মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি ২ পর্ব-২৫+২৬

0
666

#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_২৫

” কথা দাও। কখনো কারোর বাজে মন্তব্যে ভেঙ্গে পড়বে না! তুমি জানো, আমি জানি, আল্লাহ্ জানে তুমি পবিত্র। নিষ্কলঙ্ক। শত্রুর কু ছায়া অবধি তোমায় ছুঁতে পারেনি। তবে কেন লোকেদের কথায় কান দেবে? পাছে লোকে কত কি বলে। সব শোনা তো আমাদের জন্য আবশ্যক নয়। তাহলে কেন শুনবো আমরা? ওরা দু’টো বাজে বকলে আমরা তিনটে ভালো বলবো। বুক ফুলিয়ে সত্য বলবো। কারণ আমরা জানি আমরা সঠিক। ভুল নই। তবে কেন পাছে লোকে ভয়? বি স্ট্রং। গোটা দুনিয়া ভার মে যাক। জেনে রেখো তোমার স্বামী ও পরিবার রয়েছে তোমার পাশে। উই আর অলওয়েজ উইথ ইয়্যু মাই গার্ল। ডোন্ট বি উইক। ”

স্বামীর মুখনিঃসৃত প্রতিটি অনুপ্রেরণাদায়ক শব্দমালা হৃদয় ছুঁয়ে মস্তিষ্কে গেঁথে গেল। সীমাহীন ভালোলাগায় বক্ষপিঞ্জরের অন্তরালে লুকায়িত প্রণয় উদ্যান হতে মিষ্টিমধুর গুঞ্জন ভেসে আসছে। চোখেমুখে উজ্জ্বলতা। এক বুক গর্ব জীবনসঙ্গীর জন্যে। আবেগে আপ্লুত তনুমন। কম্পিত ওষ্ঠাধর। অক্ষিকোল গড়িয়ে অশ্রু নামলো গালে। হৃদি বিন্দুমাত্র কালক্ষেপণ না করে স্বামীর প্রশস্ত বক্ষপটে আছড়ে পড়লো আগ্রাসী ঢেউয়ের ন্যায়। পেলব দু হাত আঁকড়ে ধরলো পিঠ। পুরোপুরি মিশে যেতে চাইছে বক্ষস্থলে। প্রবেশ করতে চাইছে একান্ত মানুষটির মনের অরণ্যে। সেথায় অসংখ্য প্রেমময় বৃক্ষরাজির ভীড়ে সাজাবে এক ছোট্ট সুখের আবাসন। ইরহামও নিজের সনে আঁকড়ে ধরলো স্ত্রীকে। উষ্ণ আলিঙ্গনে আবদ্ধ কপোত-কপোতী। বদ্ধ দু’জনার আঁখি পল্লব। কর্ণপাত হচ্ছে হৃদযন্ত্রের মধুরতম স্পন্দন লাব ডাব। লাব ডাব। আবেগের আতিশয্যে স্বামীর ডান কাঁধের ত্বকে ক্ষুদ্র পরশ অঙ্কন করলো হৃদি। শিউরে উঠলো ইরহাম। অনুভূতির স্ফু’লিঙ্গ জ্ব’লে উঠলো মনের অরণ্যে। লাগামছাড়া হলো সত্তা। শক্তপোক্ত দু’টো হাত অর্ধাঙ্গীকে পূর্বের চেয়ে আরো গাঢ় আলিঙ্গনে নিজের সনে আগলে নিলো। তপ্ত শ্বাস প্রশ্বাস ছুঁয়ে যাচ্ছে কাঁধের উন্মুক্ত ত্বক। বাহুডোরে আবদ্ধ মেয়েটি মৃদু শিহরিত হলো। একান্ত পুরুষ তখন মত্ত প্রেমার্দ্র পরশে। বাঁ কাঁধ হতে সরে গিয়েছে কেশগুচ্ছ। অবলীলায় সেথায় অঙ্কিত হচ্ছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরশ। ইরহামের একটি হাত ঘুরে বেড়াচ্ছে অর্ধাঙ্গীর কটিদেশ। তরঙ্গ বয়ে যাচ্ছে শিরদাঁড়া বরাবর। আবেশে নখ ডেবে গেল স্বামীর পৃষ্ঠে। গলদেশে গাঢ় স্পর্শ এঁকে একটুখানি দূরত্ব সৃষ্টি করলো ইরহাম।

শিহরিত মেয়েটির দৃষ্টি অবনত। ঘন ঘন পড়ছে শ্বাস। তপ্ত শ্বাস ফেলে হাত বাড়িয়ে দিলো মানুষটি। পরম স্নেহে দু হাতের অঞ্জলীতে ভরে নিলো স্ত্রীর সুশ্রী-মায়াবী বদন। অপলক নেত্রে তাকিয়ে রইলো। উপভোগ করে চলেছে অর্ধাঙ্গিনীর লাজে রাঙা অক্ষিপল্লবের ঝাপটানি। নাকের ডগায় এক টুকরো লালিমার ছোঁয়া। শিহরিত ওষ্ঠাধরের কম্পন। সেথায় দৃষ্টি নিবদ্ধ হতেই বিস্তীর্ণ মরুর ন্যায় খাঁ খাঁ করে উঠলো গণ্ডস্থল। বারকয়েক শুকনো ঢোক গিলে নিলো ইরহাম। তবুও অশান্ত অন্তঃস্থল। মিলছে না বিন্দুমাত্র স্বস্তি। অভেদ্য সে আকর্ষণে ব’শীভূত সত্তা। নিজেকে সামলানো বড় দুষ্কর। অত্যধিক আবেগী স্বরে ডেকে উঠলো মানুষটি,

” হৃদি! ”

কর্ণ গহ্বরে যেন এক পশলা স্বস্তি হয়ে ঝরে পড়লো শ্রাবণ ধারা। হৃদি তাকালো স্বামীর পানে। সে চাহনিতে ছিল ভরসা। এক বুক ভালোবাসা। আর নিজেকে সমর্পণ করার নৈঃশব্দ্য অনুমোদন। শব্দহীন ভাষাটুকু ঠিক উপলব্ধি করতে পারলো ইরহাম। দু গালে স্থাপিত হাত দু’টো আরেকটু গাঢ় হলো। নিজের মুখ বরাবর নৈকট্যে নিয়ে এলো মায়াময়ীর মুখখানি। লজ্জালু বদনপানে তাকিয়ে সম্মোহনী স্বরে বলে উঠলো,

” নিস্তব্ধ এ রাত। সাথে একান্ত নারীর সান্নিধ্য। হৃদয়ে জেঁকে বসেছে অপরিসীম তৃষ্ণা। তোমার প্রণয় আকণ্ঠ পান করার তৃষ্ণা। ও হৃদরাণী! দেবে কি হৃদয়ের তৃষ্ণা নিবারণের একটুখানি প্রশ্রয়? ”

কোমল মুখখানি লাজে র’ক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। ঘন ঘন ঝাপটালো অক্ষিপল্লব। এতেই বেকাবু হলো ইরহাম। বিন্দুমাত্র বিলম্ব না করে সঙ্গিনীকে কাছে টেনে এলো। কপালে ঠেকে গেল কপাল। তপ্ত শ্বাস আঁকিবুঁকি করে যাচ্ছিল মেয়েটির মুখে। বুঁজে আসছিল চক্ষু। তিরতির করে কম্পমান ওষ্ঠাধর। নিমিষেই সেথায় হালাল কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করলো মানুষটি। প্রগাঢ় হলো ছোঁয়া। আবেশে সিক্ত রমণী মিশে গেল স্বামীর বক্ষস্থলে। দু হাতে আলিঙ্গনরত গলা। মধুরতম সে রজনী কাটলো বিনিদ্র। নতুন রূপে একে অপরেতে বিভোর হলো হৃ’হাম। স্বামীর প্রগাঢ় নে’শালো পরশে দিশেহারা তনুমন। এক প্রেমাসক্ত উন্মত্ত রজনী কাটালো তারা!

আপন তরিকায় চলমান সময়ের চাকা। অতিবাহিত হলো কয়েক মাস। গোয়া, ভারত…

স্বল্প আলোকিত ঘর। কৃত্রিম আলো হটিয়ে দিয়েছে আঁধারিয়া চাদর। ডিভানে বসে রুদ্রনীল। পড়নে রাতপোশাক। শক্তপোক্ত বলিষ্ঠ দেহে জড়িয়ে পোশাকটি। উন্মুক্ত বুকের উর্ধ্ব অংশ। দেখা মিলছে লোমশ বক্ষপটের। লম্বা আকৃতির চুলগুলো আজ উন্মুক্ত। মুক্ত হয়ে স্বাধীন রূপে ঘাড়ে পড়ে রয়েছে তারা। সর্বত্র নি:ষ্ঠুর বলে পরিচিত এ মানবের হাতে স্নিফটার গ্লাস। হালকা বেলুন আকৃতির গ্লাসে রয়েছে হু’ইস্কি। যার নিম্ন ভাগ সরু আকৃতির। রঙিন রূপ ধারণ করেছে গ্লাসটি। একটু একটু করে ঠোঁটের কাছে ঠেকছে গ্লাস। ক্ষুদ্র চুমুকে পান করছে হু’ইস্কি। এ মুহূর্তে নিজ বাসভবনে অবস্থান করছে রুদ্রনীল। কানে সংযুক্ত ক্ষুদ্রাকৃতির ইয়ারবাড। ইংরেজিতে কথোপকথন হচ্ছে দু’জনের। যার বঙ্গানুবাদ হলো,

” চিন্তা কিসের মিস্টার? চোখ বুঁজে আরাম করুন। নির্বিঘ্নে কাজ হয়ে যাবে। এই রুদ্রনীল আজ অবধি কোনো ডিল করেছে আর সেটা সফল হয়নি, অসম্ভব। আগামীকাল রাত বারোটা। তৈরি থাকবেন। যথাসময়ে কাঙ্ক্ষিত জিনিস পেয়ে যাবেন। ”

রুদ্রনীলের মুখনিঃসৃত প্রতিটি শব্দে আত্মবিশ্বাস। হবে না? খন্দকার রুদ্রনীল মল্লিক কোনো কর্মে সফলকাম হয়নি এমন নজির যে অত্যন্ত ক্ষীণ। বরাবরই সফলতা অর্জন করে এসেছে এই কাঠখোট্টা, নির্মম, নি-ষ্ঠুর মানুষটি। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দক্ষিণ এশিয়ার অন্ধকার সাম্রাজ্যে প্রতিপত্তি বিস্তার করে চলেছে। যার কুটিল বুদ্ধি ও হিং স্র শিকারি মনোভাবের জন্য শত্রু মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। শিকারকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে মা:রাটা উপভোগ করে এই রুদ্রনীল। একেবারে প্রাণ হরণের চেয়ে রয়েসয়ে যন্ত্রণা দিয়ে মৃ ত্যু উপহার দেয়ার আনন্দ ই ভিন্ন। উপভোগ্য।

ফোনের ওপাশে থাকা ব্যক্তিটি ইংরেজিতে কিছু বললো। সংশয় প্রকাশ করলো। রুদ্রনীল গম্ভীর স্বরে তাকে আশ্বস্ত করলো,

” চিন্তা করবেন না অ্যালবার্ট। শুধু পঞ্চাশ লাখ নিয়ে হাজির থাকবেন। এক হাতে মাল নেবেন। আরেক হাতে মানি দেবেন। হিসাব বরাবর। বুঝেছেন? ”

ওপাশ হতে ইতিবাচক সাড়া মিললো। বক্র হাসলো রুদ্রনীল। আত্মবিশ্বাসী স্বরে কাট কাট ভঙ্গিতে ইংরেজিতে আওড়ালো,

” হোপফ্যুলি দেয়ার উইল বি ডিল অ্যাগেইন ইন দ্য ফিউচার।”

ইয়ারবাডে আলতো টোকা দিয়ে যোগাযোগ বিছিন্ন করলো রুদ্রনীল। অধরে লেপ্টে বর্বর হাস্য রেখা। অপেক্ষা শুধু আগামীকাল রাত বারোটার। হবে বিনিময় প্রথা। মিলবে নগদ পঞ্চাশ লাখ!

.

মধ্যাহ্ন প্রহর। ডাইনিং এরিয়ায় উপস্থিত নারী সদস্যরা। হৃদি, মালিহা ও রাজেদা খানম। যথারীতি এজাজ সাহেব ও ইরহাম নিজ নিজ কর্মস্থলে। ক্লান্তিকর বদনে দাঁড়িয়ে হৃদি। মা ও দাদির খাবার পরিবেশন করছে। সকাল থেকেই শরীরটা বড্ড দুর্বল ঠেকছে। সব কিছুতেই বিরক্তি। খাবারদাবারের গন্ধ তো সবচেয়ে নিকৃষ্ট দুর্গন্ধ মনে হচ্ছে।‌ এই যে খাবার পরিবেশন করছে। মাছের তরকারি হতে বিদঘুটে গন্ধ আসছে। বমি বমি ভাব চেপে বসেছে গলদেশে। হঠাৎ বাজেভাবে গা গুলিয়ে উঠলো। দ্রুততার সহিত টেবিলের ওপর ফিশ কারি’র বাটি রেখে একটা চেয়ার টেনে তাতে বসে পড়লো। ভেতরকার সবকিছু বুঝি এই উগড়ে দেবে। দ্রুত গতিতে গ্লাস হাতে নিয়ে ঢকঢক করে পানি পান করতে লাগলো হৃদি। স্বেদজল উপস্থিত গলদেশে। ললাটে। মালিহা ও রাজেদা খানম সবটাই অবলোকন করলেন। চোখাচোখি হলো ওনাদের। উৎকণ্ঠিত ভাব আস্তে ধীরে দূরীভূত হলো। অভিজ্ঞতাসম্পন্ন চোখ দু’টো বলছে ‘ সুসংবাদ ‘ রয়েছে। আসলেই কি তাই? চকচক করে উঠলো আঁখি যুগল। মালিহা তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ালেন। এগিয়ে গেলেন পুত্রবধূর পানে। চেয়ারে দেহ এলিয়ে দিলো হৃদি। উনি পরম মমতায় মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। কোমল স্বরে শুধোলেন,

” তুই ঠিক আছিস তো মা? ”

হৃদি চোখ তুলে তাকালো। ক্লান্ত স্বরে বললো,

” ভালো লাগছে না মা। বমি বমি ভাব হচ্ছে। ”

” কবে থেকে এমন হচ্ছে? ” কণ্ঠে প্রকাশ পাচ্ছে উৎকণ্ঠা।

” বেশ কিছুদিন ধরে। ভেবেছিলাম গ্যাস্ট্রিকের জন্য হচ্ছে। ”

রাজেদা খানম অসন্তুষ্ট বদনে বলে উঠলেন,

” ও রে ব:লদ মাইয়া! গ্যাস্টিখ (গ্যাস্ট্রিক) আর অন্য কিছুর তফাৎ বুঝোছ না? আমগোও আগে কিছু কইলি না। বৌ তুমি ডাক্তাররে ফোন করো। আইজ ই অরে লইয়া ডাক্তারের ধারে যাবা। ”

হৃদি তৎক্ষণাৎ বলে উঠলো,

” দাদি শুধু শুধু ডক্টরের কাছে যাওয়া লাগবে না। আমি ঠিক আছি। লিটল উইকনেস। ইনশাআল্লাহ্ ভালো হয়ে যাবে। ”

রাজেদা খানম চোখ গরম করে তাকালেন,

” চুউপ। একটাও কথা না। বৌ..! ”

মালিহা ত্বরিত সাড়া দিলেন,

” জ্বি মা। অ্যাপয়েনমেন্ট নিয়ে নিচ্ছি। সন্ধ্যার দিকে যাবো। ”

রাজেদা খানম নাতবউ’কে উদ্দেশ্য করে বললেন,

” ভালো কইরা সব খুইলা কবি কিন্তু। জানোছ তো ডাক্তারগো ধারে কিছু লুকাইতে নাই। ”

হৃদি ইতিবাচক মাথা নাড়ল। চিকিৎসকের নাম শোনামাত্র ই ভয় জেঁকে বসেছে অন্তরে। হঠাৎ কি হলো তার? অ্যাসিডিটি থেকে বড়সড় কিছু নয় তো?

‘ ইয়া আল্লাহ্! রক্ষা করো। ‘

.

ঘড়ির কাঁটা তখন রাত আটটা বেজে পনেরো মিনিট নির্দেশ করছে। কর্মব্যস্ততার দরুণ আজ রাতে বাড়ি ফিরবে না ইরহাম। কিয়ৎক্ষণ পূর্বে মা’কে ফোন করে বিষয়টি অবগত করেছে। প্রথমে স্ত্রী’কেই ফোন করেছিল। কোনো কারণবশত হৃদি মেয়েটা ফোন ধরেনি। তাই মা’কে ফোন করে জানিয়ে দিলো। মালিহা কিছু বলতে উদ্যত হয়েও ব্যর্থ হলেন। বিচ্ছিন্ন হলো সংযোগ। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন উনি। না বলা কথাটি আর বলা হলো না।

.

মধ্যরাত। নিস্তব্ধতা বিরাজমান সর্বত্র। উঁচু পাহাড়ের কোল বেয়ে দৃশ্যমান নদী। বান্দরবানের সাঙ্গু নদী। নদীর দু পাশে যেন টহলরত পাহাড়। ভূতুড়ে নীরবতা চারিধারে। গা ছমছমে অবস্থা। নিজ ছায়া অবধি ভড়কে দেবার মতো ভ-য়ঙ্কর। নিস্তব্ধ পরিবেশে শ্রবণেন্দ্রিয়ে পৌঁছাচ্ছে শুধু নদীর কলতান। ঝিঁঝিঁ পোকার কলরব। নিশাচর প্রাণীর উপস্থিতি অন্তরে দামামা বাজিয়ে চলেছে। যেদিকে দৃষ্টি যায় আঁধার ও আঁধার। কৃত্রিম আলো ব্যতীত কিচ্ছুটি দেখা সম্ভব নয়। সাঙ্গু নদী যেন এক মায়াজাল। দু হাত বাড়িয়ে ডেকে চলেছে। আহ্বান করছে নিজ গহ্বরে তলিয়ে যাওয়ার। সে কি ভয়ানক আহ্বান! কিয়ৎক্ষণ বাদে আঁধারিয়া চাদর হটিয়ে সেথায় স্বল্প আলোর দেখা মিললো। নদীর বুক চিরে এগিয়ে আসছে একটি ট্রলার। যার উপস্থিতিতে সৃষ্ট ধ্বনি প্রবেশ করছে শ্রবণেন্দ্রিয়ে। ট্রলারে উপস্থিত সাতজন। সকলের হাতে মোবাইল। মোবাইলগুলোর ফ্লাশ লাইটে স্বল্প আলোকিত পরিবেশ। নদীর পাড়ে এসে থামলো ট্রলার। ট্রলারের অগ্রভাগে দণ্ডায়মান এক মাঝবয়সী ব্যক্তি। হাতে টর্চলাইট। যার আলোয় সতর্ক চাহনিতে তাকালো আশপাশ। কোথাও কেউ নেই। আছে শুধু নিস্তব্ধতার চাদর। লোকটি পিছু ঘুরে সঙ্গীদের ইতিবাচক ইশারা করলো। একে একে সাবধানী ভঙ্গিতে ট্রলার হতে পাড়ে নেমে এলো সাতজন। নিঃশব্দ পরিবেশে তাদের পদচারণায় দাঁড়িয়ে গেল লোমকূপ। সাঙ্গু’র পাড়ে অপেক্ষারত সাতজন। তাদের দলনেতা হিসেবে উপস্থিত ‘ অ্যালবার্ট উইলিয়াম ‘ এর বিশ্বস্ত সাগরেদ বছর চল্লিশের ম্যাথিউস। ম্যাথিউস হাতঘড়িতে চোখ বুলিয়ে সময় দেখে নিলো। ঠিক পাঁচ মিনিটের অপেক্ষা শেষে সকলের শ্রবণেন্দ্রিয়ে পৌঁছালো কাঙ্ক্ষিত ধ্বনি। বাঁ পাশে তাকালো তারা সাতজন।

আঁধার বিদীর্ণ করে ধেয়ে আসছে একটি ধূসর বর্ণের জিপ গ্ল্যাডিয়েটর উইলিস। সন্নিকটে এসে থামলো গ্ল্যাডিয়েটর উইলিস’টি। দ্বার উন্মুক্ত করে একে একে বেরিয়ে এলো ছয়জন। একজনের হাতে বড় আকৃতির একটি ডার্ক ব্রাউন কোকোয়া লেদার ব্রিফকেস। অতঃপর মুখোমুখি দুই পক্ষ। এসে পড়েছে সেই আকাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত। অ্যালবার্ট এর পক্ষ হতে উপস্থিত ম্যাথিউস। আর রুদ্রনীলের পক্ষ হতে শামীম। ম্যাথিউস বললো,

” হয়া’র ইজ দ্য গুডস্? ”

শামীম হাতটা স্বল্প উঁচু করে কোকায়া লেদার দেখালো। অধরকোণ প্রসারিত হলো ম্যাথিউসের। শামীম বললো এবার,

” দেন স্টার্ট দ্য প্রসিডিউর? ”

” ইয়াহ্ শিওর। ”

শামীম ডান হাতে বাড়িয়ে দিলো ড্রা গ বহনকারী লেদার ব্রিফকেসটি। ম্যাথিউস এগিয়ে ধরলো অর্থ ভর্তি ব্যাগ। রাতের আঁধারে পঞ্চাশ লাখ টাকার ড্রা গ ডিল হচ্ছে। ম্যাথিউস ও শামীম যেই না ড্রা:গ ও অর্থ বিনিময় করতে উদ্যত হলো অমনি…

চলবে.

#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_২৬ [ প্রাপ্তমনস্কদের জন্য ]

রাতের আঁধারে নিস্তব্ধতার সুযোগ নিয়ে সাঙ্গু নদীর পাড়ে মা”দক ব্যবসা চলছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে এই বেআইনি কর্মকাণ্ড। ম্যাথিউস, শামীম ড্রা গ ও টাকা বিনিময় করতে উদ্যত হলো। ঠিক সে মুহূর্তে অতর্কিত হা”মলা! শুনশান স্থানটিতে হঠাৎই হৈচৈ পড়ে গেল। একাধারে গো:লাবর্ষণ হচ্ছে। ম্যাথিউস ও শামীম বাহিনী তৎক্ষণাৎ প্রাণ বাঁচাতে সতর্ক হয়ে গেল। নিজস্ব অ স্ত্র ব্যবহার করে শত্রুর মোকাবেলা করে চলেছে তারা। লড়াই চলমান। ওরা দেখতে পেল শত্রুরূপী পুলিশ উপস্থিত। তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে অফিসার তাঈফ। মেজাজ বিগড়ে গেল। সংঘর্ষের একপর্যায়ে শামীম বু:লেট ছুঁড়লো তাঈফের উদ্দেশ্যে। কিন্তু চরম ব্যর্থ হলো। ত্বরিত গাছের অন্তরালে লুকিয়ে পড়লো তাঈফ। ধুকপুক করছে হৃৎপিণ্ড। আস্তে ধীরে সময় নিলো। সেকেন্ড কয়েক বাদে গাছের অন্তরাল হতে মাথা বের করে উঁকি দিলো তাঈফ। সুযোগ পেয়ে গু লি করলো কিছুটা দূরত্বে অবস্থিত শামীমের উদ্দেশ্যে। চতুরতার সহিত বসে পড়লো শামীম। লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো গু লি। তাঈফ আগত বুলেট হতে আত্মরক্ষা করে দৌড়ে আরেক গাছের আড়ালে উপস্থিত হলো। এক শত্রুর কপাল বরাবর চালিয়ে দিলো গু লি। র-ক্তাক্ত দেহে মাটির বুকে লুটিয়ে পড়লো সে শত্রু। দুই পক্ষের মধ্যে প্রবল সং-ঘর্ষ চলমান।

কিছু মুহূর্ত বাদে তাঈফের ছোঁড়া বুলেট বি দ্ধ হলো ম্যাথিউসের বাঁ পায়ে। ভারসাম্য হারিয়ে সাঙ্গু নদীতে ছিটকে পড়লো ম্যাথিউস। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে তা দেখলো শামীম। টগবগিয়ে উঠলো র ক্ত। বোধবুদ্ধি লোপ পেল। কাপুরুষের ন্যায় তাঈফকে উদ্দেশ্য করে পেছন হতে গু লি করলো। এক অফিসারের সতর্ক বাণীর জন্য বড় বিপদ হতে রক্ষা পেল তাঈফ। তবে হাতের বাহু ছুঁয়ে গেল বু:লেট। র ক্তপাত হতে লাগলো ক্ষতস্থান হতে। অধর কা’মড়ে যন্ত্রণা সহ্য করে যাচ্ছে। এক প্রকাণ্ড গাছের আড়ালে অবস্থান নিলো তাঈফ। পকেট হাতড়ে বের করলো শুভ্র রুমাল। যাতনায় বিকৃত মুখাবয়ব। রুমালের এক অংশ দাঁত দিয়ে চেপে। আরেক অংশ হাতে। যথাসাধ্য ক্ষতস্থান বেঁধে নিলো রুমালে। র-ক্তক্ষরণ কিছুটা হলেও লাঘব পেল। বড় শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করলো তাঈফ। অতঃপর বেরিয়ে এলো গাছের অন্তরাল হতে। দু হাতে দু’টো BERETTA 81FS. পি স্ত ল দু’টো ব্যবহার করে ক্ষি প্র গতিতে শত্রু নিপাত করে চলেছে। শামীম একাকী বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারলো না। হৃৎপিণ্ড হতে কিছুটা নিচে গু:লিবিদ্ধ হলো। নদীর তীরে লুটিয়ে পড়লো র ক্তমাখা দেহটি। সফল হলো পুলিশি অপারেশন। উদ্ধার হলো পঞ্চাশ লাখ টাকা মূল্যের ড্রা গ। আহত সঙ্গী ও শত্রুদের দ্রুত চিকিৎসালয়ে প্রেরণ করার ব্যবস্থা নেয়া হলো। এদিকের সকল কর্ম সম্পাদন করে তাঈফ চিকিৎসালয়ে গেল। সেথা হতে প্রাথমিক চিকিৎসা গ্রহণ করে ছুটলো পুলিশ স্টেশন।
.

এক নতুন দিনের সূচনা। ঘড়ির কাঁটা তখন দশের কাছাকাছি। জয়েন্ট পুলিশ কমিশনারের কার্যালয়…

মুখোমুখি বসে সাংসদ ইরহাম চৌধুরী এবং পুলিশের যুগ্ম কমিশনার। কমিশনার সাহেবের সামনে টেবিলের ওপর ল্যাপটপ। সেথায় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত গতকালের পুলিশি অভিযানে সফল অফিসার তাঈফ এবং মা!দকবিরোধী এক নামকরা সফল সংগঠনের পরিচালক। কমিশনার সাহেব গম্ভীর স্বরে শুধোলেন,

” ম্যাথিউসকে পাওয়া গেছে? ”

তাঈফ দৃষ্টি নত করে নিলো‌। সে অবনত মস্তক বুঝিয়ে দিচ্ছিল তার ব্যর্থতা।

” না স্যার। ম্যাথিউসকে পাওয়া যায়নি। ধূর্ততার সহিত পালিয়েছে। ”

নেতিবাচক জবাবে অসন্তোষ প্রকাশ করলেন কমিশনার। গমগমে স্বরে বলে উঠলেন,

” অফিসার এতবড় বোকামিটা কি করে করলে? তুমি জানো না ম্যাথিউস কে? সে ইন্টারন্যাশনাল ড্রা গ ডিলার অ্যালবার্ট উইলিয়ামের বিশ্বস্ত সাগরেদ। ম্যাথিউসকে ধরা মানে বিশাল বড় এক চক্রের হদিস পাওয়া। সেখানে তুমি কিনা ম্যাথিউসকেই মিস্ করে ফেললে? হাউ কুড ইয়্যু? ”

নত মস্তকে ক্ষমা চাইলো তাঈফ। হাতের বাহুতে এখনো যন্ত্রণা। অন্তরে অনুতাপ। কি করে ম্যাথিউসকে হারিয়ে ফেললো সে! এতবড় সুযোগ কি সহজে দ্বিতীয়বার মিলবে! ইরহাম স্বভাবসুলভ গম্ভীর-শান্ত ভঙ্গিতে বসে। মনোযোগ সহকারে শুনে চলেছে প্রতিটি শব্দ। মস্তিষ্কে কিলবিল করে চলেছে ভাবনার দল। মা!দকবিরোধী সংগঠনের পরিচালক চল্লিশোর্ধ ব্যক্তিটি এবার মুখ খুললেন। নম্র স্বরে বললেন,

” স্যার আপনাদের ইম্পর্ট্যান্ট কথার মাঝে ইন্টারাপ্ট করার জন্য ক্ষমা চাইছি। আপনি অনুমতি দিলে কিছু বলতে চাই। ”

বয়স্ক-অভিজ্ঞতা সম্পন্ন যুগ্ম কমিশনার সাহেব অনুমতি প্রদান করলেন,

” গো অ্যাহেড। ”

অনুমতি পেয়ে প্রসন্ন হলেন পরিচালক মশাই। ইরহাম আরেকটু মনোযোগী হয়ে বসলো। শুনতে লাগলো,

” স্যার। অ্যাজ পার আওয়া’র সার্ভে, বিগত এক বছরে এই নিয়ে ছয়বার বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটিতে ড্রা গ ডিলিং হয়েছে। তন্মধ্যে ধরা পড়েছে এবার নিয়ে মাত্র দুইবার। ইদানিংকালে ড্রা:গ ডিলিং খুব বেড়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশগুলো আর ইউরোপ কান্ট্রি হতে বেশ ড্রা”গ সাপ্লাই হচ্ছে। আমাদের দেশে মা!দকাসক্তের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ”

” তো কি বলতে চাইছেন আপনি? ” কমিশনার প্রশ্নবিদ্ধ চাহনিতে তাকিয়ে।

” আমরা কি কিছুই করতে পারি না? এভাবে তো মা;দকের করাল গ্রাসে দেশটা ধ্বংস হয়ে যাবে। ”

” হুম। কিন্তু জানেন ই তো আমাদের হাত-পা বাঁধা। সিস্টেমের শক্তপোক্ত হাতকড়া আমাদের বেঁধে রেখেছে। চাইলেও আমরা অনেক সময় অনেক কিছু করতে পারি না। মুখ বুজে সহ্য করতে হয়। ”

শান্ত গম্ভীরমুখো মানুষটা কথা বলার সুযোগ পেল। টেবিলের ওপর দু হাত ঠেকিয়ে স্বল্প ঝুঁকে গেল। মস্তিষ্কে গেঁথে দেয়ার ভঙ্গিতে বলতে লাগলো,

” স্যার আমাদের দেশটা বিপদের মুখে। তরুণ প্রজন্ম বিশ্রীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বর্তমানে স্কুল বয়েজরাও মা:দকাসক্ত হয়ে পড়ছে। আর কলেজ ভার্সিটির কথা নাইবা বললাম। মা দ ক নিরাময় কেন্দ্রে আজকাল অনেকেই আসছে। কেউবা আসছে না। আমাদের অগোচরে ধুঁকে ধুঁকে মৃ*ত্যুর পথে ধাবিত হচ্ছে। উই কান্ট লেট ইট হ্যাপেন। ”

কমিশনার সাহেব কিছুটা নরম কণ্ঠে বললেন,

” দেখো চৌধুরী। বিষয়টা আমরা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছি। কিন্তু কি করতে পারি বলো? গতরাতে বান্দরবানে অপারেশন হলো। সকালে হতে না হতেই ওপর মহল থেকে বেশ কয়েকবার ফোন এসেছে। তারা জবাবদিহি করছে। কেন তাদের অনুমতি বিহীন এতবড় অপারেশন হলো। ”

ইরহাম ভাবলেশহীন ভাবে বললো,

” এটাই তো আমাদের মেইন প্রবলেম স্যার। আমরা ক্ষমতার সৎ ব্যবহার না করে কিভাবে ক্ষমতাশালী গদিতে টিকে থাকবো সে-ই চেষ্টায় মত্ত। যা সত্যিই দুঃখজনক। ”

কমিশনার দুঃখ প্রকাশ করলেন,

” আই অ্যাগ্রি উইথ ইয়্যু ইয়ংম্যান। আমাদের এখন সঠিক সময়ের অপেক্ষা করা ছাড়া কিছুই করার নেই। দেখা যাক কি হয়। ”

কথাটিতে সন্তুষ্ট হতে পারলো না ইরহাম। কঠিন হলো মুখাবয়ব। সিস্টেমের দোহাই দিয়ে আর কত ব্যর্থতা আড়াল করবে এরা! আমাদের সোনার বাংলা কি কখনোই নিষ্কলুষ হবে না! কোথায় অন্ত এ কালো সাম্রাজ্যের!

” বাই দ্য ওয়ে ইয়ংম্যান। থ্যাংকস। তোমার পরোক্ষ সহায়তা ব্যতীত গতকালের অপারেশন সফল হতে পারতো না। আশা করি এভাবেই পাশে থেকে দেশের সেবা করবে। ”

উঠে দাঁড়ালো চৌধুরী। চোখে পড়ে নিলো রিমলেস চশমা। স্বচ্ছ কাঁচের আড়ালে ঢাকা পড়লো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ নভোনীল চক্ষুদ্বয়। নিঃসংশয় কণ্ঠে বললো সে,

” যখন যখন দেশমাতৃকার প্রয়োজন পড়বে এগিয়ে আসবে এই চৌধুরী। বাই হুক অর ক্রুক দেশের মাটিকে কলুষতা মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ্। ”

.

আঁধারিয়া আঁচলে আবৃত বসুন্ধরা‌। অন্তরীক্ষে দৃশ্যমান চন্দ্রিমা। সদ্য বাড়ি ফিরলো ইরহাম। পা বাড়ালো দোতলায় নিজ ঘরের পানে‌। লিভিংরুমে আজ অনুপস্থিত পরিবারের সদস্যরা। কোথায় গেল সব? নিজ ঘরে প্রবেশ করে থমকালো অন্তর। অমানিশায় ছেয়ে ঘরটি। অবেলায় কেন এত আঁধার? বিচলিত চিত্তে ঘরে প্রবেশ করলো মানুষটি। এদিক ওদিক তাকালো। দেখা নেই সঙ্গিনীর। ইরহাম হাতঘড়ি খুলতে খুলতে পৌঁছালো সুইচবোর্ডের ধারে। আঙ্গুল চেপে আলো জ্বালিয়ে দিলো। কৃত্রিম আলোয় আলোকিত হলো ঘর। ততক্ষণে হাতঘড়ি খুলে ফেলেছে। পিছু ঘুরতেই ভড়কালো দৃষ্টি।দ্রুতবেগে স্পন্দিত হতে লাগলো হৃৎপিণ্ড। অবিশ্বাস্য নয়নে তাকিয়ে সম্মুখে। সে কি জাগ্রত অবস্থায় স্বপ্ন দেখছে! দু চোখ বিশ্বাস করতে নারাজ। বক্ষমাঝে লুকায়িত হৃদযন্ত্রটি জানান দিচ্ছে অস্থিরতার আভাস। পদযুগল যেন মেঝেতে আটকে। নিশ্চল। নড়তে ব্যর্থ। রিমলেস চশমার অন্তরালে মোহাচ্ছন্ন অক্ষিদ্বয়। ধীরপায়ে এগিয়ে গেল মানুষটি। প্রতিটি কদমে ধড়াস ধড়াস করছে বুক। ভারসাম্য হারানোর উপক্রম সুঠামদেহ। মন্থর পায়ে পৌঁছালো গন্তব্যে। বালিশের ত্বকে এলিয়ে একটি কাঠের সাইন। পাইনউড এর তৈরি সাইনটি। ‘হাই ড্যাডি’ প্রেগন্যান্সি টেস্ট কিপসেক কাঠের সাইন। লেজার দিয়ে ইংরেজি ভাষায় ইটালিক স্টাইলে খোদাই করা ‘ হাই ড্যাডি ‘. যার নিম্নে বাদামী সুতা দিয়ে আবদ্ধ প্রেগন্যান্সি কিট। সেথায় স্পষ্টভাবে জ্বলজ্বল করছে দু’টো লাল দাগ। ইরহামের দু চোখে তখন বারিধারা। লম্ফ দিচ্ছে হৃৎপিণ্ড। দ্রুততম হৃদস্পন্দনের গতিবেগ। দু’চোখ নিম্নে এলো। সাইনে প্রেগন্যান্সি কিটের আরেকটু নিচে বাংলায় গোটা গোটা অক্ষরে খোদাইকৃত,

‘ আমি জানি বাবা আমাদের এখনো দেখা হয়নি
কিন্তু আমি এটাও জানি আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি
তোমার সাথে দেখা করার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছি বাবা ‘

ঝাঁপসা হলো নয়ন জোড়া। স্থির চাহনিতে তাকিয়ে ইরহাম। কম্পিত দু হাত। নিঃশব্দে ঠোঁট নাড়িয়ে বারবার নিচের লেখাটুকু পড়তে লাগলো মানুষটি। হ্যাঁ। বাবা ই তো লেখা। বাবা! কাঁপা কাঁপা ভঙ্গিতে সাইনটি হাতে নিলো ইরহাম। দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো প্রেগন্যান্সি কিটে। সেথায় জ্বলজ্বল করছে দু’টো র’ক্তিম দাগ। ক্লান্ত মানুষটির অধরকোণে ঝলমলে হাসি ফুটে উঠলো। টলমলে দু চোখ। আলতো করে পাইনউডে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। ঠোঁট নাড়িয়ে শব্দহীন উচ্চারণ করলো,

” বা-বা! ”

ইরহাম ডান পাশে তাকালো। কাবার্ড এর সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় কিছু একটা। মানুষটি হাতে থাকা সাইনে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলো। রাখলো বিছানায়। সাবধানে। যেন নবজাতক শিশুকে বিছানায় শায়িত করছে। একটুও ব্যথা না লাগে। বিস্ময়ে অভিভূত মানুষটি শ্লথ গতিতে কাবার্ডের নিকটে গেল। সেখানেও চমক! কাবার্ডের সাথে ঝুলন্ত অলঙ্কার। এক গোলাকার কাঠের অলঙ্কার। সেথায় লেজারে খোদাই করে বড় আকারে ইংরেজি ক্যাপিটাল লেটারে লেখা,

‘ ইয়্যু & মি বিকেম থ্রি ‘

লেখাটির নিচে তিনটে পায়ের ছাপ অঙ্কিত। ফাঁকা সে-ই পদচিহ্নের মধ্যভাগ। দু’টো বড় পায়ের ছাপ, তাদের মধ্যখানে ছোট্ট পায়ের ছাপ‌। সবশেষে লেখা ‘ 2023 ‘. কালো, লাল রঙের ফিতা দিয়ে সংযুক্ত অলঙ্কারটি। উচ্ছ্বসিত কল্লোল আছড়ে আছড়ে পড়ছে মানসপটে। দু চোখে খুশির বাঁধ। অশ্রুসজল নয়নে আশেপাশে তাকালো ইরহাম। কোথায় লুকিয়ে তার খুশির ফোয়ারা, প্রশান্তির পরশ! তার হৃদি! বেশি অপেক্ষা করতে হলো না। খট করে শব্দ হলো। উন্মুক্ত হলো দ্বার। তৎক্ষণাৎ পিছু ঘুরে তাকালো ইরহাম। ওয়াশরুম হতে বেরিয়ে এসেছে অর্ধাঙ্গিনী। তার অনাগত সন্তানের মা! বিন্দুমাত্র বিলম্ব না করে অশান্ত ছটফটে ভঙ্গিতে ছুটে গেল ইরহাম। তার লাজে রাঙা বধূ যে অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে। লালিমা লেপ্টে গোটা মুখশ্রীতে। মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে মানুষটি! কত কি বলার রয়েছে। অনুভূতি ব্যক্ত করার রয়েছে। কিন্তু ব্যর্থ সে। শব্দমালা যে অবরুদ্ধ কণ্ঠনালীতে। কিছু বলতে পারছে না কেন! বড় উদগ্রীব হয়ে উঠলো ইরহাম। বহুক্ষণ বাদে কিছু বলতে উদ্যত হলো তখনই তার দৃষ্টি কিছুটা নিম্নে ধাবিত হলো। কেননা আস্তে ধীরে বক্ষস্থল হতে দোপাট্টা সরিয়ে নিচ্ছে হৃদি। কি করছে সে! চমকালো ইরহাম! অর্ধাঙ্গীর পড়নে আজ কৃষ্ণবর্ণ টি-শার্ট। সেথায় ডিজাইনিং ভঙ্গিতে শুভ্র হরফে লেখা,

‘ ওয়ান মোর
রিজন টু বি
থ্যাংকফুল
দিস ইয়ার ‘

‘থ্যাংকফুল’ শব্দটি হলদে রঙে লেখা। দু পাশে ফুলেল নকশা। সবটুকু লেখার শেষে একটি শিশুর পদচিহ্ন। আর সইলো না অন্তর। শক্তপোক্ত দু হাতে স্ত্রীকে গ্রহণ করলো ইরহাম। জড়িয়ে নিলো প্রশস্ত বক্ষপটে। এতক্ষণ ধরে আটকে রাখা অশ্রু কণা এখন বাঁধাহীন ভাবে গড়িয়ে পড়লো। সিক্ত হলো গাল। আরেকটু শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো মানুষটি। বক্ষ পিঞ্জিরায় বদ্ধ করে ফেলবে বুঝি! কোমল হৃদয়ের অধিকারিণী কন্যাও এবার আবেগতাড়িত হয়ে গেল। পেলব দু হাত খামচে ধরলো স্বামীর চওড়া পিঠ। দু’জনের চোখে সুখের অশ্রু। অন্তরে খুশির জলোচ্ছ্বাস। ইরহাম দু হাতের অঞ্জলীতে ভরে নিলো স্ত্রীর মায়াবী মুখখানি। এলোপাথাড়ি পরশ বুলিয়ে গেল চোখেমুখে, নাকের ডগায়। অধরে অধর হালকা ছুঁয়ে ফিসফিসিয়ে আওড়ালো ইরহাম,

” আলহামদুলিল্লাহ্ ফর এভরিথিং। ”

সন্ধি হলো অধরে অধরে। হৃদয় নিংড়ানো সবটুকু অনুরক্তি ঢেলে দিলো সঙ্গিনীর অধরোষ্ঠে। প্রগাঢ় রূপে আগলে নিলো নিজের সনে। আবেশে মুদিত দু’জনার অক্ষিপুট। হৃদিও মিশে গেল স্বামীর বক্ষস্থলে। একে অপরকে আঁকড়ে তারা উপভোগ করে চলেছে মুহুর্তটি। চক্ষু গড়িয়ে পড়ছে নোনতা জল। ভিজিয়ে দিচ্ছে গাল বেয়ে চিবুক। বড় সুখময়, আবেগপ্রবণ, আনন্দ মিশ্রিত এ লগন।

চলবে.

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে