তুললো। বলল
ছিঃ ছিঃ এখনো কোথায় কি? তুমি বেশিবেশি করো মাহিদ ভাই।
বলতে না বলতে পিহু আবার জিভে কামড় দিল। মাহিদ হেসে বলল
তুই ভাই ডাকতে থাক। আমি তোর বাচ্চাকাচ্চার বাপ ও হমু, মামা ও হমু। তোর আণ্ডাবাচ্চার তো মামু টামু নাই। আমি পূরণ কইরা দিমু। সমস্যা নাই। তোর মুখ ভাই ডাক শুনলে পরাণ জুড়াইয়া যায়।
পিহু বলল
তওবা তওবা। আর জীবনে ও ডাকবো না। নানু শুনলে আমাকে লাঠির বাড়ি দিবে।
মাহিদ পিহুর কথা শুনে হেসে উঠলো।
_____________
মাহিদ চলে গেল। পিহু আরও দুতিন দিন থাকবে। মাহিদ হসপিটালে গেল। নিনিতের সাথে দেখা করবে। যখন হসপিটালে গেল নিনিতকে পেল না। নিনিত নাকি আজ ডিউটিতে নেই। মাহিদ এবার একেবারে নিনিতের বাড়িতে চলে গেল। জালিশা তাকে দেখে খুশি হলো। বলল
পিহু কেমন আছে? পিহু এখানে আসবে না?
ভালো আছে। আসবে।
আসুন। আজ ডক্টরের ডিউটি নেই। বাসায় আছে।
ফোন দিলে হসপিটালে যেতে হতো না। আমি চাচ্ছিলাম ওকে না জানিয়ে যাই। তো আর কি আপডেট?
জালিশা বোকা চোখে চেয়ে বলল
কিসের আপডেট?
মাহিদ তার মাথায় টোকা দিল। বলল
বিয়ের।
জালিশা লজ্জা পেয়ে বলল
আমি কিছু জানিনা ভাইয়া।
মাহিদ বলল
আচ্ছা। ওর সাথে দেখা করে আসি।
জালিশা মাথা নাড়ালো। নিনিতের মনোযোগ ফোনে। মাহিদ হঠাৎ করে চলে আসবে সে ভুলে ও ভাবেনি। মাহিদ প্রথমেই এসে পিঠে চড় থাপ্পড় বসিয়ে দিল। নিনিত হেসে বলল
মারোস কেন? লাগে তো।
শালা তোর কি ফোনে কথা কইতে শরম করে বাপ?
নিনিত টি শার্ট ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালো। চশমা চোখে দিয়ে বলল
চা ঘরে খাবি? নাকি বাইরে।
না বসুম না। বাইরে দোকানে।
চল।
কথা বলতে বলতে দুজন বেরিয়ে পড়ছিল। ঘরের বাইরে পা রাখতেই জালিশা চা নিয়ে এসে বলল
চা!
নিনিত ভুরু কুঁচকালো। মাহিদ বলল
এত তাড়াতাড়ি কেমনে?
কিছুক্ষণ আগেই বানিয়েছিলাম সবার জন্য। প্লিজ!
মাহিদ জালিশার কথা ফেলতে পারলো না। চায়ের কাপ নিল। নিনিত নিল না। জালিশা মাহিদের দিকে করুণ চোখে তাকালো। মাহিদ চায়ের পেয়ালা নিয়ে নিনিতের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল
টান দে।
নিনিত চায়ের কাপ নিয়ে ঘরে চলে গেল। জালিশা বলল
ভাইয়া আমি এই ঝাল পিঠা বানিয়েছি। গরম আছে। নেন৷
মাহিদ নিল। জালিশা ভীষণ খুশি হলো। বলল
ডাক্তারকে একটা দেবেন? উনি পছন্দ করে। বাট আমি বানিয়েছি বলে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।
মাহিদ মাথা নাড়লো। তুমি ওর ঘরের টেবিলে রাখো। আমি দিচ্ছি।
জালিশা উঁকিঝুঁকি দিয়ে নিনিতের ঘরে ঢুকলো। নিনিত ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে চাইলো। চায়ের কাপে চা অর্ধেক। জালিশা পা টিপে টিপে হেঁটে প্লেটটা টেবিলে রেখে দৌড়ে বেরিয়ে পড়লো। মাহিদ চায়ের কাপ রেখে ঝাল পিঠা নিনিতের দিকে বাড়িয়ে দিল। বলল
নে খা। তোর ভবিষ্যৎ বউয়ের হাতে বানানো পিঠা। ভালোই হয়েছে।
নিনিত নিল ভেবেচিন্তে। বলল
এত তেল! আমি এত তেলের খাবার পছন্দ করিনা।
একটা খাহ। ও খুশি হবে। আশ্চর্য! কষ্ট করে বানিয়েছে। রান্না এত সহজ যতটা আমি তুই ভাবি। খাওয়া দরকার।
আচ্ছা চল যেতে যেতে খাই৷
যাওয়ার সময় নিয়াজ সাহেবের সামনে পড়ে গেল। ডাক্তার সাহেব তাহলে বেরোচ্ছেন।
হ্যা বাবা। মাহির সাথে বেরোচ্ছিলাম। কিছু লাগবে তোমার।
নাহ। যেটা চাইছি সেটাই তো দিচ্ছ না তুমি। আর কি চাইবো? ব্যারিস্টারের পোলা, তোর গাঁধামার্কা বল্টুরে বুঝা। বুঝা যে মানুষ একা সুখী থাকতে পারেনা কখনো। কাউকে পাশে দরকার। এই যে রোগীর সেবা করে রাতে বাড়ি ফেরে, তার সেবা করার জন্য হলেও তো একজন মানুষ দরকার। নিজের মানুষ৷ বুঝা বাপ বুঝা। আমি আর বুঝাতে পারছিনা।
মাহিদ বলল
আঙ্কেল ও তো রাজী। তোমাকে লজ্জায় বলছেনা। রাজী। বিয়ে করবে তো।
সত্যি?
হ্যা করবে। মাইশাকে।
নিনিত হা করে চেয়ে রইলো মাহিদের দিকে। নিয়াজ সাহেব ও হা করে চেয়ে রইলেন। জালিশা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে যেন থমকে গেল। পা আর নড়ছেনা।
মাইশাকে বিয়ে করবে বলছে আমাকে। তোমাদের লজ্জায় বলছেনা। তোমরা মাইশার মা বাবার সাথে কথা বলো। আমরা আসি। চল চল।
নিনিতকে টেনে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো মাহিদ। নিনিত কিছুদূর গিয়ে থামলো। বলল
এসব কি বললি তুই?
মাহিদ নিনিতের কাঁধে হাত রাখলো। বলল
বিয়ে তো করতেই হবে তোকে। আজ নয়ত কয়েক বছর পর। জালিশাকে নয়ত জালিশার মতোই একটা মেয়েকে। তাহলে এখন করতে সমস্যা কোথায়? তুই ঠিকই জালিশার মতো একটা মেয়েকে পাবি, কিন্তু জালিশাকে পাবি না। আইমি আন্টি মাকে বলেছে তোর জন্য ওর এই দেশে মাটি কামড়ে পড়ে থাকা। ওর পড়ালেখার সমস্যা হচ্ছে। তাছাড়া ওখানে বাংলাদেশী একটা ছেলের সাথে ও বিয়ের কথাবার্তা ও হচ্ছিল। কি করতে চাস তুই? নাকি মাইশাকে করবি?
ইম্পসিবল মাহি। পাগল হয়ে গেছিস? মাইশা আমার ছোট বোনের মতো।
তাহলে বাড়িতে তাড়াতাড়ি জানা যে তুই জালিশাকেই বিয়ে করবি। নইলে তারা মাইশার মা বাবার সাথে কথা বলবে। কেউ না বললে ও তোর মা। জালিশাকে কম পছন্দ করে, মাইশাকে বেশি পছন্দ করে। সেহেতু!
নিনিত বলল
এটা কি ভালো করেছিস? সবাই কি ভাবছে আমাকে? জালিশা কি ভাবছে?
জালিশার কি ভাবলো তাতে তোর কি যায় আসে?
নিনিতের এবার উত্তর দিতে দেরী হলো। তবে বলল
কি যায় আসবে? বলবে আমি লুচ্চা। মাইশার প্রেমে পড়েছি?
তাতে তোর কি যায় আসে?
খোঁটা দেবে আমায়। ও খুব ডেঞ্জারাস মেয়ে। তুই চিনিস না ওকে, যতটা আমি চিনি।
তোকেই তো চিনতে হবে বাপ। কারণ ওটা তোর মানুষ। যাহ, আর তিড়িংতিড়িং করিস না। বিয়ার পিড়িতে বয়। তোর জন্য আমার হানিমুন আটকায় আছে।
চলবে,,,
#মন_গোপনের_কথা
#পর্ব_৪৯
লেখনীতে, পুষ্পিতা প্রিমা
লাবীব আর তপু ও চলে এসেছে। নিনিত আর মাহিদকে দেখে হেসে বলল
কি খবর মামা! আজ দুজন একেবারে ফোন টোন দিয়া উল্টাই ফেলতাছোস?
মাহিদ তপুর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল
তোগো খুশির খবর দেওয়ার জন্য ডাইকা আনছি বাপ।
লাবীব বলল
তুমি মিয়া এত সুন্দরসান্দর হইয়্যা গেছ ক্যান? রহস্য কি?
মাহিদ তার পাছায় লাতি বসিয়ে বলল
গরুর ট্যাবলেট। খাবি নাকি?
নিনিত হেসে উঠলো। বলল
তোদের মারামারি শুরু হয়ছে?
লাবীব আঘাত পাওয়া জায়গায় হাত বুলিয়ে বলল
শালা সবার আগেভাগে বিয়াশাদী কইরা সরস হইয়্যা গেছে। খবরদার লাতি দিবিনা। নইলো তোর বউরে কিডন্যাপ করুম।
নিনিত হাসতে হাসতে বলল
থামবি তোরা?
তপু বলল
কার বিয়ার কথা চলতেছে সেটা তো বল।
মাহিদ বলল
আমাগো ডাক্তারের বিয়া।
জালিশারে বিয়া করবে? করবো না ক্যান? সুন্দরী মাইয়্যা বিনাকষ্টে পাইয়্যা গেছে।
আরেহ ধুরর। জালিশা না। মাইশা মাইশা।
লাবীব খুকখুক করে কেশে উঠলো।
ওই বিচ্ছু মেয়েটা? হ্যা রে নিনিইত্যে তোর ওই তিড়িংতিড়িং ফড়িংরে শেষ পর্যন্ত পছন্দ হয়ছে?
নিনিত নীরব চোখে মাহিদের দিকে চেয়ে থাকলো। কিছুক্ষণ পর বলল
আর কি কি বলবি বলে ফেল।
মাহিদ হাসলো। গলা কাত করে বলল
তাইলে রাজী কহ মামা। নইলে আমি এখন মাইশারে ও ফোন দিয়া এইটা বলুম।
লাবীব বলল
এই থাম থাম। তোরা কি মশকরা করতাছোস?
নিনিত বলল
আরেহ ওর কথা শুনিস দোস্ত। গাঞ্জা খাইছে। বাবার সামনে ও বলে দিল আমি নাকি মাইশাকে বিয়ে করতে চাচ্ছি। এটা কোনো কথা হলো? আমাকে নিয়ে পড়েছিস ভাই?
তপু বলল
ঠিকই বলছে। জালিশারে করতে অসুবিধা যখন মাইশারে কর। নইলে দুইটারেই ছাড়। আমি আর লাবীইব্যা আছি কি করতে। লাবীইব্যার জন্য এমনিতেও আন্টি মাইয়্যা দেখতেছে।
মাহিদ লাবীবের দিকে হা করে চাইলো। লাবীব বলল
ধুরর শালা ওভাবে কি দেখোস?
সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। মাহিদ হাসতে হাসতে বলল
তলে তলে টেম্পু তাহলে চলতেছে মাম্মা।
নিনিত বলল
সমস্যা কি? তোরা করে নে। এবার কে কারে নিবি ঠিক কর।
লাবীব বলল
ঢংয়ের কথা কস? মাইয়্যা কি কম পড়ছে দেশে? তোগো বউ নিয়া কেন টানাটানি করতে হইবো?
নিনিত বলল
আচ্ছা এসব থাক। আমরা কি আগে এসব নিয়ে কথা বলতাম? এসব ছাড়া কি আর কোনো টপিক নেই?
আছে আছে। মাহিদ তুই বল এবার। হানিমুনে কবে যাইতেছোস?
মাহিদ কপাল ভাঁজ করে চাইলো। বলল
তোগো বউ পোয়াতি হইলে।
নিনিত আর তপু খিক করে হেসে উঠলো। লাবীব বলল
শালা ভালা কথা কইলাম তোরে। শালা বেয়াদব।
তোরা টিকিট ম্যানেজ কর। আমি কি টাকা পয়সা কামাই?
খেলে কামাইতাছো।
কচু কামাই। ওগুলা দিয়ে কিছুই হয় না। আমার চুলের জেল ও তো বাপের টাকায় কেনা। বাপের টাকার প্রতি মায়া লাগে বাপ বুঝোস না? আমার ব্যারিস্টার বাপ রায় দিয়া দিয়া টাকা কামাই করবো। আর আমি সেই হানিমুন করুম। এগুলা কুনো কথা হইলো? ভাবছিলাম নিনিইত্যারে বিয়া করামু। তারপর তোগো দুজনেরে করামু। সব্বাই মিলে যামু পাহাড় পর্বত ঘুরতে। কিন্তু না তোরা শালা তো বিয়ার নাম ও ধরতেছোস না? আমি কিল্লাই আগেভাগে বিয়া কইরা বইসা আছি?
লাবীব কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। তপু বলল
ওই ওই ওইটা কে দেখ?
সবাই রিকশা থেকে নামা একটা মেয়েকে দেখলো। কালো গোলাপি ড্রেস পড়েছে। মাথায় ওড়না। কাঁধে ব্যাগ ঝুলছে। রিকশা ভাড়া মিটিয়ে তাদের দিকেই তাকালো। মাহিদ খুকখুক করে কেশে উঠে নিনিতকে কনুই দিয়ে গুঁতো মেরে বলল
মামা তোর বউ আসতেছে।
মাহি ফালতু কথা বলিস না ওর সামনে। আমার সব যাবে।
মাইশা এল। খুব সুন্দর করে হেসে বলল
আসসালামু আলাইকুম এভরিওয়ান। সবাই কেমন আছেন?
সবাই চুপচাপ। একজন আরেকজনের দিকে তাকাচ্ছে। মাইশা ভুরু কুঁচকে চাইলো। মাহিদ নীরবতা ভাঙলো। হেসে বলল
ওয়ালাইকুমুস সালাম। ভালো আছি। তুমি কেমন আছ?
এইতো ভালো। পিহু কেমন আছে? আঙ্কেল আন্টি।
সবাই ভালো।
মাইশা নিনিতের দিকে তাকালো।
নিনিত মাহিদের দিকে তাকালো। তারপর বলল
ভালো আছি। তুমি কেমন আছ?
এইতো।
তপু বলল
আমি ও ভালো আছি বইন।
মাইশা লাবীবের দিকে তাকালো। বলল
এই যে মিঃ!
লাবীব বলল
জ্বী।
কথা বলতে জানেন?
মাহিদ হেসে বলল
লজ্জা পাইতেছে আমার বন্ধু। ও ছোট থেকেই এরকম। মেয়েমানুষ দেখলেই লজ্জা পায়।
লাবীব মাহিদের দিকে হা করে তাকালো। মাইশা খিক করে হেসে উঠলো। বলল
তাই নাকি? কিন্তু ওনি তো আমার সাথে বিয়ের সময় বেশ ভালো গল্প টল্প করেছেন। তাই না মিঃ লাবীব?
লাবীব মাথা নাড়লো। মাহিদ বলল
তাই নাকি মামা? আমাগো বলোনাই ক্যান? তুমি রেকর্ড ভাঙছো।
চুপ থাক। আমি কেন মেয়েদের লজ্জা পাব? আশ্চর্য!
শুধু মাইশারে লজ্জা পায়।
লাবীব কপালে ভাঁজ ফেলে মনে মনে বিড়বিড় করে বলল
শালা!
মাইশা কিছু একটা বুঝতে পেরে কথা ঘুরিয়ে বলল
যাইহোক। আপনাদের দেখলাম তাই এলাম। শুনেছি জালিশার বিয়ে খাব সামনে?
হ। জালিশার জন্য পাত্র দেখতেছি। আগে তোমাগো বিয়ে খাবো।
মাইশা চোখ বড় বড় করে চাইলো। বলল
আমার?
হুম।
ধুর আপনি সবসময় মজা করেন।
নিনিত ঘামতে লাগলো। এই মাহিটার বিশ্বাস নেই। তার ইজ্জতের ফালুদা বানাতে তার সেকেন্ড লাগবে। চশমা খুলে মুছে আবার চোখে লাগালো সে।
মাহিদ বলল
ঘরে যাও। তারপর সব শুনবা।
সত্যি বলছেন? আমার তো খুব চিন্তা হচ্ছে। কোন হাঁদারাম আবার পেছনে পড়লো।
নিনিত খুকখুক গলা পরিষ্কার করে মাহিদকে বলল
রোদ চলে এসেছে। আমি রোদে দাঁড়াতে পারিনা দোস্ত। ওদিকে যাই?
মাহিদ বলল
যাহ।
মানে সবার কথা বলছি।
মাইশা বলল
আচ্ছা। আপনারা থাকেন। আমি বাসায় যাই। আপনি আমাকে টেনশনে ফেলে দিলেন।
মাহিদ বলল
যাও যাও। চোখ বন্ধ কইরা কবুল বলে দিবা। বর ভালা মানুষ। সাদাসিধা সুন্দর মানুষ।
মাইশা না পারতে হেসে বলল
আপনি পারেন বটে।
মাইশা চলে গেল। সে চলে যেতেই নিনিত মাহিদের পিঠে কিল বসালো। বলল
সত্যি সত্যি ওর বাড়িতে কিছু বলেছিস নাকি?
তুমি মামা রাজী কও নইলে বলতে কতক্ষণ? আমি কিন্তু ছেঁড়া বেড়া লাগায় দিমু কইলাম।
নিনিত দোটানায় পড়ে গেল। বলল
এসব ভালো হচ্ছে না বন্ধু।
তোমার ভালা আমি বুঝি বাপ। রাজী কও। জালিশা আমারে কইছে সে ঠেকা পড়েনাই। তোমারে বিয়া করতেই হইবো এরকম কোনো কথা নাই। তুমি এখানকার ডাক্তার। সে চাইলেই কানাডিয়াম ডাক্তার বিয়া করতে পারে। সো তুমি অত ভাব লইয়ো না।
নিনিত বলল
তো বল কানাডিয়ান ডাক্তার বিয়ে করতে। আমার সাথে কি?
নিনিত গটগট পায়ে হাঁটা ধরলো। মাহিদ তপু লাবীব তার পেছনে ছুটলো। মাহিদ বলল
তারমানে রাজী না? মাইশার বাপের নাম্বার আছে ফোন করি?
নিনিত থেমে বলল,
মাহি প্লিজ! আমাকে জোর করতে পারিস না তুই।
ঠিক আছে। আর জোর করব না। জালিশাকে ও বলে দেব ডাক্তারের অভাব পড়েনি ভাই।
নিনিত চেয়ে রইলো৷ মাহিদ বলল
তোরা থাকবি? আমি বাড়ি যামু।
তপু আর লাবীব মাথা নাড়লো। নিনিত তার হাত ধরে ফেলল।
রাগিস না দোস্ত। তোরা এমন করলে আমি কার কাছে যাব?
মাহিদ বলল
হাত ছাড় বাপ। তোর কোনোকিছুরই ব্যাপারে না গলামু না আমি। যাহ করার তুই কর।
মাহি!
আরেহ যাহ।
মাহিদ হনহনিয়ে হেঁটে রাস্তা পার হয়ে গেল। নিনিত তার পেছন পেছন রাস্তা পার হলো। বলল
এমন করছিস কেন? বিয়ে তো একবারই হয়। আমি সত্যি সিদ্ধান্ত নিতে পারছিনা। মনে হচ্ছে জালিশা আমার কাছে সুখে থাকবে না।
মাহিদ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। বলল
কেন? কাউরে ভুলতে পারছিস না নাকি?
বলেই রিকশা ডাকলো মাহিদ। নিনিত ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। মাহিদ রিকশাওয়ালার সাথে কথা বলতে যেতেই নিনিত বলল
কি বলতে চাচ্ছিস? ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলবি না মাহি।
সোজাসাপটা বলি তাহলে?
নিনিত চেয়ে রইলো তার মুখের দিকে। মাহিদ বলল
পিহুর সাথে যখন বিয়ে ঠিক ছিল তখন কেন মনে হয়নি পিহু তোর সাথে ভালো থাকবেনা। জালিশার বেলায় কেন মনে হলো?
যে এখন তোর স্ত্রী। তাকে কি করে এই বিষয়ে ঢুকাচ্ছিস?
কারণ বিষয়টা আমার কাছে ক্লিয়ার হওয়া দরকার।
এরকম কোনো কিছু নেই। আমি অতটা উদার নয় যে নিজের মানুষ অন্য কাউকে দিয়ে দেব। তোকে ও স্পষ্ট করে বলে দিলাম। আমাকে অযথা সন্দেহ করবি না। তোর রোগ হয়ে গেছে আমাকে সন্দেহ করতে করতে। জালিশাকে বিয়ে করলে তোর সন্দেহ ঘুচবে? যদি ঘুচে তাহলে ঠিক আছে। তাই হবে।
বলতে বলতে চোয়াল ফুলে উঠলো নিনিতের। মাহিদের চোখ রাস্তায়। নিনিত বলল
এখন চুপ করে আছিস কেন?
তোকে জালিশাকে বিয়ে করা লাগবে না। আমার প্রমাণ চাই না। সন্দেহ ও নেই। আমি শুধু কারণটা জানতে চাইলাম। জালিশাকে অপছন্দ কেন তার কারণটা স্পষ্ট কর। জালিশা তোর চোখের আড়াল হয়ে যাবে। ওকে আশায় রাখা কিংবা নিরাশায় রাখা তোর অধিকারের মধ্যে পড়েনা।
নিনিত বলল
জালিশার যখন ঠেকা পড়েনি তখন ওকে বল বিয়ে করে নিতে। তখন তো আর এসব বিয়ে বিয়ে প্রশ্ন উঠছেনা। ওরজন্য আমার ঘরে যেতে ইচ্ছে করেনা। আমি কি বলব বাবাকে?
মাহিদ রিকশায় উঠে পড়লো। বলল
তাইলে তুই থাক তোর মতো। তোরে ফোনে ব্লকে রাখলাম। এসপার ওসপার কর ভাই। আমি আর এসবে নাই।
নিনিত বলল
নাম নাম। আরেহ যাস না দোস্ত। অনেক কথা আছে।
নাহ তোর লগে কোনো কথা নাই। বহুত বলছি। বহুত বুঝাইছি। আর না।
আমি আর কিছুতে নাই। খবরদার আমারে ফোন ও দিবিনা।
রিকশা চলতে শুরু করলো। নিনিত ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। লাবীব এসে পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল
যা সিদ্ধান্ত নিবি ভেবেচিন্তে নিবি। ঠান্ডা মাথায় ভাব।
______________
নিনিত বাড়িতে পৌঁছুতে যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। সে বাড়িতে পৌঁছুতেই নিশিতা ফোন করলো। বলল
ভাইয়া তুমি মাইশাকে বিয়ে করবে বলেছ? মাইশাকে তোমার পছন্দ? আগে কেন বলোনি? মা কি বলছে?
নিনিত বলল
সব মিথ্যে নিশু। মাহি মজা করে বলেছে এসব।
মাহিদ মজা কেন করবে? নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে যেটা আমরা পাচ্ছিনা৷ তুমি জালিশার কথা ভেবে মিথ্যে বলো না। তুমি অন্য কাউকে পছন্দ করে, জালিশার সাথে সুখী হতে পারবেনা কখনো। আমাকে বলো।
নিনিত বলল
আহ! আমি সত্যি বলছি। মাইশাকে এসব বলিস না। উফফ।
রাগে ফোন কেটে দিল নিনিত।
নিকিতা বেগম বললেন, আমার ছেলে যাকে বিয়ে করতে চায়, তার সাথেই হবে।
আইমি ও হেঁটেহেঁটে চুপচাপ সবার কথা শুনছে।
রাতে জালিশার ঘরে গেল। জাবিরের আজকে ঢাকা থেকে ফেরার কথা। এসব শুনলে সে কত কষ্ট পাবে। মেয়েটা তার সব। আইমিকে দেখে জালিশা সতর্ক হয়ে বসলো। আইমি বলল
তুমি এবার খুশি হয়েছ? আর কতদিন থাকতে চাও এখানে?
জালিশা চুপ করে থাকলো। আইমি বলল
তোমার কোনো কথা আমি আর শুনবো না। আজ তোমার পাপা আসুক।
আমি কি করেছি?
এখনো বড় গলায় বলছ কি করেছ? কোন অংশে কম তুমি যে তোমাকে এখানে পড়ে থাকতে হবে?
আমি পড়ে থাকিনি আম্মি। ডাক্তারের বিয়েটা দেখে যাই? মামা খারাপ ভাববে তার আগে চলে গেলে।
কে খারাপ ভাবছে আর ভালো ভাবছে সেটা তোমাকে ভাবতে বলিনি আমি। কখন থেকে আমার উপরে কথা বলতে শুরু করেছ? কত বড় হয়েছ তুমি? তোমার কথা অনেক শুনেছি আমি। আর একটা কথা ও শুনবো না।
জালিশা চুপ করে থাকলো। মাকে কি করে বুঝাবে ডাক্তার মাইশাকে বিয়ে করবে বলেনি। সব মাহিদ ভাইয়া নিজ থেকে বলেছে। উফ সব এলোমেলো লাগছে।
নিকিতা বেগম নিনিতের মুখে স্পষ্ট শুনতে চাইলেন। নিনিত বলল
এসব ভুয়া কথা মা। মাহি মজা করে বলেছে।
আর তোমরা ও কথা শুনে নাচানাচি করছো। উফফ চলে যাব আমি এই বাড়ি ছেড়ে।
তুই বিয়েই করবি না এমনটা হবে না। আমি মানব না। আমার দশটা ছেলে নেই। একটাই। সব আশা ভরসা তুই। আমার ঘর আলো করার জন্য বউ লাগবে। নাতি নাতনি লাগবে। আমি তোর কথা শুনে চলতে পারব না।
মা তুমিও।
হ্যা আমি ও। বিয়ে কি বুড়ো হলে করবি? বুড়ো হলে তোকে বউ কে দেবে?
আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। এসব আর সহ্য হচ্ছেনা।
যাহ। দূর হ। যেদিন বিয়ে করবি বলে মনস্থির করবি সেদিন ফিরবি। তার আগে নয়।
মা!
ডাকবি না মা। আমি শুধু নিশিতার মা। আর কারো না। আমার একটাই মেয়ে৷ ওর মতো কাউকে পছন্দ করে বিয়ে তো করে নিতে পারিস। ছোট বোন থেকে আক্কেল নিস। আমার মেয়ের জন্য দশটা পাত্র দেখতে হয়নি আমাকে। ও যেটা চুজ করেছে সেটাই একশ। তুই তো গাঁধা।
আমাকে কি করতে বলছো তুমি?
নিকিতা বেগম কিছু একটা ভাবতে ভাবতে বললেন
বারান্দা ঘুরে এসো। উত্তর সেখানে।
বলেই তিনি চলে গেল। নিনিত হাঁটতে হাঁটতে বারান্দায় গেল। খোলা চুলে দাঁড়িয়ে থাকা একজনকে গুনগুন করে গান গাইতে দেখলো।
এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকেনা তে মন।
কবে যাব, কবে পাব ওগো তোমার নিমন্ত্রণ।
নিনিত এবার বেশ দোটানায় পড়ে গেল। ঘরে আসতে আসতে ভাবলো নিমন্ত্রণ আবার কিভাবে দেয়?
________________
পিহু গোছগাছ করছে। তার চলে যাওয়ার সময় চলে এসেছে। সকাল থেকে মন খারাপ। ছিকু ঘুরে ঘুরে এসে পিহুর কাছে জিজ্ঞেস করলো
পিহুর মন কালো কেন?
পিহুর এমনিতেই মন খারাপ। এসব উলটপালট কথা শুনে কেমনটা লাগে। হাসতে ইচ্ছে করে?
তারপরও সে শোধরে দিল।
মুখ কালো বলে আব্বা।
মুখ কালো কেন? মিহি বুকা দিচে কেন? আদর করেনি কেন?
পিহু কাপড় ভাঁজ করা থামিয়ে চাইলো ছিকুর মুখের দিকে। ছিকু ডাগরডাগর চোখে চেয়ে রয়েছে।
পিহু তার গাল টেনে ধরে বলল
এসব আর বললে খুব মারব।
কেন মারবে কেন? তুমি পুঁচা কেন?
আমি পুঁচা।
নীরা ফোন করলো পিহুকে। পিহু ফোন তুলেতেই দেখলো নানী। সালাম দিতেই নানী সালাম নিয়ে বলল
বইন গোছগাছ শেষ?
হ্যা।
আইচ্ছা। তোর শ্বশুর যাবে। তোর জামাই নাকি আবার খেলতে গেছে। সে আসতে দেরী হবে।
খেলতে গেছে? আমাকে তো,,,
নানী জিভে কামড় দিয়ে বলল
বইন তোর জামাইর কানে এসব তুলিস না। তোরে আনতে যাইতে পারবেনা সেজন্য তুই রাগ করবি জেনে আমারে বলতে বারণ করছে। তুই রাগিস না আমার ভাইয়ের উপর। এখনো খেলার মন বুঝোস না? গায়ে গতরে বড় হয়ছে। মাথায় বোধবুদ্ধি এখনো তেমন হয়নাই। দায়িত্ব কর্তব্য পুরোপুরি বুঝে উঠতে সময় লাগবো। বুঝোস না?
বুঝেছি। মামা আসলে আসুক৷ আম্মাকে বলি আমি।
কোন মামা? কিসের মামা? মামা ডাকা যাইবো না আর। বাপ ডাকবা। আমাগো জামাইর একডা পোলার বউ। তার মুখে মামু ডাক শুনতে পারবো না। মনে থাকবো?
পিহু হেসে বলল
আচ্ছা।
রিপ বেলা সাড়ে তিনটার দিকে এল। বসে আদি আফির সাথে অনেক গল্পগুজব করে চা নাশতা খেল। যাওয়ার সময় পিহুর সে কি কান্না! পিহুর কান্না দেখে ছিকু ও কাঁদা শুরু করলো। হাত পা ছুঁড়ে কান্না যাকে বলে। সে পিহুর সাথে যাবে। নইলে পিহু এখানে থাকবে। পরী কত করে বুঝালো পিহু আবারও আসবে। কে শুনে কার কথা। হাত পা ছুঁড়ে সবার নাকমুখ ফাটিয়ে দেওয়ার মতো অবস্থা। শেষমেশ পিহু যখন কোলে নিল তখন শান্তি। তারপরও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মুনা সেসব শুনে রিপকে ফোনে বলল
ছিকুকে যেন সাথে করে নিয়ে আসে। মাহি গিয়ে পরে দিয়ে আসবে।
পরী দিতে চাইলো না। ওর পড়া আবার এলোমেলো হয়ে যাবে। মুনা বকাবকি করতেই দিতে রাজী হলো। ছিকুর সে কি খুশি। নতুন টি শার্ট আর প্যান্ট পড়লো। কেডস পড়লো। কালা চশমা গলার সামনের দিকে ঝুলিয়ে দিল। হাতে ঘড়ি পড়লো। গায়ে পারফিউম লাগালো। মাথার চুল আঁচড়ালো। সব সাজিয়ে দিল রাইনা। সাজগোজের পর আয়নাতে নিজেকে দেখে সে কি হাসি। খিকখিক করে হেসে রাইনাকে বলল
আনার বাবু বিটিফুল কেন?
রাইনা তার কপালের পাশে কালো টিপ পড়িয়ে গালে কপালে চুমু দিয়ে বলল,
আয়নার বাবুটা আমার সোহাগ আর কি। আমার নাতি। আমার ভাই।
বাবু দাদুর চুহাগ কেন?
রাইনা বুকে শক্ত করে চেপে ধরে রেখে আদর করতে করতে বলল
আমার সোহাগের মানিক । আমার রেহানের সোহাগ তাই আর কি।
তারপর রিপের কোলে চড়ে গাড়িতে উঠে বসলো৷ পিহু তাকে তার পাশের সিটে বসালো। বলল
আমরা কোথায় যাচ্ছি।
ছিকু কিছু একটা মনে করে বলল,
চচুর বাড়ি যাই কেন?
কার চচুরবাড়ি?
ছিকুর চচুর বাড়ি যাই কেন?
পিহু হেসে উঠে জড়িয়ে ধরলো তাকে। বলল
মারেমা এত কথা কেমন বলে এই ছেলে!
_______
পিহু আর ছিকুকে পেয়ে সবাই খুশি। নীরা পিহুর মুখে হাত বুলাতে বুলাতে বলল
বাড়ির বউ বাড়ি না থাকলে ভালো লাগে? তাই তাড়াতাড়ি চলে আসতে বলছি। আমার উপর রেগে থাকলে ও কিছু করার নাই। আমার একমাত্র ছেলের বউ তুমি। বউয়ের সাথে আমাকে প্রচুর সময় কাটাতে হবে।
পিহু হাসলো। বলল
রেগে নেই মামি।
নানী লাঠি দিয়ে গুঁতো দিল।
মা ডাক।
ঠিক আছে। মা। মা। আর ভুল হবে না।
সবাই একসাথে হেসে উঠলো।
মুনারে বড় মা ডাকবি আমার ভাইয়ের মতো। কোনো মামী টামি চলবো না।
পিহু মাথা নাড়ালো। ছিকু বলল
বুড়ি লাডি দিয়ে পিহুকে মাচচো কেন?
নানী গালে হাত দিয়ে বলল
ওমাগো! আমারে বুড়ি ডাকছে পরীর পোলা।
ছিকু কপাল কুঁচকে চেয়ে রইলো। মুনা তাকে কোলে তুলে নিয়ে চলে গেল।
মাহিদ ফিরলো মাগরিবের একটু আগে। রিপ বসার ঘরে ছিল। মাহিদ বাড়িতে পা রাখলো। ব্যাডটা নিয়ে ঘরের উদ্দেশ্যে যেতেই রিপ বলল
সামনে পরীক্ষা মনে আছে?
জ্বি আব্বা।
মনে থাকে যেন। খেলা থাকবে পাশাপাশি। খেলতে বারণ নেই।
আচ্ছা।
রিপ টিভির নিউজে মনোযোগ দিল। মাহিদ ঘরে চলে গেল। ছিকুর চিল্লাচিল্লির আওয়াজ ভেসে আসছে মুনার ঘর থেকে। তারমানে শালা ভিলেন আবারও হাজির। মাহিদ ঘরে গেল। পিহু ঘরে নেই। মনে হয় রান্নাঘরে। সে গোসল করতে ঢুকে পড়তেই পিহু এল। তাকে গোসলে ঢুকতে দেখে আবার চলে গেল। তারপর গরম চা আর ইশার পাঠানো নাশতাগুলো নিয়ে এল। মাহিদ গোসল সেড়ে বের হয়ে দেখলো পিহু চা নাশতা রেখে গেছে৷ চা খাওয়া শেষ করে ঘর থেকে বের হলো। বসার ঘর থেকে হেঁটে এল। রান্নাঘরের দিকে উঁকিঝুঁকি দিল। পিহুর দেখাসাক্ষাৎ নেই।
আশ্চর্য! সে এসেছে তারপরও রান্নাঘরে কি? পথে নানীর সাথে দেখা। নানী চোখের চশমা ঠিক করে বলল
বউরে খুঁজো?
মাহিদ বলল
কে বলছে?
চোখেমুখে তাই বুঝা যাচ্ছে।
ফালতু কথা।
নানী হেসে বলল
যাই বল আমি বুইঝা ফেলছি কিন্তু । পাঠাইতাছি তোর বউরে। দাঁড়া।
নানী গেল। রান্নাঘরে নীরার সামনে বলল
নাতবৌ তোর জামাই তোরে খুঁজে। যাহ।
পিহু লজ্জা পেয়ে গেল। নীরা কিছু বলল না। তবে পিহুর আড়ালে হাসলো সামান্য। পিহু চলে এল। ঘরে এসে দেখলো মাহিদ নেই। কোথায় গেল। বারান্দায় নাকি? খুঁজতে ঝুল বারান্দায় চলে এল সে। ঠিকই ভেবেছে। তার চুড়ির আওয়াজে মাহিদ বুঝতে পারলো সে এসেছে। তবে পিছু ফিরলো না। পিহু গিয়ে গ্রিলের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। মাহিদ কোণা চোখে তাকালো। পিহু ভুরু উঁচালো। মাহিদ এগিয়ে এল।
পেটের একপাশে খামচে ধরে নাকের একপাশে নাক ঠেকালো। কপালে কপাল ঠেকলো। উন্মাদের মতো শ্বাস টেনে বলল
কি অবস্থা?
পিহু শিউরে উঠে চেপে গেল। চোখ বন্ধ অবস্থায় বিড়বিড়িয়ে বলল
কেউ চলে আসবে।
তাতে আমার কি?
চলবে,