মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি ২ পর্ব-৩৫

0
610

#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৩৫ [ প্রথমাংশ ]

নিস্তব্ধ নয়ন জোড়া নিবদ্ধ অপারেশন থিয়েটারের লাল রঙা বাতির পানে। অতিবাহিত হয়েছে উদ্বেগ মাখা অনেকটা সময়। এখনো অন্দরে ‘সে’। খুব যন্ত্রণা হচ্ছে বুঝি! কাটাছেঁড়া যে মেয়েটা সইতে পারে না। একফোঁটা রক্ত-ও তাকে ভয় পাইয়ে দেয়। অথচ বিগত কয়েক মাসে কত কি সহ্য করতে হয়েছে ওকে। কোমল দেহটা আর কত সহ্য করবে! সহ্য সীমা অতিক্রম করলে যে বড় পীড়া হয়। এখনো অন্দরে ‘সে’। সি সেকশন চলছে। চলছে ওদের অনাগত সন্তানদের দুনিয়ায় আনার সর্বশেষ ধাপ। সার্জারির যন্ত্রণাদায়ক প্রহর কাটিয়ে সুস্থ সবল দেহে ফিরে আসুক সে।

‘ ইয়া আল্লাহ্! আমার স্ত্রীকে সমস্ত যন্ত্রণা সহ্য করার তাওফীক দান করো। ওকে শারীরিক ও মানসিকভাবে সবল রেখো। আমিন। ‘

প্রচুর অস্থির লাগছিল। একটুও শান্তি মিলছিল না। বুকের ভেতরটা পু’ড়ে যাচ্ছিল। অ-গ্নিকান্ড হচ্ছিল বক্ষ বাগিচায়। চঞ্চল পায়ে এদিক ওদিক পায়চারি করছিল ইরহাম। দৃষ্টি বারংবার চলে যাচ্ছিল অপারেশন থিয়েটারের দ্বারে। ধীরে ধীরে অসহনীয় দুশ্চিন্তা আষ্টেপৃষ্ঠে গ্রাস করে ফেললো। চকিতে স্মরণে এলো সমস্ত চিন্তার সমাধান। মহান রবে’র ইবাদত বন্দেগী। যেকোনো সমস্যায়, বিপদে একমাত্র রক্ষাকারী মহান আল্লাহ্। ওনার সীমাহীন ছায়াতলে মিটে যাবে সকল অশান্তি। দূরীকরণ হবে অস্বস্তি। শান্ত হবে এই অশান্ত তনুমন। আর বিলম্ব করলো না ইরহাম। দুশ্চিন্তায় বিধ্ব-স্ত মানুষটি মন্থর গতিতে পা বাড়ালো। গন্তব্য হাসপাতালের প্রার্থনা ঘর। স্ত্রী-সন্তানদের সুস্থতা কামনা করে নফল ইবাদত বন্দেগিতে হবে মশগুল। ওর গমন পথে তাকিয়ে উপস্থিত আপনজন।
__

হৃদির গর্ভকালীন সময়ের ত্রিশ সপ্তাহ চলছিল। মায়ের ইন্তেকালের পর থেকেই অতিবাহিত হচ্ছিল ওর বিভীষিকাময় জীবন। শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রচুর বিধ্ব-স্ত ছিল মেয়েটি। ওজন বেশ হ্রাস পেয়েছিল। বৃদ্ধি পেয়েছিল বমির প্রকোপ। এছাড়াও ছিল মানসিক অস্থিরতা ও পা:গলামি। পরিবারের সদস্যরা অতি যতনে ওকে আগলে রাখছিল। দুই সপ্তাহ বাদে আট মাসে পড়বে। শেষের এই সময়কাল বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। অসুস্থ মেয়েটির জন্য চিন্তার কারণ। ইরহাম ও বাড়ির লোকেরা ওকে যথাসাধ্য দেখে রাখছিল। তবে মহান স্রষ্টার ছিল ভিন্ন কোনো পরিকল্পনা। ফলস্বরূপ সাড়ে সাত মাসেই অকাল প্রসবের উপসর্গ দেখা দিলো।

বিকেল হতেই শরীরটা বড্ড খারাপ লাগছিল। হাঁসফাঁস করছিল হৃদি। নিজ শরীরে পরিবর্তন অনুভব করতে পারছিল। অজানা ভয়ে হিম হয়ে আসছিল তনুমন। ওর গর্ভস্থ বাচ্চারা ঠিক আছে তো? মা হয়ে সে নিজ সন্তানদের কোনো ক্ষতি ডেকে আনেনি তো! ভয় পেয়ে গেল হৃদি। কপালে, গালে, গলদেশে জমায়েত হলো স্বেদবিন্দু। কালক্ষেপণ না করে মামীকে বিষয়টি জানালো সে। পল্লবী নিজেও চিন্তিত হয়ে পড়লেন। ওকে আশ্বস্ত করতে কোমল স্বরে বললেন,

” চিন্তা করো না মা। তুমি একটু এদিকে কাত হয়ে শুয়ে থাকো। কখনো কখনো ফলস্ পেইন হয়। একটু রেস্ট নাও। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমাদের শিওর হওয়া দরকার। ”

মামীর কথামতো কাত হয়ে শুলো হৃদি। তবে কোনো উত্তম পরিবর্তন হলো না। বরং শারীরিক অবস্থা আরো শোচনীয় হতে লাগলো। এক ঘন্টার বেশি সময় ধরে শুয়ে। তবুও অকাল প্রসবের উপসর্গ দূরীভূত হয়নি। বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরো প্রকট আকার ধারণ করছিল। হৃদির অবস্থা বেশ নাজুক। এতেই ঘাবড়ে গেলেন পল্লবী। রাজেদা খানমের সঙ্গে আলাপ করে নিশ্চিত হলেন এটি ফলস্ পেইন নয়। আসলেই হৃদির প্রসব বেদনা আরম্ভ হয়েছে।

গোধূলি লগ্ন তখন। কড়া নিরাপত্তায় নিয়োজিত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দেহরক্ষীরা। সম্মুখে, পিছে তাদের তিনটে গাড়ি। মধ্যখানে হৃদি’কে বহনকারী গাড়ি। প্রসব বেদনায় কাতর হৃদি ছটফট করে যাচ্ছিল মামীর কাঁধে মাথা এলিয়ে। পল্লবী অবিরাম ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। শাড়ির আঁচলে মুছে দিচ্ছেন ঘামে সিক্ত মুখখানি। ইনায়া ওপাশে বসে। ভাবীর হাত ম্যাসাজ করে দিচ্ছে। দোয়া দরুদ পাঠ করে ফুঁ দিচ্ছে অবিরাম। বেদনায় কঁকিয়ে উঠছে মেয়েটা। দু হাত চেপে বসেছে উদরে। মুখনিঃসৃত হচ্ছে যন্ত্রণা মিশ্রিত ধ্বনি। সামনের সিটে বসে রাহিদ। অনবরত নির্দেশনা দিচ্ছে সাবধানে দ্রুত গতিতে অগ্রসর হবার জন্য। সে মতোই ধেয়ে যাচ্ছে গাড়িটি। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সঙ্গ দিচ্ছে দেহরক্ষীরা। তন্মধ্যে বেজে উঠলো রিংটোন। হাতেই ছিল যান্ত্রিক ডিভাইসটি। ত্বরিত কল রিসিভ করলো রাহিদ। কানে ঠেকলো মোবাইল। ওপাশ হতে নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে চৌধুরী। সে-ও বেরিয়েছে নিজ কর্মস্থল হতে। সরাসরি আসছে হসপিটাল।

বেদনা ক্লি’ষ্ট অন্তঃস্থল। একান্ত পুরুষের সান্নিধ্য লাভের অভিলাষ জেগেছে অন্তরে। দু চোখে বারিধারা। মুখনিঃসৃত যন্ত্রণার বুলি। খুঁজে বেড়াচ্ছে ‘তাকে’। তাকে একপলক দেখার জন্য তৃষ্ণার্ত চক্ষু জোড়া। মন কাননে ভেসে উঠছে তার নাম… ‘ইরহাম।’ অসহনীয় ব্যথায় চিড়চিড় করছে দেহের নিম্ন ভাগ। বুঁজে গিয়েছে অক্ষিপুট। এই বুঝি ঘনিয়ে এলো মৃ-ত্যু প্রহর। চিরতরে বন্ধ হবে আঁখিপল্লব। চেতনা অচেতনের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছিল হৃদি। ভয় হচ্ছিল। স্মরণ করে যাচ্ছিল রব’কে।

” আল্লাহ্! রক্ষা করো। ”

সহসা এক পশলা প্রশান্তি আগলে নিলো তাকে। অদৃশ্য ভরসাস্থলে হারালো মন। যাতনায় বিকৃত অধরকোণ ঈষৎ প্রসারিত হলো। কর্ণে ঠেকে যান্ত্রিক ডিভাইসটি। ধরে পল্লবী। ওপাশ হতে শ্রবণপথে পৌঁছাচ্ছে সে-ই প্রিয় কণ্ঠস্বর,

” জানি তুমি পারবে আমরা হৃদহরণী। আল্লাহ্ ভরসা। ”

বেদনাবিধুর মুখখানিতে উজ্জ্বলতা দেখা দিলো। থমকে গেল ক্রন্দন। অস্ফুট স্বরে ডেকে উঠলো সে,

” ই-রহাম! ”

.

” কনগ্রাচুলেশন মিস্টার চৌধুরী। ইয়্যু আর ব্লেসড্ উইথ টুইনস্। এক ছেলে ও এক মেয়ের বাবা হয়েছেন। ”

চিকিৎসকের মুখনিঃসৃত সুসংবাদ তড়িৎ বেগে পৌঁছালো কর্ণ গহ্বরে। অফুরন্ত খুশির উজ্জ্বল আভা ছড়িয়ে পড়লো মুখজুড়ে। সারা জাহানের মালিকের প্রতি শুকরিয়া আদায় করলো ইরহাম। অনুভব করলো দু ফোঁটা নোনাজল অক্ষিকোল গড়িয়ে পড়তে উদগ্রীব। ছটফট করে চলেছে অক্ষিকোণে। বাবা হয়েছে সে। প্রথমবারের মতো পিতৃত্বের স্বাদ গ্রহণ করেছে। সে আর হৃদরাণী একা নয়‌। এসেছে তাদের ভালোবাসার দু’টো অংশ। তাদের সন্তান। অবর্ণনীয় খুশিটুকু কোন পন্থায় প্রকাশ করবে জানা নেই এই সৌম্যরূপী মানুষটির। পাশেই অশ্রুসজল উজ্জ্বল মুখে দাঁড়িয়ে দুই পরিবারের সদস্যরা। খুশির ফোয়ারা সিক্ত করে দিচ্ছে তাদের। কিয়ৎক্ষণ সময় নিলো। অন্তরে বহমান চঞ্চলতা সামাল দিয়ে শুকনো ঢোক গিললো ইরহাম। চিকিৎসককে শুধালো,

” আমার স্ত্রী? সে ভালো আছে তো? ”

পরিবর্তিত হলো মুখভঙ্গি। চিকিৎসক বলতে লাগলেন,

” দেখুন মিস্টার চৌধুরী। আপনার ওয়াইফ প্রি ম্যাচিউর দুই সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। এর ওপর সি সেকশন হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই উনি খুব উইক। মিসেস চৌধুরীকে আপাতত অবজারভেশনে রাখা রয়েছে। জ্ঞান ফিরলে দেখা করতে পারবেন। ”

ফারহানার চোখে জল। নির্দ্বিধায় গড়িয়ে পড়ছে দু গাল বেয়ে। বাকিরাও হতাশ। মনে জমলো কালো মেঘের আস্তরন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে রাহিদ উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললো,

” ডক্টর আমরা কি বেবিদের দেখতে পারি? ওদের কখন কোলে নেবো? ”

চিকিৎসক বুঝিয়ে বললেন,

” ওরা দু’জন প্রিটার্ম বেবি। নির্ধারিত সময়ের বেশ আগেই জন্মগ্রহণ করেছে। ওদের শারীরিক অবস্থা এখনো স্থিতিশীল নয়। নাজুক। নিবিড় পরিচর্যার জন্য বেবি দু’টোকে এনআইসিইউ’তে রাখা হয়েছে। এখুনি কোলে নেয়া, আদর করা এগুলো সম্ভব নয়। ওদের শারীরিক অবস্থার উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত ওরা এনআইসিইউ’তে থাকবে। শুধুমাত্র প্রয়োজনের সময় মায়ের কাছে যাবে। আশা করি বুঝতে পেরেছেন? বেবি দু’টো খুবই উইক। ওদের ওয়েট, নিউট্রিশন রেট সব লো। কিছু ফিজিক্যাল প্রবলেম দেখা দিয়েছে। আশা করছি সময়ের সাথে সাথে ইনশাআল্লাহ্ সব ঠিক হয়ে যাবে। ”

অপ্রত্যাশিত ভাবে আগমন এ সুখবরের। তবে একাকী আসেনি সে। সঙ্গে নিয়ে এসেছে নতুন দুঃসংবাদ। ভালো নেই ওদের সন্তান। কষ্টে রয়েছে তারা। জন্মের পর পিতা-মাতার কোল নয়। ওদের ঠাঁই হয়েছে এনআইসিইউ। ইরহামের অন্তরে ধ্বনিত হলো,

‘ ইয়া আল্লাহ্! আমাকে আরো ধৈর্য ধারণ করার তাওফীক দান করো। আমার স্ত্রী ও দুই সন্তানকে সুস্থ রেখো। ভালো রেখো। রক্ষা করো ওদের। আমিন। ‘

রাজধানী ঢাকার একাংশে তখন জন্মগ্রহণ করেছে দু’টো নতুন প্রাণ। সুখ ও দুঃখের মিশ্রণে তাদের আগমন। অন্যদিকে রাতের গভীরতায় রাজধানীর আরেক অংশে চলছে ভিন্নতর দৃশ্য।

ঘড়ির কাঁটা নির্দেশ করছে তখন রাত দু’টোর ঘর পাড় হয়েছে। নিজ কক্ষে গভীর নিদ্রায় তলিয়ে আজগর সাহেব। ঘুমের ঘোরে স্বাস্থ্যবান দেহটি হালকাপাতলা নড়েচড়ে উঠছে। পা দু’টো দৃঢ় রূপে চেপে বসছে বিছানায়। দু হাত আঁকড়ে ধরতে চাইছে কোনো অদৃশ্য সম্বল। বন্ধ চোখের পাতায় ছটফট করছে কৃষ্ণবর্ণ নয়নমণি। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে শুয়েও ঘামে ভিজে যাচ্ছে দেহ। অনবরত দু পা ও হাত ঘর্ষণ করে চলেছে বিছানা চাদরের আবরণে। হঠাৎই এক তীব্র ঝাঁকুনি। চকিতে নিদ্রা হতে ছিটকে বেরিয়ে এলো লোকটি। উঠে বসলো বিছানায়। ঘন ঘন শ্বাস পড়ছে তার। ঘামে ভেজা মুখ হা হয়ে খোলা। সেথা হতে হচ্ছে শ্বাস প্রশ্বাসের অস্বাভাবিক চলাচল। আজগর সাহেবের ভীত নয়ন জোড়া স্থির। এদিক ওদিক নাড়াতে ব্যর্থ। অব্যক্ত ভয় জেঁকে বসেছে অন্তরে। রয়েছে। কেউ রয়েছে পাশেই। ডানে নাকি বামে? কোন পাশে দাঁড়িয়ে হাতছানি দিয়ে ডাকছে! অনবরত শুকনো ঢোক গিলে যাচ্ছে লোকটা। পানির পিপাসায় গণ্ডস্থল মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। কেঁপে কেঁপে উঠছে হাতের আঙ্গুল। তবে অসাড়ের ন্যায় অনুভূতি জাপটে ধরে। নড়াতে ব্যর্থ হাত-পা। আঙ্গুল। সহসা এক দমকা হাওয়া আঘাত করে গেল কানে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে ডানে ঘুরে গেল মুখ। এক লহমায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো মুখশ্রীতে। ওই। ওই তো দাঁড়িয়ে সে। বিশালাকৃতির এক অবয়ব। হিং স্র চাহনিতে তাকিয়ে তার পানে। দু চোখ দিয়েই চেপে ধরছে। ধাওয়া করছে হিমশীতল হাওয়া। দুর্বল করে তুলছে সকল ইন্দ্রিয়।

ইন্দ্রিয় দুর্বলতার চাপে পিষ্ট আজগর সাহেব। ঘামে ভেজা মুখখানা ভয়ে র’ক্তিম রূপ ধারণ করেছে। মুখ হা করে ঘন ঘন শ্বাস ফেলছেন উনি। দু হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে তাড়াতে চাইছেন ওই হিং স্র অবয়বকে। তবে সে অবয়ব নড়লো না একচুল। বরং শ্লথ পায়ে এগিয়ে আসছে ওনার পানে। সে কি বীভৎস-বিকট আকৃতি! একঝলকের দর্শনে হৃৎপিণ্ড ছিটকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। ভয়ে-আতঙ্কে আজগর সাহেব চিৎকার করে চলেছেন। হাত-পা ছুঁড়ে ওটাকে দূর হতে বলছেন। যন্ত্রণায়-পীড়নে ছটফট করছেন। নীলাভ হয়ে আসছে মুখ। বয়স্ক লোকটার তীব্র আর্তনাদ ঘরের মধ্যেই বদ্ধ রইলো। শব্দনিরোধক ঘর হতে বেরোতে পারলো না সেই আতঙ্কিত আর্তনাদ। যন্ত্রণায় মাথার চুল খামচে ধরছেন উনি। চিৎকার করে ভয় হতে মুক্তি চাইছেন। ওই হিং-স্রতা হতে পরিত্রাণ চাইছেন। তবে মিললো না কিছুই। শুধুই ভীতি আর ভীতি। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসেও ঘামে জবজবে শরীর। আকুতিমিনতি করে যাচ্ছেন আজগর সাহেব। তেমনই যন্ত্রণাদায়ক মুহুর্তে এই বদ্ধ ঘরের বাহির হতে সরে গেল এক মানবছায়া।

আঁধারিয়া রজনী। ছিমছাম গোছানো কেবিনটি। বিছানায় শায়িত হৃদি। ওর বাঁ পাশেই টুলে বসে একান্ত পুরুষ। শক্তপোক্ত হাতের মুঠোয় বন্দী কোমল হাত। মানুষটি স্থির চাহনিতে তাকিয়ে ঘুমন্ত স্ত্রীর পানে। তার সন্তানদের মায়ের পানে। ‘মা’! কতটা অর্থপূর্ণ-মমতাময়ী শব্দ। সারা দুনিয়ায় সকল জীবের সর্বপ্রথম ভরসার স্থল, ভালোবাসার উৎস এই ‘মা’। মা ছাড়া অন্ধকার জগৎ সংসার। যেমন অন্ধকার হয়েছে তাদের সংসার। মা বিহীন তমসাচ্ছন্ন তাদের হাসিখুশি সোনার সংসার। ইরহামের হৃদি আজ মা হয়েছে। প্রথমবারের মতো মাতৃত্বের স্বাদ লাভ করেছে। এ দিনটি নিয়ে মা কতটা আগ্রহী ছিল। উৎসুক ছিল। মা-বাবা দু’জনেই এই দিনটি নিয়ে অনেক পরিকল্পনা করে ফেলেছিল। অবর্ণনীয় এক্সাইটেড ছিল তারা। অথচ আজ? মা নেই। দেখে যেতে পারলো না নাতি নাতনিদের। যাদের রক্ষা করতে প্রাণত্যাগ করলো তারা আজ সুষ্ঠুভাবে এসেছে দুনিয়ায়। কিন্তু অসুস্থ। নিবিড় পরিচর্যা চলছে ওই প্লাস্টিকের ঘেরাটোপে। এখনো বাবার কোলে আসার সুযোগ মেলেনি। মায়ের সান্নিধ্য মেলেনি। কেমন নির্দয় রূপে তাদের আগমন! ইরহাম বেদনাময় হাসলো। উঠে দাঁড়ালো আস্তে করে। তবে হাতটি ছাড়লো না। এখনো পুরুষালি হাতের মুঠোয় বন্দী কোমল হাত। ইরহাম আস্তে ধীরে ঝুঁকে গেল তার জীবনসঙ্গীর পানে। ঘুমন্ত অর্ধাঙ্গীর ললাটে প্রগাঢ় চুম্বন এঁকে ফিসফিসিয়ে আওড়ালো,

” জাঝাকিল্লাহু খায়রান বাবুর আম্মু। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠো। তোমার অপেক্ষায় দিন গুনছি আমরা। ”

স্বাভাবিক সময়ের বেশ পূর্বে জন্মগ্রহণ করা শিশু, যাদের শারীরিক ত্রুটি ও দুর্বলতা রয়েছে, তাদের পরিচর্যা করার জন্য এই এনআইসিইউ। বিশেষ এ কক্ষে ঘুমন্ত বেশ কিছু শিশু। ইনকিউবেটরে ঘুমন্ত তারা। ইনকিউবেটর হলো পরিষ্কার, শক্ত প্লাস্টিকের দ্বারা ঘেরা ছোট বিছানা। এ ইনকিউবেটরের দেহে কয়েকটি মাঝারি আকারের গর্ত। চিকিৎসক, নার্স এবং অন্যান্য পরিচর্যাকারীরা ইনকিউবেটরের দেহে অবস্থিত এই গর্তের মাধ্যমে শিশুদের যত্ন নেন। ক্ষুদ্রাকৃতির বেশকিছু ইনকিউবেটরে ঘুমিয়ে নবজাতক শিশুরা। ছোট্ট ছোট্ট শরীরে চিকিৎসা সহায়ক যন্ত্র চেপে বসে। নবজাতক, নিষ্পাপ শিশুদের এমন যান্ত্রিক সান্নিধ্যে দেখে হুঁ হুঁ করে উঠলো অন্তর। কোমল মাতৃহৃদয় কেঁদে উঠলো নিজ আত্মজ-আত্মজাকে দেখে। ওই তো কয়েক হাত দূরত্বে পাশাপাশি দু’টো ইনকিউবেটরে শায়িত ওরা। চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্র লেপ্টে ছোট্ট দেহে। ঘুমোচ্ছে ওরা। একটুখানি স্বস্তির ঘুম। দুনিয়ায় আসার পূর্বে কম তো সংগ্রাম করেনি। কত কি সয়েছে ওরা। অবশেষে আল্লাহ্’র রহমতে দেখেছে দুনিয়ার আলো। নিজ সন্তানের এই দুরবস্থা কোনো মা ই সহ্য করতে পারে না। হৃদিও পারছিল না। হাসপাতালের পোশাক পরিহিতা মেয়েটি স্বামীর বুকে মুখ লুকিয়ে কেঁদে উঠলো। দু হাতে আঁকড়ে ধরলো স্বামীর প্রশস্ত পিঠ। সযতনে ওকে নিজের সনে আগলে নিলো ইরহাম। স্ত্রীর চুলের ভাঁজে ক্ষুদ্র পরশ বুলিয়ে দিলো। তাকালো নিদ্রায় মগ্ন সন্তানদের পানে। চোখে জমলো বাষ্প। জ্ব’লন হচ্ছে অন্তরে। কোনো বাবা-মা’কে তাদের নবজাতক সন্তানকে এই করুণ অবস্থায় দেখতে না হোক। সুস্থ সবল রূপে দুনিয়ায় আসুক সকল সন্তান।

অতিবাহিত হয়েছে বেশ কিছু দিন। নাতিশীতোষ্ণ এক সকাল। বিশালাকৃতির আকর্ষণীয় টেবিলে সাজানো হরেক রকমের খাবার। টেবিলের সম্মুখ ভাগে একটি বড় চেয়ার। সেথায় রাজকীয় ভঙ্গিতে বসে আজগর সাহেব। শুকনো মুখশ্রী। চোখের নিচে কালচে ভাব। গত রজনীও কেটেছে নিদ্রাহীন। ক্লান্ত লাগছে শরীর। ঘুম চেপে বসেছে দু চোখে। তবুও কোনোমতে প্রাতরাশ নিচ্ছে সেরে। খাবারে অরুচি ঠেকছে। হচ্ছে বমি বমি ভাব। হাত বাড়িয়ে গ্লাস নিলেন। পানি পান করতে মুখে ঠেকালেন গ্লাস তখনই বেজে উঠলো কলিংবেল। ব্যাঘাত ঘটলো পানি পানে। বিরক্তিতে বিকৃত হলো মুখভঙ্গি। বাম পাশে দাঁড়ানো এক গৃহ পরিচারককে ইশারায় দ্বার উন্মুক্ত করতে বললেন। ইতিবাচক মাথা নেড়ে দরজার পানে অগ্রসর হলো সে গৃহ পরিচারক। নিঃশব্দে উন্মুক্ত হলো সদর দরজা। চমকালো আগন্তুকদের দেখে!

” কে আপনারা? ”

” দুদক! ”

বজ্রপাত হলো আভিজাত্যে ভরপুর সে গৃহে। দুদক এসেছে বাড়ি!

চলবে.

#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৩৫ [ শেষাংশ ]

নতুন এক দিনের সূচনায় চরম আশ্চর্যান্বিত আজগর সাহেব! সম্মুখে দাঁড়িয়ে একদল সৎ ব্যক্তি। যাদের চাহনিতে লুকিয়ে অপরাধ দমনের তীব্র স্পৃহা। পেশাগত জীবনে তারা বেশ ক্ষমতাশালী। হাজার কোটি টাকার মালিককে এক লহমায় ফকির বানিয়ে দেবার ক্ষমতা রাখেন। আজ এই ভ’য়ঙ্কর মানুষগুলো ওনার দোরগোড়ায় কি করছে? কেন এসেছে এখানে? আবার কোন দুঃসংবাদ! বড় করে শ্বাস ফেললেন আজগর সাহেব। পুনরায় নিশ্চিত হতে কম্পিত কণ্ঠে শুধোলেন,

” কে? কে আপনারা? ”

” দুর্নীতি দমন কমিশন। সংক্ষেপে দুদক। আশা করি এবার চিনতে পেরেছেন মিস্টার আজগর? নাকি আরো ডিটেইলসে বলতে হবে? আইডি কার্ড দেখাবো? ”

দুদক থেকে প্রেরণ করা হয়েছে এদের। বিষয়টি শ্রবণ পথে নৃ;শংসভাবে কাঁটা বি দ্ধ করে যাচ্ছিল। উচ্চ র ক্তচাপ আবার তাকে কুপোকাত করতে উদ্যত হয়েছে। প্যান্টের পকেট হতে রুমাল বের করলেন আজগর সাহেব। দ্রুত অথচ কম্পিত হাতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বেদবিন্দু মুছতে লাগলেন। বক্র হাসির রেখা ফুটে উঠলো সম্মুখে উপস্থিত বাহিনীর দলনেতার অধরকোণে।

” এখনই এত ভয় পাচ্ছেন? সবে তো শুরু। ”

” ক্ কিহ্? ”

মন গহীনে উঁকি দেয়া ভয়টি অতঃপর সত্য হলো। মিললো না একবিন্দুও ছাড়। কোনোভাবেই ক্ষমতার ব্যবহার করতে পারলেন না আজগর সাহেব। ওনার চোখের সামনেই সব শেষ হয়ে গেল। ধপ করে বসে পড়লেন সোফার কোলে। ধূসর মেঘ রাঙিয়ে দিলো মুখখানা। নকল দেয়ালে অবিরাম আঘাত করে চলেছে স্লেজ হ্যামার। স্বল্প সময়ের মধ্যেই গুড়িয়ে গেল নকল দেয়ালটি। অতি নি-ষ্ঠুর পন্থায় বাড়ির স্টোর রুমের এই মিথ্যে দেয়াল ভাঙ্গা হলো। বেরিয়ে এলো অজস্র বান্ডিল টাকা। অব্যবহৃত পুরনো ওয়াশরুমের কমোডের ফ্লাশ ভেঙ্গে কয়েক টুকরো হলো। সেখানেও টাকা। বাড়ির বাগানে মাটির তল, স্টোররুম, এসির ফাঁকা অংশ, পুরনো আসবাবপত্র কোথায় নেই টাকা? খন্দকার আজগর মল্লিকের নিজ বাসভবন হতেই প্রায় চল্লিশ কোটি টাকা উদ্ধার করা হলো। কালো টাকা। আজ এ মুহূর্তে শুধুমাত্র নিজ বাসভবন হতেই নয়। তার অন্যান্য ডেরা, বাংলো হতে আরো টাকা উদ্ধার করা হলো। তন্মধ্যে রয়েছে জনগণকে ঠকিয়ে বিভিন্ন সময় আ;ত্মসাৎকৃত টাকা। আজগর সাহেবের কাছ থেকে দীর্ঘ পাঁচ ঘন্টার অভিযান শেষে মোট ১৪০ কোটি টাকা উদ্ধার করা হলো। সেসবের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আ;ত্মসাৎকৃত অর্থ, কালো টাকা, অনৈতিক উপায়ে উপার্জনকৃত টাকা প্রভৃতি। এক লহমায় ওনার সমস্ত জারিজুরি ফাঁ স হয়ে গেল। ওনার সব কয়টি মোবাইল তখন দুদকের কব্জায়। বিন্দুতুল্য সাহায্য মিললো না বাহির হতে। চোখের সামনে দেখলেন নিজের বিনাশ।

” ইয়্যু আর আন্ডার অ্যারেস্ট খন্দকার আজগর মল্লিক। বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করার অভিযোগে আপনাকে গ্ৰেফতার করা হচ্ছে। চলুন আমাদের সঙ্গে। ”

গ্ৰেফতারি পরোয়ানা! চোখের সামনে আঁধার ঘনিয়ে এলো। আরম্ভ বিনাশের সূচনা! আসন্ন পরিস্থিতি অনুধাবন করতেই বুকে ব্যথা আরম্ভ হলো। হৃৎপিণ্ড বরাবর হাত চেপে কাতরাতে লাগলেন আজগর সাহেব। দুদক কতৃপক্ষের এক অফিসার তীক্ষ্ণ চাহনিতে তাকিয়ে। এগিয়ে গেল। বুকের ওপরে থাকা হাতটা হিচড়ে সরিয়ে ফেললো। দাঁড় করালো তাকে। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

” অভিনয় অনেক তো করলেন। এবার ভদ্রলোকের মতো চলুন আমাদের সঙ্গে। চলুন। ”

শেষোক্ত শব্দে কাঠিন্যতা প্রকাশ পেল। দেশটির সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীকে কিঞ্চিৎ পরিমাণ সহানুভূতি দেখাতে নারাজ দুদক। দিনেদুপুরে দুর্নীতি ও মানি লন্ডারিং এর অভিযোগে গ্রেফতার হলো সাবেক মন্ত্রী আজগর সাহেব।
_

বিগত সরকারের যোগাযোগমন্ত্রী ছিলেন খন্দকার আজগর মল্লিক। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হাজার হাজার যোগাযোগ টাওয়ার নির্মাণ করার সংকল্পে অর্থ নিয়েছিল ওনার মন্ত্রনালয়। সে অর্থ উনি ও অধীনস্থ সহচররা আত্মসাৎ করেছে। অধিকাংশ যোগাযোগ টাওয়ার আজও নির্মাণ করা হয়নি। কোথাও কোথাও কম দামী, বাজে জিনিসপত্র ব্যবহার করে নিম্ন মানের টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছিল সেসময়ে। দুর্নীতি আইন লঙ্ঘন করা ছাড়াও ওনার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং এর অভিযোগ রয়েছে। বিপুল পরিমাণ অর্থ উনি দেশের বাইরে পা চা র করেছেন। ভিন্ন ভিন্ন দুই অভিযোগে ওনার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে ‘দুর্নীতি দমন কমিশন’। সে প্রেক্ষিতেই আজ গ্রেফতার করা হলো। অসুস্থতার অভিনয় করেও মিললো না মুক্তি। সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ওনার উকিল।

.

‘ আনন্দাঙ্গন ‘ আর আগের মতো নেই। বদলেছে রূপ। পরিবর্তিত হয়েছে পরিবেশ। বাড়ির প্রাঙ্গনে চারদিকে নির্মাণ করা হয়েছে সুউচ্চ দেয়াল। দেয়ালের ওপর কাঁটাতারের বেড়া এবং তড়িৎ সংযোগ। দেয়াল টপকে কেউ অন্দরমহলে প্রবেশ করার চিন্তায় আছে? সে চিন্তা বদলে ফেলুক এখুনি। দেয়ালের উপরিভাগে ওঠা মাত্রই ধারালো কাঁটাতারের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হবে পায়ের নিম্নতল। অধিক শক্তিশালী তড়িৎ দেহে ঝটকা দেবে কয়েকবার। সে মুহূর্তে অচেতন হয়ে দেয়াল টপকে মাটিতে পড়তে বাধ্য হবে সে-ই অযাচিত আগন্তুক। এছাড়াও বাড়ির বাইরে নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত রয়েছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দেহরক্ষীরা। তাদের সকলকে শহরের নামকরা সিকিউরিটি এজেন্সি হতে হায়ার করা হয়েছে। সকলের হাতেই আগ্নেয়া-স্ত্র। সুতীক্ষ্ণ চাহনি ঘুরে বেড়াচ্ছে আশপাশে। ‘ আনন্দাঙ্গন ‘ এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দায়িত্বরত তারা ক’জন।

আনন্দাঙ্গনে আজ বসেছে আনন্দমেলা। প্রথমবারের মতো গৃহে প্রবেশ করেছে নতুন অতিথিদ্বয়। প্রায় একমাস শ্বাসকষ্ট ও হৃৎপিণ্ডজনিত সমস্যার জন্য চিকিৎসাধীন ছিল নবাগত-নবাগতা দুই অতিথি। আজ সুস্থ সবল দেহে বাড়ি ফিরেছে তারা। ঘুমন্ত ছেলে বাবুটি মায়ের উষ্ণ ওম পেয়ে ঘুমিয়ে। মেয়ে বাবুটি বাবার বুকে মাথা এলিয়ে নিদ্রায় শায়িত। হৃদির হাত ধরে ভেতরে প্রবেশ করলো রাঈশা। স্বামী স্ত্রীর অধরকোলে ফুটে উঠলো হাসির রেখা। একত্রে হাসিমুখে লিভিংরুমে দাঁড়িয়ে পরিবারের সদস্যরা। নীতি, নিদিশা, রায়না ছুটে এলো ওদের পানে।

” ভাবী আসসালামু আলাইকুম। ওয়েলকাম ব্যাক। ”

রাঈশা সরে দাঁড়াতেই ভাবীকে আহ্লাদী একপেশে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে নিলো রায়না। হৃদি হাসলো। মায়াবী সে হাসি। কতদিন পর অধরকোণ প্রসারিত হলো। সকলে বিমোহিত হলো সে হাস্য আভায়। নীতি ও নিদিশা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। ইতিমধ্যে তাদের গম্ভীর জিজু’কে সালাম দেয়া হয়ে গেছে। দু’জনেই দ্বিধান্বিত চাহনিতে বাবুদের পানে তাকিয়ে। একবার ছেলে বাবু তো একবার মেয়ে বাবু। একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে ওরা। রাঈশা ভ্রু কুঁচকে শুধালো,

” দরজার সামনে সঙ হয়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আমাদের ভেতরে যেতে দে। ”

” আরে যাবে তো। আমরা একটু বাবুদের কোলে নিই। এরপর তোমরা আরামসে আসো। ”

নিদিশা ভালো বুদ্ধি দিল। কিন্তু ওর বুদ্ধিমত্তায় ঠিক প্রসন্ন হতে পারলো না রাঈশা। নীতি দুঃখ ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,

” কিন্তু কোলে নেবোটা কাকে? দু’জনেই ঘুমাচ্ছে। এত কিউটিপাই হয়েছে না দু’টো! ঘুম ভাঙাতে ইচ্ছেই করছে না। এবার কি করি? বল তো হৃদু। ”

নাজরিন মেয়ে দু’টোকে সামনে থেকে সরিয়ে দিলেন। ইরহাম ও হৃদি’কে ভেতরে আসার পথ করে বললেন,

” তোমরা ভেতরে আসো। এ দুটোর কথায় কান দিয়ো না তো। দুটোই খুশিতে পা-গল হয়েছে। ”

নিদিশা তৎক্ষণাৎ শুধরে দিলো,

” আম্মু কারেকশন। পা’গল না পা’গলী হবে। আমাদের জেন্ডার বদলে দিচ্ছো কেন? ”

নিদিশা’র কথায় সেভাবে কেউ হাসতে পারলো না। এ বাড়ির লিভিংরুম হতে আজো দূরীভূত হয়নি শোকাচ্ছন্ন আভা। কি করে মনখুলে হাসবে তারা?

হৃদি বোনের পানে চেয়ে আলতো হাসি উপহার দিলো। ভেতরে প্রবেশ করলো মিস্টার ও মিসেস চৌধুরী। একত্রে পদচারণা তাদের। পাশাপাশি দু’জনে বসলো সোফায়। কোলে এখনো নিদ্রামগ্ন দুই সন্তান। পল্লবী ও ফারহানা এগিয়ে এলেন।

” কই? দেখি আমার নানুদের। ”

ফারহানা মেয়ের কোল থেকে আলতো করে নাতিকে কোলে নিলেন। লহমায় শিহরিত হলো তনুমন। ওনার ছোট মেয়ের আত্মজ এ। সে প্রথমবারের মতো অনুভূতি হলো। বড় কন্যা রাঈশার মেয়েকে কোলে নেয়ার মতো। নানা – নানু হবার আনন্দে এত সুখানুভূতি মিশিয়ে দিয়েছে আল্লাহ্! অবর্ণনীয়। ফারহানা ছলছল চোখে ঘুমন্ত নাতীর পানে তাকিয়ে। স্নেহময়ী চুম্বন এঁকে দিলেন ছোট্ট ওই কপালে। ঘুমন্ত শিশুটি ঈষৎ নড়ে উঠলো। পুনরায় তলিয়ে গেল নিদ্রায়। পল্লবী অশ্রুভেজা হাসলেন। ভাগ্নের কোল হতে নিলেন নাতনিকে। আনমনে নতুন বাবা সাবধানী স্বরে বলে উঠলো,

” আস্তে। ”

হালকা হাস্যোজ্জ্বল ভাব ছড়িয়ে পড়লো ঘরজুড়ে। প্রথমবারের মতো পিতৃত্বের স্বাদ কিনা। প্রথম প্রথম এমন চিন্তা, ছটফটানি হয়। ছেলেমেয়ের জন্য মন বড় পু’ড়ে। স্বাভাবিক। এজাজ সাহেব ভেজা চোখে ছেলের পানে তাকিয়ে। ওনার সে-ই গম্ভীর একরোখা ছেলেটা আজ বাবা হয়েছে। দুই সন্তানের জনক! আহ্! দাদা হবার এক চমৎকার অনুভূতি মনেপ্রাণে ছড়িয়ে পড়লো। মন কাননে ভেসে উঠলো মরহুমা স্ত্রীর মুচকি হাসি মাখা মুখশ্রী। মনে মনে অভিমান পুষে আওড়ালেন,

‘ এত আনন্দ, সুখানুভূতি তুমি দেখে যেতে পারলে না মালিহা! এভাবে চুপিসারে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলে? ‘

মন গহীনের কোথায় যেন চিরন্তন সত্য রূপে সুরের মূর্ছনায় ভেসে আসছে,

‘ আলেয়ার পিছে, ছুটে মিছেমিছে
বুঝিনি তো আলোর ভাষা ও..
আজকে তোমাকে হারিয়ে বুঝেছি
কাকে বলে ভালোবাসা।
আঁধারে খোঁজে মন, আলোকে সারাক্ষণ।
মেলে না, ওহোহো মেলে না। ‘
[ সিনেমা ~ সাত পাকে বাঁধা ]

এটাই চিরসত্য। আলেয়ার পিছে মিথ্যামিথ্যা ছুটতে ছুটতে আলোর ভাষাটা কখনো বোঝা হয়নি। আজ সে আলোকে হারিয়ে বোধগম্য হলো তার প্রকৃত মর্ম। হতভাগা কপাল। সময় থাকতে কেন বুঝলো না প্রকৃত মর্ম! তাহলে তো আরেকটু বেশি সুখমিশ্রিত প্রহর কাটানো যেতো। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন এজাজ সাহেব। তাকালেন সকলের পানে। শোকাচ্ছন্ন বাড়িতে আজ ফিরেছে খুশির বহর। আল্লাহ্ তা’য়ালা এই খুশি, এই সুখ সদা অটুট রাখুক। সে প্রার্থনাই মনে মনে করলেন।

ভাই বোনেরা ঘিরে দাঁড়িয়ে ফারহানা, পল্লবীকে। ওনাদের কোলে ঘুমন্ত দুই পুঁচকে। সকলকে পাশ কাটিয়ে এক নিরালায় ফোনালাপে লিপ্ত ইরহাম। ওপাশ হতে শ্রবণ হলো,

” আজগর মল্লিক গ্রেফতার হয়েছে ভাই। ”

বক্র হাসির রেখা শোভা পাচ্ছে অধরকোণে। উদ্যমী স্বরে জানান দিলো চৌধুরী,

” ওয়েটিং ফর দ্য সেকেন্ড এক্সপ্লোশন। ”

তারা দ্বিতীয় বি-স্ফোরণের অপেক্ষায়। ব্যাং ব্যাং….!

দেশের মাটিতে গ্রেফতার হয়েছে পিতা। সে সংবাদ পাওয়া মাত্র গোয়ার বুকে ভ’য়াবহ হু’ঙ্কার ছাড়লো রুদ্রনীল। বিগত কতগুলো দিন তার জন্য এমনিতেই অসহ্যকর ছিল। ঘরের শত্রু বিভীষণের জন্য পরপর দু’টো বড় ডিল হাতছাড়া হয়েছে। লোকসান গুনতে হয়েছে প্রায় ষাট কোটি টাকার। বিভীষণকে চিহ্নিত করা মাত্রই তাকে পরপারের রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছে সে। রুদ্রনীল একবার, সর্বোচ্চ দু’বার তোমায় শুধরে যাওয়ার সুযোগ দেবে। কিন্তু তৃতীয়বারের বেলায় সোজা ওপরের টিকিট। নৃ-শংসতার সহিত অভ্যন্তরীণ শত্রুকে হ ত্যা করলো সে। লা শে র ছোট্ট ছোট্ট টুকরো ভাসিয়ে দিলো সমুদ্রের বুকে। অতল গহ্বরে তলিয়ে গেল টুকরো গুলো। জলজ প্রাণী গিলে নিলো খাদ্য ভেবে। সে কি ভ’য়াবহতা!

আজগর মল্লিক শুধুমাত্র দুর্নীতি নয়। ফেঁসেছে শ্লী-লতাহানির অভিযোগেও। বুড়ো বাপের এই ছুঁকছুঁক স্বভাব সম্পর্কে বরাবরই অবগত ছিল রুদ্রনীল। নিজে নারীবিদ্বেষী হলেও পিতাকে কখনো শুধরে যাওয়ার পরামর্শ দেয়নি। বরং সাবধানে মজা লুটে নেয়ার উপদেশ দিয়েছে। আজ কোথায় গেল সে-ই উপদেশের মর্ম? বুড়ো বয়সে কচি কচি দু’টো মেয়ের অভিযোগের ভিত্তিতে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হলো। তন্মধ্যে একটা মেয়ে বেশ অভিজাত পরিবারের সন্তান। বাবা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। সে-ই সঙ্গে সমাজসেবক। তার মেয়েকে কিনা শ্লী-লতাহানি করা! জোরালো কেস ঠুকে দিয়েছে। এত সহজে মিলবে না ছাড়। এছাড়াও দুর্নীতির অভিযোগ অত্যন্ত শক্তপোক্ত। কঠিন। আপাতত মিলবে না ছাড়।
_

নীলাভ জল আবদ্ধ বিশালাকার এ সুইমিং পুলে। স্বচ্ছ পানির বুকে দুর্ধর্ষ গতিতে সাঁতরে যাচ্ছে বলিষ্ঠদেহী পুরুষটি। দেহের উর্ধাংশ অনাবৃত। নীলাভ জল আলতো করে ছুঁয়ে যাচ্ছে দেহ। জমায়েত হচ্ছে গলদেশ, ঘাড়ে। হাত-পায়ের চমৎকার কারুকার্যে পানির বুক চিরে এগিয়ে যাচ্ছে মানুষটি। দীর্ঘকায় দেহের দাপটে উল্লম্ফন করছিল জলধারা। অগণ্য সময় পুলের স্বচ্ছ-শীতল গভীরতায় অতিবাহিত করলো রুদ্রনীল। ঠাণ্ডা হলো মন ও মস্তিষ্ক। সাঁতরে পুলের কিনারায় এলো সে। হেলান দিয়ে দাঁড়ালো পুলের দেয়ালে। দীর্ঘক্ষণ সাঁতার কাটার ফলে ঘন শ্বাস পড়ছিল। দ্রুত ওঠানামা করছিল লোমহীন বক্ষপট। ভিজে চুল গড়িয়ে টুপ টুপ করে পড়ছে জলকণা। পেছনে অবস্থিত এক নারী পরিচারিকা কম্পিত হাতে যত্নের সহিত তোয়ালে দিয়ে শুষে নিলো প্রতি ফোঁটা জল। রুদ্র হাত বাড়িয়ে তোয়ালে নিলো। সে তোয়ালে জড়িয়ে নিলো গলায়। তর্জনী নাড়িয়ে ইশারা করতেই সে পরিচারিকা দ্রুত পায়ে দৃষ্টি সীমার বাহিরে হারিয়ে গেল। অতঃপর রুদ্রনীল ডান পাশে হাতটি স্বল্প বাড়াতেই এক ভৃত্য তার হাতে তুলে দিলো গ্লাস। গ্লাস হাতে নিলো বলিষ্ঠদেহী নি-ষ্ঠুর পুরুষটি। ঠোঁটে ঠেকলো গ্লাস। রঙিন পানীয়তে চুমুক দিয়ে মেটাতে লাগলো তৃষ্ণা। দু চোখে ভাবনার আনাগোনা।

কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হলো। রঙিন পানীয় তখন নির্দয় পুরুষটির তৃষ্ণা নিবারণে ব্যস্ত। ভিজিয়ে যাচ্ছে গলা। ঠিক সে মুহূর্তে বেজে উঠলো রিংটোন। প্রাইভেট নম্বরে কেউ কল করেছে। যোগাযোগ করতে ইচ্ছুক। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা পি.এ দ্রুত কদম ফেলে এগিয়ে এলো। বসের হাতে তুলে দিলো আইফোনের লেটেস্ট ভার্সন স্মার্টফোনটি। কলার আইডি লক্ষ্য করে কুঁচকালো রুদ্রর দু ভ্রু। বিলম্ব না করে কল রিসিভ করলো সে। পানীয় পান করতে করতে ছোট্ট করে বললো,

” হুঁ বল।‌ ”

ওপাশ হতে লম্বা বিবরণে কোনো সংবাদ জানালো ব্যক্তিটি। সে সংবাদে আস্তে ধীরে পরিবর্তন হতে লাগলো মুখভঙ্গি। কঠোরতা প্রকাশ পাচ্ছে চোখেমুখে। ফুলে ফেঁপে উঠছে শিরা উপশিরা। হাতে বন্দী গ্লাসে জোরদার চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। এই বুঝি গেল ভেঙ্গে। ওপাশ হতে প্রাপ্ত সংবাদ পুরোটা ক্রো ধ সংবরণ করে, ধৈর্য ধরে শুনলো রুদ্রনীল। উত্তপ্ত স্বরে দিলো এক আদেশ। কোনো নতুন ধ্বং-সলীলার। আবার কোথায় কি ঘটতে চলেছে! কোন নয়া লীলা খেলা হবে আরম্ভ!

ইরহাম ও হৃদির পুত্র-কন্যার আজ আকিকা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ধর্মীয় অনুশাসন মান্য করে আকিকা সম্পন্ন হয়েছে। এতদিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল দুই খুদে সদস্য। তাই আকিকা করতে এতখানি বিলম্ব হলো। আকিকা উপলক্ষে দুই পরিবারের সদস্যরা এবং নিকট আত্মীয়রা উপস্থিত হয়েছিল ‘ আনন্দাঙ্গন ‘। বহুদিন বাদে বাড়ির অন্দরে খুশির ঝলকানি দেখা দিলো। নতুন সদস্যদের নামকরণ করা হলো ‘ রিহাম চৌধুরী ‘ এবং ‘মাহিকা চৌধুরী’। রিহাম নামের অর্থ হলো ‘হালকা বৃষ্টি বা ঝিরঝিরি বৃষ্টি’। মাহিকা অর্থ ‘পৃথিবী বা তুষার’। খুদে দুই পুঁচকে সদস্যকে নিয়ে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে রীতিমতো টানাহেঁচড়া আরম্ভ হয়েছে। কে ধরবে আগে। কে নেবে কোলে। কে দেবে চুমু। আরো কত কি। সে এক হুলস্থুল আনন্দঘন পরিবেশ। মালিহা মা বিহীন…

.

তমসাচ্ছন্ন রজনী। নিজ ঘরে বিছানায় বসে ইনায়া। কোলে সযত্নে শায়িত ভাতিজা রিহাম। ছোট ছোট চোখ দু’টো খোলা। একদৃষ্টিতে দেখছে এই সুন্দরী তরুণীকে। মনে করার চেষ্টা করছে বুঝি, এ যেন তার কি হয়! বাবার বোন তো। হ্যাঁ। মনে পড়েছে। ফুপি হয়। এই সুন্দরীটা তার কিউট ফুপি। ইনু ফুপি। রিহাম সোনাটা তার ছোট্ট মুখে পেলব চারটে আঙ্গুল পুরে রেখেছে। ফুপি’কে দেখছে। আলতো করে হাসছে। ইনায়া ব্যস্ত নিজ কর্মে। সে মুহূর্তে ঘরে প্রবেশ করলো রাহিদ। এদিক ওদিক না তাকিয়ে সোজা বসলো বিছানায়। পরক্ষণে মাথা এলিয়ে দিলো স্ত্রীর কাঁধে। কিছু মুহূর্ত বাদে ক্লান্ত স্বরে শুধালো,

” কি করছিস বউ? ”

সে এখনো দেখেনি কি করছে তার ছোট বউ। ইনায়া বিরক্তিকর শব্দ করে লহু স্বরে বললো,

” হুশশ্। চুপ থাকো‌। কাজ করছি তো। ”

রাহিদ নাকমুখ কুঁচকে বললো,

” কোন রাজকার্য করছিস শুনি যে ক্লান্ত বরকে এক গ্লাস পানি দেয়ার সময় নেই? দেখি। ”

মাথা তুলে স্ত্রীর পানে ভালোমতো তাকালো রাহিদ। পুঁচকের দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসলো। চকিতে চমকালো বেশ!

” এসব কি? ”

চলবে.

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে