মনোহারিণী পর্ব-১৫+১৬

0
1173

❝মনোহারিণী❞
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
পর্ব : (১৫)+(১৬)

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ!)

উঁচু ভবনের একদম নিচে দাঁড়িয়ে ডান থেকে বায়ে, আবার বাম থেকে ডানে এভাবে পালাক্রমে হাঁটছে অনিক। কখনো ফোনের স্ক্রিনে চোখ বুলিয়ে ফেইসবুকের নিউজফিড স্ক্রল করছে আবার কখনো চোখ ঘুরিয়ে রাস্তা দেখছে। ফাঁকে ফাঁকে ঘড়িতেও চোখ বুলাচ্ছে। এখান থেকে মাইসারার হোস্টেল খুব বেশি দূরে নয়, এতক্ষণে চলে আসার কথা। অবশ্য অপেক্ষা করতে মন্দ লাগছে না তার। এভাবে প্রিয়জনদের জন্য অপেক্ষা করাটাও সুখের, আনন্দের। এজন্যই ইচ্ছে করেই আনতে যায়নি। তাছাড়া ওই মুহূর্তে হোস্টেলে বাড়তি কাউকে এলাও করতো কিনা ঠিক নেই। হয়তো চো’র-ডাকাত ভেবে পাগ’লা কু’কু’রের মতো তাড়া করতো। অযথা সন্দেহের পাত্র হওয়ার চেয়ে অপেক্ষা করাই শ্রেয়!

রিকশার ভাড়া মিটিয়ে রেস্টুরেন্টের সামনে আসলো মাইসারা! অনিকের কাছাকাছি দাঁড়াতেই সবক’টা দাঁত বের করে প্রাপ্তির হাসি ফুটালো সে। মনে হলো বিশ্ব জয় করে ফেলেছে আজ। মাইসারা ভ্রু নাচালো। বলল,

-“তুমি এমন কেন? পাগ’লাটে স্বভাবের। আগে তো এমন ছিলে না। মাথায় কী ঢুকেছে! আর এখানে কেন রুম বুকিং করেছো? জানো, চব্বিশ ঘণ্টার ভাড়া কত আসবে? সিলেটে আর রেস্টুরেন্ট নেই?”

একসাথে এতগুলো কথা শুনে কোনোটারই জবাব দিল না অনিক। মাইসারার হাত ধরে চুপচাপ লিফটের কাছে চলে গেল। লিফটে উঠেও কোনো কথা বললো না। একদম রিসেপশনের কাছে এসে ম্যানেজারকে কিছু বললো। ভদ্রলোক মুচকি হেসে ক্যামেরা বের করে ঝটপট একটা কাপল ছবি তুললেন। মাইসারার দিকে তাকিয়ে বলল,

-“মে য়্যুওর ম্যারেড লাইফ বি হ্যাপি ম্যাম!”

মাইসারা উত্তরে লাজুক হাসলো। অনিক আবারও ম্যানেজারকে প্রয়োজনীয় কথা বলে লিফটের কাছে আসলো। মাইসারা তখন বলল,

-“ছবি তুললো কেন?”

-“এদের কাজই এমন। নিউ কাপলদের ছবি তুলে রাখা।”

প্রতুত্তরে আর কোনো জবাব খুঁজে পেল না মাইসারা। মুখ নিচু রেখেই অনিকের হাত ধরে রুমের ভেতর আসলো। রুমে প্রবেশ করেই দ্বিতীয় চমকটা খেল। ভেতরটা এত সুন্দর করে সাজানো যে, হুট করে যে কারও মনে হবে এটা স্বপ্নপুরীর চেয়েও কম যায় না। পুরো রুমে চোখ ঘুরিয়ে মারাত্মক শক খেল সে। প্রতিটা কোণায় রঙবেরঙের মোমবাতি জ্বালানো। শুধু মোমবাতির আলোতেই ঘরটা আলোকিত হয়ে আছে। বাড়তি কোনো বিদ্যুতের প্রয়োজন হচ্ছে না। এসি’র হিমশীতল স্পর্শ অনুভব হচ্ছে শরীরে। ক্ষণে ক্ষণে চোখ ঘুরছে ধবধবে সাদা বিছানার উপর। মাঝখানে লাভ শেপের গোলাপ ফুল। তার সামনের দিকে দুটো হাঁস! মনে হচ্ছে একটা আরেকটার দিকে দৃষ্টি দিয়েই একে-অন্যের অনুভূতিকে উপলব্ধি করছে। হোটেল কর্তৃপক্ষ বেশ যত্ন নিয়েই এটা সাজিয়েছে। মাইসারার মনে হলো, এইটুকুতেই অনিকের পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি টাকা খরচ হবে আজ! আলমারি থেকে কিছু বের করলো অনিক। ঝটপট সেটা মাইসারার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

-“এটা পরে আয়!”

-“কী?”

প্যাকেটটা হাতে নিয়ে সন্দিহান চোখে প্রশ্ন করলো মাইসারা। অনিক তাকে সোজা ওয়াশরুমে ঠেলে হাতে একগাদা সেফটিপিন দিয়ে বলল,

-“শাড়ি!”

-“এখন এটা পরবো?”

খানিকটা বিরক্তি আর লজ্জায় রাঙা হয়ে সংকোচ নিয়ে প্রশ্ন করলো মাইসারা। অনিক তা দেখে মুচকি হাসলো। দুষ্টামি করে বলল,

-“শাড়ি পরতে লজ্জা পাচ্ছিস? তোকে কষ্ট করতে হবে না। চোখ বন্ধ করে দাঁড়া, আমিই পরিয়ে দিই। শখ করে বউয়ের জন্য প্রথম কোনো উপহার নিয়ে আসলাম। তাতে তাকে কেমন লাগে দেখবো না? দু’চোখে প্রচুর তৃষ্ণা নিয়ে এসেছি সারা! প্লিজ…!

আর কথা বাড়ালে নির্ঘাত এই ছেলে তাকে আরও লজ্জায় ফেলবে। কোনোমতে শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো সে। ততক্ষণে ওয়েটার খাবারটা রুমেই নিয়ে এসেছে। অনিক ছোট্ট টেবিলটায় খাবারগুলো সাজিয়ে নিল ঝটপট। সে জানে মেয়েদের শাড়ি পরা কতটা ঝা’মে’লার কাজ। আর একা পরা তো ভীষণ কষ্টের। তবুও এই কষ্টের মাঝেই ফেললো মাইসারাকে। ভেতরটা যেমন অস্থির হয়ে আছে, সেই অস্থিরতা থামানোর ঔষধ তো তার অর্ধাঙ্গিনীই। তাই তাকে মনমতো সাজিয়েই দু’চোখের তৃষ্ণা আর মনের অস্থিরতা দূর করার কৌশল বেছে নিতে হয়েছে তাকে।

*****

মেয়েদের কাছে সাজগোছ খুব একটা বিরক্তির নয়। বরং সাজতেই তারা পছন্দ করে বেশি। হুটহাট নানান সাজে সেজে প্রিয়জনকে চমকে দেয়াই তাদের কাজ। ওভাবে নিয়ম করে কারও জন্য সাজতে পারেনি মাইসারা। পড়াশোনার চাপ থাকায় প্রেম ভালোবাসার সম্পর্ককে খুব একটা পাত্তা দিতে পারেনি। নিয়ম করে ডেটে যাওয়া হয়নি, পাশাপাশি হাঁটা হয়নি, ভালোবেসে চোখ চোখ রাখাও হয়নি। সানভির সাথে তার সম্পর্ক যান্ত্রিকই ছিল বটে। পড়াশোনার ফাঁকে দু’চার মিনিট ফোনে কথা বলা, সময় সুযোগ পেলে ক্যানটিনে দেখা করা, ব্যস। এইটুকুই। অথচ আজকের সময়টা পুরোপুরি ভিন্ন তার কাছে। একদম আলাদা। ভালো লাগার, ভালোবাসারও।

একা-একাই শাড়িটা সামলে নিল মাইসারা। হাতের কূর্তি, উড়না রেখে দিল হ্যাঙ্গারে! রুমে এসে প্রথমে বাতি জ্বাললো। কেমন অগোছালো, এলোমেলো লাগছে নিজেকে। সবদিক পারফেক্ট হলো কিনা সেটা দেখতেই আয়নার সামনে দাঁড়ালো। ট্রায়াল দেয়ার মতো এদিক-সেদিক দেখছিল সে। কোথাও ত্রুটি দেখলেই সামলে নিচ্ছিলো তা। দূর থেকে অনিক এই মুহূর্তটা দু’চোখে তৃপ্তি নিয়ে কিছুক্ষণ দেখলো। ধীরপায়েই এগিয়ে আসলো সামনে। মাইসারার হাত ধরে নিজের দিকে ঘুরালো। বলল,

-“হয়েছে, আর ঠিক করতে হবে না। একটা শাড়ি পরতে যে মেয়েদের এতক্ষণ লাগে তা জানা ছিল না আমার।”

লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেললো মাইসারা। চোখ তুলে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না সে। আজ এত লাজলজ্জা ভর করলো কেন, কে জানে! তবুও লজ্জা সরিয়ে বলল,

-“এতকিছুর প্রয়োজন ছিল না। শুধু শুধু টাকা নষ্ট। এই টাকাগুলো থাকলে তো অন্য যেকোনো কাজে আসতো।”

-“আমার টাকা আমি যেদিকে খুশি খরচ করবো তাতে তোর সমস্যা কী!”

-“এটা বাড়তি খরচ হয়ে গেল না?”

-“চুপ থাক। পাকা গিন্নীর মতো কথা বলিস না। আমাকে এই মুহূর্তটা উপলব্ধি করতে দে।”

কথার তাল হারিয়ে ফেললো মাইসারা। অনিক শুধু কাছেই আসেনি, দু’হাতের আঁজলায় অর্ধাঙ্গিনীর নিষ্পলক চাহনিতে মুগ্ধতা খুঁজে নিচ্ছে সে। মনে হচ্ছে, দীর্ঘ সময় অতিক্রম করে কাঙ্ক্ষিত মানুষের সম্মুখীন হয়েছে। এই মুহূর্তটা এতটাই দামী যে, অন্য কোনোকিছু মাথাতেই আসছে না তার। নিশ্চুপে চোখের মায়ায় হারিয়ে যেতে চাইলো সে। শুধু কোনো বাধা-বিপত্তিকে আলিঙ্গন করতে চাইলো না। মৃদুস্বরে উচ্চারণ করলো,

-“আজ যদি কোনো ভুল করে ফেলি, দূরে ঠেলে দিবি?”

পুরো চোখমুখে আবারও লজ্জার আভা ফুটে উঠলো তার। চোখ নামিয়ে নিচের দিকে দৃষ্টি দিল মাইসারা। তা দেখে অনিক বলল,

-“আমায় বিশ্বাস করিস না?”

-“করি!”

-“তবে? ভয় কীসের?”

-“হারানোর। যখন মা’কে কাছে পেয়েছি তখনই মা হারিয়ে গেল। যদি তুমিও…!”

চোখ তুলে চমকে গেল মাইসারা। অনিক ততক্ষণে দূরে সরে গেছে। চুপচাপ প্লেটে খাবার সাজাচ্ছে সে। কোথাও তার এই কথায় মনে আঘাত পেল না তো? সে তো কষ্ট দিতে বলেনি। ভয়ে আপনা হতেই বেরিয়ে এসেছে। তখনো ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো সে। এই ছেলেটার এমন এমন অদ্ভুত কাণ্ড কখন যে তাকে প্রাণে মে’রে ফেলে কে জানে! কখনো হাসে, আবার কখনো চুপচাপ থাকে। যেন হঠাৎ করেই রোদের ভেতর মেঘের লুকোচুরি চলে। খাবার প্লেটে তুলে পানিও গ্লাসে ঢাললো অনিক। বলল,

-“পেটে নিশ্চয়ই ক্ষিধে আছে! রাত হচ্ছে খেয়ে নিই আগে। এখন আর নিচে যেতে ইচ্ছে করছে না।”

বুঝতে দেরী হলো না যে, এই সামান্য কথাও তী’রের ধারা’লো ফ’লার মতো সুক্ষ্ণ আঘাত গেঁথে দিয়েছে বুকে। রক্তক্ষরণ ঠেকাতেই কথার ভাবভঙ্গিতে ভেতর ঢাকছে সে। পাশাপাশি না বসে চুপচাপ অনিকের উরুর উপর বসে পড়লো মাইসারা। দু’হাতে মুখটা তুলে সরাসরি দৃষ্টি ফেলার চেষ্টা করলো। অনিক সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে নিল। রাগ ভা’ঙা’তে মাইসারা কথার যুক্তি সাজিয়ে বলল,

-“এই সম্পর্কটা বিশ্বাসের! আমি বিশ্বাস ভা’ঙার কথা বলিনি। বলেছি হারানোর ভয়। মৃ’ত্যুর কাছে সব প্রাণীই অসহায়। তুমি, আমি, আমরা সবাই।”

অনিক জবাব দিল না। মাইসারা আবারও বলল,

-“বিশ্বাস কখনো প্রিয়জনকে দূরে ঠে’লে দিতে জানে না। কাছে টেনে নেয়। আমিও এই সম্পর্কের প্রিয় মুহূর্তটাকে সাদরে গ্রহণ করতে চাই। বাঁচতে চাই তোমার সাথে। একই ছাদের নিচে গোটা জীবন পার করে দিতে চাই। আমাদের গল্পটা হাসির হোক কিংবা দুঃখের। কান্নাহাসির প্রতিক্ষণ, প্রতিমুহূর্তে আমি তোমাকে কাছে চাই৷ পাশে চাই। মৃ’ত্যুর দ্বারে পৌঁছে গিয়েও দু’চোখে তৃপ্তি নিয়ে দেখতে চাই, তুমি কাছে আছো, পাশে আছো, আমার আছো, সবসময়।”

বহুদিন পর, ঠিক কতদিন পর হৃদয়ে প্রশান্তি অনুভব করলো সে, সেই হিসাবটা করার সময়, সুযোগ কিছুই হলো না অনিকের। দৃষ্টি ফিরিয়ে চোখে চোখ রাখতে গিয়েই থমকে গেল সে। অর্ধাঙ্গিনী সুপ্ত অনুভূতির জবাবে এতটাই প্রখরতা ছিল যে, অস্থির, অশান্ত, শূন্য মনের ঘর পরিপূর্ণ হয়ে গেল মুহূর্তে। মনের আকাশে এক টুকরো সুখের প্রজাপতি উড়ে বেড়ালো নিঃসন্দেহে। জবাবটা আর দিতে পারলো না অনিক, ততক্ষণে তার অধরোষ্ঠ সাক্ষী হলো অর্ধাঙ্গিনীর কঠিন ভালোবাসার আলিঙ্গনকে গ্রহণ করে।

*****

খোলা আকাশের নিচে এসে যে কেউ চঞ্চলতাকে খুঁজে নেয় মুহূর্তেই। হোক তা বৃষ্টি বাদলের ক্ষণ কিংবা রৌদ্রজ্বল বিকেল। অথবা কোনো বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যা নয়তো কোনো ঝলমলে, নির্মল, সতেজ সকাল। আকাশের বুকে মিশে গিয়ে নিজেকে খুঁজে নেওয়ার সুখটাই অন্যরকম। আজকের এই বিকেলটাও তেমনি সুখকে ছুঁয়ে দিতে এসেছে। সকাল থেকে বিকেল পুরোদিন হসপিটালের দৈনন্দিন কাজ সামলে বিকেলেই দু’জনে ঘুরতে বেরিয়েছে। মাঝেমধ্যে যান্ত্রিক শহরের কোলাহল থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারলে মন্দ হয় না। জীবনের কিছু সুখকে উপলব্ধি করতে এভাবে শত ব্যস্ততায়ও প্রিয়জনের জন্য একটুখানি সময় তো বের করে নিতেই হয়। এতে সম্পর্কে আস্থা আসবে, মনমালিন্য দূর হবে, ভালোবাসা আর বিশ্বাস গাঢ় হবে!

তখন সুরমা নদীর বুকে অসংখ্য ছোটো বড়ো নৌকার ছোটাছুটি চলছে। ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে সেই নদীর কিনার ঘেঁষে ছুটে চলা কিছু সাধারণ মানুষের জীবনের খণ্ডচিত্র উপভোগ করছে মাইসারা। সুন্দর, দৃষ্টিনন্দন কিছু নজরে পড়লেই ঝটপট মোবাইলে ক্লিক করে ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। অনিকের মনে হলো, এবার অন্তত বাড়ির ঝামেলার কথা মাইসারাকে জানানো উচিত। মেয়েটা এখনো জানে না, একটা সাজানো গোছানো সংসার ভে’ঙে যেতে যাচ্ছে। কীভাবে তা জোড়া লাগাবে তা নিয়েই ভীষণ দুঃশ্চিন্তা আর দোটানায় ভুগছে অনিক। মাঝেমধ্যে কিছু সিদ্ধান্ত, পরামর্শের ভার অপরপক্ষের উপর ছেড়ে দেয়া উচিত। এতে করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া যায় এবং উপযুক্ত পরামর্শও খুঁজে পাওয়া যায়।

এমন সময় নদীর বুকে একঝাঁক বাচ্চাদের সাঁতার প্রতিযোগিতা চলছে। মূলত এটা তাদের নিত্যদিনের দৃশ্য। গোসলের সময় একছুট দৌড় তারা দিবেই। বাচ্চাদের এই দুষ্টুমিষ্টি মুহূর্তটা ফ্রেমে আটকে নিল মাইসারা। অনিকের দিকে তাকিয়ে বলল,

-“ওরা ভয় পাচ্ছে না? এত বড়ো নদী! যদি ডুবে যায়?”

-“সাঁতার না জানলে আসতো না নিশ্চয়ই! এদের দৌড় দেখেই বুঝা যাচ্ছে পাকা সাঁতারুর দলে নাম লেখাবে।”

ততক্ষণে ব্রিজের ওপর কনুই ঠেকিয়ে মাইসারার এই পাগ’লামি দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো অনিক। ছবি তোলা শেষে মোবাইলটা ভ্যানিটি ব্যাগে রেখে দিল সে। অনিকের দিকে গভীর দৃষ্টি দিয়ে তাকালো। তার নীরব চাহনি দেখে মনে হলো, ভেতরে ভেতরে কথা গোছাচ্ছে সে। জরুরী কিছু বলবে নিশ্চয়ই। প্রিপারেশন নিয়েই পাশাপাশি দাঁড়ালো মাইসারা। হাতের বাহু শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো। কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে বলল,

-“ঝটপট বলে পেল, কী সমস্যা!”

ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো অনিক। মেয়েটা তাকে বুঝতে পারে, এইটুকুই যেন এই মুহূর্তে অনেক দামী কিছু। জীবনে মানুষ এসবই চায়। প্রকৃত একটা মানুষ, যে মানুষ তাকে বুঝে, আগলে রাখে। প্রিয় মানুষটা মনের কথা মুখ ফুটে বলার আগে বুঝে নিতে জানে। ভাবনা থামিয়ে বলল,

-“বিশাল এক সমস্যা হয়েছে সারা, তার কোনো সমাধান খুঁজে পাচ্ছি না।”

-“কী হয়েছে? বাড়িতে কোনো ঝামেলা?”

-“ভাইয়া ভাবীর মধ্যে ঝামেলা চলছে। সেপারেশনে যেতে চাইছে তারা। কিন্তু তাদের এই ভা’ঙ’ন নাহিয়ানের জীবনটাকে নষ্ট করে দিবে।”

অবিশ্বাস্য ঠেকলো সব কথা! মনে হলো এসব সে ভুল শুনছে। কত করে বুঝিয়ে এসেছিল আলিফকে, তবুও তার কোনো কথাকে কানে তুললো না সে। এমন সুন্দর সংসারে এখন ভা’ঙনকে জরুরী করে দিল। অনেকক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো মাইসারা। ঠিকঠাক কোনো জবাব খুঁজে পেল না। অনিকের কণ্ঠস্বর বলছে, চেষ্টার কোনো কমতি রাখেনি সে। অথচ আলিফ গুরুত্ব দেয়নি। সব শুনে, বুঝে নীরবে আবারও কিছুক্ষণ ভাবলো মাইসারা। ভরসা দিয়ে বলল,

-“তুমি চিন্তা করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

-“কীভাবে? ভাইয়া কারও কথা শুনতে চাইছে না। তার একটাই সিদ্ধান্ত, আলাদা হয়ে যাওয়া। হ্যাঁ প্রিয়জনের বদলে যাওয়া কষ্ট দেয়, তাই বলে তাকে কোনো সুযোগ দিবে না? এভাবে একতরফা বিচার হয় কী করে! ভুল তো মানুষই করে। ক্ষমাও মানুষ চায়। তাকে তো সুযোগ দিতে হবে। তা না করে উল্টোপাল্টা সিদ্ধান্ত নিলে তো হবে না।”

-“আমি ভাবীর সাথে কথা বলবো। তাকে বুঝাবো।”

-“পারবি?”

-“চেষ্টা করে দেখি। এভাবে তো ভে’ঙে যেতে দিতে পারি না। ঝামেলাটা যেহেতু আমাকে নিয়ে তৈরী, সমাধানও আমি দিব। অযথা দুঃশ্চিন্তা করো না। ভাইয়াকে বুঝাও। ভা’ঙ’নে কী ক্ষ’তি হয়, তা তো নিজেকে দিয়ে বুঝেছি! চোখের সামনে আরেকটা সন্তান বাবা-মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত হবে, সেটা তো দেখতে পারবো না। কিছু একটা ভাবতে হবে। দ্রুত এর সমাধান খুঁজতে হবে। শুধু আমার উপর ভরসাটুকু রাখো।”

বহু সাধনার পর মানুষ মনের মতো যোগ্য সঙ্গী পায়। এই মুহূর্তে অনিকের ঠিক এই উপলব্ধিটাই হলো। এই মেয়ে প্রতি মুহূর্তে তাকে মায়ায় ফেলেছে, ভালোবাসতে বাধ্য করেছে, বাকি জীবন এই নারী ছাড়া সে রীতিমতো অসহায়, দিশেহারা পথিক হয়ে যাবে। চলার পথ শূণ্য হয়ে যাবে এই মনোহারিণী ছাড়া। যে তার মন বুঝে, তাকে বুঝে, সেই মানুষটাকে ভরসা না করে পারা যায় না। ঠোঁটে নির্ভরতার হাসি ফুটালো অনিক। মাথা নেড়ে অর্ধাঙ্গিনীর হাতটা শক্ত করে ধরলো। মৃদুস্বরে বলল,

-“আই অলওয়েজ ট্রাস্ট য়্যু, সারা। আই উইল ডু ইট ফোর দ্য রেস্ট অফ মাই লাইফ!”

*****

চলবে…

❝মনোহারিণী❞
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
পর্ব : (১৬)

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ!)

হুট করে কোনোকিছু পাওয়া, আবার তা হুট করেই হারিয়ে ফেলার সময়টুকু যে কতখানি ব্যথার সৃষ্টি করে মনে, তা কেবল এই মুহূর্তে মাইসারাই উপলব্ধি করতে পারছে। সে তো বলেনি, অনিককে এখানে আসার জন্য! জো’রও করেনি। নিজের ইচ্ছায় এসেছিল, এখন কাজের তাড়া পড়েছে তাই চলে যেতে হচ্ছে। যেভাবে দু’হাত ভরতি ভালোবাসার রঙ নিয়ে মনের রুদ্ধদ্বারে কড়া নেড়ে এসেছিল আবারও সেই দ্বারকে অপেক্ষার প্রহরে ফেলে চলে যাচ্ছে। এই দুটোদিন যতখানি সুখের ছিল, এই মুহূর্তটা তারচেয়েও দ্বিগুণ দুঃখের। পোষমানা বিড়ালছানার মতো গুটিসুটি মে’রে প্রিয়জনের বক্ষস্থলে লুকিয়ে রইলো সে। চোখের জল বাঁধ মানছে না আর। ক্ষণে ক্ষণে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। খটখটে শুকনো বুকের মধ্যে হুটহাট বৃষ্টির আনাগোনা টের পাচ্ছে অনিক, তবুও কোনো কথা বলছে না। অর্ধাঙ্গিনীকে যত্ন করে আগলে রেখেছে! ঝরে পড়া অশ্রু মুছে দিতে খানিক পর পর অধর ছুঁইয়ে দিচ্ছে পুরো মুখমণ্ডলে। তবুও কান্নার রেশটা তার থামছে না।

-“কান্না থামা প্লিজ, ভালো লাগছে না। একটু ভালোমতো বিদায় দে৷ এভাবে একেবারে ইমোশনাল হয়ে যাবি জানলে আমি এখানে আসতাম না। এটাই শেষ, আর আসবো না দেখে নিস।”

মায়াবতীর নীরবতার চেয়ে বিরহের কান্নাটাই অন্তরে বিঁ’ধছে অনিকের। কেন যে সে এখানে আসতে গেল! মেয়েটা এমন আবেগী হয়ে যাবে জানলে পা রাখতো না নিশ্চয়ই। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল অনিক, যতদিন না মাইসারার সার্টিফিকেট হাতে আসছে ততদিন আর সিলেট পা রাখবে না। বার বার এমন দৃশ্য দেখা সম্ভব না তার পক্ষে। মনকে কতই আর মানানো যায়, কতই স্বান্তনা দেয়া যায়! চুপচাপ বিছানা ছাড়লো অনিক। হাত বাড়িয়ে মাইসারাকে টেনে তুললো। হাতের স্পর্শে চোখের পানি মুছে চিবুক ধরে কপালে গভীর স্পর্শে অধর ছুঁলো! বুকের কাছটায় আগলে নিল দ্রুত। মাইসারার মাথার তালুতে তার থুতনি ঠেকলো। যদি সবসময়ের জন্য এখানেই পু’তে ফেলা যেত, তবে এত বিরহ আসতো না বোধহয়। ফিসফিস করে বলল,

-“কাঁদিস না সারা, আমরা চোখের আড়াল হলেও মনের আড়াল কখনোই হবো না। যোগাযোগ তো থাকবেই, তাই না! আমি তো আর প্রবাসী নই যে, সব ছেড়ে চলে যাচ্ছি চিরদিনের জন্য। আমাদের দূরত্বটা কয়েকটা ঘণ্টার পথ মাত্র।”

আবেগী মেয়ে হুট করে যেভাবে বাচ্চা হয়ে গিয়েছিল, ঠিক তেমনি হুট করে আবার ম্যাচিউরড হয়ে গেল। ঝটপট বিছানা ছাড়লো সে। ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে ওড়নাটা ভালোমতো পেঁচিয়ে নিল। বলল,

-“ট্রেনের সময় হয়ে যাচ্ছে, এসো।”

অনিক অবাক চোখে একপলক তাকালো। দড়াম করে আকাশে বজ্রপাত যেমন হয়, বৃষ্টি হয়ে মাটির বুকে ঝরে পড়ে একটুকরো মেঘের ঘনঘটা, আবারও আকাশে মিশে গিয়ে রংধনুর সাতরঙে রাঙিয়ে দেয় আকাশ, তেমনি প্রিয়তমার মুখশ্রীও সেই রূপে ফিরে গেল তৎক্ষনাৎ। যেমনটা দু’চোখে বৃষ্টির জল নামিয়ে ছিল, তেমনটাই আবার তাকে রোদের আড়ালে লুকিয়ে নিয়েছে। নিজেকে মানিয়ে নেয়ার কত চেষ্টা যে প্রতিনিয়ত করে মানুষ, তা এই মুহূর্তে মাইসারাকে না দেখলে উপলব্ধি হতো না তার। কথার জবাবে শুধু চুপচাপ মাথা নাড়লো সে। তারপর ব্যাগ হাতে নিয়ে সোজা রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলো দু’জনে। রিসেশনে এসে বিল মিটিয়ে রিকশা ডেকে নিল। মাইসারাকে হসপিটালের সামনে নামিয়ে স্টেশনের দিকে চলে গেল অনিক। দূরত্বের এই সীমানাটা দূর থেকেই দেখলো মাইসারা! ইচ্ছা থাকলেও উপায় জানা নেই তার। চাইলেও দায়িত্ব, কর্তব্যকে অবহেলা করা যায় না। এভাবেই কিছু চাওয়া-পাওয়াকে দূরে ঠে’লে দিতে হয়। ধৈর্য্য নিয়ে স্বপ্ন পূরণের শেষপ্রান্তে পৌঁছানোর পথ পেরোতে হয়। অপেক্ষা করতে হয়, আবারও দেখা হওয়ার জন্য, এক হওয়ার জন্য, একসাথে বাঁচার জন্য, ভালোবাসার জন্য।

*****

বেশ কিছুদিন ধরে কোনো কাজে ঠিকমতো মনোযোগ দিতে পারছে না মাইসারা। বড্ড বেশি মুড সুইং হচ্ছে। কোথাও মন টিকছে না! কেমন অস্থির, এলোমেলো, অগোছালো লাগছে সবকিছু। অনিক যাওয়ার পর থেকেই এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। অকারণ মনের আকাশে মেঘ জমেছে। কখনো তা বৃষ্টির ফোঁটার মতো গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। মাইসারার এই পরিবর্তন খুব করে লক্ষ্য করছে রিপা। মেডিকেলে পড়াশোনার শুরু থেকেই রিপার সাথে সম্পর্ক তার খুব ভালো। সবকিছু শেয়ার করা ছাড়াও একে-অন্যের সুখ-দুঃখের সবচেয়ে কাছের বন্ধু হয়ে উঠেছে দু’জনে। মাঝেমধ্যে রিপাও বুঝতে পারে, প্রিয় বন্ধুর মন খারাপের আনাগোনাটা কেন হয়, কী কারণে হয়! সাধ্য অনুযায়ী মন ভালো করার চেষ্টা সে করেও। এই মুহূর্তেও ঠিক তাই করলো রিপা। একটা এলোমেলো রুবিকস কিউব এনে হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

-“ঝটপট এটা মিলিয়ে নে। মন ভালো হয়ে যাবে!”

ঘাড় ফিরিয়ে গেইমের দিকে দৃষ্টি দিল মাইসারা। মুচকি হেসে বলল,

-“তোর কাজ তুই কর। সারাদিন এই-ই তো চলে।”

-“আরে ধর, ট্রাই কর! চাইলে ভাইয়ার সাথে কথা বলে মন হালকা করতে পারিস! তাছাড়া আধঘণ্টা পর ও.টি’তে ঢুকবি। এভাবে মাথার উপর বাড়তি চা’প নিয়ে ঢুকলে রোগীকে বাঁচানোর বদলে মে’রে ফেলবি!”

গেইমটা তৎক্ষনাৎ নিজের হাতে আনলো মাইসারা। রিপা এমনভাবে এলোমেলো করেছে প্রথমবার এটা যে মেলাতে যাবে তার মাথার ঘাম ঝরে যাবে। মাইসারার এই গেইমটা খেলার অভ্যাস আছে। ঝটপট কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সবক’টা কিউব মিলিয়ে হাতে ধরিয়ে দিল আবার। বলল,

-“আরেকটু এলোমেলো করলে ভালো হতো। খানিকটা সময় ইনভেস্ট হতো!”

-“তোর হয়েছেটা কী বলতো? সারাক্ষণ এমন মনমরা হয়ে থাকলে চলবে? সময় কত দ্রুত যাচ্ছে খেয়াল আছে! হুট করেই একদিন এতসব ঝামেলার ছুটি হয়ে যাবে। নিজের একটা জায়গা তৈরী হবে। দৈনন্দিন কাজের চাপ বাড়বে। চারপাশে সারাদিন এত রোগী ছোটাছুটি করবে যে, মন খারাপ করার জন্যও বাড়তি সময় পাবি না। তাছাড়া তোকে এভাবে একদমই মানাচ্ছে না। একটু হাসতে তো পারিস।”

-“হাসি না আসলে জো’র করে কীভাবে হাসবো বল!”

-“ভাইয়া তোকে একটা দায়িত্ব দিয়ে গেছে, নিজেকে তৈরী করার। এইযে অযথা মন খারাপকে সঙ্গী করে দায়িত্ব থেকে সরে যাচ্ছিস, এটা কি ঠিক হচ্ছে? এভাবে চলতে থাকলে শেষপ্রান্তের ঠিক কিনারায় পৌঁছার আগেই চলন্ত গাড়ির দৌড় থেমে যাবে। তখন তুই ওই একটা গানই গাইবি, ‘গাড়ি চলে না, চলে না, চলে না রে, ও গাড়ি চলে না!’ শেষে এসে থেমে যাস না সারা, দৌড়া। জয়ের শেষ সীমানায় পৌঁছেছি আমরা। এখানে থেমে যাস না দোস্ত!”

রিপার এই ঠে’লে ঠে’লে গাড়ি চলে না গান শুনে ফিক করে হেসে ফেললো মাইসারা। অনেকক্ষণ হাসলো। হাসি থামিয়ে বলল,

-“থ্যাংকস! এই হাসিটার প্রয়োজন ছিল!”

কিছুক্ষণ পর মাইসারা টের পেল সামান্য হালকা লাগছে। নিজেকে পুরোদমে স্বাভাবিক করে ঝটপট তৈরী হয়ে নিল। আর কিছুক্ষণ পরই একটা অপারেশন আছে। সকালেই একজন গর্ভবতী নারী এসে এডমিট হয়েছেন। তার কান্ডিশন ভালো থাকলেও তিনি লেবার পেইন সহ্য করতে পারবেন না বলেই অপারেশনে যেতে চাইছেন। অথচ প্রত্যেকেই চায়, সিজারিয়ান অপশন থেকে দূরে থাকতে। এই মহিলাটা পুরোটাই আলাদা! যখন তাকে চেকাপ করছিল, তখন তার ভীতিগ্রস্ত চোখমুখ দেখে প্রচণ্ড হাসি পাচ্ছিলো মাইসারার। ভয় পাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু তার মনে হচ্ছিলো, মেয়েটা অভার অ্যাকটিং করছে। হাজবেন্ডের হাত ধরে সে কী কান্না! মুহূর্তেই সেই ঘটনা তাকে আরেকদফা হাসিয়ে দিল। হাসিটাকে শুধু ঠোঁটের কোণেই সীমাবদ্ধ রাখলো, বাড়তি আওয়াজ তৈরী হতে দিল না।

*****

অপা’রেশন থিয়েটারে যথেষ্ট সাহস আর যত্ন নিয়েই কাজ করে মাইসারা। আজকের কাজটায়ও বিন্দুমাত্র অবহেলা নেই। ডাক্তারদের আপ্রাণ চেষ্টা একটা সুস্থ শিশুর জন্ম দেয়া, একজন মা’কে পরিপূর্ণ সুস্থ রাখা। সেই অনুযায়ী চেষ্টার কোনো কমতি রাখেন না তারা। ও.টি’র ঝামেলা শেষে যখন সুস্থ নবজাতককে তার মায়ের বুকে শুইয়ে দিল মাইসারা তখন সেই সদ্য মা হওয়া অনুভূতিকে নিজের মধ্যে ধারণ করতে পেরে আবেগে কেঁদে ফেললো মেয়েটি! তা দেখে মাইসারার চোখে জল এলো। একটা সন্তানকে মা ঠিক এইভাবেই বুকে আগলে রাখে, সারাজীবন। রোজ এই দৃশ্য যখন দেখে তখন নিজের ভাগ্যটা নিয়ে বড্ড আফসোস হয় তার, আবার পরক্ষণেই মন ভালো হয়ে যায়, যখন হাজারও না পাওয়ার ভিড়ে অনিকের হাসিটুকু চোখে ভাসে। এইটুকুতেই নিজেকে পরিপূর্ণ অনুভব করে সে।

অপা’রেশনের ঝামেলা শেষ করে মা এবং সন্তানকে আলাদা কেবিনে শিফট করা হলো। হাতের গ্লাভস খুলে হাত পরিষ্কার করলো দ্রুত। নিজের গায়ের সবুজ অ্যাপ্রোন খুলে ঝটপট রোগীর কাছে আসলো। আলাদা একটা বিছানায় তখন নবজাতককে শুইয়ে রাখা হয়েছে। বাচ্চার বাবা এসে ততক্ষণে বাচ্চাকে একনজর দেখে গেছে। মাইসারা ভালোমতো চেক করলো বাচ্চাটাকে। কোনোপ্রকার অসুবিধা হচ্ছে কিনা তা দেখে নিল। তখন ভদ্রলোক বললেন,

-“ভবিষ্যতে বাচ্চার কোনো ক্ষ’তি হবে কী?”

-“মানে?”

আচমকা এমন প্রশ্নে ভরকে গেল মাইসারা। লোকটা তখন সামান্য হেসে বলল,

-“আসলে আমরা কাজিন। আমার মা একজন ডাক্তার। তবে তিনি এখানে নেই। আমাদের লাভ ম্যারেজ! কিন্তু মা বার বার বলতেন, কাজিনদের মধ্যে বিয়ে হলে ফিউচারে বাচ্চাদের সমস্যা হতে পারে। তো সেটাই আরকি জানতে চাইছি।”

-“সমস্যা হলে সামলাবেন। ডাক্তার তো আছেই। রোগ আসলে রোগের মুক্তিও আছে। ভয় পাবেন না। আপনারা দু’জনে মিলে বাচ্চাকে আগলে রাখবেন। ইন-শা-আল্লাহ্ কঠিন কোনো রোগ হবে না! হলেও বাঁচানোর মালিক আল্লাহ! তবে মনে রাখবেন, যতই রোগবালাই আসুক, বাচ্চাকে কখনো বাবা-মায়ের আদর-স্নেহ থেকে বঞ্চিত করবেন না। অসুস্থ হোক বা সুস্থ, একটা বাচ্চা সবসময়ই ভালো থাকে যদি সে তার বাবা-মায়ের সংস্পর্শে থাকে। তাই তাকে আগলে রাখার দায়িত্ব আপনাদেরই।”

ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন আবারও। মাইসারা কেবিন থেকে বেরিয়ে উপর থেকে নিচে আসছিলো, ঠিক সেই মুহূর্তে তার চোখ গেল ওয়েটিং রুমে বসে থাকা নারীর দিকে। তার শারিরীক পরিবর্তন বলছে সে প্রেগন্যান্ট! সময়ের হিসাব করে চমকে গেল মাইসারা। দ্রুত এগিয়ে আসলো সামনে। অবাক হয়ে বলল,

-“আপু, তুমি এখানে?”

পাশে তাকিয়ে নামিরা নিজেও প্রচণ্ড চমকালো। খুশিতে হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরলো। বলল,

-“তুমি এই হসপিটালে?”

-“আমারও তো একই প্রশ্ন। তুমি এখানে?

-“এই শহরেই আমার শ্বশুরবাড়ি!”

-“ওহ! তোমার কন্ডিশন বলছে প্রেগন্যান্সির ছয় মাস! এ্যাম আই রাইট?”

-“সাড়ে ছয়।”

মুচকি হেসে উত্তর দিল নামিরা। মাইসারা আঙুলের দাগে মাসের হিসাব করলো। সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বলল,

-“কীভাবে? বিয়ের তো মাত্র তিন মাস হলো! না না, আরও বেশি!”

-“বুদ্ধু! আমাদের বিয়ের এক বছর হয়ে গেছে! গত কয়েকদিন আগে বিবাহবার্ষিকী ছিল!”

-“কী?”

মাইসারার মনে হলো সে ধড়াম করে আকাশ থেকে মাটিতে পড়লো। কপালে হাত রেখে অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইলো। নামিরা তার হাত ধরে বলল,

-“আসলে ভুলটা আমারই! জেনে-বুঝে তোমার মানুষটাকে কেড়ে নিতে চাইছিলাম আমি। সময়মতো সবাইকে সব সত্যি জানাইনি। তানভীর আর আমার ভালোবাসার সম্পর্ক। পালিয়ে বিয়ে করেছিলাম আমরা। কিন্তু সে বিয়ে তার বাবা-মা মেনে নেননি। সবাই ডি’ভোর্সের জন্য চাপ দেয়৷ বাবা-মা এক প্রকার জো’র করে ডি’ভোর্স করিয়ে নিতে চান৷ কিন্তু পারেননি। জো’র করে অনিকের সাথে বিয়ে দিতে চাইছিলেন। বিয়ের ব্যাপারটা অনিকও জানতো না। এত চাপ নিতে পারছিলাম না। এক সময় অসুস্থ হয়ে পড়লাম। জানতে পারলাম, আমি প্রেগন্যান্ট। বাধ্য হয়ে মুখ খুললাম।”

-“মানে! তোমাদের বিয়ের ব্যাপারটা প্রথমে কেউ জানেনি?”

-“কাউকে জানাইনি! প্রেগন্যান্সির পরই আংকেলকে এসে সব বললাম। অনিককেও বুঝালাম। আমার বদলে তোমাকে বেছে নেওয়ার কথা বললাম। অনিক ভয় পাচ্ছিলো, যদি তুমি তাকে ফিরিয়ে দাও! যদি বলো, সানভিকেই চাও। তবে? এজন্যই!”

-“এতসব কথা তো আমাকে সরাসরি বললেই হতো। অনিক কেন চুপ ছিল?”

-“কারণ, তোমার ভেতরে সবসময় তুমি অন্য একজনকে বাঁচিয়ে রেখেছো! তোমাকে ভালোবাসি বলা, কিংবা সরাসরি বিয়ের কথা বলা এই নিয়ে প্রচুর দ্বিধার মাঝে ছিল অনিক। ও চায়নি এমন কিছুই। তখন আমার মনে হলো, যদি আমি সত্যিটা না বলি, তবে তুমি বিয়েতে রাজি হবে না। একদিকে তোমার জন্য শক্ত আশ্রয় তৈরী করা, অন্যদিকে তোমার মনে নিজের জন্য অনুভূতির সঞ্চার করা, দুটোই খুব কঠিন ছিল সারা। এই কঠিন কাজটা সহজে হতো না, যদি না আমি মাঝখানে আসতাম।”

-“সত্যি কথা বলতে এত ভয় কীসের আপু?”

-“সানভি দেশে আছে সারা। ওর সাথে অনিকের দেখাও হয়েছে। সব জানলে তুমি অনিককে ফিরিয়ে দিতে নিশ্চয়ই! আর তোমার প্রত্যাখ্যান ও মেনে নিতে পারতো না। তাই সরাসরি না এসে আমার মাধ্যমেই তোমার সামনে এসেছে!”

এতসব কথা শুনে মনে হলো, তার মাথার ভেতর হাজারও পোকামাকড়ের কিলবিল চলাচল করছে! দু’হাতে মাথা চেপে ধরলো মাইসারা। তার ভেতরে তখন একটাই কথা ঘুরপাক খাচ্ছে, সানভি দেশে ফিরেছে আর সেটা অনিক জেনেও লুকিয়ে গেছে। কেন? কী কথা হয়েছে দু’জনার মাঝে যা সে জানতেও পারেনি! কীসের এত লুকোচুরি চলছে? কেনই-বা এই লুকোচুরি?

*****

ফারজানাকে এই ক’দিনে অনেক বারই কল করেছে মাইসারা কিন্তু সে কল রিসিভ করেনি। প্রতিবার রিং বাজতে বাজতে একটা সময় বন্ধ হয়ে যেত, এপাশের মানুষটা ফোন রিসিভ করতো না। আজও হসপিটাল থেকে ফিরে বার কয়েক চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়ে বিছানায় বসে রইলো সে। মাথাটা যন্ত্রণায় ফে’টে যাচ্ছে তার। কোনোকিছুই ঠিকমতো ভাবতে পারছে না। অনিককে কথা দিয়েছিল, যেভাবে হোক ফারজানাকে বুঝিয়ে বাড়িতে পাঠাবে কিন্তু তা আর রাখতে পারলো না। কোনোভাবেই ফোন রিসিভ করলো না সে। পরবর্তীতে কলও ব্যাক করলো না। দুঃশ্চিন্তায় বুকের ভেতর কাঁপন শুরু হয়েছে তার। একদিকে ফারজানা আর আলিফের সংসার, অন্যদিকে তার আর অনিকের সংসার, দুটো সংসার নিয়েই মাত্রাতিরিক্ত দুঃশ্চিন্তা ভর করছে মনে। সানভির সাথে অনিকের কী কথা হতে পারে, সে বিষয়ে কোনো আইডিয়া আসছে না মাথায়! এর কারণেই কি তবে অনিক পাগ’লামি করছিল? হুটহাট না জানিয়ে চলে এসেছিল! কিছুই ভাবতে পারছে না সে। যতই ভাবছে সব ভাবনা একটা জায়গায় এসে থমকে যাচ্ছে, অনিকের সাথে তার সম্পর্কটা ঠিক কী? যান্ত্রিক নাকি হৃদয়ের সুপ্ত অনুভূতি! আদৌ এর কোনো সঠিক জবাব নেই তার কাছে।

যতসব জটিল ভাবনার কোনো সঠিক সমাধান খুঁজে পেল না সে। নীরবে মাথা ঠেকালো বালিশে। সারাদিনের দুঃশ্চিন্তাকে দূরে সরিয়ে দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করলো তবুও ব্যর্থতা উঁকি এসে বুঝিয়ে দিল, শত চেষ্টা করলেও দুঃশ্চিন্তা থেকে আজ আর মুক্তি নেই। দু’চোখে অশ্রু’রা ভিড় জমিয়েছে। তার মনে হচ্ছে, যে আশ্রয়েই সে পা রাখছে সেটাই হারিয়ে যাচ্ছে! একটা সময় হয়তো অনিকও হারিয়ে যাবে। টেনশনে পাগল পাগল অবস্থা হলো মাইসারার। ফোন হাতে নিয়ে আবারও ফারজানাকে ফোন করলো। অন্তত একটা কাজ সুষ্ঠুভাবে হোক। কিন্তু তা-ও হলো না। বাধ্য হয়ে শেষমেশ আলিফের নাম্বারে ফোন করলো। বেশ কিছুক্ষণ পর রিসিভ হলো সেটা। চোখমুখ মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করলো সে। সালাম দিয়ে জানতে চাইলো,

-“বাড়ির সবাই ভালো আছে তো ভাইয়া? ক’দিন ধরে নাহিয়ানের জন্য মনটা বড্ড ছটফট করছে। একটু ফোনটা দাও না, ওর সাথে কথা বলি।”

সরাসরি ভা’ঙনের প্রশ্নে গেল না মাইসারা। বুদ্ধি করে নাহিয়ানের কথা বলে কথা ঘুরানোর চেষ্টা করলো। কিছুক্ষণ পর আলিফ জবাব দিল,

-“ও তো ওর নানু বাড়ি আছে।”

-“কবে গেল?”

-“হয়ে গেছে অনেকদিন!”

-“কবে আসবে? ভাবীকে কতবার ফোন দিলাম, রিসিভ করলো না। কিছু কি হয়েছে ভাইয়া?”

-“কিছু হয়নি। তুই অযথা দুঃশ্চিন্তা করিস না।”

-“না না, আমি দুঃশ্চিন্তা করবো কেন। এমনিতেই মনে পড়লো, তাই জিজ্ঞেস করলাম। তুমি এক কাজ করো, কাল গিয়ে বরং ওদেরকে বাড়ি নিয়ে এসো। ঘরের বউ ঘরে থাকবে এটাই তো সুন্দর, তাই না? কেন শুধু শুধু পরের বাড়িতে থাকবে!”

আলিফ তখন আর কোনো জবাব দিল না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে জবাবের অপেক্ষা করলো মাইসারা। কিন্তু ভাইয়ের নীরবতা দেখে বলল,

-“কবে নিয়ে আসবে বলো?”

-“আনবো সময় হলেই। আমার বাচ্চাকে তো আমি আনবোই। তবে তোর ভাবীকে আনবো না।”

ঠিক তারপরই লাইন কে’টে গেল। হতাশ হয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলো মাইসারা। কাকে, কীভাবে বুঝাবে কোনো আইডিয়া নেই তার। তবে যে করেই হোক, ভা’ঙ’ন আটকানোর চেষ্টা তাকে করতেই হবে। আলিফের জবাব পেলেও ফারজানার কোনো জবাব সে পায়নি। বুঝতেও পারলো না, কেন ফারজানা তার ফোন রিসিভ করছে না! সে তো কোনো দোষ করেনি! তবে? তার উপর কীসের এত রাগ তার? শুধু কি সম্পত্তির জন্যই? বেঁচে থাকার জন্য সম্পদটাই খুব প্রয়োজন কারো কারো কাছে? হবে হয়তো। নয়তো বিনা অপরাধে সে কেন কারও দুশ’মন হয়ে গেল?

*****

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে