মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি ২ পর্ব-৮+৯

0
733

#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৮

রাতের শেষ প্রহর তখন। আরামদায়ক তুলতুলে বিছানায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ষাটোর্ধ্ব আজগর সাহেব। জাগতিক সকল প্রকার ভাবনা তখন হারিয়ে। আকস্মিক সারা ঘর জুড়ে ধ্বনিত হতে লাগলো ফোনের কর্কশ ধ্বনি। তবে গভীর নিদ্রায় মগ্ন লোকটি তা টের পেল না। একবার, দু’বার, তিনবার রিংটোন বেজে গেল। ঘুমের ঘোরে বিরক্তিকর অভিব্যক্তি প্রকাশ করলেন আজগর সাহেব। চতুর্থবারের মতো কর্কশ ধ্বনি বেজে উঠলো। এবার মস্তিষ্ক ও শ্রবণেন্দ্রিয় দুয়েতেই পৌঁছালো সে শব্দ। ভঙ্গ হলো নিদ্রা। মনে মনে বি শ্রী গাল দিয়ে ঘুম ঘুম চোখ মেলে তাকালেন। ঘুমের ঘোরে বোধগম্য হচ্ছে না কিছুই। শুধু একটি কর্কশ বিরক্তিকর শব্দ শুনতে পাচ্ছেন। ঘোরের মাঝেই হাতড়ে বালিশের ডান পাশে খুঁজতে লাগলেন শব্দের উৎস। অবশেষে হাতের নাগালে মিললো মোবাইল। কলার আইডি না দেখেই রিসিভ করলেন আজগর সাহেব। ভ”য়ানক একটি গাল দিয়ে বললেন,

” তোর কোন মায়ে ম-রছে রে যে এত রাতে আরেক জনকে ডিস্টার্ব করছিস? ”

লহমায় ওপাশ হতে জানা গেল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত সংবাদ! মূহুর্তের মধ্যেই পলায়ন করলো সবটুকু নিদ্রা। আতঙ্কিত আজগর সাহেব দ্রুত উঠে বসলেন। হিমশীতল ঘরে বসেও ঘেমে যাচ্ছেন উনি। অ্যাডামস্ অ্যাপল নড়েচড়ে উঠছে। দুর্বল হয়ে পড়ছে স্নায়ু। মাথার ওপর ঘুরতে থাকা ফ্যানটি যেন বি-ষধর সাপের ন্যায় আষ্টেপৃষ্ঠে পেঁচিয়ে ধরছে। রূদ্ধ হয়ে আসছে শ্বাস-প্রশ্বাস। ভোঁ ভোঁ করছে মাথার ভেতর। দমবন্ধকর অবস্থা থেকে কোনোমতে পরিত্রাণ পেয়ে উনি চেঁচিয়ে উঠলেন,

” অ্যাই! এসব কি বলছিস তোরা? ”

হাতের উল্টো পিঠে গলদেশের ঘাম মুছে,

” ওখানে। ওখানে দুই কোটি টাকার মাল ছিল। এ কি সর্বনা’শ করলি তোরা! ”

কণ্ঠে অসীম ভীতি। যেন ছোটোখাটো হরিণ শাবক আজ ভ-য়ঙ্কর বাঘের আগ্রাসী সত্তার মুখোমুখি। যেকোনো মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়বে মাং-শাসী বাঘ। কা’মড়ে ছিঁ’ড়ে খাবে শরীরের প্রতিটি ভাগ।

” তোদের জ্যা ন্ত কবর দেবে ‘ও’। কাউকে ছাড়বে না। ”

ফিসফিসিয়ে আনমনে বলে উঠলেন ভীত লোকটি। ওপাশে থাকা ব্যক্তি তা শুনলো কি? বোধহয় না। ভিন্ন কিছু বলতেই বিরক্তি প্রকাশ করলেন আজগর সাহেব,

” উফ্! ফোন রাখ বলছি। রা**কেল এর দল! ”

চিন্তায়-দুশ্চিন্তায় সংক্রমিত হয়ে গর্জে উঠলেন ষাটোর্ধ্ব আজগর সাহেব। ছিটকে মোবাইল ফেলে দিলেন বিছানায়। কি থেকে কি করবেন। কি বলে সাফাই দেবেন। ‘ও’ যে ছাড়বে না কাউকে। এতবড় অপরাধের দায়ে সব কয়টা’কে শেষ করে দেবে। ওহ্! যন্ত্রণায় ছটফটিয়ে উঠলেন আজগর সাহেব। মস্তিষ্কে ট’গবগ করে ফুটছে গরম লাভা। এবার? কি হবে এবার!

পূর্ব দিগন্তে সরু একফালি আলোক রেখা। আঁধারিয়া রজনী দূরীকরণ হয়ে একটু একটু করে আলোকিত হচ্ছে বসূধা। শ্রবণেন্দ্রিয়ে পৌঁছাচ্ছে বিহঙ্গের শ্রুতিমধুর কলরব। আপনাআপনি নিদ্রা ভঙ্গ হলো মেয়েটির। নিদ্রা দূরীকরণে সোজা হয়ে শুয়ে রইলো কিছু মুহূর্ত। অতঃপর হাই তুলে আড়মোড়া ভেঙে বাম পাশে তাকাতেই হলো আশ্চর্যান্বিত! রাহি ভাইয়া! হাঁ। তাই তো দেখা মিলছে চোখের পর্দায়। ওর পানে কাত হয়ে ঘুমিয়ে ছেলেটি। সহসা মানসপটে ভেসে উঠলো গতকালের সেই স্মরণীয়, মধুরতম মুহূর্ত। তাদের বিবাহের মুহূর্ত। স্বপ্ন নয় এ যে তার অতি আকাঙ্ক্ষিত সত্যি! তিন কবুল বলে এক হালাল, প্রগাঢ় বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে তারা‌। মুহুর্তের মধ্যে চোখের কোলে জমলো অশ্রুবিন্দু। তার হৃদয়ে লুকানো অনুভূতি কোনো নামমাত্র আবেগ নয়। সে সত্যিকার অর্থেই মন হারিয়েছে এ মানুষটির তরে। বিনিময়ে কিচ্ছুটি আশা করেনি। এই যে আজ এই মুহূর্তে তার পাশে শায়িত মানুষটি। এ তো তার স্বপ্নে দেখা মুহুর্ত। তাদের খুনসুটিময় ছোট্ট এক সংসার রোজ উদিত হতো ঘুমের ঘোরে। সেথায় শুধু তারা। রাহি ও তার ইনু। মিলেমিশে, আদরে ভালোবাসায় এক আকাশসম সুখের ভেলায় ভেসে চলেছে তারা। তার স্বপ্নে দেখা সুখ বুঝি বাস্তবে ধরা দিতে চলেছে! নাকি দমকা এক হাওয়ায় ছিন্নভিন্ন হবে স্বপ্নটি!

উজ্জ্বল মুখশ্রীতে কালো মেঘের দেখা মিললো। একটু আগের ঝলমলে চেহারা এখন কালো রঙে ছেয়ে। বড় ভয় হচ্ছে। একতরফা ভালোবাসা তার জন্য অসীম দুঃখ না বয়ে আনে! দুঃখময় ভাবনা উদয় হতেই অধর কা’মড়ে কেঁদে উঠলো মেয়েটা। নিজেকে সামলাতে দ্রুত উঠে বসলো। পা নামালো জমিনে। চঞ্চল পায়ে ছুটে গেল ওয়াশরুমে। সে প্রস্থান করতেই চোখ মেলে তাকালো রাহিদ। উপলব্ধি করতে পারলো ইনুর মানসিক অবস্থা। আজ এ মুহূর্তে মন থেকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো সে। ইনুর জীবনে দুঃখের শেষবিন্দু শুষে নিয়ে দুজনে ভেসে যাবে সুখের ভেলায়। ইনশাআল্লাহ্!

.

” হায়! বোন আমার ভাবী আজ থেকে। এ আনন্দ লুকাবো কার থেকে.. ”

বেসুরো গলায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে উল্টোপাল্টা গেয়ে চলেছে রায়না। লাজে র’ক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়লো ইনুর কপোলদ্বয়ে। ইশ্! রায়না’পু কি যে করছে না! এমনভাবে ভাবী বলে ডাকছে! লজ্জা! ফিক করে হেসে উঠলো হৃদি। এ মুহূর্তে তারা তিনজন বসে বাড়ির প্রাঙ্গনে। বেতের দু’টো চেয়ারে পাশাপাশি বসে রায়না, ইনায়া। হৃদি ওদের বিপরীত দিকের সিঙ্গেল সোফায় বসে। হাস্যমুখে শুধালো,

” রায়ু বেবি। ছোটবোন এখন বড় ভাবী। ফিলিংস কেমন বলো তো দেখি। আমরাও একটু শুনি। ”

রায়না হেসে নতুন ভাবীর গাল টিপে দিলো। উচ্ছ্বসিত বদনে বললো,

” ভাবী কি বলবো তোমায়? ফিলিং ফ্যান্টাস্টিক! জোশ। ভাষায় বলার মতো না। আমি ভাবতেই পারছি না ভাইয়া বিয়ে করে ফেলেছে। উফ্! আর ভাবী কিনা আমার আদরের ইনু টা। হায়! কি থেকে কি হয়ে গেল। বোন এখন ভাবী! তা ডাকবো কি বলে? বনু নাকি ভাবী? হুঁ? ”

হৃদি শব্দহীন হাসলো। তাকালো ইনুর র’ক্তিম বদনে। জুড়িয়ে গেল নয়ন। এমনটাই তো চেয়েছিল তার স্বামী। সে শুধু সঙ্গ দিয়েছে। ফিরিয়ে এনেছে ইনুর স্বাভাবিক সত্তা। হঠাৎই রায়না অভিমানী স্বরে বলল,

” কিন্তু এটা কি ঠিক হলো? ভাইয়ার একমাত্র লিলিপুট বোন হিসেবে আমিই কিনা বিয়েতে অনুপস্থিত? ইটস্ নট ফেয়ার। ”

কথাটি শ্রবণ হবা মাত্র পরিবর্তিত হলো পরিবেশ। হৃদি ও ইনুর মুখে আঁধার ঘনিয়ে এলো বোধহয়। ওদের মুখভঙ্গি লক্ষ্য করে রায়না উপলব্ধি করতে পারলো ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছে সে। বিয়েটা তো আর পাঁচ দশটা বিয়ের মতো স্বাভাবিক নয়। সবটাই আকস্মিক! তাহলে! পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হৃদি বলে উঠলো,

” নো টেনশন নন্দিনী। তখন ছিলে না তো কি হয়েছে? ইনশাআল্লাহ্ পরেরবার ধুমধাম করে বিয়ের আয়োজন করা হবে। তখন আমরা জমিয়ে মজা করবো ওকে? ফুল অফ এন্টারটেইনমেন্ট। ”

ঝলমল করে উঠলো মুখখানি। ঘন ঘন মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো রায়না,

” ইয়েস। তখন বিয়ের গেট ধরা থেকে শুরু করে বাসর ঘরে টাকা আদায় সব হবে। আমি কিন্তু বর-কনে দুই পক্ষের ই সদস্য। ঠিক আছে? ”

সশব্দে হেসে উঠলো হৃদি, ” ঠিক আছে। ”

ওদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, কথোপকথনে এখানে টিকে থাকা দায় হলো। লজ্জালু আভা ছড়িয়ে মুখে। চঞ্চল পায়ে সে স্থান পরিত্যাগ করে বাড়ির দিকে ছুটে গেল ইনু। এ দেখে ননদ ভাবী যুগল সমস্বরে হেসে উঠলো। লজ্জা পেয়ে পালিয়েছে মেয়েটা।

.

বাহিরের পোশাক পড়ে পরিপাটি রূপে দাঁড়িয়ে সৌম্যকান্তি মানুষটি। বরাবরের মতো চোখেমুখে গাম্ভীর্য। রিমলেস চশমার ওপাশে বুদ্ধিদীপ্ত নভোনীল চক্ষু জোড়া। নিবদ্ধ রাহিদে। গম্ভীর স্বরে বলে চলেছে,

” একে অপরকে ভালোবাসিস। বিয়েটা দিয়ে দিয়েছি। এবার বোনের বিদায়ের পালা। বউকে নিয়ে কোথায় থাকবি, কি করে থাকবি ইটস্ নান অফ মাই বিজনেস। আমি হয়তো রাস্তা দেখিয়ে দেবো। এখন সে রাস্তায় ঠিক কিভাবে, কত গতিতে চলাচল করবি, কিভাবে গন্তব্যে পৌঁছাবি সেটা তোর ওপর নির্ভর করছে। গট ইট? ”

দ্রুত ইতিবাচক মাথা নাড়ল রাহিদ। সে বুঝেছে। গম্ভীর ভাইয়ের গাম্ভীর্যপূর্ণ কথাবার্তা ঠিক বুঝেছে। আগে তো শুধুমাত্র বড় ভাই ছিল‌। এখন বদলেছে সম্পর্কের সমীকরণ। ভাইয়ের পাশাপাশি নতুন এক পরিচয়। সমন্ধি হয়। তাই বুঝি ভয়টা বেশি কাজ করছে? সেদিনের অতর্কিত চ-ড় স্মরণে এলো। শুকনো ঢোক গিললো ছেলেটা।

” বিয়ের পর মেয়েরা বেশিদিন বাবার বাড়ি থাকে না। লোকে মন্দ বলে। কিন্তু তুই খুব ভালো করেই জানিস লোকের মন্দ কথায় এই ইরহাম কখনো পাত্তা দেয়নি। আর দেবেও না। টেইক ইয়্যুর টাইম। সবটা গুছিয়ে নে। ততদিন অবধি ইনু এখানেই থাকবে। ওকে? ”

আর কোনো কথা নয়। গম্ভীরমুখো মানুষটি বেরিয়ে গেল ‘ আনন্দাঙ্গন ‘ হতে। তার গমন পথে করুণ চোখে তাকিয়ে রাহিদ। এ কি অনাসৃষ্টি কথা! বিয়ের দু’দিন হতে না হতেই বিপত্নিক করে দিচ্ছে! বউ ছাড়া ওঠা বসা, ঘুমানো হবে কি করে? আহাজারি করতে ইচ্ছে হলো। এ অন্যায়। অবিচার। তবে বিচার চাইবে কোন আদালতে? সব যে বন্ধ। দুঃখ ভারাক্রান্ত বদনে হাঁটা ধরলো রাহিদ। কর্ণ গহ্বরে বেজে চলেছে সে-ই জনপ্রিয় গানটি,

‘ দিল সামহাল যা জারা ‘

বউ ছাড়া সামলাবে কি করে? হুঁ? কি দুঃখ! দুঃখে তার মেঝেতে গড়াগড়ি খেতে ইচ্ছে করছে। আহা রে! বেচারা’টা!

.

‘ আনন্দাঙ্গন ‘ আজকাল কেমন নীরব-শান্ত। ক’দিন আগেও ইনুর বিয়ে নিয়ে ঝামেলা হচ্ছিল। চলছিল মতবিরোধ। আজ সব শান্ত। নিশ্চুপ। এজাজ সাহেব কেমন যেন মাত্রাতিরিক্ত নিশ্চুপ হয়ে গেছেন। হৃদি একা হাতে সবটা সামাল দিতে ব্যস্ত। তার পাপা, মা, দাদী সবাইকে দেখে রাখছে। মন জুগিয়ে চলছে। পরিস্থিতি বোঝানোর চেষ্টা করছে। তার স্বামীকে কেউ শুধু শুধু ভুল বুঝুক, তা সে কখনোই চায় না। তাই তো যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে সবটা স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেয়ার। মালিহা এবং রাজেদা খানম হয়তো বুঝলেন। কিন্তু এজাজ সাহেব? দা`ম্ভিক মানুষটির সকল দ ম্ভ নিজ পুত্র দ্বারা ভেঙ্গে চুরমার হয়েছে। হজম করতে একটু সময় দরকার। আর রাহিদ? তাদের বিবাহ পরবর্তী জীবন, ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করতে ব্যস্ত। ইনু রয়ে গেল বাবার বাড়ি। আপাতত যোগাযোগ বিহীন দু’জনে। রাহিদ যদিওবা চেষ্টা করেছে। কিন্তু অভিমানী কন্যা তাতে সাড়া দেয়নি। কেন দেবে? সে কি ফেলনা? ওপাশের মানুষটিও একটু বুঝুক যন্ত্রণার স্বাদ কেমনতর! এভাবেই অতিবাহিত হলো বেশ কিছুদিন।

সান্ধ্যকালীন প্রহর। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে হৃদি। হাতে বোমকেশ বক্সি রচনাবলীর একটি বই। মনোযোগ সহকারে উত্তেজনাময় দৃশ্য পড়ছে সে। চিন্তা ছড়িয়ে শিরায় উপশিরায়। স্বেদজল গড়িয়ে পড়ছে চিবুক বেয়ে। মনে হচ্ছে দৃশ্যপটে স্বয়ং সে উপস্থিত। বোমকেশ এর পাশে অজিতের পরিবর্তে সে দাঁড়িয়ে। অপেক্ষায় রহস্য উন্মোচনের। এমন টান টান উত্তেজনার মধ্যে ব্যাঘাত ঘটালো মোবাইলের কর্কশ ধ্বনি। মনোযোগ বিছিন্ন হলো। উড়ে গেল উত্তেজনা। রাগে কিড়মিড় করে উঠলো মেয়েটা। কার এত বড় সাহস তার পড়ার সময়ে বিরক্ত করে? হুঁ? ইচ্ছে সত্ত্বেও বইয়ের পাতায় মনোযোগ বসছে না। দ্বিতীয়বারের মতো রিংটোন বেজে উঠলো। অসীম বিরক্তি নিয়ে কল রিসিভ করলো হৃদি। দেখলো না কলার আইডির নামটি। রাগত স্বরে কিছু বলার পূর্বেই শ্রবণেন্দ্রিয়ে পৌঁছালো সে জনের কণ্ঠস্বর,

” ব্যাগপ্যাক গুছিয়ে ফেলো। পরশু ট্রিপে যাচ্ছি। ”

ব্যাস। সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলো। চমকিত নেত্রে কলার আইডি দেখলো হৃদি। সত্যিই এমপি সাহেব কল করলেন! ওরা। ওরা ঘুরতে যাচ্ছে! বিয়ের সাত-আট মাস পেরিয়ে গেল। এই প্রথমবারের মতো ঘুরতে যাবে দু’জনে! তরঙ্গ বয়ে গেল হৃদ জমিনে। ঝলমল করে উঠলো মুখশ্রী। আহা! এতটা আনন্দ হচ্ছে কেন? খুশিতে আত্মহারা মেয়েটি মৃদু স্বরে চেঁচিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলো। মনকাননে বেজে উঠলো,

‘ আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে.. ‘

চলবে.

#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৯ ( প্রথমাংশ )

নিশাকরের অংশুমালা ছড়িয়ে ধরনীর বুকে। বিছানার এককোণে পড়ে মোবাইলটি। কর্কশ ধ্বনি জানান দিচ্ছে কল করেছে ‘সে’। উৎকণ্ঠিত আজগর সাহেব ডিভানে জড়োসড়ো হয়ে বসে। মনের মধ্যে সাজিয়ে নিচ্ছেন শব্দমালা। কোথা থেকে আরম্ভ করবেন উনি। কি বলে সাফাই দেবেন। কোন পন্থায় শান্ত করবেন ওই নি”র্দয় মানবকে। সে যে মাং-শাসী বন্য পশুর চেয়েও ভয়ঙ্ক”র। অতি শান্ত কিন্তু নির্মম। দয়া ও মায়া নামক কোনো শব্দ নেই তার ডিকশনারিতে।

‘ প্রথমবার ভুল করেছো। যাও। ছোট্ট একটা সুযোগ দিলাম। কিন্তু দ্বিতীয়বার সে একই ভুল তোমার ম-রণের কারণ হতে চলেছে। কথাটা মস্তিষ্কে গেঁথে নাও। ‘

এমন জীবনাদর্শে চলে মানুষটা। বছরের পর বছর অন্ধকার কুৎ সি ত জগতে রাজত্ব করে আসছে। মায়াদয়া বিহীন আস্ত এক ন-রপশু সে। যার চরণে ক্ষমা চাইতে চাইতে কখন ঘটবে তোমার ম-রণ, জানবে না তুমি নিজেও। সে নি;ষ্ঠুর, নি’র্মম। এক ভ”য়ানক জীব। সেই ভ’য়াল সত্তা আজ জাগ্রত হতে চলেছে। এক দু টাকা নয় বরং দুই কোটি টাকার লোকসান, দুর্দান্ত পরিকল্পনায় ব্যর্থতা। ছাড়বে না ‘সে’। ক্ষুধার্ত হায়েনার ন্যায় ঝাঁ”পিয়ে পড়বে শত্রু অঙ্গে। চিঁ’ড়ে ছিঁড়ে খাবে সর্বশেষ মাংসল অংশ। ভ’য়াবহ ভাবনাটি মস্তিষ্কে যেন র-ক্তক্ষরণের সৃষ্টি করলো। বয়স্ক পাথর হৃদয়ের অধিকারী আজগর সাহেবের দেহে বিন্দু বিন্দু ঘামের অস্তিত্ব। উনি যে চুনোপুঁটি সেই ভ’য়াল জীবের ধারে। কি করে পরিস্থিতি সামাল দেবেন? ঘন শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন আজগর সাহেব। হাঁপরের ন্যায় ওঠানামা করছে বক্ষস্থল। বৃদ্ধি পাচ্ছে র-ক্তচাপ। কাঁপছে সারা কায়া। মন্থর পায়ে বিছানার ধারে গেলেন। শুকনো ঢোক গিললেন বার কয়েক। তপ্ত শ্বাস ফেলে কম্পিত হস্তে নিলেন মোবাইল। রিসিভ করে কর্ণে ঠেকালেন।

” হ্যালো! ”

এতটাই ক্ষীণ স্বর! নিজ কণ্ঠ নিজেও শুনতে পাচ্ছেন না যেন। কিন্তু থেমে নেই ফোনের ওপাশে থাকা ব্যক্তি। বিধ্বং-সী ঝড়ের পূর্বাভাস। অতি শান্ত। নীরবতা। এতেই হৃদক্রিয়া বন্ধ হবার উপক্রম। ধপ করে বিছানায় বসে পড়লেন আজগর সাহেব। হাতের উল্টো পিঠে মুছে ফেললেন কপালে জমায়েত স্বেদজল। কি এক রুদ্ধশ্বাস অবস্থা!

আদিত্যর মিঠি রৌদ্র মমতাময়ী রূপে আগলে এ বসূধা। উন্মুক্ত জানালা গলিয়ে হিমেল হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে বদন। রৌদ্র-পবনের সে এক মিষ্টি যুগলবন্দী। ঝলমল করে উঠছে মায়াবী মুখখানি। জানালায় ঠেকে বাঁ হাতের কনুই। তার ওপর থুতনি স্থাপন করে চমৎকার এই পরিবেশ উপভোগ করে চলেছে হৃদি! চোখেমুখে উজ্জ্বলতা। অধরে লেপ্টে খুশির ছোঁয়া। ড্রাইভিং সিটে বসে ইরহাম। গাড়ি চালানোর ফাঁকে স্ত্রীর উজ্জ্বল মুখশ্রী দেখতে ভুলছে না। অন্য দিনের তুলনায় আজ যেন একটু বেশিই আকর্ষণীয়, নজরকাড়া লাগছে তার হৃদয়ের রাণীকে! পড়নে জর্জেটের র-ক্তবেগুনী সালোয়ার স্যুট। হিজাবে লুকায়িত দীঘল কালো কেশ। মুখে মানানসই প্রসাধনীর প্রলেপ। অধরকোলে মোহনীয় দ্যুতি। উফ্! হৃদক্রিয়া বন্ধ হবার উপক্রম।
ঝ ল সে যাচ্ছে অক্ষিদ্বয়। ধুকপুকানি হচ্ছে হৃৎযন্ত্রে। মুচকি হেসে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো সে। গাড়ি চলছে এখন প্রশস্ত শুনশান সড়ক ধরে। সকাল সকাল। যানজট নেই বললে চলে। পথের দু ধারে বীরদর্পে দাঁড়িয়ে সারি সারি বৃক্ষরাজি। বাঁ পাশে পার্ক করা কিছু শূন্য ট্রাক। ডান পাশে গাছপালা এবং বিপরীতমুখী কিছু যানবাহনের উপস্থিতি।

চোখেমুখে পবনের মৃদু ঝাপটায় শব্দহীন হাসলো হৃদি। সোজা হয়ে বসলো। দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো ডান পাশে চালকের আসনে বসা স্বামীর পানে। লহমায় বিমোহিত হলো তনুমন! আজ যে তার সুদর্শন বর সম্পূর্ণ ভিন্নরূপে হাজির হয়েছে। সদা শুভ্র পাঞ্জাবি পড়ুয়া মানুষটি আজ ক্যাজুয়াল লুকে। বলিষ্ঠ দেহে জড়িয়ে শ্বেতশুভ্র শার্ট। আঁটসাঁট হয়ে দেহে জড়িয়ে তা। স্পষ্ট রূপে দৃশ্যমান পুরুষালি দেহের খাঁজ। সাথে নেভিব্লু রঙের গ্যাবার্ডিন প্যান্ট। পায়ে শুভ্র রঙা শ্যু। চোখে বরাবরের মতো রিমলেস চশমার উপস্থিতি। একদম ভিন্নতর লুক। বড় সুদর্শন লাগছে! কোমল হৃদয়ে সৃষ্টি হচ্ছে মধুরতম ঝঙ্কার। চোখের ভাষায় অপরিমেয় মুগ্ধতা! একটুখানি কাছে পাবার অভিলাষ তনুমনে। লজ্জালু রেখা ফুটে উঠলো মেয়েটির ওষ্ঠপুটে। এই সুদর্শন পুরুষটি শুধুমাত্র তার। একান্ত একজন। ইশ্! সম্মুখে সড়কে তাকিয়ে হৃদি। রসিকতা করে টেনে টেনে বলে উঠলো,

” কেউ কি জানে তাকে বিধবার বেশ হতে এই লুকে বেশি আকর্ষণীয় লাগছে! ”

ইরহাম স্পষ্ট শুনলো। বুঝলো কাকে উদ্দেশ্য করে এ শব্দমালা। অধরে চিকন হাসির রেখা ফুটে উঠলো। বললো,

” সর্বদা আকর্ষণীয় দেখালে তো সমস্যা। মূল্য কমে যাবে। কমে যাবে মুগ্ধতার রেশ। তারচেয়ে মাঝেমধ্যে ভিন্ন রূপ নেয়াই বেটার। ”

নিঃশব্দে হাসলো হৃদি। মন্দ বলেনি। তবুও সে স্ত্রী ধর্ম পালন করবে। স্বামীর কথায় সরাসরি সহমত পোষণ করবে না। তাই তো স্বামীর পানে তাকিয়ে বলে উঠলো,

” ভুল। সবই ভুল। বিধবা সেজে ঘোরাঘুরি করার চেয়ে এই লুক ই বেটার। ”

ওর পানে একঝলক তাকিয়ে সম্মুখে রাস্তায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো ইরহাম। দুষ্টু স্বরে বললো,

” এর চেয়েও বেটার লুকে একজন ঘা য়ে ল হয়। সে কি তা জানে? ”

ভ্রু কুঞ্চিত হলো। ভাবনায় পড়লো হৃদি। তার কথা বলছে? সে আবার অন্য কোন লুকে ঘা য়ে ল হলো? মনে পড়ছে না তো। স্বামীর পানে তাকিয়ে দ্বিধান্বিত স্বরে শুধালো,

” কোন লুকে? সবসময় তো পাঞ্জাবি পড়ে ঘুরঘুর করেন। ”

ওর পানে তাকালো মানুষটি। নয়নে মিলিত হলো নয়ন। কেমন দুর্বোধ্য চাহনিতে তাকিয়ে মানুষটি। সম্মোহনী স্বরে বললো,

” ভুলে গেলে? উদোম আমিটাকে? ”

ত্বরিত লালাভ রঙে রঙিন হলো রমণীর কপোলদ্বয়। ইশ্! কি বেশরম কথাবার্তা! সে নাকি স্বামীর উদোম দেহে! অসম্ভব! তাহলে এত লাজ আসছে কোথা থেকে? উফ্! লাজুক বদনে সম্মুখে তাকালো হৃদি। ইরহাম কিছু বলতে উদ্যত হতেই হৃদি লাজে মরি মরি করে মৃদু আপত্তি জানালো,

” আপনি দয়া করে গাড়ি চালানোয় মন দিন। প্লিজ। ”

নিঃশব্দে হাসলো মানুষটি। মনোনিবেশ করলো ড্রাইভিংয়ে। গন্তব্য আর বেশি দূরে নয়। নিরাপদে পৌঁছানোই অন্যতম মূল লক্ষ্য। আজ তারা দেহরক্ষীদের সরাসরি নিরাপত্তা বলয় হতে মুক্ত। নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঠিক বহাল রয়েছে। তবে আড়ালে। দু’টো দিন অন্তত নির্ঝঞ্ঝাট ভাবে অর্ধাঙ্গীর সঙ্গে কাটাতে ইচ্ছুক সে। রক্ষী নিয়ে অহেতুক ঝামেলায় পড়তে নারাজ। তাই তো দূর হতে ছদ্মবেশে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিদ্যমান। এখন এমপি সে। তন্মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী, তার শ ত্রু আজগর নামক এক ধূর্ত ব্যক্তি। তাই সাবধানের মা র নেই। নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আবশ্যক।

.

‘ সারাহ রিসোর্ট গাজীপুর। ‘ রিসোর্টের অগ্রভাগে নীলাভ জল ধারণকৃত গোলাকার একটি সুইমিং পুল। তার অপর পাশে কয়েক তলার রিসোর্ট। আশপাশে দৃশ্যমান অসংখ্য বৃক্ষরাজি। পাখপাখালির কলরব ভেসে আসছে শ্রবণেন্দ্রিয়ে। মন জুড়িয়ে যাওয়া পরিবেশ। গাজীপুরের বুকে এই রিসোর্টটি বেশ নীরব-শান্ত। নজরকাড়া। নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং দূরত্ব বিবেচনা করে এখানেই আগমন। অন্যথায় একমাত্র বউকে নিয়ে দূরে কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। গাড়ি এসে থামলো রিসোর্ট প্রাঙ্গনে। দ্বার উন্মুক্ত করে বেরিয়ে এলো হৃদি। মোহাচ্ছন্ন হলো নান্দনিক সৌন্দর্যে! চক্ষু ঘুরে বেড়াচ্ছে আশেপাশে। অস্ফুট স্বরে আওড়ালো,

” ওয়াও! বিউটিফুল! ”

গাড়িটি যথাযথ স্থানে পার্ক করে স্ত্রীর পাশে এসে দাঁড়ালো মানুষটি। বরাবরের মতই কোমল আঙ্গুলের ভাঁজে গলিয়ে দিলো পুরুষালি শক্তপোক্ত আঙ্গুল। ঘোর কাটলো হৃদির। তাকালো হাতে। মুচকি হাসলো এ বন্ধন দেখে। অর্ধাঙ্গীর হাতটি আগলে রেখেই আজকাল বাহিরে চলতে অভ্যস্ত এমপি সাহেব। ছোট্ট লাগেজ বাঁ হাতে ধরে। ডান হাতে আঁকড়ে ধরে স্ত্রীর হাত। রিসোর্টের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলো দু’জনে।
.

প্রিমিয়াম ভিলায় বুকিং দিয়ে রেখেছিল এমপি সাহেব। নির্ধারিত কক্ষটি বেশ আকর্ষণীয়! নিঃসন্দেহে আগামী দু’টো দিন দারুণ কাটতে চলেছে। স্বামীর সঙ্গে এ প্রথমবারের মতো একান্তে কাটাবে। ঘুরে বেড়াবে। ভাবতেই শিরশিরানি বয়ে গেল মেয়েটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে। কোনোমতে উত্তেজনা দমিয়ে রেখে লাগেজ রাখলো বিছানায়। চেইন খুলে উন্মুক্ত করলো লাগেজ। নিজের জন্য ও স্বামীর জন্য পোশাক বের করে রাখলো বিছানায়। দু’জনের তোয়ালে বের করলো। দরকারি জিনিসপত্র বের করে ঘরের যথাযথ স্থানে রেখে দিলো। অতঃপর দেয়াল ঘেঁষে রেখে দিলো বদ্ধ লাগেজ। সে মুহূর্তে ঘরে প্রবেশ করলো ইরহাম। রিসিপশনে কথাবার্তা বলে মাত্র ফিরলো। হৃদি শুধালো,

” আপনি আগে ফ্রেশ হবেন? নাকি আমি যাবো? ”

” তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো। ততক্ষণ আমি একটু রেস্ট নিয়ে নিই। ”

” আচ্ছা। ”

পোশাক ও তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে পা বাড়ালো হৃদি। ইরহাম বসলো শুভ্র রঙা এক ডিজাইনিং চেয়ারে। বাঁ হাতে খুলে ফেললো শার্টের সব ক’টি বোতাম। উন্মুক্ত হলো প্রশস্ত বক্ষপট। চক্ষু বুজে দেহ এলিয়ে দিলো চেয়ারে।

কিছুক্ষণ পর সতেজ-স্নিগ্ধ রূপে ওয়াশরুম হতে বেরিয়ে ঘরে এলো হৃদি। তোয়ালে চালনা করে চলেছে সিক্ত কেশে। স্বামীকে কোমল স্বরে বললো,

” এবার যান। ফ্রেশ হয়ে আসুন। ”

উঠে দাঁড়ালো ইরহাম। সহসা তার অনাবৃত বক্ষপটে দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো মেয়েটির। হিল্লোল আছড়ে পড়লো মানসপটে। লাজে লাল হলো গাল। দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নিলো হৃদি। নিজেকে সামাল দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ইরহাম অবশ্য তা লক্ষ্য করেনি। বিছানায় রাখা পোশাক আশাক নিয়ে ফ্রেশ হতে গেল। হৃদি তোয়ালে হাতে বসলো বিছানায়। মোবাইল হাতে নিলো। কল করলো মা’কে। নিরাপদে পৌঁছেছে জানাতে হবে। অন্যথায় দুশ্চিন্তা করবে মা। প্রথমে শাশুড়ি মা অতঃপর নিজের মায়ের সাথে কথা বললো। চিন্তামুক্ত করলো তাদের। মাতৃহৃদয় তো। চিন্তা আপনাআপনি জেঁকে বসে।
.

যোহরের সালাত আদায় শেষে মধ্যাহ্ন ভোজ সেরে নিলো ইরহাম, হৃদি। অতঃপর বিছানায় এলিয়ে দিলো ক্লান্ত শরীর। একান্ত জনের বুকে মাথা রেখে শুয়ে হৃদি। বলিষ্ঠ বাহুবন্ধনে আবদ্ধ। স্বল্প সময়ের মধ্যে নিদ্রায় তলিয়ে গেল দু’জনে।
.

নগরীর একাংশে অবস্থিত এই বৃদ্ধাশ্রমটি। অসংখ্য অসহায় বৃদ্ধ, বৃদ্ধার বাসস্থান। সন্তান বেঁচে থাকতেও নিসন্তান তারা। যে সন্তানকে অসহনীয় যন্ত্রণা সহ্য করে পৃথিবীর আলো দেখালেন। হাঁটি হাঁটি পায়ে শেখালেন পথ চলতে। অবুঝ শিশুটির মুখে তুলে দিতেন আহার। রোগাক্রান্ত সন্তানের সেবাশুশ্রূষা করে অসংখ্য রাত বিনিদ্র কাটিয়েছেন। আজ সেই সন্তান পিতা-মাতাকে চেনে না। তাদের দায়িত্ব নিতে নারাজ। অথচ শৈশবে এই সন্তান ই হয়তো ভাইবোনের সঙ্গে মা-রামারি করেছে, মা-বাবাকে নিয়ে টানাহেঁচড়া করেছে। ‘ আম্মু আমার। ‘ এমন বুলি হয়তো বলেছে অসংখ্য বার। আজ সেই সন্তান ভাই কিংবা বোনের দিকে মা-বাবাকে ঠেলে দেয়। নিজের কাছে রাখতে ইচ্ছুক নয়। তাদের একমাত্র সুখ, জগৎ হলো নিজের স্ত্রী সন্তান। সে কি ভুলে যাচ্ছে তার নিজেরও সন্তান রয়েছে? একদিন এই সন্তান হয়তো তার মতোই মুখ ফিরিয়ে নেবে। তারও ঠিকানা হতে পারে অসহায় বৃদ্ধ বৃদ্ধার আশ্রয় ‘বৃদ্ধাশ্রম। ‘ হাহ্! জানে না সে। কিংবা জেনেও অবুঝ। এদের মতো নির্দয়, নি-ষ্ঠুর দ্বিতীয়টি নেই। পিতা-মাতাকে কষ্ট দিয়ে ইহকাল ও পরকাল দুইই নষ্ট করছে তারা। কতটা অবুঝ আচরণ! আল্লাহ্ তা’য়ালা এদের হেদায়েত দান করুন।

বৃদ্ধাশ্রমের এক বৃক্ষতলে বসে এক মাঝবয়সী নারী। হাতে একটি ফটো। ছবিতে সে, তার স্বামী এবং দুই সন্তান। এক পুত্র ও এক কন্যা। অশ্রুসজল নয়নে ফটোতে হাত বুলিয়ে চলেছেন উনি। স্বামী ওনায় একাকী করে দুনিয়া ত্যাগ করলো সেই কত বছর পূর্বে। আর দুই সন্তান? তারা আজ..

চলবে.

#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৯ ( শেষাংশ ) [ ১৮+ অ্যালার্ট ]

” কেন চলে গেলে? ”

বৃদ্ধাশ্রমের এক বৃক্ষতলে কাঠের বেঞ্চে বসে এক মাঝবয়সী নারী। হাতে একটি ফটো। ছবিতে সে, তার স্বামী এবং দুই সন্তান। এক পুত্র ও এক কন্যা। অশ্রুসজল নয়নে ফটোতে আলতো করে হাত বুলিয়ে চলেছেন উনি। স্বামী ওনায় একাকী করে দুনিয়া ত্যাগ করলো সেই কত বছর পূর্বে। আর দুই সন্তান? তারাও আজ নেই। পিতার পথ অনুসরণ করে দুনিয়া ত্যাগ করেছে। একাকী ফেলে রেখে গিয়েছে তাকে। বিশাল এ পৃথিবীতে আজ সে একা। বড় একা। চারিদিকে শুধু নিস্তব্ধতার চাদর। ধূ ধূ মরুর ন্যায় প্রাণহীন পরিবেশ। কোথাও কেউ নেই। লহমায় ওনার অশ্রুসিক্ত দু নয়ন অনুতাপের ভারে নুয়ে গেল। ঘৃণা জন্মালো নিজের প্রতি। ছিঃ! ধিক্কার নিজেকে। জন্মদাত্রী মা হিসেবে উনি ঘৃণ্য। জঘন্য! ওনার পাপের কোনো ক্ষমা হয় না। নির্মম, নি-ষ্ঠুর উনি। কেন নিজেকে এত ঘৃণা? কেন এই অনুতাপ? হবে না? মন গহ্বরে বেশি খুঁজতে হলো না। সহজেই মিললো ঘৃণা, অনুশোচনার সেই ধ্বং-সাত্মক উৎস।

নয়ন। এক মা-দকাসক্ত তরুণ। মা•দকের ভয়াল থাবায় মনুষ্যত্ব, নীতিবোধ হারিয়েছে বহু পূর্বেই। নে শা বিহীন থাকতে পারে না দু দণ্ড। বাড়িতে অষ্টাদশী ছোট বোন, অসুস্থ মা রয়েছে। তাতে কি? বেকার তরুণ দিনরাত
নে শায় বুঁদ হয়ে পড়ে থাকে। ছোট বোন পড়াশোনার পাশাপাশি বেশকিছু টিউশনি পড়ায়। অসুস্থ মা সেলাই মেশিনের জাদুতে ঘরসংসার সামলানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যায়। প্রায়শ নে•শার টাকার জন্য ঘরে অশান্তি হয়। মা ও বোনের থেকে জোরপূর্বক অর্থ ছিনিয়ে নে-শার ব্যবস্থা করে নয়ন। অসহায় মা ও বোন শত চেষ্টা করেও তাকে শুধরাতে ব্যর্থ। এভাবেই চলছিল দিন। নয়ন তখন চরমভাবে মা•দকাসক্ত। এ থেকে মুক্তির আর বুঝি কোনো উপায় নেই। এক রাতে ঝড় উঠলো। কাঁপলো আকাশ বাতাস। অভাবনীয় পৈ•শাচিকতা ঘটলো ধরনীর বুকে। ছোট্ট এক ভগ্ন ঘরে। সে রাতেও নে শা য় বেহুঁশ প্রায় নয়ন। মাঝরাত অবধি বন্ধুদের সঙ্গে দেখলো প**গ্রাফি। সীমাহীন নে শা চড়ে বসলো দেহমনে। মা•দকের নে-শার চেয়েও নারীর নে শা তাকে বেশি কুপোকাত করলো। সারা কায়ায় তখন বি”ষযন্ত্রণা। কুটকুট করে কা’মড়ে খাচ্ছে কোনো পোকা। নে-শার ঘোরে ছটফট করছে নয়ন। বরাবরের মতই ডুপ্লিকেট চাবি ব্যবহার করে বাড়িতে প্রবেশ করলো। টলে উঠছে পা। সারা কায়া। ভনভন করছে মস্তক। র-ক্তবর্ণ চক্ষুদ্বয়। হাত-পা যেন লাগামছাড়া। টলমল পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। নারীর নে-শায় বি”ধ্বস্ত অবস্থা তার। চাই। কাউকে চাই। হঠাৎ চক্ষু গেল পাশের ঘরে। ভিড়িয়ে রাখা দ্বার। অল্প ফাঁক হতে দেখা মিলছে এক নারী অবয়ব। হায় রে খোদা! মা•দক নামক বি ষা ক্ত ছোবলে আক্রান্ত ছেলেটা অন্য নারী আর নিজের মায়ের পেটের বোনের তফাৎ বুঝলো না। তার চোখে তখন নারী স-ম্ভ্রম হরণকারী অদম্য নে”শা। জাগ্রত হয়েছে ভেতরকার আদিম সত্তা। নারী তখন শুধুমাত্র ভোগ্যবস্তু। অন্য কিছু নয়। দুর্বল অথচ ছটফটে পায়ে বোনের ঘরে প্রবেশ করলো নয়ন। ঘুমিয়ে তখন অষ্টাদশী বোনটা। হঠাৎ কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই ঘুমের মধ্যে আপন ভাইয়ের পৈ•শাচিকতার শিকার হলো মেয়েটা। রাতের আঁধারে জাগতিক হুঁশ বিহীন নয়ন। আপন বোনের ওপর জাহির করছে কাপুরুষত্ব। তমসাচ্ছন্ন রাতে নে-শার ঘোরে চিনলো না বোনকে। শুধুমাত্র ভোগ্যবস্তু হিসেবে করে গেল ভোগ। আর বোনটি! নির্মম ব•র্বরতার শিকার অপরিপক্ক মেয়েটি অনবরত নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। পারলো না এক পশুর সঙ্গে। রাতের শেষ প্রহরে আধো আলোয় সে দেখলো শোষকের মুখখানা। যন্ত্রণার চেয়েও অন্তরে আঘাত করলো অবিশ্বাস! অস্ফুট স্বরে ডেকে উঠলো,

‘ ভাইয়া! ‘

আহা! সে কি করুণ শোনালো! কিন্তু শোষক ভাইটি তখনও ব্যস্ত দুনিয়ার অন্যতম বর্বর-জঘন্য অপরাধে। শুনলো না বোনের করুণ আর্তি। রাতভর চললো নি”র্যাতন। অসুস্থ মা তখন কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ সেবন করে গভীর নিদ্রায়। সে জানলো না। পারলো না আদরের মেয়েকে বিপদ হতে রক্ষা করতে। অপরিপক্ক, অনভিজ্ঞ দেহের মেয়েটি এত পারুষ্য সইতে পারলো না। বইতে লাগলো র-ক্তের ধারা। সুবাহের প্রথম ভাগে, নিজ ভাই কর্তৃক অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে র-ক্তক্ষরণের ফলস্বরূপ মৃ•ত্যুর কোলে ঢলে পড়লো মেয়েটি। পাড়ি জমালো অনন্তকালের দেশে। সৃষ্টিকর্তার পানে। হয়তো অভিযোগ জানালো মহান রবের পানে, এমন মৃ-ত্যু না হলেও পারতো তার। এতটা পৈ•শাচিকতা, নি”র্মমতা কি খুব বেশি দরকার ছিল? হয়তো ভাইয়ের অবিশ্বাস্য মুখখানা না দেখলে একটু হলেও লাঘব হতো যন্ত্রণা। কিন্তু আপন সহোদরের মুখদর্শনে জীবনের সবচেয়ে বড় ধোঁকা, বি*ষযন্ত্রণা পেল সে। সে কি নির্মম মৃ ত্যু!

সকাল সকাল অস্বস্তির শিকার হয়ে নে শায় বুঁদ ছেলেটির ঘুম ভঙ্গ হলো। যন্ত্রণা হচ্ছে মাথায়। ভেতরটা কেমন ছটফট করছে। সব ঝাঁপসা লাগছে কেন? মাথাটা ছিঁড়ে চিঁড়ে যাচ্ছে কি! এরপরের সময়টা ছিল অসীম বেদনাদায়ক! অবিশ্বাস্য! আপন সহোদরা এবং নিজ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে একটুও বুঝতে অসুবিধা হলো না কি থেকে কি হয়েছে। বোন আর নেই! চিৎকার করে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো নয়ন। সে চিৎকারে ছুটে এলেন মা। সদ্য ঘুম থেকে উঠেছেন উনি। পুত্রের চিৎকার শুনে কন্যার ঘরে তড়িঘড়ি করে ছুটে এলেন। কি হয়েছে রে! হায় হায়! একমাত্র কন্যা তখন নিথর দেহে বিছানায় পড়ে। পুত্রের অবস্থাও দৃষ্টিকটু, বি শ্রী। ব্যতিব্যস্ত পায়ে কন্যার পানে ছুটে গেলেন মা। বসলেন শিয়রে। মৃ ত মেয়েকে বুকে জড়িয়ে এক মায়ের সে কি আর্তনাদ! চিৎকার করে কাঁদছেন তিনি। আশেপাশে বাড়িঘর তেমন একটা নেই। শুনশান এলাকা। তাই তো ঘরের কুকর্ম ঘরেই চাপা পড়লো। টের পেলো না কেউ। মা তখন ক্রন্দনে দিশেহারা। পুত্র জাপটে ধরে মায়ের দু পা। হাউমাউ করে কাঁদছে ছেলেটা। আবলতাবল বলছে কত কি! ক্ষমা চাইতে চাইতে কণ্ঠনালী আটকে আসছে। ফ্যানা বের হচ্ছে মুখ দিয়ে। সে কি অচেতন হয়ে যাচ্ছে! দু হাতে মায়ের পা জড়িয়ে ছেলেটা। একসময় মায়ের পায়ে মাথা লুটিয়ে পড়লো। অচেতন হলো নয়ন।

অতঃপর! এক দীর্ঘশ্বাসের কাহিনী! একমাত্র কন্যাকে হারিয়ে একমাত্র পুত্রকে বাঁচানোর সে কি আপ্রাণ চেষ্টা! মাতৃ হৃদয় লো’ভী হলো। হলো ব’র্বর। এক সন্তানের মায়া ত্যাগ করে আরেকজনকে নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল। তাই তো নি”ষ্ঠুর চিত্তে বেছে নিলো অন্যায়-জঘন্য পথ। প্রায় জনবসতিহীন এলাকা তাদের। তাই অসুবিধা হলো না। দুপুর নাগাদ তড়িঘড়ি করে কন্যাকে দেয়া হলো মাটি চাপা। হলো না কোনো জানাযা, সঠিক রূপে দাফন প্রক্রিয়া। এক স”ম্ভ্রমহারা নারী দেহ লুকায়িত হলো মাটির অতলে। সে সঙ্গে চাপা পড়লো এক ঘৃণ্য অপরাধ। সাড়ে তিন হাত মাটি অবধি কপালে জুটলো না মেয়েটির। এতটাই মূল্যহীন, হেয় সে! এরপরের সময়টা ভাবনা মতো কাটলো না। চরমভাবে মানসিক অস্থিরতা, অপরাধবোধে জর্জরিত নয়ন। মা-ও ভালো নেই। দিনদিন শরীর আরো খারাপ করছে। যত্ন নেয়ার জন্য নেই যে মা পা-গলী মেয়েটা। উৎকণ্ঠিত চিত্তে বলছে না,

‘ ও মা। ওষুধ খাইছো? ‘

‘ বেশি খারাপ লাগতাছে? ‘

‘ ঘুমাইবা না? অনেক রাত হইছে তো। ঘুমের ওষুধ খাইছো! ‘

ঘৃণা করেন এই ঘুমের ওষুধকে। কেন সেদিন এই ওষুধ সেবন করলেন। কেন ম রা ঘুম দিলেন। এ ওষুধ না খেলে বেঁচে যেতো মেয়েটা। এত ঘৃণ্য অপরাধ করতে পারতো কি নয়ন? হয়তো না। সেদিনের পর পেরিয়ে গেল কয়েক মাস। অনুশোচনায়, অপরাধবোধে পা-গলপ্রায় অবস্থা নয়নের। এলো আরেক তুফানি রাত। পা-গলের মতো হাসতে হাসতে ছটফটিয়ে স্বেচ্ছায় মৃ-ত্যুকে বরণ করে নিলো নয়ন। গণ্ডস্থলে ঢেলে দিলো এক সিসি বি ষ। ঝ ল সে গেল গণ্ডস্থল। যেন এক সিসি এ সি ড পড়েছে গলায়। গলাকাটা মুরগির ন্যায় ছটফট করতে লাগলো নয়ন। হাত ফসকে পড়ে গেল সিসি। পিঠ লেগে গেল খাটের পায়ায়। ডান হাতে খামচে ধরলো গলা। তবুও ওষ্ঠপুটে লেপ্টে খুশির ছোঁয়া। চোখে জল অধরে লেপ্টে হাসি। মুক্ত সে। চিরকালের মতো অপরাধবোধ হতে মুক্ত সে।

‘ বুইন রে! ভাই আসতাছি। ‘

এ কেমন বিরল মৃ ত্যুর স্বাদ আচ্ছাদন! ইহকাল ও পরকাল দুই শেষ করে ম র লো নয়ন। বোনের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা আর হলো না রে!

পৃথিবীর বুকে লুকায়িত থাকে কিছু রহস্য। যা ভেদ হয় না কভু। শত চেষ্টা করেও জানে না কেউ। এ তেমনই এক র”হস্যজনক ঘটনা। ছেলেমেয়ে মৃ ত। মায়ের ঠাঁই বৃদ্ধাশ্রমে। মা•দকের ভয়াবহ সংক্রমণে এক পরিবার পেল নির্মম পরিণতি। এ বাস্তবতা। নির্মম-বর্বর বাস্তবতা। পৃথিবীর বুকে এরকম অজস্র ঘরে মা•দকের কু প্রভাবে চলছে অপরাধ। ধ্বং-সলীলা। সেসবের কি নেই কোনো অন্ত? আসবে না কোনো অগ্রদূত? মাতৃভূমি হতে উৎপাটিত হবে না কি এই ধ্বং-স ধ্বং-স খেলা!

অপরাহ্ন প্রহর। প্রিমিয়াম ভিলা প্রাঙ্গন। ঘাসের সবুজাভ আচ্ছাদন বিছানো জমিনে। ছোট-বড় বৃক্ষরাজি দণ্ডায়মান চারিধারে। খোলা আকাশের নিচে সে এক মনোরম পরিবেশ! যেন এক টুকরো সবুজের দুনিয়ায় তাদের আগমন। শীতলতম হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে কায়া। প্রাঙ্গনের একাংশে একত্রে তিন কোণে পাতা তিনটে আকর্ষণীয় হালকা মেরুন রঙা বেঞ্চি। সে বেঞ্চিতে মুখোমুখি বসে হৃদি এবং তার এমপি সাহেব। ইরহাম মোবাইল স্ক্রল করে চলেছে। মনোযোগ নিবদ্ধ মোবাইলে। আর তার অর্ধাঙ্গী? সেলফি তোলায় ব্যস্ত সে হৃদয়ের রাণী। রঙঢঙ করে স্ন্যাপচ্যাটে বেশকিছু ফটো তুললো মেয়েটি। হঠাৎ তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো স্বামীতে। ত্বরিত ভাবলো কিছু। মিটিমিটি হেসে উঠে দাঁড়ালো। অগ্রসর হলো স্বামীর পানে। বসলো তার কায়া ঘেঁষে। আকস্মিক কাণ্ডে ঈষৎ চমকালো ইরহাম! কপালে ভাঁজ ফেলে তাকালো স্ত্রীর পানে।

” কি? ”

” সেলফি। ” একগাল হেসে বললো হৃদি।

” হা? ” ঠিক বোধগম্য হলো না মানুষটির।

” আরে। সেলফি। সেলফি তুলবো দু’জন মিলে। আমরা না বর বউ? ”

” বর বউ বলে সেলফি তুলতে হবে? ” প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ইরহাম।

হৃদি হাসিমুখে ইতিবাচক মাথা নাড়ল,

” ইয়াহ্। তুলতেই হবে। ”

ইরহাম দৃষ্টি সরিয়ে নিজের মোবাইলে নিবদ্ধ করলো। শান্ত স্বরে বললো,

” ছবি তুলতে পছন্দ করি না। ”

তৎক্ষণাৎ আপত্তি জানালো মেয়েটি,

” ও য়ে! একদম মিথ্যে বলবেন না। নির্বাচনী প্রচারণার সময় ইভেন এমপি হওয়ার খুশিতে এত এত ছবি তুলেছেন। সেসময় তো বলেননি ‘ স্যরি। আমি ছবি তুলি না। ‘ যেই বউ বললো অমনি আপত্তি? তা হবে না। তা হবে না। ঘুরুন এদিকে। দাঁত বের করে ঝাঁকানাকা একটা স্মাইল দিন। ফার্স্ট ক্লাস দেখাবে। ”

বউয়ের কথায় না হেসে পারলো না ইরহাম। মুচকি হেসে তাকালো বউয়ের পানে। একমাত্র ছোট বউ। তার এতটুকু ইচ্ছে পূরণ করা যেতেই পারে। তো মোবাইল হাতে নিয়ে স্ত্রীর কথামতো ঘুরে বসলো এমপি সাহেব। তার প্রশস্ত বক্ষপটে কোমল কায়া এলিয়ে দিলো হৃদি। শিউরে উঠলো দুজনারই হৃদয়। শুকনো ঢোক গিলে ওষ্ঠ সিক্ত করে নিলো মেয়েটি। অধরকোলে ফুটে উঠলো মিষ্টি হাসির রেখা। স্বামীকে বললো,

” স্মাইল! ”

ফ্রন্ট ক্যামেরায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করে মুচকি হাসি উপহার দিলো ইরহাম। বিমোহিত রমণী ক্যামেরাবন্দী করলো দু’জনার এই হাস্যজ্জ্বল মুখশ্রী। মানুষটির চিবুক আস্তে ধীরে স্থাপিত হলো অর্ধাঙ্গীর ডান কাঁধে। দু বাহু আবদ্ধ হলো পুরুষালি হাতের মুঠোয়। কম্পন সৃষ্টি হলো মোবাইল আঁকড়ে ধরা হাতে। চক্ষু বুজে তপ্ত শ্বাস ফেললো হৃদি। মনের গহীনে এলোমেলো রূপে ডানা ঝাপটে চলেছে বাহারী প্রজাপতি। এ কেমন হৃদয় পু”ড়ানো অনুভূতি! কোনমতে নিজেকে ধাতস্থ করে আরো কয়েকটি সেলফি তুলে নিলো হৃদি। স্মরণীয় এই ভ্রমণের মনোমুগ্ধকর স্মৃতি হয়ে গেল ক্যামেরায় বন্দী। সেলফি তোলা শেষে স্বামীর বক্ষস্থলে লেপ্টে থেকেই ফটো গ্যালারিতে ছবিগুলো দেখতে লাগলো হৃদি। উচ্ছ্বাস পরিলক্ষিত হচ্ছে মুখভঙ্গিতে। তা লক্ষ্য করে প্রসন্ন হলো ইরহাম। এই স্বচ্ছ-নির্মল হাসিটুকুর জন্য সে সব করতে রাজী। সদ্য তোলা ফটো দেখা শেষে মোবাইল রাখতে যাচ্ছিল হৃদি। আকস্মিক ভ্রু কুঁচকে গেল মানুষটির। বাঁধাপ্রাপ্ত হলো হৃদি। লহমায় তার মোবাইলটি চলে গেল স্বামীর হাতে। থতমত খেল মেয়েটি। এটা কি হলো? তীক্ষ্ণ চোখে মোবাইলের স্ক্রিনে তাকিয়ে ইরহাম। হৃদি উঁকিঝুঁকি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে হচ্ছেটা কি। বেশি অপেক্ষা করতে হলো না। ওর পানে মোবাইল ঘুরিয়ে ধরলো ইরহাম। গম্ভীর স্বরে শুধালো,

” এটা কি? ”

হৃদি মনোযোগ সহকারে মোবাইলের স্ক্রিনে তাকালো। থতমত খেল ওয়ালপেপার দেখে। ইশ্ রে! গেল। মানসম্মান সব গেল। ওয়ালপেপারে শোভা পাচ্ছে বছর কয়েক পূর্বে তোলা একটি ফটো। ওর সম্মানীয় স্বামী মহারাজের। কি সুন্দর ঝাঁকানাকা পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে! অতটাও গম্ভীর-তেঁতো লাগছে না। ভাল্লাগছে! হৃদি বেমানান হাসি উপহার দিলো।

” ছবি। নাইস না? ”

” তোমার মোবাইলে এটা কি করছে? ” গাম্ভীর্যে ভরপুর প্রশ্ন।

হৃদি আকাশ পাতাল ভাবলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে মাথা চুলকে নিলো‌। অতঃপর পেশ করলো এক ডাহা মিছা কথা।

” হে হে। আমি এমপির বউ না? সবাই যাতে সহজেই বিশ্বাস করতে পারে এজন্য এই ফটো সেট করেছি। ভালো করেছি না? ”

কেমন নিষ্পাপ চাহনিতে তাকিয়ে। ইরহাম স্তব্ধ! বুঝে উঠতে পারলো না ঠিক কেমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা উচিত। এমন গাঁ-জাখুরি মিথ্যাও হতে পারে! স্বামীর চাহনি দেখে হৃদি অনুধাবন করতে পারলো মিথ্যাটা ঢোপে টেকেনি। ওরে গাঁধী! কাঠখোট্টা জবাবদিহিতা থেকে বাঁচতে চাইলে পালা। পালানো বিহীন দ্বিতীয় পথ খোলা নেই। স্বামী হতে নিরাপদ দূরত্বে বসলো মেয়েটা। চক্ষু ঘুরছে আশেপাশে। কোন পথে পালানো সহজ হতে পারে! ইয়েস। পেয়ে গেছে। ইরহাম যেই কিছু বলতে উদ্যত হলো অমনি খালাস মিসেস হৃদি শেখ! চোখের পলকে হৃদি উধাও। অবহেলিত মোবাইলটি পড়ে রইলো ইরুর হাতে। হতভম্ব সে! এটা কি হলো?

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে