মন গোপনের কথা পর্ব-৪২+৪৩

0
1040

#মন_গোপনের_কথা
#পর্ব_৪২
লেখনীতে, পুষ্পিতা প্রিমা

পিহুকে ঘরে তুলতে তুলতে মাগরিবের পর হয়ে গেছে। নীরা মুনা মিষ্টির প্লেট নিয়ে নীরাকে ডাকলো। পাশ থেকে একজন বয়স্কা মহিলা বলল

বৌমা তুমি বউকে আগে ঘরে ঢুকাও।

মুনা বলল

নীরু আসুক না।

তুমি ও তো শ্বাশড়ি। ঘরে তুলো। আর কতক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে মেয়েটা?

ছিকু পিহুর আঙুল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। পিহুকে টানছে ঘরে ঢুকার জন্য। পিহু ইশারায় বলল চুপ থাকতে। ছিকু চুপ থাকলো না। মাহিদ তার কান্ড দেখছিল চুপচাপ। শালা তার বউয়ের আঙুলটা টাইনা ছিইড়া ফেলতাছে। শালা ছিকুরে একা পাইলে খবর আছে। ছিকু চুপ থাকতে না পেরে বলল

পিহুকে ঘরে যায় না কেন? ইখানে দাঁড়িয়ে আচে কেন?

পিহু তার কথা শুনে চাপা হাসলো। মাহিদ মাথার চুল টেনে দিয়ে বলল

শালা চুপ থাক।

পিহু চোখ তুলে তাকালো। মাহিদ পেছনে হাত দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চোখ সামনে রাখলো। ছিকু মাথার পেছনে হাত ঢলতে ঢলতে বলল

‘ মিহি ছিকুকে দুক্কু দেয় কেন? বিশিবিশি মারে কেন?

মুনা বলল

তোর কি আর কোনো কাজ নাই মাহি? আজকের দিনে ও ছেলেটার পিছু লাগতে হবে?

রিপ বলল

ভাই তুমি চলে আসো।

ছিকু বলল

না। ছিকু চলি গেলে পিহু দুক্কু পাবে কেন? কান্না করবে কেন?

সবাই হেসে উঠলো তার কথায়। মাহিদ বিড়বিড় করে বলল

শালা তোরে আজ আমি খাইয়্যা ফালামু। তোরে একলা পাই।

নীরা ছুটতে ছুটতে এল। জুসের গ্লাস নিয়ে। রিপের বিরক্ত হওয়া দিকে মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠে বলল

পিহুর এটা খেলে ভালো লাগবে। তাই এটা আনতে গিয়েছি। রাগ করছেন কেন?

মুনা বলল

খাওয়া।

নীরা পিহুকে জুস খাইয়ে দিতে গেল। ছিকু বলল

ছিকু জুচ খাবে কেন?

ওহ আপনি ও খাবেন।

মুনা বলল

ওকে না দিয়ে কাউকে দিতে পারবি? ওকে দে আগে৷

ছিকু খেয়ে মাথা দুলিয়ে বলল

মুজা মুজা৷

নীরা হেসে বলল

খুব মজা?

উম উম মুজা মুজা।

পিহু দু চুমুক খেল। নীরা বাকিটুকু মাহিদকে দেখিয়ে বলল

মাহি তুই খাবি?

না। ছিকুশালা খাইছে। ফসফস কইরা শ্বাস ফালাইছে। শালা এত রাক্ষস।

ছিকু কাঁদোকাঁদো মুখে বলল

কেন? মিহি ছিকুকে রাক্ষুচী বলে কেন?

পিহু মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল

না। কাঁদলে চকলেট দেব না।

ছিকু চকলেট পাবেনা ভেবে কাঁদলো না। তবে ভীষণ দুক্কু পেল৷ মুখ কালো করে রাখলো। মিষ্টি খাইয়ে পিহুকে বাড়িতে ঢুকানো হলো। সোফায় বসালো প্রথমে। অনেক মেহমান মিষ্টিমুখ করিয়ে চলে গেল। মুনার বাপের বাড়ির লোকজন ও বউ আসার অপেক্ষায় ছিল। বউয়ের মুখ দেখে সবাই চলে গেল। নাজিয়া বানু পানের বাটা নিয়ে এল। পিহুর পাশে বসে বলল

বইন ধর। পান বানায় দে একটা। পরী তো খাওয়াইছে। তুই ও দেখি খাওয়া। পারিস তো?

পিহু মাথা নাড়লো। পান বানিয়ে দিতেই নানী বলল

তোর আপার কাছ থেকে শিখছিস?

দাদুকে ও বানিয়ে দিতাম।

তোর দাদী পান খাইতো? যে ফিটফাট মহিলা ছিল। বাপরে!

হ্যা খেত। মিষ্টি জর্দা দিয়ে। আমি বানিয়ে দিতাম। দাভাই ও পারে।

ছিকু বলল

রেহান পারে কেন?

পিহু তার গালে টেনে দিয়ে বলল

পাপা বলে। রেহান নয়।

কেন পাপা বলে কেন?

পিহু হেসে ফেলল। বলল

পাঞ্জাবি পাল্টে দেব? গরম লাগছে?

ছিকু জামাই কেন?

পিহু হেসে ফেলল। বলল

বলি একটা উত্তর দেয় আরেকটা। পাজি ছেলে। আসেন। পাশে এসে বসেন।

ছিকু পিহুর পাশে গিয়ে বসলো। পিহুকে ভালো করে দেখতে দেখতে বলল

পিহুর গরম লাগে না কেন? পিহু বুউ কেন?

মাহিদ এসে ধপাস করে বসলো ছিকুর পাশে। কোলে বসিয়ে গাল চেপে চেপে চুমু খেয়ে বলল

শালা তোরে আজ বহুত খুঁজছি। হাতের কাছে পাইনায়। তোর বহুত মাইর জমা আছে বাপ।

ছিকু কাঁদোকাঁদো মুখর হয়ে গেল। মাহিদ আরেক গাল চেপে চুমু খেয়ে বলল

তুই আমার লগে মিলায় পাঞ্জাবি পড়ছোস কিল্লাই? আমার শ্বশুর তোরে কিল্লাই এই পাঞ্জাবি কিইনা দিছে?

ছিকু জামাই কেন?

মাহিদ হো হো করে হেসে ছিকুর পেটে মুখ দিয়ে সুড়সুড়ি দিয়ে বলল

শালা তুই জামাই তো কিতা হয়ছে? তোর তো বউ নাই। আমার বউ আছে। বউ নাই। জামাই হইয়্যা কি লাভ হইলো?

ছিকু কপাল কুঁচকে এল। মন খারাপ করে মাহিদের দিকে চেয়ে থাকলো। মাহিদ তাকে সোফায় শুয়ে দিয়ে নাকের উপর চুমু খেয়ে পিঠে ধপাসধপাস মেরে চলে গেল।

তার নানী পিহুকে বলল

দেখেছিস কান্ড? এগুলো কোনো আদর হলো? এদিকে আদর ও করতেছে, মাইর ও দিতেছে।

পিহু কিছু বলল না।

_______________

রাইনার ভাইঝি রিনা মিনা দুজনই থেকে গেছে। নীরা তাদের যেতে দেইনি। পিহুর কাছে থাকতে পারবে তারা।
তাদেরকে বলল পিহুকে ঘরে নিয়ে যেতে। এবং সাজগোছ গুলো ফেলে দিয়ে একটা বিয়ের দ্বিতীয় শাড়িটা পড়িয়ে দিতে।
তারা পিহুকে নিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরেই মাইশারা সবাই এল। নীরা বলল

এত দেরী করলে কেন আম্মা?

বাসা থেকে ড্রেস পাল্টে এসেছি আন্টি। পিহু কোথায়?

ঘরে। ওর শাড়ি টাড়ি গুলা একটু পাল্টায় দাও। যা গরম পড়তেছে। ঝড় টড় তো উঠে গেছে দুনিয়া থেকে। কি একটা অবস্থা?

মেহেদী রাতে তো ঝড় হলো আন্টি।

তাতে কি হয়ছে? এককোণা ও তো ভিজে নাই সেই ঝড়ে। নিশি আর জালিশা আসবে না?

নিশি তো বিয়ে খেয়ে ওর শ্বশুর বাড়িতে উঠেছে। কাল আসবে বোধহয়। ও না আসলে জালিশা ও আসবে না।

জালিশাকে তুমি নিয়ে আসতে পারতে। মেয়েটাকে আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। ওর সাথে অনেক্ক্ষণ কথা বললাম।

হ্যা পারতাম। বললে চলে আসতো। আচ্ছা আন্টি মাহিদ সাহেব কোথায়?

বাইরে গেছে বোধহয়। কেন?

ডক্টর নিনিত আসবেন বলেছিলেন বোধহয়।

হ্যা ছেলেটা বিয়েতে আসেনি।

মিঃ মাহিদকে বলুন ওনার বন্ধুকে বলতে জালিশাকে ও যেন সাথে করে নিয়ে আসে।

তাই তো! আচ্ছা আমি ফোন করে বলি। তুমি পিহুর ঘরে যাও।

মাইশা মাথা দুলিয়ে চলে গেল। পিহুর সাজগোছ মুছে শাড়ি পাল্টাতে সাহায্য করলো মাইশা ও। পিহু বলল, তার প্রচুর গরম লাগছে। সে গোসল করবে। মাইশা বলল, তাহলে করে ফেলো। নইলে শান্তি লাগবে না। সে গোসল করে বেরই হতে পারলো না ছিকুর কান্নায় পুরো বাড়ির লোক সব একখানে হলো। পিহু শাড়ি সামলে ছুটতে ছুটতে বসার ঘরে চলে এল। দেখলো ছিকু মেজেতে শুয়ে হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে কাঁদছে। মাহিদ তার পেছনে। পিহুকে দেখে সে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। নীরাকে বলল

কেন কাঁদছে সেটা আমি জানিনা। কিছু করিনাই আমি।

পিহু গিয়ে তাকে মেঝে থেকে তুললো। পাঞ্জাবি ঝাড়তে ঝাড়তে বলল

কি হয়েছে? কথায় কথায় মেঝেতে শুয়ে পড়েন কেন?

ছিকু ঠোঁট টেনে কেঁদে বলল

মিহি বুলেছে বুউ নাই। ছিকুর বুউ নাই কেন? মিহির বুউ আচে কেন?

পিহু কপাল কুঁচকে চাইলো। ছিকু কাঁদতে কাঁদতে বলল

কেন? নাই কেন? পিহু বুলেনা কেন?

সবাই উচ্চস্বরে হেসে উঠলো পিহু ছাড়া। মাইশা কপাল চাপড়ে বলল,

হায় কপাল! এটার জন্য কাঁদছো বাবু? বউ তো বড় হলে আসবে। আপনাকে বড় হতে হবে আগে।

কেন? ছিকু বড় না কেন?

পিহু মাথায় হাত বুলিয়ে বলল

আচ্ছা কান্না থামান। বউ আসবে। আর কান্না নয়। আর কাঁদলে পরীর কাছে পাঠিয়ে দেব৷

বুউ এখুনো আচেনা কেন?

আসবে।

মাহিদ হাত ধরে ছিকুকে টেনে নিয়ে গেল। আঙুল দিয়ে গাল চেপে দিয়ে বলল

তোর গায়ে বালি লাগছে বাপ। ঘেমে ভূত হইয়্যা গেছোস। আয় তুই আর আমি গোসল করুম। বহুত গরম লাগতেছে। বিয়া কইরা কেলানতো হইয়্যা গেছি।

ছিকু গোসলের কথা শুনে কান্না থামিয়ে বলল

বুউ আচেনা কেন?

মাহিদ হো হো করে হেসে তাকে কোলে নিয়ে যেতে যেতে পিহুর সামনে গিয়ে থেমে গেল। কন্ঠ খাঁদে নামিয়ে বলল

তোর বউ আনার পেলেন করতাছি বাপ। একটু ধৈর্য ধর।

পিহু কপাল কুঁচকে অন্যদিকে চাইলো।
এই লোকের মুখে সব সময় বাজে বাজে কথা ছোট বাচ্চা টার সামনে! বেয়াদব।

ছিকু গোসল করে এল গামছা পেঁচিয়ে। সে কাপড় আনেনি। পরী আর রেহান আসার সময় আনবে। তাই মাহিদ তাকে তোয়ালে পড়িয়ে দিয়েছে। শালা ছিকুরে ন্যাংটা রাখা মানে পুরুষজাতির লজ্জা। তাই তাকে তোয়ালে পড়িয়ে দিয়ে পেটে চিমটি মেরে বলল

শালা তুই ন্যাংটা।

ছিকু চিমটি খেয়ে ছুটতে ছুটতে পিহুর কাছে এল। তোয়ালে খুলে পড়ে গেল। কেঁদে দিয়ে বলল

ছিকু ন্যাংটু কেন?

পিহু খিকখিক করে হেসে ফেলল তার কান্ড দেখে। ছিকু লজ্জা পেয়ে দৌড় দিল। পিহু তার একটি ওড়না নিয়ে ছিকুর পেছনে ছুটতে ছুটতে বলল

সবাই দেখলে আর ও বেশি লজ্জা পাবেন। আসেন। এটা পড়িয়ে দিই। আর পড়বে না। ছিকু বসে গেল। পিহু দৌড়ে গিয়ে ধরলো। ওড়না দিয়ে শাড়ি পড়িয়ে দিয়ে পেঁচিয়ে কোলে তুলে গালে আদর দিয়ে বলল

কলিজা বুউ সাজিচে। কি সুন্দর!

ছিকু চুপ হয়ে থাকলো। মাহিদ এসে ছিকুকে দেখে হো হো করে হাসলো। ভেজা চুল ছিকুর মুখের উপর ঝাড়তে ঝাড়তে বলল

শালা আর কত নাটক দেখাবি?

পিহু বলল

কি হচ্ছে এসব?
মাহিদ জোরে চুল ঝাড়া দিয়ে চলে গেল। ছিকু বলল

মিহি অচুভ্য কেন? পিহুকে ছিকুকে ভিজি দিচে কেন?

____________

নিনিত ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে অপারেশন শেষে সে ক্লান্ত। এখন গিয়ে কি করবে? কাল একেবারে রিসিপশনে আসবে। মাহিদ জোর করলো না। কারণ তার গলা এমনিতেই নরম শোনাচ্ছে। তাই বলল কাল যাতে তাড়াতাড়ি চলে আসে সবাইকে নিয়ে।

টুকটাক গল্প, খাওয়া দাওয়া আর জিনিস গোছগাছ করতে করতে অনেক রাত হয়ে গেল। পিহু ছিকুকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। নাজিয়া বানু এসে পালঙ্কে বসলো। বলল

কি করছিস বইন?

ওকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি। দিদিয়াদের আসতে দেরী হচ্ছে কেন? নাকি কাল আসবে?

কেন জানে? ফোন দিছে বোধহয়। ওকে এটা কি পড়েছিস?

শার্ট।

কার?

ওই,,

মাহির?

হ্যা।

ও আল্লাহ! নড়তেছে। একটু জড়িয়ে ধরে ঘুম পাড়া। তুই বোস আমি পানের বাটাটা নিয়ে আসি।

নাজিয়া বানু পানের বাটা নিয়ে আসলো। পালঙ্কে বসতেই মাহিদ ঘরে ঢুকে এল হুট করে। কাবার্ড খুলে কি যেন চেক করতে করতে বলল

বুড়ি আমার ঘরে তুমি কি করো?

ঘুমাইতে আসছি। আমার ঘরে তুই যাহ। তোর দিদিয়া আর জামাই বাবু আসতে আসতে অনেক রাত হবে।

মাহিদ ঘাড় ঘুরিয়ে চাইলো। নাজিয়া বানু হেসে বলল

এভাবে দেখার কি আছে? তুমি আইজ বউরে পাবা না। যাও বাছা। গিয়া ঘুমাও। কেলানতি দূর করো।

মাহিদের কান পুড়ে ছাই হলো যেন। পিহু জিভে কামড় দিয়ে ছিকুর গালে মুখ লুকিয়ে ফেলেছে৷ কি অসভ্য অসভ্য কথা!

মাহিদ দাঁতে দাঁত চেপে বলল

বেয়াদব বুড়ি।

বলেই তার ফোন আর ইয়ারফোনটা নিয়ে বের হয়ে গেল হনহনিয়ে ৷ নাজিয়া বানু হাসতে হাসতে বলল

পিহুরে তোর জামাই শরম পাইছে রে বইন। এই পোলার আর কত রূপ দেখুম। তুই কি তোর জামাইর কাছে যাবি নাকি? ইচ্ছা করলে যাহ। তোগো ঘরটর সাজানো হয়নাই তাই য়াইতে দিতাছিনা, প্রথম দিন অনেক নিয়ম কানুন আছে। বুঝোস নাই? ঘরটর সাজানো লাগে। আজ দম রাখ। কাল তোর জামাইর কাছে তোরে দিয়া দিমু৷

পিহু বলল

নানু ঘুমাচ্ছি আমি। আর কথা বলো না৷ লাইট বন্ধ করো। উফফ।

নাজিয়া বানু হেসে বলল

লজ্জা পাইছোস? লজ্জা পাইস না। আমি তোগো নানী। তোগো মনের কথা জানি।

পিহু কানের উপর হাত দিয়ে বলল

উফফ।

চলবে

#মন_গোপনের_কথা
#পর্ব_৪৩
লেখনীতে, পুষ্পিতা প্রিমা

ছিকুকে বুকের উপর নিয়ে শুয়ে আছে পিহু। ভোরের আলো ফুটছে। পাশে নাজিয়া বানু নেই। বোধহয় নামাজ পড়তে উঠে গিয়েছে। ছিকু ফুসফুস শ্বাস ছেড়ে ঘুমোচ্ছে। পিহু তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ডাকলো

কলিজা আমি উঠবো তো। এভাবে কেউ ঘুমায়?

ছিকুর সাড়াশব্দ নেই। পিহু তার গাল টানতে টানতে বলল

আব্বা পিহুকে উঠতে দেন।

ছিকু নড়েচড়ে উঠে পিহুর হাত সরিয়ে দিয়ে আবার ও ঘুমিয়ে গেল।

ঘরের দরজা ঠেলে কেউ একজন ঘরে ঢুকে এল। চোখাচোখি হতেই পিহু চট করে শাড়ির আঁচল খুঁজে নিল। ছিকুকে সহ ঢেকে নিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল।

মাহিদ কাবার্ড খুলে তার কাপড়চোপড় খুঁজতে লাগলো। সব পিহুর জিনিসপত্রে ঠাসা। পাশের নতুন কাবার্ডটি খুলতেই দেখলো সব পিহুর শাড়ি আর গয়নাগাটির বাক্স। তার কাপড়চোপড়গুলো খুঁজতে লাগলো সে। নাজিয়া বানু তজবি জপতে জপতে ঘরে এলেন। বিছানায় এসে বসলেন। বললেন

উঠছিস বইন? তোর কইলজ্যা তো এখনো উঠেনাই।

হ্যা এখনো ঘুমোচ্ছে।

মাহিদকে হন্য হয়ে কিছু একটা খুঁজতে দেখে নাজিয়া বানু বললেন

কি খুঁজিস ভাই ?

কিছু না। চুপ থাকো। মাথা খারাপ।

আচ্ছা চুপ থাকলাম। পিহু আইজ সূর্য কোনদিক দিয়া উঠবেরে? এত সক্কাল সক্কাল কাউরে তো ঘুম থেকে উঠতে কখনো দেখলাম না। আইজ হঠাৎ?

পিহু কপাল কুঁচকালো।

মাহিদ ঘাড় ঘুরিয়ে নানীর দিকে একবার চাইলো। আবার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। নানী বললেন

ভাই তোর কি রাতে ঘুম হয়ছে নাকি? তাই সকাল সকাল উঠে পড়ছিস।

মাহিদ জোরে চেঁচিয়ে ডাকলো

মা তাড়াতাড়ি আসো।

নানী ভড়কে গিয়ে বললেন

ওরেব্বাপ সকাল সকাল এত গরম ক্যান ?

মাহিদ বলল

বকবক না করে মাকে ডেকে নিয়ে আসো। আমার কাপড়চোপড় পাচ্ছি না।

নানী ধীরপায়ে হেঁটে ঘরের বাইরে গেলেন৷ পিহু ছিকুর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে চুপ করে মাহিদের কান্ড দেখতে লাগলো।
নীরাকে ডেকে নিয়ে এলেন নানী। নীরা এসে পিহুকে বলল

উঠেছ আম্মা?

পিহু মাথা নাড়লো।

মাহিদ বলল

আগে আমার শার্ট খুঁজে দাও। পরে কথা বলো।

নিজের জিনিস নিজে গুছিয়ে রাখতে পারিস না। এত কাজ ফেলে আমাকে তোর কাজ করতে হচ্ছে।

রাখছো কোথায় সব? যেদিকে যায় সেদিকে শাড়ি গয়না, বাক্স আর বাক্স। এগুলা কি? এটা আমার ঘর না কার ঘর। তাড়াতাড়ি এগুলা সরাও।

এগুলা মানুষে তোর বিয়েতে গিফট দিছে আর কি। কাল থেকে সব ঠিক হয়ে যাবে। এগুলো গোছগাছ করার সময় পেলাম কই? এগুলা তোর বউয়ের জিনিস। এগুলা তোর জিনিস। এখানে বাইরের মানুষের জিনিস রাখছি নাকি? আশ্চর্য!

সবুজ রঙের ব্যাগ বের করে মাহিদের সব কাপড় চোপড় বের করে দিল নীরা। বলল

ধর। এগুলো এখানের ভেতর রেখে দিছিলাম। ওখানে জায়গা ছিল না তাই।

সব কুঁচকে গেছে। এভাবে রাখছো কেন? এগুলো আমি পড়বো? ধ্যাত। তুমি পড়ো। ফালতু সব। পড়ব না।

পা নাচিয়ে হনহনিয়ে ঘরের বাইরে চলে গেল সে। নীরা তার যাওয়ার পথে ছুটতে ছুটতে বলল

তো আইরন করে নে না। নিজের কাজ নিজে করতে কখন শিখবি তুই? আজব। এই মাহি? আচ্ছা আমি করে দেব? দাঁড়া। কই যাস?

নীরা আবার ঘরে ফিরে এল। বলল

মা রিনা মিনাকে একটু ডেকে দাও তো ঘুম থেকে৷ পিহুকে রেডি করে দিক।

পিহু ছিকুকে বুকে জড়িয়ে ধরে উঠে বসলো। বলল

না। থাক মামি। আমি পারব।

নীরাকে কথায় আটকে দিয়ে নানী বললেন

মামি? কিসের মামি? এখন তোর শ্বাশুড়ি। মা ডাকবি তোর জামাইয়ের মতো। বুঝছিস?

পিহু বোকাসোকা চোখে তাকালো।
নীরা হেসে বলল

ডাকবে ডাকবে। মামিই ডেকে এসেছে তাই ভুল হচ্ছে। আচ্ছা তুমি রেডি হয়ে নাও আম্মা। হ্যা? রান্নাঘরে আপা হাঁপিয়ে উঠছে। আমি যাই।

পিহু ছিকুকে শুইয়ে দিয়ে বিছানা থেকে নামলো। ঘরটা এক আধটু গুছিয়ে দিল। নানী বললেন

বইন তোর জামাইর কয়েকটা জামাকাপড় আইরন করায় দে। পারবি? না পারলে রাখ৷

পারব।

পিহু আইরন করাতে গিয়ে দেখলো ছিকু গড়াতে গড়াতে বিছানায় একদম কোণায় এসে গিয়েছে। আইরন রেখে পিহু দৌড়ে গিয়ে তাকে কোলে তুলে নিল। ছিকু চোখ মেলে ড্যাবড্যাব করে চাইলো। পিহু হেসে বলল

গুড মর্নিং আব্বা।

গুড মুন্নিং পিহুচুন্নি। হাউআর ইউ। আয়েম ফাইন টেংকিউ।

পিহু হেসে তার নাকের মাথায় কামড় দিয়ে বলল

এগুলো কচুর কথা৷

ছিকু চোখ বন্ধ করে ফেলল আবার। পিহু বলল

আর না। এবার উঠেন। অনেক ঘুমিয়েছেন। উঠেন। মিহিকে শার্ট দিয়ে আসেন।

মিহির কথা শুনে ছিকু চোখ খুললো। গা মোচড় দিল। পিহু কোল থেকে নামিয়ে দিল। কোল থেকে নেমে সে নিজের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টেনে বলল

মিহিকে শাট দিবু না।

পিহু হেসে ফেলল। বলল

আচ্ছা। দিয়েন না। তো ঠোঁট টানছেন কেন?

নাজিয়া বানু বলল

ও বোধহয় গায়ের শার্টের কথা বলছে পিহু।

পিহু বলল, তাই তো এই শার্টের কথা বলছেন।

ছিকু তার গোড়ালি পর্যন্ত শার্টটা তুলে ধরে বলল

দিতে মন চায় না কেন?

পিহু হেসে বলল

এটার কথা বলিনাই তো। উফফো। আমি ওগুলার কথা বলছি। ওগুলা দিয়ে আসেন৷

ছিকু মাথা নাড়লো। ছিকু শার্টদুটো নিয়ে দৌড়ে দিল। পিহু বলল

পড়ে যাবেন। আস্তে।

ছিকু গেল। এল কেঁদে কেঁদে। পিহু বলল

কি হয়েছে? কে মেরেছে?

মিহির শাট উল্টি দিচে কেন? ছিকুর নজ্জা করছে কেন?

নানী বললেন

শার্ট উল্টায় দিছে? হায় আল্লাহ!

ছিকু ঠোঁট উল্টে কেঁদেই গেল। পিহু তাকে কোলে নিয়ে হাসতে হাসতে বলল

তো আপনি প্যান্ট পড়েননাই। সাবধানে থাকবেন না?

ছিকুর প্যান্ট নাই কেন?

আপনার আম্মা আনবে।

পরী রেহান চলে এল আটটার দিকে। ছিকু তাদের দেখে খুশিতে নাচতে নাচতে এল। খিকখিক করে হেসে দিয়ে রেহানের কোলে ঝাপ দিয়ে বলল

মিহি শাট উল্টি দিচে কেন?

রেহান পরী দুজনেই হেসে বলল

শাট উল্টায় দিছে? কামড়ে দিতে পারেননি? আপনার শার্ট প্যান্ট এনেছি অনেকগুলো। যান এগুলো পিহুকে পড়িয়ে দিতে বলেন। শার্ট প্যান্টের ব্যাগ নিয়ে পিহুর কাছে ছুটলো ছিকু। মাহিদ আসতেই পরী বলল

ভাই তুই আমার ছেলের ইজ্জত নিয়ে টানাটানি করছিস কেন? তোকে অসভ্য ডাকলে ভালো লাগে তোর?

বহুত ভালা লাগে বাপ।

বদমাশ একটা। পরী চলে যেতেই রেহান তার কাঁধ চাপড়ে বলল,

তো শালা বাবু আর কি খবর? আপনি বিয়ে করে সুন্দর সান্দর হয়ে গেছেন দেখছি। কি ব্যাপার স্যাপার?

মাহিদ গালে হাত রেখে বলল

কই সুন্দর হয়ছি? আমার সুন্দর হওয়া লাগবো ক্যান? আমি তো এমনিতেই সুন্দর।

রেহান হেসে দিল। বলল

না আজকে আর ও বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে। যাইহোক আমি আমার বোনকে দেখে আসি।

বলেই রেহান চলে গেল।

ছিকু কাপড় চোপড় পড়ে এসে মাহিদের কাছ থেকে দূরে দাঁড়িয়ে মুখ মোঁচড়ে দিয়ে নাক ফুলিয়ে চাইলো। রিপ রিক কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে মামা ভাগিনার কান্ড দেখছে। ছিকু মাহিদের শার্ট ছুঁড়ে মারলো। কোমড়ে হাত রেখে বলল,

ছিকু বিটিফুল শাট পড়িচে। মিহির শাট লাতি দিচে কেন? মিহির শাট পুচা কেন? ছিকুর বুমি আচে কেন?

রিপ আর রিক একসাথে হেসে উঠলো। মাহিদ সেদিকে না তাকিয়ে বলল

শালা প্রয়োজনের সময় পড়ছোস। প্রয়োজন ফুরায়ছে আর তুই লাতি দিছোস? এদিকে আয় তোরে দুটো লাতি দেয়। লাতি দিয়া ঘরের বাইর করি। আয়।

ছিকু দৌড়ে পরীর কাছে চলে গেল। রেহান পিহু আর পরী দরকারি কথা বলছিল৷ ছিকু সেখানে গিয়ে বলল

মিহি লাতি দিবে বুলচে কেন? ঘর থিকে বার করি দিবে বুলছে কেন?

রেহান বলল

আহা দরকারি কথা বলছিলাম। এই ছেলেটা আর কোনো কথা পায় না।

পরী বলল

একদম উচিত হয়েছে। দিক লাতি। ভাই আয় একে দুটো লাতি দে। সারাক্ষণ অযথা বকবক করে।

ছিকু ফোঁসফোঁস করতে করতে পিহুর পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। পিহু তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। সে পিহুর হাতে জোরে কামড় বসিয়ে দিয়ে বলল

পিহুর জামাই বুকা দিচে কেন?

পিহু চিৎকারে সবাই ছুটে এল। পরী ছিকুকে টেনে এনে ঠাস করো মারলো এক চড়। মাহিদ ছুটে এসে কোলে নিয়ে চলে গেল তাকে । ছিকু গর্জে গর্জে হাত পা ছুঁড়ে কাঁদা শুরু করে দিল। মাহিদ তাকে নিয়ে বাড়ির বাইরে চলে গেল। নীরা পিহুর হাতে বরফ ঘষতে ঘষতে বলল, বাচ্চাটাকে কেন যে রাগিয়ে দেয় আমি কিছু বুঝলাম না। গাধাটার কখন বুদ্ধিসুদ্ধি হবে? বাচ্চাটা কার রাগ কার উপর ঝেড়ে ফেলল। উফফ দাগ বসে গেছে।

পরী মলম এনে বলল, ছোট মা এটা লাগিয়ে দাও। দাঁত বসিয়ে দিয়েছে রাগে। দাঁত সব ফেলে দিব আজ। আসুক।

___________

আজকে অনেক মানুষের খাওয়া দাওয়ার আয়োজন হয়েছে। রান্নার জন্য বাবুচি আনা হয়েছে। ইশা আদি রাইনা, আফি আর দূর সম্পর্কের আত্মীয় স্বজনরা ও এল। মাহিদ তার বন্ধুদের অপেক্ষায় ছিল। তপু, আর লাবীবরা ও চলে এসেছে নিনিতের দেখা সাক্ষাৎ নেই। নিশিতা জালিশা আর মাইশা দুইটার দিকে এল। মাহিদ নিশিতাকে বলল

তোর ভাই কোথায়? ফোন দিচ্ছি ফোন ও তুলছেনা।

জালিশা ফট করে বলে ফেলল।

উনি আসবেন না ভাইয়া।

মাহিদ কপাল কুঁচকে চাইলো। নিশিতা বলল

মাহিদ ভাই শোনো। ভাইয়া বলছে আজকে অনেক মেহমান আর আত্মীয় স্বজনরা থাকবে। তাই ভাইয়ার নাকি লজ্জা লাগছে। তুমি একটু বুঝো ব্যাপারটা। রাগ করো না। ভাইয়া আমাকে বুঝিয়ে বলতে বলেছে। আদি আঙ্কেল ও অনেক করে বলেছে, ভাইয়া তারপর ও আসতো চাইছেনা। তুমি কিছু মনে করো না। মেহমান কমে টমে যাক, পরে আসবে।

মাহিদ শুধু মাথা নাড়লো উপরনিচ। নিশিতা বলল

রাগ করো না ভাইয়ার উপর। ভাইয়া সত্যি আসবে।

আর আসার দরকার নেই। থাক।

মাহিদ চলে গেল। নিশিতা তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকলো। পিহুর কাছে গেল তারা তিনজন। পিহুকে গোল্ডেন আর খয়েরী রঙের একটি জামদানী পড়ানো হয়েছে। পিহু তাদের দেখে ভীষণ খুশি হলো। জালিশা আর মাইশা বকবক করে নিশিতাকে বলল

তুমি কথা বলো। আমরা ঘুরে আসি।

ওরা চলে গেল। যেতেই পিহু নিশিতার খুব কাছে এসে বসলো। নিশিতা চোখ তুলে চেয়ে হাসলো। পিহু ও একটু হাসার চেষ্টা করে বলল

কেমন আছিস? আর কেউ আসেনি?

কার কথা জিজ্ঞেস করছিস?

মানে আঙ্কেল আন্টিরা আর স্যারের কথা বলছিলাম।

মা বাবা কি করবে এসে?

স্যার?

তোর স্যারকে তুই বলিসনি আসার জন্য?

পিহু ভড়কে গেল। নিশিতা হেসে বলল

মাহিদ ভাই বলেছে তাই বলিসনি? মাহিদ ভাইয়ের তো বন্ধু লাগে, আর তোর স্যার।

পিহু আমতাআমতা করতে করতে বলল

স্যারের আজকে আসার কথা ছিল। কেন এল না?

তোদের পরিবারের সব আত্মীয় স্বজনরা ভাইয়াকে চেনে। ভাইয়া চায় না কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে। সেটা মাহিদ ভাইকে বুঝিয়ে বলিস। মাহিদ ভাই রেগে আছে ভাইয়ার উপর।

অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসলো নিশিতা। ফোনে মনোযোগ রাখার বৃথা চেষ্টা করলো। পিহু তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। মিহি গলায় বলল

সবকিছুর জন্য সরি বান্ধবী। তুই আগের মতো হয়ে যাহ। আমি আমার আগের বান্ধবীকে সত্যি মিস করছি। নিশিতা মুখ ফেরালো না। তবে কম্পিত গলায় জবাব দিল

আমি তোর কেমন বান্ধবী রে? আমার পেটের সব কথা তোর জানা। জিয়াদের কোন কথাটা আমি তোকে না জানিয়ে ছিলাম? আর তুই?

পিহু আর ও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল

এভাবে বলিস না প্লিজ৷

নিশিতা ছাড়াছাড়ি করতে জোর দিল না। চুপটি করে বসে থাকলো। আঙুল দিয়ে চোখের কোণা মুছতে মুছতে বলল

তুই সুখী হ। মাহিদ ভাই তোকে ভালোবাসে। তোকে ভালো রাখবে। এই পরিবারের মানুষগুলোর সাথে তুই ভীষণ ভালো থাকবি। আমার পরিবার তোকে আর কতই বা ভালো রাখতে পারতো? যা হয় ভালোর জন্যই হয়। ভালো থাক।

জালিশা দরজার কাছটায় দাঁড়িয়ে থাকলো। মাইশা এসে তাকে ধাক্কা দিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে দিক। পিহু নিশিতাকে ছেড়ে দিল। নিশিতা বললো

কি হলো?

মাইশা বলল

একটা বিয়ে তো খেলাম ভালো করে। এবার ডক্টর আর জালিশার বিয়েটা খাবো। কি বলো পিহু?

পিহু হাসলো। জালিশা লজ্জা পেয়ে কাঁচুমাচু করে বলল

আচ্ছা পিহুকে নিয়ে যেতে বললো না?

মাইশা বলল

হ্যা তাইতো। পিহু চলো। চলো।

পিহুকে নিয়ে গেল তারা।

খাওয়া দাওয়া, রীতিনীতি, ফটোগ্রাফি সব হলো। জালিশা আছে ছিকুর পিছু পিছু। বাচ্চাটাকে তার ভীষণ মনে ধরেছে। কিন্তু বাচ্চাটা তাকে এত লজ্জা পায় কেন? লুকিয়ে লুকিয়ে থাকে। জালিশা ও কম না। তাকে একবার ধরলে আর ছাড়েনা।

এশার আজান পড়ে গিয়েছে অনেক আগে। বাড়ি ভর্তি মানুষ। অনেক আত্মীয়রা চলে গিয়েছে। নীরা মাইশাদেরকে যেতে দেয়নি। অনেক মজা হচ্ছে। জালিশা ও ভীষণ এনজয় করছে। কথায় কথায় নাজিয়া বানু বলে বসলেন ওনার জা’য়ের মেয়ের দুটো অবিবাহিত নাতি আছে। মাইশা আর জালিশাকে ওনার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। ওরা দুই ভাইয়ের জন্য এরা পারফেক্ট হবে। মাইশা আর জালিশাহা করে তাকিয়ে থাকলো। মাহিদ বলল

যাদের দেখো তাদের তোমার নাতিদের বউ বানানো লাগবো না?

তুই চুপ থাক। তুই তো বউ পাইয়্যা গেছিস। তাই রাজা হইয়্যা গেছিস। এদের ও জামাই লাগবো, আমার নাতিদের ও বউ লাগবো।

নিশিতা বলল

হ্যা নানু ঠিক বলেছ।

নীরা বলল

মা, তুমি আবিরের জন্য মাইশারে দেখো। তানভীরের জন্য অন্য কাউকে দেখো। জালিশা তো নিনিতের বউ হবে। ওদের কথাবার্তা চলতেছে তো।

জালিশার কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে যেন।

নানী নিশিতাকে বলল

কি বলিস?

নিশিতা মাথা নাড়লো।

তাইলে তো খুব ভালা। সুখী হ বইন সুখী হ। ডাক্তার নাতিরে তো আমার ভীষণ ভালা লাগে৷ বসেনাই ক্যান? এখন গল্প গুজব করতে পারতাম।

মাহিদের চেহারার রঙ পাল্টে গেল। নিশিতা বলল

কাল আসবে। আমি বলব।

আচ্ছা বলিস। তো তোর কি খবর? তোর তো বিয়া হয়ছে দেরী হয়ছে। বাচ্চাকাচ্চা কখন নিবি?

নিশিতা লজ্জা পেয়ে বলল

এগুলো কেমন কথা নানু? মাহিদ ভাই আছে।

মাহিদ উঠে চলে গেল। মাহিদ যেতেই সবাই হেসে উঠলো। মাইশা বলল

নানু সুখবর আছে তো। আমি জানি। লজ্জায় কাউকে বলছেনা।

নিশিতা বলল

আরেহ ধুরর চুপ থাক ভাই।

নীরা বলল

তাই? ওমা আমরা জানলাম না?

পিহু বলল

এই নিশু সত্যি নাকি রে?

জালিশা বলল

হ্যা হ্যা সত্যি। আরেকটা ছিকু আসবে। ভীষণ মজা হবে। ও লজ্জায় কাউকে বলছেনা। ওর শ্বাশুড়ি ও জানেনা। জানলে কোথাও যেতে দিবে না।

নীরা বলল

এটা কোনো কথা? ওনার জানার দরকার সবার আগে। এগুলো কত খুশির কথা। সেটা এখন আমি অনুভব করতে পারতেছি। আমি যে কখন শুনবো?

সবাই আরেক দফা হেসে উঠলো। জালিশা বলল

ও তো মাত্র পরশু টেস্ট করে জানতে পেরেছে আন্টি। কাল গিয়ে জানাবে।

তাইলে তো ভালো। যাইহোক সব ভালো হলেই হলো। তোমাদের বিয়ে কখন খাব সেটা বলো আগে।

জালিশা চুপ করে গেল। নানী মাইশাকে বলল

এই শোন তোরে আমি নাতবৌ বানাবো। খবরদার কারো দিকে চোখ দিস না।

মাইশা বলল

উফফ আমাকে ছাড়ো নানু। আমি এখন বিয়ে টিয়ে করছিনা।

নানী বললেন

না তোরে ছাড়তে পারুম না। নাতবৌ বানামুই তোরে৷

জালিশা হাততালি দিয়ে বলল

খুব জমবে।

___________

রাত হয়ে যাওয়ায় নীরা বলল তাদের থেকে যেতে। আজ কোথাও যাওয়া হচ্ছে না। জিয়াদের সাথে কথা বলে নিশিতাকে ও রেখে দিল। মাহিদের ঘর সাজিয়ে ফেলেছে সবাই মিলে। ছিকু সেখানে সবার কাজে সাহায্য করছে। পিহু মাহিদের নানীর সঙ্গে বসে আছে। ইশা, রাইনা, নীরা মুনা গল্প গুজব করছে।

কথায় কথায় পিহু ইশাকে বলল

কাল থেকে আর শাড়ি পড়ব না আম্মা।

ইশা মুনার দিকে তাকালো। মুনা বলল

পড়তে হবে না। থ্রি পিছ, টু পিছ যা আগে পড়তে সব পড়ো। শাড়ি পড়তে হবে এমন কোনো কথা নেই।

পিহু মাথা দুলালো। নানী বললেন

কেন? তুই বিয়ের প্রথম সাতদিন শাড়ি পড়বি। সেজেগুজে থাকবি। তারপর যা ইচ্ছা তাই পড়।

পিহু গালফুলিয়ে চাইলো। রাইনা বলল

ওমা! শাড়ি পড়লেই তো বউ বউ লাগে। তুই এখন এই বাড়ির বউ না? নানীর কথা শোন।

ছিকু এসে পিহুর কোলে গুঁজে বসলো। রাইনা বলল

মানিক তুমি যাবা না আমাদের সাথে?

পিহু বলল

না। আমার সাথে থাক।

ইশা বলল

ওর টিচার রাখা হয়েছে। এসব বলো না৷ ও যেতে চায়বে না।

ছিকু বলল

যাবু না কেন? যেতে মন চায় না কেন?

নানী বলল

খাইছে।

পিহু তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল

না না ও আমার সাথে থাকবে।

__________

রাতে সবাই মজা করে খেল। তারপর পিহুকে পিহুর ঘরে দিয়ে এল৷ পিহু এত রাজকীয়তা দেখে চুপ হয়ে গেছে। অদ্ভুত শিরশিরিয়ে উঠেছে মন৷ মাইশা বলল

আপনার সাহেব টাকা দেওয়ার ভয়ে পালালো নাকি? দেখা সাক্ষাৎ নেই।

পিহু বলল

আমি জানিনা কিছু।

নানী বললেন

এগুলো কোনো কথা? এই ছেলেরে এতকিছু শিখায় দিলাম।

নিশিতা বলল

টাকা দেওয়ার ভয়ে পালাইছে।

মাইশা বলল

কাল সকালে হলেও নিয়ে ছাড়বে আমি। এগুলো কোনো কথা?

নানী বললেন

আমার নাতি টাকা পয়সা কামাইনা এখন। তোরা আমার কাছ থেকে নে।

দাও। বেশি বেশি দিবা।

সবাই এক হাজার করে দিল নানী। বলল

আমার ভাইরে আর জ্বালাস না। যাহ।

সবাই টাকা পেয়ে ঘুমাতে চলে গেল। ছিকু দাঁড়িয়ে রইলো। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

ছিকুকে টেকা দাও না কেন?

নানী তাকে একটি একশ টাকার নোট দিল। ছিকু টাকা পেয়ে খুশিতে নেচে নেচে বলল

ওহ ওহ মুজা মুজা।

________

হসপিটাল থেকে নিনিতের সাথে দেখা করে ফিরলো মাহিদ৷ নিনিত আগেই বাড়ি ফিরেছে। দেখা হয়নি। সাদা পাঞ্জাবি পড়া কাউকে বাড়ি ঢুকতে দেখে রিক ডাক দিয়ে উঠলো ।

কে রে?

মাহিদ থেমে গেল। রিক বলল

ওহ তুই?

এত রাতে এখানে অন্ধকারে কি করো?

ঘুম আসছেনা তাই একটু হাঁটাহাঁটি করছি।

ঔষধ ঠিকঠাক খাচ্ছ?

হ্যা হ্যা ওসব ঠিক আছে। বরসাহেব বাড়িঘরের কাছাকাছি থাকো একটু। ঘরে বউ রেখে বাইরে এত ঘুরাঘুরি কিসের?

কাজে বেরিয়েছি। ঘুরতে নয়। ঘুমিয়ে পড়ো৷

তুই যাহ।

মাহিদ চলে গেল৷

অন্ধকার ঘরের আলতো করে লাগানো দরজা খট করে খুলতেই ভেতর থেকে আওয়াজ এল।

এখন না।

মাহিদ বাইরে দাঁড়িয়ে থাকলো।

শাড়িটা কেন যে পাল্টাতে গেল? মসলিন শাড়িটা পিনপিনে। ঠিকঠাক পড়া হয়ে উঠছেনা। একটু গুছিয়ে পড়তে না পারলে লোকে হাসবে না?

মাহিদের পায়ে ঝিঝি ধরে গেল। ঘরে ঢুকে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাতের ঘড়ি খুলতে আবছা আবছা পিহুকে দেখলো। চোখ সরিয়ে ঘড়ি খোলায় মনোযোগ দিল। পিহু বিড়বিড় করে বলল

এতক্ষণ বাড়ির বাইরে, আর এখন একটু দাঁড়াতে পারছেনা।

মাহিদ আবারও ঘর থেকে বের হয়ে গেল। বারান্দায় কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করবে। সে ঘর থেকে বের হতেই পিহু গলা বাড়িয়ে ঘরের বাইরে উঁকি দিল। না দেখে ধপ করে দরজা বন্ধ করে দিল। একা এই ঘরে তার ভয় লাগছে। জেদ, ভয় আর রাগে কান্নায় দুচোখ টলমল করছে। বুকে দ্রিম দ্রিম শব্দ হচ্ছে।
মাহিদ ভাবলো সে না ঢুকার জন্য দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। চেঞ্জ করা হলেই খুলে দেবে। হাঁটতে হাঁটতে এসে যখন দেখলো দরজা খোলা নেই তখন সে বারান্দায় রাখা চেয়ারে বসে পড়লো। বারান্দার গ্রিল পেরিয়ে রাতের আকাশ দেখা যাচ্ছে। ঝলমলে রাত। বসতে বসতে দু চোখের পাতা লেগে আসতেই ঘরের দরজার কাছে ছুটে গেল।
দরজায় ঠোকা দিতেই ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকা পিহু কেঁপে উঠলো। ছুটে এসে দরজা খুলে দিল৷ খোঁপাবিহীন খোলা চুল, গয়নাবিহীন নীল রঙের শাড়ি পরিহিতা রমণীর ভয়ার্ত দুচোখ আর মায়ায় ভরা চেহারায় কিছুক্ষণ ডুবে যাওয়া হলো না। বুকে এসে আঁছড়ে পড়লো বড় ধরণের ঢেউ। মাহিদ পিছিয়ে যেতে যেতে ও থেমে দাঁড়ালো।
পিহু ফুঁপিয়ে উঠলো। শক্ত করে বলতে গিয়ে ও গলা নরম হয়ে এল। বলল

আমার ভয় হচ্ছিল।

আমি বারান্দায় ছিলাম। দরজা খোলা ছিল না বিধায়,,

পিহু তাকে ছেড়ে পিছু করে দাঁড়ালো। গাল মুছতে মুছতে ভাবলো তারই বোকামি হয়েছে।

মাহিদ বিছানায় তাকালো। ইশ ফুলটুল দিয়ে এসব করতে কে বলছে এদের? একটু শোয়ার জোঁ রাখেনি। বালিশ আর বেডশিটের উপর থেকে কিছু ফুল সরিয়ে দিল। অনেক গর্জিয়াসভাবে সাজিয়েছে। সব খোলা সম্ভব ও নয় এখন৷

পিহু এখনো দাঁড়িয়ে আছে। মাহিদ শুয়ে পড়লো। লম্বা হয়ে শুয়ে চোখের উপর হাত রাখলো। পিহু সেদিকে একবার আঁড়চোখে তাকিয়ে আবারও ফুঁপিয়ে উঠলো। নিজের জায়গা পরিষ্কার করে ঘুমোচ্ছে। সে কোথায় ঘুমোবে সেটা ভাবার নামগন্ধ ও নেই। তাকে না দেখেমতো লাইট নিভিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ঘুমাতে হবে না তাকে। এটা তার ঘর নাকি? সে না ঘুমালেও কার কি আসে যায়? কোথায় তার রাগ ভাঙাবে, তার সাথে কথা বলবে তা না। ঘুম আর ঘুম৷ পা টা নাড়তেই ঝনঝন করে কি যেন মাটিতে পড়ে গেল। পিহু ফোঁপাতে লাগলো। ফোঁপানি একসময় কান্নায় পরিণত হলো। থেমে থেমে কান্না। কিছু বলতে না পারার। সইতে না পারার।

কাঁদতে কাঁদতে একসময় খেয়াল হলো তার হাতের আঙুলের ভাঁজে ভাঁজে ভাজিয়ে দেওয়া কারো আঙুল। হাত দুটো আর নড়তে পারলো না। শক্ত হাতের আঁকিবুঁকি মেদ হীন উদরের চারপাশে। তপ্ত নিঃশ্বাসের আঁচড় কাঁধে। উষ্ণ অধরের ক্লান্ত, অবসন্ন নরম হয়ে আসা শেষ বেলার স্পর্শে নতুন কোনো নাম না দেওয়া এক অনুভূতিরা যেন আঁকড়ে ধরলো পিহুকে।
আটকে যেতে যেতে পিহু শেষবারের মতো ফুঁপিয়ে উঠলো। বলল

আমাকে কারো দরকার নেই। আমার ও কাউকে প্রয়োজন নেই।

আমার ভীষণ দরকার।

চলবে,,
রিচেক করা হয়নি।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে