মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি ২ পর্ব-৩৮

0
702

#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৩৮

নিস্তব্ধ পরিবেশে বাতাসের শোঁ শোঁ উথালপাথাল ধ্বনি। জনশূন্য নীরব সড়কে ছুটে চলেছে পোর্শে কেয়েন’টি। গাড়ির হেডলাইটের আলো আছড়ে পড়ছে পিচঢালা সড়কে। দক্ষ হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং চালনা করছে সৌম্য পুরুষটি। অতিক্রান্ত হলো অনেকটা পথ। মূল শহরে প্রবেশ করার রাস্তা বেশ সন্নিকটে। সড়কের দু পাশে দণ্ডায়মান বিশালাকার বৃক্ষরাজি। মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে গাড়ি। সহসা গাড়ির গতি হ্রাস পেল। চোখের ওপর হামলে পড়ছে আলো। দক্ষতার সহিত গাড়ির গতি হ্রাস করলো ইরহাম। কয়েক কদম এগিয়ে থেমে গেল কুচকুচে কালো গাড়িটি। পেশিবহুল দু হাত তখনো চেপে বসে স্টিয়ারিংয়ে। নভোনীল চক্ষু জোড়ায় খেলে বেড়াচ্ছে এক অদ্ভুতুড়ে বিচ্ছুরণ। মুখখানা এখনো আবৃত কালো মাস্কে। দেখছে সম্মুখের চিত্র। পোর্শে কেয়েন হতে ত্রিশ কদম দূরে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে দু’টো গাড়ি। রাস্তা অতিক্রম করার পথ বন্ধ। হেডলাইটের আলোয় কিয়ৎক্ষণ পূর্বে বাঁধাপ্রাপ্ত হয়েছে সে। গাড়ি দু’টোর সম্মুখে দাঁড়িয়ে কিছু ব্যক্তি। তাকে খুঁজে পেল তবে! বক্র রেখা অধরকোণে ফুটে উঠলো। শক্ত হাতের স্পর্শে উন্মুক্ত হলো গাড়ির ডান পাশের দ্বার। মাথা ঝুঁকিয়ে পোর্শে কেয়েন হতে বেরিয়ে এলো কালো পোশাকধারী চৌধুরী। পা দিয়ে ঠেলে বন্ধ করলো উন্মুক্ত দ্বার। অজ্ঞাত আগন্তুকদের ন্যায় ইরহাম চৌধুরী-ও আজ কালো বেশে নিজেকে সাজিয়েছে। মুখোমুখি দুই পক্ষ।

নৈঃশব্দ্যে অতিবাহিত হলো কয়েক মিনিট। আস্তে ধীরে শ’ত্রুদের পিঠের দিকে পোশাকের অন্তরাল হতে বেরিয়ে এলো ধারালো অ স্ত্র। কয়েকজনের কোমরের ধার হতে বের হলো আগ্নেয়া-স্ত্র। ধেয়ে আসছে একজন। একটু একটু করে দ্রুততর হচ্ছে পায়ের গতিবেগ। স্থির দাঁড়িয়ে ইরহাম। দেখছে। নভোনীল চোখ দু’টো মেপে নিচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বীকে। চোখেমুখে প্রচ্ছন্ন রূঢ়তা। ক্ষণিকের মধ্যেই নৈকট্যে পৌঁছালো সে অজ্ঞাত ব্যক্তি। হাতে থাকা ধারালো ছু-রির আঘাতে চুরমার করতে উদ্যত হলো। কিন্তু তার পূর্বেই কান ও গাল পেঁচিয়ে পড়লো এক জোরালো সিংহল থাবা। ভনভন করে উঠলো মস্তিষ্ক। ডানে বেঁকে গেল মুখ। দুর্বল হলো ছু রি আঁকড়ে ধরা হাত। তন্মধ্যেই পেটে এক শক্তপোক্ত লা-থ। ছিটকে কয়েক কদম দূরে পড়লো সে দু-র্বৃত্ত। নির্বিশঙ্ক চিত্তে শত্রুর পানে ঘুরে দাঁড়ালো চৌধুরী। দু পা অটল জমিনের বুকে। ডান হাত উঁচু করে রাখা। কয়েক আঙ্গুলের নড়চড়। আ”ক্রমণ করার শব্দহীন আহ্বান জানালো সে। অতর্কিত হইহই করে ছুটে এলো তিনজন শত্রু। দুর্দান্ত রূপে আয়ত্ত্ব করা ‘ ক্রভ মাগা ‘ কৌশল অবলম্বন করে শত্রুদের কুপোকাত করে চলেছে অকুতোভয় মানুষটি। হাত ও পায়ের নিখুঁত সম্মিলনে শত্রুর ভিত চুরমার করে দিচ্ছিল সে। হঠাৎই চললো শত্রুর পি;স্তল। বাতাসের বেগে মাথাটা বামে ছিটকে নিয়ে গেল ইরহাম। বু;লেট ডান কানের পাশ কাটিয়ে আঁধারে হারালো। মুখভঙ্গি অত্যন্ত কঠিন হলো। নিকটস্থ শত্রুর পাঁজরে লা থ বসিয়ে তাকে পরাস্ত করলো ইরহাম। চোখের পলকে সুনিপুণ ভঙ্গিতে কোমরের হোলস্টার হতে বের করলো লাইসেন্সপ্রাপ্ত পি;স্তল। তা দিয়ে আগ্নেয়া-স্ত্র বহনকারী শ’ত্রুদের পাল্টা জবাব দিতে লাগলো।

র ক্ত ঝড়ছে অবিরাম। হাঁটু, উরু কিংবা হাতের বাহু গলিয়ে পড়ছে লাল তরল। প্রাণনাশ করে নয় বরং ভঙ্গুর করে পরাস্ত করছে শত্রুকে। আগন্তুক দু-র্বৃত্তরা আজ বাকরুদ্ধ। চৌধুরীর এই প্রশিক্ষিত নয়া নি-ষ্ঠুর রূপ জানা ছিল না তাদের। একাকী পনেরো জনের বাহিনীকে অক্রূর পন্থায় ঘায়েল করে ফেললো সে। বিনিময়ে চোয়ালে ও হাতেপায়ে পেল স্বল্প আঘাত। এই কি সে-ই সাধারণ সাংসদ ইরহাম চৌধুরী? কি করে এত পরিবর্তন! ঠিকমতো জানার পূর্বেই পরাভূত হলো দু-র্বৃত্তরা। একেকজন লুটিয়ে পড়েছে মেঝেতে। যন্ত্রণায় কঁকিয়ে কঁকিয়ে উঠছে। র ক্তে র-ঞ্জিত পিচঢালা পথের বুক। পি;স্তলের মুখে হালকা ফুঁ দিয়ে ইরহাম সেটি ভরে নিলো কোমরের হোলস্টারে। চোখ তুলে তাকালো গগন পানে। চরম বিপদের মূহুর্তে রক্ষা করার জন্য শুকরিয়া আদায় করলো মহান রবের। চোখেমুখে বিজয়ের পরিতৃপ্তি।
_

সাইরেনের উচ্চ ধ্বনি আলোড়ন সৃষ্টি করলো নিঝুম পরিবেশে। প্রবল ভাবে কড়া নাড়ছে শ্রবণেন্দ্রিয়ে। ঘটনাস্থলে পৌঁছালো স্থানীয় পুলিশ। থামলো তাদের বহনকারী গাড়ি। উন্মুক্ত হলো গাড়ির দ্বার। একে একে বেরিয়ে এলো পুলিশ সদস্যরা। পুলিশ ইনচার্জের দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো সড়কে। পড়ে রয়েছে শত্রুর দল। যাতনায় ছটফট করে চলেছে। র ক্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে পথে। উনি দৃষ্টি সরিয়ে এদিক ওদিক তাকালেন। এমপি সাহেব কোথায়! অপেক্ষা করতে হলো না। ওই তো সে। গাড়ির বনেটে রাজোচিত ভঙ্গিতে বসে চৌধুরী। হাতে মোবাইল। দৃষ্টি নিবদ্ধ মোবাইলের স্ক্রিনে। কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত বুঝি! পুলিশ ইনচার্জ ইরহামের পানে এগিয়ে গেল। গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সমাপ্ত হতেই অফিসারের পানে তাকালো ইরহাম। পকেটে মোবাইল পুরে হালকা লাফ দিয়ে নামলো। জমিনে ঠেকলো পদযুগল। কালো মাস্কটি এখন থুতনিতে নামিয়ে রাখা। অনাবৃত মুখশ্রী। সৌজন্যতামূলক করমর্দন করলো দু’জনে। সালাম বিনিময় হলো।

” আপনি ঠিক আছেন তো স্যার? ওরা আপনার কোনো ক্ষতি করতে…”

অসম্পূর্ণ প্রশ্নের উত্তর দিলো ইরহাম। শান্ত স্বরে বললো,

” আলহামদুলিল্লাহ্ আ’ম ফাইন। আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। আপনি এদের ওপর মনোযোগ দিন। তুলে নিন সব কয়টাকে। ”

” জ্বি স্যার। নিশ্চয়ই। কিন্তু… স্যার এসব কি করে হলো? ”

ঘুরে দাঁড়ালো মানুষটি। যন্ত্রণায় কাতর এক শত্রুর পানে তাকিয়ে নিগূঢ় স্বরে বললো,

” আমাকে ফলো করছিল এরা। একটা পার্সোনাল কাজে এদিকে এসেছিলাম। শুরু থেকেই ফলো করছিল। মাঝপথে এদের আর দেখিনি। ভেবেছিলাম আমার বোঝায় ভুল হয়েছে বোধহয়। কিন্তু ভুল ভেঙ্গে গেল। ফেরার পথে এবার ডিরেক্ট অ্যা;টাক করে বসলো এরা। তখন আত্মরক্ষা করতে একটুআধটু র ক্ত ঝড়াতে হলো। ”

একজন আলোচিত সাংসদ সে। তরুণ প্রজন্ম ছাড়াও বড়-ছোট অনেকের আদর্শ। এ মানুষটি মিথ্যা বলতেই পারে না। তাই তো নির্দ্বিধায় ইরহামের মুখনিঃসৃত প্রতিটি শব্দ বিশ্বাস করে নিলো সে অফিসার। ঘুণাক্ষরেও টের পেল না আধা সত্য, আধা মিথ্যার মিশ্রণ ছিল এ বক্তব্য। অফিসার কিছু বলার পূর্বেই ইরহাম জানিয়ে দিলো,

” ডোন্ট ওয়ারি। প্রাণে মে রে দিইনি। একটু খাতিরযত্ন করলেই ঠিক হয়ে যাবে। ”

গদগদ কন্ঠে বলে উঠলো অফিসার,

” না না স্যার। আপনি কি করে কাউকে মা•রতে পারেন? আপনি তো অকুতোভয় একজন বীরপুরুষ। যার কোনো তুলনা হয় না। স্যার, আপনাকে অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার সুবাদে সমাজের কতগুলো কীট সহজেই ধরা পড়লো। আপনি না থাকলে কি যে হতো…! স্যার এবার এদের ব্যবস্থা আমরা করছি। আপনি একদম নিশ্চিন্তে থাকুন। ”

স্মরণ করিয়ে দিলো ইরহাম,

” ঠিকমতো যত্ন নিতে ভুলবেন না যেন। ”

স্বল্প হেসে মাথা নাড়ল পুলিশ অফিসার,

” জ্বি স্যার। একদম জামাই আদর করে রাখবো। ”

ইরহাম বিপরীতে কিচ্ছুটি বললো না। নিজ গাড়ির দিকে এক কদম অগ্রসর হতেই পুলিশ অফিসারটি বলে উঠলো,

” স্যার চলুন আপনাকে পৌঁছে দিচ্ছি। ”

” অফিসার আপনি এদেরকে দেখুন। আমায় নিয়ে শুধু শুধু মাথা ঘামানোর দরকার নেই। আ’ম ফাইন। ”

আমতা আমতা করে বললো অফিসার,

” ঠিক আছে স্যার। আপনি যেটা ভালো মনে করেন। তবে স্যার…! আপনাকে একবার থানায় যাওয়া লাগতে পারে। বুঝতেই পারছেন আইনী মামলা… ”

বিষয়টি অনুধাবন করে ইরহাম জানালো,

” ইটস্ ওকে। আমাকে জানিয়ে দেবেন। পৌঁছে যাবো। ”

পুলিশ অফিসার কৃতজ্ঞতাপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। অতঃপর বিদায় নিয়ে চলে গেল। পোর্শে কেয়েনের দ্বার উন্মুক্ত করে অন্দরে প্রবেশ করলো ইরহাম। বসলো সিটে। শরীরে বেঁধে নিলো সিটবেল্ট। চালু হলো ইঞ্জিন। স্বল্প সময়ের মধ্যেই ঘটনাস্থল হতে প্রস্থান করলো চৌধুরী। নিস্তব্ধ সে পরিবেশে অপরাধীদের নিয়ে ব্যস্ত পুলিশ সদস্যরা।

তমসাচ্ছন্ন রজনী। বিছানায় বসে শান্ত ইরহাম। উদোম দেহের উপরিভাগ। নিম্নে এখনো পরিহিত কালো জিন্স প্যান্ট। অতি সন্নিকটে তার সহধর্মিণী হৃদি। সে ব্যস্ত নিজ কর্মে। একমনে স্বামীর হাতের উল্টো পিঠে অয়েন্টমেন্ট মাখা আঙ্গুল বুলিয়ে যাচ্ছে। মুখভঙ্গি একদম স্বাভাবিক। ইরহাম দেখছে। ভাবছে। সময়ের পরিক্রমায় কত কি বদলে যায়। তার বিবাহ পরবর্তী জীবনের আরম্ভে কি ছিল হৃদি আর আজ কিসে পরিণত হয়েছে! সে-ই চঞ্চল, সরল, অস্থির মেয়েটি আজ বড্ড পরিণত, বুঝদার, শান্ত। তার দুই সন্তানের মা হয়েছে। ধৈর্য্যের সহিত সামলে যাচ্ছে এই গোটা সংসার। আগের মতো ভীত, অস্থির নেই। এখন বোঝে সব। পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। যেমন এ মুহূর্তে করছে। ভয় পেয়ে, কেঁদেকেটে কি লাভ! তার স্বামী কিংবা স্বামীর কার্যকলাপ কিছু্ই তো বদলাবে না। এমনই থাকবে চিরকাল। তাই অশ্রু বিসর্জন দিয়ে বোকামি করার চেয়ে শান্তরূপে পরিস্থিতি সামাল দেয়াটাই শ্রেয়। বুদ্ধিমানের কাজ। সেটাই করছে মেয়েটা। স্বামীর হাত ও মুখের কালশিটে অংশে অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে দিলো হৃদি। সরে গেল নীরবে। বিছানায় আরাম করে ঘুমিয়ে চার মাস বয়সী দুই সন্তান। তাদের ঘুমে ব্যাঘাত না ঘটে সে চেষ্টায় মত্ত মেয়েটি।

যথাস্থানে ফাস্ট এইড বক্স রেখে ঘুরে দাঁড়ালো হৃদি। লহমায় বন্দিনী হলো একান্ত পুরুষের বাহুবন্ধনে। উদোম বক্ষপটে মিশে সে। কান ঠেকে হৃৎপিণ্ড বরাবর। স্পষ্টরূপে শুনছে সে-ই অস্থির হৃদস্পন্দনের ধ্বনি। মানুষটিও তার মতো অশান্ত হয়ে। শান্ত হতে পারছে না। ভয় হয় হৃদির। সে র•ক্তমাংসের মানুষ। কোনো রোবট নয়। আপনজনকে হারানোর সামান্যতম ভয় তাকে মৃ-ত্যুর স্বাদ পাইয়ে দেয়। যন্ত্রণায় খণ্ডিত বিখণ্ডিত হয় অন্তর। খুব কাছের একজনকে তো হারিয়েছে। সাক্ষী হয়েছে বি’ভৎস এক রাতের। দ্বিতীয় কাউকে হারানোর মতো শক্তি অবশিষ্ট নেই দেহে। ম রে যাবে সে। স্রেফ ম রে যাবে। কখন যেন দু’চোখ ভিজে গেল। অশ্রু জমলো অক্ষিকোলে। আবেগের আতিশয্যে দু হাতে স্বামীকে আলিঙ্গন করলো হৃদি। আঁকড়ে ধরলো ভরসাযোগ্য ব্যক্তিগত পুরুষটিকে। সে মানুষটিও আগলে নিলো ভালো করে। গাঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ হলো দু’জনে। লেপ্টে একে অপরের সনে। স্ত্রীর চুলের ভাঁজে প্রেমার্দ্র এক চুম্বন এঁকে দিলো ইরহাম। একে অপরের সান্নিধ্যে খুঁজে নিলো মানসিক প্রশান্তি। এ আলিঙ্গনে ছিল না কামনা, উ-ন্মাদনা। শুধুমাত্র ছিল একরাশ ভরসা, মানসিক শান্তির লো’ভে আরো গাঢ় করে একে অপরকে আঁকড়ে ধরা। যেন ছেড়ে দিলেই যাবে হারিয়ে। কখনো যাবে না পাওয়া।

অনেকটা সময় পেরিয়েছে। বিছানায় শায়িত মা ও দু সন্তান। ঘুমে মগ্ন তারা। ঘুম নেই শুধু ওই অটলসংকল্প মানুষটির দু চোখে। ডিভানে বসে সে। কোলের ওপর রাখা ল্যাপটপ। তাতে সংযুক্ত পেনড্রাইভ। আজকের সে-ই দ্বিধান্বিত রাত্রি সফরে কারাকুরি রিপল আউট পাজল বক্সের গুপ্ত ড্রয়ার হতে মিলেছে এই জা-দুকরী পেনড্রাইভ। পেনড্রাইভে লুক্কায়িত সমস্ত তথ্য আহরণ করতে ব্যস্ত চৌধুরী। ল্যাপটপের কিবোর্ডে দ্রুততম গতিতে চলছে আঙ্গুল। দেখছে সে। জানছে অজানা। আঁধারিয়া কক্ষে ল্যাপটপের আলোয় দেখা গেল জাজ্বল্যমান চোখ দু’টো। অধরকোণে ফুটে রহস্যময় এক দ্যুতি।

পৃথিবীর বুকে এক সন্তানের সবচেয়ে নিকটবর্তী আপনজন হয় তার মা ও বাবা। কেউ মায়ের আহ্লাদে হয় কেউবা বাবার। মা-বাবাই এক শিশুর সর্বোত্তম ভরসার স্থল। আশ্রয়স্থল। শৈশব হতেই স্বল্পভাষী ইরহাম। নিজস্ব অনুভূতি আবডালে রাখতে বেশ পটু। বাবা নামক মানুষটি সর্বদা নিজ কর্মে ব্যস্ত। জন্মের পর থেকে বাবাকে খুব কমই প্রয়োজনের সময় পেয়েছে শিশু ইরহাম। বাবা বড্ড কাজপাগল মানুষ। যশখ্যাতি, আরো বিত্তবান হবার তাড়নায় ঘর সংসারে কখনোই তার মন ছিল না। এজাজ চৌধুরীর পূর্বপুরুষরা ছিলেন জমিদার। ওনার বড় বাবা জমিদার শাহজাহান চৌধুরী ছিলেন ওনাদের বংশের সবচেয়ে উত্তম শাসক, ঐশ্বর্যবান পুরুষ। অত্যধিক কড়া ছিলেন মানুষটি। ন্যায় ও অন্যায়ের পক্ষে সদা অটল। ওনার চলনবলনে সর্বদা আভিজাত্য বজায় থাকতো। প্রতিটি শব্দমালায় এক প্রচ্ছন্ন তেজদীপ্ত আভা। মান্য করতে সকলে বাধ্য। দাদা বাড়ির সদস্যরা কেউ কেউ ধারণা করতো ইরহাম ওনার মতোই স্বভাব পেয়েছে। একরোখা, গম্ভীর, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এক রণমূর্তি। সময়ের পরিক্রমায় চৌধুরীদের জমিদারি প্রথা আজ বিলুপ্ত প্রায়। তবে সে-ই অহংবোধ, আভিজাত্য, দাপট আজও অটুট। এজাজ সাহেব ছিলেন এত বিত্তবান পরিবারের সন্তান। তবে ওনার জীবনসঙ্গিনী ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। ওনারা যেন নদীর এপাড় ও ওপাড়। এতখানি দূরত্ব ও বৈপরীত্য ছিল। এজাজ চৌধুরীর মা রাজেদা খানম নিজে মালিহা নামক অপরূপা তরুণীকে পুত্রবধূ হিসেবে পছন্দ করেছিলেন। নিজেদের এলাকা, আভিজাত্য ছেড়ে সিলেটের এক মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে মালিহাকে পুত্রবধূ হিসেবে বেছে নিলেন। কাজপাগল এজাজ সাহেব তখন হালকাপাতলা এ সম্বন্ধে আপত্তি পোষণ করেছিলেন। তবে তা ধোপে টেকেনি। বাবারও শান্তশিষ্ট মেয়েটিকে পুত্রবধূ হিসেবে পছন্দ হলো। অগত্যা সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনা মাফিক পবিত্র এক বন্ধনে আবদ্ধ হলেন এজাজ, মালিহা। বিবাহ পরবর্তী জীবনের শুরুর দিনগুলো ছিল বড় রষকষহীন। এজাজ সাহেব কেমন নির্লিপ্ত আচরণ করতেন। ওনার সমস্ত খেয়াল শুধু ব্যবসায়িক কাজে। ঘরে যে নববধূ ওনার অপেক্ষায় দিন গোনে জানাও ছিল না। সেভাবে কখনো মুখ তুলে ওই সুশ্রী মুখখানি দেখেনওনি। এভাবেই কাটছিল দিনকাল। স্বামীর একটুখানি ভালোবাসা, যত্ন পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় দিন গুনছিলেন মালিহা। রবের নিকটে রাতের পর রাত দোয়া করতেন। একসময় প্রকৃতির সে-ই আদিম নিয়মানুযায়ী এক হলেন এজাজ, মালিহা। প্রকৃতপক্ষে শুরু হলো দাম্পত্যের সূচনা।

তবে কর্মব্যস্ততা বরাবরই ছিল। তখনো স্ত্রীকে ভালোবেসে উঠতে পারেননি এজাজ। যা ছিল শুধুমাত্র জৈবিক চাহিদা। বিবাহিত জীবনের কয়েক বছর শেষে জন্ম নিলো প্রথম সন্তান ইরহাম। প্রথম সন্তান হিসেবে পুত্র লাভে বেশ খুশি হয়েছিলেন এজাজ। তবে মুখ ফুটে কখনো প্রকাশ করেননি। স্বল্পভাষী কিনা! ইরহামের জন্মের পর ওনার ব্যবসায় বেশ উন্নতি দেখা দিলো। আরো বড় হলো গার্মেন্টসের কার্যপরিধি। ফলস্বরূপ কাজে পুরোপুরি ডুবে গেলেন উনি। ইরহামের শৈশব কাটলো বাবার আদর-যত্ন বিহীন। কেমন অবহেলা ছিল লুকিয়ে। সেই শৈশবেই দূরত্বের সূত্রপাত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাবা নামক মানুষটির সঙ্গে দূরত্ব আরো বাড়তে লাগলো। দু’জনের মতের অমিল, দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য, মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত শ্রেণীর প্রতি ধ্যান ধারণা… সবেতে অমিল। আরো কিছু বিষয় ছিল। দিনকে দিন বাপ বেটার মধ্যে প্রশস্ত এক ফাঁক সৃষ্টি হতে লাগলো।

ইরহাম তখন সদ্য এইচএসসি পাস করেছে। ওর ইচ্ছে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করার। মনেপ্রাণে ছড়িয়ে দেশপ্রেম। শৈশব থেকেই অন্যের উপকার করা স্বভাব। আজ তা রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে। কিন্তু বাবা নামক মানুষটির প্রবল ইচ্ছে ছেলে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়ুক। ভবিষ্যতে সে-ই তো ওনার এই সুবিশাল ব্যবসার হাল ধরবে। বাবার প্রস্তাবে আপত্তি জানালো ইরহাম। বাবার ব্যবসা হোক কিংবা অন্যের ব্যবসা। কোনো আগ্রহ নেই তার। সে দেশের জন্য কিছু করতে চায়। রাজনীতির প্রতি এক সুপ্ত ঝোঁক লুকিয়ে মনে। ব্যাস। বাবা ও ছেলের মধ্যে বড়সড় তর্কবিতর্ক সৃষ্টি হলো। বাপ বলছে এক। ছেলে বলছে আরেক। এরমধ্যে ফেঁ-সে গেলেন নিরীহ মালিহা। এক রাতে স্বামীকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। ছেলের পক্ষে দু’টো কথা বললেন। ফলস্বরূপ গালে পড়লো শক্তপোক্ত পাঁচ আঙ্গুলের ছাপ। অনিচ্ছাকৃতভাবে প্রথমবারের মতো স্ত্রীর গালে আঘাত করে ফেলেছিলেন এজাজ সাহেব। যা লুকানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন মালিহা। পরেরদিন সকালবেলা ঠিক ছেলের তীক্ষ্ণ চাহনিতে ধরা পড়লো গালে লেপ্টে থাকা লালচে দাগ। সদ্য কৈশোর পাড় করা ছেলেটার র ক্ত গরম। তীব্র প্রতিবাদ জানালো সে। বাবার মুখের ওপর তর্ক করলো। মালিহা বহু চেষ্টা করেও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারলেন না। জেদ দেখিয়ে ঢাবিতে ভর্তি হলো ইরহাম। রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে যত ঝামেলা তো? সে এই সাবজেক্ট নিয়েই পড়বে। এজাজ সাহেবও নিজ ভুল স্বীকার না করে দম্ভ দেখালেন। জানিয়ে দিলেন ওই ছেলে যেন নিজের খরচা নিজে চালায়। উনি ওর পেছনে এক পয়সাও অপচয় করবেন না।

শৈশব থেকেই বাবা নামক মানুষটি ওর ওপর নিজের সকল সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়ে এসেছে। পোশাক হোক বা শখ কিংবা বিদ্যালয় পরিবর্তন… সর্বক্ষেত্রে ওনার দাপট। ওর নিজস্ব ইচ্ছে সব যেন মৃ-তপ্রায়। এভাবেই বড় হচ্ছিল ছেলেটা। মনে মনে বৃদ্ধি পাচ্ছিল জেদ। দূরত্ব আরো প্রশস্ত হচ্ছিল। অষ্টম শ্রেণীর পর সায়েন্স নিয়ে পড়তে চেয়েছিল ইরহাম। কিন্তু বাবা বাধ্য করলেন কমার্স নিতে। ছেলে ওনার এখন থেকেই বিজনেস বিষয়ক জ্ঞান অর্জন করুক। ভবিষ্যতে বাবার ব্যবসা সামলাতে হবে যে। এটাই ছিল ওনার গুরুগম্ভীর আদেশ। আরো একবার বাবার আদেশ মান্য করতে বাধ্য হলো ইরহাম। নবম শ্রেণী থেকেই টিউশন পড়াতো ছেলেটা। ছোট ক্লাসের নয়। বরং সহপাঠীদের পড়াতো সে। মেধাবী শিক্ষার্থী হবার সুবাদে ক্লাসে তার অন্যরকম পরিচিত ছিল। কখনো পারিবারিক ঐশ্বর্য কিংবা বিত্তবান হবার অপব্যবহার করেনি সে। নিজের খরচ নিজে চালাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতো। তাই বাবার এই মৃদু হুমকিতে কিছুই হলো না। মায়ের মুখ চেয়ে ওই বাড়িতে রয়ে গেল। নিজের খরচ চালাতো নিজেই। একসময় জড়িয়ে পড়লো ঢাবির ছাত্ররাজনীতিতে। এখানেও বাবার নিষেধাজ্ঞা। তুচ্ছতাচ্ছিল্য। পাত্তা দিলো না ইরহাম। বাবার কথায় ওঠবোস করার বয়স পালিয়েছে বহু আগেই। অতঃপর সময়ের পরিক্রমায় পাকাপোক্ত ভাবে রাজনৈতিক অঙ্গনে পদার্পণ হলো ইরহাম চৌধুরীর। এজাজ সাহেব সবই দেখলেন। সহ্য করে গেলেন‌। পিতা ও পুত্রের সেই দূরত্ব আর মিটলো না। পুত্রবধূর আগমনের পর কিছুটা স্বাভাবিক হয়েও যেন স্বাভাবিক নয়। এক সুক্ষ্ম দূরত্ব রয়েই গেল। যা অবশেষে মিটলো মিসেস মালিহা চৌধুরীর ইন্তেকালে।

বিরস বদনে আরামকেদারায় বসে এজাজ সাহেব। স্মৃতির মানসপটে ভেসে উঠছিল পুরনো কত কথা। কত ভুল। সব যেন আজ চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। বুঝিয়ে দিচ্ছে এক জীবনে কতখানি ভুল করেছেন উনি। মিথ্যে অহং, কর্ম ব্যস্ততা দেখিয়ে কত কি খুইয়েছেন। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন উনি। জীবনে করার মতো করলেন টা কি? ভুল সবই ভুল। চারিদিকে ভুলের হাতছানি। সহসা হুঁশ ফিরল ভারিক্কি সে কণ্ঠস্বরে। চোখ তুলে তাকালেন উনি। হাত বাড়িয়ে ইরহাম। হাতের তালুতে তাকালেন উনি। ওষুধ। ওনার রাতের ওষুধ। বিগত কয়েকমাস ধরে রাতের এই দায়িত্ব পুত্র ইরহাম ই পালন করছে। একদা করতো স্ত্রী এরপর পুত্রবধূ। আর এখন পুত্র নিজেই করছে। ইদানিং বাবা ছেলের সম্পর্কে লক্ষণীয় পরিবর্তন এসেছে। টুকটাক কথাবার্তা হয়। দেশীয় আন্তর্জাতিক খবরাখবর সাথে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা গরম চা। চায়ে চুমুক দেয়ার ফাঁকে কখনো কোনো প্রভাতে কিংবা গোধূলি লগ্নে কথা হয়। মৃদুমন্দ একে অপরের খোঁজখবর নেয়া হয়। এই তো চলছে জীবন।

‘ মালিহা একদা এমন স্বপ্ন ছিল তোমার। আজ সে স্বপ্ন সত্যি হচ্ছে। বাবা ছেলে ঝামেলা বিহীন কথা বলছে। একে অপরের খোঁজখবর নিচ্ছে। তুমি কিচ্ছু দেখে যেতে পারলে না। তোমার অনন্তকালের বিচ্ছেদ সব ঠিক করে দিলো। কিন্তু আমি তো এমনভাবে ঠিকঠাক চাইনি। শুধু তোমায় পাশে চেয়েছিলাম। আমার পরিবর্তন কি তুমি একটু হলেও বুঝতে পেরেছিলে? পেরেছিলে ক্ষমা করতে? বলো না মালিহা। একটু বলো। আমায় কি ক্ষমা করা যায় না? এ জীবনে তোমার ক্ষমা আর পাওয়া হলো না। চিরতরে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল। কেন থাকবে এই লোকটার সাথে? বড় নি-ষ্ঠুর, স্বার্থপর এই আমিটা। খারাপ। এর সাথে থাকা যায় না। নাহ্। ‘

মনের কথা মনেতে রয়ে গেল। ভারী আস্তরণে লুকায়িত মনোবেদনা। ওষুধ খেয়ে পানি পান করলেন উনি। ইরহাম গ্লাস রাখতে রাখতে শান্ত স্বরে বললো,

” অনেক রাত হয়েছে। এবার শুয়ে পড়ো। ”

” হুম। তুমিও ঘুমিয়ে পড়ো। দাদুভাইরা ঘুমিয়েছে? ”

আরামকেদারা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন উনি। ইরহাম বালিশ ঠিক করে দিয়ে জবাব দিলো,

” হৃদি ঘুম পাড়াচ্ছে। ”

” ওহ্। ”

বিছানায় শুয়ে পড়লেন এজাজ সাহেব। বৃদ্ধ পিতার দেহে কাঁথা জড়িয়ে দিলো ইরহাম। এসির ভলিউম সেট করে বাবার পানে একপলক তাকালো। এজাজ সাহেব বেদনাময় হেসে চোখ বন্ধ করে ফেললেন। ঘরের আলো নিভিয়ে দিলো ইরহাম। জ্বলছে মৃদু আলোর ডিম লাইট। নীরবে ঘর হতে প্রস্থান করলো ইরহাম। আস্তে ধীরে উন্মুক্ত হলো এজাজ সাহেবের চোখ। এত সহজে কি ঘুম ধরা দেবে? মরহুমা স্ত্রীর দুঃখ বিলাস করতে করতে প্রায় মাঝরাতে নিদ্রায় তলিয়ে যাবেন উনি। এই তো চলছে অনুশোচনায় দ’গ্ধ জীবন।

চলবে।

[ আসসালামু আলাইকুম। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের এখন অবধি সবচেয়ে বড় পর্বটি আজ দিলাম। শব্দসংখ্যা ২,৬০০+ পাঠকদের সর্বোচ্চ রেসপন্স আশা করছি। নিজস্ব অনুভূতি কমেন্ট করে জানাবেন। ধন্যবাদ সবাইকে পাশে থাকার জন্য। ওহ্ হ্যাঁ। চমক থাকছে পরবর্তী পর্বে। মিস্ করবেন না যেন। ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে