মনোহারিণী পর্ব-১৩+১৪

0
1200

❝মনোহারিণী❞
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
পর্ব : (১৩)+(১৪)

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ!)

কাঠফা’টা রোদে তৃষ্ণার্ত পথিক যেমন একটুখানি ছায়া আর বৃষ্টির জন্য পিপাসার্ত হয়ে দিকবিদিক ছোটাছুটি করে, দুঃসময়ে একফোঁটা পানি যার জন্য আত্মতৃপ্তি নিয়ে আসে; ঠিক তেমনি হাজারও উৎকণ্ঠা, ব্যথা-বেদনার সময়ে তৃষ্ণার্ত পথিকের মনে তৃপ্তির হাসি ফুটাতেই বোধহয় অসময়ে বাড়ির আঙিনায় পরিচিত মানুষের আগমন ঘটলো! বুকের ভেতর যতখানি যন্ত্রণার জন্ম নিয়েছিল, অনুশোচনা আর ন্যায়-অন্যায়ের অ’স্ত্র হিসেবে বিবেক যখন তাকে প্রতিনিয়ত নীরবে চাবু’কের আঘা’তে খণ্ডবিখণ্ড করে দিচ্ছিলো, তখনই চূর্ণবিচূর্ণ হওয়া মনে প্রশান্তির একমুঠো সুখ নিয়ে হাজির হলো কেউ! আশ্চর্যের প্রতিটা রেখা ফুটে উঠলো তার চেহারার। বিশ্বাস, অবিশ্বাসের হিসাবে সে বরাবরই কাঁচা। তাই হুট করে এই আগমন অবিশ্বাস্যই ঠেকলো। যখন তার ইন্দ্রিয় জানান দিল, নাড়িছেঁড়া ধন তার কোলে ফিরে এসেছে তখনই নীরব আর্তনাদে বুক ভাসিয়ে দিল ফারজানা। অনেকক্ষণ ছেলেকে আঁকড়ে ধরে যন্ত্রণাটুকু উপশমের সামান্য চেষ্টা করতে লাগলো। অনিক উঠোন থেকে ভেতরে এসে সোজা তার মুখোমুখি দাঁড়ালো। ঔষধপত্র ধরিয়ে দিয়ে বলল,

-“হুট করেই জ্বর চলে এসেছে! সাবধানে রেখো।”

ফারজানা মাথা নেড়ে ছেলেকে নিয়ে ভেতরের ঘরে চলে গেল। বিছানায় শুইয়ে প্রথমে জ্বর চেক করলো। তখনো তার উত্তপ্ত শরীর বলছে, জ্বর খুব বেশিই। নিজের উপরই রাগ হলো তার। আজ তার সামান্য ভুলে ওইটুকু বাচ্চা কষ্ট পাচ্ছে। ভেতর নিংড়ে অনিকের জন্য প্রার্থনা বেরিয়ে এলো, তবে তা মুখে প্রকাশ করলো না। অনুতপ্ত মনের গোপন জায়গাতেই উপলব্ধিটাকে আটকে দিল সে। ফারহানের সাথে প্রয়োজনীয় কথা বলছিল অনিক! কী করবে, কীভাবে করবে, সবকিছুর একটা নির্দিষ্ট সমাধান নিয়ে আলোচনা করছিল। ঠিক তখনই ভদ্রমহিলা এসে অনিকের সামনে দাঁড়ান। তীক্ষ্ণ দৃষ্টির অগোচরে নিজের রাগকে হাজারও চেষ্টায় দূরে সরিয়ে রাখতে পারলেন না। চিৎকার করে বললেন,

-“খুব তো বাহাদুরি দেখিয়েছিল তোমার ভাই। রাখতে পারলো না কেন? সেই তো বাচ্চা নিয়ে ফিরে আসতে হলো! রাখতেই যদি পারবে না, তবে এত নাটক সাজিয়েছিল কেন? মা ছাড়া সন্তান লালন-পালন করা কি চাট্টিখানি কথা!”

অনিক তাৎক্ষণিক কোনো জবাব দিল না। মুরব্বি মানুষ, কথার সাথে কথা জড়িয়ে তর্কে যাওয়া উচিত হবে না। সমস্যা যাদের নিয়ে তৈরী হয়েছে, সমাধানে তাদেরই প্রয়োজন। কোনো তৃতীয় ব্যক্তির সাথে তর্কবিতর্ক করে সম্পর্ক নষ্ট করার প্রয়োজন দেখছে না সে। অনিকের নীরবতা দেখে তিনি আরও সাহস পেয়ে গেলেন। চেহারার কাঠিন্যতা বজায় রেখে বললেন,

-“তোমার ভাইকে বলো, বেশি বাড়াবাড়ি যেন সে না করে! ফের যদি বাচ্চা নিয়ে এসব ঝামেলা সে তৈরী করে তবে আমরা কোর্টে যেতে বাধ্য হবো।”

বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলো অনিক। ত্বোয়াও চুপচাপ। তার আসলে কিছু বলার নেই। যেখানে অনিক দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে সে বাড়তি কথা বলে কেন অপরাধ নিজের মাথায় নিবে। তবুও চুপ থাকতে পারলো না সে। বলল,

-“ছোটো ভাইয়াকে ওসব বলে লাভ নেই আন্টি। ভাইয়া তখন বাড়িতে ছিল না। আপনার যদি কিছু বলার থাকে, বড়ো ভাইয়াকে বলবেন। চলো ভাইয়া উঠি, এখানে অযথা সময় নষ্ট করে লাভ নেই!”

এখানে বেশিক্ষণ থাকা মানে অযথা তর্কাতর্কি টে’নে আনা সেটা বেশ বুঝতে পারলো অনিক। তর্কে গিয়ে ফায়দা নেই, উলটে মুরব্বি মানুষটার উপর রাগ ঝাড়া। আপাতত এসবে দৃষ্টি নেই তার। নাহিয়ান সুস্থ হোক, এটাই চাওয়া। তাই সোজাসাপটা উঠে দাঁড়ালো। ফারহানকে বলল,

-“সুস্থ হওয়ার পর ফোন দিও। যাবতীয় আলাপ, আলোচনা নাহয় তখনই হবে।”

দু’জনে যখন উঠে দরজা পর্যন্ত চলে আসলো তখনই পিছন থেকে ফারজানা তাদের আটকে দিল। চা-নাশতা এনে টি-টেবিলে রেখে বলল,

-“কিছু তো মুখে দিয়ে যাও ভাই! এভাবে খালি মুখে…!”

হাসার চেষ্টা করলো অনিক, কিন্তু কোথাও মাতৃতুল্য ভাবীর উপর অভিমান এসে ভর করলো। বলল,

-“ঘরটা ফাঁকা হয়ে গেছে ভাবী! যেদিন ফিরে যাবে সেদিন যদি কিছু খেতে বলো মানা করবো না। কিন্তু এই মুহূর্তে গলা দিয়ে কিছু নামবে না। জানি না কেন, কী কারণে বদলে গেলে তুমি? আমাদের পরিবারে কি সুখের অভাব ছিল? হাসি-আনন্দেই তো কাটছিল সময়, তবু কেন এই নীরব রে’ষারে’ষি? যদি এর পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা তুমি দিতে পারো, যদি আবারও নিজেকে আমাদের ঘরের একজন তৈরী করতে চাও তবে মন-মানসিকতায় পরিবর্তন আনো। আগে যেভাবে ঘর-সংসার আগলে রেখেছিলে, কোনো দ্ব’ন্দ্ব, হিং’সা-বিদ্বে’ষ ছাড়া, সেভাবেই আগলে নাও না প্লিজ!”

ফারজানা কোনো কথা খুঁজে পেল না। অনিক আবারও বলল,

-“সুখের সংসারে আগু’ন কখন লাগে জানো? দু’জন সুখী দম্পতির মাঝখানে যখন তৃতীয় ব্যক্তি চলে আসে! তোমাদের মাঝখানেও সেই তৃতীয় ব্যক্তিরই আগমন ঘটেছে! হয় জেনে-বুঝে ঘটিয়েছো, নয় না জেনে। কিন্তু যাই করো, ভেবে সিদ্ধান্ত নাও। তোমার একটা ভুল নাহিয়ানের জীবনটা বি’ষিয়ে দিবে। যেমনটা সারার জীবন এলোমেলো হয়েছিল, তেমনটা এই বাচ্চার জীবনও এলোমেলো হবে। আর কিছু না হোক, অন্তত নিজের সন্তানের জন্য বুঝে কাজ করো। আমি বলবো না তুমি দো’ষী কিংবা তুমি নির্দোষ এ-ও প্রমাণ করতে চাইবো না। নিজেরটা তো পাগ’লেও বুঝে। আশাকরি তুমিও বুঝবে।”

এরকম কথার পরে আর কোনো উত্তর দেয়া যায় কিনা জানা নেই ফারজানার। আড়ালে দীর্ঘশ্বাস ফেললো! সংসারটা স্বর্গই ছিল একদিন, নিজের ভুলে সেই স্বর্গ থেকে বিতাড়িত সে। যেখানে ননদ, দেবর কেউ-ই কোনোদিন কথা কাটাকা’টি করেনি, অপরাধী জেনেও কোনো প্রকার নালিশ দেয়নি, সেখানে তাদের উপর অহেতুক অবিচার করে কোনো জবাবের মাধ্যমে পা’প থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না! আজ তার মুক্তি নেই, সে দিব্যি বুঝতে পারছে। অপরাধবোধ আর লজ্জায় মাথা নুইয়ে আসছে তার। অনিক জবাবের অপেক্ষা করলো না অবশ্য, তার বিস্মিত চোখকে উপেক্ষা করে ত্বোয়াকে নিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিল!

*****

কুসুম গরম পানিতে ছোট্ট কাপড় ভিজিয়ে তা ছেলের মাথায় রেখে দিল ফারজানা। কিছুক্ষণ পর পর এভাবে জলপট্টি দিয়ে তাপমাত্রা কমানোর চেষ্টা করলো! হুট করেই মেয়ের ঘরে প্রবেশ করলেন ভদ্রমহিলা। মেয়ের এমন আহ্লাদ, আদর দেখে ঠোঁট বাঁ’কালেন। বললেন,

-“এত আদিখ্যেতা আমার এখানে করিস না! যেদিকে পারিস চলে যা। আমার ওতো টাকা-পয়সা নেই, ঘাড়ে দুটো বো’ঝা নিয়ে ঘুরবো।”

মায়ের হুটহাট এই পরিবর্তনে মনে ভীষণ আঘা’ত পেল ফারজানা। জবাব দেয়ার আগেই দু’গাল চেপে ধরলেন তিনি। বললেন,

-“মাথায় একটুও বুদ্ধি নেই। এখন যে বাচ্চা নিয়ে পথে নামলি, তার কী হবে! কে দেখবে এখন তোকে? জানিস না, এই ঘরে বাড়তি আয় হয় না। তোর ভরণপোষণের দায়িত্ব কে নিবে? ঘা’টের ম’রা, সব এখানেই এসে পড়লো।”

ব্যথায় আর্ত’নাদ করে উঠলো ফারজানা। এমনিতেও মনটা ভালো নেই। তার উপর মায়ের এই অনাকাঙ্ক্ষিত রূপ। মনের কোথাও বেজে উঠলো একই কথা। যা সে খুব নীরবে ঠাণ্ডা মাথায় মাইসারাকে শুনিয়েছিল। ভাইয়ের টাকায় খেতে হলে কি বোনকে কৈফিয়ত দিতে হয়? বোনেরা কি ভাইদের দায়িত্বে পড়ে না? কেন তারা বাড়তি বো’ঝা হয়? নিজের পা’পের শা’স্তি পাচ্ছে, এটা উপলব্ধি হতে বিন্দুমাত্র দেরী হলো না ফারজানার। ব্যাগপত্র গুছিয়ে বলল,

-“আমার টাকাগুলো দাও! আমি তোমার বাড়িতে আর এক মুহূর্তও থাকবো না।”

ভদ্রমহিলা শুকনো ঢুক গিললেন। কীভাবে দিবেন এখন টাকা! ওসব টাকা তো তিনি সু’দের কাজে ব্যবহার করেছেন! কেউ পাঁচ’শো টাকা ধার চাইলে ফেরত নিতেন ছ’শো টাকা। এভাবে তো অনেকগুলো টাকাই তিনি খরচ করে ফেলেছেন। বাকি যা ব্যাংকে আছে তা তো নিজের নামে। কোথাও তো তিনি মেয়ে কিংবা নাতির নামে টাকা জমাননি! আমতা আমতা করে বললেন,

-“আমার কাছে কোনো টাকা নেই। সব টাকা খরচ হয়ে গেছে!”

মনে হলো হাজার টনের একগাদা বাঁশের বাড়ি এসে মাথার উপর পড়লো তার। বিস্মিত চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,

-“আমার এতগুলো টাকা তুমি কীভাবে খরচ করতে পারো? দু’বছরে দু’লাখেরও বেশি টাকা দিয়েছি আমি তোমাকে। আমার টাকা আমায় ফেরত দাও, আমি আমার ছেলেকে নিয়ে চলে যাব।”

-“যাওয়ার হয় যা, কোনো টাকা-পয়সা পাবি না। ওসব অনেক আগেই ফুরিয়ে গেছে। পরের বোঝা হয়ে না চেপে নিজের রাস্তা মাপ!”

-“এই ছিল তোমার মনে? আসল রূপ দেখিয়ে দিলে তবে? যে মানুষগুলোকে তোমার জন্য, তোমার কথায়, খেতে পরতে কথা শুনিয়েছি সে মানুষগুলো এখনো চায়, আমি যেন ফিরে যাই। সেখানে তুমি তোমার মেয়েকে বো’ঝা ভাবছো! আমি তো জানতাম সারার মা খারাপ। এখন তো দেখছি আমার মা-ও ভালো নয়। পৃথিবীতে কেউ-ই ভালো হয় না। যারা ভালো হয়, তাদের সাথেই অন্যায় হয়! তোমার কথায় ওদেরকে ঘরছাড়া করতে চেয়েছি, বুঝিনি আমিই আজ আশ্রয়হীন হয়ে যাব।”

ফারজানা সবকিছু গুছিয়ে অসুস্থ নাহিয়ানকে কোলে নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে চাইলো। তাদের দু’জনার এই তর্কাতর্কি এতক্ষণ ফারহান শুনলেও কোনো জবাব দেয়নি। এখন আর চুপ থাকতে পারলো না সে। ফের নাহিয়ানকে বিছানায় ঘুম পাড়িয়ে বলল,

-“যতদিন না ঝামেলা মিটছে তুই এখানেই থাকবি! খাওয়াপরা নিয়ে আমি তোকে কখনো খোটা দেইনি, আর দিবও না। কে কী বললো, কী করলো তা নিয়ে মাথা ঘামাস না। এই সমাজে এখনো অনেক মা আছে, যারা নিজেরা কুমন্ত্রণার জা’লে ফেলে অন্যের সুন্দর সংসার নষ্ট করে দেয়। তোকে আগেই বুঝিয়েছি, তুই বুঝিসনি। এখন দেখলি তো, সব মায়েরা তোর শাশুড়ি মায়ের মতো নয়। কিছু মা ডা’ইনীর চেয়েও কম যায় না। এই মা’কে তো আমি চিনি, তাই চাইলেও শা’স্তি দিতে পারি না।”

-“আমার ভুল হয়ে গেছেরে ভাই! অনেক বড়ো ভুল হয়েছে। এ ভুলের প্রায়শ্চিত্ত আমি কীভাবে করবো! ম’র’লেই বোধহয় সব পা’প মুছে যাবে।”

ফারহান বোনকে শান্ত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ভদ্রমহিলা আর সেখানে দাঁড়িয়ে রইলেন না। কার্যসিদ্ধি তিনি আগেই করেছেন! মেয়েকে বুঝিয়ে শুনিয়ে অনেকটা টাকা হাতে আনতে পেরেছেন। এখন যদি ছেলে তার দায়িত্ব না নেয়, তাতেও অসুবিধা নেই। তিনি ঠিকই খেয়েপড়ে বাঁচতে পারবেন। সুযোগ সন্ধানী মানুষ যেমন, অন্যের অনিষ্ট করে নিজের সুখ খুঁজে নেয়, তিনিও সেই দলেরই একজন। ফারহান সব বুঝেও জবাব দিতে পারে না। তার কাছে তো মোটা অংকের টাকা নেই, নেই অর্থবিত্ত আর প্রাচুর্যের অহংকার! যা আছে তা নিরেট সততা। প্রয়োজনে নিজে না খেয়ে বোনকে খাওয়াবে, তবুও কখনো বো’ঝা ভাববে না।

*****

পারিবারিক এই দ্ব’ন্দ্ব আর ঝামেলায় বড্ড অশান্তিতে পড়েছে অনিক। চুপ থাকা যাচ্ছে না, আবার ভাইয়ের বিরুদ্ধেও যাওয়া যাচ্ছে না। যুক্তির এটাই যে, ফারজানাকে অনুতপ্ত হতে দেয়া। যদি সে ক্ষমা চেয়ে ফিরে আসে তবে আলিফ কোনোভাবেই তাকে ফিরিয়ে দিবে না। এদের দু’জনের ভালোবাসার গভীরতা তার দিব্যি জানা আছে। সহ্যের সীমা যখন ছাড়িয়ে গিয়েছিল, তখনই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে। একরকম বাধ্য হয়েই ভালোবাসার মানুষটিকে ঘরছাড়া করেছে তার ভাই।

রাত্রি তখন গভীর। এপাশ-ওপাশ করেও ঘুম আসছে না অনিকের। নানারকম দুঃশ্চিন্তা, ব্যথা-বেদনা ভর করছে মনে। এই সময়ে কাছের মানুষটাকে বড্ড প্রয়োজন হয়। অস্থির, অশান্ত মনকে সান্ত্বনা দিতে প্রিয়জনের সান্নিধ্য খুব বেশিই জরুরী। এই মুহূর্তে সে-ও প্রিয়জনের অভাব টের পেল। এত সমস্যা, এত দ্ব’ন্দ্বের ভার আর নেয়া যাচ্ছে না। শান্তির ঘুম দরকার, বিশ্রাম দরকার, অথচ তার সেটাও নেই আজকে। অনেকক্ষণ চোখ বন্ধ করেও ঘুমকে দু’চোখে টে’নে আনতে পারলো না। বুকের ভেতর ফাঁকা অনুভব করলো সে। মনে হলো, এই ফাঁকা জায়গাটায় যদি কেউ মাথা রাখতো তবে হয়তো শান্তিতে ঘুমোতে পারতো। অসময়ে মাইসারাকে বিরক্ত করতেও ইচ্ছে করছে না। সারাদিন দৌড়ঝাঁপ করে মেয়েটা নিশ্চয়ই ক্লান্ত!

নানা ভাবনার জা’ল ছিঁড়’লো ফোনের হুটহাট রিংটোনে। হাত বাড়িয়ে ফোন কাছে এনেই থমকে গেল দৃষ্টি। ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে দেখলো রাত প্রায় দুটো। এতরাতে মাইসারার ফোন! কোথাও কোনো বিপদ হলো না তো! এমনিতেও যা পরিস্থিতি, তাতে মন ভালো কিছু ভাবতেই পারছে না। বুকের ভেতর কাঁপন শুরু হলো তার। ঝটপট তা রিসিভ করে বলল,

-“তুই ঠিক আছিস সারা? কোথাও কোনো অসুবিধা হয়নি তো! আমি কি আসবো?”

এমন আবেগঘন কথা আর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ দেখে ওপাশে নীরব হয়ে গেল মাইসারা। মাত্রই ও.টি শেষ করে এসেছে। সারাদিনে অনিকের সাথে কথা হয়নি আর। হসপিটালে এতটাই ব্যস্ততা যে কাছের মানুষদের খোঁজ নেয়ারও সময় পাওয়া যায় না। নিজের জন্যই দু’দণ্ড সময় মিলে না, আবার অন্যের জন্য সময় বের করে তার খোঁজখবর নেয়া! দায়িত্ব, কর্তব্য হোক কি সম্পর্কের সম্মানেই হোক মাইসারার মনে হলো, কাজের ফাঁকে হলেও দু’মিনিটের জন্য এই মানুষটাকে কল করা উচিত ছিল তার। যদি সময়ে সময়ে খোঁজ-খবর নিত তবে অসময়ের এই ফোন তাকে ঘাবড়ে দিত না। অনিকের মনের অবস্থা যেন মুহূর্তের আয়ত্তে আনলো সে। ফোন কানে ঠেকিয়েই বলল,

-“আমি একদম ঠিক আছি। সারাদিন খুব ব্যস্ত ছিলাম, তাই আর ফোন করতে পারিনি। এইমাত্র ফ্রি হলাম। তাই ভাবলাম, রাতে খেয়েছো কিনা খোঁজ নেই!”

যত দুঃশ্চিন্তা মনের ভেতরে এসে হুট করেই ভেতরটা নাড়িয়ে দিয়েছিল, মাইসারার এই সামান্য কথাতে সব দুঃশ্চিন্তা ঝ’ড়ো হাওয়ার মতো সুদূরে পালিয়ে গেল। ফোন কানে রেখে পিঠে বালিশ ঠেকালো অনিক। বিড়বিড় করে বলল,

-“ঘুম আসছে না সারা! অনেকক্ষণ ধরে জেগে আছি। শূন্যতা এসে ভর করেছে বোধহয়। কেউ যদি মাথায় বুলিয়ে দিত, ঘুম পাড়িয়ে দিত, হয়তো একটু শান্তিতে ঘুমোতে পারতাম। অথচ সেই কেউ’টাই অনেক দূরে! এতটাই দূরে যে, চাইলেও ছুটে যাওয়া যাবে না। কাছে টানা যাবে না, আগলে নেয়া যাবে না। দূরত্বের কাছে অনুভূতিগুলো হেরে গেল তাই না!”

-“তুমিই তো বলেছিলে, এই দূরত্বটা ক্ষণিকের! একদিনেই যদি এই অবস্থা হয়, তবে এতগুলো মাস আমি এখানে থাকবো কী করে?”

অনিক জবাব দিল না। তখন বুঝেনি, এই মেয়েটা আর অস্তিত্বে কতখানি মিশে আছে। তার নীরবতা দেখে ওপাশে আলগোছে চোখের পানি মুছলো মাইসারা। এই মানুষটা তাকে এতটাই ভালোবাসে যে, তার কোনো সীমা পরিসীমা সে খুঁজে না পেলেও অনুভূতির গভীরতা ঠিকই উপলব্ধি করতে পারছে। কণ্ঠ নামিয়ে শান্তস্বরে বলল,

-“রাত জেগো না, অসুস্থ হয়ে পড়বে!”

-“তোকে খুব মিস করছি সারা।”

-“যে মনের গভীরে থাকে, তাকে তো মানুষ সবসময়ই মিস করে! আমি খুব ভাগ্যবতী যে তোমাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছি। যখন তুমি আমার ভরসা হয়েছো, আমাকে এতটা দূরে সরিয়ে গন্তব্য স্থির করে দিয়েছো, তখন আমাকে দুর্বল করে মাঝপথে সব থামিয়ে দিবে? এভাবে চলতে থাকলে এখানে থাকা আমার জন্য কষ্টকর হয়ে যাবে।”

-“আচ্ছা, রাখছি। ঘুম প্রয়োজন।”

-“রাগ করলে?”

অভিমানে যে কথাখানি বলে ফোন রাখতে চেয়েছিল অনিক, মাইসারার কথা শুনে তা আরও দ্বিগুণ হয়ে চাপলো বুকে। কথার কোনো জবাব না দিয়ে ফোন কে’টে দিল সে! ওপাশে মাইসারা থমকে গেল অনিকের এমন আচরণে! যে মানুষটা সামনে থাকা সত্ত্বেও আবেগকে প্রশ্রয় দেয়নি, অনুভূতি প্রকাশ করেনি, দূরে আসাতে সেই মানুষটাই এখন ছেলেমানুষী করছে। মানুষের মন বড্ড অদ্ভুত, ক্ষণে ক্ষণে অস্থির হয় আবার শান্তও হয়। মাইসারার মনে হলো, অনিককে শান্ত করার জন্য ছোট্ট একটা কথা বলা জরুরী। এইভেবে পুণরায় ফোন করলো সে। অভিমানে প্রেমিক তার মনকে শক্ত করে নিয়েছে, তাই ফোন করে নিজেকে আর দুর্বল প্রমাণ করবে না সে। যথাসম্ভব ইগনোর করে ফোন সাইলেন্ট করে বালিশে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। খেয়াল করলো না, অর্ধাঙ্গিনী তাকে স্বান্তনা দিতে কী চমৎকার অনুভূতির প্রকাশ ঘটিয়েছে। অভিমান তার এতটাই গাঢ় হলো যে, ভুল করেও ফোনের দিকে হাত বাড়ালো না আর। নয়তো এই ম্যাসেজটা শত যন্ত্রণা আর অশান্তির একটুখানি প্রশান্তি হতে পারতো! বুঝতে পারতো, শুধু একাই সে বিরহকে সঙ্গী করে সময় অতিবাহিত করছে না, ওপাশের মানুষটাও নিঃসঙ্গ মুহূর্তটাকে উপেক্ষা করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে!

চলবে…

❝মনোহারিণী❞
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
পর্ব : (১৪)

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ!)

আমি তোমারি বিরহে রহিব বিলীন, তোমাতে করিব বাস–
দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী, দীর্ঘ বরষ-মাস ।

খুব ভোরে ঘুম ভাঙলো অনিকের। মোবাইল হাতে নিয়ে সময় দেখতে গিয়েই চোখদুটো কুঠরে ঢুকে গেল তার। বেশ কয়েকবার ম্যাসেজের উল্লিখিত লাইনগুলো আওড়ে গেল। বাংলায় বিরহের কোনো ঋতু আছে কি? নির্দিষ্ট কোনো ঋতু? যা শুধু দুঃখজনক অনুভূতির প্রকাশ ঘটায়। ক্যালেন্ডারের পাতা অনুযায়ী তো এখন বর্ষার সিজন। বৃষ্টিবাদলের দিনে কোথায়, বাদলা দিনের একগুচ্ছ কদমফুল কিংবা কৃষ্ণচূড়ার রাঙা লাল টুকটুকে রঙ মেখে এক লাইন, দুই লাইন রোমান্টিক ছন্দ সাজাবে; তা না করে একরাশ বিরহ প্রকাশ করে দুটো লাইন লিখেই বুঝিয়ে দিল, সদ্য প্রেমে পড়া তরুণী প্রেমে পড়ার পরপরই বিরহে নিপতিত হয়েছে। তার বিরহের ঔষধ যে, তাকেই ছন্দ পাঠিয়েছে। যেন সে বুঝতে পারে, সময়টা নিঃসঙ্গ কাটছে। মনের অজান্তেই বিড়বিড় করলো অনিক,

-“আমার বউটা পাগ’ল হলো কবে?”

হুট করেই দুষ্টু বুদ্ধি চাপলো মাথায়। সকাল সকাল মাইসারাকে ক্ষ্যা’পিয়ে দিতে পারলে মন্দ হয় না। দেরী না করে দ্রুত ডায়াল করলো প্রিয়তমার নাম্বারে। খানিকক্ষণ বাজার পরই রিসিভ হলো তা। ঘুম ঘুম চোখেই সালাম দিয়েই আটকে গেল মাইসারা। মুখের উপর জবাব দিয়ে ঝটপট বলল,

-“এখানে সারা নামে কেউ থাকে? নিশ্চিত মেয়েটার মাথার স্ক্রু সব ঢিলা হয়ে গেছে। নয়তো প্রেম-ভালোবাসার অনুভূতি জন্মানোর আগেই বিরহ এসে মনে ভর করলো কেন?”

রীতিমতো শকড হলো মাইসারা! সকাল সকাল এই ছেলেটা তাকে পাগ’ল সাজিয়ে দিল। চোখ টেনে টেনে ঘুম ঘুম ভাবটাকে দূরে সরানোর চেষ্টা করলো সে। অনিক আবারও বলল,

-“এইযে হ্যালো, যিনি ফোন রিসিভ করেছেন তাকে বলছি, আমার বউয়ের যদি ঘুম ভা’ঙে তাকে বলে দিবেন, ভুল করেও এমন বিরহমার্কা ম্যাসেজ যেন সে আর না পাঠায়। নইলে সোজা তুলে নিয়ে আসবো। আর দূরে পাঠাবো না।”

মাইসারা টের পেল তার কানে ভোতা ভোতা শব্দ হচ্ছে। একেই তো রাতে ভালো ঘুম হয়নি, তার মধ্যে সকালবেলাই এমন রম্যরচনার সূচনায় কথার খেই হারিয়ে ফেললো সে। চুপচাপ বসা ছাড়া কোনো জবাবও খুঁজে পেল না। অনিক ঠোঁট চেপে হাসি আটকে বলল,

-“কী হলো, কথা আটকে গেল কেন?”

-“তোমার বউয়ের ঘুম পাচ্ছে। আপাতত সে আধোঘুমে কথা শুনছে। উল্টোপাল্টা কথার ধরন দেখে সে বুঝে গেছে, বিরহের চাপে পড়ে তোমার বউ না তোমারই মাথার স্ক্রু সব খুলে গেছে। আমারটা তা-ও ঢিলা হলেও খসে পড়েনি। ঠিক জায়গায়ই আছে!”

-“বাপরে! রাগ তো দেখি নাকের ডগায় নিয়ে ঘুরছিস! এমনভাবে রাগ ঝাড়ছিস যেন কোনো পরপুরুষকে ইচ্ছামতো ধুয়ে দিচ্ছিস!”

-“উল্টোপাল্টা কথা বলে রাগটা তুমিই বাড়িয়ে দিয়েছো। সকাল সকাল মাথা ন’ষ্ট!”

-“আচ্ছা, তাহলে রাগ ভা’ঙাবো কীভাবে? কোনো ওয়ে আছে? থাকলে বল, দেখি চেষ্টা করে!”

-“রাতে মুখের উপর ফোন কে’টে দিয়েছো, সেজন্য খুব রেগে আছি৷ এখন একদফা বকাঝকা করে মেজাজ ঠাণ্ডা করবো। আপাতত কানে তুলো দিয়ে বকা শুনো। মেজাজ ভালো হলে পরে বাকি কথা হবে!”

সামান্য একটু দুষ্টামি করতে গিয়ে এইভাবে ফেঁ’সে যাবে ভাবেনি অনিক। রাতে ওভাবে ফোন রেখে দেয়া উচিত হয়নি তার। নিশ্চিত মেয়েটা কষ্ট পেয়েছে তার ব্যবহারে। এজন্যই এত বেলা অবধি ঘুমাচ্ছে। হয়তো দুঃশ্চিতার ভারে ঠিকঠাক ঘুমাতে পারেনি রাতে। চোখমুখ কুঁচকে আবারও ব্যা’ঙ্গাত্মক স্বরে বলল,

-“শা’লা’র এমন একটা বউ জুটলো কপালে, দুই লাইন রোমান্টিক কথা বলে মুহূর্তটা সুখে ভরিয়ে দিবে, তা নয় সে এখন বকা দেয়ার প্রিপারেশন নিচ্ছে। তুই থাক তোর বকাঝকা নিয়ে, আমি অফিস গেলাম। সারাদিনে আর একবারও বিরক্ত করবি না।”

শুরু হলো ননস্টপ ঝগড়া। অফিস যাবে বলে ফোন রাখতে চেয়েও কানে চেপে কথার ফুলঝুরি খুলে বসলো অনিক। একজন আরেকজনকে ইচ্ছামতোই কথা শুনাচ্ছে। কেউ হার স্বীকার করতে রাজি নয়। দু’জনের মতে, দু’জনার দোষ। একা একজন কেন দোষের ভাগিদার হয়ে ভুক্তভোগী হবে। তার চেয়ে হা’ড্ডাহা’ড্ডি লড়াই চলুক, যথা সময়ে দেখা যাবে বিজয়ীর খাতায় কার নাম যোগ হলো!

*****

নাহিয়ান মোটামুটি সুস্থই বলা চলে। জ্বর নেমেছে পুরোপুরি তবে শরীরের দুর্বলতা কমেনি। অল্পকিছু খাবারও ঠিকঠাক খেতে পারছে না। যা খাচ্ছে, বমির সাথে সবকিছুই উগড়ে দিচ্ছে। আগের তুলনায় নিশ্চুপ হয়ে গেছে সে। বাবা-মায়ের ঝগ’ড়াঝাটি আর মান-অভিমানের সন্ধিক্ষণ কিঞ্চিৎ হলেও তার ছোট্ট মনকে প্রভাবিত করেছে। গুটিসুটি মে’রে বিছানার মাঝখানে শুয়ে রয়েছে। ফারজানা পাশে বসেই ছেলের মাথায় হাত বুলাচ্ছে। একটা সময় মায়ের দিকে তাকালো নাহিয়ান। অভিযোগের সুরে বলল,

-“বাড়ি চলো আম্মু। এখানে ভালো লাগছে না।”

বুকফাটা আর্ত’নাদ ঝেঁকে বসলো তার অন্তর জুড়ে। তবু কাঁদতে পারলো না, কিছু বলতেও পারলো না। আলতো করে ছেলের কপালে চুমু খেয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে নিল। চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,

-“যাব! তুমি সুস্থ হও, তারপর।”

-“এখানে তো আমার ভালো লাগছে না। নানু সারাক্ষণ তোমাকে ব’কে। বাবার কাছে থাকলে কেউ তোমাকে বকবে না আর। চলো না আম্মু, যাই।”

-“তুমি তো এখন অসুস্থ সোনা, আগে সুস্থ হও। বাবা এসে নিয়ে যাবে তোমাকে।”

ফারজানার মনে হলো, এই মুহূর্তে মিথ্যে স্বান্তনাটাই ছেলেকে চুপ করানোর একমাত্র মাধ্যম। সে যেতে চাইলেও আলিফ যে পুনরায় তাকে গ্রহণ করবে তার তো কোনো গ্যারান্টি নেই। যতখানি অন্যায় সে করেছে সবার সাথে তার শোধ না তুলে, পর্যাপ্ত শা’স্তি না দিয়ে মুখও দেখতে চাইবে না। কী সুন্দর জীবন ছিল তার! হাসিখুশি সংসার ছিল! ছিল সে জীবনে চাওয়ার চেয়েও অতিরিক্ত পাওয়া। তবুও সে তার মূল্য দিতে পারলো না। গোটা জীবন সবার অভিশা’প, লাঞ্চনা আর অপ’মান নিয়েই কাটিয়ে দিতে হবে তাকে। এখন তো পাড়াপ্রতিবেশি কেউ কিছু জানে না, যখন জানবে ধীরে ধীরে তার প্রত্যেকটা তীক্ষ্ণ কথার আঘা’ত এসে নাহিয়ানের ছোট্ট মনকে বি’ষিয়ে দিবে। তাছাড়া সুস্থ হওয়ার পরই যদি আলিফ তার বাচ্চাকে জো’র করে নিয়ে যেতে চায়, তখন সে কী করবে? সবকিছু ছেড়ে দেয়া যায় কিন্তু মা হয়ে নাড়িছেঁড়া ধনকে কীভাবে ছাড়বে সে? পারবে না তো এই কঠিন সত্যির মুখোমুখি হতে। এসব ভুলভাল ভাবতে ভাবতেই অদ্ভুত এক সিদ্ধান্ত নিল ফারজানা। নিজের সুক্ষ্ম চিন্তাভাবনা নিজের কাছেই গচ্ছিত রাখলো সে। আপাতত নাহিয়ান সুস্থ হোক, পরবর্তী পদক্ষেপ সে পরেই নিবে। এখন কোনো তাড়াহুড়োর প্রয়োজন নেই। আগে দেখবে নাহিয়ান সুস্থ হওয়ার পর আলিফ ঠিক কতটা ছটফট করে তার বাচ্চার জন্য।

স্কুল থেকে ফিরে বাড়ির আঙিনায় হাঁটাহাঁটি করছে আলিফ। ত্বোয়া সেই তখন থেকে ভাইকে লক্ষ্য করছে। কারও সাথে কথা বলছে না, কাউকে নাহিয়ান কিংবা ফারজানার কথাও জিজ্ঞেস করছে না। হাঁটতে হাঁটতেই একটা সময় পুকুরপাড়ে গিয়ে বসলো সে। ফোনের গ্যালারি ওপেন করে নাহিয়ানের দুষ্টু মিষ্টি সবক’টা ছবিতে চোখ বুলালো। এমন হাসি হাসি মুখ দেখলে যে কারও অন্তরে প্রশান্তির বাতাস বয়ে যাবে। আর সে যদি হয় রক্তের টান, তবে তো কথাই নেই। দূর থেকে ত্বোয়া আবিষ্কার করলো, ক্ষণে ক্ষণে চোখের জল মুছছে আলিফ। বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে তার, হাসিখুশি থাকা মানুষটাও আজ প্রিয়জনদের শূন্যতাতে কাঁদতে বাধ্য হচ্ছে। সাহস নিয়ে দু’পা এগিয়ে গেল সে। পুকুরপাড় চারপাশটাই পাকা, বসবার সিঁড়ি আর ব্রেঞ্চও আলাদা ইট-সিমেন্টের তৈরী৷ এখানে বসে প্রকৃতির এক সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করা যায়। দু’চোখে মুগ্ধতা খুঁজে নেয়া যায়।

কিছুক্ষণ চুপচাপ ভাইয়ের পাশে বসে রইলো সে। আলিফ টের পেল না প্রথমে, পরক্ষণেই চোখ পড়তেই ঝটপট নিজেকে সামলে নিল। মোবাইলটা প্যান্টের পকেটে রেখে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল,

-“কিছু বলবি?”

-“নাহিয়ানের সাথে কথা বলছো না কেন! ওর তো কোনো দোষ নেই। বিনা দোষে বাচ্চাটা শা’স্তি পাচ্ছে ভাইয়া। নিয়ে এসো দু’জনকে। এভাবে ঘরের বউ পরের বাড়িতে কয়দিন থাকবে? যতই বলো, এই বাড়িটাই ভাবীর সবকিছু। একটা সময় তো ভাবী সব দায়িত্বই ঠিকঠাক পালন করেছে। মানুষ তো ভুল করে, হয়তো সে-ও না বুঝে ভুল করেছে। সবকিছু ভুলে আবারও ঘরটাকে আগের মতো করে নাও-না। ঘরটা কেমন প্রাণহীন ধুধু মরুভূমির মতো হয়ে গেছে। এভাবে বেশিদিন চলতে থাকলে, প্রাণ থাকা সত্ত্বেও প্রাণী মৃ’ত্যুর দিকে এগিয়ে যাবে। আগের কথা ভেবে তার ভুলটা ক্ষমা করে দাও ভাইয়া। নিয়ে এসো ভাবীকে। ঘরের কর্ত্রী না থাকলে ঘর নিঃস্ব হয়ে যায়! প্লিজ…!”

নির্লিপ্ত চাহনি আলিফের। ভাবলেশহীন। নীরব, নিস্তব্ধ। কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল,

-“ভাইয়ের থেকে ভাবীর প্রতি ভালোবাসাটা বেশিই প্রকাশ পাচ্ছে! অথচ তোর ভাবী তোদের সাথে খারাপ ব্যবহার করতো।”

-“আমাদের তো তা নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই। কখনো নালিশও করিনি তোমার কাছে। তাকে সম্মান করি, ভালোবাসি দেখেই তার একটু একটু রাগ হজম করি। একটা সংসার সামলে রাখা অনেক কঠিন। হয়তো এই কঠিন চাপটা তার ভাবনাচিন্তার মধ্যে বিস্তর ফারাক তৈরী করেছে। যার কারণে ঠিক-ভুলের হিসাব না কষে খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছে। মাঝেমধ্যে আমিও তো ঝগ’ড়া বাঁধিয়ে ফেলতাম। সংসারে এমন টুকরো টুকরো ঝা’মে’লা হয়েই থাকে। তাই বলে সংসার ভে’ঙে দেয়া যুক্তিযুক্ত নয় ভাইয়া। তাকে বুঝাতে হবে, ক্ষমা চাওয়া কিংবা উপলব্ধি হওয়ার সময়টা তাকে দিতে হবে, কোনো সুযোগ না দিয়ে একতরফা অবিচার করো না তার উপর!”

আলিফ এবারও নিশ্চুপ। সবার চিন্তাভাবনা আর মতামতের যুক্তি সে দেখছে অথচ তার ভেতরটা কেউ দেখছে না। বিশ্বাস ভা’ঙার যন্ত্রণা সে কাকে বুঝাবে! কে বুঝবে সে ঠিক কতটা ভে’ঙে গুড়িয়ে গেছে প্রিয়জনের এই হুটহাট পরিবর্তনে। ফারজানার এই রূপ, এই আচরণ তার ভেতরে যতখানি ঝ’ড় তুলেছে, তার ক্ষ’তির পরিমাণটা কেবল সে-ই উপলব্ধি করছে; আর কেউ না।

*****

ব্যস্ততা পুরোপুরি ঝেঁকে ধরলো মাইসারাকে। সারাদিন ডিউটি করা, রোগীদের পিছনে সময় দেয়া, স্যারদের সাথে ফাঁকে ফাঁকে ও.টিতে যোগ দেয়া, নানারকম পেরেশানিতে সময় অতিবাহিত করছে সে। সময় যাচ্ছে তার হিসাবের দিন শেষ হচ্ছে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে যতটুকু পারছে অনিকের খোঁজ নিচ্ছে। একদিন ফোন কিংবা ম্যাসেজ না করলেও দেখা যাচ্ছে রেগে বম হয়ে যাচ্ছে অনিক। মাঝেমধ্যে তার এই আচরণে ভীষণ হাসি পায় মাইসারার। সাহস করে দূরে পাঠিয়ে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু সময়ের যাতাকলে পি’ষ্ট হয়ে সে বুঝতে পারছে দূরত্ব কতখানি ব্যকুল করে মনকে।

ডিউটি শেষে রুমে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলো মাইসারা! তখন কেবল সন্ধ্যা হয়েছে মাত্র। ব্যস্ত শহরের ছুটে চলা উপভোগ করছে সে। যান্ত্রিক এই শহরে রোজ রোজ কত মানুষের যাতায়াত চলে। কত মানুষ হাসে, কত মানুষ কাঁদে, কেউ ফিরে পায়, কেউবা হারায়, আবার কেউ একাকীত্বকেই আপন করে দিন অতিবাহিত করে। মানুষের চলাফেরার এই নিত্যনতুন দৃশ্য তাকে ভীষণ ভাবায়। বুঝতে শেখায়, কতকিছু উপলব্ধি করায়। একাকী ভাবনায় বিভোর ছিল সে। ফোনের অবিরত রিংটোন তাকে বুঝিয়ে দিল ওপাশের মানুষটার ধৈর্যের বাঁ’ধ ভে’ঙে যাচ্ছে। রিসিভ না করলে নির্ঘাত রাগ করে গাল ফুলিয়ে বসে থাকবে। অনিকের এই বাচ্চাবাচ্চা কাণ্ডকারখানা ভীষণ আনন্দ দেয় তাকে। বুঝিয়ে দেয়, এক জীবন মানুষ ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত হয়ে গেলেও এই মানুষটা ভালোবেসে কখনও ক্লান্ত হবে না। রিসিভ করা মাত্রই ওপাশ থেকে রীতিমতো আদেশ করলো অনিক। চড়াগলায় বলল,

-“আমি রোজ ভিউ’তে আছি। আধঘণ্টা সময় দিলাম। দ্রুত তৈরী হয়ে চলে আয়!”

-“মানে!”

বিস্মিত চোখে প্রশ্ন করলো মাইসারা। সে এখনো অনিকের কথা বুঝতে পারছে না। এই ভর সন্ধ্যে বেলায় পাগ’ল প্রেমিক সিলেট চলে এসেছে! এই ব্যাপারটা মাথায় পুরোপুরি ঢুকছে না তার। হজম করতেও বেশ খানিকটা বেগ পেতে হলো তাকে। অনিক আবারও বলল,

-“আসবি কি না? না আসলে বল তুলে নিয়ে আসি! পরে যদি লোকজন কিডন্যা’পার ভাবে বাঁচানোর দায়িত্ব কিন্তু তোর। অসময়ে নিজের মানুষকে চুরিডা’কাতি করতে চাইছি না।”

মাইসারার মাথা পুরো ফাঁকা হয়ে গেল। মাত্র কয়েকটা দিনে এরকম পাগ’লামি করতে পারে অনিক, সেটা ভাবেওনি আগে। এই মুহূর্তে হোস্টেল থেকে বের হওয়াটাও তো মুশকিল। তার নীরবতা দেখে রেগে গেল অনিক। বলল,

-“আসবি না তো? ঠিক আছে। আসতে হবে না। আমি চলে যাচ্ছি। ভাবলাম দুটো দিন ছুটি পেলাম যখন, তখন এই সময়টা একসাথে উপভোগ করি। কিন্তু তুই তো বিরাট ব্যস্ত! ব্যস্ত ডাক্তারদের কারও জন্য দু’মিনিট সময় আছে নাকি। তুই এখনো অতীত থেকে বেরোতে পারিসনি তাই না? আমি এত চেষ্টা করছি সবকিছু স্বাভাবিক করার তা-ও পারছিস না! তোকে আর পারতে হবে না সারা।”

এ পর্যায়ে চুপ করে গেল অনিক। তার মনে হলো অযথাই বকবক করছে সে। এসেছিল হুট করে মাইসারাকে চমকে দিতে। অথচ তার নীরবতাই তাকে দ্বিগুণ চমকে দিয়েছে। কোথাও সে ভুল পথে অনুভূতির বিসর্জন দিল না তো? নয়তো এত চেষ্টার পরেও কেউ কীভাবে নিশ্চুপ থাকতে পারে। যা বুঝার তা বুঝা হয়ে গেছে তার। রাখছি বলে ফোন কা’টতে চাইলো সে। ওপাশ থেকে মাইসারা দ্রুত জবাব দিল,

-“আমি আসছি। একটু অপেক্ষা করো!”

এমন ভয়া’নক কণ্ঠস্বর শুনে অজান্তেই কেঁপে উঠলো মাইসারা! এই মানুষটাকে ফিরিয়ে দেয়ার সাধ্য তো তার নেই। তড়িঘড়ি করে তৈরী হলো আগে। হাতের সামনে কূর্তি পেয়ে সেটাই পরে দ্রুত বেরিয়ে পড়লো। বের হওয়ার পথেই রিপার সাথে দেখা হলো তার। এভাবে তাকে তাড়াহুড়ো করে ছুটতে দেখে বলল,

-“অসময়ে কোথায় ছুটছিস তুই?”

-“আমার যাওয়া উচিত! রাতটা একটু সামলে নিস প্লিজ। রাতে ফিরবো কিনা ঠিক নেই!”

রিপা এবার ঘাবড়ে গেল। ভয়ে, আত’ঙ্কে চোখদুটো বড়ো বড়ো হয়ে গেল তার। ভীতিগ্রস্ত চোখমুখ নিয়ে জানতে চাইলো,

-“ফিরবি না মানে! যাচ্ছিস কোথায় সেটা অন্তত বলে যা।”

-“অনিক এসেছে!”

দৌড়ের উপর জবাব দিল মাইসারা। পিছনে ফিরে তাকালো না আর। তার এই দৌড়ঝাঁপ দেখে মুচকি হাসলো রিপা। বুঝতে পারলো, দাম্পত্য সম্পর্কের দায়িত্ব, কর্তব্য আর অনুভূতি কতখানি প্রখর! মাইসারার এই ছুটে যাওয়াই বুঝিয়ে দিচ্ছে, অগোচরে সে-ও সুপ্ত অনুভূতিকে ঠাঁই দিয়ে ফেলেছে মনে। যা অতি পবিত্র, সুন্দর, স্বচ্ছ। নির্ভেজাল এক অনুভূতি, যা কেবল একজনের জন্যই লুকায়িত থাকে অন্তরে! মাইসারা হয়তো নিজেও টের পায়নি, গোপনে সে কতখানি জড়িয়ে গেছে অনিকের সাথে। তাইতো সবকিছুকে উপেক্ষা করে প্রিয়জনের ডাকে সাড়া দিতে ছুটে যাচ্ছে সে। অভিমানের কাছে কখনো অনুভূতিকে হারতে দিতে চায় না কেউ, সে-ও দিবে না। অনুভূতিকে জাগিয়ে তুলতেই হুটহাট ডাকে ছুটে যাওয়া। বুঝিয়ে দেয়া, তারা একে-অন্যকে কতখানি মূল্যায়ন করে।

*****

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে