#মন_গোপনের_কথা
#পর্ব_৩৬
লেখনীতে, পুষ্পিতা প্রিমা
মাহিদের মুখ ফুলে গেছে ঠোঁটের ব্যাথায়। গায়ে জ্বর ও এসেছে। মাথা ভার হয়ে আছে। সকাল সকাল নীরা এসে পরপর অনেকবার দেখে গেল। মাহিদ উপুড় হয়ে শুয়ে রয়েছে। নীরা এতগুলো প্রশ্ন করলো একটার ও উত্তর দিল না। নীরা শেষমেষ বলল
‘ তোর বাপকে ডেকে আনি?
মাহিদ নড়লো। বলল
‘ কেন?
‘ কেন মানে? তুই এভাবে চিত হয়ে পড়ে আছিস কেন সেই তখন থেকে? কি সমস্যা? নিনিতের সাথে কি নিয়ে ঝামেলা হয়েছে? ও তোকে মেরেছে তাই তো? আমি বোধহয় ঠিক এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম। ভালোই হয়েছে। ঝামেলার বিষয় কি পিহু?
মাহিদ শক্ত হয়ে শুয়ে থাকলো এবার। নড়লো ও না।
নীরা পিঠে কয়েকটা চড় বসিয়ে দিল। বলল
‘ উঠ। উঠতে বলেছি। উঠ মাহি। মাইরা খাস না। আমার হাতের বাইরে যাসনি এখনো। উঠতে বলেছি।
মাহিদ উঠে বসে বলল
‘ উফফ কি সমস্যা তোমাদের? আমি কিছু জানিনা। আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন?
‘ তো কি তোর বাপকে জিজ্ঞেস করব বেয়াদব? নিনিতের সাথে কি হয়েছে? আমার দিকে তাকা।
মাহিদ তাকালো। নীরা বলল
‘ কি হয়েছে?
‘ কিছুই হয়নি।
দায়সারা ভাবে কথাটা বলল মাহিদ। নীরা বলল
‘ আমি কি পিহুকে ফোন দেব?
‘ আমি কি জানি?
নীরা চলে গেল। পিহুর ফোনে কল দিল। পিহু ফোন তুললো। স্বাভাবিক গলায় বলল
‘ কোনো সমস্যা মামি?
‘ নিনিত আর মাহিদের কি হয়েছে জানো? নিনিত বোধহয় রেগে গায়ে হাত তুলেছে।
পিহু চমকালো। গায়ে হাত তুলেছে? মেরেছে?
‘ হ্যা।
পিহু আর কথা বললো না। নীরা বলল
‘ এখন আমার কি করা উচিত?
‘ আমি কি বলব ? সব তোমার ছেলের দোষ। একদম ভালো হয়েছে মার খেয়েছে। আমি খুব খুশি হয়েছি। এরকম হওয়ারই ছিল।
‘ তুমি ওর সাথে আর ফোনে কথা বলেছ?
‘ না। কেন বলব? আমি ফোন দিতে বারণ করেছি। দরকার নাই আমার। কাপুরুষ তোমার ছেলে। সব তোমার ছেলের জন্য হচ্ছে। মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকতে বলো আর ও। আমি করব সব সমাধান।
বলেই জেদ করে ফোনটা কেটে দিল পিহু। নীরা রিপের কাছে গেল। বলল
‘ আপনি কি এভাবে বসে থাকবেন? এদের একটা বিহিত করুন না। আমার এসব আর ভালো লাগছেনা।
‘ আমি ইশুকে বলেছি।
‘ কি বলেছেন?
‘ বলেছি আর কি। আমার বেয়াইন হবে না কি?
নীরা অবাক গলায় বললেন
‘ সত্যি? কখন? আমাকে বলেননি।
‘ আহা রাগ করার কি দরকার? বলতাম তো।
‘ ইশু কি বলেছে?
‘ কিছুই বলেনি। হঠাৎ করে সারপ্রাইজ পেল তো, কথা বেরোচ্ছে না। আমি বলেছি পিহুকে জিজ্ঞেস করতে। ওর মত থাকলে তাড়াতাড়ি বিয়ে নামিয়ে ফেলব।
‘ আবার পিহুর মতামতের কি দরকার? মাইশা কি বলল শুনেননি?
‘ তারপর ও। পিহুর মত দরকার। মাহি কোথায়?
‘ এখনো শোয়া থেকে উঠছেনা। গায়ে জ্বর ও এসেছে।
‘ ডাক্তার আনার ব্যবস্থা করে ফেলো। জ্বর পালিয়ে যাবে।
‘ কিন্তু নিনিতের সাথে যে সমস্যা হলো।
‘ হওয়ারই কথা। আমি নিনিতের জায়গায় থাকলে আরও বেশি রাগতাম। বিয়ে, সম্পর্ক এগুলো হেলাফেলায় ফেলে রাখার বিষয় না নীরা। তাছাড়া বন্ধুত্বে বিশ্বাস, ভরসা, আশ্বাসের একটা ব্যাপার থাকে। যখন কেউ আমাদের বন্ধু ভাবে, আমাদের সাথে সব শেয়ার করে কিন্তু আমরা তার সাথে করিনা, মনের কথা বলিনা, সেই বন্ধুটি যখন সেটা জানতে পারে তখন তার খারাপ লাগবেই। এটাকে বলে বন্ধুর প্রতি বিশ্বাসের ঘাটতি। তোমার ছেলে বন্ধুত্বের মর্যাদা রাখতে পারেনি। এটাই তার প্রাপ্য।
‘ তো? ও তো কিছু বলছেই না।
‘ না বলুক। ওর কথা শুনছে কে?
নীরা বলল
‘ ধুর আপনি ও মজা করেন ব্যারিস্টার।
______________
নিনিতের মেজাজ চটে ছিল বিধায় কেউ ডাকাডাকি করতে যায়নি। নিকিতা বেগম ও যায়নি। ও সহজে রাগেনা। কিন্তু রাগলে রাগ কমানো অনেক দুষ্কর। নিশিতা ঘরে কয়েকবার উঁকি দিয়েছিল৷ কথা বলার সাহস করে উঠতে পারেনি। জালিশা তা দেখে বলল
‘ কোনো সমস্যা?
‘ হ্যা রে। ভাইয়া সকাল থেকে গম্ভীর হয়ে আছে। তুই কি কফিটা দিয়ে আসতে পারবি। আমাকে যদি বকা দেয়, ভয় লাগছে।
জালিশা বলল
‘ না। আমি যাব কেন?
‘ যা না। তোর উপর রাগারাগি করবে না।
‘ হুহ দেখা যাক। যদি কিছু বলে বলব আমাকে তুই পাঠিয়েছিস।
‘ ঠিক আছে।
জালিশা নিশিতার দেওয়া কফিটা নিয়ে ঘরে পা রাখলো। নিনিত চোখ তুলে চাইলো। জালিশা বলল
‘ কফি।
‘ টেবিলে রেখে চলে যাও।
‘ চলেই যাচ্ছি, থাকতে আসিনি।
জালিশার তেজী গলা। নিনিত রুক্ষ দৃষ্টিতে তাকালো। বলল
‘ আমি আজেবাজে কথা পছন্দ করিনা জালিশা। বেরোও ঘর থেকে।
‘ বেরোবো না।
নিনিত তেড়ে গিয়ে হাত ধরে টেনে ঘর থেকে বের করে দিতেই জালিশা থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো। বলল
‘ হাতটা এভাবে ধরেছেন কোন সাহসে? এত সাহস কোথাথেকে পেলেন?
‘ যথেষ্ট সাহস আমার আছে।
জালিশা হাতটা ছাড়িয়ে নিল। বলল
‘ ভুল কথা। আপনি একটা ভীতুর ডিম। সাহসিকতার ছিঁটেফোঁটা ও নেই আপনার মাঝে।
নিনিত রেগে চেয়ে থাকলো। জালিশা রসিকতা করে বলল
‘ ভীষণ ভয় পাচ্ছি। ওভাবে তাকাবেন না প্লিজ।
নিনিত চেঁচিয়ে বলল
‘ মা, নিশু কোথায়?
জালিশা বলল
‘ কেউ আপনার কথা শুনবে না।
নিনিত মহাবিরক্ত হলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল
‘ কি চাইছো টা কি তুমি?
‘ আপনাকে তো চাইছিনা। এত মেজাজ দেখাচ্ছেন কেন?
‘ তো কি চাও?
‘ আমি যা চাই তা আপনি কি দিতে পারবেন? জেনে কি লাভ?
‘ জেনে কোনো লাভ নেই। লাভ লোকসান দেখে চলিনা আমি। দয়া করে এখান থেকে যাও।
‘ চলে যাব। আগামী মাসেই ফ্লাইট। আপনাকে জ্বালানোর জন্য আমি থেকে যাব না।
নিনিত এবার চুপ হলো। কিছুক্ষণ পর বলল
‘ তাহলে ঠিক আছে।
_______
পরী মহাখুশি। ইশার মুখ থেকে খুশির সংবাদ শুনে সে আর ছিকু খুশিতে আত্মহারা। ছিকু কোমর দুলিয়ে নাচলো। ডিংকাছিকা ডিংকাছিকা। মিহি পিহুর বিয়ে! ওহ মুজা মুজা।
রাইনা বলল
‘ কি আশ্চর্যের কথা। কথায় ঝগড়া আর মারপিট করা দুজন বউ জামাই হবে? সংসার করবে? তোদের মাথা কি গেছে? মারপিঠ তো লেগে থাকবে দুজনের মধ্যে।
ইশা মিটমিট করে হাসলো শুধু।
পিহু সব শুনে যাচ্ছে। সন্ধ্যার দিকে আদি ইশা তার ঘরে আসতেই সে চেঁচিয়ে বলল, কোনো বিয়েশাদি করব না আমি। কেউ যদি ভুলেও ওসবের নাম তুলে খবরদার আমি বের হয়ে যাব ঘরে থেকে।
ইশা বলল
‘ একি কথা? আমি রিপদাকে হ্যা বলে দিয়েছি। আকদটা সেড়ে ফেলব তাড়াতাড়ি। নিনিত আর জালিশার বিয়ের কথা ও পাকাপোক্ত হোক।
পিহুর কৌতূহলী প্রশ্ন।
‘ কখন?
‘ সেটা এখনো ঠিক করা হয়নি। নিনিতের বাবা তোমার পাপাকে বলেছে এমনি।
‘ আমি কিছু জানিনা। আমাকে বিয়ে টিয়ের ব্যাপারে কিছু বলতো এসোনা। আমি বিয়েশাদি করব না। আমার অনেক পড়াশোনা বাকি আছে। যাও তোমরা।
আদি বলল
‘ কিন্তু?
‘ কোনো কিন্তু না।
পরী এসে বলল
‘ ওভাবে বলছ কেন পিহু? ভাই তো,,
‘ তোমার ভাই সম্পর্কে কোনো কিছু জানার আগ্রহ নেই আমার। আমি বিয়ে করব না মানে করব না।
আদি ইশার পিছুপিছু বেরিয়ে যেতে যেতে বলল
‘ মিষ্টি কি হবে এখন?
‘ জানিনা ডক্টর। রিপদাকে বলে দেখি।
‘ হ্যা ঠিক বলেছ। রিপকে বলো। ও ম্যানেজ করে নেবে।
______________
বাইরে ঠান্ডা হাওয়া বইছে আজ ভালো করে। মাহিদের ঘর অন্ধকার। নীরা লাইট জ্বালালো। দেখলো মাহিদ নেই। বারান্দায় যেতেই দেখলো মাহিদ দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। নীরা বলল
‘ নিনিতের সাথে কথা হয়েছে তোর ? এই মাহি?
মাহিদ তার দিকে ফিরলো। মাথা নাড়ালো দুপাশে।
‘ তুই ফোন দিস নি?
‘ দিয়েছিলাম। তুলেনি।
‘ তাহলে দেখা করে আয়।
‘ নাহ।
‘ তো? নিজে দোষ করবি তা স্বীকার ও করবি না। একদম ভালো কাজ হয়েছে। পিহু একদম বেঁকে বসেছে। ও তোকে বিয়ে করবে না। তোর মতো ছেলেকে কোনো মেয়েই বিয়ে করতে চাইবেনা গাঁধা। এবার থাক দেবদাস হয়ে।
‘ কেন?
নীরা রসিকতা করে বলল
‘ কেন আবার? আপনি যে মহান, আপনাকে দেখে ধেইধেই করে নেচে যে কেউ বিয়ের পিঁড়িতে বসে যাবে এমন ভেবেছেন? মেয়েদের মন পেতে অনেক খাটাখাটুনি করতে হয়। আপনি তা আগেভাগে পেয়ে গেছিলেন তো তাই ধরে রাখতে জানেন নি । এবার বুঝেন ঠ্যালা। নিনিতের বিয়ের জালিশার সাথেই হবে। ও বউ পেয়ে গেছে। কিন্তু তুই? তুই তো আর বউ পাবিনা।
আমি তো তোর বাপকে বলেছি, ভালো একটা পাত্র যোগাড় করতে পিহুর জন্য। ও খুব ভালো একটা ছেলে ডিজার্ভ করে। কম জ্বালা তো জ্বালাসনি মেয়েটাকে। এবার একটু ভালো থাকুক।
মাহিদ নীরার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলো। বলল
‘ কি বলছে পিহু?
‘ বলছে তোরে বিয়া করবে না। যারে পাইবে তারে করবে কিন্তু তোরে করবে না।
‘ কেন? রাগ করে বলছে।
‘ যে করেই বলুক। ও তোকে বিয়ে করবেনা বলছে।
মাহিদ হনহনিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে সোজা চৌধুরী বাড়ি হাজির। সবাই তাকে দেখে হতবাক। সবাই কতকিছু জিজ্ঞেস করলো মাহিদ বলল, সে ছিকুকে দেখতে এসেছে। পিহু একবার ও সামনে আসেনি। মাহিদ পিহুর ঘরে যেতে চাইলো। ছিকুর কারণে গেল না। শালা কিছু দেখলেই চিল্লায়।
আফি, আদি আর রেহান মিলে মাহিদের বারোটা বাজিয়ে ফেলল। সেই এক এক গা জ্বলানো বেয়াদব বেয়াদব কথা। ছিকু তো আছেই। পা তুলে তুলে কোমর দুলিয়ে নেচেনেচে বলল
‘ কেন? মিহি পিহুর বিয়ে কেন? মুজা মুজা লাগে কেন?
মাহিদের ইজ্জৎ সম্মান সব শেষ। ওই বেয়াদব বেডির লগে তার আসতে হয়ছে নইলে মানসম্মান নিয়ে টানাটানি পড়তো না। যে যা বলে গেল মাহিদ কানে ইয়ারফোন গুঁজে চুপচাপ বসে ছিল।
রাতের খাবার খাওয়ার সময় ও পিহুকে দেখতে পেল না মাহিদ। ছিকু তার সাথে খেয়েছে। সোফা উপর বসে আফির আঙুল নিয়ে খেলছে। মাহিদ তাকে ইশারায় ডাকলো। ছিকু তার কোলের উপর উঠে বসলো। মাহিদ তার তুষ্টুপুষ্ট গালে আদর বসিয়ে কানে কানে ফিসফিস করে বলল
‘ পিহুর বাচ্চি কি করছে, কোথায় আছে দেখে আয়।
‘ ছিকু কিছু বলে উঠার আগেই মাহিদ তার গাল চেপে ধরলো। বলল
‘ মানইজ্জত আর খোয়াইস না বাপ। সব গেছে আমার। যাহ দেখে আয়।
ছিকু চলে গেল। পরী বলল
‘ কোথায় যাচ্ছেন আব্বা?
ছিকু ব্যস্ত মানুষের মতো জবাব দিল
‘ ছিকু পিহুর কাছে যায়।
পরী হেসে বলল
‘ আচ্ছা সাবধানে।
ছিকু পিহুকে দেখে ফিরে এল। মাহিদের।কোলে উঠে বসলো। মুখোমুখি বসে বলল
‘ পিহু ঘরে নাই কেন? পিহু ছাদি কেন?
‘ ছাদে গেছে? তাইলে চল। নাহ তোরে নিয়া যাইবো না। তুই এইহানে থাক।
ছিকু রেগে তাকালো। মাহিদ তার গালে আদর করে বলল
‘ তোরে চকলেট দিমু। চিপস দিমু। আইসকিরিম দিমু। আমার মাথা দিমু। তোর মাথা দিমু। কান্দিস না কেমন?
ছিকু কপাল কুঁচকে চেয়ে রইলো। মাহিদ তাট গাল জোরে টেনে দিয়ে চলে গেল। ছিকু ভয়ানক রেগে গিয়ে বলল
‘ মিহি ডগ কেন? ক্যাট কেন? মাংকি কেন?
আফি বলল
‘ মাহিদ্দে তোমারে চ্যাঁতায় দিছে? চেতাইওনা। আসো কোলে আইসা বসো। তোমারে আদর করি। আসো ভাই।
‘ কেন? ছিকুকে আদর কেন? ছিকু বড়ো কেন?
‘ ওমা বড় হইয়্যা গেছ? কিতা কও? তোমারে দেখলেই তো আদর করতে মন চায়।
‘ কেন মন চায় কেন? মন পুঁচা কেন?
‘ বুড়া হইতাছি তাই বোধহয়।
রাইনা এসে ছিকুকে কোলে তুলে নিয়ে বলল
‘ ছেলেটার সাথে ফালতু কথা বলতে বারণ করছি। কিসব হাবিজাবি কথা শিখাচ্ছে ওকে।
ছিকু রাইনার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল
‘ কেন দাদাই হাজুবুজি বুলে কেন?
রাইনা তার প্রশ্ন শুনে হেসে ফেলল। রাইনাকে হাসতে দেখে ছিকুও খিকখিক করে হেসে ফেলল।
______
পিহু হাঁটতে হাঁটতে ছাদে এসেছে। হাতে ফোন। নিশিতার ফোনে একের পর এক ফোন দিয়েই যাচ্ছে। রিং পড়ছে কিন্তু নিশিতা ফোন তুলছেনা। পিহু ফোন দিচ্ছে আর পায়চারি করছে। করতে করতে একসময় ক্লান্ত হলো। রাগে, জেদে হাতের মুষ্টিকাঘাত করতে লাগলো রেলিঙে।
মাহিদ ততক্ষণে পিহুর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। পিহু তাকে দেখে অবাক হলো না৷ বরঞ্চ ছাদের কর্ণিশে দুজন পাশাপাশি কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল তার হিসেব নেই। পিহু যখন সরতে চাইলো৷ মাহিদ ওড়নার কোণা ধরে রাখলো। পিহু ওড়না ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বলল
‘ যত্তসব নোংরামি।
মাহিদ ওড়না ছেড়ে দিল সাথে সাথে। কথাটাই ভীষণ খারাপ লাগলো তার। পিহু চলে যেতেই মাহিদ পথ আটকে দাঁড়ালো। বলল
‘ তুই নাকি আমাকে বিয়ে করবি না বলেছিস৷
‘ হ্যা।
‘ কেন?
‘ সব কেন’র উত্তর নেই আমার কাছে ।
‘ কিন্তু আমার জানা দরকার।
‘ আমি তোমাকে বলতে বাধ্য নই। পথ ছাড়ো।
মাহিদ পথ ছাড়লো না। বরং পথ আরও ভালোভাবে আটকে দাঁড়ালো। বলল
‘ বন্ধু আমার গেছে। মার আমি খাইছি। সব ক্ষতি আমার হয়ছে। তুই এত রাগ দেখাস কেন? তোর তো কোনো ক্ষতি হয়নি।
‘ বন্ধু আমার ও গেছে। মার খাইনি। তবে বিষবাক্য শুনেছি। আর সব হয়েছে তোমার জন্য।
মাহিদ তার হাত খামচে ধরে বলল
‘ তাতে আমার দোষ কি?
‘ তোমার দোষ না? নিজের দোষ তো নিজে দেখবে না ৷ শুধু আমার দোষ দেখো। আর গজগজ করতে আসো। আমাকে কি খেলনা পেয়েছ? ছাড়ো।
মাহিদ ছাড়লো না, কথা ও বললো না। শুধু তীর্যক চোখে চেয়ে রইলো। পিহু হাতটা ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলল
‘ উফফ ছাড়ো। আমার ব্যাথা লাগছে।
‘ শেষপর্যন্ত এসে উল্টে যাচ্ছিস কেন তুই?
‘ তো কি করব? তুমি জানো নিশি আমাকে কাল কি বলেছিল? আমি এই মুখ নিকিতা আন্টির সামনে দাঁড়াতে পারব? তোমার লজ্জা না থাকতে পারে, আমার আছে। উফ ছাড়ো।
‘ তুই চাইছিসটা কি?
‘ কিচ্ছু চাই না। তোমাকে ও চাই না। যাও আমার সামনে থেকে।
মাহিদ আর দাঁড়ালো না। সোজা চলে গেল বাড়ির বাইরে। ইশা তার খোঁজ করতেই আফি বলল, মাত্রই বের হতে দেখলাম।
‘ বের হয়েছে? কোথায় গেছে?
‘ আমি তো জানিনা। বেরোতে দেখছিলাম শুধু।
পিহু এসে আফির পাশে বসলো চুপচাপ। ইশা রেহানকে বলল
‘ এটকু বের হয়ে দেখো তো আব্বা। ও কোথায় গেল?
‘ পিহু টিভির দিকে চোখ রেখে জবাব দিল, খোঁজার কি দরকার। চলে গেছে।
ইশা কপাল ভাঁজ করলো। গলার স্বর খানিকটা উঁচু করে বলল
‘ তুমি কিছু বলেছ ওকে?
পিহু চুপ করে থাকলো। ইশা বলল
‘ কি হলো? কি বলেছ?
আফি বলল
‘ ওরে বকতেছ ক্যান? ওদের ঝামেলা ওরা মিটায় নিবো।
ইশা বলল
‘ পিহু উত্তর দিচ্ছ না কেন?
পিহু গালফুলিয়ে বসে থাকলো চুপচাপ। ইশা বলল
‘ তুমি এত বেয়াদব হয়েছ কখন থেকে?
রাইনা বলল
‘ কি হয়েছে রে?
রেহান বলল
‘ কাকিয়া ওকে বকছ কেন? তুমি তো ছোট আন্টিকে ফোন দিতে পারো। মাহি বাড়ি পৌঁছালে ফোন করতে বলো।
ইশা বলল
‘ কোনমুখে ফোন করব? ওরা কি বলবে? ছেলেটাকে এত রাতে বের করে দিয়েছি বলবে না?
পিহু কাঁদোকাঁদো চেহারায় ঘরে চলে গেল। আদি এসে বলল
‘ মিষ্টি তুমি আমার মেয়েকে কি বলেছ? ও কাঁদছে।
‘ কাঁদুক। আদরে আদরে বাঁদর বানিয়েছেন।
ছিকু রাইনার কোল থেকে বলল
‘ কেন? পিহু ছিকুর মুতো মাংকি কেন?
সবাই হেসে উঠলো। হাসলো না শুধু আদি। সে মিষ্টির উপর রেগে আছে।
মাহিদকে হঠাৎ বাড়ি ফিরতে দেখে সবাই চমকালো। রিপ নীরাকে ইশারা করলে। নীরা মাহিদের পিছু পিছু ছুটলো। মাহিদ ঘরের দরজা বন্ধ করে দিত গেল। নীরাকে দেখে আর দিল না। নীরা হেসে বলল
‘ পিহুর রাগ কমছে? শোন তোদের বিয়ে এই সপ্তাহেই। কি মজা। তোর নানু কালই চলে আসবে। কি যে খুশি হয়েছে বলার বাইরে।
‘ আমি বিয়ে করব না।
‘ নাউজুবিল্লাহ। কি আশ্চর্য কথা! কি হয়েছে? আবার পিহুর সাথে ঝামেলা হয়েছে?
‘ আমার লগে সারাক্ষণ খ্যাঁকখ্যাঁক করে । ভালা করে কথা কয় না। বিয়া করুম না শালীরে।
‘ ওহহ। এগুলা তো রাগ কইরা বলতাছে বাপ। বুঝোস না ক্যান? তুই না বুঝলে কে বুঝবো?
মাহিদ নিচে তাকিয়ে থাকলো। নীরা বলল
‘ আইচ্ছা এখন ঘুমা। টা টা বাচ্চা।
মাহিদ বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। কতক্ষণ এপাশ কতক্ষণ ওপাশ করতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর ফোন বেজে উঠলো৷ পিহুর ফোন দেখে লাফ দিয়ে উঠে বসলো মাহিদ। আজকাল এমন হুটহাট ফোন পাওয়া ভীষণ দুষ্কর। মাহিদ ফোন তুলে বলল
‘ কি চাই?
পিহু গলায় কান্নাকান্না ভাব। সে তা যথাসম্ভব চেপে রাখার চেষ্টা চালিয়ে বলল,
‘ তোমার মাথাটা এনে দাও। সবাইকে কি খাইয়ে বশ করেছ? শোনো মাহিদ ভাই আমি তোমাকে ভালো টালো বাসিনা। আমাকে বিয়ে করে শান্তি পাবেনা তুমি। বিয়ের পর বলতো পারবানা কোনোকিছু। আগেভাগে বলে রাখলাম আমি।
‘ তোরে ও ভালো টালো বাইসা আমি উল্টায় ফেলছি। তোরে আমি ভালো টালো বাসিনা বাপ। আগেভাগে বলে রাখলাম। বিয়ার পর কিছু কইলেই তোরে খাইছি।
পিহু ফোনটা ছুঁড়ে মেরে বালিশটা ও ছুঁড়ে মারলো। হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিকু মতো করে থেমেথেমে কাঁদলো ইচ্ছেমত। রাগে, জেদে।
অন্যদিকে মাহিদ ঢুসে ঢুসে ঘুমোচ্ছে। কে জানে আর কবে শান্তিতে ঘুমাতে পারবে সে?
চলবে,
#মন_গোপনের_কথা
#পর্ব_৩৭
লেখনীতে, পুষ্পিতা প্রিমা
মেডিক্যালে মনমরা হয়ে বসে রয়েছে পিহু।নিশিতা এখনো আসেনি। বাকিদের সাথে গল্পগুজব করতে করতে পিহু ক্লাসের বাইরে এল। নিশিতা নিনিতের সাথে মাত্রই গেইট পার হয়ে ঢুকেছে। পিহু তাদের দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো। পাশ থেকে একজন প্রত্যুত্তর করলো
‘ পিহু তোর হ্যান্ডসাম।
পিহু রেগে তাকালো। মেয়েটা জিভ কেটে বলল
‘ সো সরি। স্যারকে আবার বলিস না। আচ্ছা তোদের বিয়ে কবে খাচ্ছি রে? নিশি তো এদিন বলল বেশি দেরী নেই। তুই আমাদের ম্যাডাম হয়ে যাবি? কি আশ্চর্য!
পিহু উত্তর না দিয়ে দাঁড়িয়েই থাকলো। তারা কাছে চলে এসেছে। পিহুকে দেখে খানিকটা থমকালো। তারপর দুজন দুদিকে হাঁটা ধরলো। পিহু একবার নিনিতের দিকে, আরেকবার নিশিতার পথের দিকে তাকিয়ে শেষমেষ নিনিতের পিছু পিছু দৌড়ে গেল। বলল
‘ স্যার?
নিনিত তার ডাকে ঘাড় ঘুরালো। বলল
‘ কোনো সমস্যা?
পিহু চুপসে গেল। বলল
‘ আ’ম সরি স্যার।
‘ কেন?
পিহু ভয়ে ভয়ে ঢোক গিললো। নিনিত বলল
‘ রিল্যাক্স। যা বলার বলে ক্লাসে যাও।
‘ আমি খুব সরি স্যার। আসলে আমি,,
‘ আমি কোনো কৈফিয়ত চেয়েছি?
পিহু ভয়ার্ত চোখ আবার তুলে নামিয়ে ফেলল। আমতাআমতা করতে করতে বলল
‘ আমার সাথে যা কথা তা মাহিদের সাথে হবে, তোমার সাথে নয়। যাও।
পিহু বলল
‘ আসলে আমি,
নিনিত সোজা হয়ে দাঁড়ালো। বলল
‘ কি তুমি? মাইশার কাছ থেকে আমি যা শুনেছি তাতে কখনো মনে হয়নি, মাহিদের একপাক্ষিক কিছু ছিল। তাহলে তুমি কেন কাউকে কিছু বলোনি? আমাকে না বলো নিশুকে বলতে পারতে। ও তোমার খুব কাছের বন্ধু। অবশ্য তুমি আর মাহিদ একই টাইপের। বন্ধুত্ব তোমাদের কাছে কিছুই না। শুধু একটা শব্দ। ব্যস।
আমি জেনেশুনে কখনো তোমাদের মাঝখানে আসতে চাইতাম না। অতটা নির্বোধ তো আমি নই। শুধুশুধু তোমাদের ভুলের কারণে তৃতীয়পক্ষ হয়ে গেলাম আমি। আমার অমন বন্ধু দরকার ছিল না। নেই। লাগবে না। আমি ও কারো বন্ধু নই। ক্লাসে যাও।
পিহু গেল না। নিনিত বলল,
কি হলো?
পিহু মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়েই থাকলো। নিনিত নিজেই চলে গেল।
পিহু তারপর ক্লাসে গেল। নিশিতা আজ অন্যপাশে বসেছে। অন্যদের সাথে গল্পগুজব করছে। পিহুকে দেখামাত্রই মুখ ফিরিয়ে নিল। পিহু তার জায়গায় গিয়ে বসলো। দু একবার নিশিতার দিকে ফিরে তাকালো। নিশিতা ভুলেও তার দিকে ফিরে তাকালো না।
যখন ক্লাস ছুটির সময় এল। নিশিতা সবার মাঝখানে দাঁড়িয়ে বলল
কনগ্রেস ইয়োর উইডিং মিসেস খানম।
পিহু থমথমে মুখে সবার দিকে তাকালো। সবাই ও যেন ভীষণ আশ্চর্য হয়েছে।
পিহু বলল
দোস্ত শোন না কিছু কথা ছিল…
নিশিতা গর্জে বলল
কারো বন্ধু নই আমি। যে বন্ধুত্ব শব্দটা নিয়ে ছেলেখেলা করে তার সাথে কোনো বন্ধুত্ব নেই আমার। মাইশার সাথে ভাব করেছি বলে আমার সাথে রাগ করেছিলি না? এখন তো বলতেই হচ্ছে তোর চাইতে মাইশা অনেক অনেক ভালো। অন্তত আমার কাছ থেকে কিছু লুকোয় না।
পিহুর চোখদুটো জলভর্তি।
এখন তোর কাছে মাইশা সব হয়ে গেল?
হবেনা কেন? মাইশা না বললে তো তোর সরূপ জানতাম না আমি। মাইশা সেগুলোই করেছে যেগুলো একজন প্রকৃত বন্ধু বন্ধুর জন্য করে।
আমি কি বলতাম তোকে, তখন,,,
এখন কোনোকিছু শুনতে চাই না।
পিহু ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো নিশিতা চলে গেল দলবল নিয়ে।
কয়েকজন দৌড়ে এসে বলল
দোস্ত দেখিস আমাদের বিয়ের দাওয়াত দিতে ভুলিস না।
বলেই আবার দৌড় দিয়ে চলে গেল।
_____________
মেডিক্যাল থেকে ফিরে ঘরের এককোণায় চুপটি করে বসে রইলো পিহু। ছিকু তাকে খুঁজতে খুঁজতে এল। হাতে বড় সাইজের একটি ফুটবল। দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে পিহুকে দেখে বলল
পিহু ডততর ছিকুর জুন্য ফুতবল আনিছে কেন?
পিহু কথার জবাব দিল না। ছিকু কপাল কুঁচকে পিহুকে পরখ করলো। বিছানায় উঠে পিহুর কোলে গিয়ে বসলো। ফুটবল দেখিয়ে বলল
পিহু ছিকুর সাথি ফুতবল খিলবে কেন? পিহুর মন খারাপ কেন?
পিহু বলল
খেলব না। প্রশ্ন করবেন না এত।
কেন? করবো না কেন?
উফফ মাইর খাবেন কিন্তু।
ছিকু কাঁদোকাঁদো চেহারায় বলল
কেন? পিহুকে ছিকুকে মারবে কেন? পিহু পুঁচা কেন?
পিহু তার গালের দুপাশে আদর করে বলল
আচ্ছা মারব না। যান ফুটবল খেলেন দাদাইয়ের সাথে। পিহু খেলবে না।
ছিকু রেগে গর্জে বলল
কেন? পিহু খিলবেনা কেন?
পিহুর মন ভালো নেই।
কেন? মন ভালো নেই কেন? মিহি বুউকে বুকা দিচে কেন?
পিহু বলল
যাহ পঁচা ছেলে। একদম চুপ। যান।
কেন যাবু কেন?
পিহু চিৎকার করে ডাকল
বড়মা? তোমার নাতিকে নিয়ে যাও। নইলে খুব মারবো আমি।
ছিকু রেগে নাকফুলিয়ে কোমরে হাত দিয়ে তাকিয়ে থাকলো পিহুর দিকে।
পিহুকে কামুড় দিতে মন চায় কেন?
রাইনা এসে বলল
কি হয়েছে রে?
দেখো বকবক করে আমার মাথা খাচ্ছে।
রাইনা ছিকুর দিকে তাকালো। ছিকুর দুচোখে জল টলমল করছে। রাইনা বলল
বিয়ে হয়ে গেলে আর পাবি আমার নাতিকে? তখন তো মিস করলে ও কাছে পাবিনা। চলো দাদুভাই।
পিহু খাট থেকে লাফ দিয়ে নামলো। ছিকু দৌড়ে চলে যেতেই পিহু তাকে ধরে ফেলল। কোলে তুলে বুকে শক্ত করে চেপে ধরে কপালে গভীর চুমু খেয়ে বলল
‘ আমার কলিজা!
ছিকু ঠোঁট উল্টাচ্ছে। পিহু তার গালে কপালে টুপটাপ আদর বসাতে বসাতে বলল
‘ আচ্ছা আর বুকা দিবো না আমার কলিজাকে।
ছিকু আদর পেয়ে চুপটি করে থাকলো।
পিহু হেসে বলল
‘ এই সুন্দর বিলাই?
‘ কেন ছিকু চুন্দর বিলাই কেন?
পিহু হেসে উঠলো। আহা কলিজা তার মন ভালো করার ঔষধ।
____________
বিয়ের উপলক্ষে নীরার মা নাজিয়া বানু এসেছেন। মাহিদ বাড়ি ফিরে নানীকে দেখে মহাখুশি। নাজিয়া বানু বলল
আমি এসব কি শুনলাম রে ভাই? তুই শেষমেশ পিহুরে,, হায়হায়।
মাহিদ চোখ গরম করে বলল
শরম দাও ক্যা বাপ?
নাজিয়া বানু হেসে ফেললেন। বললেন
আয় আয়। তোরে একটু আদর করি। তুই তো আমারে দেখতে যাস না।
মাহিদ এসে ধপাস করে শুয়ে পড়লো নানীর কোলে। বলল
জানেমন ডাক্তারের বাচ্চি তো মোর ফোন ধরেনা বাপ। এখন কিতা করুম?
আহা রাগ করছে? মারছোস টারছোস নাকি?
কিল্লাই মারুম? মারিনাই। কিন্তু এখন দেখতাছি শালীরে মারা লাগবো। কাল যামু। শালীরে সবার সামনে গিয়া মাইরা আসুম। ঠাস ঠাস কইরা মারুম। বেশি বার বাড়ছে শালী।
নাজিয়া বানু গালে হাত দিলেন।
এসব কেমন কথা ভাই? বউ হইতেছে ঘরের রাণী। রাণীরে এইভাবে সম্বোধন করতে নাই।
ফালতু কথা কইয়োনা। আমার সামনে কইতাছো ভালা কথা। কিন্তু ওই বেডির সামনে কইয়োনা। শালী এমনিতে আমারে দুপয়সার দাম দেয় না। এইডা হুনার পর এক পয়সা ও দিত না।
নাজিয়া বানু হাসতে হাসতে বললেন
‘ নীরু তোর ছেলের কথা শোন। এই ছেলেকে বউ দিচ্ছে এটা ও তো বেশি।
নীরা ব্যস্ত গলায় বলল
‘ ওর বাজে কথা শোনার সময় নাই মা।
মাহিদ বলল
‘ শালার বাপের বউ।
_______
বিয়ের বাজারের মেন্যু তেরী করেছে পরী। মাহিদকে ফোন দিয়ে বলল, ভাই বাজার লিস্ট অনেক বড়। সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হচ্ছে তুই বাপের টাকায় বিয়ে করছিস। এখন তোর বউয়ের খোঁটা শুনতে হবে সারাবছর।
বাপের টাকাই আমার টাকা বাপ। শালীরে কথা কম কইতে শিখায় দিবা। বেশি ফটরফটর করলে গাল চিইপ্যা দিমু ছিকুশালার মতো।
পরী খিকখিক করে হাসতে লাগলো। পিহু এসে বলল
কি সমস্যা? এত হাসাহাসি কিসের?
পরী চুপ হয়ে গেল। মাহিদ ফোনের ওপাশ থেকে বলল, আইছে নবাবজাদী। হারামজাদি।
________
আইমি বারান্দায় বসেছিল চেয়ার পেতে। হাতে বই। বই পড়ার অভ্যাসটা ছোট থেকেই। জালিশার সাড়াশব্দ নেই আজ। বই পড়ায় অমনোযোগী হলো সে। এখন আপাতত আর পড়ায় মন বসবেনা। বই রেখে উঠতেই নিয়াজ সাহেব এসে দাঁড়ালেন। বললেন
তুই এখানে? তোকে তো আমি খুঁজছিলাম।
বলো না কি বলবে।
শোন না। আমি জালিশার ব্যাপারে কথা বলতে চাচ্ছিলাম।
আইমির ঠনক নড়লো। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বলল
‘ আসলে ওখানে এক বাংলাদেশী পরিবার আছে। আমি ওখানেই জালিশাকে দেব ভেবেছিলাম। ছেলে এবং ছেলের পরিবার ভালো। জালিশাকে ও তারা পছন্দ করে। ছেলে ওখানেই সেটেল।
এটা কেমন কথা? তুই কি তোর ভাবির উপর রাগ করে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিস?
সিদ্ধান্ত তো নেওয়াই ছিল। ভাবির উপর রাগ কেন হবে? ছেলের জন্য মেয়ে পছন্দ করে রাখতেই পারে। এটা স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। যেহেতু বিয়েটা হচ্ছে না সেহেতু জালিশার কথা তোমাদের মাথায় আসতে পারে। তবে আমি চাইনা এটা।
জালিশা তো চায়।
চাইলেই সব পেতে হবে এমনটা নয়। আমি ওকে সবটা পরিপূর্ণ ভাবে দিয়ে বড় করেছি এমন না। ওকে অভাব এবং বাস্তবতা ও বুঝতেও শিখিয়েছি। ও মানিয়ে নিতে এবং মেনে নিতে শিখেছে। কষ্ট হবে তবে সামলে উঠবে। আমি চাই বাচ্চারা সবাই ভালো থাকুক।
আদি নিনিতের বাড়ি এসেছে বিয়ের দাওয়াত করতে। জালিশা তাকে দেখে এককোণায় চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইলো। আদি তাকে ইশারায় ডাকলো। জালিশা গুটিগুটি পায়ে হেঁটে এল। আদি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল
‘ কেমন আছ মামুনি?
‘ খুব ভালো। আপনি কেমন আছেন?
‘ এইতো আছি আলহামদুলিল্লাহ।
নিকিতা বেগম থাকায় জালিশা উশখুশ করতে লাগলো। তারপর চলে গেল। আদি বলল
‘ নিনিতের জন্য এমন মেয়ে পেয়ে আমি ভীষণ হ্যাপী। সবাই ভালো থাকলেই হলো।
নিকিতা বেগম চুপ করে আছেন। আইমি আসতেই আদি বলল
তোমাকে আজকাল ভীষণ ঘরকুনো মনে হচ্ছে কেন?
আইমি হাসলো। বলল
আর বলোনা। জাবির বেরোবে বেরোবে করে নিজেও বের হলোনা। আমাকে ও বের হতে দিল না। জালিশা কতবার বলল, তোমার বাসায় যাবে। যাইহোক বিয়ে উপলক্ষে কিন্তু অবশ্যই যাচ্ছি।
সিউর। আগেভাগে চলে যাবে। নিনিত কোথায় আপা?
নিকিতা বেগম গম্ভীর গলায় বললেন
বাইরে গেছে। বলে তো যায়নি।
আচ্ছা ঠিক আছে। আমাকে নিশুর শ্বশুরবাড়ি ও যেতে হবে। নতুন আত্মীয় তাই আমি চাচ্ছি গিয়ে বলে আসি। সেটা ভালো দেখায় কি বলো ইমি?
আইমি মাথা দুলালো। গুড ডিছিশন।
নিয়াজ সাহেব বললেন
আপনার মেয়ের বিয়ে এই সপ্তাহে। আর আমার ছেলের বিয়ে আগামী সপ্তাহে ডাক্তার সাহেব। বিয়েটা দিয়েই ছাড়বো।
নিকিতা বেগম চোখ তুলে তাকালেন নিয়াজ সাহেবের দিকে। আদি বলল
আমি ও সেটাই বলতে চাইছি। আমার যদি ছেলে থাকতো আমি কিন্তু জালিশাকে একদম ছেলের বউ করে নিতাম।
আইমি হেসে বলল
অতটা ভালো না যতটা ভাবছ। ভীষণ রাগী।
নিয়াজ সাহেব বললেন
‘ভালোই। আমার সাহেবের সাথে ওরকম বউ দরকার। যাইহোক জালিশাই আমার পুত্রবধূ হবে ডিছিশন কিন্তু ফাইনাল।
আদি বলল
আমার ভাবতেই ভালো লাগছে। ছেলেমেয়েরা ভালো থাকলেই আমরা এমনিতেই ভালো থাকি।
আইমি বলল
পরী কেমন আছে? ওর নাকি একটা ছোট্ট বাচ্চা ও আছে।
ভালো আছে। হ্যা ওর বাচ্চা মাত্র চার বছরে পড়েছে আর কি। ভীষণ পাকা পাকা কথা বলে।
কি বলো? আমার তো ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে। মিষ্টি কেমন আছে?
আরেহ গিয়ে সবাইকে দেখে আসো ভাই। আইমি হেসে বলল, হ্যা অবশ্যই।
________
বিয়ের বাজারে বের হয়েছে রেহান, পরী, পিহু, ইশা, রাইনা, নীরা,মুনা আর মাহিদ। সবার আদরের ছিকুসোনা তো রয়েছেই। সারা রাস্তা কেন কেন করে সবার মাথা নষ্ট করে দিতে সে সদা সর্বদাই প্রস্তুত। সবাই একসাথে বেরিয়েছে। মাহিদ মাঝপথ থেকে এসেছে। সে আসতেই রেহান বলল, তোমার বন্ধুরা কোথায়?
‘ সব শালা নিনিইত্যার কাছে। আমার কাউরে লাগবো না।
মেজাজ ভীষণ চটে আছে তার। গাড়ির দরজা খুলে একদম পিহুর পাশে এসে ধপাস করে বসে পড়লো সে। সবাই খিক করে হেসে উঠলো আওয়াজ করে। মাহিদের মতিভ্রম হতেই পাশে পিহুকে চেপে বসে থাকতে দেখে সবার হাসির কারণ বুঝতে পারলো। মুনা বলল
‘ বাহ মাহি তুই তো একদম সঠিক জায়গাটা বেছে নিয়েছিস।
মাহিদ উঠে যেতেই পরী হাত টেনে ধরে রাখলো। বলল
‘ বোস বোস। তুই বসবি না তো কে বসবে? উফ মা তোমরা ওকে লজ্জা দিচ্ছ কেন?
ইশা বলল, আচ্ছা ঠিক আছে আর লজ্জা পেতে হবেনা।
নীরা বলল
‘ শোন আমি একটা খয়েরী রঙের শাড়ি কিনবো ইশু। ব্যারিস্টার খয়েরী রঙ পছন্দ করে।
মুনা বলল
‘ হ্যা বিয়ে তো তোর ছেলের না। বিয়ে তোর আর তোর ব্যারিস্টারের।
সবাই হেসে উঠলো।
রাইনা বলল
‘ আচ্ছা আমাদের কেন তোদের সাথে আনতে হলো বলতো। আমি আমার দাদুভাইকে নিয়ে থাকতাম।
ছিকু বলে উঠলো
‘ কেন থাকবো কেন?
নীরা বলল
‘ এই দেখো প্রতিবাদী ছেলে।
খিকখিক করে হাসতে লাগলো ছিকু।
বরকনের বিয়ের বাজার শেষ হলো। তখন সবাই ক্লান্ত। সবার জন্য কেনাকাটা করতে করতে রাত অনেক হয়েছে। ছিকুর রেহানের কাঁধে ঘুমিয়ে পড়েছে। পিহু বড্ড ক্লান্ত। রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়া দাওয়া করলো সবাই। ছিকুকে দুটোর চাইতে বেশি খাওয়াতে পারেনি। সে চোখ খুলছেনা।
গাড়িতে বসতেই পিহুর চোখ লেগে এসেছে। ইশা বলল, নীরু সবাই আমাদের এখানে চলে আয়। রাতটা থেকে সকাল সকাল চলে যাস।
‘ না না এটা হয় না। বাড়িতে সবাই আমাদের অপেক্ষায়। কাল মেহেদী। অনেক কাজ।
মাহিদ গাড়িতে বসতে গিয়ে পিহুকে ওভাবে ঘুমোতে দেখে বলল, শালী আইজ আমার লগে কথা কইলি না। তোরে আমি দেইখা নিমু বাপ। তোর ভাব বাইর করুম আমি।
পিহু নড়েচড়ে উঠে আবার ঘুমোতে লাগলো। পরী এসে বলল, ভাই আরেকটু যাহ। পিহুর পাশে যাহ না আর ও। ওমা আমরা বসবো না? মাহিদ গেল। তবে খানিকটা আলগা হয়ে বসলো। সবাই একে একে সামনে পেছনে বসেছে। ছিকু পরীর কোলে ঘুম। মাহিদ তার গাল টেনে ঘুমের মধ্যে আদর করলো। গাড়ি ছাড়তেই পিহুর মাথা তার হাতের বাহুর উপর এসে পড়লো। মাহিদ বলল, ইজ্জত সম্মান সব শেষ করবো এই শালী।
পিহু ঢলে পড়ে যাচ্ছে সেটা মুনা খেয়াল করলো। মাহিদকে বলল
‘ এই মাহি পিহুকে ধর না। কি আশ্চর্য? ও তো পড়ে যাচ্ছে। তুই এমন কেন?
‘ কেমনে ধরুম বাপ? ধুর পারুম না। শরম করে।
সবাই এত ক্লান্তির মাঝে ও হেসে ফেলল। রেহান গাড়ির লাইট অফ করে দিল। শালাবাবু হবু বউয়ের লগে একটু আরাম কইরা বসুক। মা শ্বাশুড়ি আর জেঠির সামনে তার তো লজ্জা করে।
লাইট অফ হতেই রাইনা বলল, আমার চোখ এজন্য জ্বলছিল বোধহয়। উফফ এখন শান্তি লাগতেছে। মাহিদ ও একটু আরাম করে বসলো। পিহু ততক্ষণে তার বুকের সাথে লেগে গিয়েছে। মাহিদের আগে শরম করলে ও এখন করলো না। কারণ কারো চোখে তেমন পড়তেছেনা। এক হাত দিয়ে পিহুকে সযত্নে আগলে ধরে সে মাথা এলিয়ে দিল সিটে। পরী আঁড়চোখো তা দেখে ফিসফিস করে বলল
‘ ভাই জিও জিও।
চলবে,,,,