#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৩১
অন্দরমহলে প্রবেশ করে থমকালো পা। বিচলিত চিত্ত। ধুকপুক ধুকপুক ধ্বনি ঝড় তুলেছে বক্ষপিঞ্জরে। অসীম ভয়ে শুকনো আঁখি যুগল দেখছে অভ্যন্তরীণ হালচাল। লিভিংরুমে কিয়ৎক্ষণ পূর্বে বয়ে গেছে ভ’য়াবহ তুফান। তার চিহ্ন যত্রতত্র স্পষ্টরূপে দৃশ্যমান। সোফাসেটের অবস্থান জায়গা হতে বেশ নড়ে গেছে। কয়েকটি দামী শোপিস, ফ্লাওয়ার ভাস মাটির বুকে যেখানে সেখানে এলিয়ে। ছোপ ছোপ লাল তরল মিশে সাদা মেঝেতে। অনেকগুলো পদচিহ্ন র-ক্তের ছাপের ওপর। অসংখ্যবার ধাওয়াধাওয়ি হয়েছিল যে আন্দাজ করা মুশকিল নয়। র-ক্তলাল ঘরের হাল। একদম হৃদয়বিদীর্ণ করা সে-ই দৃশ্যপট! এই লাল লাল ছাপগুলো মানুষটির অভ্যন্তরীণ ভয় শতগুণ বৃদ্ধি করলো। কোনো ধারালো দন্ত যেন কা’মড়ে ধরলো হৃৎপিণ্ড। পদযুগল ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। নে”শাগ্রস্তের ন্যায় এলোমেলো হাল। মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা তখন পুরোপুরিভাবে নিয়ন্ত্রণের বাহিরে। ইরহামের অর্থহীন চাহনি মন্থর গতিতে একবুক সাহস সঞ্চয় করে বামে তাকালো। সেথায় অনুপস্থিত আপন ও অবিচ্ছেদ্য দুই অংশ। এদিক ওদিক তাকিয়ে চলেছে ইরহাম। খুঁজে বেড়াচ্ছে তাদের। মা ও স্ত্রীকে। জড়ানো কণ্ঠস্বর হতে নিঃসৃত হলো মৃদু ডাক,
” মা! হৃদি! ”
শুনশান নীরব ঘরে সে ধ্বনি বারংবার প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। নিজের শ্রবণপথেই যেন দমকা হাওয়ার ন্যায় আঘাত খেল ফিসফিস ধ্বনি। সদা প্রাণবন্ত বাড়িটি হঠাৎই ভূতুড়ে শুনশান কেন? কোথায় লুকিয়ে আপনজন? কেন তার ডাকে সাড়া দিচ্ছে না? কেন রোজকার মতো দরজা উন্মুক্ত করে দিলো না মা? কেন আজ স্ফীত উদরে হাত স্থাপন করে ঘরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে নেই অর্ধাঙ্গী? কোথায় হারিয়ে সকলে? যত সময় গড়িয়ে যাচ্ছিল ততই বিচলিত হয়ে পড়ছিল মানুষটি। দু চোখে তীব্র আকুলতা। তৃষ্ণার্তের ন্যায় এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিল। স্বরূপ ত্যাগ করে সহসা উচ্চ স্বরে ডেকে উঠলো ইরহাম,
” মা! ”
দেয়ালে দেয়ালে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সে আকুলিবিকুল ডাক,
” মা! মা! ”
সাড়া দিলো না মমতাময়ী মা। হাজির হলো না তার মমতার ভাণ্ডার সমেত। এসেই সেই হৃদয়কাড়া মুচকি হাসিটি উপহার দিলো না। কোথায় চুপটি করে লুকিয়ে মা! আর স্নায়ু যু-দ্ধে লড়াই করা সম্ভব হচ্ছিল না। শরীরের সর্বত্র এক তেজদীপ্ত মনোবল ছড়িয়ে পড়লো। গতিশীল হলো দুই পা। বিলম্ব না করে দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বরাবর ছুটলো ইরহাম। লিভিংরুমের মাঝবরাবর পৌঁছাতেই অকস্মাৎ দু পায়ের গতিবেগ মন্থর হলো। এক দ্রুত গতিসম্পন্ন গাড়ি হঠাৎ ব্রেক কষে দাঁড়ালো যেন। মস্তিষ্কে তখন প্রবল তুলকালাম। ডান পার্শ্বে আবছা আবছা কি দেখলো সে! নজরবন্দী হলো কোন অনাহুত-অপ্রত্যাশিত দৃশ্যপট! তার চক্ষুদ্বয় যে ওই দৃশ্যাবলী দেখতে নিরুৎসুক। মস্তিষ্ক দুর্বল ওই দৃশ্য সহ্য করতে! সে পারবে না ওই ব’র্বর দৃশ্যটি দেখতে। তার হৃদয়ে প্রাণ সঞ্চার রয়েছে। পাথরের ন্যায় কঠিন নয় হৃদয়। কি করে সে তাকাবে ওইদিকে? অন্তর কি সইতে পারবে আগত দৃশ্যটি? পারবে কি করে? কিছু নি-ষ্ঠুর সত্য যে লুকিয়ে সেথায়। তবুও মানব মন তো। আস্তে ধীরে ডান পাশে ঘুরে যাচ্ছে সুঠামদেহী মানুষটি। স্মরণ করে চলেছে সারা জাহানের মালিক’কে। মিথ্যে হোক। অসত্য হোক ওই দৃশ্য। ভুল হোক এই বিপদের মুহুর্ত। পরাজিত হোক অন্যায়। কিন্তু আফশোস! নিয়তির নির্মম-নিষ্ঠুর পরিহাস। ডানে ঘুরে দাঁড়াতেই টলে উঠলো গোটা দেহটি। ছলকে উঠলো র-ক্ত কণিকা। বোধবুদ্ধিহীন মস্তিস্ক। বজ্রপাত হলো অন্তরীক্ষে। কেঁপে উঠলো দুনিয়া। শোঁ শোঁ বাতাস তীব্রতর রূপে প্রবেশ করছে অন্দরে। মানুষটির দু চোখে নেমেছে ঘন আঁধার। মা! তার মা লুটিয়ে মেঝেতে। চারিদিকে লাল র-ক্তের ঘেরাটোপ। র ক্ত আর র ক্ত! মায়ের পরিহিত লাইট পিঙ্ক শাড়িটি বেরঙ। নি-ষ্ঠুর লাল রঙে রঞ্জিত। উদরে সৃষ্ট এক খোলা গহ্বর। পরপর নয়বার এলোপাথাড়িভাবে ছু;রির ক্রু-দ্ধ আঘাত। কাতরেছে। গলাকা”টা মুরগির মতো ছটফট করেছে। নিদারুণ শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠেছে। তার দুচোখে ছিল আকুলতা। বাঁচার আকাঙ্ক্ষা। বারবার নিজেকে শেষরক্ষা করতে চেয়েছে। বাঁচাতে চেয়েছে তার হৃদি মা’কে। শত্রুকে পরাস্ত করতে চেয়েছে। এক রাজনীতিবিদ, সাংসদের তেজস্বী জননী সে। এত সহজে হার মানতে চায়নি। শেষ নিশ্বাস অবধি চলমান ছিল লড়াই। কিন্তু ভাগের নির্মম পরিহাস! শেষরক্ষা হলো না। হঠাৎই এক প্রবল কাঁপুনি। আস্তে ধীরে বন্ধ হয়ে গেল নিশ্বাস। মালাকুল মউত এলো। হলো জান কবজ। বাস্তবায়িত হলো পবিত্র কুরআন মজিদের সে-ই আয়াত,
‘ হে নবী ওদের বলুন, যে মৃ-ত্যু থেকে তোমরা পালাতে চাচ্ছ, তোমাদেরকে সে মৃ-ত্যুর মুখোমুখি হতেই হবে। শেষ পর্যন্ত তোমাদেরকে হাজির করা হবে দৃশ্য ও অদৃশ্যের প:রিজ্ঞাতা আল্লাহর কাছে। জীবদ্দশায় যা করেছ, তা তোমরা তখন পুরোপুরি জানতে ও উপলব্ধি করতে পারবে।’ (সূরা জুমআ, আয়াত ৮)
ইরহাম কতটা সময় রূদ্ধশ্বাসে স্তব্ধ হয়ে ছিল জানা নেই। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে মায়ের খোলা চোখে। মা অমন চোখ মেলে তাকিয়ে কেন! সেই কখন থেকে একভাবে তাকিয়ে। কষ্ট হবে তো। চোখের পলক ফেলছে না কেন? মা! ও মা। ইরহাম কখন যে শ্লথ পায়ে মায়ের নৈকট্যে পৌঁছালো জানলো না নিজেও। ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লো দীর্ঘকায় মানুষটি। হাঁটু ঠেকলো র-ক্তলাল মেঝেতে। লাল র-ক্তে রঙিন হলো তার সাদা পাঞ্জাবি, পাজামার একাংশ। সদা শক্তপোক্ত, কঠোর বলে পরিচিত হাত দুটো অসম্ভব ভাবে কাঁপছে। পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তির ন্যায় অসাড়। নিষ্পলক তাকিয়ে মায়ের খোলা চোখে। মায়ের চোখ দু’টো না অসম্ভব সুন্দর! সাহিত্যের ভাষায় যাকে বলে ‘ হরিণীর মতো চোখ ‘। ছোটবেলায় বালক ইরু মা’কে আস্তে করে ফিসফিসিয়ে কানে কানে বললো,
‘ তোমার চোখটা না সুন্দর! আমাকে দিয়ে দেবে? আমি তোমাকে ক্যান্ডি দেবো। ‘
মা তখন নিঃশব্দে হাসতো। মায়ের হাসিটা নজরকাড়া! মা হাসলে সাথে হাসতো মায়ের দু চোখ। অপূর্ব সৌন্দর্য লুকিয়ে সে হাসিতে! আজ মায়ের সে-ই সৌন্দর্যমণ্ডিত হাসি কোথায় হারিয়ে! কেন শূন্য মায়ের চাহনি! কেন মায়ের মুখজুড়ে নেই মমতার প্রলেপ! কেন নিথর রূপে পড়ে মা!
” আসসালামু আলাইকুম মা। আমি এসে পড়েছি। তোমার ইরু। ”
আস্তে আস্তে ডেকে চলেছে ইরহাম। শূন্য দৃষ্টি স্থির মায়ের মুখপানে। গায়ে হাত দিয়ে ডাকতেও কুণ্ঠাবোধ। পাছে মায়ের ঘুমে ব্যাঘাত না ঘটে। মা ঘুমোচ্ছে। আস্তে আস্তে ডাকলে ঠিক উঠে যাবে। ভয় পাইয়ে তাড়াহুড়ো করে ঘুম ভাঙ্গতে হবে না। ইরহাম শ্লথ গতিতে আরেকটু ঝুঁকে গেল মায়ের দিকে। সে-ই শৈশবের মতো আহ্লাদে কণ্ঠে মিহি স্বরে বলতে লাগলো,
” মা। খিদে পেয়েছে। ওঠো না। খাবো। ”
খিদে পেয়েছে তার। শৈশবে খেলাধূলা করে কিংবা বিদ্যালয় থেকে ফিরে মা’কে ঠিক এভাবেই স্বভাবসুলভ শান্ত স্বরে বলতো। মা কথাটি শুনতেই কেমন অস্থির পড়তো। তার সোনা মানিক ক্ষুধার্ত! ওকে খেতে দিতে হবে। দ্রুত হাতে খাবার রেডি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন উনি। সেসব সোনালী অতীতের দৃশ্যপট। তবে বদলে যায়নি মা। বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরো যত্নশীল হয়ে পড়েছিল। ছেলেটা যে আজকাল বড় গম্ভীর হয়ে গেছে। মুখ ফুটে কিচ্ছুটি বলে না। উনি তো মা। না বলতেও সব বুঝে যান। পূরণ করার চেষ্টা করেন। তবে সেই স্নেহময়ী-বুঝদার মা কেন আজ এত্ত অবুঝ? কেন ঘুম থেকে উঠছে না? তাকাচ্ছে না ছেলের পানে! কেন? তার ইরু যে ক্ষুধার্ত-ক্লান্ত। মা নামক শান্তির স্থলে অসীম আশ্রয় প্রয়োজন। তবে কেন উঠছে না মা! কেন দিচ্ছে না তার ডাকে সাড়া! ইরহামের কম্পিত হাত আস্তে ধীরে এগিয়ে গেল। কাঁপতে কাঁপতে রাখলো মায়ের গালে। ছুঁয়ে দিলো আলতো করে। আহ্লাদী স্বরে ডেকে উঠলো,
” আমার মা! ”
আস্তে ধীরে মায়ের খোলা দু চোখ বন্ধ করে দিলো। বেশিক্ষণ হয়নি তো। বুঁজে গেল অক্ষিপুট। অবচেতন মনে একাকী বলতে লাগলো,
” তুমি একটু বিশ্রাম নেও ঠিক আছে? তোমার আদরের বৌমা নাহয় খাবার বেড়ে দেবে। ঘুমাও মা। তুমি ঘুমাও।”
মায়ের ঘামে ভেজা, যন্ত্রণা ক্লিষ্ট ললাটে চুম্বন এঁকে দিলো ইরহাম। আখেরি চুম্বন! আর কখনো ছুঁয়ে দেয়া হবে না। স্নেহশীল মায়ের স্নেহ পাওয়া হবে না। সব শেষ। ইরহাম না কেমন অদ্ভুত আচরণ করছিল। যেন সব স্বাভাবিক। ঘুমিয়ে মা। এখন হৃদিকে খুঁজতে হবে। মেয়েটা এই অবস্থায় কোথায় ঘুরঘুর করছে কে জানে। ইরহাম মায়ের মাথাটা আলতো করে নিজ কোলে তুলে নিলো। ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে চলেছে। মায়ের আরামদায়ক নিদ্রার ব্যবস্থা করেছে।
ঠিক সে মুহূর্তে হুড়মুড়িয়ে ঘরে প্রবেশ করলো রাহিদ। বেচারা ছেলেটা আহত দেহে বাইক নিয়ে একপ্রকার ঝড়ো গতিতে ছুটে এসেছে। রাস্তায় প্রচুর যানজট। ভারী বর্ষণে রাজধানীজুড়ে জমায়েত পানি। গাড়িঘোড়া জ্যামে বন্দী। কোনোমতে বাইক নিয়ে চিপা চাপা রাস্তা ডিঙিয়ে এসেছে সে। সে যদি ঝড়ো গতিতে এসে থাকে তবে ইরহাম ছিল আরো দ্রুত গতিসম্পন্ন। দেড় ঘন্টার রাস্তা মাত্র চল্লিশ মিনিটে পার করে এসেছে। শর্টকাট রাস্তায় কর্দমাক্ত অবস্থা। ছোট-বড় গর্ত। চলতি পথে তীব্র ঝাঁকুনি। তবুও চরম অস্বস্তি অবজ্ঞা করে ক্ষিপ্রবেগে ছুটে এসেছে মা ও স্ত্রীর বিপদের আশঙ্কায়। তবে শেষ রক্ষা কি হলো? রাহিদ এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজছে। ডাকছে ভাবী, ফুপি, ভাইকে। তবে সাড়া দিলো না একটি মানুষও। ঘরে এ কি দুর্দশা! তাদের অবর্তমানে হয়েছে টা কি? বুকের ভেতর ধরফর করছে। র:ক্তশূন্য মুখশ্রী। রাহিদ এদিক ওদিক তাকিয়ে চলেছে। হঠাৎ তার অশান্ত দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো ডানে। মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে ইরহাম। ভাইয়া হঠাৎ অদ্ভুতভাবে ওখানে কি করছে? তার সুঠামদেহ ব্যতীত দেখা যাচ্ছে না কিছুই। পরিস্থিতি সম্পর্কে পুরোপুরি অজ্ঞ রাহিদ ছুটে এলো ভাইয়ার পানে। অস্থির কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে উঠলো,
” ভাইয়া তুমি এখানে কি কর… ”
আর বলা হলো না। শব্দমালা যেন একপ্রকার আ-ত্মহনন করলো কণ্ঠনালীতে। বিহ্বল নয়নে তাকিয়ে রাহিদ! কখন যে দু চোখে জমলো নোনাজল জানা নেই তার। অস্ফুট স্বরে তীব্র আর্তনাদ করে উঠলো,
” ফুপি! ”
ইরহাম তখন অনবরত ডেকে চলেছে স্ত্রীকে। বসে তার শিয়রে। উ-দ্ভ্রান্তের মতো গালে হালকা চাপড় মে রে ডেকে যাচ্ছে,
” হৃদি শুনতে পাচ্ছো? চোখ মেলে তাকাও। হৃদি! ”
.
অন্তরীক্ষে তখনও দুঃখী-বেদনাদায়ক ক্রন্দন। মাঝেমধ্যে গর্জন করে উঠছে মেঘমালা। বাড়ির বাহিরে দাঁড়িয়ে অ্যাম্বুলেন্স। সাইরেনের সে-ই ভ”য়াল শব্দে কাঁপছে আকাশ বাতাস। বাতাসের প্রবল আধিপত্যে নৃত্যরত বৃক্ষপল্লব। আঁধারিয়া পরিবেশে শুধুমাত্র কৃত্রিম আলোর ঝলকানি। ব্যস্ত পায়ে ‘ আনন্দাঙ্গন ‘ নামক শ্ম”শানে প্রবেশ করছে পুলিশ সদস্যরা। বাড়ির সদর দরজা তখন ওনাদের দখলে। একজন নারী অফিসার মালিহার শ্বাস প্রশ্বাস নিরীক্ষা করে দেখলো। নেতিবাচক মাথা নাড়লো উচ্চপদস্থ অফিসারের পানে তাকিয়ে। ওই অফিসার ভীত নজরে তাকিয়ে এমপি সাহেবের পানে। কিয়ৎক্ষণ পূর্বেই অগ্নিতেজা বি”দ্রোহ করে উঠেছিল এই চৌধুরী। অত্যন্ত ভ”য়াল সে গর্জন! কিসের ইনভেস্টিগেশন হবে? তার র-ক্তাক্ত মা ও স্ত্রীর জীবন বাঁচানো সবচেয়ে জরুরি। আগে তারা এরপর পুরো দুনিয়া। পুলিশকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে স্ত্রীর নিস্তেজ দেহটি যত্নবান হাতে কোলে তুলে নিলো ইরহাম। ভাইকে হৃদয় কাঁপানো স্বরে আদেশ প্রদান করলো তার মা’কে সহিসালামতে নিয়ে আসার। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে একপ্রকার বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে অবজ্ঞা করলো বেপরোয়া চৌধুরী।
.
আনন্দাঙ্গন প্রাঙ্গনে মাত্র এসে থামলো গাড়িটি। দ্রুত গাড়ির দরজা উন্মুক্ত করে বেরিয়ে এলেন এজাজ সাহেব। ছেলের ফোনকল পাওয়া মাত্র অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি মিটিং মাঝপথে ছেড়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে ছুটেছেন উনি। রাস্তায় প্রচুর যানজট। বৃষ্টিমুখর রাতে বাড়ি ফেরাটা বেশ ক্লান্তিকর ছিল। এসির নিচে বসেও ঘামে ভেজা দেহ। শুকিয়ে এতটুকু মুখখানা। হঠাৎ কি হলো! কেন তড়িঘড়ি করে পুলিশ আনার আদেশ প্রদান করলো ইরহাম? ছেলের কণ্ঠে কিছু তো একটার আভাস পেয়েছেন উনি। যা ওনাকে বিন্দুতুল্য স্বস্তি দিতে নারাজ। থেমে থেমে বুকের ভেতরটা পু’ড়ে যাচ্ছে। চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে। কোথায় যেন বেজে চলেছে মূল্যবান কিছু হারানোর সুর। তবে কেন এই অযাচিত সুর! ভাবতে না ভাবতেই মিললো প্রশ্নের জবাব। স্তব্ধ এজাজ সাহেবের নয়ন জোড়া স্থির একমাত্র ছেলের পানে। বাড়ির সদর দরজা পেরিয়ে দ্রুততম পায়ে বেরিয়ে আসছে ইরহাম। কোলে হৃদির নিস্তেজ ভারী দেহখানি। বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে দু’টো শরীর। তবুও থেমে নেই পদযুগল। বাবাকে মোটেও লক্ষ্য করলো না ইরহাম। ঠিক তার পাশ কাটিয়ে ছুটে গেল। ক্ষিপ্রবেগে প্রবেশ করলো অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে। এজাজ সাহেব অবিশ্বাস্য চাহনিতে তাকিয়ে। ইরহাম! ওর। ওর কোলে ছিল কে? ওনার পুত্রবধূ হৃদি! কি হয়েছে মেয়েটার? তন্মধ্যে বাড়ি হতে বেরিয়ে এলো রাহিদ। কোলে ফুপির নিথর দেহ। আহত হওয়া সত্ত্বেও যথাসাধ্য সর্বোচ্চ গতিতে ছুটছে রাহিদ। এ অপ্রত্যাশিত দৃশ্য অবলোকন করে বয়স্ক মানুষটির ভারসাম্য এক লহমায় হারিয়ে গেল। ঠাস করে দেহ ঠেকে গেল গাড়িতে। দু চোখে ঘোর বিস্ময়! এজাজ সাহেব একের পর এক নি”র্মম দৃশ্য সহ্য করতে পারছিলেন না। ঝাঁপসা হয়ে আসছিল চক্ষু। একপ্রকার আধবোজা চোখে দেখতে পেলেন রাহিদকে। ছেলেটা সাবধানে আলতো করে অ্যাম্বুলেন্সে শায়িত করলো ফুপি’কে। নিজে বসলো ড্রাইভারের পাশের সিটে। পেছনে আরেক গাড়িতে সিকিউরিটি গার্ডের দল। চোখের পলকে ‘ আনন্দাঙ্গন ‘ চত্বর হতে প্রস্থান করলো শুভ্র রঙা অ্যাম্বুলেন্সটি। যার উপরিভাগে জ্বলজ্বলে রঙিন বাতি। সাইরেন বাজিয়ে ছুটেছে চিকিৎসালয়ের উদ্দেশ্যে। পিছুপিছু এক গাড়ি দেহরক্ষী ও আরেক গাড়ি পুলিশ। সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ধেয়ে চলেছে তিনটে গাড়ি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাদের দমাতে চরম ব্যর্থ।
•
তমসাচ্ছন্ন রজনী। বাহিরে তোলপাড় সৃষ্টি করা ঝড় থেমেছে কিয়ৎক্ষণ পূর্বে। তবে এ ঘর জুড়ে চলমান আরো বিপদজ্জনক তোলপাড়ের আগমনী সংকেত। গা হিম করা শুনশান নীরবতা। ঘন শ্বাস প্রশ্বাসের আলোড়ন। জ্ব’লছে অল্প আলোবিশিষ্ট এক দামী আকর্ষণীয় বাতি। যার নিম্নে ভয়ে তটস্থ ছয়জন। দলনেতা লোকটি সপ্তম জন। একটু বেশিই আত্মপ্রত্যয়ী। তাই তো যেখানে ভয়ে কম্পিত সব। সাহস সঞ্চয় করে সে এগিয়ে গেল অ-সুরের ধারে। আমতা আমতা করে বলবে কিছু, তৎক্ষণাৎ সবচেয়ে বিশ্বস্ত এ অনুচরের গাল বরাবর ঠাস করে আঘাত করলেন খন্দকার আজগর মল্লিক। বৃদ্ধের শক্তপোক্ত পাঁচটি আঙ্গুলের ছাপ পড়ে গেল দলনেতার গালে। অবিশ্বাস্য নয়নে তাকিয়ে সে! নেতাজী এই প্রথমবারের মতো আঘাত করলো তাকে। এ-ও দেখার ছিল! অবিশ্বাস্য! দলনেতা বিশ্বাস করতে পারছিল না। গালে হাত দিয়ে হতবুদ্ধি হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে। আজগর তখন বোধবুদ্ধি হারিয়ে চেপে ধরেছে দলনেতা লোকটির শার্টের কলার। ক্রো”ধ প্রকাশ স্বরূপ করছে বিশ্রী গালাগাল। অকস্মাৎ সব ভণ্ডুল হলো। শ্রবণপথে প্রবেশ করলো রিংটোন। আলোকিত মোবাইলের স্ক্রিন। পড়ে রয়েছে গোলাকার টেবিলের কাঁচের আস্তরণে। দেখাচ্ছে সে স্ক্রিনে,
‘ রুদ্র কলিং ‘
.
” সন্ধ্যারাতে একজন এমপির বাড়িতে অনায়াসে প্রবেশ করলো হা’মলাকারীরা। আ’ক্রমণ করে পালিয়েও গেল। এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটলো কিভাবে? কোথায় ছিল সিকিউরিটি গার্ড, বাড়ির অন্য সকলে? কি করে হা’মলাকারীরা এত সহজে বাড়ির ভেতরে ঢুকে কার্যসিদ্ধি করে পালিয়ে গেল? একজন এমপির বাড়িতে হা’মলা করা কি এতটাই সহজ? ”
সম্মুখে দাঁড়িয়ে ক্যামেরাম্যান। জনগণের উদ্দেশ্যে এখানকার অবস্থা তুলে ধরছে রিপোর্টার। এই মুহূর্তে শহরের অন্যতম নামকরা হাসপাতালের বাহিরে অবস্থান করছে মিডিয়া। সকলের মুখে একই সুর। একজন সাংসদের বাড়িতে কি করে এমন অবলীলায় ঘটলো অপ্রত্যাশিত হা’মলা!
চলবে.
#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৩২
” স্যরি মিস্টার চৌধুরী। সি ইজ নো মোর। এখানে নিয়ে আসার অনেকক্ষণ আগেই উনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। ওনাকে অলমোস্ট নয়বার স্টাব করা হয়েছে। খুবই ধারালো অ স্ত্র ছিল। উনি বেশিক্ষণ সেই মৃ ত্যু যন্ত্রনা সহ্য করতে পারেননি। উই আর ভেরি স্যরি। ”
বিপরীতে দণ্ডায়মান চিকিৎসকের মুখনিঃসৃত হলো কতগুলো নি’ষ্ঠুর শব্দ। প্রতিটি শব্দ বু লেটের ন্যায় ঝাঁ’ঝরা করে দিচ্ছিল শ্রবণপথ। ম রণ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে হৃৎপিণ্ড। থমকে সময়। বোধহীন মস্তিষ্ক। শুধু চারিদিকে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে একটাই কলরব,
‘ সে আর নেই। ‘
হারিয়ে গেছে মা। চিরতরে ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে। আর কখনো হবে না মাতৃস্নেহ লাভ। হবে না মায়ের পবিত্র মুখদর্শন। জীবনটা এত নি’র্মম বাস্তবতায় পরিপূর্ণ কেন? কেন সময় অসময়ে বুকে অন্তর্দাহ সৃষ্টি করে! কেন চিরস্থায়ী হয়না সুখপাখিটির জীবন! কেন! জানা নেই এতসবের করুণ উত্তর। অন্তঃপুরে যেন আস্তে ধীরে ম’র্মান্তিক স্বরে শ্রুতিগোচর হলো সে-ই চিরন্তন বাণী,
‘ ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন। ‘
লহমায় অতি সুনিপুণ ভঙ্গিতে নিজেকে ঠিক সামলে নিলো ইরহাম চৌধুরী। দ্রঢ়িমা মোড়কে মুড়ে নিলো দুঃখ ভারাক্রান্ত সত্তা। নিজেকে সামলাতে জানে সে। জানে ভেতরকার সবটুকু অনুভূতি অতি যতনে লুকোতে। মায়ের নিথর দেহটি দেখে ক্ষণিকের জন্য হতবুদ্ধি হয়েছিল ঠিকই। হারিয়েছিল হুঁশ জ্ঞান। তবে এবার নয়। তাকে লড়াই করতে হবে আন্তঃযন্ত্রণার বিপক্ষে। নিজেকে শান্ত রাখতে হবে। এখনো যে জীবিত তার বেঁচে থাকার আরেক মূল কারণ। তার হৃদরাণী। ইরহাম নামক মানুষটি তখন শব্দমালা গুছিয়ে নিচ্ছে ভেতরে ভেতরে। অধর সিক্ত হলো লালারসে। মাঝবয়সী চিকিৎসক প্রতিক্রিয়াহীন মানুষটির পানে অদ্ভুত চাহনিতে তাকিয়ে পানে। মায়ের মৃ ত্যু সংবাদ শুনে কি করে এত শান্ত-স্বাভাবিক এই সাংসদ চৌধুরী! সে কি একটুও ব্যথিত নয়? মাতৃবিয়োগে বুকফাটা আর্তনাদ বেরিয়ে আসতে চাইছে না? ইচ্ছে করছে না দুনিয়া ধ্বং’স করে দিতে! লোকমুখে শোনা কথাটিই তবে সত্য? কাঠিন্যতায় মোড়ানো এই চৌধুরীর হৃদরাজ্য। যেখানকার খোঁজ পাওয়া বহিরাগতদের জন্য শুধু দুষ্কর নয়। অত্যধিক মুশকিল বটে।
” হাউ ইজ মাই ওয়াইফ? ”
শীতল কণ্ঠস্বরে দৃঢ় প্রশ্ন। চিকিৎসকের হুঁশ ফিরলো। ওনার মুখপানে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে ইরহাম। সে চাহনিতে কেমন হাহাকার-বেদনা লুকিয়ে। সাথে এক অদৃশ্য শক্তি। ওই দুচোখে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা গেল না। আস্তে করে দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন চিকিৎসক। মৃদু স্বরে বললেন,
” মিসেস চৌধুরীর কন্ডিশন ভালো নয়। ভ্যাজাইনা হতে ব্লা’ড লস হয়েছে। আমরা আপাতত ব্লা’ডিং বন্ধ করেছি। এছাড়াও ওনার এক্সটার্নাল কিছু ইনজুরি রয়েছে। ইন্টার্নাল কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। আমরা কিছু টেস্ট দিয়েছি। সি ইজ অ্যাট রিস্ক অ্যাজ অ্যা প্রেগনেন্ট লেডি। ”
টলে উঠলো পদযুগল। আঁধারে নিমজ্জিত হলো দু চোখ। আরো এক দুঃসংবাদ। ভালো নেই তার স্ত্রী, অনাগত দুই সন্তান। বিপদের মুখে পতিত তারা। ব্যর্থ সে। এক সন্তান, স্বামী, পিতা হিসেবে। চরম ব্যর্থ। ইরহাম জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বরে চিকিৎসককে বললো,
” যে করেই হোক আমার ওয়াইফ এবং সন্তানদের সুস্থ করে তুলুন। ওপরে আল্লাহ্। নিচে আপনারাই ভরসা। নিজের সেরাটা দিয়ে কাজে লেগে পড়ুন ডক্টর। বেলাশেষে আমি সুসংবাদটুকুই শুনতে চাই। ”
শেষোক্ত বাক্যে কি হুমকি লুকিয়ে ছিল! বোঝা গেল না। ভীষণ ঠাণ্ডা স্বরে এ যেন এক অদৃশ্য সতর্কবাণী। নিজস্ব বক্তব্য পেশ করে সরে গেল ইরহাম। বক্ষস্থলে কেমন ব্যথা হচ্ছে। চিনচিনে ব্যথা। ক্রমে যা গ্রাস করে নিচ্ছে সমস্ত সত্তা। মানুষটি ঘুরে দাঁড়াতেই তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো পিতার শোকাহত রূপ। স্টেইনলেস স্টিলের থ্রি সিট ওয়েটিং চেয়ারের একটিতে বসে এজাজ সাহেব। কালো মেঘে ছেয়ে মুখখানা। অস্থির রূপে ওঠানামা করছে বক্ষদেশ। শূন্য চাহনিতে তাকিয়ে মেঝেতে। পাশেই বসে রাহিদ। ওনার কাঁধে হাত রেখে কিছু বলে চলেছে সে। ইরহাম তার অচঞ্চল দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। তাকালো নিজের পানে। র-ক্তাক্ত পোশাক ছেড়ে ফ্রেশ হতে হবে তাকে। এশার আজান দিয়েছে বহু পূর্বেই। রুস্তম’কে ডাকলো ইরহাম। চলন্ত পথে ব্যস্ত হলো আলাপণে। এটাই ইরহাম। নিজ অনুভূতি লুকোতে সর্বসেরা। ভেতরকার সকল আবেগ অনুভূতি লুকিয়ে একদম স্বাভাবিক সে। তাকে যে ঠিক থাকতেই হবে। নইলে বাকিদের সামলাবে কে? ওদিকে এজাজ সাহেব! স্ত্রীর আকস্মিক বিয়োগ ওনায় হতবিহ্বল করে দিয়েছে। সব শেষ। এখন কাঁদবে সব। বুঝবে মর্ম। দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বোঝে ক’জন!
.
রাজধানী ঢাকা তলিয়ে ঘোর অমানিশায়। বৃষ্টি শেষে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। ঠাণ্ডা হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে দেহ। কর্দমাক্ত জমিন-পথঘাট। তবুও সেথায় লোক সমাগম। বেশকিছু গাড়ি দাঁড়িয়ে একাংশে। শহরের অন্যতম নামকরা এ হাসপাতালের বাহিরে সাংবাদিকদের ভীড়। চাঞ্চল্যকর নিউজ কভার করছে তারা। ক্যামেরাম্যানকে সম্মুখে রেখে এক নারী রিপোর্টারের মুখে শোনা যাচ্ছে,
” আজ সন্ধ্যা নাগাদ আলোচিত তরুণ সাংসদ ইরহাম চৌধুরীর মা ও স্ত্রীর ওপর ম-রণঘাতী হা”মলা। নিজ বাসভবনে গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন তারা। জানা গেছে, স্বয়ং ইরহাম চৌধুরী তাদের উদ্ধার করে এই হসপিটালে অ্যাডমিট করেছেন। বর্তমানে কি অবস্থায় রয়েছেন তারা তা এখনো অবধি জানা যায়নি। ভেতরকার খবরাখবর সম্পূর্ণ গোপন রাখা হয়েছে। যেমনটা আপনারা দেখতে পারছেন পুরো হসপিটালে টাইট সিকিউরিটি। অনুমতি ছাড়া ভেতরে কেউ ঢুকতে পারছে না। সবার আইডি ভ্যারিফাই করে ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হচ্ছে। ”
সাংবাদিকের মুখে মুখে মালিহা চৌধুরী ও মিসেস ইরহাম চৌধুরীর হালচাল। তাদের ওপর সংঘটিত হা”মলার খবর। সহসা সেথায় থামলো পরপর দু’টো কৃষ্ণবর্ণ গাড়ি। গাড়ির দ্বার উন্মোচন করে একে একে বেরিয়ে এলো শেখ পরিবারের সদস্যরা। নারী সদস্যরা ক্রন্দনে লিপ্ত। থমথমে পুরুষ সদস্যের মুখশ্রী। সাংবাদিকরা তাদের লক্ষ্য করলো। ত্বরিত উজ্জ্বল হলো মুখশ্রী। দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসার চেষ্টা করলো সাংবাদিকরা। তবে বাঁধাপ্রাপ্ত হলো তৎক্ষণাৎ। পুলিশ ও শক্তপোক্ত দেহের অধিকারী দেহরক্ষীরা তাদের বাঁধা প্রদান করলো। সকলের ভীড় বাঁচিয়ে অতি সাবধানে হাসপাতালের অন্দরমহলে ছুটলো শেখ পরিবারের সদস্যরা। সাংবাদিকরা তাদের সাক্ষাৎকার নিতে পুরোপুরি ব্যর্থ। কিয়ৎক্ষণ বাদে এক পুরুষ সাংবাদিকের কণ্ঠে শোনা গেল,
” সন্ধ্যারাতে একজন এমপির বাড়িতে অনায়াসে প্রবেশ করলো দু-র্বৃত্তরা। আ’ক্রমণ করে পালিয়েও গেল। এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটলো কিভাবে? সেসময় কোথায় ছিল এই টাইট সিকিউরিটি, বাড়ির অন্য সকলে? কি করে দু-র্বৃত্তরা এত সহজে বাড়ির ভেতরে ঢুকে কার্যসিদ্ধি করে পালিয়ে গেল? একজন এমপির বাড়িতে হা’মলা করা কি এতটাই সহজ? ”
সম্মুখে দাঁড়িয়ে ক্যামেরাম্যান। জনগণের উদ্দেশ্যে এখানকার অবস্থা তুলে ধরছে রিপোর্টার। টেলিভিশনের পর্দায় প্রদর্শিত হচ্ছে এই খবর। জনসাধারণের মুখে মুখে একই সুর। একজন সাংসদের বাড়িতে কি করে এমন অবলীলায় ঘটলো অপ্রত্যাশিত হা’মলা!
•
মৃদু আলোয় আলোকিত বিশালাকার ঘরটি। ঘরের ঠিক মাঝবরাবর আকর্ষণীয় সোফাসেট। সেথায় বসে চৌধুরী। বাঁ হাত ঠেকিয়ে রাখা সোফার হাতলে। ডান হাতের অঙ্গুলি আড়াল করে ওষ্ঠাধর। রিমলেস চশমায় আড়ালকৃত নভোনীল শাণিত চক্ষুদ্বয় স্থির ল্যাপটপের যান্ত্রিক পর্দায়। পুরো ঘরজুড়ে পিনপতন নীরবতা। ইরহামের ডান পাশে দাঁড়িয়ে রুস্তম। সে-ই ল্যাপটপে অপারেট করছে সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ। ডান পাশে দাঁড়িয়ে রাহিদ। সম্মুখে কয়েকজন দেহরক্ষী। যারা সে রাতে দায়িত্বরত ছিল আনন্দাঙ্গনে। কিন্তু আনাড়ি-কদর্যভাবে ব্যর্থ হয়েছে। দুর্ঘটনা চলাকালীন সময়ে কোথায় ছিল এরা? কোন মুখে ঘাস কাটছিল! ল্যাপটপের পর্দায় প্রদর্শিত হচ্ছে সে রাতে সিসি ক্যামেরায় ধারণকৃত দৃশ্যপট,
আনন্দাঙ্গনের সদর দরজার বাহিরে স্থাপিত তিনটি সিসি ক্যামেরা। সব কয়টি ক্যামেরা সচল। সক্রিয়ভাবে চলছে। সব স্বাভাবিক। হঠাৎই হতবিহ্বল পরিস্থিতি! একদম ক্যামেরা বরাবর এসে দাঁড়ালো এক অজ্ঞাত আগন্তুক। কালো পোশাকধারী সে। মুখোশে আবৃত মুখ। দু হাতে গ্লাভস। ক্যামেরা বরাবর মুখ করে দাঁড়িয়ে। কেমন বিদ্রুপ করে দু আঙ্গুল কপালে ঠুকে সালাম জানালো। এরপর অতীব ক্ষীণ সময়ের মধ্যেই অকেজো ক্যামেরা। একে একে বাড়ির বাহিরে এবং লিভিংরুমে অবস্থিত সকল ক্যামেরা নিস্ক্রিয় হয়ে পড়লো।
এ দৃশ্য দেখে কঠিন হলো মানুষটির মুখাবয়ব। শক্ত চোয়াল। দু চোখে অবর্ণনীয় ক্রো’ধের উপস্থিতি। পাশ হতে রুস্তম বললো,
” বস! ক্যামেরা জ্যামার ইউজ করেছে এরা। বোতামে ছোট্ট একটা চাপ। সব ক্যামেরা অকেজো। ”
সিসি ক্যামেরাগুলো সেদিন সে বিপদের মূহুর্তে নিস্ক্রিয় ছিল। কোনোরূপ কাজে লাগেনি। এতগুলো ক্যামেরা সব নিস্তেজ হয়ে ছিল। কোনো ক্যামেরায় বিন্দুমাত্র অঘটন ধারণ হয়নি। সশব্দে ল্যাপটপটের স্ক্রিন নামিয়ে ফেললো ইরহাম। দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো স্বল্প দূরত্বে অবস্থিত দেহরক্ষীদের পানে। বাঁ পায়ের ওপর ডান পা তুলে বসলো ইরহাম। দু হাত ঠেকিয়ে রাখা সোফার হাতলে। রাজকীয় ভঙ্গিতে বসে মানুষটি। ভীষণ গুরুগম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,
” কি বলে নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করবে, আশা করি ভাবা শেষ? নাউ স্টার্ট। একে একে উগলে ফেলো। ”
দেহরক্ষীরা র ক্তশূন্য মুখে দাঁড়িয়ে। কোন শব্দ বুননে এ অশান্ত মানুষটিকে আশ্বস্ত করবে, বুঝ দেবে তাদের সত্যিই অজানা। তাদের চরম ব্যর্থতার ফলস্বরূপ মাতৃহারা হয়েছে চৌধুরী। স্ত্রী এখনো ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে চিকিৎসাধীন। কোন ভাষায় এই অগ্নিশর্মা মানুষটিকে শান্ত করবে এরা?
” বস আমরা কেউ কিছুই টের পাইনি। আ আসলে আমাদের হুঁশ ছিল না। ”
” হ্যাঁ। আমরা ওসময় অচেতন ছিলাম। কি থেকে কি হয়েছে কিছুই টের পাইনি। ”
সাহস সঞ্চয় করে আরো দু’জন একই কথা বললো। গৃহ পরিচারিকা যারা সে রাতে বাড়িতে ছিল তাদেরও একই মন্তব্য। সকলে উদগ্রীব হয়ে উঠেছে চৌধুরীকে আশ্বস্ত করার জন্য। তাদের অসাড় পরিস্থিতি বোঝানোর জন্য। তারা জ্ঞাত, তাদের এই ক্ষুদ্র ভুলটি তাদের জন্য ঠিক কতবড় বিপদ বয়ে আনতে পারে। কিছু সময়ব্যাপী চললো সে রাতের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ। আকস্মিক উঠে দাঁড়ালো ইরহাম। সকলের দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো তার পানে। কি বলবে এমপি সাহেব! কি হবে তার রায়? সকলের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে মন্দ্র কণ্ঠে বললো সে,
” সবাইকে স্যালারি বুঝিয়ে দিয়ে বাহিরে যাওয়ার রাস্তাটা দেখিয়ে দাও। অকর্মণ্য কাউকে এ চৌধুরীর প্রয়োজন নেই। চৌধুরী নতুন করে এক পরাক্রমশালী সৈন্যদল গড়বে। সে দলে এ টু জেড হবে হাই এফিসিয়েন্ট। ট্রেইনড্। গট ইট? ”
রুস্তম তৎক্ষণাৎ সাড়া দিলো,
” ইয়েস বস। ”
ব্যাস। সে-ই ছিল শেষ কথা। মন্দ্র স্বরে আদেশ প্রদান করে গটাগট কদম ফেলে সে ঘর হতে প্রস্থান করলো ইরহাম। পিছুপিছু রাহিদ। রুস্তম রয়ে গেল এদের ব্যবস্থা করতে।
.
অমানিশায় আচ্ছাদিত ধরিত্রী। কেবিন জুড়ে বিরাজমান অসীম শূন্যতা আর নৈঃশব্দ্য ভাব। কেবিনের মাঝ বরাবর বেডটি। সেথায় শায়িত ইরহামের হৃদ সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিকারিণী। তার রাণী সাহেবা। হৃদরাণী। বিগত কতগুলো ঘণ্টা ছিল তাদের জীবনের কালো অধ্যায়। ক”লঙ্কিত অধ্যায়। এক অতি মূল্যবান রত্ন হারিয়েছে তাদের জীবন থেকে। সেই রত্ন সদৃশ দ্বিতীয়টি মিলবে না কভু। মা হারিয়েছে যে। মায়ের অভিরুপ দ্বিতীয় কেউ হয় কি? হয় না। মাতৃহারা ইরহাম কেমন যেন পাথরে পরিণত হয়েছে। দিবারাত্রি সবদিক সামলে যাচ্ছে। চিকিৎসাধীন স্ত্রীর দেখভাল, পুলিশের তদন্ত কতদূর অগ্রসর হলো তার খবরাখবর, কবে নাগাদ ময়নাতদন্ত শেষে মিলবে মায়ের দর্শন। একাধারে সব দিকটা সামলে যাচ্ছে। কিন্তু তাকে সামলানোর জন্য কে রয়েছে? কেউ নেই। মা তো চিরতরে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল। আর অর্ধাঙ্গী! তার অর্ধেক অংশ। সে-ও বুঝি অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কেন যথাসময়ে এলো না সে? কেন ওদের ওই পশুবৎ লীলা হতে রক্ষা করলো না! কেন তার নিয়োজিত লোকগুলো অকর্মণ্যতার পরিচয় দিলো! কেন কেন? প্রতিনিয়ত এক প্রবল কিন্তু সুপ্ত অপরাধবোধ ঘিরে ফেলছে তাকে। বাবার শোকাহত মুখখানা, শ্বশুরবাড়ির লোকেদের চোখেমুখে লুকায়িত অসন্তোষ যখনই লক্ষ্য করছে ভেতরটা শত সহস্র টুকরোয় খণ্ডিত বিখণ্ডিত হয়ে যাচ্ছে। নভোনীল চক্ষু জোড়ায় দেখা মিলছে অপরিসীম গ্লানির। তন্মধ্যে প্রতিশোধস্পৃহার লেলিহান শিখা সদর্পে জ্বলজ্বল করছে অমোঘ তমসাচ্ছন্ন অন্তরে। সে ছাড়বে না কাউকে। কাউকে না। জ্বা’লিয়ে পু’ড়িয়ে অঙ্গার করে দেবে পাপের কালো সাম্রাজ্য। সোজা আঙ্গুলে তো এতদিন ঠিকঠাকমতো ঘি উঠলো না। এবার আঙ্গুলটা যে বাঁকা করতেই হচ্ছে। ইনশাআল্লাহ্ এবার পরাজয় নয় বিজয়ের মুকুট ছিনিয়ে নেবে এই চৌধুরী। এক নীরব ঘা ত ক রূপে দেখা মিলবে তার।
বিছানায় শায়িত মেয়েটি নিদ্রায় মগ্ন। বন্ধ অক্ষিপুট। মাথায় সফেদ ব্যান্ডেজ। ডান গালে কালশিটে আভা। বড্ড ম্লান সদা প্রাণবন্ত মুখখানি। সাদা কাগজের ন্যায় খসখসে ওষ্ঠাধর। পড়নে হাসপাতালের পোশাক। স্ফীত উদর আস্তে ধীরে শ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গে ওঠানামা করছে। তার থেকে কয়েক হাত দূরত্বে শুভ্র সোফায় বসে তার স্বামী। বরাবরের মতো আজও নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে। মায়ের ওই নি র্ম ম পরিণতি, স্ত্রীর করুণ হাল তাকে যে ঘুমোতে দেয় না। চোখ বুজলেই আঁতকে ওঠে হৃদয়। হাহাকার করে ওঠে অন্তঃস্থল। কিছুতেই ঘুমোতে দেয় না তাকে। রাতগুলো এভাবেই হাসপাতালে ক্লান্তিকর অবস্থায় অতিবাহিত হচ্ছে। নির্ঘুম-বিনিদ্র রজনী। কিয়ৎক্ষণ বাদে বেডের ওপর কিছুটা অস্বাভাবিকতা দেখা দিলো। আস্তে ধীরে হালকা হচ্ছে হৃদির ঘুম। চোখের পাতায় ভেসে উঠছে এক নির্মম-নিঠুর-ভয়ঙ্কর দৃশ্য। শ্রবণপথে কিলবিল করে চলেছে গগনবিদারী আর্তনাদ। চারিদিকে র ক্ত আর র ক্ত। অবিরাম আর্তনাদে কান ফেটে যাবার উপক্রম। ম-রণঘাতী সেই ছু রি টি এগিয়ে আসছে। নি”ষ্ঠুরতার পরিচয় দিতে ছুটে আসছে। হ্যাঁ। ওরই দিকে এগিয়ে আসছে। ওপাশে চিৎকার করে চলেছে মা। তবে কি সে আর বাঁচবে না! এতটুকুই ছিল তার জীবনকাল! কাল্পনিক ভয়াবহ দৃশ্যগুলো হৃদি আর সহ্য করতে পারছিল না। সহ্যসীমার বাহিরে ছিল সে দৃশ্যপট। ছটফট করছিল ভারী দেহটি। অবিরাম ছুঁড়ে বেড়াচ্ছে হাত-পা। জোরে জোরে ওঠানামা করছে বক্ষস্থল। যন্ত্রণা হচ্ছে উদরে। গর্ভস্থ সন্তানের অসুবিধা হচ্ছে। তাতে একটুও হুঁশ নেই মেয়েটির। সে তো কল্পনার রাজ্যে ডুবে। অনবরত কাতরাচ্ছে। গভীর আর্তনাদ করছে। নির্ঘুম মানুষটি সেসময় মাতৃশো’কে বিভোর। হঠাৎই গোঙানির শব্দ প্রবেশ করলো কর্ণ গহ্বরে। তৎক্ষণাৎ স্ত্রীর পানে তাকালো ইরহাম। ত্বরিত উদ্বেজিত হয়ে উঠলো। উঠে দাঁড়ালো সোফা হতে। ছুটে গেল অশান্ত হৃদির পানে। হৃদি’কে আগলে নিলো এক হাতে। আরেক হাতে নিকটস্থ বেল বাজিয়ে দায়িত্বরত নার্সকে খবর পাঠালো। যেকোনো মুহূর্তে নৈশকালীন চিকিৎসক এসে পড়বে।
” হৃদি শান্ত হও। চোখ মেলে তাকাও। হৃদি দেখো আশপাশে। কিচ্ছু হয়নি। সব ঠিক আছে। তুমি শুনতে পাচ্ছো হৃদি? অ্যাই মেয়ে। চোখ মেলে তাকাও সোনা। দেখো আমাকে। ”
অস্থির-অশান্ত সহধর্মিণীকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো ইরহাম। মায়ের অনাকাঙ্ক্ষিত বিয়োগে সাজানো গোছানো গোটা পরিবারটা আজ বি ধ্ব স্ত। কিচ্ছুটি ঠিক নেই। এক ন”রাধমের পা-শবিক পরিকল্পনায় সব শেষ। সে ছাড়বে না একটাকেও। চৌধুরীর মা ও স্ত্রীর ওপর আঘাত হানার মূল্য চুকাতেই হবে। এ তার দৃঢ় প্রতিশ্রুতি।
•
দিন গড়িয়ে পড়ছে রাত। স্রষ্টার নিয়মে চলছে সব। স্বাভাবিক গোটা দুনিয়া। শুধু ঠিক নেই আনন্দাঙ্গনবাসী। থমকে গিয়েছে তাদের সময়। হারিয়েছে সুখপাখি। মালিহার ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। কিছুক্ষণ পূর্বেই তার নিথর দেহটি হস্তান্তর করা হয়েছে ইরহাম চৌধুরীর নিকটে। এক সন্তানের কাছে তার মায়ের কাটাছেঁড়া নিথর দেহটি যখন হস্তান্তর করা হয়, সে মূহুর্তের অনুভূতি কি ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব? অবর্ণনীয় নয় কি! এককথায় অত্যন্ত ম’র্মান্তিক ছিল সে মুহুর্তটি। কয়েক হাজার গুণ বেশি উত্তপ্ত অ”গ্নিসংযোগ হচ্ছিল বুকের ভেতর। বলে বোঝানোর মতো নয়।
চলবে.