মনোহারিণী পর্ব-১৯+২০(অন্তিম পর্ব)

0
1662

❝মনোহারিণী❞
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
পর্ব : (১৯)+(২০) অন্তিম পর্ব

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ!)

মাঝেমধ্যে যখন অতীতের ছোটো অধ্যায় কিংবা এক টুকরো অনুভূতির ফেলে আসা দিন অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে সামনে এসে দাঁড়ায়, ব্যক্তি তা সামলাতে বড্ড হিমশিম খায়। কেউ কখনোই চায় না, তার ছোট্ট অতীত সুন্দর বর্তমানকে এসে প্রশ্নবিদ্ধ করুক। বর্তমানের সাজানো, গোছানো মুহূর্তগুলোকে ভে’ঙে তছনছ করে দিক। তবুও কিছু সময়, অতীত মানুষের বর্তমানে চলে আসে। ভুল হোক কিংবা সঠিক, অতীত এসে জাগিয়ে দেয় কিঞ্চিৎ দুর্বলতা! মাইসারার আজকের সুন্দর দিনটায়ও হুট করেই অনাকাঙ্ক্ষিত সময়ের আবির্ভাব ঘটলো। তাকে পুরোপুরি কাঁপিয়ে দিল। বুঝিয়ে দিল, মানুষ চলে গেলেও বার বার ফিরে আসে। কিন্তু কেন আসে?

ইন্টার্নিশিপের নির্ধারিত সময় ফুরিয়ে গেছে। সেই হিসেবে আজকের দিনটা বিশেষ একটা দিনে পরিণত হওয়ার কথা। সুন্দর এক আলোচনা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সেরা তিনজনকে স্পেশাল পুরষ্কার দেয়ার পাশাপাশি লিগ্যাল সার্টিফিকেট প্রদান করা হবে। এতে তারা বাংলাদেশের যেকোনো হসপিটালেই প্রেকটিস করার সুযোগ পেয়ে যাবে। এখানে যেমন বেশি মেধার ছাত্রছাত্রী আছে, তেমনি কম মেধারও আছে। তবে প্রত্যেকেরই মনের জোর ছিল প্রখর। ফলস্বরূপ আজকের এই সফলতা।

“ইন্টার্নশিপ সার্টিফিকেট প্রদান অনুষ্ঠান” চলাকালীন সময়ে সেরা তিনজন শিক্ষার্থীর জন্য বিশেষ শুভেচ্ছা স্মারক প্রদান করা হয়। যাদের মধ্যে মাইসারার নামটাও ছিল। যখন তিনজনের হাতে ক্রেস্ট আর সার্টিফিকেট তুলে দেয়া হয়, সেই সময়টা গোটা জীবনের সবচেয়ে দামী মুহূর্ত হিসেবে অনুভব করে সকলে। অনুষ্ঠান থেকে একজন পুরো সময়টা ফেইসবুকে লাইভে ছেড়ে দেয়। ফলে গোটা দেশ সাক্ষী হয়ে যায় একটি সুন্দর সফলতার।

অনুষ্ঠান শেষে উৎফুল্ল মনে নিজের সবকিছু গোছগাছ করছিল মাইসারা। আজকেই বাড়ি ফিরবে এমনটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আগে। সব গোছানো প্রায় শেষ। অনিককেও জানিয়ে দিয়েছে খুশির খবরটা। লাগেজ নিয়ে যখন হোস্টেল ছেড়ে বের হলো তখনই রিপা আসলো। জড়িয়ে ধরে বিদায় নিল একে-অন্যের থেকে। মুচকি হেসে বলল,

-“তোর জন্য একজন অপেক্ষা করছে!”

-“কে?”

কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো মাইসারা। অনিক এত দ্রুত চলে এসেছে তবে! কেমন খাপছাড়া লাগলো। ঘণ্টা খানেক আগেই মাত্র জানিয়েছে, আজ বাড়ি ফিরবে। এরমধ্যেই তো চলে আসার কথা না। রিপা পক্ষান্তরে জবাব দিল,

-“ক্যান্টিনে অপেক্ষা করছে! আজই তো চলে যাবি। আর আমাদের দেখা হবে না!”

-“যোগাযোগ তো হবেই। সাবধানে থাকিস। আল্লাহ্ হাফেজ।”

ফের রিপাকে জড়িয়ে ধরে বিদায় নিল মাইসারা। ভাবনারত চেহারা নিয়েই ক্যানটিনের ভেতরে প্রবেশ করলো। চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে পরিচিত কাউকেই দেখতে পেল না। পিছু ঘুরে চলে আসতে গিয়েই থমকে দাঁড়ালো। হাতের ঠিক ডানপাশে বসে থাকা যুবক হুট করে দাঁড়িয়ে সৌজন্যতাবোধ প্রকাশে হাত বাড়িয়ে বলল,

-“হাই সারা! কেমন আছো?”

ঠিক এই মুহূর্তে কী জবাব দেয়া উচিত ভেবে পেল না মাইসারা। সেই একটা মেইল, এরপর আর কোনো খোঁজ নেই। আজ এতগুলো বছর পর এসে সানভি জানতে চাইছে, সে কেমন আছে! প্রশ্নটা অদ্ভুত শোনালো। তবুও মাইসারা নিজেকে সামান্যতম বিচলিত হতে দিল না। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। হাত না বাড়িয়ে মুচকি হেসে বলল,

-“সৃষ্টিকর্তা খুব ভালো রেখেছেন। তুমি এখানে কেন এসেছো, কতখানি ভে’ঙে গুড়িয়ে গেছি সেটা দেখতে?”

-“তোমার সাথে দেখা করতে!”

-“দেখা করার কথা ছিল আমাদের?”

সানভি এই প্রশ্নে পুরোটাই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। আসলেই কি ছিল? কেন এলো সে? এতগুলো বছর পর কীসের আর টান জন্মাতে পারে? কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,

-“দেশে ফিরে তোমার অনেক খোঁজ করেছি সারা, তোমাদের বাড়িতেও গিয়েছি। ভেবেছিলাম বিয়ের প্রস্তাব দিব, কিন্তু তোমার ওই কাজিন রীতিমতো ঘাড় ধা’ক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে আমাকে! আজকের ফেইসবুক লাইভেই দেখলাম, তুমি এই হসপিটালে। বাধ্য হলাম এখানে আসতে।”

বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো মাইসারা। কেন যেন সানভির সাথে কথা বলার আগ্রহ আসছে না তার। রাগ লাগছে নিজের উপর। কেন ভুল মানুষকে মন দিয়েছিল সে? কেন অতীতটা আজ সামনে সে দাঁড়ালো? কী উপায়ে তাকে এড়িয়ে যাবে সে? কোনো উত্তরই খুঁজে পেল না তৎক্ষনাৎ। তবুও ধৈর্য্য ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। সানভি আবারও বলল,

-“আমি আসলে তোমাকে কিছু কথা বলতে এসেছি! ভেবেছিলাম তোমার মতো মিডি’লক্লাস মেয়েরা স্বপ্ন পূরণের জন্য আমার মতো হাই সোসাইটির লোকজনকে বেছে নিবে। সে কারণে দেশের বাইরে গিয়ে আমি আর যোগাযোগ রাখতে চাইনি।”

-“তুমি কী ভেবেছিলে? তুমি ছেড়ে চলে গেলে আমি ওখানেই মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবো? সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবো না? নিজের লক্ষ্য থেকে দূরে সরে যাব? এতটাই দুর্বল ভেবেছিলে আমাকে?”

-“এটাই ভেবেছিলাম! কারণ তোমার মাথার উপর ছাদ ছিল না। এমনকি ভরসা দেয়ার মতোও কেউ ছিল না। কিন্তু তুমি তা ভুল প্রমাণ করে দিয়েছো। দেশ ছেড়ে বাইরে যাওয়ার আগে তোমার কাজিনের সাথে খুব ঝামেলা হয় আমার!”

-“কীসের ঝামেলা?”

চমকে উঠলো মাইসারা। অনিকের সাথে সানভির তবে অনেক আগেই দেখা হয়েছে। ঝামেলাও হয়েছে। ঠিক কী নিয়ে? এতগুলো বছর পর, এসব কথা সানভি কেনই-বা জানাতে এসেছে? সে তো আর যোগাযোগ রাখার প্রয়োজন মনে করছে না। ভুল মানুষ একবারই করে, বার বার নয়! সে-ও একবারই করেছে, আর করবে না।

*****

ফ্ল্যাশব্যাক :
___________

তখন মাইসারার মেডিকেল জীবনের মাত্র শুরু। সানভির সাথে রিলেশনের প্রায় কয়েক মাস পরের ঘটনা। মাইসারার প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস আর টাকা দিতে হোস্টেলে এসেছিল অনিক। ঠিক এই ক্যানটিনে এসেই অপেক্ষা করছিল। সেই মুহূর্তে সানভির সাথে আলাপ হয় তার। সেটা শুধু সৌজন্যসাক্ষাৎ ছিল না রীতিমতো ঝগড়া বেঁধে গিয়েছিল দু’জনার। প্রথমে অনিক একপলক দূর থেকেই দেখছিল সানভিকে। মাইসারার মুখে শুনেছিল দু’জনার রিলেশনে জড়ানোর কথা। হোয়াটসঅ্যাপে ছবিও দেখেছিল। খারাপ লাগলেও মন থেকে চেয়েছিল, মাইসারা সেই খুশিতে খুশি থাকুক। অথচ তার সেই ভাবনাকে তুড়ি মে’রে উড়িয়ে দিয়েছিল সানভি। এক পরিচিত বন্ধুর সাথে আলোচনা করছিল সে। বলছিল,

-“শা’লা এমন মিডি’লক্লাস একটা মেয়েকে ভালোবাসলাম, যার চালচুলো কিছুই নেই।”

অপরপাশে থাকা ছেলেটা জবাবে বলেছিল,
-“নিজের ইচ্ছেতেই তো রিলেশনে জড়িয়েছিলি। এখন এত ভাবছিস কেন? কিছু থাকুক বা না থাকুক, তুই তো আছিস। মানিয়ে নিবি দু’জনে।”

-“আমার বাপের এত সম্পত্তি! যদি শুনে এমন একটা মেয়ের সাথে রিলেশনে জড়িয়েছি আমাকে ত্যা’জ্যপুত্র করবে। তাছাড়া মা আমার কাজিনের সাথে বিয়ে ঠিক করে রেখেছে। মেয়েটা আমেরিকাতে থাকে। ভাবছি উচ্চ ডিগ্রির কথা বলে এখান থেকে চলে যাব। ওখানে গিয়ে কাজিনকে বিয়ে করে সুখী জীবন কাটাবো।”

-“তবে তোর গার্লফ্রেন্ডের কী হবে?”

-“চুলোয় যাক সে। তার রূপ ধুয়ে কি পানি খাব আমি? আমার নখেরও যোগ্য নয় মাইসারা!”

-“এতদিন যে মেয়েটাকে স্বপ্ন দেখালি! সব স্বপ্ন ভে’ঙে দিবি?”

-“আমি তো বলিনি তাকে স্বপ্ন দেখতে! সে অনেক বুদ্ধিমতি। আমার ঘাড়ে ভর দিয়ে এই সুযোগটা লুফে নিতে চাইছিল। বড়ো হওয়ার স্বপ্ন দেখছিল। ডাক্তার হবে। না আছে টাকা-পয়সা, আর না আছে স্ট্যাটাস! কীভাবে এই কঠিন পথ অতিক্রম করবে সে?”

হাসিঠাট্টায় খুব বা’জে বা’জে কথা বলছিল সানভি, যার প্রত্যেকটা কথা মাইসারাকে অপমান করে বলা হচ্ছিলো। অনেকক্ষণ চুপ থেকে তার পুরো প্ল্যানটাই শুনে ফেলেছিল অনিক। মুখোমুখি জবাব দিতে সোজা তার সামনে এসে পাশের চেয়ারে বসেছিল। বলেছিল,

-“দারুণ চিন্তাভাবনা! একটা মেয়ের অনুভূতি নিয়ে খেলতে লজ্জা লাগে না? তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে, সেই প্রতিশ্রুতি ভা’ঙ’তে বুক কাঁপে না? এই ছিল বিশ্বাস আর ভরসার মূল? মানুষকে না চিনে, না বুঝে তাকে অপমান করতে বিবেকে বাঁধেনি আপনার? মনে হয়নি, যদি একবার মেয়েটা এই সত্যি জানে, কতখানি কষ্ট পাবে?”

জবাবে সানভি ঠোঁট উলটে হেসেছিল। চেয়ারে হেলান দিয়ে গর্বের সাথে বলেছিল,

-“ওসব মেয়েদের আমার চেনা আছে। এই দু’হাতে কত মেয়েকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়েছি!”

-“সারাকেও ঘুরাতে চান?”

-“মেয়েটা তো ঘুরছেই। পা’গলের মতো ঘুরছে। অথচ জানেই না, এসব মিথ্যে অভিনয়। এমন দু’চারটা মেয়ে যদি না পটাতে পারি, তবে পুরুষ মানুষ হয়ে জন্মালাম কেন?”

-“ওহ, যারা মেয়ে পটাতে পারে না তারা বুঝি হিজ’ড়া?”

-“ওদেরকে তো কাপু’রুষ বলে।”

-“তুই কি জানিস তুই কুকু’রের চেয়েও অধম?”

আপনি থেকে তুই-তে নেমে আসলো অনিক। মাইসারার অপমানটা হজম করতে পারছিল না সে। ততক্ষণে অনিকের দুটো হাত সানভির শার্টের কলার চেপে ধরেছে। রাগে তার চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। কখন যে নাকমুখ ফা’টি’য়ে ফেলে ঠিক নেই। আচমকা এই আচরণে রীতিমতো হকচকিয়ে যায় সানভি। অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে অনিকের দিকে তাকায় সে। রাগে হিসহিসিয়ে বলে,

-“আপনার সাহস হয় কী করে আমার কলার চে’পে ধরার?”

-“তোর সাহস হয় কী করে, আমার সামনে আমার কাজিনকে অপমান করার! তোর ভাগ্য অনেক ভালো যে, যে মুখে এসব কথা বলেছিস ওই নোংরা মুখটা আমি এখনো থেত’লে দেইনি!”

-“ছাড়ুন আমার শার্ট! যেমন ক্লাস তেমন তার আচরণ!”

-“তোদের মতো হাই সোসাইটি বুঝি একটা মেয়েকে অপমান করার শিক্ষা দেয়! বাবা-মা সঠিক শিক্ষা দিয়ে বড়ো করেনি দেখেই মেয়েদের মন বুঝার মতো মানসিকতা জন্ম হয়নি। মনে রাখিস, তোর মতো কুৎসিত মনের মানুষকে ফের যদি সারার পিছনে ঘুরঘুর করতে দেখি, তোর দুটো চোখ আমি উপ’ড়ে ফেলবো!”

সানভির বন্ধুরা সেদিন টেনেটুনে তাকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়। অনিক সেসব কথা ইচ্ছে করেই মাইসারাকে জানায়নি। জানলেই মেয়েটা পুরোপুরি ভে’ঙে পড়তো। সানভি চলে যাওয়ার বহুদিন পর যখন তার বিয়ের খবর সে মেইল করে পাঠায় সেদিন থেকে মাইসারা একটু একটু করে ভা’ঙ’তে থাকে। সেই ভে’ঙে যাওয়া মানুষটাকে আবারও সোজা হয়ে দাঁড় করাতে কতখানি কষ্ট করেছিল অনিক, সেটা মাইসারার অজানা নয়। প্রতি পদে পদে অনিক ভরসা হয়ে এগিয়ে এসেছিল। বুঝিয়েছিল,

-“কেউ কিছু হারিয়ে ফেললে গোড়া থেকে ভে’ঙে পড়ে না, বরং সেখান থেকে নিজেকে একটু একটু করে আবারও সোজা করে দাঁড় করায়। মানুষ সবসময় তার নিজের জন্যই বাঁচে। ভালোবাসা একবার হারিয়ে যাওয়া মানে এই নয় যে, আর তা ফিরে আসবে না। বরং তার দ্বিগুণ সুখ নিয়ে জীবনটাকে আবারও সুখে ভরিয়ে দিবে। দুর্বল হোস না সারা, এখনও অনেকটা পথ অতিক্রম করা বাকি!”

মাইসারা সেদিন বুঝেনি অনিকের এতসব কথার মর্ম। এখন বুঝতে পারছে, নিজের প্রিয়জনকে কতখানি অপমানের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেও শক্ত মনে আবারও সাহস সঞ্চার করে সামনের পথকে সহজ করে দিয়েছিল সে। বুঝিয়েছিল, যত ঝড় আসুক সে থাকবে, সবসময়। ভরসা আর বিশ্বাস হয়ে। আগলে রাখবে সারাজীবনের জন্য।

*****

-“সারা যা হয়েছে ভুলে যাও। চলো না দু’জনে একসাথে বাঁচি!”

সানভির এই কথা আচমকাই প্রচণ্ড হাসি পেল মাইসারার। খিলখিল করে কিছুক্ষণ হাসলো। তারপর বলল,

-“তুমি কী ভাবছো, আমি এখনো তোমার অপেক্ষায় বসে রয়েছি?”

-“আমি জানি, তুমি আমাকে অনেক ভালোবাসো। তোমাকে শা’স্তি দিতে গিয়ে আমি নিজেও অনেক শা’স্তি পেয়েছি। যাকে বিয়ে করে সুখী হতে চেয়েছিলাম, সেই আমাকে ছেড়ে চলে গেছে তা-ও অন্য একজনের হাত ধরে। এখন তুমি যদি আমাকে ফিরিয়ে দাও, তবে আমি যে নিঃস্ব হয়ে যাব।”

-“ঠিক তাই। তুমি চলে যাওয়ার পর আমারও নিজেকে নিঃস্ব মনে হয়েছিল। ভে’ঙে পড়েছিলাম আমি। অবিশ্বাসের অতল গহ্বরে তলিয়ে গিয়েছিল আমার এক চিলতে বিশ্বাস। সেই ভে’ঙে যাওয়া আমিটাকে আবারও যত্ন করে গড়ে নিয়েছে একজন। যার কারণে আজকের এই মাইসারা হাসানের জন্ম হয়েছে। হয়তো সেদিনই আমার দৌড় থেমে যেত, যদি না সেই মানুষটা আমাকে সাহস আর মনোবল দিত।”

-“কে সে? যার কারণে আজকের এই তুমি?”

-“জীবনসঙ্গী!”

-“তুমি বিয়ে করেছো? তুমি তো বলেছিলে, আমার জন্য অপেক্ষা করবে। তবে?”

-“ভুল ছিল তোমার মতো কা’পুরুষকে ভালোবাসা। ভুল পথে নিজের সচ্ছ অনুভূতিটুকু বিলিয়ে দিয়েছিলাম আমি। তুমি ভাবলে কী করে, আমি সেই মানুষটাকে ছেড়ে আবারও তোমার হাত ধরবো? ভালোবাসা তোমার কাছে সস্তা পণ্য মনে হয়? যখন ইচ্ছে হলো ছুঁড়ে ফেললাম, আবার যখন ইচ্ছে হলো কুড়িয়ে নিলাম। ভালোবাসা তো পবিত্র একটা অনুভূতি। এই চিরন্তন সত্য অনুভূতিটুকু কেবল যোগ্য মানুষটার জন্যই হওয়া উচিত। তোমার মতো চি’প মেন্টালিটির মানুষের জন্য ভালোবাসার জন্ম হয়নি! যাও আমার সামনে থেকে, আর কখনো তোমার ওই মুখ নিয়ে আমার সামনে আসবে না। যদি দেখি আমার পায়ের জু’তো খুলে তোমার গা’লে বসিয়ে দিব স্টুপিড!”

-“প্লিজ সারা আমাকে শেষবারের মতো সুযোগ দাও। আমেরিকা থেকে ফিরেই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম আমি। কিন্তু সেদিন তোমার কাজিন আমাকে পথ থেকেই তাড়িয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, তুমি নাকি বাড়ি ছেড়ে চলে গেছো।”

-“ভালোই করেছিল। তোমার মতো রাস্তার কুকু’রের সাথে এরকমটাই করা উচিত। তুমি এসবেরই যোগ্য!”

অনেকক্ষণ ধরে বেশ সাবধানে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করছে মাইসারা। আর পারলো না। যখন দেখলো সানভি অকারণ ঝামেলা তৈরী করার চেষ্টা করছে তখনই ক্যানটিন ছেড়ে বেরোতে গিয়েই থমকে দাঁড়ালো। অনিককে দাঁড়িয়ে থাকতে থেকে ভীষণ চমকালো। দেড় থেকে দু’ঘণ্টার পথ, এত দ্রুত কীভাবে আসলো সে! ভয়ে ঢুক গিললো মাইসারা। সামনে বর্তমান আর পিছনে অতীত। কীভাবে সামলানো উচিত বুঝতে পারলো না কিছুই। কোনোমতে কেঁপে কেঁপে উচ্চারণ করলো,

-“তুমি? সেই কখন তোমাকে আসতে বললাম! এতক্ষণ লাগলো?”

-“চলে আয় এখান থেকে!”

যেভাবে হুট করে এসেছিল, ঠিক সেভাবেই ঝড়ের বেগে বাইরে বেরিয়ে গেল অনিক। মাইসারা থম মে’রে দাঁড়িয়ে রইলো। কোথাও অনিক তাকে ভুল বুঝলো না তো! কিছু ভাববারও সুযোগ পেল না আর। হাতের ট্রলিটা নিয়ে ঝটপট অনিকের পিছু ছুটলো।

*****

মূল গেইটের সামনে এসে দ্বিতীয়বারের মতো চমকালো মাইসারা। একটা প্রাইভেট কারের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনিক। তার উদাসী চেহারায় যেন অনেকখানি বেদনা লুকিয়ে রয়েছে। বহুদিনের তৃষ্ণা মেটাতে প্রিয়জনের হাসিমাখা মুখ দেখতে চেয়েছিল সে, অথচ অনিকের এই বিষণ্ণতায় ভরা থমথমে ভাবটা তাকে ক্ষণিকের জন্য মারাত্ম’ক ভয় পাইয়ে দিল। কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বলল,

-“সানভি এখানে আসবে আমি বুঝতে পারিনি!”

-“এই টপিক নিয়ে কোনো কথা বলার প্রয়োজন নেই আর। গাড়িতে উঠ। সবাই অপেক্ষা করছে।”

কেমন নিষ্প্রাণ শুনালো তার কণ্ঠস্বর। মাইসারার মনে হলো, এক্ষুণি মানুষটাকে জড়িয়ে ধরে ভুল ভা’ঙিয়ে দিক। সবসময় চোখের দেখা সত্য হবে এমন তো কোনো কথা নেই। এখানে নেগেটিভ না ভেবে পজেটিভটা কেন ভাবছে না সে? কেন ভুলকে সঙ্গী করে রাগকে অকারণ দূরত্বের কারণ হিসেবে বেছে নিয়েছে? আজকের দিনে এমন বিচ্ছি’রি কাণ্ড কেন ঘটলো? কেন অসময়ে সানভি এসে সবকিছু এলোমেলো করে দিল? ভাবতে ভাবতেই গাড়ির দরজার সামনে গেল সে। অনিক দরজা খুলে পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ চেহারা বলছে, সে ভালো নেই। আড়চোখে চারপাশে চোখ বুলালো মাইসারা। যত মানুষের আনাগোনা ছিল, প্রায় সবাই-ই চলে গেছে। হাতে গোনা কয়েকজন রেস্তোরাঁয় বসে খোশমেজাজে গল্প করছে, কেউবা চা-নাশতা পান করছে। লোকজনের নজর এদিকে আছে বলে মনে হলো না তার। আলগোছে অনিকের ডানহাতটা শক্ত করে ধরলো। আলতো স্পর্শে হাতের উপরিভাগে অধর ছোঁয়ালো। খানিকটা কাছাকাছি এগিয়ে চেহারাটা নিজের দিকে ঘুরালো। বলল,

-“আমায় জিজ্ঞেস করো, কেন এসেছিল? মনের ভেতর অকারণ কোনো অভিযোগকে প্রশ্রয় দিও না।”

চমকে তাকালো অনিক। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে ততক্ষণে অর্ধাঙ্গিনী তার কেঁদে ফেলেছে। হাত ছাড়িয়ে চোখের পানি মুছে দিল। বলল,

-“ওই চ্যাপ্টারটা ক্লোজ। দ্বিতীয়বার আর কোনো কথা হবে না। আমি তো ভেবেছি, তুই আমাকে ভুল বুঝতে পারিস। কারণ আমার সাথে সানভির দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে রাগারাগি হয়েছে এতসব কথা আমি তোকে লুকিয়ে গেছি। এখন সে এসে তোকে সব বলে দিয়েছে। মনে হলো, হয়তো তুই এখন বলবি, আমি কেন লুকোলাম!”

-“আমি সেদিনই বলেছিলাম, তোমাকে বিশ্বাস করি। আমি এটাও বুঝতে পেরেছিলাম, সানভির সাথে দেখা হওয়া এসব কথা লুকোনোর পিছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ ছিল! যার কারণে তুমি চাওনি, সে দ্বিতীয়বার আমাকে আর অপমান করুক।”

-“তার মানে তুই সব জানতি?”

-“হ্যাঁ! নামিরা আপু বলেছে।”

-“তবে এতদিন জানতে চাসনি কেন?”

-“ওসব পাগ’ল, ছা’গলের কথা কেন জানতে চাইবো? ভালোই করেছো, তাড়িয়ে দিয়েছো। আমার তো ইচ্ছে করছিল, পায়ের জুতো খুলে ঠা’স করে ওর গা’লে বসিয়ে দেই।”

অনেকক্ষণ পর ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো অনিক। অকারণ দুঃশ্চিন্তা ঘাড় থেকে নামলো। যত্ন করে হাত ধরে অর্ধাঙ্গিনীকে গাড়িতে তুললো সে। সোজা সামনের সিটে বসালো। খানিকটা ঘুরে এসে ড্রাইভিং সিটে বসলো নিজে। মাইসারা অবাক হয়ে বলল,

-“এটা কবে কিনলে?”

-“এক সপ্তাহ আগে! ভাবলাম তোকে সারপ্রাইজ দিব। কিন্তু এখানে এসে তো আমিই সারপ্রাইজড হয়ে গেলাম।”

-“কী বুঝলে?”

-“অনেককিছু!”

মাঝেমধ্যে ভালোবাসি কথাটা মুখে বলার প্রয়োজন পড়ে না। প্রিয়জনের আচার-আচরণে বুঝে নেয়া যায়, সঙ্গী/সঙ্গিনী একে-অন্যকে কতখানি সম্মান করে, ভালোবাসে। আজকের পরিস্থিতিটাও তেমন। মাইসারা আর সানভির কথা কাটাকা’টি সম্পূর্ণ শুনেছে সে। এতেই পুরো বিষয়টা তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। ভুল বুঝা কিংবা ভুল ভাবারও প্রয়োজন পড়েনি। বরং সে চেয়েছিল, আরও খানিকক্ষণ মাইসারা ওই পাগ’লটাকে ইচ্ছামতো বকুক। বুঝিয়ে দিক, জীবন কখনো কারও জন্য থেমে থাকে না। তার জীবনও সে থামিয়ে রাখেনি, গুছিয়ে নিয়েছে নিজের মতো করে! ভরসার কাঁধ পেয়েছে, বিশ্বাস পেয়েছে, পেয়েছে ভালোবাসাও। ভাবনা থামিয়ে খানিকটা ঝুঁকে প্রিয়তমার কপালে উষ্ণ স্পর্শ ছুঁইয়ে দিল অনিক। দু’চোখ বন্ধ করে সেই স্পর্শটুকু যত্ন করে আগলে নিল মাইসারা। ফিসফিস করে বলল,

-“তোমার তিনটে বউকে তাড়িয়ে দিয়েছো তো? এখন শুধু আমার রাজত্ব চলবে। আমি ছাড়া আর কাউকে নিয়ে ভাববে না।”

জবাবে মুচকি হাসলো অনিক। সোজা হয়ে বসে চাবি ঘুরিয়ে গাড়ি স্টার্ট করলো! অর্ধাঙ্গিনীর ডানহাতটা তার বামহাতের ভাঁজে আট’কে নিল। নির্ভরশীল এক হাসি ফুটালো ঠোঁটে। চোখের পলক ফেলে আশ্বস্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো। বলল,

-“তুই ভোরের আলো নোস যে, বিকেল গড়ানোর সাথে সাথে আঁধারে নিজেকে আড়াল করে নিবি। তুই আমার ছোট্ট হৃদয়ের গভীর এক অনুভূতি। আঁধারে হোক কিংবা আলোতে, যা আমার তা আমি চিরকাল আমার করেই রাখবো। পৃথিবীর রঙ পাল্টাক, বর্ষপঞ্জিকা তার ঋতু পাল্টাক, খরস্রোতা নদী শুকিয়ে আরও খটখটে হয়ে যাক, সময় যতই হাওয়ার বেগে পালিয়ে যাক, আমার অনুভূতিটুকু আমি সবসময় তোর জন্যই গচ্ছিত রাখবো। যদি তুই হাতটা ধরিস, বাকি জীবন আমি হাসতে হাসতে তোর নামে লিখে দিতে পারবো। যে ঘর বেঁধেছি আমি ভালোবাসায়, সে ঘর ভা’ঙবো না কভু অবহেলায়! আমৃ’ত্যু আমার প্রতি তোর বিশ্বাসকে বাঁচিয়ে রাখিস সারা, তোর কাছে আমার শুধু এতটুকুই চাওয়া!”

চলবে…

❝মনোহারিণী❞
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
পর্ব : (২০) অন্তিম পর্ব

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ!)

মানুষ অভ্যাসের দা’স! যে স্থানে বসতী গড়ে তুলে সে স্থান ছেড়ে চলে আসতে গেলেই মন কাঁদে। হোক তা কোনো প্রিয় জায়গা কিংবা কর্মক্ষেত্র অথবা নিজের বাড়িঘর। একটা সময় বাড়ি ছেড়ে বাহিরে থাকতে মন কেঁদে উঠতো মাইসারার। আজ মন কাঁদছে প্রিয় কর্মক্ষেত্রের জন্য। প্রতিটা কাজের সময়ে যারা সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে, বুঝিয়েছে, শিখিয়েছে, এই পর্যন্ত গড়ে উঠতে সাহস জুগিয়েছে সবাইকে খুব মিস করছে সে। গাড়ির সিটে বসে ফেলে আসা জায়গার স্মৃতিচারণে মগ্ন ছিল মাইসারা। হুঁশ ফিরলো গাড়ি থামার পর। দ্রুত গাড়ি থেকে নামলো অনিক। পিছন থেকে ট্রলিটা বের করলো। পাশের দরজা খুলে হাত বাড়ালো অর্ধাঙ্গিনীর দিকে। মুচকি হেসে যত্ন করে সেই হাতে ভরসা খুঁজলো প্রিয়জন। দু’পা হেঁটে সামনে এগোতেই অনিক তার কাঁধে হাত রেখে বলল,

-“এটা তোর প্রেমকুঞ্জ। তোর স্বপ্ন পূরণের দ্বার! এখান থেকেই আবারও নতুন স্বপ্নের শুরু করবি। সাজাবি নিজের সংসার। দু’হাতে আগলে নিবি স্বপ্নকে, আপন, পর সবাইকে। উপলব্ধি করবি, প্রিয়জনের সংস্পর্শ আর ভালোবাসাকে। দিনশেষে একমুঠো সুখ এনে ভরে দেব তোর আঁচল! জীবনের আরও একটা অধ্যায়কে আঁকড়ে ধরতে পারবি না, সারা?”

মুখে কোনো জবাব আসলো না তার। শুধু চোখের পলক ফেলে আশ্বস্ত ভঙ্গিতে নীরবে মাথা নাড়লো। ভেতরে পা রাখতেই নাহিয়ান ছুটে আসলো কাছে। দু’হাত বাড়িয়ে তাকে কোলে তুলে নিল মাইসারা। আদুরে মাখা তুলতুলে গালে অজস্র চুমুর স্পর্শ দিল। বুকের সাথে আগলে নিয়ে বলল,

-“ভালো আছো তুমি?”

-“খুব ভালো আছি। তুমি এত দেরী করে আসলে! সেই সকাল থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।”

মাইসারা কিছু বলার আগেই অনিক ফোড়ন কে’টে বলল,
-“অনেক দূরের পথতো বাবা! তাই তোমার ফুপ্পির ফিরতে একটু দেরী হয়ে গেল।”

ভাবুক চেহারা নিয়ে তাকিয়ে রইলো নাহিয়ান। হয়তো এই দূরত্বের সংজ্ঞা, কিংবা সীমা পরিসীমা তার জানারও বাইরে। তাই ছোটো মাথায় ওতো চাপ আর নিল না। ঘাড় নাড়িয়ে শুধু দূরে ছিল, এইটুকু বুঝেছে বলে মাথা নাড়লো। মাইসারা হেসে ফেললো। ড্রয়িংরুমে এসে নাহিয়ানকে রেখে আরমান সাহেবকে জড়িয়ে ধরলো সে। অনেকদিন পর আবারও ছোটো বাচ্চার মতো কাঁদলো। তিনি মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। ভরসা দিয়ে বললেন,

-“কাঁদিসনে মা। তোকে তোর লক্ষ্যে পৌঁছাতেই এভাবে দূরে সরিয়ে দিয়েছি! আজ আমাদের কত আনন্দের দিন জানিস? সেই ছোটো ছোটো পা ফেলে হাঁটতে শেখা তুই, নিজের একটা পরিচয় গড়ে তুলতে পেরেছিস। এখন আর কেউ বলবে না, ‘বাবা-মা ছেড়ে চলে গেছে বলে, এই মেয়ের জীবন এখন অভি’শপ্ত!’ বরং সবাই গর্ব করে বলবে, ‘এই গ্রামে এক নতুন ডাক্তারের আবির্ভাব ঘটেছে! যে কিনা নিজের জন্য নয়, পরের জন্য নিজেকে তৈরী করেছে।’ পারবি না মা, এই গ্রামের অসহায় মানুষগুলোর পাশে থাকতে?”

-“পারবো চাচ্চু। তোমরা পাশে থাকলে আমি সব কঠিন পথ সহজেই অতিক্রম করতে পারবো।”

-“যা, ফ্রেশ হয়ে আয়। জমিয়ে গল্প করবো।”

মাইসারা উঠে দাঁড়ালো। চোখের পানি মুছে রুমে না গিয়ে চুপিচুপি রান্নাঘরে গেল। সেখানে ত্বোয়া আর ফারজানা রান্নাবান্না সামলাচ্ছে। পা টিপে টিপে দরজার কাছে গিয়ে উঁকি মা’রলো। অমনি ত্বোয়ার নজরে পড়ে গেল। চিৎকার দেয়ার আগেই ত্বোয়ার মুখে হাত রেখে তাকে থামতে নিষেধ করলো। জবাবে ঘাড় নাড়লো সে। মাইসারা আবারও ধীরপায়ে ফারজানার পিছনে দাঁড়ালো। দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বলল,

-“খুব মিস করেছি তোমাকে।”

প্রথমে চমকে উঠলেও পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিল ফারজানা। উল্টোহাতে মাইসারার গাল ছুঁয়ে বলল,

-“বুঝতে পারছি তো! মিস তো স্পেশাল কাউকে করেছিস। এখন অজুহাত দেখাতে আমার উপর ঠেলে দিচ্ছিস! তাই না রে ত্বোয়া?”

খিলখিল হাসিতে ভরে উঠলো চারপাশ। মাইসারা ঠোঁট বাঁ’কা’লো। বলল,

-“আমার খেয়েদেয়ে কাজ নেই তো, শুধু একা একজনকে মিস করবো। আমি সবাইকেই মিস করেছি। চাচ্চু, তুমি, ভাইয়া, ত্বোয়া, নাহিয়ান আর…!”

কথার মাঝখানে থেমে গেল মাইসারা। তা দেখে ফারজানা আর ত্বোয়া মুখ টিপে হাসলো। মুখের উপর লজ্জা বাড়িয়ে দিতে বলল,

-“আর…? পরবর্তী জনের নাম মুখে আসছে সোনা? এত লজ্জা নিয়ে চলিস কীভাবে সারা? এটা আধুনিক যুগ। এই যুগে এত লজ্জা?”

-“যাহ্ ভাবী! তুমিও না। আমি মোটেও লজ্জা পাচ্ছি না।”

মুখ নিচু রেখে অযথাই মাথা চুলকাতে লাগলো মাইসারা। ফারজানা আবারও বলল,

-“আমরা তো সবই বুঝি। আমাদের এত অবুঝ ভাবিস না। ঝটপট ফ্রেশ হয়ে আয়, একসাথে খাব। আর শোন, আলমারিতে একটা শাড়ি রাখা আছে, ওটা পরিস।”

সুযোগ পেয়ে দৌড়ে পালালো মাইসারা। বাকি দু’জন আবারও উচ্চস্বরে হেসে ফেললো। লজ্জা হোক কিংবা অনিচ্ছা, কোনো এক কারণে অনিকের নামটা চেয়েও বলতে পারেনি সে। এটা দিব্যি বুঝে নিয়েছে এই দু’জন। থাক না কিছু নাম উহ্য, অপ্রকাশ্য। যারা বুঝার তারা ঠিকই বুঝে নেবে। যেমনটা ত্বোয়া আর ফারজানাও বুঝে নিয়েছে নিমিষেই।

*****

মাঝেমধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু উপহার পেতে বড্ড আনন্দ লাগে। অবিশ্বাস্য মনে হয়, কেমন অদ্ভুত সুখ আর স্বপ্ন মনে হয় সবকিছু। আলমারিতে শাড়ি খুঁজতে গিয়ে নতুন একটা কাতান শাড়ি পেল মাইসারা। রঙটা ভীষণ রকম সুন্দর। খুব একটা ঝকঝকেও না, আবার আঁধারও না। তার নিজের গায়ের সাথে বেশ মানানসই। গোল্ডেন কারুকাজ হলেও মূল শাড়িটা পার্পল কালার। দু’হাতে মেলে তার সৌন্দর্য দেখছিল মাইসারা। অনিক আধশোয়া হয়ে ফোন টিপছিল। অর্ধাঙ্গিনীর ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা মৃদু হাসি চোখ এড়ালো না তার। ওভাবে বসে থেকেই বলল,

-“এটা ভাবী এনেছে। পছন্দ হয়েছে?”

-“ভীষণ সুন্দর! চাওয়ার থেকেও বিরাট কিছু পাওয়া। এই প্রাপ্তি যে অনেক দামী। তোমাকে কী করে বুঝাই বলো তো!”

দু’হাতে যত্ন করে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরলো শাড়িখানা। আনন্দে চোখে বৃষ্টি নামতে চাইছে। চোখের পানিকে বহু কষ্টে দমিয়ে রাখলো মাইসারা। আর সে কাঁদবে না। একজীবন কান্না থাকে অনেক যন্ত্রণা দিয়েছে। তার কাঁদার দিন অনেক আগেই ফুরিয়ে গেছে। যেদিন থেকে অনিক নামক বটবৃক্ষ থাকে প্রখর রোদে ছায়া দিয়েছে, ঝুম বৃষ্টিতে ছাতা হয়েছে, অশান্ত মনকে শান্ত করতে দু’হাত ভরতি ভালোবাসা কুড়িয়ে এনেছে, দু’চোখে তৃপ্তির ঘুম জড়াতে প্রশস্ত বক্ষ মেলে দিয়েছে সেদিনের পর থেকে দুঃখের কান্না তার জীবন থেকে চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়েছে।

শাড়ি, ব্লাইজ, পেটিকোট, প্রয়োজনীয় সেফটিপিন সবকিছু বিছানার উপর রাখলো মাইসারা। অনিকের দিকে তাকিয়ে বলল,

-“কী ভাবছো এত?”

-“তুই আমার কাছে সুখী তো সারা? আমি কি পেরেছি তোর সব দুঃখ দূর করে দিতে? তোর কি মনে হয় না, তুই আরও ভালো কিছু ডিজার্ভ করিস?”

অভিমানী চোখে তাকালো মাইসারা। কখনও সে এমনটা ভাবেওনি। বরং সে নিজে অনিকের যোগ্য কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় তার মনে। ভুল পথে পা ফেলেছিল যে! তার সেই ভুলই তাকে সঠিক মানুষের সংস্পর্শে আসতে অনেক দেরী করিয়ে দিল। দূরে না থেকে কাছে এসে বসলো সে। দু’হাতে গাল ছুঁয়ে অধর ছুঁইয়ে দিল কপালে। নিঃশব্দে বুকে মাথা রাখলো। বলল,

-“ভুল করেও নিজেকে ছোটো ভাববে না। যতক্ষণ তুমি আমার পাশে আছো, ততক্ষণ আমার আর কোনোকিছু চাই না। হয়তো তোমার মনে হচ্ছে, আমি আরও ভালো কিছু ডিজার্ভ করি, কিন্তু যে দামী সম্পদটা আমি পেয়েছি তার কাছে অন্য সবকিছু তুচ্ছ। স্রষ্টার কাছে এইটুকু চাওয়া, তিনি যেন সারাজীবন আমাকে তোমার পাশেই রাখেন। এভাবেই রাখেন। তুমি পাশে থাকলে, কুঁড়ে ঘরও আমার জন্য স্বর্গ হয়ে যাবে। তাই অনুরোধ করবো, এমন কথা আর কখনো বলবে না।”

দামী সম্পদ বলতে এখানে মাইসারা যে তাকে বুঝিয়েছে, উদাহরণ হিসেবে জীবনসঙ্গীকে টে’নে এসেছে, সেটা বুঝতে দেরী হলো না অনিকের। কিছু বলার আগেই দরজায় নক পড়লো। ওপাশ থেকে ত্বোয়া গলা উঁচিয়ে বলল,

-“ছোটো ভাইয়া, তুমি একটু বাইরে যাও। আমি ভাবীকে শাড়ি পরাবো।”

অসময়ে শাড়ি পরতে হবে, এই ব্যাপারটা মানতে পারলো না অনিক। কতদিন পর দু’জনে কাছাকাছি আসার সুযোগ পেল, এখনই যত বাঁধা সব আসতে হলো। অগত্যা বিছানা ছাড়তে হলো তাকে। যাওয়ার আগে মাইসারার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,

-“এই শাড়ি পরলে তোকে একদম নতুন বউয়ের মতো লাগবে। যে রূপ স্বচক্ষে দেখলে নয়ন জুড়ে শুধু মাদ’কতা বিরাজ করবে! তুই কি আবারও আমাকে তোর রূপের মায়ায় চু’বি’য়ে মা’রতে চাস?”

মাইসারা জবাব খুঁজে পেল না। লজ্জায় হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো মিইয়ে গেল। নতজানু হয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই লজ্জায় লাল হওয়া তুলতুলে চিবুকে অধরের উষ্ণ স্পর্শ ছুঁইয়ে ফুড়ুৎ করে উড়ে পালালো অনিক। তারপরই ভেতরে আসলো ত্বোয়া।

*****

শাড়ি পরানোর সময়ই মাইসারার ফোনটা কেঁপে উঠলো। ফোন আসলো না, কিন্তু ওপাশ থেকে ছোট্ট একটা ম্যাসেজ আসলো। আড়চোখে ম্যাসেজের দিকে চোখ বুলালো মাইসারা। ত্বোয়ার সে সময় নজর পড়লো সেখানে। ম্যাসেজ দেখে মিটিমিটি হাসলো সে। তাকে লজ্জায় ফেলতে ইচ্ছে করেই ম্যাসেজটা সাউন্ড নিয়ে উচ্চারণ করলো ত্বোয়া। বলল,

-“শাড়ি পরছিস ভালো কথা, দোহাই; তোর মুখে কোনো রঙচঙ মাখবি না৷ ঠোঁটে লিপস্টিকও দিবি না। শান্তিতে চু’মু খাওয়া যায় না। শুধু চোখে কাজল দিবি, ব্যস।”

ত্বোয়ার বলার ঢং দেখে ঠোঁট চেপে হাসলো মাইসারা। আলতো করে চ’ড় মা’র’লো গালে। বলল,

-“করছিসটা কী? আস্তে পড়। কেউ শুনে ফেলবে!”

-“কী হবে মুখে মেকাপ দিলে, ঠোঁটে লিপস্টিক দিলে? চু’মু খাওয়া ওতো জরুরী কেন? একদিন চু’মু না খেলে কী ক্ষ’তি হয়? বলো না আমায়!”

বুঝেও না বুঝার ভান ধরে মুখ বাঁ’কি’য়ে জানতে চাইলো ত্বোয়া। উদ্দেশ্য মাইসারাকে জ্বা’লা’নো। আজকাল সে তাকে তুমি বলে সম্বোধন করে। আবার ভাবী বলেও ডাকে। এই মুহূর্তটা তাকে আনন্দ দেয়। সুখ দেয়। বুঝিয়ে দেয়, সম্পর্ক উন্নতির দিকে এগিয়ে গেছে। মাইসারার দিক থেকে কোনো জবাব পেল না সে। আবারও বলল,

-“ভাইয়া এখনো তোমার সাথে তুইতোকারি করে? বারণ করতে পারো না?”

-“তোর ভাই আমাকে যেভাবে ডাকে, যে নামে ডাকে সে শব্দেই আমি ভালোবাসা খুঁজে পাই। হোক তা, তুই, তুমি কিংবা আপনি! তার কণ্ঠে সে এই শব্দে যতখানি ভালোবাসা মিশিয়ে রাখে তা অন্য কোনো শব্দে হয়তো আসবে না। আমি চাই, চিরকাল ও এমন থাকুক। এভাবেই ডাকুক, ভালোবাসুক। শুধু সেটা উপলব্ধি করবো আমি।”

থামতে বাধ্য হলো ত্বোয়া। এদের ব’কে বুঝিয়েও লাভ নেই। তারা নিজেরা, নিজেদের যেভাবে বুঝতে আগ্রহী, জানতে আগ্রহী, ভালোবাসতে আগ্রহী, তাদের সম্পর্ক এমনই থাকুক। এভাবেই ভালোবাসার গভীরতা বাড়ুক, তবু দু’জনার মাঝে দূরত্ব না আসুক আর। দিনকেদিন দু’জনে যেভাবে একে-অপরের ভরসা হয়ে উঠেছে, সেভাবে বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিক।

খাওয়ার টেবিলে আজ সবাই একসাথেই রাতের খাবার খেতে বসলেন। পুরো টেবিল খাবার দিয়ে সাজিয়ে রাখা। যে চেয়ারে রোজ আরমান সাহেব বসে খাবার খান, মাইসারা নিজ হাতে ধরে এনে তাঁকে সেখানে বসিয়ে দিল। পাশাপাশি ডানে-বামে বসলো অনিক আর আলিফ। এরপর যার যার সঙ্গীর পাশে মাইসারা, ফারজানা। ত্বোয়া আর নাহিয়ান অপজিটের চেয়ারে। অনেকদিন পর ভদ্রলোক টের পেলেন তার সংসারটা সুখে পরিপূর্ণ। তৃপ্তির সাথে খাবার খেলেন। দুই বউকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

-“যখন আমি থাকবো না, তখনো সবাই এভাবেই সংসারকে আগলে রাখবে। আজ যেভাবে সবাই একসাথে আছো, আগামীকাল এমনকি, জীবনের বাকি দিনও এভাবেই কাটাবে। সময় হয়তো বদলাবে, দায়িত্ব বাড়বে, সংসারে চাপ বাড়বে, হয়তো অভাব-অনটন আসবে কিন্তু তবুও কেউ কাউকে দোষারোপ করে সংসারটাকে ভে’ঙে ফেলার মতো ভুল কাজ করবে না। তোমাদের মধ্য থেকে যদি কেউ অন্যায় করে ফেলো, তবে অপরজন তাকে বুঝাবে, পাশে থাকবে, ভরসা দিবে, সাহস জোগাবে, তবু দোষ ধরিয়ে বলবে না আলাদা হও। এই সমাজে যৌথ পরিবারগুলো দিনদিন কেন ভা’ঙ’ছে জানো? একে-অপরকে দোষারোপ করা, অপমান করা, ছোটো করা, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার জন্য। সবাই নিজের দোষ ঢেকে অন্যের দোষ খুঁচিয়ে বের করতেই ওস্তাদ, কেউ কারও পাশে থাকতে নারাজ, ভালোবাসতে নারাজ। আমি তোমাদের ভরসা করি, বিশ্বাস করি, আমি জানি আমার ছেলেমেয়েরা কখনো এই সংসারে ভা’ঙ’ন ডেকে আনবে না। তোমরা সবাই একে-অপরকে ঘিরে বাঁঁচবে। মনে থাকবে?”

পক্ষান্তরে মাথা নাড়লো সকলে। অনিকও বাবাকে ভরসা দিয়ে বলল,
-“তুমি চিন্তা করো না বাবা, আমাদের আপ্রাণ চেষ্টা থাকবে সংসারটাকে রক্ষা করার। তবে তোমার বউ’মাদের বলে দাও, তারা যদি কখনো অন্যায় করে তবে তার জন্য তাদেরকে শা’স্তি পেতে হবে। তাদেরকে বলে দাও, গুরুজনদের কথা যেন তারা অমান্য না করে।”

-“শা’স্তি দিবে সেটা ঠিক আছে। কিন্তু কখনো তাদেরকে শারিরীক অত্যাচা’র করবে না। মেয়ে মানুষের গায়ে আঘাত দিয়ে শাসন করা ইসলামে নেই। আমি জানি, আমার দুই বউমা-ই বুদ্ধিমতি। তারা কেউ-ই এমন কোনো কাজ করবে না, যার কারণে তাদের শা’স্তি পেতে হয়! তাই যা করবে বুঝে-শুনে করবে। না বুঝে ধড়াম করে হাত তুলবে না।”

আরমান সাহেবের কথা শুনে মুচকি হাসলো মাইসারা। সে বুঝতে পেরেছে অনিক ইচ্ছে করেই খুঁচিয়ে এই কথা বলেছে। বার বার তার দিকে তাকাচ্ছে আর রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে। মাইসারার এমন হাসি দেখে অনিক আবারও ঠোঁট চেপে মৃদুস্বরে বলল,

-“বারণ করেছিলাম না? আজ তোর ঠোঁটটা যদি সে’লাই না করেছি তবে আমার শান্তি নেই দেখিস…!”

-“বেশ করেছি। খুব সাহস হয়েছে না? তোমার লজ্জা করে না, ছোটো বোনের সামনে উল্টাপাল্টা ম্যাসেজ পাঠাও?”

অনিক চোখ বড়ো বড়ো করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। জবাবে ভ্রু নাচিয়ে ভেংচি কাটলো মাইসারা। ঝটপট উঠে দাঁড়িয়ে এঁটো থালাবাসন নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলো। রান্নাঘরের সমস্ত কাজ শেষে ত্বোয়া নিজের ফোন নিয়ে পারিবারিক কয়েকটা ছবি তুললো। মাইসারা আর ফারজানার পরনের শাড়ি একই রঙ, একই ডিজাইনের ছিল। দু’জনকে একসাথে বেশ মানিয়েছেও। মনে হচ্ছিলো অনেকদিন পর দুই বোন একসাথে। একে-অপরকে যেভাবে জড়িয়ে ধরে ছবি তুলছে, তাতে মনেই হবে না কখনো দু’জনার মাঝে ঝগ’ড়াঝাটি হয়েছিল। পুরনো অধ্যায় তারা ভুলে গেছে, এখন শুধু নতুন অধ্যায় গড়ে তোলার স্বপ্ন দু’জনের মনে। চিরকাল এই বন্ধন যেন এমনই থাকে, ঠিক এই প্রার্থনাই এখন সকলের অন্তরে।

*****

দিনের আলো যেমন ঝকঝকে আয়নার মতো স্বচ্ছ, পরিচ্ছন্ন, রাতের অন্ধকারটাও তেমন ঝাপসা! তবুও দিনের সৌন্দর্য আর রাতের সৌন্দর্য বরাবরই আলাদা। একফালি চাঁদের আলো আর ঝিকিমিকি হাজারও তারকারাজি যেভাবে দূর আকাশের সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলে, সেভাবে দিনও সূর্যের আলোতে নিজেকে উজ্জ্বল সাজে সাজায়। দুটো সময়ই দুইভাবে আকৃষ্ট করে মানুষকে। বুঝিয়ে দেয়, কতই না নিপুণ হাতে তৈরী স্রষ্টার এই দারুণ সৃষ্টি। এমন সৌন্দর্য, এমন চোখ ধাঁধানো, মন মাতানো রূপ কি কোনো মানুষের দ্বারা তৈরী করা সম্ভব? মহান রবের এই অসাধারণ ক্ষমতাকে উপলব্ধি করার মাঝেও মানব হৃদয়ে তৃপ্তির বাতাস বইয়ে দিতে বাধ্য। কী হতো, যদি তিনি ভূ-খণ্ড সৃষ্টি না করতেন? কী হতো যদি তিনি মানুষ জাতিকে সৃষ্টি না করতেন? কী হতো যদি তিনি মানব হৃদয়ে ভালোবাসা নামক ছোট্ট অনুভূতি না জাগাতেন? মানুষ কি আদৌ তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে সবকিছু করতে পারতো? এত এত প্রশ্ন, এত এত কৌতূহল, মানুষের মনে জাগে দেখেই সৃষ্টির এই মর্ম মানুষ উপলব্ধি করতে পারে।

অনেকক্ষণ ধরে অন্ধকার রাতের নীরবতাকে একা একাই উপভোগ করছে অনিক। ভাবছে জীবনের খণ্ডাংশ। উপলদ্ধি করছে, স্রষ্টার সৃষ্টিকে। অন্তরের অন্তস্তল থেকে শুকরিয়া জানাচ্ছে প্রভুর দরবারে। তিনি চেয়েছেন বলেই, এই ধরনী দেখার সুযোগ হয়েছে মানুষের। তিনি চেয়েছেন বলেই, ভালোবাসা এসে ধরা দিয়েছে জীবনে। পরিপূর্ণ হয়েছে জীবন। বেঁচে থাকার জন্য এইটুকুই কি যথেষ্ট নয়? একটা সুন্দর জীবন তো এভাবেই হেসেখেলে কাটিয়ে দেয়া যায়, যদি ওপাশের মানুষটা সার্বক্ষণিক সঙ্গী হয়ে পাশাপাশি থাকে, হাতে হাত রাখে।

বেশ কিছুক্ষণ পর মাইসারার আগমন ঘটলো ছাদে। দূর থেকেই ভাবুকে চেহারায় নিজের অর্ধাঙ্গকে আবিষ্কার করে সামনে এগিয়ে গেল। সামনে যেতেই অভিমানে চোখ সরিয়ে নিল অনিক। পকেট থেকে ফোন বের করে ত্বোয়ার নাম্বারে ডায়াল করলো। মাইসারা শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার কাণ্ডকারখানা দেখে ঠোঁট টিপে হাসলো।

-“ছাদের সবক’টা বাতি নিভিয়ে দে।”

অনিকের এমন কথা শুনে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো মাইসারা। ভ্রু নাচালো। জবাব না দিয়ে ফোন পকেটে রেখে রেলিঙের উপর হাত রেখে দূরে দৃষ্টি দিল। ঠিক তার পাঁচ মিনিটের মাথায় ছাদের সবগুলো বাতি নিভে গেল। এমনকি বাড়ির সামনের, পিছনের বাতিও নিভলো। মুহূর্তেই চারপাশটা কেমন গা ছমছমে রহস্যময় এক দৃশ্যে রূপান্তরিত হলো। ভয়ে খানিকটা কেঁপে উঠলো মাইসারা। দু’পা এগিয়ে ফটাফট পিছন থেকে অনিককে জড়িয়ে ধরলো। পিঠে মাথা রেখে বলল,

-“মাঝেমধ্যে কী ইচ্ছে হয় জানো, এভাবে মিশে থাকি তোমার সাথে। উপলব্ধি করি, তোমার রাগ, অভিমান আর ভালোবাসাকে। এইযে, রাগ দেখিয়ে চেহারা দেখবে না বলে বাতি নিভিয়ে দিতে বললে, এতেও কিন্তু তোমার রাগের বদলে ভালোবাসাটাই বেশি প্রকাশ পাচ্ছে!”

গম্ভীর চেহারা নিয়ে নীবরতা দিয়ে পুরোটাই নিজেকে আগলে নিল অনিক। আসলেই সে রেগে গেছে। মাইসারার তখনকার কাণ্ড যে ইচ্ছাকৃত সেটা বুঝেই রাগ এসে ভর করেছে চেহারায়। কিন্তু এখানেও মেয়েটা ভালোবাসা খুঁজে বেড়াচ্ছে। অনিকের নীরবতা দেখে মাইসারা আবারও বলল,

-“তুমি চাও না, তোমার আর আমার এই রাত্রিযাপন কারও চোখে পড়ুক। আশেপাশে অনেক বাড়ি আছে, হুটহাট কারও নজর পড়বে আমাদের এই ছাদে। তখন সবাই হয়তো খারাপ কিছু ভাববে।”

মৃদু এক হাসির রেখে খেলে গেল অনিকের পুরো চেহারা জুড়ে। এমনটা ভেবেই বাতি নেভাতে বলেছিল সে। ওভাবে দাঁড়িয়ে থেকেই বলল,

-“তুই অনেক বেয়াদব সারা!”

-“আদব-কায়দা শিখিয়ে নাও। মানুষটা তো তোমারই। নিজের মতো করে গড়ে নিচ্ছো না কেন?”

-“কথা শুনছিস কই তুই? স্বামীর কথা অমান্য করিস! তোকে তো শা’স্তি দেয়া উচিত।”

-“দাও। তোমার আদুরে শা’স্তি গ্রহণ করতে আমি সবসময়ই প্রস্তুত।”

সম্পর্কে শত অভিমান আসুক, এমন টুকরো টুকরো সুখকর কথাতেই অভিমান গায়েব হয়ে যায়। তখন মনে হয়, শা’স্তিটা কেবল ভালোবেসেই হোক। পিছু ঘুরে মুখোমুখি হলো অনিক। মাইসারার মাথা ঠেকলো তার বুকের ঠিক বা’পাশে। ডানহাতের আলতো স্পর্শে খানিকটা উঁচু করে মায়াবী মুখের চাহনি দেখলো সে। জ্যোৎস্নার ঝলমলে আলো না থাকলেও রাত্রি তখনো গাঢ় অন্ধকার নয়। চোখাচোখিটা নিঃশব্দেই হলো। ওভাবে তাকিয়ে থেকেই কপালে অধর ছুঁইয়ে দিল সে। বলল,

-“সব ভুলের শা’স্তি এমনই হবে। সারাজীবন কাছে থাকবি, ভালোবাসবি। সম্পর্কে যতই রাগ আসুক, ঝগড়া আসুক, মান-অভিমান আর দূরত্ব আসুক, সবকিছুকে দূরে ঠে’লে ভালোবাসা দিয়ে বুঝিয়ে দিবি, এই সম্পর্ক টুকরো অভিমানকে সঙ্গী করে ভা’ঙ’নকে কখনোই ছুঁয়ে দেখতে চায় না। যা-ই হয়ে যাক, দিনশেষে আমরা আমাদের মাঝেই সুখকে খুঁজে নিব। ভালোবাসবো। রাজি…?”

-“যখন থেকে জেনেছি, অপ্রকাশ্য এক সুপ্ত অনুভূতিকে সঙ্গী করে দিন অতিবাহিত করছো, তখন থেকেই মনে-প্রাণে চেয়েছি, এই সম্পর্ক জোড়া লাগুক। বুঝিনি, তাইতো অসময়ে অবুঝের মতো কাজ করেছি, ভুলকে সঙ্গী করে দিন কাটিয়েছি, সবকিছু ভুলে নতুন জীবনকে আঁকড়ে ধরেছি, শুধু তোমায় ভরসা করে! আমি কখনোই চাইবো না, অভিমানের কাছে আমাদের স্বচ্ছ অনুভূতিটুকু হার মেনে যাক। আমি বিশ্বাস করি তোমায়, ভরসা করি, ভালোবাসি! সারাজীবন তোমায় ভালোবেসেই বাঁচতে চাই।”

জীবনে মানুষ একটু সুখকেই তো ছুঁয়ে দেখতে চায়। সেই সুখ দু’হাতের মুঠোয় ধরা দিতে কখনো কখনো অনেক সময় নেয়, আবার কখনো কখনো না চাইতেও আপনা হতেই চলে আসে জীবনে। মাইসারার মনে হলো, তার জীবনের খাঁচায়ও সুখপাখি ধরা দিয়েছে। সেই সুখকে আঁকড়েই বাঁচার পথ খুঁজে নিতে হবে।

অর্ধাঙ্গিনীর এমন আবেগপ্রবণ জবাব শুনে নিরুত্তর অনিক কোনো কথা খুঁজে পেল না। সুখের অদ্ভুত মা’দ’ক’তা ছুঁয়ে দিল তার মন-প্রাণকে। শীতল স্পর্শে হৃদয়টা ভরিয়ে দিল। প্রশান্তি অনুভব করলো। সময় কে’টে গেল। মিনিট পেরুলো, রাত্রি ক্রমশ আঁধারে তলিয়ে যেতে শুরু করলো, তবু দু’জনার অনুভূতির লেনদেন থামলো না। ভালোবাসার এই সময়টা আরও ভালোবাসাময় হয়ে উঠলো! চোখে চোখে মনের অব্যক্ত কতশত কথা ডালপালা মেললো। তবু কেউ দূরত্বকে, কিংবা কথাদেরকে কাছে ঘেঁষতে দিল না। নিঃশব্দের এই সময়টা আরও নিস্তব্ধতা দিয়ে সীমাহীন অনুভূতি নিয়ে মুড়িয়ে নিল একে-অন্যেকে। আদুরে স্পর্শের কাছে রাত্রির গভীরতাও জানলো, ভালোবাসা আছে, থাকবে, অনন্তকাল। অনুভূতির লেনাদেনা এভাবেই চলছে, চলবে। তারা ভালোবেসেছে, ভালোবাসবে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ। তবু কমতি আসতে দিবে না ভালোবাসা প্রকাশে! এক জীবন তারা শুধু ভালোবেসেই বাঁচবে।

*****

সমাপ্ত…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে