#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৬
” ও ভাই! আরেক পেগ দাও না। ”
কালো আঁধারে তলিয়ে বসুন্ধরা। শহরের একটি নামকরা বার এ আজ আগমন হয়েছে নতুন অতিথির। নাম তার রাহিদ। অন্তরের বিষাদপূর্ণ অবস্থা হ্রাস করতে এক বন্ধুর কু পরামর্শে এখানে আসা। জীবনে হার্ড ড্রিংকের স্বাদ না নেয়া ছেলেটি আজ একের পর এক গ্লাস বিস্বাদ তরল গলাধঃকরণ করে চলেছে। জ্ব’লে পু’ড়ে খাঁক গণ্ডস্থল। ঝাপসা হয়ে আসছে দৃষ্টি। ভোঁ ভোঁ শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে মস্তকে। টালমাটাল পদযুগল। যা দেখছে ডাবল ট্রিপল দেখছে। তবুও থেমে নেই সে। বার কাউন্টারে একটি স্টিলের চেয়ারে বসে রাহিদ। একটু একটু করে ম দ পান করছে আর বিকৃত হচ্ছে চেহারার ভাবভঙ্গি। কাউন্টারের ছেলেটি স্পষ্ট বুঝতে পারলো এ বান্দা প্রথমবারের মতো ম দ খাচ্ছে। প্রেমে ছ্যাঁ’ক খেয়ে নির্ঘাত দুঃখ মোচন করতে এসেছে। তাই তো এমন অবস্থা। ইতিমধ্যে বেশ কয়েক পেগ খাওয়া শেষ। অন্তঃস্থল চাইছে আরো। তাই তো নে-শাক্ত আধো আধো স্বরে কাউন্টারে বসে থাকা ছেলেটির দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললো,
” ও ভাই! আরেক পেগ দাও না। ”
মাথা এবং শরীর দুইই দুলছে। ঘুরছে মস্তিষ্ক। নিষ্পাপ চেহারা বানিয়ে ডান হাতটি বাড়িয়ে দিয়েছে রাহিদ। হাতে ম দ চাইছে কি! বিরহ বেদনা সইতে না পেরে রাহিদ ভুলে গেল ধর্মীয় অনুশাসন। কুরআন ও হাদীসের কথা। সে কি করে ভুলে গেল হাদীসের সেই বাণী,
” যে ব্যক্তি দুনিয়াতে ম-দ পান করবে ও তাওবাহ করবে না, সে আখেরাতে তা থেকে বঞ্চিত হবে। [বুখারী ৫৫৭৫] ”
ইসলামে ম দ কিংবা সকল ধরনের নে শাদ্রব্য হা”রাম ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে স্বেচ্ছায় প্রথমবারের মতো এমন গর্হিত অপরাধ করে চলেছে ছেলেটি! দুঃখজনক! রাহিদ আরেক পেগ খাওয়ার জন্য ছটফট করে চলেছে। মাথার মধ্যে ট্রেন চলেছে ঝিকঝিক শব্দে। পেটের মধ্যে কুস্তি খেলছে বিড়াল কুকুর। উফ্ যন্ত্রণা! ছিঁড়ে যাচ্ছে কপালের পাশ্ববর্তী রগ। শরীরটা বড় খারাপ লাগছে। সে কি দুঃখ যন্ত্রণা প্রকাশ করতে না পেরে ম রে যাচ্ছে? হঠাৎ তার ব্যথিত দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো নিজ বরাবর ডান পাশে। ত্বরিত ঝলমলে রোদের মতো উজ্জ্বল হলো মুখখানা। ভুলে গেল সকল যাতনা! ইনু! তার ইনু এসেছে! প্রিয়তমের ডাকে সাড়া দিয়ে চলেই এসেছে। ওহ্ ইনু! প্রেম প্রেম চাহনিতে তাকিয়ে রাহিদ। আস্তে ধীরে দু হাত দুই দিকে ছড়িয়ে দিলো। জড়ানো স্বরে কাছে আসার আহ্বান জানাচ্ছে,
” ইনু! আ আমার সোনা! ত্ তুই এসেছিস? আয়। বুকে আ য়। ”
এলো না ইনু। শুভ্র পোশাকে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে। রাহিদ ঝাপসা দেখছে ঠিকই। দুই তিনখান দেখছে। তবুও প্রিয়তমাকে চিনতে ভুল করেনি। অস্ফুট স্বরে ডেকেই চলেছে। কিন্তু নির্দয় প্রিয়তমা এলে তো।
” আয় না ইনু। তোকে একটু ব্ বুকে নিয়ে অশান্ত বুকটা শা ন্ত করি। আয় না সোনা। আয়। ”
দুই হাত প্রসারিত করে অবিরাম আকুতিমিনতি করে চলেছে ছেলেটা। আকস্মিক ঝড় উঠলো। শক্তপোক্ত এক যন্ত্রণাদায়ক চ ড় পড়লো বাম গালের আবরণে। আকস্মিক আঘাতে বিহ্বল হলো ছেলেটা। ভারসাম্য হারিয়ে নেমে গেল দুই হাত। পু’ড়ে যাচ্ছে গাল। এত জোরে তার ইনু মা রতে পারলো! বেদনা মিশ্রিত চাহনিতে ইনুর পানে তাকালো রাহিদ। এবার আতঙ্কিত হবার পালা। তৎক্ষণাৎ কেটে গেল নে শা। ইনু! কোথায় তার ইনু! তোতলাতে তোতলাতে বলে উঠলো,
” ভা ই য়া! ”
ইয়েস! কোনো ইনা মিনা দিকা নয়। বরং তার সম্মুখে বিপদের বার্তা সমেত দাঁড়িয়ে ইরহাম। এমপি ইরহাম চৌধুরী। শুভ্র পোশাকে আচ্ছাদিত মানুষটির চোখেমুখে কাঠিন্যতা। অসন্তোষ প্রকাশ পাচ্ছে প্রতিটি অভিব্যক্তিতে। নভোনীল চক্ষুদ্বয়ে আজ অমানিশার ঘোর অন্ধকার। অপরাধবোধে নত হলো রাহিদের মস্তক। ছিঃ! ধিক্কার নিজেকে। এসব কি করছিল সে?
” ভালোবাসিস আমার বোনকে? ”
ব’জ্রকণ্ঠে শুধালো মানুষটি। বিহ্বল রাহিদ কিচ্ছুটি বলতে পারলো না। চুপটি করে আনত নয়নে বসে।
” কিছু জিজ্ঞেস করেছি আমি। রাহি! ”
হিমশীতল শিহরণ বয়ে গেল রন্ধ্রে। বদ্ধ হলো অক্ষিপুট। আস্তে ধীরে ইতিবাচক মাথা নাড়ল রাহিদ। আজ দ্বিধাহীন চিত্তে প্রকাশ করেই ফেললো হৃদয়ে লুকানো অনুভূতির বহর। হাঁ। সে ভালোবাসে তার ইনুকে। দুর্বোধ্য রেখা ফুটে উঠলো এমপি সাহেবের অধরকোণে। বারের উগ্র পরিবেশ ছাপিয়ে সে ব্যক্ত করলো এক অভাবনীয় বাক্য,
” গেট রেডি ম্যান। ”
চমকিত নেত্রে তাকালো রাহিদ! প্রস্তুত! কিসের জন্য? কি বলছে ইরু ভাইয়া! হুঁ?
•
পাশাপাশি বসে দু’জনে। একদম পারফেক্ট টোনাটুনি লাগছে! হতবিহ্বল নয়নে তাদের পানে তাকিয়ে হৃদি! একবার ওদের দিকে তো আরেকবার পাশে দণ্ডায়মান স্বামীর দিকে তাকালো মেয়েটি। চোখেমুখে অবাকতার রেশ! চোখের ইশারায় কাজটি করতে আদেশ প্রদান করলো ইরহাম। শুকনো ঢোক গিলে চক্ষু বন্ধ করলো হৃদি। মিললো চোখ। আস্তে ধীরে কম্পিত হস্তে কাগজের নির্ধারিত স্থানে স্বাক্ষর করে দিলো। সাক্ষী হিসেবে লিখিত হলো ওদের কয়েকজনের নাম।
” আজ থেকে আপনারা দু’জন ধর্মীয় ও আইনী মতে স্বামী-স্ত্রী। নতুন জীবনের জন্য দোয়া ও শুভকামনা রইলো। ”
বর কনের স্থানে বসে রাহিদ এবং তার ইনায়া। বদ্ধ হলো মেয়েটির আঁখি পল্লব। অপ্রত্যাশিত সুখের অশ্রু গড়িয়ে পড়লো কপোল ছুঁয়ে। রাহিদ চোখ বন্ধ করে বড় করে শ্বাস ফেললো। শুকরিয়া আদায় করলো মহান স্রষ্টার। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তাকালো ভাইয়ের দিকে। ইরহাম চোখের পলক ঝাপটে ভরসা প্রদান করলো। মিষ্টি করে হাসলো রাহিদ। ভাইয়ের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তাকালো নববধূর পানে। তার অর্ধাঙ্গিনী। তার ইনু। সত্যিই আজ থেকে ইনু তার জীবন ম”রণের সঙ্গিনী! এখনো বিশ্বাস করতে নারাজ অন্তর। এ কি থেকে কি হয়ে গেল!
এই মুহূর্তে তারা অবস্থান করছে ইরহামের এক বাংলো বাড়িতে। সকাল সকাল ভাইয়ের ইমার্জেন্সি কল পেয়ে এখানে ছুটে এসেছিল রাহিদ। এরপর যা হলো স্বপ্নের মতো। সাহিল ও দু’জন মিলে তাকে নিয়ে গেল এক ফাঁকা ঘরে। স্বল্প সময়ের মধ্যেই বরবেশে প্রস্তুত সে। সফেদ পাঞ্জাবি, পাজামা পড়নে তার। মাথায় টুপি। পবিত্রতা প্রকাশ পাচ্ছিল এহেন রূপে। সাহিল তাকে এনে বসালো সোফায়। বোধবুদ্ধি লোপ পাচ্ছিল রাহিদের। বুঝে উঠতে পারছিল না কি থেকে কি হচ্ছে। এসবের মানে কি? আর ভাইয়া ই বা কোথায়? তাকে ডেকে কোথায় হারিয়ে গেল? সব ঠিক আছে তো? কেমন একটা অনুভূতি হচ্ছে। ধুকপুক ধুকপুক করছে ভেতরে। অবশেষে অপেক্ষার প্রহর সমাপ্ত হলো। জীবনের অন্যতম বড় চমক পেল ছেলেটা! বধূ বেশে সিঁদুর লাল বেনারসী শাড়ি পড়নে তার প্রেয়সী। ভাবীর সঙ্গে ধীরপায়ে হেঁটে আসছে। এদিকেই আসছে সে। যার প্রতিটি পদচারণায় দামামা বেজে উঠছে হৃদয়ের অন্তঃস্থলে। স্বার্থক আজ চক্ষুজোড়া! বিমুগ্ধ চাহনিতে তাকিয়ে রইলো সে! ভুলে গেল জাগতিক সকল প্রকার হুঁশ।
বধূ বেশে কন্যা বসলো তার বাঁ পাশে। স্নিগ্ধ এক সুবাস কড়া নাড়লো নাসিকা গ্ৰন্থিতে। আবেশে নিমীলিত হলো রাহিদের আঁখি যুগল। এরপরের সময়টা কাটলো এক মধুর স্বপ্নের মতন। প্রথমে ধর্মীয় মতে অতঃপর আইনী ভাবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলো রাহিদ, ইনায়া যুগল। সাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষর করলো হৃ’হাম এবং এমপি সাহেবের সাগরেদরা। এ কি সত্যিই কোনো স্বপ্ন? তবে আমৃ”ত্যু এই স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছুক সে। ঘুম থেকে জাগ্রত হতে নারাজ। প্রেয়সীর সঙ্গে স্বপ্নে বাঁধবে সুখের সংসার। হালি হালি সোনামনি হবে তাদের। উফ্! কি মধুরতম আকাঙ্ক্ষা! সব পূরণ হবে তো? নাকি ভেঙ্গে চুরমার হবে সব? হঠাৎই মনে কালো মেঘ জমলো ছেলেটার। তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী এমন বিষন্ন বদনে বসে কেন? একটিবারের জন্যও তার দিকে তাকালো না। অবনত মস্তকে বসে। সে কি এ বিয়েতে খুশি নয়? অপ্রসন্ন হয়ে আছে? নাকি অভিমানে এমন হাল? উফ্! চিন্তায় চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছে। আর ভাবা যাচ্ছে না। বাকি যা ভাবার ভাববে বাসর রাতে। বাসর রাত! শিরশির করে উঠলো কায়া। আচ্ছা অতি খুশিতে সে কি পা-গল হয়ে যাচ্ছে? এমন অনুভূতি হচ্ছে কেন?
ইরহাম এবং হৃদি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। রূক্ষ আঙ্গুলের ভাঁজে ডুবে পেলব আঙ্গুল। গাঢ় বাঁধন। তাদের উজ্জ্বল মুখশ্রী নিবদ্ধ নব দম্পতির পানে। সদা সুখী থাকুক এ যুগল, এ-ই তাদের দোয়া! সাহিলের ডাকে ধ্যান ভঙ্গ হলো। স্ত্রীর আঙ্গুলের ভাঁজ হতে আঙ্গুল সরিয়ে নিলো ইরহাম। এগিয়ে গেল সাহিলের পানে। কথোপকথনে লিপ্ত হলো তারা। সাহিল কিছু বলে চলেছে। গম্ভীর বদনে মনোযোগ সহকারে তা শুনছে মানুষটি। যেন একটি শব্দও বাদ না পড়ে যায়। হৃদি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে স্বামীর পানে। গর্বিত এমন উদারমনা একজনের সঙ্গিনী হতে পেরে। মানুষটি এত ভালো কেন? সে যেন সাধারণের বেশে অসাধারণ একজন! তার প্রতিটি বাচ্যভঙ্গী, মতাদর্শ, চিন্তাভাবনা কেমন ভিন্নতর। মুগ্ধকর! তার আশেপাশে থাকা প্রতিটি জীব তার থেকে পজিটিভ ভাইবস্ পেয়ে থাকে। ভালোমন্দ দুই মিলিয়ে মানুষ। তবে এ মানুষটির ভালো গুণগুলো তার স্বল্প মন্দ দিকটিকে পুরোপুরি আড়াল করে ফেলে। স্বার্থক তার ক্ষুদ্র জীবন এমন একজনার জীবনসঙ্গী হতে পেরে। বিমোহিত নয়ন জোড়া অনিচ্ছা সত্ত্বেও সরিয়ে নিলো হৃদি। নইলে উপস্থিত সব্বাই কি বলবে? বর পা গ লী হৃদি! ইশ্!
.
ধরিত্রীতে তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। বিদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে সূর্য মামা। সে মুহূর্তে উন্মুক্ত হলো ‘ আনন্দাঙ্গন ‘ এর সদর দরজা। দরজায় দাঁড়িয়ে সুঠামদেহী সুশ্রী মানব। বামে দাঁড়িয়ে তার সহধর্মিণী। ডান হাতের মুঠোয় বন্দী বোনের আদুরে হাত। আর বোনের পাশেই দাঁড়িয়ে নব বোন জামাই। নবদম্পতির সাজে সজ্জিত রাহি-ইনু! দরজা উন্মুক্ত করেই এমন অপ্রত্যাশিত দৃশ্য দেখে বাকশূন্য হলেন মালিহা! কিয়ৎক্ষণ বাদে অস্ফুট স্বরে একটিমাত্র শব্দ উচ্চারণ করতে পারলেন,
” ইনু! ”
অবনত মস্তকে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে চলেছে ইনু। ইরহামের দিকে একপলক তাকিয়ে অন্দরে প্রবেশ করলো হৃদি। মায়ের কাঁধ বাঁ হাতে আঁকড়ে ধরলো। কোমল স্বরে বললো,
” মা! একটু শান্ত হও। সবটা বুঝিয়ে বলছি। ”
হৃদির কণ্ঠে থমকে গেল লিভিং রুমে চলমান অশান্তি। জহির সাহেব একপ্রকার রূঢ় শব্দমালা গিলে নিলেন। এজাজ সাহেব হতে দৃষ্টি সরিয়ে ক্রো-ধান্বিত চেহারায় তাকালেন ওদের পানে। এজাজ সাহেবের মুখখানাও থমথমে। পল্লবীর চোখে জমায়েত জল। সবটা অবজ্ঞা করে ভেতরে প্রবেশ করলো দুই যুগল। তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল নির্ভীক। চোখেমুখে অপরাধবোধের লেশমাত্র নেই। নেই কোনো অনুশোচনা। বড়দের অগ্রাহ্য করে সোফায় আয়েশ করে বসলো ইরহাম। বাঁ হাত এলিয়ে সোফার ফোমযুক্ত হাতলে। গরম লাগছে বেশ। ডান হাতে পাঞ্জাবির ওপরের দু’টো বোতাম খুলে ফেললো। স্ত্রীকে বলার পূর্বেই সে গেল এবং ফিরে এলো মিনিটের মধ্যেই। স্বামীর পানে এগিয়ে দিলো পানির গ্লাস। তৃপ্তির সহিত পানি পান করে গ্লাসটি ফেরত দিলো ইরহাম। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে মুচকি হাসলো। হৃদিও বিনিময়ে আলতো হাসি উপহার দিলো। গ্লাস রাখলো সেন্টার টেবিলের ওপর। এদের মিয়া-বিবির এমন নির্লিপ্ততা দেখে ক্রো’ধে ফেটে পড়লেন জহির সাহেব।
” তোমাদের এতবড় দুঃসাহস! দিনদুপুরে জোরজবরদস্তি করে আমার ছেলেকে বিয়ে দিয়ে দিলে? হাউ ডেয়ার ইয়্যু? ”
ইরহাম ডান হাতের ইশারায় ওনায় শান্ত হতে বললো। মুখে বললো,
” শান্ত মামা সাহেব। শান্ত হন। বিপি বেড়ে যাবে তো। এই বয়সে এত চিল্লাচিল্লি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ”
ধমকে উঠলেন উনি,
” চুপ! একটাও ফালতু কথা বলবে না। বোনের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। তাহলে কিসের ভিত্তিতে ওকে আমার ছেলের গলায় ঝুলিয়ে দিলে? কি করে? ”
ত্বরিত সোজা হয়ে বসলো ইরহাম। মুখশ্রী হতে মুছে গেল রসিকতা। কঠিন স্বরে বলে উঠলো,
” বিয়ে ঠিক হয়েছিল। হয়ে যায়নি। ফর ইয়্যুর কাইন্ড ইনফর্মেশন, তোমার ছেলে কচি খোকা নয় যে তাকে ধরে বেঁধে বিয়ে দেবো। হি ইজ অ্যান অ্যাডাল্ট। ”
” ওর বিয়ের বয়স হয়নি। ”
” হালাল প্রেম করার বয়স হয়েছে। সেটার ব্যবস্থাই করেছি। ওকে? ” শীতল স্বরে বললো মানুষটি।
ওর সঙ্গে কোনোমতেই কথার মা”রপ্যাঁচে পেরে উঠছেন না জহির সাহেব। তাই তো ঘুরে দাঁড়ালেন বোন জামাইয়ের দিকে। এজাজ সাহেবকে বললেন,
” এজাজ ভাই! এগুলো কিন্তু চরম লেভেলের বেয়াদবি হচ্ছে। ইরহাম কি করে এসব করতে পারে? আপনি কিছু বলছেন না কেন? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সার্কাস দেখছেন? ”
স্বামীর বদলে মুখ খুললেন স্ত্রী। মালিহা চিন্তাগ্ৰস্থ অবস্থা একপাশে রেখে স্বামীর পক্ষ নিলেন। বড় ভাইকে বলে উঠলেন,
” ভাইজান! এবার কিন্তু তুমি বেশি বেশি করছো। এভাবে ওনার সঙ্গে কথা বলতে পারো না। উনি বয়সে তোমার বড় হন। ”
এ প্রথমবারের মতো চরম অপমানে বাকশূন্য এজাজ সাহেব। ওনার প্রিয়ভাজন জহির আজ ভিন্ন রূপ দেখালো। যা নয় তাই বলে করলো অসম্মান। আর নিজ পুত্র-কন্যা! তারা নিজেদের হাতে জন্মদাতা পিতার অপমানের পথ উন্মোচন করে দিলো। পিতা হিসেবে এতখানি নীচ, হেয় উনি! চরম অপমান সইতে না পেরে কাঁপছে দেহ। নিশ্চুপ উনি ধীরপায়ে সেথা হতে প্রস্থান করলেন। পা বাড়ালেন বেডরুমের দিকে। জহির সাহেব রাগে গজগজ করে চলেছেন। এজাজ ভাই এভাবে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল! আর ছোট বোন কিনা! উনি রাগে থরথর করে কাঁপছেন। তাকালেন রাহিদের দিকে। রাহিদের কঠোর চাহনি তার পানেই নিবদ্ধ। নিজ ব্যর্থতা মানতে নারাজ জহির সাহেব পুত্রের দিকে দ্রুত পায়ে তেড়ে গেলেন। চ-ড় মা”রতে উদ্যত হতেই হতভম্ব হলেন! ওর পুরুষালি হাতটি বাঁধাপ্রাপ্ত হলো শক্তপোক্ত এক হাতে। উপস্থিত সকলেই চরম আশ্চর্যান্বিত!
” নো মামা সাহেব। একদম নয়। আমার বোনের স্বামীর গায়ে এক চিমটি পরিমাণ আঘাত সহ্য করার মতো ভদ্রলোক নই আমি। ইয়্যু নো দ্যাট ওয়েল। তাই না? ”
চোখে চোখ স্থির হলো। ইরহামের চোখে তখন সীমাহীন অনমনীয়ত্ব! না চাইতেও ভড়কে গেলেন জহির সাহেব। ওনার হাতের কব্জিতে শক্তপোক্ত হাতের ছাপ অঙ্কিত করে হাতটি একপ্রকার ছিটকে ছেড়ে দিলো ইরহাম। অবিন্যস্ত চুলে আলতো করে আঙ্গুল চালনার ফাঁকে চোখের ভাষায় ওনাকে আচরণের সীমা-পরিসীমা বুঝিয়ে দিলো। রিমলেস চশমার অন্তরালে লুকায়িত নভোনীল চক্ষু জোড়া তখন শান্ত অথচ ভয়”ঙ্কর! মুহুর্তের মধ্যেই অশান্ত পরিবেশ শান্ত হলো। নির্ভীক পদচারণায় সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেল এমপি সাহেব। ধীরে ধীরে ভঙ্গ হলো ভীড়। সকলে নিজ নিজ গন্তব্যে অগ্রসর হলো। একাকী লিভিংরুমে দাঁড়িয়ে জহির সাহেব। আজকের এই অপরাধের কোনো ক্ষমা নেই। নেভার এভার!
চলবে.
#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৭
নিকষকৃষ্ণ রজনী। ঘরের বাহিরে অবিরাম পায়চারি করে চলেছে ছেলেটা। একবার ডানে যাচ্ছে তো একবার বামে। কখনো আবার থমকে দাঁড়িয়ে তাকাচ্ছে ঘরের দরজায়। ভেতরে যাবে কি যাবে না! আশ্চর্য! আজ হঠাৎ এমন অদ্ভুত লাগছে কেন? এমনটা নয় যে এই ঘরে সে ইতঃপূর্বে আসেনি। এসেছে। অল্প কয়েকবার হলেও এসেছে। তবে সে আসা আর আজকের আসার মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। তখন তো আসতো মামাতো ভাইয়ের পরিচয়ে। আর আজ? মামাতো বর হিসেবে। উফ্! আবার কিসব উদ্ভট ভাবনা উদয় হচ্ছে। বিরক্ত হয়ে ‘ চ ‘ সূচক ধ্বনি মুখনিঃসৃত হলো। ইতস্তত করে মন্থর পায়ে ঘরের দরজায় দাঁড়ালো রাহিদ। আস্তে করে হাত বাড়িয়ে দিলো। দরজায় কড়া নাড়তে গিয়ে টের পেল কম্পিত তার হাত। উফ্ কি এক যন্ত্রণা! নিজের ওপর সীমাহীন বিরক্তি নিয়ে হুট করেই ঘরে প্রবেশ করলো সে। লাগবে না নক করা। তবে সে কি জানতো ঘরে প্রবেশ করামাত্র তার জন্য অপেক্ষা করছে অভাবনীয় চমক!
বিহ্বল নয়নে সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীর পানে তাকিয়ে রাহিদ! সে কি ঠিকঠাক দেখছে! নাকি জেগে জেগে দিবাস্বপ্ন! আজকের দিনে আর কত চমকাবে সে? চমকে চমকে হৃদযন্ত্র কাজ করা না বন্ধ করে দেয়! কি ভয়ঙ্ক”র ব্যাপার স্যাপার! ঘর জুড়ে মৃদু আলোর উপস্থিতি। টেবিল ল্যাম্পের আলোয় উজ্জ্বল স্টাডি টেবিলটি। সেথায় বইপত্র নিয়ে পড়ালেখায় মনোযোগী তার নববধূ। মিসেস ইনায়া। বোঝাই যাচ্ছে অ্যাডমিশন কোচিংয়ের পড়াগুলো রিভাইস দিচ্ছে। ঘরোয়া পোশাক পরিহিতা অর্ধাঙ্গীকে অবলোকন করে অন্তরে বেজে উঠলো ছ্যাঁ’কা খাওয়া গান। নিয়ম মোতাবেক আজ না তাদের বাসর রাত! টোনাটুনির কাছে আসার রাত! আর কাছে আসা! সে যে এতদিন কুকর্ম করেছে এর খেসারত দিতে দিতে প্রথম বিবাহবার্ষিকী না চলে আসে! দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাতে থাকা ব্যাগের দিকে তাকালো রাহিদ। দু’টো ব্যাগ। একটায় নিজের জন্য পোশাক। আরেকটিতে নববধূর জন্য ছোট্ট উপহার। আজকের দিনে স্ত্রীকে উপহার না দিলে হয় নাকি? তবে সে কি এই ছোট্ট উপহারটি নেবে? ভাবনা একপাশে রেখে বিছানার একাংশে ব্যাগ দু’টো রাখলো রাহিদ। একটি ব্যাগ হতে নিজের পোশাক বের করলো। আজ রাতটি এখানে ‘ আনন্দাঙ্গন ‘ এ কাটাবে সে। ইরু ভাইয়ার গুরুগম্ভীর আদেশ। আদেশ পালন না করে উপায় আছে? অপর ব্যাগটি একটু সাবধানে রেখে পোশাক নিয়ে ছেলেটি পা বাড়ালো ওয়াশরুমের পানে। অতি শীঘ্র ফ্রেশ হওয়া আবশ্যক। সারাদিনের ক্লান্তিতে গা হাত-পা বেশ ম্যাজম্যাজ করছে।
একটি অঙ্কের সমাধান নির্ণয় করতে ব্যস্ত ইনায়া। তখন দ্বার উন্মুক্ত করে ওয়াশরুম হতে বেরিয়ে এলো রাহিদ। সদ্য স্নাত ছেলেটির পড়নে টিশার্ট, থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট। ঘরে সে এমন পোশাকে অভ্যস্ত। অভ্যস্ত নয় ওয়াশরুমের মেয়েলি সুবাসে। প্রথমবারের মতো একটি মেয়ের ওয়াশরুম ব্যবহার করলো সে। সর্বত্র মেয়েলি সুবাস, বাথ এক্সেসরিজ। কেমন ভিন্নতর অনুভূতি হচ্ছিল। আজকের পর থেকে এমনই তো হবে। তার ঘর এবং জীবন সর্বত্র থাকবে এই ললনার উপস্থিতি। একান্ত সুবাস। ভাবতেই পুলকিত হলো তনুমন। বেলকনিতে ভেজা তোয়ালে মেলে দিলো রাহিদ। উপায় না পেয়ে নববধূর তোয়ালে ব্যবহার করেছে। মেয়েটা রাগ না করে বসে। ওষ্ঠাধর গোলাকার করে তপ্ত শ্বাস ফেললো। প্রবেশ করলো ঘরে।
বিছানায় শুয়ে রাহিদ। অপলক তাকিয়ে পড়ালেখায় মগ্ন স্ত্রীর পানে। শরীরটা খুব ক্লান্ত। কয়েকবার জানতে চেয়েছিল কোথায় শয্যা গ্রহণ করবে। বিছানায় শোবে কি? ওপাশ হতে কোনোরূপ সাড়া মিললো না। অগত্যা কিইবা করার? অনুমতি বিহীন বিছানায় গা এলিয়ে দিলো সে। কেউ যদি স্বেচ্ছায় বধির হয়ে থাকে সে কি করতে পারে? হুম! নববধূর অপেক্ষা করতে করতে এসময় নিদ্রা নেমে এলো চোখের পাতায়। বুঁজে আসছে আঁখি পল্লব। সে কি ঘুমিয়ে পড়ছে? সজাগ থাকতে হবে তো। আজ না তার বাসর? ইটিশপিটিশ না হোক অন্তত বউয়ের সাথে কথা তো বলতে হবে। লম্বা হাই তুলে নিদ্রায় তলিয়ে গেল ছেলেটা। খতম তার আকাঙ্ক্ষিত বাসর। কিয়ৎক্ষণ বাদে চেয়ারে বসেই পিছু ঘুরে তাকালো ইনায়া। চোখে জমে অশ্রু। অনিমেষ নেত্রে তাকিয়ে বিবাহিত স্বামীর পানে। স্বপ্ন বুঝি এমন করেও সত্যি হয়?
.
অন্ধকারাচ্ছন্ন কক্ষটি। আরামকেদারায় বসে এজাজ সাহেব। কালো মেঘে ছেয়ে মুখাবয়ব। হাতে তাদের ফ্যামিলি ফটো অ্যালবাম। একটা একটা করে পাতা বদল করছেন উনি। চিত্র একই। প্রায় পঞ্চাশের অধিক ফটো ঠাঁই পেয়েছে এ অ্যালবামে। তন্মধ্যে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে উনি উপস্থিত হাতে গোনা সাতটি ফটোয়। বাকিতে অনুপস্থিত উনি। হবেন না? আজীবন কাজ-কাজ, টাকার পেছনে ছোটাছুটি, ফ্যামিলি স্ট্যাটাস বজায় রাখতে গিয়ে পরিবারকে দু দণ্ড সময় দিয়েছেন কি? দেননি তো। নামমাত্র পিতার ভূমিকা পালন করেছেন। সত্যিকার অর্থে সন্তানদের পিতা কিংবা বন্ধু হয়ে ওঠতে পারেননি। তাই তো আজ এ দিন দেখতে হলো। পিতা হিসেবে ওনার অপারগতার জন্য ই পর হয়েছিল একমাত্র ছেলে। আজ মেয়েও সে পথে পা বাড়ালো। জীবনের এতবড় সিদ্ধান্তে বাবাকে সাথে রাখার বিন্দুমাত্র প্রয়োজন বোধ করলো না। এতটাই পর উনি? পর ই তো। নামমাত্র পিতা। ব্যর্থ উনি একজন স্বামী হিসেবে, সন্তানদের পিতা হিসেবে। সীমাহীন ব্যর্থতা কুঁড়ে কুঁড়ে খেতে লাগলো ওনায়।
এমনটা তো চাননি উনি। কোনো বাবাই তার সন্তানের ক্ষতি চায় না। উনিও চাননি। জুনায়েদ ভালো ছেলে। ইনুকে সুখে রাখবে। এমনটাই প্রত্যাশা করেছিলেন। তাই ছেলে যখন মতের বিরোধিতা করলো, জেদের বহিঃপ্রকাশ করলো উনি চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন। একরোখা, জেদি ছেলে ওনার। যা বলে তাই ই করে। এখন তো আবার সাংসদ। ক্ষমতার অধিকারী। বেশ শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন উনি। তাই তো তাড়াতাড়ি করে আকদের তারিখ এগিয়ে আনলেন। ভালোয় ভালোয় সবটা করতে চেয়েছিলেন। তা আর হলো কোথায়? হিতে চরমভাবে বিপরীত হলো। সবটা শেষ হয়ে গেল। শেষ। ব্যর্থ উনি আজ মানসিকভাবে বিধ্ব-স্ত। এত বড় দুনিয়ায় একাকী উনি। মস্ত পাপী। আস্তে ধীরে বুঁজে আসছে আঁখি যুগল। অনুভব করতে পারলেন মাথায় মমতার সহিত হাত বুলিয়ে চলেছ একজন। ঝাপসা চোখে দেখতে পেলেন এক নারী অবয়ব। ওনার সহধর্মিণীর। তৃপ্তির আভা ছড়িয়ে পড়লো অধরে। না। একা নন উনি। একজন তো অন্তত রয়েছে সাথে। ওনার অর্ধাঙ্গী। এই যে ওনাকে আলতো করে ধরে যত্নের সহিত বিছানায় শুয়ে দিচ্ছে। কাঁথা টেনে দিচ্ছে দেহে। সে রয়েছে পাশে। ধীরে ধীরে নিশ্চিন্তে নিদ্রায় তলিয়ে গেলেন উনি। চোখেমুখে উজ্জ্বলতা।
.
ডিভানে বসে ইরহাম। হাতে পার্টির একটি ফাইল। গুরুত্বপূর্ণ কর্মটি সম্পাদনে ব্যস্ত সে। তবে বারবার মনোযোগে বিঘ্নিত হচ্ছে। যন্ত্রণা হচ্ছে মাথায়। কপালের রগ যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে। লালচে রঙ ছড়িয়ে চোখের সফেদ অংশে। মুখভঙ্গিতে কেমন যাতনার প্রকাশ। দিনভর এমন তেমন দৌড়ঝাপ, অশান্তিতে শরীর আর সইতে নারাজ। বড় কষ্ট হচ্ছে। কষ্টদায়ক সে মুহূর্তে প্রশান্তির পরশ পাথর হিসেবে আগমন হলো স্ত্রীর।
” আর কত পরিশ্রম করবেন? এবার তো একটু নিজেকে বিশ্রাম দিন। ”
চোখ তুলে তাকালো ইরহাম। রিমলেস চশমার অন্তরালে লুকায়িত চক্ষুজোড়া যন্ত্রণা গোপন করতে ব্যর্থ হলো। ত্বরিত চিন্তিত হয়ে পড়লো হৃদি। এগিয়ে এসে স্বামীর কাঁধে হাত রাখল।
” আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? শরীর খারাপ করছে? কাজকর্ম এখন বাদ দিন তো। পরেও করা যাবে এসব। আসুন আমার সঙ্গে। ”
কণ্ঠে কেমন আদুরে শাসনের আভাস। যন্ত্রণার মাঝেও এক চিলতে তৃপ্তি প্রকাশ পেল। ততক্ষণে বেদখল ফাইলটি। কাবার্ডে ফাইলটি যত্ন সহকারে রেখে দিলো হৃদি। ফিরে এলো স্বামীর কাছে। চোখ হতে চশমা খুলে নিলো। কোমল স্বরে বললো,
” আপনি শুয়ে পড়ুন। আসছি। ”
একবিন্দু কাছছাড়া করতে নারাজ মন। তবে কিইবা করার? ডিভান হতে উঠে দাঁড়ালো ইরহাম। পরিহিত টি-শার্ট খুলে যথাস্থানে রাখলো। শ্রান্ত দেহে শয্যা গ্রহণ করলো বিছানার নরম আবরণে। উজ্জ্বল আলো নিভে ডিম লাইটের আলো ছড়িয়ে পড়লো ঘরে। স্বামীর দেহে কাঁথা জড়িয়ে তার পানে কাত হয়ে শুয়ে পড়লো হৃদি। দু’জনের দেহে জড়ানো একই কাঁথা। মেয়েটি বাড়িয়ে দিলো ডান হাত। কোমল হাতে আলতো করে ম্যাসাজ করে দিচ্ছে কপালে। নরম কোমল হাত ছুঁয়ে যেতে লাগলো কপালের ত্বক। যন্ত্রণা উপশমকারী হিসেবে বেশ কার্যকরী ভূমিকা রাখছে। কখনোবা চিকন আঙ্গুল গুলো গলিয়ে দিচ্ছে চুলের ভাঁজে। চুল ভেদ করে মস্তকের আবরণে আঙ্গুল চালনায় মিলছে অপরিসীম আরাম। আরো স্বস্তি লাভের আকাঙ্ক্ষায় সন্নিকটে এলো মানুষটি। আস্তে করে মাথা রাখলো সঙ্গিনীর বক্ষদেশে। আকস্মিক আচরণে শিউরে উঠলো কোমল সত্তা। পুরোপুরি স্ত্রীর অবয়বে লেপ্টে গেল মানুষটি। দু হাতের বাঁধনে অর্ধাঙ্গীর উদর পাশ। প্রতিবারের ন্যায় এবারও স্বামী সাহচর্যে শীতলতা গ্রাস করে নিলো। বুক ফুলিয়ে শ্বাস ছাড়লো হৃদি। আস্তে ধীরে বাঁ হাতটি স্থাপন করলো প্রশস্ত পৃষ্ঠে। ডান হাত গলিয়ে দিলো মসৃণ চুলে। আলতো করে মাথার তেলোয় আঙ্গুল চালনা করে চলেছে। কখনোবা টেনে দিচ্ছে চুল। একান্ত রমণীর উষ্ণতা, তার সান্নিধ্যে সমস্ত ক্লান্তি, যাতনা দূরীভূত হচ্ছে। প্রতিটি মানুষের জীবনে এমন এক শান্তির স্থল আবশ্যক। যার সাহচর্যে মিলবে স্বস্তি। যে হবে সকল প্রকার দুশ্চিন্তা-ক্লেশের উপশম। ইরহামের জীবনে নিঃসন্দেহে সে স্থানটি দখল করে নিয়েছে তার জীবনসঙ্গিনী। মিসেস হৃদি। তার হৃদয়ের রাণী। তৃপ্তিময় হাসলো ইরহাম। বেশ আরাম মিলছে। তবুও স্ত্রী সান্নিধ্য ত্যাগ করতে অনিচ্ছুক মন। ওভাবেই স্ত্রীর বক্ষে মাথা রেখে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেল সে। কিয়ৎক্ষণ বাদে স্বামীর চুলে আঙুল বুলাতে বুলাতে ঘুমিয়ে পড়লো তার হৃদরাণী নিজেও।
.
দেশের একপ্রান্তে তখন ঘুমে তলিয়ে সাধারণ জনগণ। আরেক প্রান্তে বঙ্গোপসাগরের সুগভীর বুকে চলছে ষ-ড়যন্ত্র। আঁধার মাঝে বেশ কিছুটা দূরত্ব রেখে অবস্থিত দু’টো কার্গো জাহাজ। প্রথম জাহাজে সাবধানী ভঙ্গিতে রাখা ক্ষুদ্র আকৃতির জিপিএস ট্র্যাকার সংযুক্ত বেশকিছু প্যাকেজ। এ যেনতেন প্যাকেজ নয়। এসবের মধ্যিখানে লুকায়িত দুই কোটি টাকা মূল্যের ড্রা•গস্! বিশেষ কায়দায় জলের বুকে প্যাকেজগুলো ডুবিয়ে দেয়া হয়। প্যাকেজে সংযুক্ত জিপিএস ট্র্যাকার অনুসরণ করে দ্বিতীয় জাহাজে অবস্থানরত লোকগুলো মাছ তোলার ভঙ্গিমায় প্যাকেজগুলো তাদের জলযানে তুলে নেয়। ভিন্নধর্মী এ কায়দায় বিগত দুই বছর ধরে রাতের আঁধারে গভীর জলধারায় হচ্ছে ড্রা-গ পা চা র। আজ অবধি ধরা পড়েনি কেউ। তবে কোস্ট গার্ড সদস্যরা বরাবর সন্দেহ করে এসেছে। কোনো প্রমাণ পায়নি বটে। অবশেষে বছর দুইয়ের চতুরতা আজ সমাপ্ত হলো। অপ্রত্যাশিত ভাবে কোস্ট গার্ড সদস্যদের আ-ক্রমণ। আটক হলো পা-চারকারী চক্রের এই সদস্যরা। প্রাণ হারালো দুই পক্ষের বেশকিছু সদস্য। জলধারায় মিশে গেল তাজা র ক্ত। পঁয়তাল্লিশ মিনিট ব্যাপী চললো র-ক্তক্ষয়ী সং•ঘর্ষ। কোথা থেকে কি করে আ-ক্রমণ হলো বুঝে ওঠার আগেই সব শেষ। দুই কোটি টাকার ড্রা•গ বা”জেয়াপ্ত করলো কোস্ট গার্ড বাংলাদেশ।
•
” অ্যাই! এসব কি বলছিস তোরা? ওখানে। ওখানে দুই কোটি টাকার মাল ছিল। এ কি সর্বনা’শ করলি! তোদের জ্যা ন্ত কবর দেবে ‘ও’। উফ্! ফোন রাখ বলছি।”
চিন্তায়-দুশ্চিন্তায় সংক্রমিত হয়ে গর্জে উঠলো ষাটোর্ধ্ব মানুষটি। ‘ও’ যে ছাড়বে না কাউকে। কি হবে এবার!
চলবে.