#মন_গোপনের_কথা
#পর্ব_৩২
লেখনীতে, পুষ্পিতা প্রিমা
মাহিদ ক্রিকেট ঘুরাতে ঘুরাতে বাড়ি ফিরলো মাত্র। রিপকে দেখে ক্রিকেট নিচে নামালো৷ রিপ বলল
‘ সামনে তোর পরীক্ষা খেয়াল আছে?
মাথা নাড়লো মাহিদ। তারপর ঘরে যেতেই নীরা এল। বলল
‘ ছিকুর নাকি গায়ে জ্বর উঠেছে৷ কিছু খেতেটেতে চাইছেনা। নিউমোনিয়া নাকি বেড়ে গেছে।
‘ কখন হলো এসব? আমি তো কাল ঠিকই দেখে আসলাম।
‘ অসুখ-বিসুখের টাইম ঠিকানা ঠিক থাকে? তোর বড়মা ওকে দেখতে যেতে চাইছে। আমি ও যাচ্ছি। তোরা বাপ ছেলে জ্যাটা মিলে রান্না করে খাস। ঠিক আছে?
যেন মামার বাড়ির আবদার। মাহিদ বলল
‘ এ্যাহহ?
‘ হ্যা।
‘ ইয়ামপসবিল। আমি রান্না টান্না করবার পারতাম না বাপের বউ। ইয়ামপসিবল। শালা ছিকু শালা আমারে শান্তি দেই না।
‘ এভাবে বলছিস কেন? বাচ্চাটা অসুস্থ। তোর কি আর কোনো কাজ নেই ওকে গালি দেওয়া ছাড়া। তারপরও ওই বাচ্চাটা মিহি মিহি করে।
‘ করে ক্যান? আমি ওরে আমার নাম জপতে কইছি? শালা ছিকু।
নীরা বলল
‘ অত কথা জানিনা। তোর বাপ বলছে থাকতে পারবে তাই আমি আর তোর বড়মা চলে যাচ্ছি। তোরা রান্না করে খাস। শোন তোর বড় আব্বাকে রান্নাঘরে একদম পাঠাবি না। তুই আর তোর বাপ মিলে করবি। তোর বাপকে বেশি চুলার কাছে দাঁড়াতে দিবিনা। তুই করবি যা করার।
‘ ওরেব্বাপ আমি অন্যের জামাই। পারুম না। কালা হইয়্যা গেলে আমারে কেউ বিয়া করবো না। কেন বুঝোনা না বাপ?
নীরা খিক করে হেসে আবার হাসি চাপা দিল। বলল
‘ যেটা বলেছি সেটা মনে রাখবি। আমরা নাইওরে যাইতাছি।
মাহিদ ধপাস করে বিছানায় শুয়ে পড়লো।
_____
ছিকুকে দেখার জন্য নীরা মুনা চলে গেল চৌধুরী বাড়িতে। রিপ নিজ হাতে রান্না করলো রাতের জন্য । লন্ডনে থাকার সময় সে নিজে রান্না করে খেত। তারপর অনেকগুলো বছর রান্না না করায় ভুলতে বসেছে। মাহিদকে ডাকলো। মাহিদ এক ডাকে সোজা দৌড়ে এল।
‘ কি লাগবে আব্বা ?
রিপ বলল
‘ লবণ আর ডিমের বাক্সটা খুঁজে দে।
‘ মাকে ফোন করি।
‘ এখানে আশেপাশে আছে। খুঁজে দেখ।
মাহিদ বিড়বিড় করলো
” শালার বাপ।
খুঁজে পেল অবশেষে। রিপ বলল
‘ ডিম ভেঙে নে তিনটা।
‘ আমি খাব না। দুইটা ভাঙি।
‘ চারটা ভেঙে নে।
‘ চারটা কেন?
‘ তুই দুইটা খাবি।
মাহিদ সোজাসাপটা তিনটা ভাঙলো। ভাঙতে গিয়ে মহামুশকিল। ডিমের খোসা পড়ে গেল ডিমের ভেতর। মহাযন্ত্রণা।
রাগ লাগলো মাহিদের। রিক এসে বলল
‘ কি করছিস বাপ ছেলে?
রিপ বলল
‘ তুমি কেন এলে? হয়ে গেছে আমার।
মাহিদ ইশারায় কি যেন বলতে চাচ্ছে রিককে। রিক জোরে বলল
‘ কি হয়ছে?
মাহিদ মাথা নিচু করে ডিমের খোসা তোলায় মনোযোগ দিল। রিপ বলল
‘ একটা কাজ ও ঠিকঠাক পারিস না?
থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকলো মাহিদ। রিপ ডিম ফাঁটিয়ে দেখালো। বলল
‘ এভাবে ফাটতে হয়।
রিক বলল
‘ শিখ শিখ। রান্নাবান্না শিখে নে বাপ। বউরে রান্না করে খাওয়াতে হবে।
মাহিদ বিড়বিড় করে বলল
‘ ইয়ামপসিবল। ডাক্তারের বাচ্চিরে রান্না কইরা খাওয়াতে পারুম না বাপ। কাভি নেহি।
রিক বলল
‘ আজ কি দিয়ে চলবে?
‘ ওরা তো রাতের জন্য সব রান্না করে গিয়েছে। শুধু ডিম ভাজছি। বাসি খাবার খেতে পারব না তাই বেশি রান্না করতে বারণ করেছি।
রাতের খাওয়া দাওয়া কোনোমতে চললো। ওদিকে নীরা মুনাকে দেখে খুশিতে আত্মহারা ছিকু। জ্বরের শরীরে মুনার কোলে একবার, নীরার কোলে একবার যেতে লাগলো। তারপর কিছুক্ষণ পরে বলল
‘ মিহি আচেনা কেন? মিহি পুঁচা কেন?
নীরা বলল
‘ মিহিকে আবার পাঠাবো বাবুসোনা।
___________
রান্নাঘরে কাজ চলছে। মাহিদ রিপের পেছন পেছন এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছে। উফ মা বড়মা সারাবছর কেমনে যে রান্না করে খাওয়ায়? এই রান্নাবান্না এত কষ্টের কাজ!
রিক দুজনের কাজ দেখছে। নিজে ও কিছু কিছু সাহায্য করছে। ফ্রিজ থেকে বের করা সামুদ্রিক মাছ ধুঁতে গিয়ে ঝামেলা বাঁধিয়ে ফেলল মাহিদ। বড় কাঁটা বিঁধে গেল আঙুলের কোণায়। সে কাঁটা ছাড়িয় নিতেই গড়গড়িয়ে রক্ত বের হলো। রিপ তাড়াতাড়ি ফার্সএইড বক্স এনে ব্যান্ডেজ করালো। বলল
‘ তুই যাহ। লাগবে না।
মাহিদ গেল না। রিপ তাকে কিছু করতে দিল না। তারপর ও সে গেল না৷ এসব কাঁটাছেড়া সামান্য। বারোটা বাজবে আর কিছুক্ষণ পর। ভাতের চাল এখনো ধোঁয়া হয়নি। দরজায় কলিং বেল বাজতে লাগলো। মাহিদ দরজা খুলতে গেল। দরজা খুলে যাকে দেখলো তাকে দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না সে।
পিহু ভুরু উঁচিয়ে বলল
‘ হা করে কি দেখছ? লজ্জা শরম নাই? বেয়াদব।
মাহিদ ঠোঁট বাঁকা করে হেসে বলল
‘ আরে আমার বল্টুর হবু ইসটিরি কোথাথেকে আইলো বাপ?
‘ বেয়াদব। কিসের ইসটিরি? ফালতু কথা বলার জায়গা পাও না। পথ ছাড়ো। মামাকে ডাকব?
মাহিদ পথ ছাড়লো। পিহু বাড়িতে পা রেখে মামা মামা ডাকতে ডাকতে রান্নাঘরের দিকে ছুটলো হাতের ব্যাগপত্র নিয়ে। রিপ রিক তাকে দেখে চরম অবাক। পিহি তাদের চমকে দিতে পেরে ভীষণ খুশি। রান্নাঘরের সব পাতিলরে ঢাকনা সরিয়ে দেখে বলল
‘ সব রান্না কি শেষ?
‘ না। ভাত রান্না হয়নি এখনো।
পিহু বলল
‘ আর রাঁধতে হবে না। আম্মা পাঠিয়েছে সব। তোমাদের আর রান্না করতে হবে না। এগুলো দুপুরে হয়ে যাবে। রাতে আমি রান্না করব। মামিরা কয়েকদিন থাকবে।
রিপ বলল
‘ আমাদের রান্না করে খাওয়াতে চলে এসেছ?
‘ হাহ। আম্মা পাঠিয়েছে অবশ্য। তার ভাইরা কেন রান্না করে খাবে?
রিক হেসে বলল
‘ একদম ঠিক। এটা কি রান্না করে খাওয়ার বয়স? এখন পুত্রবধূর রান্না খাওয়ার বয়স। রিপ তাকাতেই রিক সতর্ক হয়ে বোকা হাসলো। পিহু রেগে বলল
‘ কচুর বধূ।
মাহিদ রান্নাঘরের বাইরে উঁকিঝুঁকি দিতে লাগলো। রিক বলল
‘ তোর আর কোনো দরকার নাই বাপ। যাহ।
‘ বাড়ির বাইরে যাব?
রিপ বলল
‘ ফোন দিতে না হয় মতো।
মাহিদ তো উড়াল দিক সুযোগ বুঝে। ডাক্তারের বাচ্চি রাইন্ধা মর বাপ।
ইশা দুপুরের সব রান্না পাঠিয়েছে। রাতে ও খেতে পারবে।
দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেড়ে মাহিদ আবার কোথায় যেন চলে গেল।
সন্ধ্যার পর এল। পিহু তখন কিছু সবজি ভাজি করছে। মাছ মাংস আছে। মাহিদ এসে সোজা রান্নাঘরে চলে গেল রিপ আর রিকের চোখ এড়িয়ে। পিহু গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে রান্না করছে। মাহিদ গিয়ে বলল
‘ তোর গানের মারে বাপ। চা দে। চা খামু।
পিহু ভড়কে উঠে হাতের সবজির বাটি ফেলে দিল। ঝনঝন করে আওয়াজ হতেই চেঁচিয়ে উঠলো পিহু। রিপ আর রিক ছুটে আসতেই মাহিদ শক্ত হয়ে গেল। পিহু বলল
‘ আসার সাথে সাথে গালাগালি করো কেন? আশ্চর্য!
পিহু সবজি তুলে চুপচাপ কাজ করতে লাগলো। রিপ এসে বলল
‘ কি হয়েছে পিহু?
‘ কিছু হয়নি মামা।
মাহিদ পানি খাচ্ছে। পিহু রিপের দিকে ফিরলো। বলল
‘ মাহিদ ভাই চলে এল তো। আমি ভয় পেয়ে চিৎকার দিয়েছি। বাটিটা পড়ে গেল। তেমন কিছু না।
রিপ চলে গেল।
মাহিদ বলল
‘ এই বেডি রান্নাঘরটা আমার বউয়ের বুঝছোস? সব জিনিস সুন্দর কইরা সাজায়গুছায় রাখবি বাপ। নইলে খবরদার তোরে খাইছি আমি৷
পিহু মুখ মোঁচড়ে দিয়ে বলল
‘ ঢং।
মাহিদকে চা বানিয়ে দিল পিহু। মাহিদ চা টানতে টানতে বলল
‘ না তেরে দেওয়া যাইতো না বাপ। তোর চা মজা। তোর চা খাওয়ার লগে হলে তোরে এইখানে রাইখা দিমু। বুঝছোস?
পিহু জবাব দিল না। সবজিগুলো বেসিনে ধুঁয়ে বলল
‘ ধুরর তুমি ছিলানা কত ভালো ছিলাম আমি। যাও তো আমাকে রাঁধতে দাও। নইলে আমি মামাকে ডাকবো।
‘ চুপ বেডি। ঢং করোস? তোরে কি আমি জড়াই ধরছি যে তুই কাজ করতে পারতেছোস না?
পিহু কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো। ছিঃ ছিঃ কি বেয়াদব কথা৷
পিহুকে বিরক্ত করে মাহিদ চলে গেল তার ঘরে। পিহু রান্নাবান্না শেষ করে রিপ আর রিকের সাথে বসে টিভিতে নিউজ দেখতে দেখতে গল্পগুজব করলো অনেক্ক্ষণ। ছিকুকে নিয়ে যত কথা। রিপ আর রিককে ও যেতে হবে ছিকুকে দেখতে।
তারপর রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ করলো সবাই মিলে। রিপ মাহিদকে বলল সবাইকে বেড়ে দিতে। মাহিদকে তাই তাই করতে হলো। পিহু খেতে খেতে মিটিরমিটির করে হাসলো।
_____
রান্নাঘরের সবকিছু পিহুর সাথে গোছগাছ করতে হলো মাহিদকে। বাপের আদেশ বলে কথা৷ পিহুর উপর রেগে বুম হয়ে থাকলো মাহিদ। শালীরে উচিত শিক্ষা দিতে হবে আজ।
সব গোছগাছ করে সবাই ঘুমিয়ে পড়লো। পিহু ও ঘুমিয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ পর ঘুম ছুটে গেল তার। পায়ের অদ্ভুত আওয়াজ আর একটি ছায়া তার ঘরের দরজার ওপাশে। দরজা লাগাতে উঠে গেল পিহু। সারা শরীর শীতল হয়ে গেল তার, বোরকা পড়া কাউকে হাঁটতে দেখে। যেন কথা বলার শক্তি ও হারিয়ে গেছে। পিহু কাঁপতে লাগলো তরতরিয়ে। সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার দেওয়ার সময় বোরকা পড়া অবয়বটি তার মুখ চেপে ধরলো। ফিসফিস করে বলল
‘ বেহুশ হইস না বাপ। এইতা দাদীর বোরকা। তোরে ডর লাগাতে চাইছি। কিন্তু তুই তো বাপ আমার বাপ জেঠারে ঘুম থেকে তুইলা ফেলবি।
পিহু তাকে জোরে ধাক্কা মেরে বলল
‘ বেয়াদব লোক।
মাহিদ হেসে বোরকা খুলে ছুঁড়ে মারলো। পিহুর হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল
‘ আয়।
‘ কোথায় যাব?
‘ আইসক্রিম খাইতে যামু বাপ। আয়। আওয়াজ করিস না। বাইরে তালা লাগাইয়া চইলা যামু।
পিহু বলল
‘ মামারা জানলে কি বলবে। ধুর আমি যাব না। আমার ভয় করে।
মাহিদ তার হাত ছেড়ে দিল। একাই হনহনিয়ে চলে যেতে যেতে বলল
‘ যাহ তোরে লাগতো না৷
পিহু কিছুক্ষণ চুপ থেকে তার পিছু পিছু যেতে যেতে বলল
‘ যাচ্ছি। রাগ করে কেন?
রাত এগারোটা। আকাশটা ঝলমলে। সড়কবাডির আবছা আলোয় হাঁটছে দুজন কপোত-কপোতী। মাহিদ পিহুর হাতটা টেনে নিয়ে গেল৷ রাস্তায় এখনো অনেক মানুষের চলাফেরা। কত ব্যস্ত মানুষ৷ মাহিদ আইসক্রিম কিনে আনলো৷ পিহুর দিকে একটি বাড়িয়ে দিয়ে বলল
‘ ধর খাহ। আর আমারে গালি দে।
পিহু নিয়ে বলল
‘ গালি দেব কেন?
মাহিদ হাসলো৷ কিছু বলল না৷ পিহু আইসক্রিম খেতে খেতে এদিকওদিক দেখছিল৷ রাতের পরিবেশ অন্যরকম সুন্দর। মাহিদকে হুট করে কোথায় যেন চলে গেল৷ আবার হুট করে কোথা থেকে দৌড়ে এল।
পিহু বলল
‘ একা রেখে কোথায় যাও? বাড়ি যাব। চলো।
‘ যাহ বাপ দূর হ। যাহ। মাইনষ্যে কত রাত অব্ধি ঘুরাঘুরি করে জানোস? শালা অশিক্ষিত।
পিহু মুখ কালো করে বলল
‘ তো এনেছ কেন?
হনহনিয়ে হাঁটা ধরলো পিহু। মাহিদ তাকে আটকালো না৷ হাঁটতে অনেকদূর চলে গেল সে। মাহিদের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ভয় করলো। সে একা যাবে কি করে?
ভয়ে গা ছমছম করে উঠলো পিহুর। মাহিদ ঠিক সেসময় দৌড়ে এল। পিহু নিজের ভয়ার্ত রূপ না দেখিয়ে সোজা হাঁটতে লাগলো। মাহিদ সামনে এসে দাঁড়ালো। পেছনে হাত লুকোনো। পিহু সামনে পিছু পিছু হাঁটতে হাঁটতে বলল
‘ দাঁড়া না।
পিহু দাঁড়ালো না। মাহিদ বলল
‘ আমি পিছু হাঁটতেছি। পড়ে যাব।
‘ যাও।
মাহিদ হেসে ফেলল। লুকোনো হাত দুটো সামনে আনলো। একগুচ্ছ টকটকে রক্তাত্ত লাল গোলাপ। পিহু থমকে গেল। মাহিদ বলল
‘ ধর। একদম দশ টাকা দিয়ে দিয়া দিছে। বেচাকেনা নাকি শেষ। তোরে আমি ভালা টালা বাসি, ধর তাই বাসি ফুল দিলাম। ধর। বাসি হলেও ফুলগুলা কিন্তু সুন্দর। ধর।
পিহুর চোখ ঝাপসা। ফুলগুলো নিল কম্পিত হাতে। মুখ দিয়ে কথা বেরোচ্ছেনা তার। চোখের জলগুলো ফেলার জন্য কোথাও পালাতে ইচ্ছে হলো।
মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে বের হলো
‘ তুমি সত্যি মাহিদ ভাই? মাহিদ ভাই কখনো আমার সাথে ভালো করে কথা বলেনা।
মাহিদ হেসে উঠে তাকে টেনে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে মাথার উপর ঠোঁট চেপে বলল
‘ যাহ বাপ আমি তোর কোনো ভাই টাই নই। আমি তোর জামাই।
চলবে,,,,
#মন_গোপনের_কথা
#পর্ব_৩৩
লেখনীতে, পুষ্পিতা প্রিমা
পিহু নাকের পানি চোখের পানি এক করে মাহিদের শার্ট বরবাদ করে দিল। মাহিদ দূরে দাঁড়িয়ে শার্টের দিকে তাকিয়ে বলল
‘ তোরে একটু সোহাগ কইরা কথা ও কইলে ও দোষ শালী । আমারে বরবাদ কইরা দিলি। শার্টটা ধুইয়া দিয়া তারপর ঘুমাইতে যাবি বাপ।
পিহু হাতের কব্জি দিয়ে নাক মুছে বলল
‘ ধুবো না।
‘ ক্যান ধুবিনা?
‘ ধুবো না মানে ধুবো না।
মাহিদ নিচের ঠোঁট কামড়ে কপালে ভাঁজ ফেলে তাকালো। পিহু মুখে চেপে ধরে হাসি আটকে বলল
‘ তুমি এগুলা করলে আমার হাসি পায় বাপ।
মাহিদ কপালের ভাঁজ আর ও গাঢ় করে বলল
‘ তাইলে হাস। না হাসলে আইজ তোরে খালপাড়ে নিয়া গিয়া ফালায় দিয়া আসুম বাপ।
পিহু পিছু হাঁটতে হাঁটতে বলল
‘ তোমার কথা শুনে আসলেই হাসি পায়।
মাহিদ এগিয়ে গিয়ে পিহুকে খপ করে ধরে বলল
‘ তাইলে তোরে কাতুকুতু দিমু।
পিহু ভয়ার্ত চোখে তাকালো। বলল
‘ না না মাহিদ ভাই। ছেড়ে দাও। আর হাসব না। কছম। ছেড়ে দাও।
মাহিদ নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে আবার রেগে তাকালো। আর জোরে শক্ত করে ধরে বলল
‘ ভাই ডাকোস কিল্লাই বাপ?
পিহু একটু স্বস্তি পেল। যাক কথা অন্যদিকে ঘুরে গেছে। পিহু একটু মজা নিল। হেসে বলল
‘ ভালোই তো। মামা হতে পারবে।
‘ কার?
পিহু লজ্জায় বলতে পারলো না। আহা কি লজ্জা। কান দিয়ে গরম হাওয়া বেরোচ্ছে পিহুর। কি আশ্চর্য!
মাহিদ বলল
‘ এই বেডি তুই আমারে আর ভাই ডাকলে তোর খবর আছে বাপ। কাউরে মামু ডাকতে দিমুনা। আমার বাপ ডাকবো বাপ।
পিহু হাসি চেপে রাখতে না পেরে হেসে ফেলল আওয়াজ করে। মাহিদ নাকমুখ কুঁচকে তাকিয়ে থাকলো। বুঝতে পারলো না এই বেডির সমস্যা কিতা?
পিহুর মাথায় চাটি মারলো সে। পিহুর হাসি তৎক্ষনাৎ থেমে গেল। মাথার পেছনে হাত চেপে মাহিদের দিকে তাকালো। কথা বললো না। মাহিদ বলল
‘ ওভাবে কি দেখোস বাপ? হাসোস কিল্লাই?
পিহু থমথমে চেহারায় চেয়ে রইলো। মাহিদ আঁড়চোখে তাকালো কিছুক্ষণ। তারপর হো হো করে হেসে উঠলো। পিহু তাকে ঠেলে সরিয়ে দিল। গর্জে বলল
‘ সরো।
মাহিদ বলল
‘ তোরে বহুতদিন পর মারছি বাপ। রাগ করোস কিল্লাই? তোরে কি আমি জোরে মারছি বাপ? আস্তে কইরা মারছি। এমন করোস ক্যা?
পিহু ফোঁপাতে থাকলো। মাহিদ তার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল
‘ আয় অনেক ঘুরছোস। বাড়ি যাই। বাপ জেঠা যদি ঠাহর পায় সর্বনাশ বাপ। আয়।
পিহু হাতটা ছাড়িয়ে নিল। চুপচাপ হাঁটতে লাগলো। পুরো পথটায় আর কথা বললো না। মাহিদ পিহুর পেছনে হাঁটতে হাঁটতে বিড়বিড়িয়ে বলল
‘ ডাক্তারের বাচ্ছি তোরে আগে নিজের কইরা লয়। তারপর এমন মাইর দিমু।
___________
দরজার তালা খুলতেই রিককে সামনাসামনি দেখে চমকে উঠলো মাহিদ পিহু দুজনেই। পিহু মাহিদের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। রিক বলল
‘ কি অবস্থা?
মাহিদ চুপ। কিছুক্ষণ হাতা গুটিয়ে বলল
‘ আর কইয়োনা বাপ। এই শালী কয় আইসক্রিম খামু মাহিদ ভাই। মুই তার ভাই লাগি, না খাওয়াইলে কেমনডা লাগে? বিয়াশাদী হইয়্যা গেলে তারে কি আমি আর পামু। কও তো?
রিক মাথা ঝাঁকিয়ে বলল
‘ তা ঠিক তা ঠিক। তো কি কি খাইলি?
‘ বহুত কিছু খাওয়াইছি শালীরে। ওরে জিজ্ঞেস করো। আমি ঘুমাইতে যাই।
মাহিদ চলে গেল। পিহু লজ্জা পেয়ে দৌড়ে দৌড়ে চলে গেল মাহিদের পিছু পিছু। ঘরে ঢুকে পড়ার আগে মাহিদ কোথাথেকে তার গাল টেনে ধরলো। বলল
‘ রাগ বাপেরে লাত্তি মইরা ফালায় রাখ বাপ। রাগ করিস না। আমি তোর জামাই হমু। কবি বলিয়াছে, জামাইর লগে রাগ করিতে নাই। জামাই মারবো, আদর ও করবো। বুঝছোস?
তারপর পিহুর মাথায় হাত চাপা দিয়ে চলে গেল মাহিদ। পিহু ভাবলো, এই ছেলে কি আসলেই এমন? নাকি তার সামনে এসব আজগুবি কথাবার্তা বলে। লজ্জা শরম ছাড়া জামাই জামাই করতে আছে। কোনো কাজের বেলায় তো নেই। বেয়াদব।
পিহু ঘুমিয়ে পড়লো।
______________
সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়ে গেল তার। তাড়াহুড়ো করে রান্নাঘরে ছুটে যেতেই দেখলো রান্নাঘরে মাহিদ। পিহুর ভুরু কুঁচকে এল। কি আশ্চর্য!
পিহু পা টিপে টিপে যেতেই রিক পেছন থেকে বলল
‘.তুমি কোথায় যাচ্ছ? আজকে মাহিদ খান আমাদের চা খাওয়াবে। তুমি যেওনা ওদিকে।
‘ মাহিদ ভাই পারবে?
‘ পারবে না কেন? আসো আমরা বসে গল্পগুজব করি। চা চলে আসবে।
পিহু বলল
‘ আমি গিয়ে দেখে আসি?
‘ না না যেতে হবে না। রিপ বলেছে না যেতে। করুক। চলে আসো। ও বলছে পারবে। আমরা বলিনাই।
পিহু মাথা নাড়লো। মাহিদ চা বানিয়ে পিহুকে ডাক দিল। পিহু এল। কথা বলল না। এককোণায় দাঁড়িয়ে থাকলো। মাহিদ বলল
‘ ওখানে দাঁড়ায় আছোস ক্যান বাপ? এদিকে আয়। এগুলা লইয়্যা যা।
পিহু ট্রে নিয়ে চুপচাপ চলে গেল। আবার এল। বলল
‘ মামা যেতে বলেছে।
মাহিদ তার পিছু যেতে যেতে বলল
‘ ও বাপ তুই আমার লগে ওভাবে কথা কস ক্যান? ভাল্লাগেনা বাপ। ভালা কইরা কথা কহ।
পিহু কথা বলল না। চা খেল। ভালোই হয়েছে। রিক বলল
‘ বাহ বাহ আমাদের খান সাহেব দেখি চা ও করতে পারে।
মাহিদ বলল
‘ এগুলা কোনো কাজ? ভাত, তরকারি,মাছ মাংস সব পারুম।
রিপ তাকাতেই ছন্দ পাল্টে বলল
‘ সব পারব।
রিক হেসে বলল,
‘ সাবাশ। বউ বেশ লাকি। আহা এমন জামাই ভারী দুর্লভ।
মাহিদ শার্টের কলার ঝাঁকালো। পিহু ফুঁ দিয়ে চা খেতে খেতে অন্য ভাবনায় বিভোর। রিপ বলল
‘ ওরা চলে আসবে আজ।
পিহু বলল
‘ আজ? কেন?
‘ কেন মানে? তুমি আর কতদিন রান্না করে খাওয়াবে? তোমার পড়ালেখা আছে।
‘ আমার তো ভালোই লাগছিল। পড়াশোনা ভালো লাগেনা সবসময়। বেড়াতে এসেছি না?
রিপ হেসে উঠলো। বলল
‘ আচ্ছা আর ও কিছুদিন থেকে তারপর যেও।
‘ অসম্ভব এটা। মামিরা চলে আসলে পাপা এসে নিয়ে যাবে। ফাঁকিবাকি পছন্দ করেনা পাপা।
মাহিদ বিড়বিড়িয়ে বলল
‘ শালার ডাক্তার।
রিপ বলল
‘ আচ্ছা আমি আদিকে বলব। ডোন্ট ওয়ারি।
দুপুরের আগেই সবাই চলে আসলো। সাথে ছিকু। অসুখ এখনো কমেনি। তার উপর মুনার সাথে মিহিকে দেখার জন্য চলে আসার বায়না ধরেছে। পরী এই অবস্থায় তাকে একা ও ছাড়তে পারলো না তাই সে ও চলে এল ঔষধপত্রের ব্যাগ নিয়ে। যদি ও রাইনা এখন কিছুতেই ছাড়তে রাজী হচ্ছিল না। মুনা আশ্বস্ত করায় ছাড়লো। ছিকু তো বাড়ি ফিরে সেই খুশি! পরী ও খুশি হলো তার দূরন্তপনা দেখে।
জ্বর হওয়ার পরে একদম শান্ত হয়ে গিয়েছিল। এখন ভালো লাগছে। মাহিদকে দেখে সেই যে কোলে উঠলো নামার নামগন্ধ নেই। মাহিদ দোকানে নিয়ে চিপস, চকলেট কিনে দিল। ঘুরলো। তারপর দেড়টার দিকে বাড়ি ফিরলো। ছিকু তো মহাখুশি। বাড়ি ফিরতেই পিহু তাকে মাহিদের কোল থেকে নিয়ে ফেলল। বলল
‘ কোথায় গিয়েছেন কলিজা?
‘ ছিকু মিহির সাথি গিছে কেন? মিহির সাথি ফিপফিপ গিছে কেন?
পিহু হেসে বলল
‘ সেটা তো আপনিই ভালো জানেন। আমার কলিজার অসুখ গেছে?
‘ কেন? ছিকু অচুখ কেন? ছিকুর বুমি পাচে কেন? দুক্কু লাগে কেন?
পিহু ছোট্ট হাত দুটোতে আদর করে বলল
‘ ইশশ কত্ত দুক্কু পেল আব্বটা। কেনোকিছু খাওয়ার আগে অবশ্যই ওয়াশ করে খাবেন। মেঝেতে টুপটাপ বসে পড়বেন না। খালি পায়ে হাঁটবেন না। ঠিক আছে?
‘ কেন? ছিকু গুড বয়ের মুতো কেন?
‘ কচু বয়। গুড বয়দের অসুখ হয় না।
ছিকুর ভীষণ কান্না পেল। কাঁদোকাঁদো চেহারায় বলল
‘ কেন পিহু পুঁচা কথা বুলে কেন? ছিকু গুড বয় নয় কেন? পুঁচা কেন?
পিহু হেসে তার দু গালে আদর করে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল
‘ সবসময় কেন আর কেন? আর কোনো কথা জানেন না?
‘ কেন ছিকু জানেনা কেন?
________________
দুপুরে খাওয়া দাওয়া হলো। তারপর অনেকগুলো মানুষ এল বাড়িতে। পিহু দৌড়ে গিয়ে নীরাকে ডাক দিল। বাড়িতে কোনো পুরুষ মানুষ নেই। এরা কারা এল?
নীরা মানুষগুলোকে দেখে রিপ আর রিককে ফোন দিল। রিপ বলল
‘ ওনারা গাড়িতে করে আসবাবপত্র এনেছেন। চিন্তার কিছু নেই। রুম দেখিয়ে দিলে সব সেট করে চলে যাবে।
বাড়ির কিছু আসবাবপত্র আর দুই টনের এসি এসেছে। পিহু দুপুরের ঘুম দেওয়া পর উঠে দেখলো মাহিদের ঘরে সবাই। পা টিপে টিপে সেখানে যেতেই পিহু হা হয়ে গেল। কি আশ্চর্য রুমটার এত পরিবর্তন কেন?
নীরা তাকে দেখে টেনে ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলল। বলল
‘ এই দেখো এইটা মাহির ঘর। একডা কানাকড়ি ও নিমুনা ওর শ্বশুরবাড়ি থেইকা। সব জিনিস লইয়্যা আসছি। খাটের ডিজাইনটা একদম ইউনিক। ড্রেসিং টেবিলটা সুন্দর না। ওয়ারড্রবটা দেখো। ওই দেখো ওইপাশে একটা ডিভান রাখছি। থাকলে থাকবে নইলে সরায় ফেলবো। তুমি বলো কেমন হয়ছে?
পরী বলল
‘ ওর পছন্দে কি হবে? এখানে তো মাইশা থাকবে।
নীরা বলল
‘ ও হ্যা তাই তো তাই তো। পিহু ও তো মেয়ে ওর পছন্দের সাথে মাইশার মিল থাকতে পারে তাই বললাম।
পরী বিছানার উপর কিছু একটা দেখে বলল
‘ সব কিছু সুন্দর হয়েছে। কিন্তু ওইটা কি ছোট মা ?
নীরা হেসে ফেলল। বলল
‘ ওইটা? ওইটা হইতেছে দোলনা। অনলাইনে দেখছি, আমার সুন্দর লাগছে। তাই অর্ডার করে ফেলছি। এইটা এই ঘরে থাকবো। মাহির বউ বাচ্চা চড়বো আর কি। নাতি নাতনি আসলে ওগুলার জন্য তো দোলনা এমনিই লাগে।
ছিকু বলল
‘ দুলুনা ছিকুর মুতো কেন?
পরী হেসে বলল
‘ ছিকুর মুতো না। ছিকুর দোলনার মতো।
মুনা হেসে বলল
‘ কি কথা বলে ভাই?
পিহু বলল
‘ আমি বাড়ি চলে যাব মামি। পাপাকে ফোন করেছি।
মুনা বলল
‘ একি কথা? সন্ধ্যেবেলা কোথায় যাবে? থাকো আর কয়েকদিন। বিয়ে হয়ে গেলে অতদিন তো থাকতে পারবে না।
পিহু আদিকে বলেনি। তারপর ও বলল, না আমি চলে যাব। বলেই হনহনিয়ে চলে গেল। নীরা হেসে বলল
‘ ধুরর যাইবো না। বলুক গে, আমি যাইতে দিলেই তে যাইবো।
মাহিদ বাড়ি ফিরে তার ঘরের এই অবস্থা দেখে চক্ষুচড়ক। এত রাজকীয়তা কিল্লাই? সে কি ভুলে অন্য ঘরে বইসা পড়ছে নাকি বাপ? নীরা এসে বলল
‘ কেমন দিলাম সারপ্রাইজ?
‘ ফাটায় দিছো মেরিমা। কিন্তু এইগুলা কিল্লাই?
‘ তোর বউয়ের জন্য আর কি? বউ মানুষের লাগে এসব। তুই এত বড় ঘরটাতে খাট,টেবিল আর আলমিরা ছাড়া তো কিছু রাখতে দিস না। এই দেখ ঘরটা এখন পরিপূর্ণ লাগতেছে। এখন অভাব শুধু একটা বউয়ের। বউ লইয়্যা আয় তারপর সব ফিনিশ।
‘ ধুর বাপ। এত্তগুলা লাগে মানুষের? শালী থাকলে থাকবো নইলে থাকবো না। তার লাগি এতগুলা জিনিসের কি দরকার?
‘ কোন শালী আবার?
‘ বউ শালী।
নীরা খিক করে হেসে ফেলল। বলল
‘ হায় হায় আমার বাচ্চা তো বড় হইয়্যা গেছে। আমার কেমন কেমন লাগতেছে রে আব্বা। তুই তো এইদিন এতটুকুনি ছিলি।
‘ তো কিতা হয়ছে?
‘ ধুরর তুই বুঝবি না। বাচ্চাকাচ্চার বাপ হ তারপর বুঝবি।
ছিকু এল। বলল
‘ পিহু চলি যায় কেন? পিহুর মন খারাপ কেন? দুক্কু পাচে কেন?
মাহিদ তার গাল টেনে আদর করে বলল
‘ ক্যান তোর খালা এত তিড়িংতিড়িং করে ক্যান? জোরে একডা কামড় বসায় দিয়া আয়। যাহ।
ছিকু দৌড়ে দৌড়ে চলে যেতে যেতে বলল
‘ ছিকু পিহুকে কামড় দেবে কেন? মিহি পুঁচা কথা বুলে কেন?
নীরা বলল, এসব কি বললি? যদি সত্যি সত্যি কামড়ে দেয়?
ছিকু পিহুকে সত্যি সত্যি কামড়ে দিল। পিহুর চিৎকারে সবাই একজোট হলো। পিহু হাত ঝাড়তে ঝাড়তে কেঁদে দিয়ে বলল
‘ আল্লাহ আমার হাত শেষ।
ছিকু ভয় পেয়ে সোফার পেছনে গিয়ে লুকিয়েছে। মাহিদ এসে হতবাক। ছিকু শালা তার ভবিষ্যৎ বাচ্চার মারে কামড়ায় ভালা করলো না। কামড়ে দিতে বললে কামড়ে দিতেই হইবো এইডা কোনো কথা?
পিহু ব্যাথায় কাঁদলো। মাহিদ ভয়ে ভয়ে থাকলো। পিহু যদি জানতে পারে সে বলেছে তাই ছিকু কামড়েছে তাহলে তো একদম কথা বলবে না।
ঠিক তাই হলো। ছিকু কিছুক্ষণ পর ভয়ে ভয়ে পিহুর পাশে এল। পরী ফিসফিস করে বলল
‘ পিহু মারবে।
ছিকু সাহস দেখিয়ে পিহুর হাতে হাত বুলিয়ে দিল। গালে পাপ্পি দিয়ে বলল
‘ পিহু আদোল কেন? মিহি পুঁচা কেন? পিহুকে কামুড় দিতে বুলচে কেন? পিহু দুক্কু পাচে কেন?
পিহু তো রেগে আগুন। মাহিদ কপাল চাপড়াল। সব শেষ। সব শেষ।
_____________
নিকিতা বেগম থম মেরে বসে আছেন সেই সন্ধ্যা থেকেই। আদির কথাটা ওনার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। পিহুর জায়গায় জালিশাকে তিনি ভাবতে পারছেন না। জালিশা বিদেশী কালচারে বড় হওয়া মেয়ে। মা বাবার সাথে দেশে বিদেশে বড় হয়েছে। ওর মধ্যে চঞ্চলতা ভাব আছে, ও সংসারী টাইপের নয়। পিহু শান্ত, সংসারী টাইপের, নম্রতা, ভদ্রতা সব আছে ওর মধ্যে। ছোট থেকেই তিনি দেখে আসছেন। পরিবার ও ভালো। পিহুকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখে ফেলেছেন তিনি। কিছুতেই আর জালিশাকে ভাবতে পারছেন না। চৌধুরী সাহেব এটা কি বললো? অস্থির অস্থির লাগছে ওনার। তার ছেলেটা সাদাসিধা। বিদেশী কালচারে বড় হওয়া মেয়েগুলোর কাছে নিজের ইচ্ছেটাই সব। স্বামী সংসার তাদের কাছে গুরুত্ব পায় না। এগুলো পাগলামি। কেন বিদেশে কি সুন্দর ছেলেপেলের অভাব ছিল? নিনিতকে আজ ভালো লাগছে কাল খারাপ লাগলে মা বাবার সাথে বিদেশে পাড়ি দেবে। কখনোই না। জালিশাকে ভুলে ও ভাবতে পারছেন না তিনি।
নিনিত আর নিশিতা অনেক্ক্ষণ যাবত দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না।
পিহু এমনিতেই হাতের ব্যাথায় আর মানসিক অশান্তিতে ভুগছে। রাগ কিসের উপর লাগছে নিজেই জানেনা। নিজের উপর বেশি রাগ লাগছে। নীরাকে কিছুক্ষণ আগে মাইশার সাথে হেসেখেলে কথা বলতে শুনেছে। সবার কত ফূর্তি! কত আনন্দ! পিহুকে কারো চোখে পড়েনা। মাহিদের অপেক্ষায় সে। আজ অনেক শক্ত শক্ত কথা শুনিয়ে দেবে। তার চাই না অমন মেরুদণ্ডহীন পুরুষকে।
তারমধ্যে নিকিতা বেগমের ফোন। উনি কয়েকদিন ধরে ফোন কম করেছেন। পিহুর করার উচিত ছিল। এখন ফোন তুলতে লজ্জা লাগছে। পিহু ফোন তুললো। নিকিতা বেগমের গলাটা কেমন যেন ঠেকলো পিহুর কাছে।
‘ তোমার বাবাকে কিছু বলো পিহু। উনি এভাবে একটা সম্পর্ক ভেঙে দেওয়া কথা বলতে পারেন না। আমার পুত্রবধূ হিসেবে তোমাকে চাই। জালিশাকে নয়। জালিশা আমার অপছন্দের না হলেও পছন্দের নয়। তোমার বাবাকে বুঝাও।
পিহু অস্ফুটস্বরে বলল
‘ জালিশা? কি হয়েছে আন্টি?
নিকিতা বেগম সব খুলে বলল। পিহু সবটা শুনে শক্ত হয়ে বসে থাকলো। নিকিতা বেগম কথা বলতো বলতে একসময় আবেগী হয়ে পড়লেন। পিহুকে বললেন
‘ তুমি চাওনা আমার পরিবারের একজন হতে? চাওনা? বলো? তুমি তো নিজেই বলেছ নিনিত তোমার ভালোলাগার একজন মানুষ। বিশ্বাস করো, ও তোমার মতো একজন মেয়েকেই ডিজার্ভ করে। জালিশার মতো মেয়ে ওকে বুঝবে না, যতটুকু তুমি বুঝবে। তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিওনা মা।
পিহু বাকহারা হয়ে পড়লো। কি বলবে সে? নিকিতা বেগম বললেন
‘ তুমি তো জালিশাকে দেখেছ। ও ভালো মেয়ে। কিন্তু আমি ওকে তোমার জায়গায় ভাবতে পারছিনা। তোমাকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখে ফেলেছি আমি। আমি কিছুতেই এসব মানতে পারছিনা।
পিহু পুরোটা সময় চুপ। নিকিতা বেগম একসময় বলল
‘ ঠিক আছে। আমাকে কিছু বলতে হবে না। তুমি তোমার বাবাকে বলো। বুঝাও। হ্যা?
ফোন কেটে গেল টুইট টুইট আওয়াজ করে। পিহু সাথে সাথে ফুঁপিয়ে উঠলো। আদির কাছে ফোন দিল। আদি বলল
‘ হঠাৎ ফোন? ঠিক আছ মা?
পিহু গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বলল
‘ আন্টিকে কি বলেছ পাপা? উনি কষ্ট পেয়েছেন। আমার মনে হচ্ছে ওনার চোখের পানি আর কষ্টের কারণ আমি। আমি আর নিতে পারছিনা।
‘ রিল্যাক্স পিহু। আমি আছি। আমরা যা চাই তা তো সবসময় পাই না। জালিশা মেয়েটা খুব ভালো। ও যখন নিনিতের কথা বলে তখন ওর চোখগুলো ও কথা বলে। মেয়েটা আমার মেয়ের মতোই । আমি ওকে কষ্ট দিতে পারিনা। ও নিনিতকে খুব ভালো রাখবে। আমি নিনিতের ভালো চাই। ওকে ভালো রাখার মানুষটার সাথে ওকে জুড়ে দিতে চাই। ব্যস। ওর সম্পর্কে ভুল ধারণাটা দূর হলে তোমার নিকিতা আন্টি ওকে মেনে নেবে।
পিহু ফোন রাখার পরে ও স্বস্তি পাচ্ছেনা। ভেতরে ভেতরে ছটপট লাগছে। নিশিতা ও ফোন দিল। পিহু ফোন তুললো। একই অনুরোধ করলো সে ও। পিহু পড়ে গেল গোলকধাঁধায়। যদি এই অনুরোধ তাকে স্যার ও করে? কোথায় যাবে সে? মাহিদ ভাই কোথায়? তার একটু শান্তি চায়।
রাতে খেতে চাইলো না পিহু। পরী ছিকুর সাথে সাথে পিহুকে ও খাইয়ে দিল। পিহু রুমে চুপচাপ বসে থাকলো।
মাহিদ ভাত খেয়ে ঘরের দিকে যাওয়ার পথে পিহুর ঘরে উঁকি দিল। চেহারা অন্ধকার করে বসে আছে। মাহিদ গিয়ে তার সামনে বসলো। বলল
‘ ওই? তোর মন খারাপ?
পিহু চোখ তুলে তাকালো।
‘ কামড় দিতে বলেছ। আবার জিজ্ঞেস করছ?
মাহিদ অসহায় গলায় বলল
‘ শালারে মশকরা করে বলছি।
‘ যাইহোক। চলে যাও।
‘ কাঁদছোস?
‘ হ্যা।
মাহিদ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। বলল
‘ আয় আমার ঘরে আয়। দোলনা একটা রাখছেনা ওইটাতেই চড়বি। আয়।
পিহু যেতে চাইলো না।
‘ যাব না ওই ঘরে।
মাহিদ বলল
‘ আয় আয়।
পিহু বলল
‘ ভালো লাগছেনা আমার।
‘ ছাদে যাবি? আয়। গাছ লাগাইছে মা। দেখলে আয়।
পিহু চুপ করে থাকলো। মাহিদ তার হাত টেনে নিয়ে গেল। অনেকগুলো বেলীফুলের গাছ লাগিয়েছে নীরা। সেগুলোতে কয়েকটা ফুল এসেছে মাত্র। আর ও অনেক ফুল গাছের টব আছে।
পিহুর অনেকদিন ছাদে দাঁড়ানো হয় না। আজ এখন একটু শান্তি লাগছে। পশ্চিমমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে ছাদের রেলিঙে হাত ঘষতে লাগলো সে। ভাবতে লাগলো আকাশ পাতাল। মাহিদ তার ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে বলল
‘ ওই আমারে পাশে দাঁড় করাইয়া রাইখা কারে ভাবোস?
পিহু ঘাড় ঘুরিয়ে চাইলো। মাহিদ হেসে বলল
‘ তুই দাঁড়া। তোর লাগি একডা জিনিস আনছি। তোর রাগ কমানোর জন্য আনছি। দাঁড়া। আমি আসি।
মাহিদ গেল আর এল। পিহু আগ্রহ দেখালো না। তবে ভেতরে ঠিকই চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। মাহিদের হাত পেছনে লুকোনো। বলল
‘ এইদিকে ফির। চোখ বন্ধ কর বাপ।
‘ কেন? আমার ভালো লাগছেনা মাহিদ ভাই। মজা করো না।
‘ চুপ বেডি চোখ বন্ধ কর। কর।
পিহু চোখ বন্ধ করলো। বলল
‘ তাড়াতাড়ি করো। নইলে চোখ খুলে ফেলব৷
কিছুক্ষণ নীরবতা।
তারপর পিহুর মাথার উপর চড়ে বসলো সাদা রঙের পাথরের একটি ভারী ওড়না৷ পিহু চোখ খুলে ওড়নাটি ভালো করে গায়ে জড়িয়ে বলল
‘ এটা? ওড়না? অনেক সুন্দর। কোথায় পেলে?
‘ চুরি করছি।
বলেই মাহিদ হাসলো৷ পিহু রেগে তাকালো৷
মাহিদ বলল
‘ ধুর বাপ। অনেক আগে কিনছি এইডা৷ এইটার ফুল সেট আছে। আমার সুন্দর লাগছে তাই কিনছি। এইডা তোরে মানাইছে। ভালা লাগতাছে।
‘ তাহলে যে বললে আজকে আনছ?
মাহিদ হেসে ফেলল৷ ওড়নার দুপাশ ধরে টান দিতেই পিহু তার বুকের কাছে এসে পড়লো। পিহুর দুহাত টেনে তার পিঠের কাছে নিয়ে গিয়ে আটকালো৷ কিছু একটা আঙুলের মধ্যে সেট করে দিয়ে বোকা হাসলো। পিহু এক হাত দিয়ে অন্য হাতের আঙুল ছুঁয়ে বলল
‘ কিহ এটা?
‘ ধুর বাপ, ওইটা জিনিস। হুন তোরে একটা কথা কয়।
‘ কি?
‘ তোরে আমার বহুত দরকার। আমারে বিয়া করবি?
পিহু হা করে চেয়ে থাকলো। যেন আজব কথা শুনছে সে। মাহিদ বলল
‘ ধুর শালী আমার শরম করতাছে বাপ। কহ বিয়া করবি? করবি?
পিহু ঠোঁট কাঁপছে। চোখের পাতা পড়ছেনা।
মাহিদ শেষমেশ হেসে তাকে মিষ্টি আলিঙ্গনে জড়িয়ে বলল
‘ আইচ্ছা থাক বলিস না। উত্তর পাইয়্যা গেছি বাপ। তুই ও আমারে ভালাটালা বাসিস সেইটা ভাইবা এখন আমার শরম করতাছে।
পিহু উত্তর করলো না, কোনো জবাব দিল না। যেন শব্দহীন হয়ে ও কতশত কথার জুড়ি মেলে ধরলো। তার একটু অল্পস্বল্প সুখের কান্নায় বুক পকেটের পাশটা ভিজে গেল। মাঝেমধ্যে এই ভেজা অংশটুকু ও কথা বলে। মুখের কথার দরকার পড়েনা৷
চলবে,