#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_২৯
তমসাচ্ছন্ন রজনী। বিছানায় বসে হৃদি। উরুর ওপর মাথা রেখে শুয়ে তার একান্ত পুরুষ। হৃদি হৃদয়কাড়া এক হাসি উপহার দিয়ে বললো,
” আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো কেটেছে। বাবুর আব্বুর দিনটি কেমন কেটেছে? ”
বলতে না বলতেই ধক করে উঠলো হৃদযন্ত্রটি। মানসপটে ভেসে উঠলো টেলিভিশনের পর্দায় প্রদর্শিত সংবাদ। ইরহাম চমকালো স্ত্রীর আকস্মিক পরিবর্তন দেখে। তবে মুহুর্তের মধ্যেই বিষয়টি বোধগম্য হলো। দ্রুত উঠে বসলো মানুষটি। দু হাতে আঁকড়ে ধরলো স্ত্রীর কাঁধ। ঘুরালো নিজের পানে। অস্থির মুখপানে তাকিয়ে শান্ত কোমল স্বরে বললো,
” হৃদি! তাকাও আমার দিকে। দ্যাখো। ”
হৃদি কেমন অস্থির চিত্তে তাকালো। ভয় হচ্ছে বড়। কি যেন খামচে ধরছে হৃৎপিণ্ড। চোখে চোখ রাখলো ইরহাম। এক হাত স্থাপিত সঙ্গিনীর বাম গালে। নম্র স্বরে বললো,
” শান্ত হও। ব্রিথ। কিচ্ছু হয়নি। ওকে? ওটা সাধারণ বিক্ষোভ ছিল। ”
” ছিল না। ”
অস্ফুট স্বরে আপত্তি জানালো হৃদি। চোখের পলক ঝাপটালো মানুষটি,
” ছিল। ইটস্ নরমাল। ”
” আ আপনি ওসবের পেছনে আছেন তাই না? এ কি করে ফেললেন? খন্দকার আজগর যে এবার খুব ক্ষে-পে যাবে। ”
আবেগতাড়িত হয়ে পড়ছে মেয়েটা। ভীতসন্ত্রস্ত ভাব। চোখেমুখে জমায়েত বিন্দু বিন্দু ঘাম। শ্বাস প্রশ্বাসের গতিবেগ দ্রুততর। কোনোরূপ নিজেকে সামলিয়ে স্বেচ্ছায় আরেকটু সন্নিকটে এলো। স্বামীর গালে এক হাত রেখে ভীত স্বরে জানালো নিজ অনুভূতি,
” আমার খুব ভয় করছে। কোনো বিপদ.. ”
অসম্পূর্ণ রইলো বাক্য। দূরত্ব মিটিয়ে নিলো ইরহাম। কপালে ঠেকলো কপাল। আবেশে মুদিত হলো দু জোড়া চোখ। মিহি স্বরে আশ্বস্ত করলো ইরহাম,
” ভয় পেয়ো না জান। ইনশাআল্লাহ্ সফলকাম হবে ন্যায়। ”
হৃদি ভয়ডরে বিধ্বস্ত। অস্থির অভ্যন্তর। অনিয়ন্ত্রিত শ্বাস প্রশ্বাসের গতিবেগ। আরো কিছু বলতে উদ্যত হলো। কিন্তু আদুরে ভঙ্গিতে বাঁধাপ্রাপ্ত হলো। স্বামীর দু হাতের অঞ্জলীতে ভরে মুখখানি। অধরে ছুঁয়ে গেল স্বামীর ওষ্ঠ। মাত্র কয়েক সেকেন্ডব্যাপী ছিল সে ছোঁয়া। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রসঙ্গ বদল করলো ইরহাম। জোরপূর্বক শব্দহীন হাসলো। দুষ্টুমি করে বললো,
” আর কতদিন আপনি আজ্ঞে চলবে বিবিজান? ”
হৃদি কপাল হতে কপাল সরিয়ে নিলো। তাকালো জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। প্রশ্নটি ঠিক বোধগম্য হলো না তার। ইরহাম অনায়াসে তা বুঝতে পারলো। তাই আস্তে ধীরে আয়েশ করে স্ত্রীর উরুর ওপর পুনরায় মাথা এলিয়ে দিলো। বলতে লাগলো,
” আমি ব্যতীত বাড়ির সকলকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করা হয়। এমনকি আপনার শ্বশুর পাপাকেও। অথচ আমি। আপনার অধম স্বামী। আজ পর্যন্ত তুমির ‘তু’ অবধি শুনতে পেলাম না। ইজ ইট ফেয়ার? ”
এবার বিষয়টি বোধগম্য হলো। কিয়ৎক্ষণ পূর্বের ভীতি ভুলে নিঃশব্দে হেসে উঠলো মেয়েটি। পেলব আঙ্গুল ডুবিয়ে দিলো স্বামীর মসৃণ চুলে। আলতো করে আঙ্গুল চালনা করতে লাগলো কেশরাজ্যে। আরামদায়ক স্পর্শে বুঁজে আসছে আঁখিপল্লব। তবুও স্ত্রীর পানে স্থির বিমুগ্ধ চাহনি।
” ওহ্ আচ্ছা? এজন্য এমপি সাহেবের অভিযোগ রয়েছে? ”
” জ্বি রয়েছে। ছোটোখাটো নয়। বেশ বড় অভিযোগ। ক’দিন পর আমাদের বাবুসোনা আসছে। সে বিষয়টা কোন চোখে দেখবে বলো তো? ”
হেসে উঠলো হৃদি। স্বামীর ললাটে ক্ষুদ্র চুমু এঁকে দিলো।
” আচ্ছা? এখন নিজের মনোবাসনা বাবুর নামে চালিয়ে দিচ্ছেন? ”
” মোটেও না। ” সরাসরি আপত্তি পোষণ করলো এমপি সাহেব।
হৃদি সরু চোখে তাকিয়ে,
” মিথ্যা বলা পাপ। ”
” হ্যাঁ তো। আমি কখন বললাম ওটা আমার মনোবাসনা নয়? আমি চাই। বেলাশেষে যখন ক্লান্ত দেহে বাড়ি ফিরবো। তখন একগ্লাস পানি হাতে কাছে আসবে তুমি। আদুরে কণ্ঠে ‘তুমি’ বলে আমার খোঁজখবর নেবে। পোশাকআশাক এগিয়ে দেবে। দূর করবে সারাদিনের সমস্ত ক্লান্তি। চাওয়াটা কি খুব বেশিই হয়ে গেল? ”
কেমন আহ্লাদী হয়ে তাকিয়ে মানুষটি। যা কোমল হৃদয়ের অধিকারিণীর হৃদয়ে সরাসরি প্রেমাঘাত করে। বারবার। সহস্রবার। হৃদি চক্ষু ফেরাতে ব্যর্থ হলো। চুলের ভাঁজে আঙ্গুল চালনা করতে করতে মিহি স্বরে বলল,
” ইনশাআল্লাহ্ শীঘ্রই আপনার এই চাওয়াটা পূরণ হতে চলেছে। ”
” আজ এখুনি নয় কেন? ”
অবিশ্বাস্য ভাবে কেমন শিশুসুলভ আচরণ করছে কাঠখোট্টা মানুষটা। লহমায় চাহনিতে অবিশ্বাস হটে জায়গা করে নিলো মুগ্ধতা! হৃদি মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে! বোঝানোর ভঙ্গিতে বললো,
” এক বছরের বেশি সময় ধরে অভ্যাস। একটু সময় লাগবে। এতটুকু সময় নিই? ”
আবদার লুকিয়ে কণ্ঠস্বরে। অগত্যা ইতিবাচক সম্মতি জানালো ইরহাম,
” ঠিক আছে। বেশি দেরি যেন না হয়। ”
হৃদি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। প্রসন্ন হলো মানুষটি। শুলো অর্ধাঙ্গীর উদর বরাবর মুখ করে। সেথায় ছোট ছোট পরশ অঙ্কন করলো। অনাগত সন্তানকে আদর করে দিলো। মিহি স্বরে স্ত্রীকে বললো,
” হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে ভালোমতো বসো। কোনো প্রবলেম হলে সাথে সাথে বলবে। ঠিক আছে? ”
” ঠিক আছে বাবা। আপনি এখন একটু বিশ্রাম নিন তো। সারাক্ষণ শুধু টইটই। শরীরটাকে একেবারে মেশিন বানিয়ে ফেলেছেন। বিরামহীন চলছে। ”
হেসে বিষয়টি এড়িয়ে গেল ইরহাম। আরাম করে শুলো। নিশ্চিত করলো স্ত্রী, অনাগত সন্তান যেন তার দ্বারা বিন্দুমাত্র আঘাতপ্রাপ্ত না হয়। আস্তে ধীরে বন্ধ হলো অক্ষিপুট। ভাবনায় হাজির হলো আজকের ঘটনাবলী। আজ দিনভর যা হলো তা নিঃসন্দেহে অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল। আজগর সাহেবের ক্ষমতাশালী গদি নড়িয়ে দিতে যথেষ্ট। তন্মধ্যে দেশে ফিরেছে আজগর পুত্র রুদ্রনীল। শিকার ফাঁদে পা দিয়েছে। এবার যা করার শীঘ্রই করতে হবে। এমন সুযোগ দ্বিতীয়টি মিলবে না। বড় ভ-য়ঙ্কর হতে চলেছে এ লড়াই। মহান রবের অনুগ্রহ ব্যতীত সফলতা ধরাছোঁয়ার বাহিরে। ন্যায় ও অন্যায়ের লড়াই চলে আসছে সৃষ্টির আরম্ভ হতে। বরাবরই র-ক্তক্ষয়ী ছিল সে লড়াই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অন্যায়ের নিকট বারংবার পরাজিত হয়েছে ন্যায়। অবশেষে কোনো এক শুভ লগ্নে মহান রবের অনুগ্রহে জয়লাভ করেছে। রুদ্রনীলের পাপের সাম্রাজ্য কাল থেকে নয় বরং বহু বছর ধরে রাজত্ব করে আসছে। র ক্ত ঝড়িয়েছে অগণিত মানবদেহ হতে। নির্মম-বর্বর পন্থায় অপরাধকর্ম চালিয়ে গেছে। বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই বাপ-বেটার মধ্যে। কম তো রাজত্ব করলো না। প্রত্যেক ক্ষমতাবান বাদশাহ একসময় হারের স্বাদ পেয়েই থাকে। এবার সময় এসেছে তাদের পরাজিত করার। বাংলার মাটিকে কিয়দংশ নিষ্কলঙ্ক করার। ইনশাআল্লাহ্ সফলতা অর্জন করবে সততা-ন্যায়।
•
দিবাবসুর দীপ্তিতে উজ্জ্বল বসূধা। উত্তরার এক অভিজাত রেস্টুরেন্ট। ব্যক্তিগত প্রয়োজনে সেথায় আগমন এমপি সাহেবের। বসে আকর্ষণীয় সোফাসেটে। বিপরীত দিকে বসে এক চেনা পরিচিত ব্যক্তি। দু’জনের মধ্যে আলাপচারিতা চলমান।
” ওকে ফাইন। সি ইয়্যু সুন। ”
বিপরীতে বসা ব্যক্তি বললো,
” আসছি তবে। আসসালামু আলাইকুম। ”
” ওয়া আলাইকুমুস সালাম। ”
সালামের জবাব দিলো ইরহাম। ব্যক্তিটি সৌজন্য সাক্ষাৎ সেরে সেথা হতে বিদায় নিলো। অতঃপর সোফায় আয়েশ করে বসলো ইরহাম। বাঁ হাত উঠিয়ে রাখা। ঠেকে সোফার উর্ধ্বভাগে। ডান হাতে নড়ছে স্পুন। ক্যাপুচিনো এর কাপে স্বাধীন রূপে ঘুরে বেড়াচ্ছে স্পুন’টি। রিমলেস চশমার অন্তরালে বুদ্ধিদীপ্ত নভোনীল চক্ষুদ্বয়। আস্তে ধীরে পর্যবেক্ষণ করে বেড়াচ্ছে চারিপাশ। সব স্বাভাবিক। যেন সে অন্য সকলের মতো এসেছে সেথায়। আসলেই কি তাই? নাকি স্বেচ্ছায় শিকারকে সুযোগ প্রদান? অপেক্ষার প্রহর অতি শীঘ্রই সমাপ্ত হলো। স্লাইডিং ডোর উন্মুক্ত করে রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করলো সে ব্যক্তি। পড়নে আজও সাহেবি পোশাক। নীলাভ স্যুট। ম্যাচিং শ্যু। চোখে নীলাভ রঙা রে ব্যান এভিয়েটর। একদম ভদ্রলোকের অবতার। অ্যা জেন্টেলম্যান উইথ টু ক্যারেক্টারিস্টিকস্। ব্যক্তিটি রেস্টুরেন্টের প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে গোটা জায়গাটিতে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। অতঃপর তর্জনী নাড়িয়ে এক ক্ষুদ্র ইশারা পেছনে অবস্থিত অধস্তনদের উদ্দেশ্যে। ব্যাস। স্বল্প সময়ের মধ্যেই ফাঁকা হলো পুরো স্থানটি। অবস্থিত মাত্র চার পাঁচ জন কাস্টোমার এখন বাহিরে। গোটা জায়গা জুড়ে পিনপতন নীরবতা। একটি সেফটিপিন মেঝেতে পড়লেও শিউরে উঠবে শ্রবণেন্দ্রিয়। অবশেষে দুই শের এক মঞ্চে। ব্যক্তিটির চলনবলনে সম্পূর্ণ আভিজাত্যের ছাপ। শ্লথ পায়ে এগিয়ে গেল। বসলো কাঙ্ক্ষিত মানুষটির বিপরীত সোফায়।
ইরহাম বিপরীত দিকে কারোর উপস্থিতি উপলব্ধি করেও তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলো না। সম্পূর্ণ মনোযোগ বাঁ হাতে থাকা স্মার্টফোনে। ডান হাতে ক্যাপুচিনো কাপ। একটু একটু করে ঠোঁটে ঠেকছে কাপ। পান করছে ক্যাপুচিনো। রুদ্রনীল পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে। আপাদমস্তক দেখে নিচ্ছে চৌধুরীকে। এই তবে সে-ই ইরহাম চৌধুরী! দ্য ফিয়ার অফ ব্লা-ডি ওল্ড ম্যান! পড়নে তো সামান্য কম দামী সাদা পাঞ্জাবি। ব্র্যান্ডেড বলে মনে হচ্ছে না। না পোশাকআশাকে রয়েছে অভিজাত ব্যক্তিত্বের ছাপ! এমন চালচুলোহীন একজন কি করে হলো সাংসদ! তাচ্ছিল্য করে হাসলো রুদ্র। রুদ্রনীল তো পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে। তীক্ষ্ণ নজরে মেপে নিচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বীকে। তবে বিপরীত দিকের প্রতিক্রিয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখনো মোবাইলে মুখ গুঁজে ইরহাম। এক মিনিট, দুই মিনিট। কয়েক মিনিট অপেক্ষা করলো রুদ্র। কোনোরূপ পরিবর্তন নেই। অজানা এক ননসেন্স ফেলো( fellow ) তাকে কিনা অবজ্ঞা করছে! ভাব দেখাচ্ছে! এরূপ অভিব্যক্তি রুদ্রর দেহে বহ্নি শিখা জ্বালিয়ে দিলো। নির্লিপ্ত বদনে বসে তো সে। তবে ভেতরকার অবস্থা অবর্ণনীয়। ফুলে ফেঁপে উঠছে শিরা। এক কোপে ধর থেকে মাথা আলাদা করতে আনচান করছে দু হাত। লালাভ রঙ ছড়িয়ে পড়ছে মুখশ্রীতে। নীরবে অতিবাহিত হলো কিছু মুহূর্ত। অবশেষে মুখ খুললো রুদ্রনীল। বিদ্রুপ করে বললো,
” বিং ঠু(too) স্মার্ট ক্যান বি অ্যা লায়াব্লিটি। ”
অবশেষে দূরীভূত হলো নীরবতা। চোখ তুলে একবার তাকালো ইরহাম। রুদ্রকে দেখে নিলো। স্বভাবসুলভ গম্ভীর স্বরে বললো,
” বিং স্মার্ট ইজ নট অ্যাবাউট শোয়িং অফ, বাট অ্যাবাউট ইউজিং ইয়্যর নলেজ টু হেল্প আদার্স। ”
মুখের ওপর ঠাস-ঠাস জবাব। অন দ্য স্পট শিখিয়ে দিলো কারে কয় স্মার্ট। অপমানে গাঢ় র’ক্তিম রূপ ধারণ করলো মুখ। চক্ষু বুঁজে ঘন শ্বাস ফেললো রুদ্রনীল। তুড়ি বাজিয়ে বিপরীত দিকে বসা মানুষটির দৃষ্টি আকর্ষণ করার প্রয়াস চালালো,
” হেই ইয়্যু। লুক অ্যাট মি অ্যান্ড লিসেন হোয়াট আ’ম সেয়িং।”
হোয়াটস্অ্যাপে ব্যস্ত ইরহাম। ধূর্ত স্বরে বললো,
” আল্লাহ্ দু কান দিয়েছে। অল ওকে। শুনছি আমি। ইয়্যু ক্যারি অন। ”
জোরালো ভাবে টেবিল চাপড়ে দিলো রুদ্রনীল। শব্দ হলো বেশ। কেঁপে উঠলো স্বল্প দূরত্বে দণ্ডায়মান রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার। এসব কি চলছে ওনার রেস্টুরেন্টে! সাংসদ ও খ্যাতিমান ব্যবসায়ী মুখোমুখি বসে। কোথা থেকে কোথায় গড়াচ্ছে তাদের আলাপণ! বোধগম্য হলো না মাঝবয়সী ম্যানেজার সাহেবের।
” তুই কি ভেবেছিস? আমার বাপকে ফাঁ”সানো এত সোজা? ”
অভাবনীয় প্রশ্ন ছিল। অবশেষে কৃপা করে মুখ তুলে তাকালো ইরহাম। স্থির হলো দু জোড়া চোখ। উভয়ের চোখেই তেজদীপ্ত আভা। কঠোর মুখাবয়ব। হালকা হেসে ইরহাম পরিস্থিতি স্বাভাবিক করলো,
” আপনার এই অবান্তর ভ্রান্ত ধারণা কোথা থেকে জন্ম নিল জানতে পারি মিস্টার রুদ্রনীল? ”
” মানে? ” জিজ্ঞাসু নয়নে তাকিয়ে রুদ্র।
” কান টানলে মাথা আসে। বাপকে ধরলে বেটা। হোপ ইয়্যু আন্ডারস্ট্যান্ড? ”
চতুরতার হাস্য রেখা লেপ্টে চৌধুরীর অধরকোলে। দাঁতে দাঁত চেপে বললো রুদ্র,
” ইয়্যু রা;সকেল! তুই আমাকে ফাঁ’সানোর প্লান করছিস? আ’ম নট অ্যাট অল সরি টু স্যে… তোর বাপ দাদা চৌদ্দ গুষ্টি চেষ্টা করলেও আমার সামান্য একটা লোম বাঁকা করতে পারবে না। আমায় ডেস্ট্রয় করা তো বহু দূর কি বাত। ”
ক্যাপুচিনোতে চুমুক দিয়ে শুধরে দিলো সাংসদ ইরহাম,
” ডোন্ট বি ওভার কনফিডেন্ট। ইটস্ ফেটাল (fatal) ফর ভিক্টোরি। ”
” বাকওয়াস মাত বোল। আমার কনফিডেন্স লেভেল কোথায় আপ ডাউন করবে সেটা তোর মতো দু পয়সার সরকারি গোলামকে বলতে হবে না। ”
শেষোক্ত কথাটায় চামড়া ঝ ল সে গেল যেন। নভোনীল চক্ষুদ্বয়ে ক্রোধের আভাস। অত্যন্ত গম্ভীর স্বরে বললো ইরহাম,
” সরকারি গোলাম হতে পেরে আমি গর্বিত। আফটার অল দেশের জন্য ভালো কিছু করছি। কাপুরুষের মতো দেশদ্রো:হীতা তো করছি না! ”
” ইয়্যু ফা** বিচ! ”
ডান হাত উঁচিয়ে সাবধান করলো ইরহাম,
” আহা। নো গালমন্দ। এটা ভদ্রলোকের জায়গা। কোনো গালির আখড়া নয়। ”
রুদ্রনীল পুনরায় কিছু বলতে উদ্যত হলো তখনই বেজে উঠলো রিংটোন। ইরহাম মোবাইল হাতে নিলো। স্ক্রিনে দেখলো রাহিদ কলিং। একবার তাকালো রুদ্রর পানে। অতঃপর কোনোরূপ সৌজন্যতা প্রদর্শন ব্যতীত কল রিসিভ করে উঠে দাঁড়ালো। কথা বলতে বলতে দাঁড়ালো এক নিরালায়। এতেই আহত সিংহের ন্যায় গর্জে উঠলো রুদ্রনীল। হাউ ডেয়ার হি! খন্দকার রুদ্রনীল মল্লিককে অ্যাটিটিউড দেখাচ্ছে! কোথাকার কোন লাটসাহেব এ! সংসদে জায়গা পেয়ে শাহেনশাহ হয়ে গেছে!
” ইয়্যু ** ম্যান। উড়ে নে। যত পারিস উড়ে নে। ডানা এই ছেঁটে দিলাম বলে। টিল দেন এনজয় দ্য ফ্রিডম। ”
চলবে.
#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৩০ ( প্রথমাংশ )
আদিত্যর মিঠি আলো ছুঁয়ে যাচ্ছে দেহ। বেলকনিতে আরামদায়ক ফ্লোর ম্যাটে বসে পাঁচ মাসের গর্ভবতী হৃদি। দেয়ালে হেলান দেয়া দেহ। কোলে শুয়ে স্বামী ইরহাম। শালীনতার সহিত ওড়নায় আবৃত মেয়েটির কৃষ্ণবর্ণ কেশ। মুখজুড়ে মুগ্ধতার রেশ! উরুতে শায়িত স্বামীর হাতে পবিত্র কুরআন শরীফ। সুমধুর কণ্ঠে সূরা ইয়াসিন তেলাওয়াত করে চলেছে মানুষটি। কি মধুরতম কন্ঠ! শ্রবণপথ যেন আজ সার্থক। প্রতিটি হরফ, প্রতিটি আয়াত স্পষ্ট রূপে শ্রবণ হচ্ছে। মাঝেমধ্যে আবেশে মুদিত হচ্ছে চোখ। আলতো করে স্বামীর বক্ষপটে হাত বুলিয়ে চলেছে হৃদি। শুনছে অসংখ্য ফজিলত সম্পন্ন সূরা ইয়াসিন। অনুভব করার চেষ্টা করছে প্রতিটি আয়াতের মর্ম। শুধুমাত্র আরবি নয়। সঙ্গে বঙ্গানুবাদ শুনিয়ে যাচ্ছে মানুষটি। হৃদি শুনছে। মহান রবের বাণী শুনছে। অন্তরে একরাশ প্রশান্তি। শ্রবণপথে পৌঁছাচ্ছে সে-ই আয়াত ও তার অর্থ,
” ইন্না-নাহনুনুহয়িল মাওতা-ওয়া নাকতুবুমা-কাদ্দামূওয়া আ-ছা-রাহুম ওয়া কুল্লা শাইয়িন আহসাইনা-হু ফীইমা-মিম মুবীন।
বাংলা অর্থঃ আমিই মৃ*তদেরকে জীবিত করি এবং তাদের কর্ম ও কীর্তিসমূহ লিপিবদ্ধ করি। আমি প্রত্যেক বস্তু স্পষ্ট কিতাবে সংরক্ষিত রেখেছি। [ সুরা ইয়া-সীন ৩৬:১২ ] ”
হৃদি শুনলো। গেঁথে নিলো হৃদয়ে। হাশরের ময়দানে সকল পাপ ও পূণ্যের হিসাব হবে। জয়লাভ করবে পূণ্য। অতীব ভ”য়ঙ্কর পন্থায় কুপোকাত হবে পাপ ও পাপী। কল্পনার বাহিরে সে-ই মুহুর্ত। বড় করে তপ্ত শ্বাস ফেললো মেয়েটি। মনোযোগ দিলো সুমধুর তেলাওয়াতে। একসময় তেলাওয়াত সম্পন্ন হলো। পবিত্র কুরআন শরীফকে সম্মান প্রদর্শন করে চুমু অঙ্কন করলো ইরহাম। হৃদি আলতো করে দু হাতে কুরআন শরীফ স্পর্শ করলো। চুমু এঁকে সাবধানে রেখে দিলো এক হাত দূরত্বে অবস্থিত সেন্টার টেবিলের ওপর। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো স্বামীর পানে। ললাটে ওষ্ঠ ছুঁয়ে বিমুগ্ধ কণ্ঠে বললো,
” মাশাআল্লাহ্! তুমি খুব সুন্দর করে কুরআন তেলাওয়াত করো। ”
‘তুমি’ হ্যাঁ সেদিনের পর থেকে হৃদি অভ্যাস গড়ে তোলার চেষ্টা করে গিয়েছে। প্রথম প্রথম ভালোই অসুবিধা হতো। তুমির বদলে বারবার বলে ফেলতো ‘আপনি’। তবে সময়ের পরিক্রমায় বদলেছে অভ্যাস। এখন পুরোপুরিভাবে স্বামীকে তুমি বলে সম্বোধন করে মেয়েটি। ইরহাম শোনে। পুলকিত হয় তার তনুমন। অর্ধাঙ্গীর কণ্ঠে দুই বর্ণের সামান্য শব্দটি এতখানি অসামান্য কেন! ইরহাম প্রসন্ন বদনে স্ত্রীর প্রশংসার বিপরীতে বললো,
” জাঝাকিল্লাহু খায়রান মিসেস। ”
হৃদি মুচকি হাসি উপহার দিয়ে বললো,
” এটা অর্থ ধন্যবাদ তাই না? ”
ইরহাম তার সঙ্গিনীকে বোঝানোর ভঙ্গিতে বলতে লাগলো,
” ঠিক ধন্যবাদ বোঝায় না। হাদিস শরিফে এসেছে, একবার উসাইদ বিন হুযাইর রাযি. কোন এক প্রেক্ষিতে শুকরিয়া স্বরূপ রাসূল ﷺ -কে বললেন, ‘জাযাকাল্লাহু খায়রান’ বা ‘জাযাকাল্লাহু আত্বইয়াবাল জাযা’। উত্তরে তিনি বললেন, ‘ফা জাযাকুমুল্লাহু খায়রান’ বা ‘ফা’জাযাকাল্লাহু আত্বইয়াবাল জাযা’। (নাসাই কুবরা ৮০২৪ ইবনে হিববান ৭২৭৭ মুসতাদরাক হাকিম ৪/৭৯)। জাযাকাল্লাহু খায়রান একটি তাৎপর্যপূর্ণ ইসলামি বাক্য। যার অনেকগুলো অর্থ রয়েছে। তবে এই বাক্যের প্রধান বা মূল অর্থ হলো ‘আল্লাহ্ আপনাকে উত্তম পুরস্কার বা প্রতিদান দিন’। তবে কোথাও কোথাও উল্লেখিত আছে যে লিঙ্গভেদে উচ্চারণে তারতম্য ঘটে। মেয়েদের ক্ষেত্রে জাঝাকিল্লাহু খায়রান আর ছেলেদের ক্ষেত্রে জাঝাকাল্লাহু খায়রান। বুঝলে? ”
হৃদি ইতিবাচক মাথা নাড়ল। সে বুঝতে পেরেছে। অজানা বিষয়টি আজ জানা হলো। এ বিষয়ে এতকাল অজ্ঞাত ছিল সে। কথায় কথায় থ্যাংক ইয়্যু বা ওয়েলকাম বলা মেয়েটি আজ জানতে পারলো ইসলামে এর প্রতিশব্দ হিসেবে কি চমৎকার বাক্য রয়েছে। ‘আল্লাহ্ আপনাকে উত্তম পুরস্কার দিন’। অপূর্ব না! স্বামীকে মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে বললো মেয়েটি,
” জাযাকাল্লাহু খায়রান জনাব। ”
বিনিময়ে হৃদয়কাড়া হাসি উপহার দিলো ইরহাম। হৃদি প্রাণ ভরে অবলোকন করলো সে হাসি। রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়লো ভালোলাগার উত্তাল তরঙ্গ। গর্ভকালীন সময়ে হৃ’হাম দম্পতি এক নতুন অভ্যাস তৈরি করেছে। রোজ ফজরের সালাত আদায় করে বেলকনিতে উপস্থিত হয় তারা। একে অপরের সান্নিধ্যে কাটায় সময়। কুরআন তেলাওয়াত করে। কখনোবা ধর্মীয় বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করে। দেশ-বিদেশের তথ্য নিয়েও আলাপচারিতা হয়। মাঝেমধ্যে হাতে বেশি সময় পেলেই ইরহাম শুয়ে পড়ে স্ত্রীর উরুতে। সে অবস্থায় করে কুরআন তেলাওয়াত। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,
” স্ত্রী কোলে শুয়ে তিলাওয়াত করা সুন্নাত। (সহীহ বুখারী; ২৯৭, ইবনুল ক্বাইয়িম, যাদুল মা’আদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৮২) ”
এ সুন্নতটি প্রসন্ন হৃদয়ে পালন করার চেষ্টা করে হৃ’হাম দম্পতি। নিঃসন্দেহে অনাগত সন্তানের সঙ্গে অতিবাহিত হচ্ছে চমৎকার মুহুর্ত! হৃদি গর্বিত ইরহামের মতো একজন চমৎকার পুরুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়ে। জীবনসঙ্গী তো এমন একজন হওয়াই উচিত, যে শুধুমাত্র ইহকালে নয় পরকালেও হবে তোমার সঙ্গী। হৃদি যে পরিবারে বড় হয়েছে সেখানে ইসলামী অনুশাসন অতটাও গুরুত্ব সহকারে পালন করা হতো না। ছোট থেকে যে শিক্ষা লাভ করেছে সেভাবেই বড় হয়েছে। চালচলন ছিল ইসলামী অনুশাসন বহির্ভূত। তবে সকল প্রশংসা মহান রবের। ওনার অশেষ রহমতে ইরহাম নামক একজনকে সঙ্গী রূপে পেয়েছে। যে মানুষটি একটু একটু করে বদলেছে ওকে। ওর মধ্যে বপন করেছে ধর্মীয় অনুশাসন মান্য করার স্পৃহা। স্বামী নামক মানুষটির তাগাদায় হৃদি এখন ধর্মীয় বিষয়াদি সম্পর্কে জানছে। নিত্যনতুন স্বামীর কাছ থেকে কিছু না কিছু শিখছে। এ পৃথিবীতে নবী রাসুল ব্যতীত কোনো মানব সন্তান ই পুরোপুরি পারফেক্ট নয়। তবে হৃদির দৃষ্টিতে তার স্বামী নামক মানুষটি অতুলনীয়! আস্ত এক ভালোবাসার ভাণ্ডার। এই যে হৃদি বিয়ের আগে যেমন স্বামী কল্পনা করতো সেরকমটা কিন্তু পায়নি। হৃদি বরাবর কল্পনা করে এসেছে তার স্বামী হবে অত্যন্ত রোমান্টিক পুরুষ। বিনা দ্বিধায় সকলের সামনে বুক ফুলিয়ে বলবে ‘ভালোবাসি হৃদি’। সে ওর মতোই এক্সট্রোভার্ট হবে। দু’জনের হাস্য কলরব, মধুরতম আলাপণে মুখরিত হবে সারা ঘর। কিন্তু মানুষ যা চায় তা সবসময় পায় না। সে স্বামী রূপে পেল এক ইন্ট্রোভার্ট ব্যক্তি। যে মানুষটি নিজের অনুভূতি প্রকাশে বড্ড অপটু। নিজস্ব অনুভূতি বুকের মাঝে যতন করে রাখতে জানে। জনসম্মুখে যখন তখন অযাচিত প্রদর্শন করে নয় বরং সঙ্গিনীকে প্রতি মুহূর্তে কোনো না কোনো পন্থায় অনুভব করানো যে ‘ভালোবাসি তোমায়’… এরই নাম ভালোবাসা। প্রকৃত ভালোবাসা। ইরহাম এই কাতারে অন্তর্ভুক্ত। সর্বদা তার চাহনি, অনুভূতিপ্রবণ স্পর্শ, সীমাহীন যত্নের পরশ বুঝিয়ে দেয় হৃদয়ে লুকানো অনুভূতি কতটা প্রগাঢ়। আলহামদুলিল্লাহ্। হৃদি গর্বিত এ মানুষটিকে সঙ্গী রূপে পেয়ে। সুখেদুঃখে আম’রণ থাকতে চায় এ মানুষটির সনে। তার প্রশস্ত বক্ষপটে মাথা এলিয়ে খুঁজে পায় ভরসা, নিরাপত্তা ও অসীম ভালোবাসা।
•
আন্ধার মুখ করে ঘুরছে বেচারা। চোখেমুখে অনুতাপের ছাপ। একটু পরপর তাকাচ্ছে রান্নাঘর বরাবর। কোনোরূপ পরিবর্তন নেই। এখনো জোরে জোরে শব্দ ভেসে আসছে। সব রাগ কি বেচারা-মূক-জড় বস্তুর ওপর ঝাড়ছে? হয়তো তাই। বেচারা ছেলেটার আগত ঝড় হতে বেঁচে গিয়েও মুখে আঁধার। কিচ্ছু ভালো লাগছে না। এসবের কি খুব দরকার ছিল? সে না হয় ছোট্ট বাচ্চা সাইজ একটা ভুল করে ফেলেছে। তাই বলে এত ভ-য়ঙ্কর শাস্তি! গুনে গুনে পুরো একঘন্টা বউ তার সঙ্গে কথা বলছে না। কি মারাত্মক ব্যাপার! বউটার সঙ্গে কথা বলতে না পেরে তার যে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, মাথা ঝিমঝিম করছে এর দায় নেবে কে? হুঁ? আজকাল ডক্টরদের যে লোমহর্ষক ভিজিট! ভুল করেও ও তল্লাটে যাওয়া যাবে না। টাকা বাঁচাতে হবে। নাহলে অদূর ভবিষ্যতে তার হালি হালি সোনামনিরা দুর্ভিক্ষের শিকার হবে। হবু বাবা হিসেবে সে এতবড় অন্যায়, অবিচার হতে দিতে পারে না। কিন্তু ওই মূর্খ মহিলা থুড়ি মেয়েকে এসব বোঝাবে কে! ভাবতে না ভাবতেই আবার শব্দ। থালা বাসন ঝনঝন করে শব্দ করছে। রাহিদ এ পর্যায়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঁচু স্বরে মা’কে ডেকে উঠলো,
” মা ও মা। তোমার আদরের দুলালী বউমা তো সব ভেঙ্গেচুরে ফেললো। তোমার শখের রান্নাঘর বাঁচাও। সেভ দ্য কিচেন। ”
পল্লবী শোবার ঘর হতে অপ্রসন্ন কণ্ঠে সাড়া দিলেন,
” বাপ আমার। তুমি তো চুপ ই থাকো। নিজে রান্নাঘরের যে বেহাল দশা করেছো তার চেয়ে বৌমা আমার শতগুণ ভালো করে গুছগাছ করছে। ”
মুখখানি কেমন আমসক্তের মতো শুকিয়ে গেল। এত মোটা অপমান! সে নাহয় পণ্ডিতি করে একটুখানি থুড়ি একটু বেশিই বেহাল দশা করে ফেলেছে। তাই বলে এভাবে মুখের ওপর বলবে! পিঠের ওপর বললেও পারতো। যন্ত্রণা একটু কম হতো। তা না খালি বৌমা বৌমা করছে। বলি ছেলে না থাকলে বৌমা আসতো কোথা থেকে? এবার শত হাজার ভেবেচিন্তে বলুক। ছেলে বড় না বৌমা বড়? রাহিদ ম্লান বদনে সোফায় বসে পড়লো। মানসপটে ভেসে উঠলো এমনতর অদ্ভুদ ঘটনার মূল সূচনা।
গত দুই সপ্তাহ ধরে রাহিদ বেশ ব্যস্ত সময় পার করছে। পরিবারের অগোচরে চুপিসারে কোথায় কি করছে জানে না তার মা, বউ। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও বাড়িতে যথেষ্ট সময় দিতে পারছিল না ছেলেটা। অজান্তেই স্ত্রীকে অবহেলা করছিল। আজ শুক্রবার। ছুটির দিন। সময় পেল রাহিদ। বড় করে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল। এবার বোধগম্য হলো বউ তার অভিমানে এভারেস্ট জয় করে ফেলেছে। আহত বাঘিনীর ন্যায় যখন তখন তর্জন গর্জন করছে। ব্যাস। বউয়ের মান অভিমান ভাঙচুর করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো ছেলেটা। অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো আজ সে নিজের হাতে রান্না করবে। মা, বোন, স্ত্রী। জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ তিন নারীকে চমকে দেবে। সে-ই মতো খুব সকাল সকাল সবার অগোচরে রান্নাঘরে হানা দিলো। ঘুমিয়ে পরিবারের সদস্যরা। সে-ই সুযোগটা কাজে লাগানোর চেষ্টা করলো রাহিদ। এরপরের সময়টা ছিল কল্পনাতীত। আইলা-সুনামি-ক্যাটরিনা সব একত্রে বয়ে গেল রান্নাঘরে। এমন হুলস্থুল অবস্থা যে বলার বাহিরে। যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে শাক-সবজি। হরেক রকমের মশলা পড়ে রয়েছে যেখানে সেখানে। আটায় মাখামাখি মানুষটির মস্তক, বক্ষ। থালা বাসন কাঁদো কাঁদো চেহারায় তাকিয়ে। ব্যাস। তখনই সেথায় উপস্থিত হলো ইনায়া। অনাকাঙ্ক্ষিত তুলকালাম কাণ্ড সইতে না পেরে গর্জন করে উঠলো মেয়েটা। হাওয়া ফুঁস! পরাজিত বিড়ালের মতো লেজ গুটিয়ে রান্নাঘর হতে পলায়ন করতে বাধ্য হলো রাহিদ। এরপর থেকে চলছে মৌন লড়াই। বউটা তার শেষমেষ জামাইকে ভুলে বাসনপত্রকে আপন করে নিলো! এতবড় দুঃখ রাখবে কোন পকেটে? ভার সইতে না পেরে ছিঁড়ে যাবে তো! ওহ্ হো! কি দুঃখ!
•
গর্ভকালীন সময়ের পাঁচ মাস চলছে। স্বাভাবিকের চেয়ে বেশ স্ফীত উদর। গুরুজনেরা ধারণা করছে হয়তো এক নয় আসছে দু’জন নয়া সদস্য। সে থেকে রোজ আনন্দ বয়ে যাচ্ছে ঘরে ঘরে। মালিহা অত্যন্ত খুশি। পুত্রবধূর সেবাযত্নে উনি বিন্দুমাত্র ত্রুটি রাখছেন না। বলতে গেলে নিজের মায়ের চেয়েও বেশি মমতাময়ী রূপে নিজেকে উপস্থাপন করে যাচ্ছেন। এজাজ সাহেব। রাশভারী লোকটাও আজকাল ভাবনাতীত খুশি। মাঝেমধ্যে সময় পেলে সন্ধ্যায় লিভিংরুমে কথার আসর বসে। পুত্রবধূর সঙ্গে টুকটাক কথা বলেন পাপা এজাজ। ওর খোঁজখবর নেন। ওদিকে এমপি সাহেব? বেশ ব্যস্ত সময় পার করছে ইরহাম। তার অনুপস্থিতিতে এজাজ-মালিহা দম্পতি তাদের পুত্রবধূর সর্বোচ্চ খেয়াল রাখছেন। ছেলে যেন অভিযোগ করার বিন্দুতুল্য সুযোগ না পায়। এজাজ সাহেব অবশ্য ছেলের ওপর অসন্তুষ্ট। স্ত্রীর এমন গুরুত্বপূর্ণ, আবেগী সময়কালে সে কোন রাজকার্যে ব্যস্ত শুনি! হ্যাঁ এটা সত্য যে ইরহাম নিজের তরফ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। যথাসাধ্য স্ত্রীর দেখভাল করছে। তাতে হৃদির অসন্তোষ না থাকলেও এজাজ সাহেব অসন্তুষ্ট। উনি কখনোই চান না ছেলে ওনার মতো দায়িত্বজ্ঞানহীন হোক। সন্তানের চোখে বাজে পিতা হিসেবে পরিচিত হোক। তাই তো ওনার যত অসন্তুষ্টি, বিরক্ত ভাব। ছেলেটা কি একটুও বুঝতে পারছে না! কে জানে হয়তো বুঝতে পারছে কিংবা নয়।
.
দিনমণির কিরণে আলোকিত বসুন্ধরা। উত্তরার এক নামকরা হাসপাতাল। গাইনোকলজি বিভাগের বাহিরে ওয়েটিং জোন। সেথায় পাশাপাশি বসে হৃদি ও মালিহা। হৃদির নিয়মিত চেকআপের জন্য আজ এখানে আগমন। এসে থেকেই মলিন বদনে বসে মেয়েটা। তার মমতাময়ী শাশুড়ি মা সঙ্গে রয়েছে। তবুও অনুভূত হচ্ছে একাকীত্ব। গর্ভকালীন এ সময়ে প্রতিটি মেয়েই স্বামী সঙ্গ প্রত্যাশা করে থাকে। হৃদিও তাদের অন্তর্ভুক্ত। এই যে আজ এখানে আগমন। স্বামী মানুষটি পাশে থাকলে একাকীত্ব কি পারতো জড়িয়ে ধরতে? পারতো না। তার তনুমন উভয়েই ফুরফুরে থাকতো। কিন্তু দুঃখজনক ভাবে ইরহাম অনুপস্থিত। কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে সে দু’দিন ধরে শহরের বাহিরে অবস্থান করছে। বলেছে গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে। কিন্তু সে কাজটি যে কি মোটেও বলেনি। ইদানিং মানুষটা কেমন অদ্ভুত আচরণ করছে। যখন তখন চিন্তায় ডুবে যায়। কিসব ভাবতে থাকে। হৃদি উপলব্ধি করতে পারে সব। জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে। কিন্তু বলেনা না গম্ভীরমুখো মানুষটি। চতুরতার সহিত সব গোপন করে যায়। ওকে এটাসেটা বুঝিয়ে প্রসঙ্গ বদলে ফেলে। একদিন দু’দিন তিনদিন। আর কত? একসময় হৃদি ঠিক সব জানতে পারবে। তার যে বড় ভয় হয়। না জানি মানুষটি কোন মুসিবতে জড়িয়ে! দীর্ঘশ্বাস ফেললো হৃদি। ভাবনায় ছেদ পড়লো শাশুড়ি মায়ের ডাকে। চোখ তুলে তাকালো হৃদি।
” চল মা। এবার আমাদের সিরিয়াল। ”
মালিহা সাবধানে হাত ধরে হৃদির ভারী শরীরটি উঠাতে সহায়তা করলেন। সে মুহূর্তে বাম পাশ হতে বলে উঠলো রাহিদ,
” ভাবী ভয় পেয়ো না। আমরা আছি তো। ”
হৃদি যেন এই ‘আমরা’ শব্দে সন্তুষ্ট হতে পারলো না। একান্ত পুরুষ ই যে অনুপস্থিত। প্রেমিক পুরুষ রাহিদ ঠিক বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারলো। তাই তো কোমল স্বরে ভাবীকে আশ্বস্ত করতে বললো,
” ইরু ভাইয়া সত্যিই ইম্পর্ট্যান্ট কাজে ফেঁ সে গেছে ভাবী। নইলে ঠিক ছুটে আসতো। তুমি তো ভাইয়াকে খুব ভালো করেই চেনো, তাই না? বিশ্বাস করো তো? ”
হৃদি ইতিবাচক মাথা নাড়ল। হ্যাঁ সে বিশ্বাস করে। ওই মানুষটি যে তার অর্ধাঙ্গ। তাকে বিশ্বাস বিনা কাটাবে কি করে সংসার জীবন! বিশ্বাস যে সম্পর্কের অন্যতম মূল ভিত্তি। আর কথা বৃদ্ধি পেল না। মায়ের হাত ধরে সাবধানে পা ফেলে ডক্টরের চেম্বারে প্রবেশ করলো হৃদি, মালিহা যুগল।
_
” মিসেস হৃদি! আপনার বেবি বাম্পের অতিরিক্ত ওজন পিঠের নিচের দিকে ব্যথার কারণ বলে মনে করছি। এটা একটি নিস্তেজ ব্যথার মতো অনুভূত হয় এবং দীর্ঘ সময় ধরে দাঁড়িয়ে বা বসে থাকার পরে এই ব্যথা সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয়। ”
লেডি গাইনোকলজিস্টের কথা শুনে চিন্তিত হয়ে পড়লেন মালিহা। শুধোলেন,
” ডক্টর এর জন্য আমরা কি করতে পারি? এই ব্যথা নিরাময়ের কোনো উপায়? ”
” জ্বি। এই ব্যথা নিয়ন্ত্রণ করতে উনি যোগব্যায়াম করতে পারেন। যা ওনার মূল পেশীকে শক্তিশালী করার উপর ফোকাস করে। একটি প্রসবপূর্ব ম্যাসেজও স্বস্তি আনতে পারে। বিশেষ করে যদি মেল্টিং ম্যাসেজ বাম ব্যবহার করেন।”
হৃদি মৃদু স্বরে বললো,
” ইনশাআল্লাহ্ আমি যোগব্যায়াম করার চেষ্টা করবো। আপাতত কোনো ম্যাসেজ বাম লাগবে না। ”
” মিসেস চৌধুরী আরেকটা কথা। আপনার ডটার ইন ল এর ব্লা ড প্রেশার কিন্তু হালকা হাই দেখছি। এটা কোনোভাবেই হওয়া উচিত না। প্রেগন্যান্সির সময় হাই ব্লা ড প্রেশার বেশ চিন্তার কারণ। এতে মা ও সন্তানের প্রবলেম হতে পারে। মাচ রিস্কি। মেক শিওর করবেন পেশেন্টের প্রেশার যেন সবসময় নরমাল থাকে। ”
” জ্বি ডক্টর। আমরা খেয়াল রাখবো। ”
বলে মালিহা তাকালেন পুত্রবধূর পানে। মেয়েটা আজকাল নিজের অযত্ন করতে আরম্ভ করেছে। আর ওনার ছেলেটা! দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডক্টরের সঙ্গে কথোপকথনে লিপ্ত হলেন মালিহা।
•
” ভাই! জহির আহসান জেল থেকে পালিয়েছে। ”
অনাকাঙ্ক্ষিত এক সংবাদ যথেষ্ট ছিল সাংসদ ইরহাম চৌধুরীর চিন্তার উপদ্রব বৃদ্ধি করতে। হঠাৎ এ কি হয়ে গেল! কি করে পলায়ন করলো জহির! কোনোভাবে এ পলায়ন বিপদ না ডেকে আনে।
চলবে.
#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৩০ ( দ্বিতীয়াংশ )
নতুন এক দিনের সূচনা। মাঝখানে অতিবাহিত হয়েছে বেশ কতগুলো দিন। ছয় মাসের সন্তানসম্ভবা হৃদি। জমজ সন্তানের মা হতে চলেছে সে। একজন নয় আনন্দাঙ্গনে অফুরন্ত আনন্দের হাতছানি নিয়ে আসতে চলেছে নতুন দু’জন সদস্য। অবর্ণনীয় সুসংবাদে দুই পরিবারে রীতিমতো খুশির ঢল নেমেছে যেন। ফারহানা এবং নাজরিন প্রায়শ মেয়েকে দেখতে চলে আসছেন আনন্দাঙ্গন। সকলের সান্নিধ্যে অতিবাহিত হচ্ছিল হাসিখুশি মুহুর্ত। এভাবেই কাটছিল সুন্দর দিন। তবে জীবনের সব দিন যে একভাবে কাটে না। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না মিলেমিশেই তো আমাদের জীবন।
ফজরের সালাত আদায় করে বিছানায় শুয়ে হৃদি। সকাল থেকেই বড্ড অস্থির লাগছে। ফাঁকা ফাঁকা লাগছে বুকের ভেতর। কয়েক মণ ওজনের ভারী পাথর যেন চেপে বসেছে দেহে। প্রতিটি নিশ্বাসে কেমন অস্থিরতা-যন্ত্রণা মিশে। দু চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুবিন্দু। আকস্মিক এত দুঃখ ভারাক্রান্ত কেন মন! কি হয়েছে? সবই তো ঠিকঠাক। সে এবং তার অনাগত সন্তান সুস্থ রয়েছে। গর্ভকালীন সময় স্বাভাবিক ভাবেই কাটছে। আপনজন সকলে ভালো আছে। সুস্থ আছে। তবে কেন কু ডাকছে মন! ইরহাম? সে। সে কোথায়? হ্যাঁ মনে পড়েছে। রোজকার মতন জগিংয়ে গিয়েছে মানুষটি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসবে। আজ নাকি ব্যস্ত সময় কাটবে। দুপুরে ফিরতে পারবে না। আসতে অনেক রাত হবে। আজ হঠাৎই কেন যেন মন বলছে ‘সে বাহির না যাক’। রয়ে যাক ওদের সঙ্গে। মানুষটি ওর সাথেই থাকুক। আগলে রাখুক যতনে। বড় ভয় হচ্ছে যে। মনে হচ্ছে কোনো অজানা দা”নবীয় সত্তা ছি*ন্নভিন্ন করে দেবে তাকে। কেড়ে নেবে এক মা’কে তার সন্তান হতে। ভীত হৃদি ঘন শ্বাস ফেলতে লাগলো। চক্ষু বুঁজে স্মরণ করতে লাগলো মহান রব’কে। সমস্ত অস্থিরতা, বিপদআপদ হতে পরিত্রাণ কামনা করছে। পাঠ করছে দোয়ায়ে ইউনুসের সে-ই ফজিলত সম্পন্ন আয়াত। তবুও মন মানতে নারাজ। কোনো এক অদৃশ্য শক্তি তার দেহ হতে প্রাণ কেড়ে নিতে উদগ্রীব। চোখের তারায় বারংবার ভেসে উঠছে এক ভ-য়ঙ্কর রূপ! আতঙ্কিত হৃদি দ্রুততার সহিত উঠে বসতে চেষ্টা করলো। তবে হলো না সফল। অনাগত দুই সন্তান বাঁধা প্রদান করলো। চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে উদরে। দাঁত চেপে বসলো অধরে। চক্ষু বুঁজে যাতনা সয়ে যাচ্ছে সে। নিমীলিত আঁখিপল্লব। ঘেমে গেছে গাত্র। অদৃশ্য কোনো শক্তি চেপে বসেছে গলদেশে। শ্বাস প্রশ্বাসের গতিবেগ অস্থির। অনিয়ন্ত্রিত। ধীরে ধীরে বড় করে শ্বাস নিতে লাগলো হৃদি। স্মরণ করতে লাগলো স্রষ্টাকে। আস্তে ধীরে মিলছে স্বস্তি। শ্বাস প্রশ্বাসে এখন নেই অসুবিধা। দমবন্ধ অবস্থা পলায়ন করেছে। কিয়ৎক্ষণ বাদে একটু স্বাভাবিক হলো মেয়েটা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে রবে’র শুকরিয়া আদায় করলো। দু হাতে ভর দিলো বিছানায়। মন্থর গতিতে সাবধানতা অবলম্বন করে শোয়া হতে উঠে গেল। হেলান দিয়ে বসলো হেডবোর্ডে।
.
বাহিরে যাওয়ার জন্য পরিপাটি হচ্ছে ইরহাম। উদম দেহে দাঁড়িয়ে সমতল আরশির সম্মুখে। কানে ঠেকে মোবাইল ফোন। কথা বলছে কারোর সঙ্গে। ভেজা চুল গড়িয়ে পড়ছে জলবিন্দু। ভিজিয়ে দিচ্ছে চিবুক, গলদেশ, বুক। কথোপকথনের একপর্যায়ে ব্যাঘাত সৃষ্টি হলো। পেলব একটি হাত তাকে পিছু ঘুরিয়ে দাঁড় করালো। ইরহাম থমকালো তার অনাগত সন্তানের মা’কে দেখে। গর্ভধারণের পর হতে মেয়েটির সৌন্দর্য স্বাভাবিক ভাবেই কিছুটা লাঘব পেয়েছে। মোটা হয়েছে বেশ। স্ফীত উদর বহিঃপ্রকাশ করে সেথায় রয়েছে তাদের দুই বাবুসোনা। আর মাত্র কয়েক মাসের অপেক্ষা। পৃথিবীর আলো দেখবে দুটি শিশু। আসবে মায়ের কোলে। পাবে মা-বাবা সহ আপনজনদের স্নেহ। এই যে তার হৃদরাণী যখন ধীরে সুস্থে সাবধানে হাঁটাচলা করে, উদরে স্থাপন করে হাত। সে অপরূপা রমণী কি জানে তখন এই হবু মা’কে কতটা স্নিগ্ধময়ী লাগে! তাকে বুকে টেনে নেয়ার, আদরে আদরে সিক্ত করার অভিলাষ জাগে পুরুষালি মনে। তবে নিজেকে দমিয়ে রাখে ইরহাম। এসময়ে উ-ন্মত্ত ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ মা ও অনাগত সন্তান উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর। তাই তো জোরপূর্বক নিজেকে সামলানোর প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে মানুষটি। সহসা ভাবনায় ছেদ পড়লো। শ্রবণপথে প্রবেশ করলো ক্ষীণ স্বর,
” একটু ঝুঁকে দাঁড়াও তো। ”
বিপরীতে কোনো প্রশ্ন না করে ফোনালাপে লিপ্ত মানুষটি স্ত্রীর পানে স্বল্প ঝুঁকে গেল। হৃদির হাতে শুভ্র তোয়ালে। যতন করে স্বামীর ভেজা চুলে তোয়ালে চালনা করে চলেছে। শুষে নিচ্ছে জলকণা। সমস্ত মনোযোগ ভেজা চুলে। এ ক্ষুদ্র যতনে পুলকিত হলো অন্তর। স্ত্রীর ললাটে আলতো চুম্বন করে ফোনালাপ সমাপ্ত করলো ইরহাম। হৃদি হালকা অধর প্রসারিত করে মুছে দিলো ভেজা চুল। বললো,
” সবসময় আমাকে বলো। এবার নিজে কি করছিলে? তোমার বুঝি ঠাণ্ডা লাগতে পারে না? ”
ফিচেল হাসলো মানুষটি,
” ঠাণ্ডা লাগলে সমস্যা কোথায়? উষ্ণতা দেয়ার জন্য একান্ত জন তো রয়েছে। ”
অভাবনীয় ভাবে আজ লাজে রাঙা হলো না হৃদি। বরং নিষ্পলক নেত্রে তাকিয়ে রইলো স্বামীর পানে। দেখে নিচ্ছে তার মানুষটিকে। আবেগী দু’চোখ স্থির স্বামীর সুশ্রী মুখশ্রীতে। নভোনীল চোখ জোড়া, ললাটে লেপ্টে থাকা সিক্ত চুল, পুরুষালি ধুমপান বিহীন ওষ্ঠাধর। সবেতে ঘুরে বেড়াচ্ছে চোখ। হঠাৎ কি হলো কে জানে। লহমায় এক টানে সন্নিকটে এলো মানুষটি। সন্ধি হলো অধরে অধরে। অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শে বাকরুদ্ধ ইরহাম। আজ তার অধরোষ্ঠে আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে জীবনসঙ্গিনী। গাঢ় সে ছোঁয়া। একদম ভিন্নতর অনুভূতি। কিছুটা একান্ত মুহূর্ত সেভাবেই অতিবাহিত হলো। অতঃপর ইরহাম সাড়া দেয়ার পূর্বেই অধর মিলাপ ভঙ্গ হলো। স্বামীর কপালে ঠেকে গেল কপাল। নিমীলিত আঁখিপল্লব। দু’জনের পড়ছে ঘন শ্বাস। এমতাবস্থায় বলে চলেছে হৃদি। আবেগঘন কণ্ঠস্বর,
” কখনো তোমায় জোরালো শব্দে বলা হয়নি ‘ভালোবাসি’। কখনো হয়নি হাতে হাত রেখে রাতের শহরে পথচলা। কখনো ধোঁয়া ওঠা এক উষ্ণ মাটির ভাঁড়ে দু’জনে জমা করিনি বৃষ্টিফোঁটা। হয়নি একত্রে স্বপ্নের শহরে পদার্পণ। তবুও ভালোবাসি তোমায়। আজ এ মুহুর্ত হতে নয়। এক বসন্ত পূর্ব হতে। আকস্মিক এক মধুরতম লগ্নে মনের অরণ্যে এলে তুমি। স্থায়ী বসত গড়লে সেথায়। থেকো সদা সর্বদা মনের অরণ্যে তুমি। শুভ্র সুন্দর অনাবিল। ভালোবাসি প্রিয়। এভাবে স্বভাবে মিশে রইবো আম”রণ তোমাতে। ”
একের পর এক অনুভূতিপ্রবণ চমক! ঠিক সামলে উঠতে পারছিল না ইরহাম। লাজুক কন্যার আজ হঠাৎ হলোটা কি? এ চোখে প্রগাঢ় ভালোবাসার বদলে কেন ভিন্ন অস্তিত্ব টের পাচ্ছে সে! কেন চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে বক্ষমাঝে! এ বিষয়ে অজ্ঞাত ইরহাম আলতো করে সঙ্গিনীকে কাছে টেনে নিলো। আলিঙ্গনে আবদ্ধ হলো দু’জনা। মধ্যখানে তাদের সন্তানের উপস্থিতি। মাতৃগর্ভে সে-ও বুঝি অনুভব করতে পারছে মা-বাবার ভালোবাসার গভীরতা। ইরহাম স্ত্রীর চুলের ভাঁজে চুমু এঁকে দিলো। যথাসম্ভব গাঢ় হলো বাঁধন। একান্ত পুরুষের বক্ষস্থলে তখন আবেগী হৃদি। দু চোখ ছাপিয়ে নামছে বারিধারা। এ কিসের অশ্রু বিসর্জন? অজানা ভয় নাকি প্রিয় মানুষটির সান্নিধ্যে সুখময় অনুভূতি!
.
লিভিংরুমে দাঁড়িয়ে মালিহা। কথা বলছেন বছর পঁচিশের এক গৃহপরিচারিকার সঙ্গে। নাম তার মর্জিনা। সে মুহূর্তে সেথায় আগমন হলো ইরহামের। পিছুপিছু হৃদি। বিগত দুই মাস ধরে নিচতলায় তাদের ঘর স্থানান্তর করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় সকল কিছু এখন নিচতলার একটি ঘরে। গর্ভবতী হৃদির জন্য বারংবার সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামা অনুচিত। তাই তো দোতলা হতে নিচতলায় স্থানান্তর। উদরে স্থাপিত হাত। স্বামীর পানে তাকিয়ে হৃদি। ইরহাম মোবাইল স্ক্রল করতে করতে মায়ের পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল। তন্মধ্যে মা’কে উদ্দেশ্য করে বললো,
” মা আসছি। আসসালামু আলাইকুম। ”
মালিহা কথোপকথন বন্ধ করে ছেলের পানে তাকালেন। সালামের জবাব দিলেন,
” ওয়া আলাইকুমুস সালাম। সাবধানে থাকিস বাপ। ”
মমতাময়ী কণ্ঠে বললেন মালিহা। ততক্ষণে বাড়ির বাইরে ইরহাম। শেষোক্ত কথাটি বোধহয় শোনা আর হলো না। প্রস্থান করলো ব্যস্ত পায়ে। তার গমন পথে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে হৃদি, মালিহা। হঠাৎই একরাশ শূন্যতা জেঁকে বসলো গৃহে।
.
সান্ধ্যকালীন প্রহর। জনসভা সমাপ্ত হয়েছে কিয়ৎক্ষণ পূর্বে। ঢাকার ব্যস্ত সড়ক ধরে এগিয়ে চলেছে শুভ্র রঙা গাড়ি। ব্যাক সিটে বসে ইরহাম। কারোর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ চ্যাটিংয়ে ব্যস্ত। ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে সিকিউরিটি হেড রুস্তম। পিছু পিছু আসছে দেহরক্ষীদের আরেকটি গাড়ি। এমপি সাহেবের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এগিয়ে চলেছে গাড়ি দু’টো। রুস্তমের সতর্ক দৃষ্টি ঘুরে বেড়াচ্ছে পথে পথে। সহসা ইরহামের হাতে থাকা ফোনটি বেজে উঠলো। শ্রবণপথে পৌঁছালো রিংটোন। কলার আইডি দেখে কুঞ্চিত হলো ভ্রু যুগল। বিলম্ব না করে ফোন রিসিভ করলো ইরহাম। সালাম দিতেই ওপাশ হতে শোনা গেল নিরাশা মিশ্রিত কণ্ঠস্বর,
” ভাই! জহির আহসান জেল থেকে পালিয়েছে। ”
অনাকাঙ্ক্ষিত এই সংবাদ যথেষ্ট ছিল সাংসদ ইরহাম চৌধুরীর চিন্তার উপদ্রব বৃদ্ধি করতে। অবাকতার রেশ খুব শীঘ্রই কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হলো মানুষটি। গুরুগম্ভীর স্বরে শুধালো,
” কখন? ”
” ভো-ররাতের দিকে। ”
চক্ষু বুঁজে তপ্ত শ্বাস ফেললো ইরহাম। নিজেকে কোনোরূপ ধাতস্থ করে অসন্তুষ্ট কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,
” এতবড় বিষয়টা গোটা দিনশেষে জানানো হচ্ছে? কি করছিলে তোমরা? তোমাদের কি জানা নেই ওই জহির আহসান কেমন মানুষ? জানা নেই তার জেলে থাকাটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ? এতবড় বোকামিটা কিভাবে-কেন হলো জানতে চাইবো না। শুধু এটাই বলবো যে যেভাবেই হোক ওই লোকটার খোঁজ চাই। এই মুহূর্তে সমস্ত নেটওয়ার্ক অ্যাক্টিভেট করে দাও। ছেলেদের বলো কাজে লেগে পড়তে। তোমাদের হাতে সময় মাত্র পাঁচ ঘন্টা। অলরেডি সাড়ে সর্বনা-শ ডেকে এনেছো। ডু ইট ফাস্ট। ”
অসন্তোষজনক মুখশ্রী। কণ্ঠে আদেশের ছাপ। সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলো ইরহাম। রুস্তম চিন্তিত। কোনোরূপ সাহস সঞ্চয় করে জিজ্ঞেস করে উঠলো,
” কি হয়েছে বস? ”
” জহির আহসান জেল থেকে পালিয়েছে। ”
বিস্ময়ে বাকশূন্য রুস্তম! এরূপ অঘটন কবে কখন কিভাবে হলো! এ যে ভ-য়ানক বিপদের বার্তা বহন করছে। আহত মাং-শাসী প্রাণী পালিয়েছে খাঁচা হতে। কোনো নিরীহের প্রাণ এখন সংকটে। মাংসের স্বাদ গ্রহণ ব্যতীত শান্ত হবে কি ক্ষুধার্ত হা-য়েনা!
স্বল্প পথ অতিক্রম হলো। বেজে উঠলো রিংটোন। ইরহাম তপ্ত শ্বাস ফেলে কল রিসিভ করলো।
” হ্যালো আস… ”
আর বলা হলো না। ওপাশ হতে ভেসে এলো অনাকাঙ্ক্ষিত সংবাদ। স্নায়ুতন্ত্র তখন নিয়ন্ত্রণহারা। দিশেহারা তনুমন। কানে ঠেকে মোবাইল। তন্মধ্যে জোরালো শব্দে দ্রুত রুট বদলানোর আদেশ প্রদান করলো ইরহাম। ওপাশ হতে শোনা যাচ্ছে বিপদের বার্তা। প্রকৃত শ্রোতার ন্যায় শুনে চলেছে মানুষটি। ফুলে ফেঁপে উঠছে শিরা। লালিমা ছড়িয়ে মুখজুড়ে। রাগের বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ ঘুষি বসালো কার ডোরে। আঁতকে উঠলো রুস্তম। তবে কি সুখের দিনশেষে এলো দুর্দিন!
.
তমসাচ্ছন্ন রজনী। নিচতলার ঘরে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে হৃদি। পড়ছে অজিফা। ওড়নায় আবৃত মস্তক ও দেহের উপরিভাগ। সে মুহূর্তে বেজে উঠলো কলিংবেল। ফলস্বরূপ পড়ায় ব্যঘাত ঘটলো। উন্মুক্ত দরজা বরাবর তাকালো হৃদি। অবেলায় কে এলো? এখন তো কারোর আসার কথা নয়। দাদি বেড়াতে গিয়েছে রাহিদ ভাইয়ার বাসায়। বাড়িতে উপস্থিত শুধু তারা মা-মেয়ে ও গৃহপরিচারিকাবৃন্দ। পুরুষ সদস্যরা যথারীতি কর্মস্থলে। ঘনঘন কলিংবেল বেজে চলেছে। অস্থির হয়ে ত্বরিত বিছানা ছেড়ে নেমে এলো হৃদি। এতে বেশ চাপ সৃষ্টি হলো উদরে। যাতনায় বিকৃত হলো মুখাবয়ব। উদরে হাত চেপে সাময়িক যন্ত্রণা সয়ে নেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মেয়েটি। তবে লাভ হলো না। বসতে বাধ্য হলো বিছানার কিনারায়। আস্তে ধীরে সময় নিলো স্বাভাবিক হতে।
_
বারবার কলিংবেল বেজে চলেছে। কোথায় গেল সব? বিরক্তিকর অভিব্যক্তি করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন মালিহা। লিভিংরুমে পৌঁছাতেই চমক! সদর দরজা উন্মুক্ত করে দিচ্ছে গৃহপরিচারিকা মর্জিনা।
” কে এসেছে রে মর্জিনা? ”
বিনা বাক্যে দরজা উন্মুক্ত করে দিলো মর্জিনা। চোখের পলকে ঘরে প্রবেশ করলো কালো পোশাকধারী সাতজন। মুখোশে আবৃত মুখশ্রী। অজানা অচেনা আগুন্তককের উপস্থিতিতে যারপরানাই অবাক মালিহা! অসন্তুষ্ট কণ্ঠে মর্জিনাকে প্রশ্ন করলেন,
” এরা কারা মর্জিনা? চেনা নেই জানা নেই। যার তার জন্য দরজা খুলে দিচ্ছিস? ”
মর্জিনা কোনো জবাব দিলো না। বরং ধীরে সুস্থে সময় নিয়ে একটিবারের জন্য পিছু ঘুরে তাকালো। মালিহার পানে। সে চাহনিতে ছিল না বিশ্বাসের প্রতিদান। ছিল লালসা-বে*ইমানির অত্যন্ত নি-ষ্ঠুর সংমিশ্রন। মালিহার অন্তর ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে পড়লো। ধড়াস ধড়াস করছে অভ্যন্তর। দু চোখে ভীতি। ব্যাস। সে-ই একনজরের দেখা। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো মর্জিনা। গতিসম্পন্ন দু পা এগিয়ে চলেছে। মুহুর্তের মধ্যেই নৈঃশব্দ্যে গৃহত্যাগ করলো গৃহপরিচারিকা মর্জিনা। আগত ভ-য়ানক বিপদের আশঙ্কায় কম্পিত বুক। অস্থির হয়ে ডেকে উঠলেন মালিহা,
” মর্জিনা! এরা কারা? তুই কোথায় যাচ্ছিস? মর্জিনা? ”
বলতে বলতে দ্রুত পায়ে সদর দরজা বরাবর অগ্রসর হচ্ছিলেন মালিহা। বাঁধাপ্রাপ্ত হলেন তৎক্ষণাৎ। সম্মুখে দাঁড়ালো পালোয়ান মতো এক সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ব্যক্তি। আরেকজন বন্ধ করে দিলো সদর দরজা। পুরো বাড়ি জুড়ে পিনপতন নীরবতা। শুধু শ্বাস প্রশ্বাসের ভূতুড়ে ধ্বনি। টং টং করে শব্দ ভেসে আসছে বড় দেয়ালঘড়ি হতে। ভয়ে ওঠানামা করছে বক্ষস্থল। আসন্ন বিপদের বার্তা চট করে পৌঁছে গেল মস্তিষ্কে। মালিহার ভীতসন্ত্রস্ত দু চোখ ঘুরে বেড়াচ্ছে অজ্ঞাত আগন্তুকদের পানে। এ যেন অজ্ঞাত আগন্তুকদের আ;ক্রমণ নয়। রূপকথার গল্পের সে-ই দা;নবীয় উপস্থিতি। ত্রা”শজনক হানা।
” ক্ কে তোমরা? এভাবে ভেতরে এলে কেন? ”
জড়িয়ে যাচ্ছে কণ্ঠনালী। এলোমেলো শব্দভাণ্ডার। এক পা দু পা করে সতর্ক ভঙ্গিতে পিছপা হচ্ছেন মালিহা। দৃষ্টি নিবদ্ধ নির্বাক আগন্তুকদের পানে। কেন এত নিশ্চুপ তারা? কি চাই এ বাড়িতে? কেন এই অনাহুত আগমন! মালিহা সতর্কতার সহিত পৌঁছে গেলেন বিশালাকার সোফার পার্শ্বে। সেথায় সোফাসেটের পাশেই অবস্থিত ল্যান্ডলাইন। আগত বিপদের আশঙ্কা সত্ত্বেও সাহসীকতার পরিচয় দিলেন মালিহা। দ্রুত হাতে নম্বর চেপে যাচ্ছেন। কানে ঠেকে ফোনের রিসিভার। র:ক্তশূন্য দৃষ্টি নিবদ্ধ শত্রুর পানে। এখনো নির্লিপ্ত তারা। এই নির্লিপ্ততা যে র:ক্ত হিম করে তুলেছে। কা’মড়ে ধরছে হৃৎপিণ্ড। লাভ হলো না। টেলিফোনের মাধ্যমে কোনোভাবেই সংযোগ স্থাপন করা যাচ্ছে না। বিশালাকৃতির অভিজাত এ বাড়িতে উপস্থিত তারা মা-মেয়ে। বাকি গৃহ পরিচারিকাদের উপস্থিতি এখনো উপলব্ধি করতে পারেনি ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। তন্মধ্যে ভেতর হতে বদ্ধ সদর দরজা। অজানা শক্তিশালী শত্রুর বিপক্ষে কি করে লড়বে দুই নিরীহ নারী! মালিহা অসংখ্য বার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। হাত ফসকে পড়ে গেল টেলিফোনের রিসিভারটি। বাঁ হাত আঁকড়ে ধরলো শাড়ির আঁচল। নয়ন জোড়ায় হাহাকার আর আকুলতার বহিঃপ্রকাশ।
‘ আল্লাহ্! ‘
সারা জাহানের মালিককে স্মরণ করে চলেছেন মালিহা। নিস্তব্ধ পরিবেশে নিজ হৃদস্পন্দনের বেহাল দশা যেন নিজেই টের পাচ্ছেন। হৃদস্পন্দনের সে কি ভ:য়াল আকুতিমিনতি! তন্মধ্যে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ঘটনাটি ঘটেই গেল।
” মা কে এসেছে? ”
মেয়েলি কণ্ঠস্বর পৌঁছালো উপস্থিত আট জোড়া শ্রবণ পথে। তৎক্ষণাৎ বাঁ পাশে তাকালেন মালিহা। নিজ রুমের দোরগোড়ায় জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে হৃদি। মিসেস ইরহাম চৌধুরী! পরিচয়হীন সাতটে অসুর ত্বরিত তাকালো সে পথে। এতক্ষণে যেন তাদের আকাঙ্ক্ষিত শিকার হাজিরা দিলো! চোখের তারায় ক্রু ব্ধ ভঙ্গিতে তারা সাতজন বন্দী করে নিলো গর্ভবতী দুর্বল নারীটিকে। হৃদি মায়ের ভীতসন্ত্রস্ত মুখপানে তাকিয়ে আশ্চর্যান্বিত! মায়ের চোখের ভাষায় অজানা কোনো শব্দমালার উপস্থিতি। কি বলতে চাইছে মা! ঘটমান বর্তমান সম্পর্কে অজ্ঞাত হৃদি আস্তে ধীরে মা হতে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। অন্য কারোর উপস্থিতি অনুধাবন করে তাকালো লিভিংরুমের প্রবেশপথে। সহসা দু চোখের চাহনি পরিবর্তিত হলো। ধক করে উঠলো বক্ষস্থল। সাত জোড়া চোখের ব-র্বর চাহনি যে তার পানেই স্থির। অটল। কারা এরা! মুখোশধারী আগন্তুকদের চক্ষুদ্বয়ে শিকারকে কাছে পাওয়ার উচ্ছ্বাস পরিলক্ষিত হচ্ছে। মা’কে অস্ফুট স্বরে শুধালো হৃদি,
” এ-এরা কারা? ”
মাতৃহৃদয় তো। আগত ভ:য়াবহতার ছিটেফোঁটা আঁচ পেয়ে গেলেন। ওনার চোখের তারায় দৃশ্যমান, একটু একটু করে শ্লথ পায়ে স্নেহময়ী পুত্রবধূর পানে অগ্রসর হচ্ছে একজোড়া পা। মস্তিষ্ক ওনায় সতর্কবার্তা জারি করলো। একটুও কালক্ষেপণ না করে বাঁ হাতে শাড়ির কুঁচি আগলে যথাসম্ভব দ্রুত পায়ে ছুটে গেলেন মালিহা। গর্ভবতী পুত্রবধূর হাতটি খপ করে ধরে ফেললেন। বিলম্ব না করে দু’জনে ছিটকে প্রবেশ করলো ঘরে। ঠাস করে বদ্ধ হলো দ্বার। শত্রুপক্ষ ও শিকারের মাঝে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো বদ্ধ দরজাটি। এতেই ভঙ্গ হলো শত্রুর নির্লিপ্ততা। আকস্মিক কাণ্ডে তারা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার পূর্বেই সবটা ঘটে গেল। তৎক্ষণাৎ স্বরূপে ফিরে এলো সাতজন। ছুটে গেল দরজা বরাবর। অনবরত আঘাত করতে লাগলো দরজায়। হাত-পা উভয়েই আঘাত করে চলেছে বদ্ধ দরজায়। অশ্রা:ব্য ভাষায় গা-লিগালাজ করছে তারা। দরজা খুলতে হিং স্র আদেশ প্রদান করছে।
_
ভিড়িয়ে রাখা দ্বার উন্মোচন করে দ্রুতগামী উল্কার বেগে অন্দরমহলে প্রবেশ করলো ইরহাম। থমকালো সম্মুখের দৃশ্যপট দেখে! দু চোখে বিস্ময়ের আস্তরণ!
চলবে!
#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৩০ ( শেষাংশ )
[ কঠোরভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য উন্মুক্ত ]
ভিড়িয়ে রাখা দ্বার উন্মোচন করে দ্রুতগামী উল্কার বেগে অন্দরমহলে প্রবেশ করলো ইরহাম। থমকালো সম্মুখের দৃশ্যপট দেখে! দু চোখে বিস্ময়ের আস্তরণ! সে মুহূর্তে ডান পাশে এসে হাজির হলো রুস্তম।
” বস! ”
ঘোর কেটে গেল। একটুও তাকালো না রুস্তমের পানে। বরং বড় বড় কদম ফেলে সম্মুখে অগ্রসর হলো ইরহাম। বিপরীতে থাকা মানুষগুলোও তখন বিস্ময়কর চোখে তাকিয়ে! ভাইয়া এখানে! কে জানালো তাকে? সামনাসামনি এসে দাঁড়িয়েছে ইরহাম। অশান্ত কণ্ঠে শুধালো,
” তোরা ঠিক আছিস তো? ”
র-ক্তাক্ত অবস্থা। বাঁ হাতের বাহুতে সদ্য প্রাথমিক চিকিৎসা গ্রহণের নিশানা। কপালের ডান পাশ ফুলে রয়েছে। আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ায় র’ক্তিম আভা দৃশ্যমান। রাহিদের বাম পাশেই দাঁড়িয়ে বিচলিত সঙ্গিনী ইনায়া। পল্লবী, রায়না ও রাজেদা খানম আরেক পাশে দাঁড়িয়ে। রাহিদ অবাকতার রেশ কাটিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো,
” ভাইয়া তোমরা এখানে? কে খবর দিলো? ইনু? আমি বলেছিলাম এটা জাস্ট একটা মাইনর অ্যা:ক্সিডেন্ট তারপরও… ”
রাহিদ তার জীবনসঙ্গিনীর পানে অসন্তুষ্ট চাহনিতে তাকিয়ে। বারবার নিষেধ করেছিল। বলেছিল ছোটখাটো দু;র্ঘটনার কথা বলে ও বাড়ির লোকেদের অহেতুক উদ্বিগ্ন করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু মেয়েটা তা শুনলে তো? ঠিক বড় ভাইকে জানিয়ে দিলো! রাহিদ যখন একাকী বকবক করে চলেছে তখন নিরূদ্ধ ইরহাম চৌধুরীর কর্ণ গহ্বর। মস্তিষ্কে চলছে ন্যানো সেকেন্ড ব্যাপী ক্যালকুলেশন। প্লাস মাইনাস প্লাস মাইনাস। শত সহস্র হিসাবের আনাগোনা। অত্যধিক ক্ষুদ্র মুহুর্তের মধ্যেই হিসাব মিলে গেল। উচ্চরবে বিদীর্ণ হলো মস্তিষ্ক। একফোঁটা শব্দ ব্যয় ব্যতীত ক্ষি প্র গতিতে পিছু ঘুরে সদর দরজা বরাবর ছুটলো ইরহাম। চোখের পলকে বেরিয়ে গেল ফ্লাট হতে। দেখাদেখি বাধ্য অনুচরের ন্যায় পিছু ছুটলো রুস্তম। সকলে আশ্চর্যান্বিত চাহনিতে তাকিয়ে! এ কি থেকে কি হলো? হাওয়ার বেগে আকস্মিক উদয়! অতঃপর প্রস্থান! কিসের সংকেত এ উদ্ভ্রান্ত প্রস্থান ও বিচলতা!
_
বদ্ধ দরজায় একাধারে আঘাত। ওপাড়ে লুকানো দুই দুর্বল হৃদয়ের অধিকারিণী ক্ষণে ক্ষণে কম্পিত। ঘর্মাক্ত দেহের করুণ দুর্দশা। হৃদি ভীতগ্ৰস্থ স্বরে কয়েকবার মা’কে জিজ্ঞেস করে ফেলেছে কে এরা। কি তাদের পরিচয়? কিন্তু জবাব দিতে ব্যর্থ মালিহা নামক নারীটি। ওনার হাতে মোবাইল। অনবরত একমাত্র পুত্রকে ফোনে সংযোগ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কখনোবা স্বামীকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কাউকে ফোনে পেলেন না। নেটওয়ার্ক প্রবলেম ওনায় বিশ্রীভাবে পরাজিত করলো। চরম ব্যর্থতায় অশ্রুসিক্ত দু নয়ন। আকুল নয়নে গর্ভবতী পুত্রবধূর পানে তাকালেন মালিহা। দুর্বল মেয়েটি তখন ওনার ডান হাতটি আঁকড়ে। মায়া মায়া ভেজা চোখে তাকিয়ে। এতক্ষণে অনুধাবন করতে পেরেছে বিপদের মাত্রা। তাই তো ভয়ে নিশ্চুপ। আঁকড়ে ধরে ভরসাযোগ্য হাতটি। ওনার ছেলের জান এই পাগলী-চঞ্চলা-সুহৃদ মেয়েটি। চৌধুরী বংশের উত্তরাধিকারদের হবু মা। তার গায়ে কি করে বিন্দুতুল্য আঁচড় লাগতে দিতে পারেন উনি? উনি যে মা। মাতৃরূপী এক সিংহী। বিপদের মুখে গর্জে উঠতে পারে যে সত্তা। হৃদির ভীত মুখপানে তাকিয়ে জোরপূর্বক হালকা হাসলেন মালিহা। ঘামে ভেজা কপালে চুমু এঁকে দিলেন। মমতাময়ী হাত বুলিয়ে দিলেন বাম গালে। মিহি স্বরে বললেন,
” আমার হৃদি মা! ভয় পাস না কেমন? আল্লাহ্’কে ডাকতে থাক মা। উনি আছেন। নিশ্চয়ই বান্দার বিপদে একমাত্র রক্ষাকারী উনি। ”
হৃদি ভেজা কণ্ঠে কিছু বলার পূর্বেই সরে গেলেন মালিহা। দৃষ্টি স্থির হলো দরজায়। অবিরাম আঘাতে আঘাতে কম্পমান দরজাটি। যেকোনো মুহূর্তে দরজার লক ভাঙ্গবে। হানা দেবে শত্রুর দল। তাদের মোকাবেলায় প্রস্তুতি যে বড় দরকার। অশ্রুসজল দু চোখ এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে লাগলো। প্রতিরক্ষার তরে প্রয়োজন অতীব ভারী কিংবা শক্তিশালী কিছু। মায়ের চাহনি ও দরজায় আঘাতের প্রবলতা। হৃদি নিজেও আত্মরক্ষার জন্য কিছু খুঁজতে লাগলো। খোঁজাখুঁজিতে লিপ্ত দু নারী। অকস্মাৎ বে-ইমানি করলো পরিস্থিতি। লক ভেঙ্গে ছিটকে পড়লো মেঝেতে। কর্ণ গহ্বরে ঝড়ো আঘাত হানলো সে শব্দ। হুড়মুড় করে ভেতরে প্রবেশ করলো সাত সাতটে দা-নব। তাদের র-ক্তচক্ষু ঘুরে বেড়াচ্ছে এদিক ওদিক। কোথায় লুকিয়ে নরমধরম দুর্বল শিকার! অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ হলো না। অকস্মাৎ দরজা নিকটস্থ দণ্ডায়মান এক দু:র্বৃত্তের মাথা বরাবর জোরালো আঘাত করলেন মালিহা। আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে হাত চেপে যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠলো লোকটি। ত্বরিত পুত্রবধূর হাতটি আঁকড়ে একপ্রকার ছুটে ঘরের উন্মুক্ত দরজা পেরিয়ে বেরিয়ে গেলেন মালিহা। শত্রুরা তা টের পেতেই চরম ক্ষে-পে উঠলো। পিছু নিলো তৎক্ষণাৎ। ছয় মাসের গর্ভবতী হৃদির জন্য ছোটাছুটি করা বড় কষ্টদায়ক ছিল! উদরে চেপে বসেছে বাম হাত। যাতনায় ক্লি’ষ্ট গোটা দেহ। বিকৃত মুখশ্রী। তবুও থেমে নেই ছোটাছুটি। মায়ের সঙ্গ দিয়ে প্রাণ বাঁচাতে ছুটছে মেয়েটি। অধর নড়ে রবের স্মরণে।
বদ্ধ সদর দরজা বরাবর ছুটে চলেছে দু’টো প্রাণ। বারবার পিছু ঘুরে দেখে নিচ্ছে শত্রুর অবস্থান। ক্ষি প্র গতিতে ছুটে আসছে তিনজন। একজনের হাতে বন্দী শোপিস। আকস্মিক নিশানা তাক করে ছুঁড়ে দিলো শোপিসটি। শিউরে উঠলো অন্তর। দ্রুততার সহিত মায়ের বাঁ বাহু ধাক্কা দিয়ে তাকে ওপাশে সরিয়ে দিলো হৃদি। আকস্মিক ধাক্কা খেয়ে হুড়মুড়িয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন মালিহা। হাওয়ায় দু হাত ছুঁড়ে কোনোরূপ ভারসাম্য বজায় রাখতে সক্ষম হলেন। আর মেঝেতে সশব্দে আছড়ে পড়লো ভারী শোপিসটি। আরেকটু হলেই সে শোপিস আঘাত হানতো মালিহার কোমল দেহে। মাঝবয়সী নারীটি কি পারতেন তা সইতে? পারতেন না। মালিহা একনজর শত্রুর অবস্থান অবলোকন করে চঞ্চল পায়ে হৃদির পানে ছুটে এলেন। হাতটি আঁকড়ে ধরে ছুটতে লাগলেন দরজার পানে। যে করেই হোক বদ্ধ দ্বার উন্মোচন করে পালাতে হবে। দৌড়ানোর এক ফাঁকে মালিহা পিছু ঘুরে হাতে থাকা কিছুক্ষণ পূর্বে আয়ত্ত্ব করা ফ্লাওয়ার ভাসটি সর্ব নিকটে অবস্থিত শত্রুর উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিলেন। চতুরতার সহিত নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হলো শত্রুটি। দু হাতে লুফে নিলো ফ্লাওয়ার ভাস। এবার কি হবে? মালিহা ও হৃদির পদযুগলের গতিবেগ আরো বৃদ্ধি পেল। দরজা হতে মাত্র কয়েক ইঞ্চির দূরত্ব। ঠিক সে মুহূর্তে ব্যর্থতা। পেছন হতে হৃদির উন্মুক্ত চুল মুঠোবন্দী করে টেনে ধরলো এক দু:র্বৃত্ত।
” আঃ… ”
যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠলো হৃদি। বিষাদময় মুখশ্রী। লহমায় মায়ের মমতার স্থল হতে তার ঠাঁই হলো শত্রুর নৈকট্যে। ব্যাকুল চোখে তাকিয়ে মালিহা। ওনার চোখের সামনে ধরাশায়ী গর্ভবতী পুত্রবধূ। মেয়েটার চুলের মুঠি শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরে একজন। যাতনায় চোখমুখ লাল। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে চলেছে মেয়েটি। সীমাহীন যন্ত্রণা উদরে। কিক মে রে চলেছে অনাগত দু সন্তান। একত্রে তাদের উদরে আঘাত। হবু মা হৃদি এই দ্বৈত যন্ত্রণা সইতে ব্যর্থ। শরীর ভারসাম্য ছেড়ে দিচ্ছে যেন। শ্বাস প্রশ্বাসে প্রতিবন্ধকতা। দমবন্ধ হয়ে আসছে। গোটা মুখ জুড়ে কষ্টের ছাপ। চোখের সামনে এই অনাচার আর সহ্য করা গেল না। ছুটে এলো মাতৃরূপী সিংহী। শত্রুর হাতে অনবরত চ ড় মে;রে চলেছেন মালিহা। মেয়েকে ছেড়ে দিতে বলছেন। ওদের কর্মে বাঁধা প্রদান করছেন। কিন্তু শত্রুর দল তা শ্রবণ করলে তো! এক বলবান ধাক্কায় মালিহাকে দূরে সরিয়ে দিলো সে জন। আকস্মিক ধাক্কায় ভারসাম্য বজায় রাখতে ব্যর্থ হলেন মালিহা। আছড়ে পড়লেন মেঝেতে। দু কনুই আঘাতপ্রাপ্ত হলো মেঝের সনে। যন্ত্রণায় মুখনিঃসৃত হলো আর্তনাদ। দু চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো অশ্রুজল। হৃদি এই দুঃখপূর্ণ দৃশ্য অবলোকন করে মৃদু স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো,
” মা-হ্! ”
_
রাতের রাজধানী ঢাকা। স্বাভাবিক ভাবেই রাস্তাঘাটে যানজটের আধিক্য। একটুখানি নড়তে নারাজ যানবাহন। একজায়গায় অনড় দাঁড়িয়ে। চারিধারে হচ্ছে ধূলোমাখা বাতাসের দ্রুত আবর্তন। এ যানজটপূর্ণ সড়ক অতিক্রম করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা মানে, নিজের পায়ে নিজে কু;ড়াল দিয়ে আঘাত করা। লম্বা যানজট হতে স্বল্প দূরত্বে সড়কের এক পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে গাড়িটি। চালকের আসনে বসে এক দীর্ঘকায় পুরুষ। তীক্ষ্ণ চাহনিতে যান্ত্রিক ডিভাইসে তাকিয়ে মানুষটি। মোবাইলে দেখে নিচ্ছে গুগল ম্যাপ। কম্পিত চিত্ত আর গাড়ির স্টিয়ারিং আঁকড়ে ধরা হাত। গুগল ম্যাপের খুঁটিনাটি তথ্যাদি আয়ত্ত্ব করে নিলো বুদ্ধিদীপ্ত মানুষটি। সুদক্ষ হাতে ইউ টার্ন নিচ্ছে গাড়ি। বাঁ হাতে মোবাইল। অবিরাম কল করে চলেছে বাড়িতে। মা ও স্ত্রীকে। কিন্তু বরাবরের মতই সংযোগ স্থাপন করতে ব্যর্থ। শান্ত-স্থির মুখে আজ অত্যধিক কঠোরতা। সর্বোচ্চ গতিতে শর্টকাট রূট ধরে এগিয়ে চলেছে গাড়িটি। অন্তরীক্ষে আজ ঘন মেঘের অস্তিত্ব। ক্ষণে ক্ষণে চারিধার আলোকিত হচ্ছে ব’জ্রপাতের আগুন ঝলকানিতে। শোঁ শোঁ বাতাসের অবাধ্যতা রাজত্ব করে চলেছে এলাকা জুড়ে। গগনবিদারী গর্জন করে উঠছে মেঘ। শ্রবণপথ ফেটে যাবার উপক্রম। তন্মধ্যে নির্ভীক চিত্তে ক্ষি-প্রতার সহিত ধেয়ে যাচ্ছে শুভ্র রঙা গাড়িটি। বাবাকে ইতিমধ্যে ইনফর্ম করা হয়েছে। উনিও যাচ্ছেন বাড়ি। দুর্ভাগ্যক্রমে ‘ আনন্দাঙ্গন ‘ এ পাহারারত দেহরক্ষীরা সকলে আউট অফ রিচ। কোনোমতেই যোগাযোগ করা সম্ভব হলো না। ইয়া রব! এ কোন সর্বনা’শা তুফানের আগমনী বার্তা! রক্ষা করো তুমি।
_
দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ভীতসন্ত্রস্ত দেহটি। দু চোখে প্রকট আতঙ্ক। একটুখানি ছাড় দেয়ার তীব্র আকুতি। ঘর্মাক্ত মুখে লেপ্টে মুক্ত-স্বাধীন চুল। কিয়ৎক্ষণ পূর্বে দেখানো অভাবনীয় দুঃসাহসিকতা তাকে বিন্দুতুল্য ছাড় দিলো না। মায়াদয়া দেখালো না সে দু;র্বৃত্ত। মাথাটা পুনরায় জোরালো রূপে ঠুকে দিলো দেয়ালে। ত্বরিত র-ক্তপাত ক্ষতস্থান হতে। ভনভন করে উঠলো মস্তিষ্ক। লোপ পাচ্ছে বোধবুদ্ধি। আঁধার ঘনিয়ে আসছে দু চোখের তারায়। তবুও স্বাভাবিক থাকার সে কি প্রবল চেষ্টা! আস্তে ধীরে দেয়াল ঘেঁষে ঠাস করে মেঝেতে বসে পড়লো অন্তঃসত্ত্বা হৃদি। ব্যথায় জর্জরিত গর্ভধারণকৃত দু সন্তান। আর্তনাদ করে রব’কে ডেকে উঠলো হৃদি। কপালের পাশে, হাতে পায়ে ছোট-বড় আঘাতের ছাপ। এতক্ষণ সর্বোচ্চ লড়াই করার চেষ্টা করে গিয়েছে মা ও মেয়ে। আহত সিংহীর ন্যায় ফুঁসে উঠেছে মালিহা। আঘাতে আঘাতে চুরমার করে দিয়েছে ক’জনকে। তাই তো এই আ;ক্রমণাত্মক কঠোরতা। নির্মম-বর্বরতা। র-ক্তে রঞ্জিত মালিহার মুখাবয়ব এবং দু হাত। টলে উঠছে দেহ। শক্তপোক্ত চারটে হাত আঁকড়ে ধরে দুই পাশ হতে তার দু হাত। টালমাটাল নারী শরীর ভারসাম্য হারিয়ে লুটিয়ে পড়তে চাইছে। স্বল্প ঝুঁকে নিম্নগামী। ঝিঁঝিঁ পোকার আ:ক্রমণ যেন মস্তিষ্কে। ‘ আনন্দাঙ্গন ‘ এ আজ সর্বনা”শের করাল গ্রা স। সাত নয় উপস্থিত এখন আটটি দ স্যু। কিয়ৎক্ষণ পূর্বে আগমন হয়েছে সর্বশেষ জনের। বাকিদের ন্যায় সে-ও অজানা অচেনা একজন। কে এরা? কারা পাঠিয়েছে তাদের? নেই জানা।
আহত হৃদি শত্রুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সে নভোনীল চক্ষুদ্বয় যে তাকে হারতে শেখায়নি। শিখিয়েছে শত্রুর বিপক্ষে লড়তে। মনোবল বৃদ্ধি করতে। ভেঙ্গে চুরমার নয় নতুন উদ্যমে বাঁচতে। আত্মপ্রত্যয়ী হৃদি সমস্ত যন্ত্রণাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে আঁকড়ে ধরার চেষ্টায় দেয়াল। নখ যেন ডেবে যেতে চাইছে শক্তপোক্ত কঠিন দেয়ালের আস্তরণে। দু পা ভেঙ্গে আসছে। অন্তঃসত্ত্বা উদর কয়েক মণ ওজনের ভারী ঠেকছে। অভ্যন্তরে বি;দ্রোহ করছে দু সন্তান। তরল র’ক্তিম বিন্দু গড়িয়ে পড়ছে কপাল বেয়ে চিবুক। সেথা হতে গলদেশ। দু চোখ বুঁজে আসতে লড়াই করছে। তবুও নিজের বিরুদ্ধে নিজেই রুখে দাঁড়িয়েছে হৃদি। বেশ কিছুটা সময় ব্যয় করে আস্তে ধীরে উঠে দাঁড়াতে সক্ষম হলো। একটু পরপর মুখনিঃসৃত হচ্ছে আর্তনাদ। চিড়চিড় ব্যথা সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে। দু চোখ ছাপিয়ে নামছে নোনাজল। ঘাম-রক্ত-অশ্রুবিন্দুর সংমিশ্রণে ভেজা মুখশ্রী। শত্রুর দল দু চোখ জুড়িয়ে উপভোগ করে চলেছে এই দৈন্যদশা। শিকারের ছটফটানি। বাঁচার তীব্রতর আকুতিমিনতি। লহমায় তাদের অভিব্যক্তি ভ:য়াবহভাবে পরিবর্তিত হলো। কিয়ৎক্ষণ পূর্বে আগত সর্বশেষ দু:র্বৃত্ত দাঁড়িয়ে হৃদি বরাবর। স্বল্প দূরত্ব তাদের মাঝে। ক্রো-ধান্বিত চোখ স্থির পরাজিত হৃদির পানে। ডান হাতটি ডান পাশে বাড়িয়ে দিলো সে নরাধম। পাশ হতে একজন হাতের তেলোয় স্থাপন করলো একটি ট্রি-এজ ড্যাগার ( tri edge dagger). ট্রি-এজ ড্যাগার হল একটি ভ’য়ানক ছু-রি যার তিনটি কাঁটাযুক্ত কাটিং প্রান্তগুলো একটি সর্পিল-সদৃশ নকশায় বাঁকা। সে অজ্ঞাত শত্রুর হাতে প্রায় সাত ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের ছু-রি। শিকারী জ্বলজ্বলে চক্ষু স্থির হৃদির স্ফীত উদর বরাবর। আর মাত্র ক্ষণিকের অপেক্ষা। পুরোদস্তুর চূর্ণ বিচূর্ণ হবে চৌধুরী।
আশপাশে সব স্থির। নিশ্চুপ। মালিহার করুণ-ভীতিকর দৃষ্টি শত্রুর হাতে আবদ্ধ ছু-রি এবং পুত্রবধূর পানে। একটু একটু করে ধেয়ে আসছে ছু-রিটি। আর মাত্র কয়েক সেকেন্ডব্যাপী দূরত্ব। লহমায় অন্ত হবে সব। প্রাণ হারাবে…! নাহ্! কোমল মাতৃহৃদয় এই নি-ষ্ঠুর পরিণতি মানতে নারাজ। ওনার দু হাত আঁকড়ে ধরা শত্রুরা এখন বিনোদন লাভে মগ্ন। তাই তো দুর্বল গ্ৰিপ। সুযোগের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করলেন মালিহা। এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিলেন নিজ হাত। দুর্বল দেহে যথাসাধ্য সর্বোচ্চ গতিতে ছুটলেন পুত্রবধূর পানে। হৃদি তখন ভীতসন্ত্রস্ত নয়নে তাকিয়ে শত্রুর পানে। যেন অদৃশ্য এক ক্ষমতাবলে ব-শীভূত। একফোঁটা নড়তে ব্যর্থ। সে দেখছে। চোখের সামনে মৃ-ত্যু দেখছে। অন্তরাত্মা চিৎকার করে চলেছে। আকুতিমিনতি বাঁচার। আন্তঃযন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে দেহ। চোখের তারায় দৃশ্যমান আপনজনেরা। তার একান্ত পুরুষ। স্লাইডের ন্যায় ঘূর্ণায়মান দৃশ্যপট। আপনজনের মুখশ্রী। আস্তে ধীরে একসময় বুঁজে গেল অক্ষিপুট। চূড়ান্তভাবে পরাস্ত হয়ে বরণ করে নিলো ম:রণকে।
‘ লা ইলাহা.. ‘
অস্ফুট স্বরে মাত্র এতটুকু পাঠ। হঠাৎই মস্তিষ্কে এক আগ্রা”সী ধাক্কা। ছলকে উঠলো অন্তঃপুর। দেহ ঘেঁষে এক কোমল সত্তার অস্তিত্ব। তৎক্ষণাৎ চক্ষু মেলে তাকালো হৃদি। বিস্মিত দু চোখ! গগনবিদারী চিৎকার করে উঠলো হৃদি,
” মা!! ”
পুত্রবধূকে সময়মতো সরাতে বিফল হলেন মালিহা। অজানা ভয়ে ব-শীভূত হয়ে কখন যে নিজেই ছু-রির আঘাতে বিহ্বল হলেন টেরও পেলেন না। ট্রি-এজ ড্যাগারের ঝাঁকড়া কাটা প্রান্তগুলি হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করলো ওনার পেটে। নিষ্ঠুর-নির্মম পন্থায় মোচড়ে চলেছে পেট গহ্বরে। শত্রুরূপী লোকটির একমাত্র নিশানা ছিল হৃদি ও তার অনাগত সন্তানেরা। তাই তো হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে ব:র্বর আঘাত করতে উদ্যত হলেন। তবে এ কি হয়ে গেল! কার পেটে বি দ্ধ হলো ছু-রি! বিস্ময়ে হতবুদ্ধি লোকটি তখনও ছু-রি মোচড়ে চলেছে পেটে। সীমাহীন যন্ত্রণা। আর্তনাদ। তবুও পুত্রবধূকে বাঁচানোর সর্বোচ্চ প্রয়াস। ধাক্কা দিয়ে পেছন হতে হৃদিকে সরিয়ে দিলেন মালিহা। যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠছেন। নিজেকে বাঁচাতে আঁচড় কেটে চলেছেন শত্রুর মুখ ও গলদেশে। তাতেই হলো অবিশ্বাস্য কাণ্ড! নি”কৃষ্টতম বিপদের মূহুর্তে শত্রু রূপে এ কার উন্মোচন! মুখোশ অর্ধ অনাবৃত হলো নখের ধারালো আঁচড়ে। দৃশ্যমান মুখ।
” ভা ই য়া! ”
অতীব ক্ষীণ স্বর জোরদার ধাক্কা দিলো শ্রবণপথে। হতবিহ্বল জহির! নিজ হাতে আপন ছোট বোনকে ছু-রিকাঘাত করে বসলো সে! করে বসলো সর্বঘৃণ্য কুকর্ম! কাঁপলো গগন। কাঁদলো মেঘ। ঝমঝমিয়ে বর্ষণ ধরনীর বুকে। মৃ-ত্যুর নৈকট্যে এ কার মুখ দেখে নিলেন মালিহা! এই বেঈমান-ক্রুর মুখদর্শন বিনা অন্তত শান্তির মৃ-ত্যু হতো। এখন যে ম-রেও নেই শান্তি। শেষমেষ পিতৃতুল্য বড় ভাইয়ের হাতেই লেখা ছিল এই বিয়োগান্তক পরিণতি ! জহিরের অদ্ভুতুড়ে অবস্থা দেখে শ’ত্রুদের দলনেতা এগিয়ে এলো। কেড়ে নিলো র-ক্তমাখা ট্রি-এজ ড্যাগার। ধাক্কা দিয়ে একপাশে সরিয়ে দিলো জহিরকে। নিজেই একাধারে ছু-রিকাঘাত করতে লাগলো মালিহার পেটে। এই *** কম জ্বালাতন করেনি তাদের। এতক্ষণ বহুত জ্বালিয়েছে। এবার শোধ নেয়ার সময়। একবার দুইবার তিনবার। পরপর আটবার ছু;রি নামক সাত ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের মা র ণা স্ত্র আ-সুরিক পন্থায় গেঁথে গেল পেটের চামড়া ভেদ করে। গলগলিয়ে র-ক্তক্ষরণ হচ্ছে ক্ষত হতে। কণ্ঠনালী ছিন্নভিন্ন করে বেরিয়ে আসছে র-ক্তলাল তরল। আস্তে ধীরে অনুত্তেজক অবস্থা। স্বল্প সময়ের মধ্যেই নৃ:শংস ভাবে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো নারী দেহটি। র-ক্তলাল মেঝেতে সে এক র-ক্তাক্ত দেহ লুটিয়ে। কয়েক হাত দূরে মেঝেতে পড়ে হৃদি। যন্ত্রণায় নীল মুখাবয়ব। নিম্না-ঙ্গ গড়িয়ে তরল বইছে। ভাঙ্গা স্বরে চিৎকার করে চলেছে। অনবরত মুষ্টিবদ্ধ হাত আঘাত করে চলেছে মেঝেতে।
” মা! ও মা! ”
সে কি গগনবিদারী আর্তনাদ! চরম ব্যর্থতায় ক্লিষ্ট মেয়েটি মেঝেতে আঘাত করে ক্ষতবিক্ষত করছে হাত। ছুটে যেতে চাইছে মায়ের পানে। মেঝেতে সরীসৃপের ন্যায় এঁকেবেঁকে যাচ্ছে হাত। আঁকড়ে ধরতে চাইছে মমতাময়ী মায়ের ভালোবাসাময় হাত। চোখের সামনে গলাকা-টা মুরগির ন্যায় ছটফট করে চলেছে মা। র-ক্তে ভেসে যাচ্ছে শুভ্র রঙা মেঝে। অতীব ক্ষীণ নড়ছে অধর। কালিমা পাঠ করলো কি? মাত্র কয়েক মিনিটের অপেক্ষা। হঠাৎই নিশ্চুপ সারা ঘর। বন্ধ সমস্ত ছটফটানি। যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট খোলা চক্ষুদ্বয় নিবদ্ধ পুত্রবধূর পানে।
” মা…! ”
সর্বোচ্চ কণ্ঠে এক চিৎকার। আর মুখ বরাবর লা থ। নিস্তেজ হয়ে পড়লো হৃদি। ততক্ষণে হুঁশ ফিরলো জহির নামক অন্তঃশত্রুর। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বোনের নিথর দেহে। ক্রু-দ্ধ এক দু;র্বৃত্ত দুর্দান্ত শিকারের আশায় ছুটে আসছে হৃদির নিষ্প্রভ দেহপানে। তখনই আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে হলো ব”জ্রপাত। শ্রবণপথে গাড়ির হর্নের তীব্র জ-খম। ত্বরিত সতর্ক হয়ে উঠলো সব।
_
ঘন অমানিশায় ছেয়ে বসুন্ধরা। ভারী বর্ষণে রাজধানীজুড়ে সাধারণ জীবনযাপনে ব্যাঘাত। আনন্দাঙ্গন চত্বরে আলোকগতিতে থামলো শুভ্র গাড়িটি। কোনোরূপ বিলম্ব ব্যতীত ভারী বর্ষণে সিক্ত হয়ে বাড়ির অন্দরে ছুটলো ইরহাম। উন্মুক্ত রয়ে গেল কার ডোর। একদিকে সহায়তার হাতছানি সমেত প্রবেশ করছে ইরহাম। অন্যদিকে বাড়ির পেছন দিক হতে পলায়ন করছে দু;র্বৃত্তরা। একজন আঁকড়ে ধরে বোধশূন্য জহিরের কালো পোশাকের কলার। টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে এই আপদটিকে। স্বল্প সময়ের মধ্যেই চতুরতার সহিত পলায়ন করলো শত্রুর দল। ততক্ষণে অঘটন যা ঘটার ঘটে গিয়েছে। এ রাত চৌধুরীদের ইতিহাসে এক অনাকাঙ্ক্ষিত কল-ঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে চিরতরে গেঁথে রইবে। সে কি নির্মম-বর্বরতা!
চলবে.