মন গোপনের কথা পর্ব-২২+২৩

0
1094

#মন_গোপনের_কথা
#পর্ব_২২
লেখনীতে, পুষ্পিতা প্রিমা

পিহু নিজেই ছেড়ে দিল মাহিদকে। ঠেলে দিয়ে গাল মুছে চলে গেল। মাহিদ গলা কাত করে ছিকুর দিক তাকালো। ছিকু তখনও কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বড্ড রেগে আছে সে। এতটাই রেগে আছে যে মাহিদকে সুযোগ পেলে কামড় বসিয়ে দেবে। মাহিদ হেলেদুলে তার সামনে এগিয়ে গেল। পেটে আঙুল দিয়ে গুঁতো মেরে বলল

‘ শালা! তোরে খবর দেয় কেডা? তোর খালারে আমি ছুঁতে পারিনা তুই কোথা থেকে বকবক পকপক করার জন্য চইলা আসোস। তোর সমস্যা কি?

হাতের মুঠোয় থাকা আপেলের গায়ে এক কামড় বসিয়ে আবার কোমরে হাত রাখলো ছিকু। আপেল চিবোতে চিবোতে বলল

‘ কেন? মিহি পেটে গুঁতু মারে কেন?

মাহিদ আবার ও গুঁতো মারলো। বলল

‘ শালা ভিলেন। তুই থাকা অবস্থায় পেরেম টেরেম করা যাইতো না বাপ। তুই একটা বড় ঝুঁকিপূর্ণ বেডামানুষ।

‘ কেন ছিকু বিডামানুষ কেন?

বলেই আপেল চিবোতে লাগলো ছিকু। মাহিদ তার আপেল কেড়ে নিল। পিঠে ধপাস করে চড় বসিয়ে আপেলে কামড় দিয়ে বলল

‘ তুই এখন যাহ তো বাপ। আমি আপেল খাইতাছি। আমার জ্বর উঠছে। ভালা লাগতাছে না। যাহ। তোর খালা আমারে ধাক্কা মাইরা চলে গেল। সুস্থ হই, শালীরে দেইখা নিমু। ভাব দেখায় আমার লগে।

ছিকু মেঝেতে বসে পড়লো পা ছিটিয়ে। পা নাচিয়ে চেঁচিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল

‘ ছিকুর আপিল নিয়ে ফিলছ কেন? মিহি রাক্ষুচী কেন? আপিল দেয় না কেন?

মুনা দৌড়ে এল। সে এমনিতেই ছিকুকে খুঁজছিল। হাতে আপেল দেওয়ার সাথে দৌড়ে যে এদিকে চলে এল মুনা দেখলই না। তবে কান্নার আওয়াজ পেয়ে ছুটে এসে মেঝেতে তাকে গড়াগড়ি খেতে দেখে ভারী অবাক হলো সে। রিক, রিপ,নীরা ও এল। রিক ছিকুকে কোলে তুলে নিল। বলল

‘ কি হয়েছে ভাই? কে মেরেছে?

ছিকু হাত পা নাচাচ্ছে তখনো। রিকের কোল থেকে পড়ে যাওয়ার অবস্থা। মুনা এসে নিয়ে ফেলল কোল থেকে। পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল

‘ কি হয়েছে নানু?

‘ মিহি আপিল, আপিল খায় ফিলছে।

মাহিদ তখন নির্বিকার ভঙ্গিতে আপেল চিবোচ্ছে। সবাই হতাশ হয়ে তাকালো তার দিকে। রিপ চলে গেল হেঁটে। এই ছেলেটা কি কখনো বড় হবে না?
মুনা বলল

‘ তোর না জ্বর বাঁদড়? তারপরও ওর পিছু লেগে আছিস? কি সমস্যা তোর? কয়েকটা দেব?

‘ তোমার নাতি মহা বজ্জাত।

ছিকু মুনার কাঁধ থেকে মাথা তুললো। মাহিদের দিকে লাল চোখে তাকালো। মাহিদ ভড়কে গেল। সর্বনাশ ছিকুশালা যদি যা দেখলো তা বলে দেয়? তখন?
মাহিদ ছিকুকে কোলে নিয়ে ফেলল দ্রুত। আপেলটা ধরিয়ে দিয়ে বুকের সাথে চেপে ধরে দ্রুত তার ঘরে নিয়ে গেল। ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল। সবাই হতবাক। মুনা বলল
‘ নীরু এই ছেলে কি সত্যি সত্যি পাগল হয়ে গেছে নাকি রে? জ্বর মানুষকে এরকম বানিয়ে ফেলে?
নীরা ও কিছু বুঝলো না। দরজা ধাক্কালে মাহিদ ভেতর থেকে বলল

‘ আমি ঘুমাইতাছি বাপ। ছিকু শালা ও ঘুমাইতাছে।

নীরা আর মুনা কেউ ডিস্টার্ব করলো না। মুনা যাওয়ার আগে বলল

‘ এখন ঘুম পাড়াস না মাহি। ভাত খাওয়াতে পারব না। দেরী করে ঘুমালে ভালো হবে। নইলে কাউকে ঘুমাতে দেবে না রাতে।

মাহিদ তখন ছিকুকে পেটের উপর বসিয়েছে। ছিকুর কান্না মাত্রই থামলো। বাকি আপেলটা খেতে খেতে বলল

‘ মিহি পুঁচা। ক্যাট। ডগ। মাংকি।

মাহিদ হাসলো। ছিকুর মাথা টেনে এনে চুমু খেল কপালে। গালের দুপাশে টাপুসটাপুস আদর বসিয়ে বলল

‘ তুই শালারে আদর পায়। কিন্তু তুই শালা আদর খাইতে জানোস না বাপ। বেয়াদবি করোস আমার লগে।

ছিকু তার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকালো। বলল

‘ কেন? ছিকু বিদ্দবি করে কেন?

মাহিদ তার পিঠে জোরে চাপড় বসালো। তার পাশে ধপাস করে ফেলে এক হাত দিয়ে টেনে বুকের সাথে লাগালো। পিঠ চাপড়াতে চাপড়াতে বলল

‘ শালা পরীর বাচ্চা ছিকু! তোর কথা শুইনা আমার তো বহুত দুক্কু লাগতেছে। বহুত কষ্ট লাগতেছে। মইরা যাইতে ইচ্ছা করতাছে।

ছিকু তার দিকে চোখ তুলে চাইলো। ছোট হাতটা দিয়ে মাহিদকে জড়িয়ে ধরে বুকে ছোট্ট পাখির ছানার মতো গুঁজে গিয়ে বলল

‘ মিহি মরি যাবে কেন? ছিকুর দুক্কু লাগে কেন? কান্না পায় কেন?

মাহিদ হো হো করে হেসে উঠলো।

_____________

পরীর কিছু ভালো লাগছেনা। ছিকু আজ বাড়িতে নেই। বাড়িটা ফাঁকা হয়ে গেছে। রেহান পা টেনে খাটে বসে বই পড়ছে । পরী গিয়ে তার পাশে বসলো। বলল

‘ আমার ভালো লাগছেনা।

রেহান বইয়ে মনোযোগ রেখে বলল

‘ ফোন দাও।

‘ ও নাকি মাহির কাছে। মাহি দরজা খুলছেনা।

‘ অপেক্ষা করো।

পরী তার বই কেড়ে নিল। বলল

‘ এসব বই টই বাদ। ভালো লাগেনা।

রেহান হেসে ফেলল। বলল

‘ তো রাহিকে যেতে দিলে কেন?

‘ ও তো বায়না করছিল পিহুর সাথে নাকি যাবে। কান্না করছিল। যেতে না দিল মা আবার রাগ করে বসবে।

রেহান তাকে টেনে এনে বুকে রাখলো। চুলে বিলি কেটে ঠোঁট ছুঁয়ালো চুলে। বলল

‘ কাল আমি গিয়ে নিয়ে আসব।

খাবার টেবিলে খেতে বসেছে সবাই। মাহিদের পাশে ছিকু। ছিকু নিজ হাতে খাচ্ছে। মুনা খাইয়ে দেবে বলছিল কিন্তু সে কারো কথা শুনছেনা। নিজের হাতে নাকি খাবে। যতগুলো না খাচ্ছে ততগুলো ফেলছে। গালের আশপাশে লাগিয়ে ফেলছে। পিহু চুপচাপ তার কান্ড দেখছে।
তখনি চৌধুরী বাড়ি থেকে ফোন এল। পরী ফোন করেছে। মুনা ফোন ছিকুর বাম হাতে ধরিয়ে দিল। ডান হাত ধুঁয়ে মুছে দিল। ছিকু দু হাতে ফোন ধরে বলল

‘ হাউআর ইউ পরী । আম ফাইন টেংকিউ।

পরী হেসে উঠলো। বলল

‘ কেমন আছে আমার মানিক? ভাত খেয়েছেন?

ছিকু রেগে বলল

‘ পরী ভাতু খিতে দেয় না কেন? ফুন দিচে কেন?

মুনা বলল

‘ ওমা এভাবে কেউ বলে? আম্মার মন পুড়ছিল তো।

ছিকুর গলার আওয়াজ শীতল হয়ে গেল।

‘ পরী আম্মা কেন? আম্মাল মন পুড়ে কেন?

পরী বলল

‘ আচ্ছা আপনি এখন ভাত খান। ভাত খাওয়া শেষে আম্মাকে ফোন দেবেন। ঠিক আছে?

‘ ঠিক আছে কেন?

মুনা ফোন নিয়ে কথা বলতে বলতে অন্যদিকে চলে গেল। পিহুর খাওয়া শেষ। ছিকুর প্লেটের ভাত গুছিয়ে নিয়ে ছিকুকে খাইয়ে দিতে দিতে বলল

‘ ডিম দেই?

ছিকু মাথা নাড়লো।

‘ শুধু ঝোল দিয়ে ভাত খায় মানুষ? পাজি ছেলে।

ছিকু ঠোঁট টানছে। ঠোঁট উল্টাচ্ছে। পিহু হেসে ফেলল। রিপ বলল

‘ জড়িয়ে ধরো। আদর করে দাও একটু। কাঁদিওনা ভাইয়া। পিহুকে মারব।

ছিকু ঠোঁট টেনে বলল

‘ পিহু বুকা দিচে কেন? বেরিচতার পিহুকে মারবে কেন?

মাহিদ আর না পেরে বলল

‘ শালা খাইলে খা নইলে তোর বাড়ি চইলা যা। তোরে ভাত খাওয়াইতে এত ঢং করতে হয় আমার জানা ছিল না। শালা পরীর বাচ্চা। তোর মা ও বিয়ার আগে সবাইরে পাগল বানাইয়া ছাড়তো খাওয়ার টেবিলে। খাইলে আমার মতো খাবি। আমারে যা দেই তাই খাই।

পিহু রিপের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট চেপে হাসলো। মাহিদ পিহুর চোখ অনুসরণ করে রিপের দিকে তাকাতেই ভড়কে গেল। মাথা একদম নিচু করে খেতে লাগলো। তার প্লেটের একপাশে জমিয়ে রাখা পেঁয়াজ মরিচগুলো দেখিয়ে দিয়ে রিপ বলল

‘ এগুলো যাতে আজ ফেলে দিতে না হয়। যখন সব খাস এগুলো ও খাবি না কেন?

পিহুর সাথে সাথে রিক ও নিঃশব্দে হাসলো। মাহিদ রিপের দিকে অসহায় চোখে তাকালো। তারপর তাকালো পেঁয়াজ মরিচ আর তেজপাতার দিকে। এগুলো মাইনষ্যে খায় নাকি? ইয়াকক। ছিকু শালার জন্য সে মহা ঝামেলায় পড়ে গেল। শালা ছিকুরে যদি সে আজ হাতের কাছে পায়?

পিহু ঘুম পাড়াতে নিয়ে গেল ছিকুকে। ছিকু ঘুমালো না। পরীর জন্য কাঁদতে লাগলো। পিহু যেটা ভেবেছে সেটাই। চোখে ঘুম আসলে মাকে খুঁজবেই। শেষমেশ পরীর ফোনে ফোন দিল পিহু। ভিডিও কলে পরীকে দেখে নিচের ঠোঁটটা উল্টে ফেলল ছিকু। পিহু সেটা দেখে বুকের সাথে চেপে ধরে বলল

‘ কাল আম্মার কাছে চলে যাব তো। আমার ভালো ছেলে। সোনা ছেলে। ভালো ছেলেরা কাঁদে না তো।

ছিকু ঠোঁট টানতে টানতে বলল

‘ আম্মার কাছি যাবু কেন? পাপার কাছি যাবু কেন?

‘ কেন যাবেন সেটা আমি জানিনা। আমি শুধু জানি এখন কোথাও যেতে পারবেন না। এখন ঘুমান।

একবার পিহুর বুকের উপর, আরেকবার পেটের উপর শুয়ে থাকলো ছিকু। তার ঘুম আসছেনা। পিহু শেষমেশ কোলে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে ঘুম পাড়ালো। মুনা থাকলো পিহু আর ছিকুর সাথে। ছেলেটা কখন না জানি কান্না করে।

____________

মাহিদের জ্বর কমে এসেছে। তবে মাথা ব্যাথা করছে ভীষণ। মাথা তুলতে পারছেনা। তারপরও বহুকষ্ট করে আজ খেলতে গেল। সকাল সকাল বেরিয়ে পড়েছে সে। নীরা তাকে বেরোতে দেবেনা সেটা সে জানে। তাই নীরাকে না জানিয়ে বের হয়ে গিয়েছে। নীরা তাকে না দেখে চেঁচামেচি শুরু করলো। রিপ বলল, ও ছোটটি নেই নীরা। নিজের ভালোমন্দ নিজে না বুঝলে আমাদের কি করার আছে? আমরা কতক্ষণ ওর ভালোমন্দ বাছবিচার করে দেব? যা ইচ্ছে তাই করুক। কতদূর যেতে পারে আমি ও দেখি।
নীরা কপালে হাত দিয়ে বসে থাকলো। পিহু তখন ছিকুকে নিয়ে চলে এসেছে। ছিকু কোল থেকে নেমে নীরার পাশে গিয়ে সোফায় বসলো। নীরার মুখ দেখার চেষ্টা করলো গলা উঁচিয়ে। তারপর প্রশ্ন করলো

‘ বেরিচতারের বুউ কাঁদে কেন? চবাই মারিচে কেন?

নীরা মাথা তুললো। ছিকুকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খেয়ে বলল

‘ তোমার মামা কামডা কি ঠিক করছে বাবুসোনা?

‘ ভালু করেনি কেন?

রিপ আর পিহু হাসলো। মুনা বলল

‘ মিহি আসলে কানটা মলে দিয়োতো নানুভাই। মিহি ভীষণ পাজি হয়েছে?

‘ কেন মিহিকে দুক্কু দেব কেন?

সবাই আরেকদফা হাসলো।
রেহান এল দশটার দিকে। মুনা আর নীরা তাড়াহুড়োয় পড়ে গেল। অনেকদিন পর মেয়েজামাই এসেছে বাড়িতে। আয়োজনের ত্রুটি রাখলো না তারা। ছিকু তখন রেহানের বুকের সাথে লেপ্টে আছে। এখন আর কাউকে চায় না তার। পিহু গিয়ে রেহানের পাশের সোফায় বসলো। বলল

‘ তোমার ছেলে রাতে পা দিয়ে ধুমধাম মারে দাভাই। আমাকে কাল এমন মারা মেরেছে। পঁচা ছেলে।

রেহান হেসে বলল

‘ ভালোই তো। তুমি তো ওর আরেকটা মা । খাওয়া দরকার।

ছিকু পিহুর দিকে তাকিয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে মুখ মোঁচড়ালো। পিহু কপাল কুঁচকে তাকাতেই ছিকু খিক করে হেসে রেহানের বুকে মুখ লুকোলো। পিহু তার হাতে পায়ে চিমটি দেওয়ার সুযোগ খুঁজতে লাগলো। ছিকু লুকোতে লাগলো। রেহান তাকে লুকিয়ে ফেলতে ফেলতে বলল

‘ আর না আর না। দুক্কু পাবে ছিকু।

‘ তো আমাকে মুখ ভাঙালো কেন? বাপকে পেয়ে এখন বড়লোক হয়ে গেছে?

ছিকু আবার মুখ মোঁচড়ে আবার ও খিক করে হেসে মুখ লুকিয়ে ফেলল।

______________

বারোটা বেজে গেছে। খেলা ও শেষ। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে পেপসি খাচ্ছে মাহিদ আর তার বন্ধুরা। ম্যাচে জিতে মাস্তির শেষ নেই তাদের। একের পর এক পেপসি শেষ করার একমুহূর্তে ফোন হাতে টুসটাস ফোন টিপে কাকে যেন ফোন দিল মাহিদ। ওপাশে ফোন তোলা হলো মেয়েলি কন্ঠস্বর ভেসে এল। মাহিদ পেপসি খেতে খেতে বলল

‘ আপনি নীল রঙের ড্রেস পড়েছেন?

‘ ইয়েস।

‘ বাম পাশের রাস্তায় তাকান।

‘ কেন?

মাইশা ফিরে তাকালো। মাহিদকে দেখে হাত নাড়ালো। রাস্তা পার হয়ে এসে বলল

‘ আপনার না জ্বর? কি খাচ্ছেন এসব?

‘ গরম লাগছে। জ্বর ভ্যানিশ। কি অবস্থা?

‘ এইতো আছি। বাড়ির সবার কি অবস্থা?

‘ ভালো। নিন পেপসি খান।

মাহিদ বাড়িয়ে দিল একটি।

‘ না না।

‘ নিন।

মাহিদের জোরাজোরিতে নিল মাইশা। হঠাৎ একটি মেয়ে কোথাথেকে যেন ছুটে এল। মাথার চুলগুলো কাঁধের খানিকটা নিচ অব্দি। কূর্তি পড়া। পুতুলের মতো গোলগাল চেহারা। ডাগরডোগর চোখ। মাহিদ বিড়বিড়িয়ে বলল

‘ এইডা আবার কোথাকার জীব?

‘ হাই অল।

মাইশা ফিরে তাকালো। মাহিদ এক চুমুক খেয়ে বলল

‘ আমরা সবাই টিচার বাপ। সো কল মি স্যার। শুধু আমাকে না সবাইকে।

মেয়েটি বোকাসোকা চেহারায় তাকালো। বলল

‘ স্যার প্লিজ হেল্প মি। একচুয়ালি আমি,,

মাহিদ ব্যাট হাতে নিয়ে বলল

‘ সোজাসাপটা কও। নইলে ব্যাট দিয়ে মেরে হসপিটাল পাঠাই দিমু।

মেয়েটি ভড়কে গেল। মাইশা হেসে ফেলল। মেয়েটি বলল

‘ হসপিটাল? ওয়াও আমি তো হসপিটালই খুঁজছি। ইয়েস হসপিটালটা কোনদিকে?

মাহিদ হাঁফ ছাড়লো। বলল

‘ কোন দেশী?

‘ আমি তো কানাডা থেকে এসেছি। হসপিটালটা চিনিনা।

মাইশা বলল

‘ ওহ তাই তো তোমাকে ওরকম মনে হচ্ছে। ওদিকে যাও, দু মিনিটের পথ। হেঁটেই চলে যেতে পারবে। নইলে রিকশা নাও।

মেয়েটি বলল

‘ ওকে ম্যাম থ্যাংকস। আমি আসি?

মাইশা মাথা দুলালো। মেয়েটি কিছুদূর গিয়ে আবার ফিরে আসলো। বলল

‘ হাই মিস জুলিয়েট আমি জালিশা। আপনার রোমিও কিন্তু পুরোই ঝাক্কাস। টা টা মিঃ রোমিও।

বলেই দৌড় দিল জালিশা।
মাইশা আর মাহিদ হতভম্ব। মাহিদ ব্যাট হাতে নিয়ে বলল

‘ শালার জালফাল আমারে কি ডাইকা গেল?

মাইশা ব্যাটটা নিয়ে ফেলে বলল

‘ আপনি ওর সাথে মজা করছিলেন তাই ও ও মজা করে গেল। যাই বলুন সো সুইট গার্ল।

মাহিদ তপুকে বলল

‘ তোদের লাগলে পিছু লাগ বাপ। মাইয়্যা তো পারাম সুন্দরী।

‘ সামনে সুন্দরী বউ রেখে আরেকজনের উপর নজর দিস শালা। লজ্জা হওয়া উচিত।

বলেই হাসলো তারা সবাই। মাহিদ মাইশার দিকে তাকালো। মাইশা উশখুশ করে উঠলো। বলল

‘ মিঃ মাহিদ আমি আসি এখন। পরে কথা হবে। বাই।

মাহিদ মাথা দুলালো। মাইশা চলে গেল।

মাহিদ ঘরে ফিরে এল। দেখলো ছিকু খালি পায়ে সোফার উপর হাঁটছে। হেঁটে হেঁটে আবার রেহানের কোলে এসে বসছে। মাহিদ বাড়িতে ঢুকে পড়লো। দেখলো বিরাট কারবার। মজার রান্নার ম ম গন্ধে ভাসছে বাড়িটা। আহা আইজ জামাই আদর হইবে। মাহিদ ও উরুধুরা খাবে।

মাহিদ ঘরে চলে গেল। গোসল নিয়ে বের হতেই পিহুর সাথে দেখা হয়ে গেল। পিহুর হাতে ভেজা চুল মুছা গামছা। সে ও মাত্রই গোসল করেছে। নিচে যাচ্ছিল। মাহিদ কপাল কুঁচকে চাইলো। মাথার চুল ঝাড়া মারলো পিহুর মুখে। পিহু চোখ বন্ধ করে বলল

‘ বেয়াদব।

‘ কি বললি?

পিহু দু পা পিছিয়ে গেল। মাহিদ এগোতে এগোতে বলল

‘ কি বলছোস বাপ? জোরে বল।

পিহু দ্রুত পেছোতে বলল

‘ মাহিদ ভাই আমি এখন চিৎকার করব।

মাহিদ তাকে ঝট করে ধরে দেয়ালে চেপে ধরে বলল

‘ কাঁদ। নইলে আজ তোর খবর আছে।

পিহু চোখ খিঁচে বন্ধ করে বলল

‘ তুমি দিনদিন অসভ্য হচ্ছ মাহিদ ভাই। মাইশা জানে?

‘ তুই গিয়া বইলা আয়। সাথে নিনিইত্যারে ও বলবি।

‘ কি বলব?

ভীত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো পিহু। হেসে উঠলো মাহিদ। একটু ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল

‘ বলবি তুই আমারে অসভ্য বানায় ফেলছোস। এখন তোরে ছাড়া আমার গতি নাই মতিবানু।

চলবে

#মন_গোপনের_কথা
#পর্ব_২৩
লেখনীতে, পুষ্পিতা প্রিমা

পিহু রাগে কিড়মিড় করে উঠলো। মাহিদকে জোরে ঠেলা মেরে সরিয়ে দিয়ে বলল

‘ নাম আর পাওনি? মতিবানু কোনো নাম হলো? ওই নামে একদম আমায় ডাকবেনা মাহিদ ভাই। হুহ আমার জন্য দরদ একেবারে উতলে পড়ছে। কাউকে কিচ্ছু বলতে পারব না আমি।

মাহিদ হো হো করে হেসে উঠলো। পিহু অবাক চোখে তাকালো। মাহিদের হাসি থামামাত্রই প্রশ্ন করলো
‘ হাসার কি বললাম?
মাহিদ হাসতে হাসতে বলল
‘ তোর নামটা অপছন্দ হয়ছে? তাইলে তো শুধু এই নামেই ডাকুম তোরে মতিবানু। ও মতিবানু? ও মতিবানু।

পিহু পা নাচিয়ে বলল

‘ মাহিদ ভাই!

‘ কিতা হয়ছে বইন? এত ডাকা ডাকোস কিল্লাই?

পিহু রাগে কি করবে ভেবে পেল না। মাহিদ হেলেদুলে শিঁষ বাজাতে বাজাতে চলে গেল। পিহু হনহনিয়ে তোয়ালে শুকাতে দিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। নীরাকে বলল

‘ মামি দেখো মাহিদ ভাই আমাকে কি ডাকলো?
‘ কি ডেকেছে আবার?
‘ মতিবানু মতিবানু বলে ডাকতেছে।
নীরা মুনার দিকে তাকালো। মুনা ঠোঁট টিপে হেসে বলল
‘ নীরু কানটা মলে দিয়ে আয়। এটা কোনো নাম হলো?
নীরা পানির জগ নিয়ে যাচ্ছিল টেবিলে। পিহু সেটি নিয়ে ফেলল। বলল
‘ আমি নিয়ে যাচ্ছি। তুমি মাহিদ ভাইয়ের কাছে যাও৷
নীরা মাথা নেড়ে বলল
‘ আইচ্ছা।
নীরার পিছু পিছু পিহু ও গেল। দেখলো রিপ ও চলে এসেছে। নীরা রিপকে বলল
‘ ব্যারিস্টার মতিবানু নামটা কেমন?
রিপ নীরার দিকে কপালে ভাঁজ ফেলে তাকিয়ে চেয়ারে বসলো। মাহিদ শসা চিবোচ্ছে। পিহুর দিকে কোণাচোখে তাকালো সে।
রিপ বলল
‘ কেন? সুন্দর তো। কার নাম এটা?
‘ পিহুর।
” কিহ?
রিপ অবাক হলো। নীরা হেসে বলল
‘ মাহি দিয়েছে নামটা। পিহু রাগ করছে, সেজন্য জিজ্ঞেস করলাম। নামটা তো আমার ও পছন্দ হয়ছে। আপনার ও দেখি পছন্দ হলো। রেহান, নামটা সুন্দর না বাবা?

রেহান হাসলো। ছিকুর চুলগুলো কপাল থেকে সরিয়ে দিতে দিতে বলল
‘ হ্যা সুন্দর তো।
রিপ থাকায় মাহিদ কিছু বলতে পারলো না। পিহু রাগে আর ও ফুলেফেঁপে গিয়েছে। রিপ তাকে পরখ করে বলল
‘ ওর তো দুটো নাম আছে। আবার ও নাম দেওয়ার কি দরকার?
পিহু অসহায় চোখে রিপকে সমর্থ করলো। মাহিদ নড়েচড়ে বসলো। মুনা আর নীরা টেবিল সাজিয়ে ফেলেছে। ছিকু এতক্ষণ সবার কথা শুনছিল। আর না পেরে বলে উঠলো

‘ চবাই পিহুকে মুতিবেনু ডাকে কেন?

‘ মুতিবেনু?

বলেই হো হো করে হেসে উঠলো মাহিদ। পরক্ষণে রিপের দিকে চোখ যেতেই থেমে গেল সে। রিক এসে চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল

‘ কি ব্যাপার খানসাহেব? এত হাসেন কেন?

মাহিদ কান ঢলতে ঢলতে বলল

‘ না, এমনি।

রিক হেসে রিপের দিকে তাকালো। রেহানকে বলল

‘ ছিকুকে দাঁড় করিয়ে দাও চেয়ারে। বসে পড়ো বাবা। মুনা তুমি আর নীরু ও বসো।

মুনা বলল

‘ আপনারা খান না। আমরা দুজন পরে খাব। পিহু বসো পড়ো আম্মু।

রেহান বলল

‘ না না আপনারা বসুন আমাদের সাথে। সবাই বসে খাব। ভালো লাগবে। বসুন। পিহু!

পিহু বলে উঠলো

‘ হ্যা। করছি।

রান্নাঘর থেকে বাকিসব নিয়ে আসলো পিহু। মুনা রিককে চোখ গরম করে ইশারায় বলল
‘ আর কথা পায়নি। মেয়ে জামাইয়ের সাথে বসে নাকি ভাত খাব।
রিক তার তাকানো দেখে হাসলো।

পিহু বলল
‘ আমি আজকে সবাইকে বেড়ে দিই মামি?
রিক বলল
‘ দাও দাও। কিছুদিন পর শ্বশুরবাড়ি গেলে তো বেড়ে খাওয়াতে হবে।
পিহু চামচ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো গালফুলিয়ে। চোখদুটো চামচের দিকে। রিপ বলল

‘ মামা তুমি বসো। আমাকে দাও।

পিহু চামচ লুকিয়ে ফেলে বলল

‘ নাহ।

রিপ হেসে ফেলল তার কান্ড দেখে। রিক বলল

‘ আচ্ছা আচ্ছা বিয়ে দেব না পিহু রাণীকে।

মাহিদ বলল

‘ ধুর বাপ। মতিবানু ডাকবা।

রিপ বলল

‘ কথা কম।

আবারও কান ঢললো মাহিদ। বিড়বিড়িয়ে পিহুকে বলল

‘ পেট বাপের ভিতরে ইঁদুর বাপ দৌড়াইতেছে। দিলে দে না দিলে না দিলে চইলা যাই। খামুনা ভাত বাপেরে। তোর ভাত তুই খা।

পিহু সবাইকে বেড়ে দিল। সবার শেষে গেল মাহিদের কাছে। মাহিদ বিড়বিড় করে বলল

‘ ও বাপ শালী তো প্রতিশোধ নিতাছে দেখতাছি। বড়ই ডেঞ্জারাস বেডি তো।

পিহু সবার শেষে মাহিদকে দিল সবকিছু। নীরা মাহিদের দিকে তাকিয়ে ভুরু উঁচিয়ে ইশারায় বলল

‘ কি ব্যাপার বাবুসোনা? এবার লও ঠেলা। আর ডাকবা মতি বানু?

পিহু মাহিদকে বলল

‘ মাহিদ ভাই তুমি নাকি চিংড়ি মাছ খাও না?

মাহিদ কপাল কুঁচকে তাকালো। খায় না মানে? তার যে চিংড়ি বাপেরে বহুত পছন্দ সেটা কি এই বেডি জানেনা? মাহিদ তো এখন বহুত লজ্জায় পড়ে গেছে।
পিহু মাহিদকে চিংড়ি দিল না। মুনা বলল
‘ ও চিংড়ির পাগল। অন্যকিছু কম দিলে ও চিংড়ি ডাবল খাবে ও।
পিহু ঠোঁট গোল করে বলল
‘ ওহহ। এটা তুমি আমায় বলবেনা মাহিদ ভাই? লজ্জা পাচ্ছ কেন? তোমার বাড়ি তোমার ঘর।

সবাই হেসে উঠলো একসাথে। মুনা তাকে বড় সাইজের দুটো চিংড়ি দিল। বলল

‘ খা যত ইচ্ছা।

মাহিদ পিহুর দিকে চোখ গরম করে তাকালো। শালীরে একা পাই?

ছিকু খেতে খেতে মাহিদের দিকে তাকালো। গলা উঁচিয়ে মাহিদের প্লেট দেখে বলল

‘ মিহি চিংলি বিশিবিশি খায় ফিলে কেন?

সবাই তার কথায় হেসে ফেলল। রিক বলল

‘ তুমি তো একটাই খেতে পারোনি ভাই।

‘ মিহি দুতা খায় কেন?

‘ রিক তাকে আর ও একটি চিংড়ি দিল।

শান্ত হলো ছিকু। মাহিদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে খেতে লাগলো মাহিদের মতো করে।
পড়নে শার্টের সামনের দিকে ভিজে যায় তাই মুনা একটি কাপড় বেঁধে দিয়েছে। সেটি ভিজে গেল তার পানি খাওয়ার সময়। রেহান বলল

‘ আমি খাইয়ে দেই পাপা।

ছিকু হাল ছেড়ে দিল। পিহু বলল

‘ খাইয়ে দাও দাভাই। আমি রোজ এরকম করি। কারো হাতে খাবেনা শুধু শুধু কাপড়চোপড় নষ্ট করবে।

‘ কেন? পিহু ছিকুকে বুকা দেয় কেন?

পিহু মুখ মোচড়ে দিল। ছিকু ভয়ানক রেগে গিয়ে বলল

‘ মিহি পিহুকে মারেনা কেন? বুকা দেয় না কেন? আবার কাঁদায় না কেন?

মাহিদ যেন দু সেকেন্ডের জন্য মারা গিয়ে আবার ফিরে এসেছে দুনিয়াতে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো সে। সর্বনাশ হয়ে যেত! এই ডাক্তারের বাচ্চিরে আইজ সত্যি সত্যি কয়েকটা দিতে হবে।

_______________

খাওয়া দাওয়ার পরে একটু ঘুমালো রেহান ছিকুকে নিয়ে। সন্ধ্যায় পিহু আর তারা বেরিয়ে পড়লো। যাওয়ার সময় মুনা ছিকুর হাতে পাঁচশ টাকা দিল। বলল
‘ এগুলো দিয়ে চকলেট খেয়ো নানুভাই।
ছিকু টাকা পেয়ে কি খুশি। নেচেনেচে বলল
‘ ছিকুর কাছে বড় টাকা আচে কেন? মিহির কাচে নাই কেন?
মাহিদ ঠোঁট কামড়ে বলল
‘ শালা!
মুনা ছিকুর গালে,কপালে আদরে আদরে ভরিয়ে দিল। বলল, অনেক বড় হোক আমার ভাই।
ছিকু বলল
‘ কেন ছিকু বড় হবে কেন?
মুনা হেসে ফেলল। বলল
‘ চলে যাচ্ছেন তো। নানুকে আদর দেবেন না?
ছিকু খিক করে হেসে ফেলল। মুনার গালে আওয়াজ করে চুমু দিয়ে বলল
‘ নানুকে পাপ্পি দিচি কেন?
মুনা হেসে তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে। বলল
‘ আবার এসো ভাই। কেমন?
রেহান বলল
‘ আসব বলেন।
ছিকু বলল
‘ কেন আচবো কেন?
রেহান বলল
‘ সবাইকে আপনাদের বাড়িতে বেড়াতে যেতে বলেন।
‘ চবাই ছিকুর ইখানে বিড়াতে যায় না কেন?
মুনা বলল
‘ যাব আমার ভাইকে দেখতে।
‘ টা টা চি ইউ।
রেহান বলল
‘ সালাম দেন সবাইকে।
ছিকু কপালে হাত দিয়ে বলল
‘ আচচালামুলাইকুম নানুমুণি।
মুনা তার ছোট্ট হাতের উপর আদর দিয়ে বলল
‘ ওয়ালাইকুমুস সালাম ভাই।
মাহিদ বলল
‘ বাপরে বাপ আদর সোহাগ শেষ হইলে ছিকুশালারে ছাড়ো। শালার এত সোহাগ আমার সহ্য হইতাছে না বাপ।
ছিকু কপাল কুঁচকে চাইলো। মিহি ইমুন করে কেন?
সবাই একসাথে হেসে উঠলো।
তারপর গাড়িতে উঠে বসলো সবাই। রিপ পিহুকে বলল
‘ বাড়িতে পৌঁছে ফোন দিও মামা।
পিহু মাথা নাড়ালো। রিপ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।

_____________

ছিকুর গলার আওয়াজ শুনতে পেয়ে পরী দৌড়ে এল। ছিকু রেহানের কোল থেকে নেমে ঝাপটে পরীর কোলে চলে গেল। পরী তাকে শক্ত করে জড়িয়ে কপালে, গালে চুমু দিতে দিতে বলল
‘ আমার সোনামানিক এসেছে?
‘ পরী ছোনামিনিক ডাকে কেন?
পরী হেসে ফেলল। রাইনা এসে কোলে নিয়ে নিল। বলল
‘ আমার দাদুভাই এসেছে। উফ এবার শান্তি। বাড়িটা খালি হয়ে গেল।
‘ কেন খালি হচে কেন?
তার কথা শুনে সবাই হেসে ফেলল। পিহু তার ঘরে চলে গেল। মুখ হাত ধুয়ে ফ্রেশ হতে গিয়ে দেখলো তার কানের স্বর্ণের একটি দুল নেই। পিহু ইশার কাছে ছুটে গেল। বলল
‘ আম্মা কানের দুল একটা খুঁজে পাচ্ছি না। কোথায় গেল?
ইশা এগিয়ে এল। বলল
‘ কোথায় ফেলেছ?
‘ আমার তো খেয়াল নেই।
পরী বলল
‘ মা আর ছোটমাকে ফোন করে বলোনা। ওখানে পড়ে থাকলে ওরা পাবে।
পিহু তার ফোন থেকে ফোন করলো মুনাকে। ইশা কথা বললো। মুনা বলল, আমি খুঁজে দেখছি। পেলে মাহিকে দিয়ে পাঠিয়ে দেব।
পিহু যে রুমে থেকেছে সেই রুমে তন্নতন্ন করে খুঁজলো। কোথাও সেটি পেল না। শেষমেশ ফোন করে জানালো সেটি তারা পায়নি। পিহুর মন খারাপ হলো। আদি হসপিটাল থেকে ফিরে পিহুর মন খারাপের কারণ জানতে চাইলো। সব শুনে বলল
‘ নিজ থেকে হারিয়ে গেলে তোমার তো দোষ নেই। যদি কোথাও থেকে থাকে তাহলে পেয়ে যাবে। মন খারাপ করার দরকার নেই মা।
পিহু তারপরও মন খারাপ করে থাকলো। আদি বলল
‘ কি হলো?
পিহু গালফুলিয়ে বলল
‘ আমি শুধু জিনিস হারিয়ে ফেলি। এত বদঅভ্যোস কেন আমার?
আদি হেসে ফেলল। তার পাশে বসে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল
‘ পিহু তো এখনো ছোট তাই।
পিহুর আদির দিকে তাকালো চোখ তুলে। বলল
‘ তাই?
‘ হুম।
‘ তাহলে ছোট্ট মেয়েটাকে বিয়ে দিচ্ছ কেন?
আদির কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ। পিহু বলল
‘ আনসার পাব পাপা?
‘ মা বাবার কাছে সন্তানেরা কখনো বড় হয় না আম্মা। আমার কাছে তুমি সেই ছোট্ট পিহু। কিন্তু সবার চোখে, সমাজের চোখে তুমি তো যথেষ্ট বড় হয়েছ। সব মা বাবা চাই ভালো ছেলের হাতে তাদের মেয়েকে তুলে দিতে। মেয়ে যখন হয়েছ শ্বশুর বাড়ি তো যেতেই হবে।
কেন শ্বশুরবাড়ি কি পছন্দ হয়নি?

পিহু ভড়কে গেল। আদি বলল
‘ কি হলো? আমার সিদ্ধান্তে তোমার অমত আছে কোনো? বলো আমায়। না বললে কিভাবে বুঝব মা?
পিহু তার হাতের উপর হাত রেখে বলল,
‘ তোমাকে আমি সব বলব পাপা । শুধু একটু সময় দাও আমাকে।
আদি চিন্তিত চোখে চেয়ে থাকলো। পিহু চলে গেল সেখান থেকে।

_____________

মেডিক্যাল থেকে বেরিয়েছে পিহু। নিশিতা নাকি চলে এসেছে। রাস্তায় নেমে এদিকওদিক তাকালো পিহু। নিশিতা গাড়ি থেকে গলা বের করে দিয়ে পিহুকে ডাক দিল। পিহু ছুটে গেল। নিশিতা গাড়ি থেকে নেমে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো পিহুকে। পিহু আবেগি হয়ে উঠলো। বলল
‘ তোকে কত মিস করেছি জানিস?
নিশিতা হাসলো। বলল
‘ আমি ও তোকে অনেক মিস করেছি বান্ধবী। শোন না আমার সাথে একজন এসেছে। তোকে দেখতে চাইছে খুব।
গাড়ি থেকে সুন্দর রূপবতী একজন চিকনচাকন মেয়ে বেরিয়ে এল। ড্যাবড্যাব চোখে পিহুর দিকে পলকহীন তাকালো। পিহু নিশিতার হাতে চাপ দিয়ে বলল
‘ কে মেয়েটা?
‘ ওই যার কথা তোকে বলেছিলাম। ফুপীর মেয়ে আর কি।
‘ জালিশা?
‘ এইতো চিনেছিস।
পিহু জালিশার দিকে তাকিয়ে হাসলো। মেয়েটার চাহনি কেমন যেন। পিহুকে অবাক করে জালিশা এক লাফে তার পাশে এসে দাঁড়ালো। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল
‘ হাই! জালিশা মেহফুজ।
পিহু হাত মিলিয়ে বলল
‘ আরিশা চৌধুরী।
‘ আমি পিহু ডাকি নিশুর মতো?
‘ ওকে।
দুজনেই একসাথে হাসলো।
‘ তুমি নিনিত ভাইয়া ফেয়ন্সে!
পিহু জালিশার দিকে তাকালো। কিছু বলল না। নিশিতা বলল
‘ তো তোকে কি বললাম আমি? এই তো আমার কলিজার বান্ধবী। ভাবি হয় ভাবি।
জালিশা মাথা নেড়ে হাসলো। পিহু বলল
‘ খুব সুন্দর তুমি।
জালিশা হেসে বলল
‘ তাই? তুমি ও সুন্দর। তোমার কিছু একটা আছে যেটা আমার নেই।
‘ আমার? কেন বললে ?
‘ কেন সেটা আমি নিজেও জানিনা।
বলেই একগাল হাসলো সে। পিহু নিশিতার দিকে তাকিয়ে বলল
‘ নিশু আমি কি ওকে কনফিউজড ডাকব?
তিনজনই একসাথে হাসলো।
নিশিতা বলল
‘ পিহু চল পার্কের দিকে যাই। আমি মাইশাকে ও আসতে বলেছি। আমার ওর জন্য ও মন পুড়ছে রে। আমার যদি আরেকটা ভাই থাকতো আমি ওকে ভাইয়ের বউ করতামই। মাহিদ ভাইকে দিতাম না।

‘ মাহিদ ভাই তোর ভাই না বুঝি।
জিভে কামড় খেল নিশিতা। বলল
‘ ওহ তাই তো। মাহিদ ভাইয়ের বউ হলে তো আর ও আপন। থাক ভালোই হচ্ছে। এবার একটা কাজ কর, জালিশার সাথে কারো লাইন ঠিক করে দে। যাতে আর কানাডায় ফিরতে না হয়।

‘ ওসবে আমি নেই। মাইশাকে বলিস।

কথা বলতে বলতে সবাই এগিয়ে গেল। পার্কের কাছাকাছি যেতেই মাইশা রিকশা থেকে নামলো। নিশিতার কাছে দৌড়ে গিয়ে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো
‘ কেমন আছ?
‘ খুব ভালো আলহামদুলিল্লাহ। তুমি?
‘ আলহামদুলিল্লাহ।
জালিশা অবাক চোখে চেয়ে আছে মাইশার দিকে। মাইশা ও তাকে দেখে ভুরু কুঁচকে চাইলো। জালিশা বলল
‘ আয়ে হায় ম্যাম আপনি? মিস জুলিয়েট।
মাইশা হেসে জালিশার গাল টেনে দিয়ে বলল
‘ জালিশা! কি ব্যাপার তুমি?
নিশিতা বলল
‘ তোরা একে অপরকে কিভাবে চিনিস রে?
মাইশা বলল
‘ সে অনেক কথা। বাই দ্য ওয়ে তুমি আমাকে ম্যাম কেন ডাকছ?
‘ কাল স্যারটা যে বলল। মিঃ রোমিও।
নিশিতা জিজ্ঞেস করল
‘ কার কথা বলছে রে?
‘ মিঃ মাহিদের কথা। ওনি কাল মজা করে বললেন যে সবাইকে স্যার এন্ড ম্যাম ডাকতে। সো জালিশা এজন্যই,
‘ মাহিদ ভাইয়ের কথা আর বলিস না। সবার সাথে মজা উড়ায়। আমি তো জিয়াদকে মাহিদ ভাইয়ের কথা বলতে বলতে হাসি।
জালিশা বলল
‘ মিঃ রোমিওর নেম মাহিদ? ওয়াও নাইস নেম।
‘ হ্যা ওই মিঃ মিস্টার রোমিও পিহুর কাজিন। মামার ছেলে।
জালিশা বলল
‘ ওহ শিট। আমার সব এলোমেলো লাগছে।
সবাই হেসে উঠলো একসাথে। শুধু পিহু হাসেনি।
মাইশা বলল
‘ হেই পিহু চুপচাপ কেন? কাল ফিরেছ মামার বাড়ি থেকে।
‘ হুহ।
নিশিতা বলল
‘ আমরা কোথাও গিয়ে বসতে তো পারি।

সবাই আড্ডা করলো। খেল, ঘুরলো। পিহুর ভীষণ মন খারাপ। মাইশা মেয়েটা অদ্ভুত। হুট করে এসে সব কেমন যেন কেড়ে নিচ্ছে পিহুর কাছ থেকে। নিশিতাও এখন মাইশা ছাড়া কিছু বুঝেনা। কিন্তু আজব ব্যাপার হলো পিহুর একটু ও রাগ লাগেনা মাইশার উপর। হিংসে হয় না। কটু কথা বলতে ইচ্ছে করেনা। বরঞ্চ মেয়েটিকে দেখলে মনে হয় এই মেয়েটিই তার অনেক কাজে লাগতে পারে। মাইশা পিহুর ভাবনায় ছেদ ঘটায়।

‘ এত কি ভাবো পিহু? ডক্টরকে ভাবছ?

জালিশা কপালে ভাঁজ ফেলে তাকালো ঘাড় ঘুরিয়ে। পিহু আমতাআমতা করে বলল

‘ না। ওই আর কি।

মাইশা হাসলো। পিহুর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল

‘ হিংসে হয় আমায়?

পিহু চমকে গেল। মাইশার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকলো। মাইশা হেসে আবার ও নিশিতা আর জালিশার সাথে গল্পে মজে গেল।

____________

নিনিত কেবিনে। রোগী দেখছে। আজ ভীষণ ব্যস্ততা। এদিকওদিক তাকানো যাচ্ছেনা। নার্স এসে বলল

‘ স্যার আপনার এক আত্মীয় এসেছে। ওনি আপনার সাথে দেখা করতে চাই।

‘ আর আধঘন্টা পর ডিউটি শেষ আমার। ততক্ষণ অপেক্ষা করতে বলুন সিস্টার।

নার্স চলে গেল। ডিউটি শেষ হলো নিনিতের। চেম্বারে গিয়ে দেখলো জালিশাকে। বসে পানির গ্লাস টেনে পানি খেল নিনিত। বলল

‘ কি সমস্যা? মাত্র দুদিন হয়েছে ফিরেছ। বাসায় তো দু কদম ও বসোনি বোধহয়।

‘ নাহ।

‘ তো এখানে কি চাই?

‘ আপনাকে।

‘ হোয়াট?

জালিশা খিক করে হেসে দিল। বলল

‘ আপনার ট্রিটমেন্ট ডক্টর। এভাবে ভয় পেয়ে গেলেন কেন?

নিনিত বুকভরে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল

‘ সবসময় মজার তালে থাকো। বাসায় ফিরবে?

‘ হুম।

‘ চলো। আমি আর বসে থাকতে পারব না। প্রচুর টায়ার্ড।

‘ রিকশা করে যাব ভাইয়া।

‘ দেখা যাক।

নিনিত বেরিয়ে গেল। তখনি আদির সাথে দেখা। তুমি কি বাড়ি ফিরছ?

‘ জ্বী স্যার। ডিউটি শেষ।

‘ ওকে সাবধানে যেও।

নিনিত মাথা নাড়লো। চলে গেল।
জালিশাকে নিনিতের পেছনে ছুটতে দেখে আদি বলল

‘ ওয়েট ওয়েট। কে তুমি?

জালিশা হাসলো। বলল

‘ আমি? আমি, এই যে এখন একটা ডক্টর গেল ওনার ফিউচার ওয়াইফি স্যার।

আদি ভ্যাবাছ্যাঁকা খেল। নিনিত?

____________

চৌধুরী বাড়ির নিচে বাগানে আছে মাহিদ। পিহু ফোন কানে ধরে বলল

‘ এত রাতে তুমি এখানে? বাসায় আসো না।

‘ তুই আয়।

পিহু ফোন কেটে দিয়ে নিচে চলে এল। সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে বাগানে চলে এল। মাহিদ ফোন টিপছে। পিহু তাকে দেখে থমকে গেল। কেন এসেছে মাহিদ ভাই?

মাহিদ বলল

‘ এদিকে আয়।

পিহু গেল না। আলো আঁধারিতে মাহিদের দিকে ভয়ার্ত চোখে চেয়ে থাকলো। দু পা সামনে এগিয়ে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো। বলল

‘ তোমাকে আমার ভয় হয় মাহিদ ভাই। যাব না অত কাছে।

‘ কিল্লাই? আমি বাঘ না ভাল্লুক?

‘ তুমি আরেকজনের মানুষ।

পিহুর গলায় একদলা অভিমান। মাহিদ তেড়ে এল। পিহুর হাত মু্ঁচড়ে ধরে বলল

‘ তো কিতা হয়ছে? আমি আরেকজনের মানুষ তো কিতা হয়ছে?

পিহু দু পা পিছিয়ে গিয়ে একটি গাছের সাথে লেগে গেল। বলল

‘ তুমি হুটহাট আমার সাথে দেখা করতে আসবেনা। চলে যাও।

পিহু তা বলেই চলে যাচ্ছিল। মাহিদ তার হাত চেপে গাছটার সাথে লাগিয়ে মাথার চুলে কি একটা যেন লাগিয়ে দিয়ে বলল

‘ এখন মাইশার কাছে যামু। পুরো রাত তার সাথে থাকুম। তোর কাছে সেকেন্ডের জন্য আসি। যাহ। সর।

পিহুর চোখে রাগ, ক্রোধ। মাহিদের চোখে ও একই অবস্থা। পিহু ফোঁপাতে ফোপাঁতে বলল

‘ আমার কাছে সেকেন্ডের জন্য কেন আসো? আমি তো আসতে বলিনি।

মাহিদ তেড়ে এলে ভয়ে চোখ খিঁচিয়ে ফেলল পিহু। পিহুকে অমন অবস্থায় দেখে হেসে উঠলো মাহিদ। হো হো করে হাসতে হাসতে একপর্যায়ে হাসি থামলো। পিহুকে ফিসফিস করে বলল

‘ তোরে মনে পড়ছে তাই আইছি মতিবানু। তুই মানা করলে আর আসতাম না। যাহ। চইলা যাইতাছি।

বলেই মুহূর্তেই নিরুদ্দেশ হলো মাহিদ। ছিকু তাকে চলে যেতে দেখলো।

পিহু বাড়িতে ঢুকতেই ছিকু কোমরে হাত দিয়ে বলল

‘ পিহু মিহির সাথে কথা বুলতে গেচে কেন? মিহি ইখানে আচেনাই কেন?

সবাই এসে জেরা করলো পিহুকে। পিহু হা করে চেয়ে রইলো সবার দিকে। ইশা পিহুর মাথায় লাগিয়ে রাখা কিছু একটা হাতে নিয়ে বলল

‘ এটা তোমার কানের দুলটা না?

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে