মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি ২ পর্ব-৩৬+৩৭

0
722

#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৩৬

রাহিদ চমকিত নেত্রে স্ত্রীর পানে তাকিয়ে! ভড়কানো কণ্ঠে কোনোমতে বললো,

” এসব কি? নিজে তো আস্ত এক ফটোবাজ হয়েছিস। এখন আমার ভাতিজাটাকেও সে-ই রাস্তায় আনতে চাইছিস? ”

ইনায়া ফটো তোলায় বিরতি টেনে স্বামীর পানে তাকালো। অপ্রসন্ন কণ্ঠে বললো,

” তোমার সমস্যাটা কোথায় হ্যাঁ? দিলে তো আমার সুন্দর ফটোটা নষ্ট করে। ”

চরম আশ্চর্যান্বিত হলো রাহিদ!

” কি? আমি? আমি তোর ফটো নষ্ট করেছি? কবে কখন কিভাবে? টেল মি। ”

” ফালতু বকবে না। রিহাম সোনাটা কি সুন্দর তাকিয়েছিল! ফাটাফাটি একটা পোজ। ছবিটা যেই তুলবো অমনি ষাঁড়ের মতো খ্যাঁক করে উঠলে। গেল আমার ছবিটা। ”

রাহিদ দুঃখ ভারাক্রান্ত ভাব করে বললো,

” ওরে নি-ষ্ঠুর মহিলা! নিজের স্বামীকে এভাবে মুখের ওপর ষাঁড় বলতে পারলি? একটুও কিডনি কাঁপলো না তোর? সিংহ বললে তা-ও কনসিডার করতাম। একটা বীরপুরুষ বীরপুরুষ ভাইবস্ আসতো। তা না। ডাইরেক্ট ষাঁড় বানিয়ে দিলি? ”

ইনায়া চোখমুখ কুঁচকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। মোবাইলে খুটখুট করার ফাঁকে বললো,

” তোমার চৌদ্দ পুরুষের কপাল ভালো নেংটি ইঁদুর বলিনি। ”

রাহিদ এতবড় হা করলো যে সে ফাঁক দিয়ে অবলীলায় হাতি বাহিনী চলাচল করতে পারবে। মেকি আহাজারি করে উঠলো রাহিদ,

” ছিঃ ছিঃ ছিঃ ছিঃ! ইনু। শেষমেষ তোর জলজ্যান্ত তা”গড়া জামাইটাকে এভাবে অ-শ্লীল ইঙ্গিত দিচ্ছিস? ওয়াক থু। ”

ইনায়া বিস্ময়ে বাকশূন্য! তার জলজ্যান্ত জামাইটা অন দ্য স্পট কিসব ফাও বকছে! সে কিনা অ..! ছিঃ!

” এই তোমার সমস্যাটা কোথায়? কিসব ভাট বকছো? আমি তোমাকে মোটেও উল্টোপাল্টা বলিনি। ”

রাহিদ চোখ গরম করে তাকালো,

” উল্টোপাল্টা বলিসনি? তবে নেংটা কি? হ্যাঁ? ”

ইনায়া তৎক্ষণাৎ বর সাহেবের মুখে ব্রেক কষে দিলো,

” এই এই ওয়েট। আমি নেংটি ইঁদুর বলেছি। মোটেও ওই শব্দটা বলিনি। ”

” ওরে আমার নি-ষ্ঠুর বউ! এভাবে পাল্টি খাচ্ছিস? আকাশ, বাতাস, আমার রিহু বেপ্পি সব দেখছে। শুনছে। তোর শাপ লাগবে রে। শাপ। ”

রিহাম সোনাটা কি বুঝলো কি জানে। দন্তবিহীন হাসলো। হৃদয়কাড়া সে হাসি! ইনায়া ফটাফট সে হাসিটুকু ক্যামেরা বন্দী করে নিলো। রাহিদ-ইনায়া উভয়েই হাসলো। রাহিদ ঝুঁকে বাবাটার গালে চুমু এঁকে দিলো। আহ্লাদে কণ্ঠে বলতে লাগলো,

” ওলে আমার রিহু বেপ্পিটা! কি ছুন্দত করে হাসে! একদম কেরাশ বয়! চাচুর মতো? হা? ”

কথাটা শ্রবণপথে পৌঁছাতেই কটমট করে স্বামীর পানে তাকালো ইনায়া। দাঁতে দাঁত পিষে বললো,

” সবাইকে নিজের মতো মনে করো নাকি? খবরদার আমার বাবাটাকে ইঁচড়ে পাকা বানাবে না। ”

দাঁত কেলিয়ে হাসলো রাহিদ,

” তাহলে ইঁচড়ে কাঁচা বানাই? ”

ইনায়া বিরক্তিকর অভিব্যক্তি প্রকাশ করে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। রাহিদ এলো আরো সন্নিকটে। ঘন হয়ে বসলো। সঙ্গিনীর কাঁধ ও ঘাড় সংলগ্ন স্থানে তপ্ত শ্বাস ফেলে লহু স্বরে শুধালো,

” কি হয়েছে সোনা? রাগ পাচ্ছে? ”

শিহরিত তনুমন। হৃদয়ে দোল খাচ্ছে অবর্ণনীয় প্রেমময় পবন। কম্পিত স্বরে থেমে থেমে বললো ইনায়া,

” কি করছো? সরো। রিহাম তাকিয়ে.. ”

রাহিদ সম্পূর্ণ করলো বাক্য,

” থাকুক। ছোট ও। বোঝে না এসব। ”

মিনতি জানালো ইনায়া,

” সরো না। ”

কর্ণের নিম্নে ঠেকালো নাক। আলতো করে নাক ঘষে দিলো কোমল ত্বকে। ফিসফিসিয়ে শুধালো,

” খারাপ লাগছে এ ছোঁয়া? ”

জটিল প্রশ্ন ছিল এটি। জবাব দিতে ব্যর্থ ইনায়া। আবেশে মুদিত আঁখিপল্লব। ততক্ষণে সঙ্গিনীর নে শা চড়েছে ছেলেটার শিরায় শিরায়। কাঁধ ও ঘাড়ে ওষ্ঠ ছুঁয়ে যাচ্ছে অবিরাম। ইনুর শিউরে ওঠা ডান হাত চেপে বসলো স্বামীর হাতে। বন্ধ আঁখিপল্লব। অনুভব করে চলেছে একান্ত জনের আবেগী পরশ। দুঃখ যাতনা শেষে কতদিন পর এলো এই একান্ত লগ্ন! শিশু রিহাম নিজ আঙ্গুলে লালারস লাগিয়ে খেলছে। তাকিয়ে ফুপি ও ফুপা ওরফে চাচুর পানে। অবুঝ তো। তাই বুঝলো না আজ কিছুই। তাকে সাক্ষী রেখে প্রেম প্রেম খেলা চালিয়ে গেল রাহিদ। বেচারা পুঁচকে কোনো প্রতিবাদ জানাতে পারলো না। বলতে পারলো না,

‘ আমি ছুটু। তোমরা আমার সামনে দুষ্টু করছো কেন? ‘

গোধূলি লগ্ন। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এ কক্ষটি। বদ্ধ জানালার কাঁচ। সে কাঁচে ঠেকে বাঁ হাত। কানে স্মার্টফোন। ফোনালাপে লিপ্ত মানুষটি। পড়নে তুষারশুভ্র পাঞ্জাবি পাজামা। বুদ্ধিদীপ্ত নভোনীল চক্ষুদ্বয় আড়াল হয়েছে রিমলেস চশমার অন্তরালে। ফোনের ওপাশ হতে বলে চলেছে,

” ভাই। মুন্সিগঞ্জের ওইদিকে একজনকে দেখা গেছে। সন্দেহ হইতাছে ওইটাই জহির আহসান। ”

” জায়গায় লেগে থাক। এক পা-ও যেন না নড়ে। ওটা যদি জহির আহসান হয়েই থাকে তাকে বিন্দুমাত্র আঁচড়বিহীন ঢাকা আনার দায়িত্ব তোদের। আশা করছি সেটা কি করে করবি আমায় হাতেকলমে বুঝিয়ে দিতে হবে না? ”

ওপাশ হতে আশ্বস্ত করে বললো,

” না ভাই। আপনি চিন্তা করবেন না। নিশ্চিন্তে থাকেন। আমরা ওইখানে আঠার মতো লাইগা আছি। ওই বুড়া এত সহজে পগারপার হইতে পারবে না। আপনি নিশ্চিন্তে থাকেন। ”

গাম্ভীর্যপূর্ণ স্বরে বললো ইরহাম,

” মনুষ্য মস্তিষ্ক মানেই চিন্তার আনাগোনা। সে চলবেই। তোরা ওদিকে চোখকান খোলা রাখ। ”

” জ্বি ভাই। রাখছি তাহলে? কিছু টের পাইলে আপনাকে জানাবো। আসসালামু আলাইকুম। ”

” ওয়া আলাইকুমুস সালাম। ”

নিশুতি রাত। বিছানায় বসে হৃদি। কোলে তার তিন মাস বয়সী আদুরে কন্যা মাহিকা। রিহাম এখন পল্লবী দাদীর কাছে। দুই মিনিটের বড়ছোট এরা দুই ভাই-বোন। রিহাম দুই মিনিটের বড়। এরপর মাহিকা। জন্মের পর থেকেই দুর্বল মেয়েটা। তার শ্বাসকষ্ট ও হৃৎপিণ্ডজনিত সমস্যা দেখা দিয়েছিল। আলহামদুলিল্লাহ্ এখন অনেকটাই ঝুঁকিমুক্ত। ভালো রয়েছে। তবে ভবিষ্যতে কখনো অসুবিধা হতে পারে। মাহিকার তুলনায় রিহাম সুস্থ সবল। তার ইমিউনিটি সিস্টেম উন্নত। তবে মাহিকা দুর্বল। এজন্য ওকে একটু বেশিই যত্ন করা হয়। মায়ের কোলেই বেশি থাকে বাচ্চাটা। ওদিকে রিহাম দিব্যি সবার কোলে কোলে ঘুরে বেড়ায়। ‘ আনন্দাঙ্গন ‘ এ কয়েক চক্কর ইতিমধ্যে কাটা হয়ে গেছে। তাই বলে মা’কে ভুলে যায় এমনটা নয় কিন্তু। ঠিক মনে পড়লে কেঁদেকেটে মায়ের কোলে পৌঁছে যায়। এখনই বেশ চঞ্চল। মায়ের ছেলে বলে কথা। রাতে ঘুমাতে চায় না বিচ্চুটা। দিনভর ঘুমায় আর রাতে বাড়ি পাহারা দেয়। কিন্তু মাহিকা মিষ্টি নম্র মেয়ে। সে ভালোমতো ঘুমায়। তবে খাওয়া-দাওয়ায় বড় অনীহা।

মায়ের কোলে শুয়ে মাহিকা। হৃদি আহ্লাদী স্বরে দুষ্টুমি করে কথা বলছে। দন্তবিহীন হাসি উপহার দিচ্ছে মেয়েটা। সে হাসিতে দু’চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। অলপক চাহনিতে তাকিয়ে হৃদি। এই সোনামনিটা তার নিজের? তার গর্ভজাত সন্তান! আল্লাহ্ তায়ালা তাকে দু’টো অমূল্য উপহার দিয়েছে। রিহাম ও মাহিকা। আল্লাহ্ প্রদত্ত অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপহার। মায়ের হাসি দেখে শিশু মাহিকাও হাসছে। হৃদি ঝুঁকে গেল। মেয়ের ললাটে গুনে গুনে চারটা চুমু এঁকে দিল। নিঃশব্দে হাসছে অবুঝ মেয়েটা। এমনই নজরকাড়া মুহূর্ত ঘরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে উপভোগ করছে ইরহাম। সদ্য কর্মস্থল হতে ফিরলো সে। ঘরে প্রবেশ করার পূর্বেই মা মেয়ের মিষ্টিমধুর মুহূর্তের সাক্ষী হলো। অধরকোলে ফুটে উঠলো হাস্য রেখা। তখনই এদিকে তাকালো হৃদি। চোখে চোখ পড়লো দু’জনার। মুচকি হেসে সালাম দিলো হৃদি,

” আসসালামু আলাইকুম। ”

ঘরে প্রবেশ করে সালামের জবাব দিলো ইরহাম,

” ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কেমন আছে আমার বাবু এবং তাদের আম্মু? ”

” আলহামদুলিল্লাহ্ আমরা দু’জনেই ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো? ”

” আলহামদুলিল্লাহ্ আমিও ভালো আছি। না কোনো অসুবিধা হয়নি। ”

হৃদি মুচকি হেসে মেয়েকে কোলে নিয়ে উঠতে উদ্যত হলো। হাতের ইশারায় নিষেধ করলো ইরহাম। হৃদি আর উঠলো না। কাছে গিয়ে মেয়ের ললাটে চুম্বন এঁকে দিলো মানুষটি। স্নেহপূর্ণ চাহনিতে তাকিয়ে রইলো কয়েক পল। মেয়েও বাবার পানে তাকিয়ে। বাবাকে ঠিক চিনেছে। তাই তো শব্দহীন হাসছে। দ্বিতীয়বার চুমু দিয়ে,

” আমার সোনা মা! বাবা ফ্রেশ হয়ে আসছি। ঠিক আছে? ”

অবুঝ শিশুটি এখনো বাবার পানে তাকিয়ে। নিজ অনুভূতি ব্যক্ত করতে ব্যর্থ। তাই তো নিশ্চুপ। মেয়ের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে স্ত্রীর পানে তাকালো ইরহাম। বললো,

” তুমি বসো। আমি নিজেই নিয়ে নিচ্ছি। ”

প্রসন্ন হলো হৃদয়। ইতিবাচক মাথা নাড়ল হৃদি। ইরহাম মুচকি হেসে ড্রেসিং টেবিলের দিকে অগ্রসর হলো। পোশাকআশাক বদলে ফ্রেশ হয়ে বের হবে সে। বসবে বিছানায়। তন্মধ্যে রিহাম হাজির। ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে এবার বাবা সময় কাটাবে। ডিনারের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত এটা তাদের বিশেষ মধুরতম সময়। পিতা, পুত্র ও কন্যা। হৃদয়ছোঁয়া লগন!

সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী খন্দকার আজগর মল্লিক। দলে পরিচিত ‘নেতাজী’ হিসেবে। কোথায় আজ তার প্রতিপত্তি? কোথায় সেই ক্ষমতার অপব্যবহার? বিগত দুই মাস ধরে কারাবন্দী জীবনযাপন করছে সে। ঠাঁই হয়েছে জেলের এক স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে। আলো বাতাস সেথায় স্বাচ্ছন্দ্যে প্রবেশ করতে ব্যর্থ। যে লোকটির অর্ধ জীবন কেটেছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে। আজ তার শেষবেলা গরমে ঘর্মাক্ত শরীরে কাটছে। কোনো এসি নেই। নেই শীতল হাওয়া প্রদানকারী দামী সিলিংফ্যান। অন্ধকার সে কুঠুরিতে সম্পূর্ণ একাকী সে। নেই কোনো সঙ্গী-সাথী। নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে ওনাকে একাকী এক সেলে রাখা হয়েছে। দু’টো কথা বলার জন্য আজ পাশে কেউ নেই। চারিদিকে নিস্তব্ধতার চাদর। আর রাতের আঁধারে ভ”য়ঙ্কর হাতছানি। অধিকাংশ রাত তার নির্ঘুম কাটছে। দেখা দিচ্ছে সে বীভৎস-বিকট অবয়ব। ঘুমের ঘোরে চেঁচিয়ে উঠছে সে। চিৎকার করে বাঁচতে চাইছে। এই মানসিক যন্ত্রণা হতে মুক্তি চাইছে। তবে আফশোস! বাঁচাতে এলো না কেউ। বরং সামান্য ক্ষমতার অধিকারী এক কনস্টেবল তাকে ধমক দিয়ে চুপ করতে আদেশ দিলো। বাকিদের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটছে যে। আজগরের আজ এই দুরবস্থা। ভিন্ন ভিন্ন রূপে সর্বমোট এগারোটি মামলা দায়ের করা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতি মামলায় কিছুদিন জামিনে ছিল। এরপর এলো সে-ই ভ-য়ানক দিন! একাধারে বেশকিছু মামলা। তন্মধ্যে প্রাইভেট ভার্সিটির স্টুডেন্ট মুহিত হ-ত্যা মামলা, ঢাবির ছাত্রনেতা হাসিফকে হ-ত্যার মূল পরিকল্পনাকারী, নারী পা:চার এবং মা-দক ব্যবসা অন্যতম।

আজগরের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দায়ের হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে শীঘ্রই কোর্টে উঠবে তিনটে কেস। ওদিকে তার একমাত্র পুত্র রুদ্রনীল। সে আউট অফ রিচ। উনি যোগাযোগ করার চেষ্টা করে বারংবার ব্যর্থ হয়েছেন। বুঝে উঠতে পারছেন না রুদ্র কি করতে চাইছে। গোয়ায় বসে সে কি বাপের দুর্দশা দেখে মজা লুটছে? নাকি অন্যদের মতো বিপদের সময় সে-ও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আজ এতটাই দুর্ভাগ্য তার। সরকারি দলের কোনো নেতাকর্মী, কিংবা তার ছেলেপেলে কেউই সেভাবে এগিয়ে এলো না। বিপদের আশঙ্কা করে সবাই মুখ বাঁচিয়ে চলছে। দূরত্ব বজায় রাখছে। এটাই মনুষ্য ধর্ম। গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল নিজ ভাষায় একটি খাঁটি কথা বলেছেন। যার বঙ্গানুবাদ হলো,

” দুর্ভাগা তারাই যাদের প্রকৃত বন্ধু নেই। ”

একদা এমন সময় ছিল। যখন ওনার গায়ে আইনের সামান্যতম আঁচ লাগলেও দেশে হরতাল, অবরোধ কর্মসূচি পালন করা হতো। জায়গায় জায়গায় প্রতিবাদ হতো। মা-রপিট হতো। আজ সেসব অতীত। এইবার উনি এত বাজেভাবে ধরা পড়ে গেলেন। অথচ দেশব্যাপী তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা হলো না। বরং জনগণের সামনে ওনার মূখোশ উন্মোচন হলো। ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হলো বিশ্রীভাবে। এই ওনার কপালে ছিল! একদিন লোকের সম্মান নষ্ট করেছেন অবলীলায়। আজ ওনার নিজস্ব সম্মান কাদামাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। কেউ নেই পাশে। সম্পূর্ণ একা উনি। পুত্র রুদ্রনীল যদি কোনো কার্যকারী পদক্ষেপ গ্রহণ না করে তবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড কিংবা ফাঁ-সি নিশ্চিত।

রঙচটা দেয়ালে ভারী দেহটি এলিয়ে দিলেন আজগর। ধরনীর বুকে আস্তে ধীরে নামছে আঁধার। অন্যদিনের ন্যায় আজ রাতেও অন্ধকারে না হানা দেয় সে-ই বি”ভীষিকাময় মুহুর্ত! সে-ই অতিকায় দা-নব!

এক স্নিগ্ধ অপরাহ্ণ। লিভিংরুমে বসে হৃদি। কোলে তার মাহিকা। হৃদি’কে ঘিরে পাশে, সামনের সোফা দখল করেছে বন্ধুমহল। সকলে এসেছে। যথারীতি রিহাম সোনাটা তার খালামণি, মামাদের কোলে চড়ে বেড়াচ্ছে। এক জায়গায় স্থির নেই। দন্তবিহীন হাসি উপহার দিচ্ছে। হৃদি মুগ্ধ নয়নে সে হাসিটুকু উপভোগ করছে! সাবিতের ডান পাশেই বসে নাদিরা। ওর কোলে এখন রিহাম। সাবিত ভাগ্নের ছোট্ট তুলতুলে হাত নিয়ে খেলতে খেলতে দুঃখী বদনে বললো,

” বুঝলি তোরা? প্রেম ক কিংবা ফ্লার্টিং। সারাজীবন করলাম আমরা। আর শেষমেষ গুড নিউজ আগে দিলোডা কে? ওই ছ-লনাময়ী নারী। ”

” ছ-লনাময়ী নারী? কে? হৃদু? ” জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে নাদিরা।

” আবার জিগায়। এই মাইয়া হারা জীবন প্রেম ভালোবাসা থে দূরে। অথচ দেখ। ঠিক সময়মতো কাম বানাইয়া দুই পিস পুতুল আমদানী করছে। এক্কারে গুলুমুলু পুতলা। ”

এমন দুষ্টু কথাবার্তায় তপ্ত হলো শ্রবণপথ। হৃদি মেকি শাসনের সুরে বললো,

” সাবু। চুপ করবি তুই? ”

” না। করতাম না। আগে ক আমাগো সেটিং না করাইয়া তুই এতবড় পূণ্য ক্যামনে করলি? একটুও গিলা, কলিজা, ফুসফুস কাঁপলো না? ”

হেসে উঠলো বন্ধুরা। হৃদি নিঃশব্দে হাসলো। নাবিল সহমত পোষণ করে বললো,

” কারেক্ট আছে বস। আমরা এখনো একটা পারমানেন্ট গফ জুটাইতে পারলাম না! আর হৃদু কিনা দুই কিউট পিসের মামা বানাই দিলো? ”

ইভা মুখ বাঁকিয়ে বললো,

” গাপ্পেন জুটাইতে পারোছ নাই। ইগ্লা তোগো ব্যর্থতা। এতে হৃদু কি করতো? তোগো লেইগা গফ ভিক্ষা করতো? ”

সাবিত আঙ্গুল তাক করে শাসিয়ে দিলো,

” ওই মহীয়সী বেডি! তুই তো চুপ ই থাক। নিজে তো থ্রি পিস মালু লইয়া মজায় আছো। আর আমগো চিরকুমার ক্লাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট বানানোর ধান্দা করতাছো? ”

ইভা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে!

” হোয়াট! আমি। আমি তিনটাকে নিয়ে মজা লুটপাট করতাছি? ”

” অফকোর্স। কোয়ি ডাউট? ”

” পাঁচশো পার্সেন্ট ডাউট। শা লা গাঁ;জাখুরি ভাট বকছে! ”

সাবিত দাঁত কেলিয়ে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু পথিমধ্যে থামিয়ে দিলো আফরিন। সে বসে হৃদি’র বাম পাশে। নিচু স্বরে শাসন করে বললো,

” তোরা চুপ করবি? তোদের প্যাঁনপ্যাঁন শুনে আমার মা টা ভয় পাচ্ছে। যেকোনো সময় কেঁদে দেবে। চুউপ ”

ইভা তৎক্ষণাৎ ঠোঁটে আঙ্গুল ঠেকিয়ে চুপ হয়ে গেল। তবে দমে গেল না সাবিত। বরং দ্রুত উঠে দাঁড়ালো। গেল সম্মুখে এগিয়ে। আস্তে করে সাবধানী ভঙ্গিতে মাহিকা’কে কোলে নিলো। কপালে চুমু এঁকে আদুরে গলায় বললো,

” আমার মা টা কাঁদে? কেন কেন? ভু পাচ্ছে? আহা রে। ভু পায় না। ওইটা ভালো শাকচু”ন্নী। তোমাকে ডর দেখাবে না। ঠিক আছে? ওইটা সামান্য কাটপিস। ভু পায় না মা। উম্মাহ। ”

পুঁচকের কপালে আরেকটা চুম্বন করলো সাবিত। হৃদি শব্দহীন হাসলো। আর ইভা? তেলেবেগুনে জ্ব’লে উঠলো! এতবড় ফালতু কথা! সে কিনা শা:কচুন্নী? ওই। ওই সাবু’র বাচ্চা হলো গিয়ে মামদো ভূত। আস্ত খা টা শ। হুহ্।

শোকর আলহামদুলিল্লাহ্। ভাগ্য করে প্রকৃত কতগুলো বন্ধু পেয়েছে সে। হৃদি ভাগ্যবতী এই বি;চ্ছুগুলোকে বন্ধু রূপে পেয়ে। সুখেদুঃখে সদা সর্বদা পাশে ছিল এরা। হৃদি ভোলেনি তার সে-ই বি’ভীষিকাময় দিনগুলি। হাসপাতাল কিংবা বাড়ি। আপনজনের মতো পাশে ছিল এই বন্ধুরা। পালাক্রমে একেকজন দিনভর ও সন্ধ্যায় তাকে সময় দিয়েছে। বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে উদ্দীপনা জুগিয়েছে। পরিবারের পর এরাই ছিল পাশে। দুঃসময়ে হাতটি ত্যাগ করেনি। প্রকৃত বন্ধুর ন্যায়, ছায়ার ন্যায় পাশেই ছিল। সে আসলেই ভাগ্যবতী। এক জীবনে পেয়েছে অনেকগুলো মানুষের প্রকৃত স্নেহ, ভালোবাসা! আলহামদুলিল্লাহি আলা কু’ল্লি হাল!

অমানিশায় আচ্ছাদিত ধরিত্রী। নিস্তব্ধ চারিধার। গোলক ধাঁধায় ফেঁ সে মানুষটি। নভোনীল চক্ষু জোড়া ব্যস্ত ধাঁধার সমাধান খুঁজতে। আস্তে ধীরে চলছে দু’টো হাত। ভাবনা খেলে বেড়াচ্ছে মস্তিষ্কে। এ কোন গোলক ধাঁধার সমাধান করতে ব্যস্ত চৌধুরী?

চলবে.

#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৩৭

নিশুতি রাত। বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা নোটস্ এবং খাতাপত্র। কিছুদিন পর মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা। ফলস্বরূপ বিগত কিছুদিন ধরে ব্যস্ত সময় পাড় করছে রাহিদ। সমস্ত ধ্যানজ্ঞান পড়ালেখায়। পড়তে পড়তে ভুলতে বসেছে একমাত্র বউকে। এজন্য দুঃখের শেষ নেই ইনায়ার। তার বরটা এমন ভুলোমনা কেন? কাজ হোক কিংবা পড়ালেখা। একবার ডুবে গেলে দিন দুনিয়া ভুলে খেয়ে ফেলে। মস্তিষ্ক থেকে বেরিয়ে যায় তার পাঁচটা না দশটা না একটামাত্র কিউটি বউ আছে। যেমন এই মুহূর্তে খাতায় লিখতে লিখতে শহীদ হয়ে যাচ্ছে। ওদিকে যে এক আবেদনময়ী নারী তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে জানে কি সে! অনেক সহ্য করেছে ইনায়া। আর নয়। ঘনিষ্ঠ এক বান্ধবীর বুদ্ধি মোতাবেক সিদ্ধান্ত নিয়েছে আজ যে করেই হোক সাহেবের পড়ালেখা চাঙ্গে তুলবে। সেজন্য সামান্য এক প্রচেষ্টা। আরশিতে আরেকবার নিজেকে দেখে নিলো ইনায়া। পড়নে তার কৃষ্ণবর্ণ সিল্কের শাড়ি। আকর্ষণীয় ডিজাইনের ব্লাউজে অনাবৃত হাত ও পিঠের অধিকাংশ। পিঠ বরাবর এলিয়ে তার কেশ। সেথায় জড়িয়ে বেলি ফুলের মালা। মুখশ্রীতে কৃত্রিম প্রসাধনীর হালকা প্রলেপ। লাল ওষ্ঠরঞ্জনীতে রঙিন ওষ্ঠাধর। সে এক নে-শাক্ত রূপের ঝলক! পিছু ঘুরে এ যুগের বিদ্যাসাগর ম্যাক্স প্রো বরের পানে তাকালো ইনায়া। লহমায় লজ্জালু আভা ফুটে উঠলো মুখশ্রীতে। শিরশিরানি অনুভূতি শিরায় উপশিরায়। তবুও পিছু হটলো না মেয়েটা। বড় করে শ্বাস ফেললো। আজ এই পড়ুয়া বরকে নে-শালো শায়েস্তা করতেই হবে। হুম।

ছোট ছোট কদম ফেলে বিছানার ধারে অগ্রসর হচ্ছে মেয়েটি। প্রতিটি কদমে ধড়াস ধড়াস করছে বক্ষপিঞ্জরের অন্তরালে লুকায়িত হৃদযন্ত্রটি। নিজেকে সামাল দেয়া আজ দায়। ঘনঘন পলক ঝাপটালো আঁখিপল্লব। আর’ক্ত বদনে এসে বসলো বিছানায়। স্বামীর পাশে। আড়চোখে দেখে নিলো স্বামীকে। একমনে লিখতে ব্যস্ত সে। ম্যাথমেটিকাল সাবজেক্টে বুঁদ হয়ে আছে। আজ ম্যাথের সল্যুশন নয় প্রিয়তমার অভিমানের সল্যুশন কষতে হবে তাকে। হুম। ইনায়া আস্তে ধীরে অল্পখানি ঝুঁকে গেল। ইচ্ছাকৃতভাবে স্পর্শ করছে একটি খাতা। নড়েচড়ে দেখছে। পাতা উল্টাচ্ছে। হাতটি এমন ভাবে রাখা যেন সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। তা-ই হলো। কাঁচের চুড়ির রিনিঝিনি কলরব কড়া নাড়লো শ্রবণেন্দ্রিয়ে। ব্যাঘাত ঘটলো মনোযোগে। ভ্রু কুঁচকে খাতা হতে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো রাহিদ। এইসব উল্টোপাল্টা শব্দ আসছে কোথা থেকে? চোখ তুলে তাকাতেই চক্ষুতারায় বন্দী হলো স্ত্রীর পেলব হাতটি। কাঁচের রঙিন চুড়ি পড়ে সে। হালকা নড়াচড়ায় রিনিঝিনি ধ্বনি সৃষ্টি হচ্ছে। এক লহমায় মোহগ্ৰস্থ হলো রাহিদ। মাথা তুলে ভালোমতো তাকালো। বিস্ময়ে অভিভূত হলো ছেলেটা! তার প্রেয়সী এ কি আগুন রূপে নিজেকে উপস্থাপন করেছে! জ্ব’লছে অন্তর। পু’ড়ছে বুক। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে তার। দ্রুত ওঠানামা করছে বক্ষস্থল। দু চোখে আকাশসম মুগ্ধতার রেশ!

স্বামীর বিমোহিত চাহনি ঠিক উপলব্ধি করতে পারলো ইনায়া। তবুও নিজ কর্ম হতে হটলো না। পূর্বের ন্যায় স্বল্প ঝুঁকে নোটবুকের পাতা উল্টাতে লাগলো। যেন সমস্ত ধ্যানজ্ঞান সেথায়। আশেপাশে নেই কেউ। পড়ালেখা মঙ্গলে উড়ে যাক। সবকিছু বাদ দিয়ে প্রেয়সীতে মজে গেল রাহিদ। তাকে অবজ্ঞা করে নোটবুক ঠোঁটস্থ করা হচ্ছে! ধাক্কা দিয়ে নোটবুক সরিয়ে ফেললো ছেলেটা। ইনায়া কেমন চমকিত নেত্রে তাকালো! ভাবখানা এমন যে কি হলো? এটা সরিয়ে ফেললে কেন? রাহিদ মা;দকতায় আচ্ছন্ন চোখে তাকিয়ে। হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিলো সঙ্গিনীকে। চওড়া বক্ষপটে মিশে গেল মেয়েটা। কটিদেশের বাঁ পাশে স্থাপিত পুরুষালি হাত। স্বামীর দু কাঁধে ইনুর কোমল হাত। নয়নে বন্দী হলো নয়ন। নৈঃশব্দ্যে হলো অব্যক্ত কিছু অনুভূতির আদান-প্রদান।

” এত সাজ কার জন্য সোনা? ”

মোহাচ্ছন্ন স্বরে শুধালো রাহিদ। স্বামীর নয়নে নয়ন স্থির রেখে কম্পমান স্বরে জবাব দিলো ইনায়া,

” নিজের জন্য। ”

কটিদেশে চাপ সৃষ্টি হলো। আরো নৈকট্যে এলো ছেলেটা। দু’জনার নাক প্রায় ছুঁই ছুঁই।

” নিজের জন্য? ” অবিশ্বাসের স্বরে শুধালো রাহিদ।

” হ্যাঁ। নিজের জন্য। ”

” মিথ্যে। ”

” সত্যি। বেলকনিতে ফটো তুলবো। ওয়েদার বেশ সুন্দর। ”

শুকনো ঢোক গিলে বললো মেয়েটা। নাকে ওষ্ঠ চাপ বসালো রাহিদ। তেমনিভাবে ফিসফিসিয়ে বললো,

” ইয়াহ্। প্রেম প্রেম হাওয়া বইছে। এমন ওয়েদারে দূরত্ব নয় একে অপরেতে বিভোর হওয়াটাই সর্বোত্তম। ঠু গুড।”

অক্ষিপুট বুঁজে গিয়েছে ইতিমধ্যে। শক্ত করে স্বামীর কাঁধে চেপে বসলো দু’হাত। দ্বিমত পোষণ করে থেমে থেমে মৃদু স্বরে বললো ইনায়া,

” মিথ্যে কথা। পড়ছিলে তুমি। সেটাই করো। কোথাও বিভোর হতে হবে না। ”

গালের পেলব ত্বকে অবলীলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে পুরুষালি অধরোষ্ঠ। ছোট ছোট পরশ অঙ্কন করে রাহিদ গাঢ় স্বরে বললো,

” প্রেম প্রেম এ আবহাওয়ায় প্রেয়সীতে বিভোর হওয়া অত্যাবশ্যক। নাহলে প্রেমিক জাতির ওপর বেজায় অসন্তুষ্ট হবে বিশিষ্ট প্রেমিকপুরুষ জনাব রাহিদ। ”

অভিমান হলো বেশ। স্বামীর কপালে ঠেকে কপাল। মিহি স্বরে জানতে চাইলো ইনু,

” এতকাল কোথায় লুকিয়ে ছিল এই গভীর ভালোবাসা? একদিন এই তুমিটাই আমায় কথা শুনিয়েছিলে। আমার অনুভূতিকে আবেগ বলে হেয় করেছিলে। ”

কণ্ঠে ভেজা ভাব স্পষ্ট। সহসা পরিবেশ বদলে গেল। স্ত্রীর ললাটে চুমু এঁকে রাহিদ ইঞ্চিখানেক দূরত্ব সৃষ্টি করলো। প্রিয় মুখপানে তাকিয়ে রইলো কিছু মুহূর্ত। চোখে চোখ রেখে নিজেকে সামলিয়ে নিলো। গুছাতে লাগলো শব্দমালা। অধরোষ্ঠ সিক্ত হলো লালারসে। অতঃপর ধীরলয়ে অনুতপ্ত স্বরে বলতে লাগলো সে,

” ইনু। আমি কি করতাম সোনা? তোর প্রতি এই অনুভূতিটা যে আজকের নয়। সেই সাত বছরের পুরনো অনুভূতি। কিশোরী তোর মায়াতে অজান্তেই কখন যে ফেঁ;সে গেলাম, জানা নেই। সেই মায়া, সে প্রগাঢ় অনুভূতি প্রতিনিয়ত আমায় গ্রাস করে নিচ্ছিল। আমি নিজেকে দাবিয়ে রাখতে পারছিলাম না। আমার জীবনটা তো অন্য সবার মতো সরল নয়। তুই জানিস। আমার ওই বাপ। তার সঙ্গে কখনোই ভালো সম্পর্ক ছিল না। বাড়ি ছেড়ে আমি আলাদা ফ্লাটে থাকতাম বন্ধুদের সঙ্গে। আমায় মাথায় সবসময় এটাই ঘুরতো যে কখন নিজের পায়ে দাঁড়াবো আমি! কখন পুরোপুরি সাবলম্বী হয়ে মা ও বোনের দায়িত্ব নেবো। ওই নরক থেকে ওদের উদ্ধার করবো। আমার ওই কাটাছেঁড়া জীবনে বহুত দায়িত্ব রে। সেখানে প্রেম ভালোবাসা নামক লুতুপুতু বিলাসীতা বিহীন অন্য কিছু নয়। ”

দম ফেলে পুনরায় বলতে লাগলো রাহিদ,

” আমি তো জানতাম। প্রতিনিয়ত অনুভব করেছি তোর হৃদয়ের কতখানি জুড়ে আমার বসবাস। তাই তো নিশ্চিন্তে থাকতে পেরেছি। বিশ্বাস কর সোনা। আমি তোকে কখনোই অবজ্ঞা করতে চাইনি। নিজে প্রতিষ্ঠিত হবার জন্য, আমার সুপ্ত অনুভূতিকে সামাল দেয়ার জন্য সময় নিয়েছি মাত্র। তোর বয়স কম। আমার চাওয়াপাওয়া আকাশছোঁয়া। ছোট্ট একটা ভুল পদক্ষেপ তোর ফুলের মতো পবিত্র জীবনে নোংরা দাগ লেগে যেতো। আমি কখনোই তোকে প্রেমিকা হিসেবে চাইনি। আমার বিবাহিতা সঙ্গিনী হিসেবে চেয়েছি। যে হবে আমার হালাল সঙ্গিনী। যাকে নিয়ে ভাবতে, ছুঁতে আমায় বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করতে হবে না। যখন তখন এরকম সেরকম তুই শুধুই আমার। ইনায়া শুধু তার রাহি’র। ”

দু হাতের অঞ্জলীতে ভরে নিলো প্রিয়তমার আদল। অশ্রুসিক্ত সে মায়াবী নেত্রে তাকিয়ে আবেগপ্রবণ স্বরে বললো,

” আমায় বিশ্বাস কর একটু। আমি সঠিক সময়ের অপেক্ষায় ছিলাম। দিন গুনছিলাম কবে তুই পাকাপোক্ত ভাবে হবি আমার। তোকে পাওয়ার অদম্য অভিলাষ আমায় প্রতিনিয়ত কুঁড়ে কুঁড়ে খেতো। হয়তো তুই বিশ্বাস করবি না। তোর থেকেও বেশি আমি শুধু চেয়েছি তোকে। আমার প্রতিটি দোয়ায় ছিল তোকে হালাল ভাবে পাওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষা। ওপর ওয়ালা আমার দোয়া কবুল করেছে রে। তাই তো আজ তুই আমি এখানে। একসাথে। অ্যাজ অ্যা কাপল। রা’নায়া। ”

ইনায়া ভুলে গেল পলক ঝাপটাতে। দু নয়ন জুড়ে অবাকতার রেশ! হৃদয়ে সুপ্ত অনুভূতির হুলস্থুল তোলপাড়। টলমলে নয়নে তাকিয়ে মেয়েটা। একটুখানি টোকা পড়লেই গড়িয়ে পড়বে অশ্রুকণা। লালাভ রঙে রঙিন মুখশ্রী। অধর উল্টে কান্না পাচ্ছে। কি করে এ মুহূর্তে তার মন কাননে চলমান অনুভূতি, নিজ অবস্থা উপস্থাপন করবে জানা নেই তার। দ্বিধান্বিত মেয়েটা সব এড়িয়ে গাঢ় আলিঙ্গনে বেঁধে নিলো স্বামীকে। কোমল দু হাত জড়িয়ে সঙ্গীর গলা। কাঁধে মুখ গুঁজে নিঃশব্দ ক্রন্দনে লিপ্ত ইনায়া। রাহিদ টের পেল। বুঝলো সবই। তাই তো নিভৃতে আগলে নিলো নিজের সনে। প্রশস্ত বক্ষপটে ঠাঁই দিলো তার প্রেয়সীকে। অগণ্য সময় সেভাবেই অতিবাহিত হলো। একান্ত প্রেমময় এ লগ্নে ভিন্ন কিছু করার অভিলাষ জাগলো মনে। তা পূরণ করতে স্ত্রীর কর্ণ গহ্বরে ওষ্ঠ ঠেকালো রাহিদ। প্রিয়তমার অতি সন্নিকটে কোনো এক একান্ত মুহূর্তে গান গাওয়ার সুপ্ত ইচ্ছে। আজ পূরণ করবে সে। ইনায়ার শ্রবণ পথে ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে বালামের কণ্ঠে গাওয়া জনপ্রিয় সে বাংলা গানটির কিছু শব্দমালা,

” যত কথা রাখা ছিল এই বুকে জমা
যত কথা রাখা ছিল এই বুকে জমা
তোমাকে জানিয়ে দিলাম, ও প্রিয়তমা
তোমাকে জানিয়ে দিলাম, ও প্রিয়তমা ”

আকস্মিক চমকে বিস্মিত ইনায়া! থেমে গেল আবেগী ক্রন্দন। স্পষ্টরূপে শুনছে সে আবেগমণ্ডিত কন্ঠে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দমালা। স্বামীর পানে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো মেয়েটা। তাকে আরো নৈকট্যে টেনে নিলো রাহিদ। মুখ স্বল্প ডুবে সঙ্গিনীর গলদেশ বরাবর। চক্ষু নিমীলিত। ঘন শ্বাস নিয়ে নাসিকাগ্ৰন্থিতে টেনে নিচ্ছে প্রেয়সীর একান্ত সুবাস। গুনগুনিয়ে গাইছে সে,

” আমার আকাশ নীলে তুমি যে নীলিমা
আমার আকাশ নীলে তুমি যে নীলিমা
তোমাকে জানিয়ে দিলাম, ও প্রিয়তমা
তোমাকে জানিয়ে দিলাম, ও প্রিয়তমা ”

আবেশে শিউরে উঠলো তনুমন। কাঁধে ডেবে গেল নখ। প্রিয়তমার অবস্থা অনুধাবন করে আগলে নিলো ছেলেটা। কোমল ত্বকের যত্রতত্র অধর ছুঁয়ে আবেগঘন কণ্ঠে জানান দিলো,

” ও প্রিয়তমা, ও প্রিয়তমা
ও প্রিয়তমা, আমার প্রিয়তমা। ”

স্বামীকে গাঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে নিলো ইনায়া। নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারলো না। সে-ও মধুরতম কন্ঠে একই গানের কিছু লাইনের মাধ্যমে নিজস্ব অনুভূতি ব্যক্ত করার প্রয়াস চালালো,

” চিরদিন পাশে থেকো, সুখে দুখে জড়িয়ে
অভিমানে আবদারে মায়া দিও ছড়িয়ে
তুমি, তুমি, তুমি শুধু তোমারই উপমা
তুমি, তুমি, তুমি শুধু তোমারই উপমা ”

বালিশের নরম আবরণে ঠেকে গেল মাথা। শায়িত ইনায়া। বিপরীতে তার একান্ত পুরুষ। বিবাহিত প্রেমিকপুরুষ। পাশেই মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায় উড়ছে নোটবুকের পাতা। অর্থ উন্মুক্ত খাতা। সেথায় বিন্দুমাত্র নেই নজর। হাত বাড়িয়ে বেডসাইড লাইট সুইচ বন্ধ করে দিয়েছে রাহিদ। মৃদু নীলাভ আলো ছুঁয়ে যাচ্ছে গাত্র। একে অপরের পানে প্রেমাসক্ত নজরে তাকিয়ে তারা। ধীরে ধীরে সে প্রেমার্দ্র পরশ উ;ন্মাদনায় রূপান্তরিত হলো। প্রিয়তমায় মত্ত হলো প্রেমিক পুরুষ। প্রেম প্রেম এ লগনে কোথা হতে যেন ভেসে আসছে আবেগী সম্বোধন,

” ও প্রিয়তমা, ও প্রিয়তমা
ও প্রিয়তমা, আমার প্রিয়তমা। ”

নিশুতি রাত। চারিদিকে বিরাজমান ঘন নিস্তব্ধতা। শ্রবণপথে পৌঁছাচ্ছে নিশাচর পাখপাখালির কলরব। শুনশান এ সড়ক ধরে ছুটে চলেছে দ্রুতগামী কুচকুচে কালো পোর্শে কেয়েন’টি। গাড়িটির গতিবেগ সর্বোচ্চ কাঁটায় স্থির। জনশূন্য পথ ধরে ছুটে চলেছে। চালকের আসনে বসে চৌধুরী। রিয়ারভিউ মিররে আরো একবার চোখ বুলালো সে। না। আর পিছু করছে না তারা। সফলতার সহিত তাদের ধোঁকা দিতে সক্ষম হয়েছে সে। অনেকটা পথ তো পিছু নিলো। এবার একটু বোকাবনে গিয়ে এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করুক। বক্র হেসে পোর্শে কেয়েন এর গতিবেগ বৃদ্ধি করলো ইরহাম। বিনা বাধায় ছুটে চলেছে গাড়িটি। বদ্ধ গাড়ির কাঁচ। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অন্দর। তবুও চিন্তার বলিরেখা কপালে দৃশ্যমান। শক্ত চোয়াল। চশমা বিহীন নভোনীল চক্ষুদ্বয়ে আজ লেন্সের উপস্থিতি। তীক্ষ্ণ দু চোখ স্থির জনশূন্য সড়কে। সতর্ক ভঙ্গিতে গন্তব্যে এগিয়ে চলেছে সে।
_

ঘন গাছপালায় ঘেরা স্থানটি। ঝিঁঝিঁ পোকার গুনগুন কড়া নাড়ছে কর্ণ গহ্বরে। ঠাণ্ডা আবহাওয়া। সশব্দে এসে থামলো কৃষ্ণবর্ণ পোর্শে কেয়েন। উন্মুক্ত হলো গাড়ির দ্বার। বীরদর্পে বেরিয়ে এলো ইরহাম চৌধুরী। শব্দ করে বন্ধ হলো দ্বার। আজ এক ভিন্ন অবতারে উপস্থিত হয়েছে সে। পড়নে তার ব্লাক কালার হুডেড লেদার জ্যাকেট। জ্যাকেটের নিম্নে একই রঙা ভি নেক টি-শার্ট। জ্যাকেটের অর্ধ ভাগ চেইন উন্মুখ। মাথায় টেনে রাখা হুডি। মুখে কালো মাস্ক। কালো জিন্স প্যান্ট এবং একই রঙের স্পোর্টস স্নিকার্স। অসংখ্য বৃক্ষরাজির ভীড়ে অবস্থিত এ স্থানটি। বৃক্ষপত্র ভেদ করে চাঁদের আলো জমিনে আছড়ে পড়তে পুরোপুরি সক্ষম নয়। ঘোর অমানিশায় আচ্ছাদিত সব‌। নভোনীল সন্দিগ্ধ চোখ দু’টো আশপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সময় নিয়ে সতর্কতার সহিত চারপাশের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে নিলো সে। অতঃপর অচঞ্চল ভঙ্গিতে পা বাড়ালো। খুদে বার্তায় প্রেরিত নির্দেশনা অনুযায়ী পঁচিশ কদম সম্মুখে যেতে হবে। ধীরে ধীরে বুঝেশুনে পা ফেলছে ইরহাম। হাতে ছোট্ট ডিজাইনিং টর্চ লাইট। তার আলোয় দেখা মিলছে পথ। স্নিকার্সের নিচে পিষ্ট হচ্ছে শুকনো পাতা। পিনপতন নিরবতায় এ সামান্য খসখসে শব্দেও দাঁড়িয়ে যাচ্ছে লোমকূপ। সাবধানী কায়দায় পঁচিশ কদম সোজা অগ্রসর হলো। থেমে গেল পা। দু পা ঘুরিয়ে দাঁড়ালো মানুষটি। প্রথমে ডানে অতঃপর বামে চোখ বুলিয়ে নিলো। পেছনেও দেখলো একবার। কোথাও কেউ নেই। শূন্যতা আর নৈঃশব্দ্য ভাব।

ইরহাম আরো একবার এদিক ওদিক তাকালো। মাস্কের অন্তরালে চলছে শ্বাস প্রশ্বাস। ঠাণ্ডা মস্তিষ্কে ভাবনাচিন্তা করছে সে। ওপরদিকে, নিচেও দেখতে লাগলো। হঠাৎ চক্ষুতারায় বন্দী হলো অদ্ভুত কিছু একটা। কুঞ্চিত হলো ভ্রু যুগল। ডান দিকে পনেরো কদম অগ্রসর হলো ইরহাম। পৌঁছালো এক প্রকাণ্ড বৃক্ষতলে। গাছের নিম্নভাগে একটি জিনিস রাখা। ইরহাম সন্নিকটে পৌঁছালো। সুতীক্ষ্ণ চাহনি ঘুরে বেড়াচ্ছে জিনিসটির দেহে। হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করতে গিয়েও থেমে গেল সে। জ্যাকেটের অন্তরালে গুপ্ত স্থান হতে বের করলো হ্যান্ডহেল্ড এক্সপ্লোশিভ ডিটেক্টর। এক বিশেষ বন্ধু প্রদত্ত এই ছোট আকারের উপহারটি। যেকোনো এক্সপ্লোশিভ সহজেই চিহ্নিত করতে পারে এই ডিটেক্টর। তাই তো বহন করে নিয়ে আসা। ইরহাম ডিটেক্টরটি হাতে নিয়ে ঝুঁকে গেল। অদ্ভুতুড়ে জিনিসটির গায়ে সঠিক পন্থায় সেটি ধরলো। সক্রিয় হলো ডিটেক্টর। নির্দেশ করলো এর অন্দরে কোনোরূপ বি-স্ফোরক দ্রব্য নেই। সে খুলতে পারে এটি। তপ্ত শ্বাস ফেললো ইরহাম। ডিটেক্টরটি নিস্ক্রিয় করে পুনরায় গুপ্ত পকেটে চালান করলো। হাত বাড়িয়ে ছুঁলো সে-ই অদ্ভুত জিনিসটি। ইরহাম এমন বক্স বোধহয় একবার দেখেছিল। ঠিক চিনতে পারলো না। কেমন অদ্ভুত পাজল বক্সের মতো দেখতে। প্রকৃতপক্ষে এটির পরিচয় হলো এটা একটি কারাকুরি রিপল আউট পাজল বক্স।

বাক্সের ওপর কেমন সরু দাগ কাটা। ধাঁধার মতো দেখতে। আকারে এই বাক্সটি ছোট। কিন্তু দেখতে অদ্ভুত। কাঠের তৈরি বোধহয়। ইরহাম বুঝে উঠতে পারছিল না এই বাক্সটি ঠিক কোন কাজে লাগবে। এটাই কি তবে সে-ই গোপন সূত্র যার খোঁজে এখানে আগমন? তাই তো মনে হচ্ছে। বুদ্ধিদীপ্ত মানুষটির দু চোখ বাক্সে স্থির হয়ে রইলো। বাক্সের নিচের দিকে একটি ছোট্ট ড্রয়ার। আস্তে ধীরে সেই ড্রয়ার খোলার চেষ্টা করলো সে। ব্যর্থ হলো। ড্রয়ার বন্ধ। এর চাবি ব্যবহার করার কোনো নিয়ম নেই। এমনিতেই খুলবে ড্রয়ার। কিন্তু খুলছে না তো। ইরহাম আরো কয়েকবার চেষ্টা করলো। উঁহু। হচ্ছে না। বুঝে গেল সে এভাবে হবে না। এই নকশার পেছনে কোনো তো কারণ রয়েছে। বাক্সের ওপর দিকে কেমন খাঁজ কাটা নকশার মতো। উপরের ঢাকনা প্যাটার্নটি অনুভূমিকভাবে বিভক্ত এবং উপরের এবং নীচের অংশটি পাশে সরানো যেতে পারে বলে মনে হচ্ছে। নিশ্চয় এখানেই কোনো ঘটনা রয়েছে। হুঁ। বুদ্ধি প্রয়োগ করে বাক্সের ওপরের বাম অংশে হালকা নড়া দিলো। এতেই কাজ হলো। কিছুটা সরে গেল বাম অংশের কাঠ। জ্বলজ্বল করে উঠলো নভোনীল শান্ত-গভীর চোখ দুটো। আস্তে ধীরে বাক্সের ওপরের বাম অংশ ও ডান অংশ নড়াতে লাগলো। খাঁজ কাটা নকশাযুক্ত দুই অংশ। আগপিছ করে নড়ে একটা আকার ধারণ করতে চাইছে। চট করে মস্তিষ্কে কড়া নাড়লো এক বুদ্ধি। যথার্থভাবে দু’টো অংশ স্লাইড করলো। এবার এটি একটি লহরের মতো দেখাচ্ছে এবং বৃত্তের প্যাটার্ন তৈরি হয়েছে। দু চোখে আশার আলো দেখা দিলো। এবার আস্তে করে পাজল বাক্সের ড্রয়ারে হাত দিলো। একটু টান দিতেই উন্মুক্ত হলো ড্রয়ার। আঁধার মাঝে সফলতার ঝলকানি দেখা দিলো নয়ন যুগলে। অধরে ফুটে উঠলো দুর্বোধ্য রেখা।

চলবে.

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে