মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি ২ পর্ব-২৩+২৪

0
749

#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_২৩

মৃদু আলোয় উজ্জ্বল বদ্ধ ঘর। মাথার ওপরে টিমটিম করে জ্বলছে বাল্ব। হলদে আলো ছুঁয়ে রয়েছে দেহ। দেয়াল ঘেঁষে বসে সে সর্বহারা ব্যক্তি। নাম তার জহির। কয়েক হাত দূরেই মেঝেতে অবহেলিত রূপে পড়ে স্টিলের থালা। তাতে নৈশভোজের খাদ্য। দু’টো রুটি তা-ও হালকা কালচে রঙা। আর হলুদ পানিতে গোলানো নামমাত্র ডাল। তিনদিকে দেয়ালের বাঁধা। সম্মুখে লোহার শক্তপোক্ত আস্তরন। বন্দী হয়ে কাটছে দিবারাত্রি। একদিন আরাম আয়েশ, আভিজাত্য, অর্থের লো ভে পড়ে অবৈধ পথ বেছে নিয়েছিলেন। আজ সে-ই অবৈধ রাস্তা তাকে লৌহ ঘেরাটোপে বন্দী করে ফেললো। একের পর এক কেস ফাইল হয়েছে তার বিরুদ্ধে। স্বাভাবিক ভাবেই আন্দাজ করা যাচ্ছে এত দ্রুত মিলবে না ছাড়। সমস্ত অপরাধের শাস্তি ভোগ করতে করতে মৃ:ত্যু না দেখা দেয়। কেড়ে নেয় অমূল্য প্রাণ। আজ এতটা দুর্দশা, অপমান, সম্মানহানি…! একটুও কি অনুতপ্ত জহির আহসান? নাহ্। এখনো অনুতপ্ত নয় লোকটি। তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে প্রতিশোধস্পৃহা। ওই ইরহাম চৌধুরী আর নিজ কুপুত্রের জন্য জীবনটা শেষ হয়ে গেল। দেখা মিললো এই করুণ পরিণতির। অপমান, সম্মানহানি, কারাবন্দী জীবন। সব আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে। এই স্পর্ধা, দুঃসাহসের জন্য কাউকে ছাড়বেন না উনি। কাউকে না। এরা কতদিন আঁটকে রাখবে ওনায়? হুঁ? একবছর, পাঁচবছর নাকি দশ বছর? একদিন না একদিন নিশ্চয়ই বেড়োবেন উনি। নিজ হাতে বুঝিয়ে দেবেন জহির আহসান ঠিক কতটা নি-ষ্ঠুর! এই নির্মম দু হাতে সে কি কি করতে সক্ষম হাতেকলমে বুঝিয়ে দেবেন। এলোমেলো ভাবনাগুলো অকস্মাৎ ভেঙ্গে গেল। শ্রবণেন্দ্রিয়ে পৌঁছালো অপ্রত্যাশিত কণ্ঠস্বর,

” খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে উপোস করা হচ্ছে? কি প্রমাণ করতে চাইছেন আপনি? বউয়ের শোকে নাওয়াখাওয়া বন্ধ করে ফেলেছেন? ”

চমকিত নেত্রে সম্মুখে তাকালেন জহির সাহেব! এ কাকে দেখছেন উনি! সত্যিই সে দণ্ডায়মান! নাকি এ অভাবনীয় স্বপ্ন! স্বপ্ন যেন সত্যি হয়। উনি এই মুহুর্তটুকু মন ভরে উপভোগ করতে চান। ছেলে ওনার পিতার বিপদে এগিয়ে এসেছে। এ যে ওনার চরম সৌভাগ্য! সত্যিই কি তার রাহিদ দাঁড়িয়ে! হাঁ। কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে রাহিদ। মুখাবয়ব কাঠিন্যতায় মোড়ানো। জন্মদাতা পিতাকে কারাবন্দী দেখেও আজ নেই কোনোরূপ সহানুভূতিশীল অনুভূতি। ওই দু চোখে নেই শ্রদ্ধা, ভালোবাসা। আছে শুধু এক সমুদ্র ঘৃণা। জহির সাহেব সবটুকু উপলব্ধি করতে পারছেন। লহমায় ধক করে উঠলো বক্ষস্থল। নিজ কুকর্মে আজ সর্বহারা সে। ছেলের কাছে পরিচিত এক নি-ষ্ঠুর পশু হিসেবে। বাপ হিসেবে নেই বিন্দুতুল্য ছাড়। সহানুভূতি তো দূর কি বাত। মানুষটির দু চোখে প্রকাশ পেল কাতরতা। করুণ বদনে আস্তে ধীরে দেয়ালে হাত রাখলেন। দেয়ালে হাতের ভারসাম্য বজায় ছেড়ে মন্থর গতিতে উঠে দাঁড়ালেন উনি। রাহিদ সবটাই দেখলো। মুখশ্রীতে কোনোরূপ পরিবর্তন নেই। একই অভিব্যক্তিতে তাকিয়ে। জহির সাহেব ধীরপায়ে অগ্রসর হলেন পুত্রের দিকে। একদম মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পিতা ও পুত্র। মধ্যখানে লোহার শিকের ব্যবধান। চোখে চোখ পড়লো দু’জনার। জহির সাহেব যথাসম্ভব অসন্তুষ্ট কণ্ঠে শুধোলেন,

” এখানে কি চাই? অন্ধকার জেলে বাপ কেমন আছে মজা দেখতে এসেছো? ”

” দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে আপনার মতো লোকের চেহারা দর্শন করে কোনো মজা পাওয়া যায় না। হয় শুধু আফসোস। পৃথিবীতে এতো মানুষ থাকতে আপনার মতো একটা পশুকেই আমার বাবা হতে হলো? ”

অত্যন্ত নি-ষ্ঠুর ছিল সে শব্দমালা। বুকের বাঁ পাশে অবলীলায় র:ক্তক্ষরণ ঘটালো। আঁধার ঘনিয়ে এলো চেহারায়। তবে তা বহিঃপ্রকাশ করলেন না। বরং তেলেবেগুনে জ্ব’লে উঠলেন জহির সাহেব,

” মুখ সামলে কথা বলো রাহিদ। জেলে আছি বলি পঙ্গু হয়ে যাইনি। কু-লাঙ্গার বড় ভাইয়ের আস্কারা পেয়ে আকাশে উড়ছো তো? সাবধান। জমিনে মুখ থুবড়ে পড়তে সময় লাগবে না। ”

কেমন বিদ্রুপ করে হেসে উঠলো রাহিদ। শব্দহীন হাসি। জহির সাহেব ক্রু-দ্ধ নয়নে তা অবলোকন করে চলেছেন। ভেতরটা জ্ব’লেপুড়ে হচ্ছে ছারখার। নিজের র ক্ত আজ বে-ইমানি করছে! এরচেয়ে দুঃখজনক আর কি হতে পারে?

” মুখ থুবড়ে পড়বো! কেমন করে? ঠিক আপনার মতো? ” ব্যাঙ্গ করে শুধালো রাহিদ।

জহির সাহেব বি:ষাক্ত সাপের ন্যায় হিসহিস করে চলেছেন। অপেক্ষায় মোক্ষম সময়ে ছো”বল মা:রার। উত্তর না পেয়ে রাহিদ বিদ্রুপাত্মক হাসি উপহার দিলো। এই মানুষটি শুধরে যাওয়ার নয়। আমৃ”ত্যু একই থাকবে। নির্দয়-নিষ্ঠুর। রাহিদ ভোলেনি কয়েক রাত পূর্বের সে-ই বর্বর দৃশ্যপট। চোখের সামনে পড়ে ছিল র ক্তা ক্ত মায়ের দেহটি। সে সন্ধ্যায় মা’কে কল করেছিল নিত্যদিনের মতো খোঁজখবর নেয়ার জন্য। স্বপ্নেও ভাবেনি ফোনকলের মাধ্যমে পিতার অত্যধিক ক্রু র রূপটি ধরা দেবে। ফোনে সংযুক্ত ছিল রাহিদ। মায়ের সঙ্গে তেমন একটা কথাবার্তা হয়ে ওঠেনি। তবে স্পষ্ট রূপে শুনেছে বাবা নামক লোকটির কুটিলতা। শুনেছে তার মায়ের প্রতিটি আর্তনাদ। ছিঁড়ে আধখান হয়েছে কানের পর্দা। সে কি আর্তনাদ মায়ের! বাঁচার জন্য আকুতিমিনতি! বাড়ি থেকে স্বল্প দূরত্বে ছিল সে। একটা কাজে এসেছিল। তাই তো সময়মতো বাড়ি ছুটে আসতে পেরেছিল। নইলে স্বামীর বাঁধভাঙা প্রহারে মা;রা পড়তো তার জন্মদাত্রী-মমতাময়ী মা। বাড়ি পৌঁছানোর ফাঁকে নিকটস্থ থানায় যোগাযোগ করতে ভোলেনি রাহিদ। আল্লাহ্ সহায় ছিলেন তাই তো প্রাণে বেঁচে গেছে মা। কল রেকর্ডে লোকটার স্বীকারোক্তি বন্দী হয়েছে। সে-ই ছোট্ট কল রেকর্ড এর সূত্র ধরে ইরহাম ভাইয়া পেয়েছে হৃদি ভাবী সম্পর্কে ক্লু। ধরা পড়েছে এই লো’ভাতুর আত্মা। সে-ই নির্মমতা আজও নিদ্রায় তাড়া করে বেড়ায়। আর এক ফোঁটাও নি:ষ্ঠুরতা সহ্য করার মতো শক্তি অবশিষ্ট নেই। এবার সব শেষ করে তবেই ক্ষ্যা’ন্ত হবে ছেলেটা।

রাহিদ কাঁধে থাকা ব্যাগটি নামিয়ে হাতে নিলো। দ্রুত হস্তে খুলে ফেললো ব্যাগের চেইন। বের করলো সফেদ রঙা এক ডকুমেন্ট। কিসের কাগজ এটি? জহির সাহেব কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে। রাহিদ একটি কলম বের করে কাঁধে ব্যাগ জড়িয়ে নিলো। ডকুমেন্ট আকারের কাগজ ও কলম বাড়িয়ে দিলো অপরাধী বাবার নিকটে। মধ্যখানে কারাগারের বাঁধা। জহির সাহেব ওগুলো হাতে নিলেন না। বরং প্রশ্ন করলেন,

” এটা কি? ”

” ডিভোর্স পেপার। ”

ব’জ্রাহত চাহনিতে তাকিয়ে জহির সাহেব! এসব কি শুনছেন উনি? ডিভোর্স পেপার! ছেলে ওনার অতি শোকে পা গ ল হয়ে যায়নি তো? উল্টোপাল্টা কিসব বলছে! বক্র হাসলো রাহিদ।

” এমন রিয়েকশন দিচ্ছেন যে? আপনার তো খুশি হওয়ার কথা‌। খুশিতে নৃত্য করা উচিত। আফটার অল জীবন থেকে এক আপদ বিদায় নিচ্ছে। এবার আপনি জেলে বসে আপনার ওই সো কল্ড প্রেমিকা থুরি পি.এ মারিয়ার সাথে রাশলীলা করবেন নাকি রঙ্গলীলা, উই ডোন্ট কেয়ার। শুধু সাইনটা করেন আমাদের মুক্তির দিন। আফসোস এটাই যে আপনার মতো এক নষ্ট পুরুষকে ভালোবেসে আমার মায়ের জীবনটা তছনছ হয়ে গেল। সর্বহারা আজ সে। আর কিছু হারানোর মতো অবস্থায় নেই। তাই জীবনে অন্তত একবারের জন্য হলেও ওই নারীকে দয়া করুন। ডিভোর্স পেপারে সাইনটা করে দিন। মুক্তি দিন মা’কে। ”

” যদি না দেই? ” দাঁতে দাঁত চেপে শুধোলেন জহির সাহেব।

দুর্বোধ্য হাসলো রাহিদ,

” বাধ্য করবো। আপনার জন্য কাপুরুষের জন্য আমার মা আর এক ফোঁটাও অশ্রু বিসর্জন দেবে না। মায়ের ছেলে হিসেবে এ আমার প্রতিশ্রুতি। ”

জোরালো গম্ভীর স্বরে ভড়কে গেলেন জহির সাহেব। আজ এ কি দৃশ্য দেখছেন উনি? ছেলে ওনার এতখানি বদলে গেছে! প্রতিটি বাক্যে কঠোরতার ছাপ। কাট-কাট অবিচল কণ্ঠস্বর। এতটা পরিবর্তন কি করে সম্ভব? বিস্ময়ের রেশ কাটিয়ে উনি বলে উঠলেন,

” ভেবেচিন্তে বলছো তো? ডিভোর্স হয়ে গেলে আমার সহায়সম্পত্তির কানাকড়িও পাবে না কিন্তু। তোমাকে আমি ত্যাজ্য পুত্র.. ”

আর বলা হলো না। দু পা পিছিয়ে গেল রাহিদ। পিতার পানে তাকিয়ে অসন্তুষ্ট অথচ দৃঢ় স্বরে বললো,

” আপনি কি ত্যাজ্য করবেন? আজ এ মুহূর্তে আপনাকে আমি ত্যাজ্য পিতা করলাম জহির আহসান। ”

সে স্থানে যেন গগন কাঁপানো বজ্রপাত হলো। স্তব্ধ চাহনিতে তাকিয়ে পিতা। ছেলে ওনার এতবড় কথাটা বলতে পারলো? একটুও বুক কাঁপলো না? নির্দয় রূপে দ্বিধাহীন চিত্তে বলে ফেললো! এতটাই ঘৃণ্য উনি! রাহিদ বলে চলেছে,

” আপনার সাথে মায়ের ডিভোর্স তো নামমাত্র সামান্য ফর্মালিটিজ। আমাদের মন থেকে আপনি অনেক আগেই আউট হয়ে গেছেন। ভাবলেন কি করে আপনার ওই হারাম পয়সায় আমাদের ইন্টারেস্ট আছে? থাকুন আপনি আপনার ওই হারাম সহায় সম্বল নিয়ে। তার আগে আমাদের একটু শান্তিতে বাঁচতে দিন। ”

এই ছিল শেষ কথা। পিতার অবয়ব বরাবর ডিভোর্স পেপার এবং কলম ছুঁড়ে দিলো রাহিদ। কাগজের ঝাপটানি ছুঁয়ে গেল বুক বরাবর লোহার শিক। কলম আছড়ে পড়লো মেঝেতে। অদ্ভুতুড়ে শব্দ প্রতিধ্বনিত হলো। পিছু ঘুরে তাকালো না নির্দয় পুত্র। কাঁধে ব্যাগ জড়িয়ে বড় বড় কদম ফেলে সেথা হতে প্রস্থান করলো। রয়ে গেল এক একাকী ব্যক্তি। অপরাধী সত্তা কেড়ে নিয়েছে যার সবটুকু। আজ প্রকৃতপক্ষে সর্বহারা সে। কিচ্ছু নেই। এতবড় দুনিয়ায় একাকী সে।

‘ আনন্দাঙ্গন ‘ এ বসেছে আজ আনন্দমেলা। ব্যস্ত সময় পাড় করছেন মালিহা, রায়না, নাজরিন, নীতি, নিদিশা। যেকোনো মুহূর্তে এসে পৌঁছাবে বাড়ির গর্ব, তাদের আদরের হৃদি। পুত্রবধূকে সাদরে অভ্যর্থনা জানাতে প্রস্তুত মালিহা। অবশেষে এলো কাঙ্ক্ষিত মুহুর্ত। গাড়ির হর্ন প্রবেশ করলো শ্রবণেন্দ্রিয়ে। খুশিতে আটখানা হয়ে ছুটে গেল রায়না ও নিদিশা। উন্মুক্ত হলো সদর দরজা। অপেক্ষারত সকলে। উপস্থিত দুই পরিবারের সদস্যরা। কিয়ৎক্ষণ বাদে সকলের অপেক্ষার অবসান হলো। চোখেমুখে ফুটে উঠলো উজ্জ্বলতা। ফিরে এসেছে বাড়ির মেয়ে। তাদের হৃদি। তবে অভাবনীয় দৃশ্যে চমকালো সব! শ্বেতশুভ্র বেশধারী ইরহাম প্রবেশ করেছে অভ্যন্তরে। তার শক্তপোক্ত বাহুতে আবদ্ধ সঙ্গিনী। পাঁজাকোলে ঠাঁই মিলেছে হৃদির। লাজে রাঙা মেয়েটি। বারংবার উশখুশ করছে নামিয়ে দেয়ার জন্য। বড়রা, ছোটরা সবাই উপস্থিত। কি ভাবছে তারা! বেপরোয়া-বেলাজ পুরুষ তাতে ভ্রুক্ষেপ করলে তো? নিজ কর্মে লিপ্ত রইলো। অন্দরে উপস্থিত হলো তারা দু’জন। যতন করে স্ত্রীকে সোফায় বসিয়ে দিলো মানুষটি। বরাবরের মতোই মুখশ্রীতে গাম্ভীর্য বিদ্যমান। রাহিদ ও ইনায়া দু পাশ হতে হাত ধরে পল্লবীকে নিয়ে আস্তে ধীরে হেঁটে ভেতরে এলো। নীতি ও রায়না এগিয়ে গেল। ওনায় হাত ধরে সোফায় বসতে সহায়তা করলো। মালিহা ও ফারহানা চঞ্চল পায়ে সেথা হতে প্রস্থান করলেন। কিছুক্ষণ বাদে ফিরে এলেন। হাতে ট্রে। তাতে ইস্পি ড্রিংক এবং পানি। যে যেটা পছন্দ করে আর কি। মালিহা ট্রে বাড়িয়ে কোমল স্বরে বললেন,

” ভাবী, হৃদি! এই নাও। পানি খাবে নাকি শরবত? ”

হৃদি নরম স্বরে বললো,

” মা আমরা ঠিক আছি। অস্থির হয়ো না। তুমি বসো তো পাশে। ”

মালিহা মৃদু হেসে বললেন,

” সোনা মা আমার। আমরা ঠিক আছি। তুই একটু ইস্পি খা। ভালো লাগবে। এই নে। ”

ওর হাতে ইস্পির গ্লাস দিলেন। থুতনিতে আঙ্গুল ছুঁয়ে চুমু এঁকে দিলেন মালিহা। হৃদি লজ্জালু হাসি উপহার দিলো। মালিহা হাস্য বদনে ভাবীর হাতে ঠাণ্ডা পানির গ্লাস দিয়ে ওনার খোঁজখবর নিতে লাগলেন। হৃদি ইস্পির গ্লাসে কয়েক চুমুক দিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো আপনজনদের সঙ্গে আলাপচারিতায়। কতদিন বাদে একত্রিত হয়েছে সকলে। আবার দেখছে তাদের। ভেবেছিল আর বুঝি দেখা হবে না। ইউরোপের বুকেই হারিয়ে যাবে এক হৃদি। তবে আলহামদুলিল্লাহি আলা কু’ল্লি হাল। রাসূল ( সাঃ ) বলেছেন,

‘মুমিনের ব্যাপারটি কতই না বিস্ময়কর! তার সব কাজই তার জন্য কল্যাণকর, এটা মুমিন ছাড়া আর কারো জন্য হয় না। যদি তার কোন মঙ্গল স্পর্শ করে, সে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে। এটা তার জন্য কল্যাণকর। আর যখন তাকে কোন মন্দ স্পর্শ করে, তখন সে ধৈর্য ধারণ করে। আর এটাও তার জন্য কল্যাণকর হয়’ (ছহীহ মুসলিম, হা/২৯৯৯; মিশকাত, হা/৫২৯৭)

ধৈর্য ধারণ করে আজ সফলকাম হৃদি। ফিরে এসেছে আপনজনের কাছে। সকল প্রশংসা মহান রবের। হৃদির দু চোখে জমলো বাষ্প। অধরকোলে ফুটে তৃপ্তির আভা। মিষ্টিমধুর আলাপণে হঠাৎ ব্যাঘাত সৃষ্টি করলো ইরহাম। এতক্ষণ একপাশে দাঁড়িয়ে বউপাখিটির চঞ্চলতা, হাসিমুখ উপভোগ করছিল। তবে আর নয়। বিশ্রাম প্রয়োজন। শরীর এখনো দুর্বল। তাই বরাবরের মতো গম্ভীর স্বরে বললো,

” মামী, হৃদি! পড়ে কথাবার্তা বলবে। এখন রুমে চলো। রেস্ট দরকার। ডক্টর কি বলেছে আশা করি মনে আছে? ”

হৃদি করুণ চোখে তাকিয়ে। সে এখুনি ঘরে যেতে ইচ্ছুক নয়। আরো থাকতে চায়। ফারহানা মেয়ের অভিব্যক্তি লক্ষ্য করলেন। তাই তো মেয়ের স্বাস্থ্যের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে এগিয়ে এলেন। ওর মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে কোমল স্বরে বললেন,

” রাত অবধি আমরা এখানেই আছি মা। যা রুমে গিয়ে একটু বিশ্রাম নে। চনমনে শরীরে সন্ধ্যায় নাহয় আড্ডা দিস? ”

অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজী হলো হৃদি‌। আহ্লাদী সুরে বললো,

” ঠিক আছে। তোমরা কিন্তু যাবে না। এখানেই থাকবে।”

” আচ্ছা মা। আমরা আছি। তুই রুমে যা। বিশ্রাম দরকার। ”

ইরহামের ইশারা পেয়ে রায়না ও নিদিশা এগিয়ে এলো। ওরা দু’জনে মিলে হৃদির সঙ্গে কথাবার্তা বলতে বলতে ওকে নিয়ে দোতলায় অগ্রসর হলো। ইরহাম ও রাহিদ পল্লবীকে নিয়ে গেস্ট রুমের দিকে রওনা হলো। সুস্থ না হওয়া অবদি পল্লবী এখানেই থাকবেন। তারপর নাহয় ছেলের সংসারে ঠাঁই হবে ওনার। স্বামী তো আজ থেকেও নেই। এখন একমাত্র পুত্র ই আশ্রয়স্থল। চৌধুরী পরিবার অবশ্য রয়েছে। তবে উনি আর কারোর করুণার পাত্রী হতে চান না। ওনার এই সিদ্ধান্তকে সম্মান জানিয়েছে ইরহাম ও তার পরিবার। তাই কিছুদিন পর পল্লবী ছেলের নতুন আবাসে চলে যাবেন। সেথায় গড়ে উঠবে নতুন সংসার। রাহিদ, ইনায়া, পল্লবী এবং রায়না। ছোট পরিবার।

.

বিভাবরীর কৃষ্ণাবরণে আচ্ছাদিত ধরিত্রী। বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে হৃদি। ঘন্টা দুয়েক পূর্বে নৈশভোজ সেরেছে। তারপর থেকে শয়নকক্ষে। বিশ্রাম নিচ্ছে এবং আদুরে ননদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে। দু পাশে বসে ইনায়া ও রায়না। বাবার বাড়ির লোকেরা নৈশভোজ সেরে ফিরে গিয়েছে। নীতি ও নিদিশা বলেছে আগামীকাল আবার আসবে। কিন্তু বড় আপু? সে কেমন গুমোট হয়ে ছিল। কোনো কারণে কি মন খারাপ?

” অ্যাই ভাবী? যে ডক্টর রোজ তোমার কেবিনে রাউন্ডে আসতো তার নাম কি যেন? ”

হৃদি তাকালো ইনায়ার দিকে। কিছু একটা ভেবে দুষ্টু হেসে বললো,

” স্যরি ডিয়ার। নাম বলতে অপারগ আমি। তোমার বিয়ে হয়ে গেছে। ভুলে গেছো কি? সো পরপুরুষে নো হাঙ্কিপাঙ্কি। ওকে? ”

থতমত খেল ইনায়া। ত্বরিত বড় বড় চোখে তাকিয়ে বললো,

” আসতাগফিরুল্লাহ্! এসব কি খাতারনাক কথাবার্তা বলছো ভাবী? তোমাদের প্রিয় রাহি ভাইয়া যদি জানতে পারে না? আমার দুই চোখ রীতিমতো তুলে নেবে। এরপর মার্বেল খেলবে। ”

হৃদি ও রায়না ফিক করে হেসে উঠলো। রাহিদ কি আসলেই প্রিয়তমার সঙ্গে এমনটি করতে পারবে? অসম্ভব। রায়না দৃঢ় স্বরে বললো,

” ভাবীপু। তুমি কিন্তু আমার সহজ-সরল মাসুম ভাইয়ের নামে মিথ্যা অভিযোগ করছো। আমার ভাই ভদ্রলোক। সাইকো না যে কেউ তার বউয়ের দিকে তাকালে চোখ তুলে নেবে। ”

ইনায়া তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ জানালো,

” এক মিনিট। এক মিনিট। আমি কখন বললাম যে সেই ডক্টর আমার দিকে তাকিয়ে থাকে? আমি তো তোমার জন্য জিজ্ঞেস করছিলাম। ”

শেষের কথাটা দুষ্টু হেসে বললো ইনায়া। রায়না বিস্ময়ে বাকশূন্য! ভাবীপু এসব কি বলছে! হৃদি সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,

” ইনু! এসব কি শুনছি? কেচ্ছা সত্যি নাকি? ”

ইনায়া আত্মবিশ্বাসী স্বরে বললো,

” পঁচাশি পার্সেন্ট সত্য। ওই হ্যান্ডসাম ডক্টর কেবিনে এসে রোগী মানে তোমাকে কম রায়নাপু’কে দেখতো বেশি। ”

মুখ টিপে হাসছে ইনু। রায়না থতমত খেল। লাজে লাল হলো গাল। এ কেমন লজ্জাজনক পরিস্থিতি! লুচু ডক্টর আসলেই এমনটি করতো? কই? সে তো লক্ষ্য করেনি!

” ইশ্। কিসব বলছো তুমি? মোটেও এমনটা হয়নি। ”

রায়না মানতে নারাজ। হৃদি শব্দহীন হেসে উঠলো। দুষ্টুমির ছলে শুধালো,

” কি গো নন্দিনী? কেয়া চাল রাহা হ্যায়? সম্বন্ধ ঠিক করবো কি? হা? ”

সম্বন্ধ! নো ওয়ে। রায়না তৎক্ষণাৎ লাজশরম বিসর্জন দিয়ে প্রতিবাদ জানালো,

” একদমই না। আমার ওই ডক্টর মক্টর পছন্দ না। রোগী দেখতে দেখতে ওরা সব পাথর দিলের হয়। আমার তো.. অফিসওয়ালা হ্যান্ডসাম চাই। ”

শেষোক্ত কথাটায় কেমন লাজুকতা প্রকাশ পেল। টোন করে বলে উঠলো হৃদি-ইনায়া,

” ওহ্ আচ্ছা? ”

” কর্পোরেট হ্যান্ডু চাই তাই তো? ঠিক আছে। তোমাদের ভাইয়া ফিরুক। বলবো নে। ”

হৃদির কথায় আঁতকে উঠলো রায়না। দ্রুততার সহিত দু হাতের মুঠোয় ভাবীর কোমল হাতটি বন্দী করে করুণ স্বরে বললো,

” ভাবী। মে রে দেবে নাকি? আমি তো এখনো বাচ্চা। কিয়ের বিয়েশাদী? আমি এখনো ফিডার খাই বুঝেছো? ভুল করেও ইরু ভাইয়াকে এসব বলবে না। ভাইয়া শুনলে কি ভাববে বলো তো? যে তার ভদ্র সভ্য রায়ু বোন এতটা বেশরম? ছিঃ ছিঃ ছিঃ। ভুল করেও এসব বলতে যেয়ো না। ”

” কি বলতে নিষেধ করা হচ্ছে? ”

গম্ভীর পুরুষালি কণ্ঠস্বর ধাক্কা দিলো ওদের শ্রবণেন্দ্রিয়ে। কথায় আছে না যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধে হয়। সর্বনা’শ! ভীত দৃষ্টিতে দরজা বরাবর তাকালো রায়না। ঘরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ইরহাম। হৃদি ও ইনায়া একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে মিটিমিটি হাসছে। রায়না ত্বরিত লাফ দিয়ে বিছানা হতে নেমে এলো। ইরহাম সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে। ধীরপায়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। রায়না কি বলবে কি বলবে ভাবতে ভাবতে শেষমেষ লম্বা করে সালাম দিলো,

” আ আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া। ভালো আছো? ”

” ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ্। তোর কি খবর? ”

ঘন্টাখানেক আগেও দেখাসাক্ষাৎ হলো। এখন সৌজন্যতার খাতিরে কুশল বিনিময় করতে হচ্ছে মানুষটিকে। রায়না বোকা হেসে বললো,

” আমিও আলহামদুলিল্লাহ্। তোমরা তাহলে থাকো। আমি আসছি কেমন? বাই বাই। ”

রায়ু’কে আর কে পায়। উসাইন বোল্টের গতিতে দৌড়ে সেথা হতে প্রস্থান করলো মেয়েটা। হৃদি ও ইনায়া একত্রে শব্দ করে হেসে উঠলো। ভাই ভাবীকে বিরক্ত করতে চায় না বিধায় ইনায়া বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ভাবীকে বললো,

” ভাবী আমিও আসছি তাহলে। নিজের যত্ন নিয়ো। ঠিক আছে? গুড নাইট। ”

হৃদি মুচকি হেসে ইতিবাচক মাথা নাড়ল। ইনায়া একবার ভাইয়ের দিকে তাকালো। সে ড্রেসিং টেবিলের সম্মুখে দাঁড়িয়ে। হাতঘড়ি খুলছে। ইনায়া দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে ঘর হতে প্রস্থান করলো। এতক্ষণে হৃদি পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো স্বামীর পানে। প্রায় দশ বারো দিন বাদে সে-ই চেনা পরিচিত দৃশ্য! বাহির হতে ফিরেছে মানুষটি। স্বেদজল উপস্থিত মুখশ্রীতে। পরিপাটি মসৃণ চুল হালকা এলোমেলো। চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ। তবুও সুদর্শন লাগছে! নজরকাড়া সুপুরুষ সে! তার একান্ত পুরুষ। লাজুক আভা ছড়িয়ে পড়লো দু গালে।

” মায়াবী দু চোখে লাজুকতা, গালে লেপ্টে লালিমা। সিডিউস করতে চাইছেন বিবিজান? ”

চলবে.

#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_২৪ ( প্রথমাংশ )

হৃদির অবনত মুখশ্রীতে লাজুকতার আভাস। সমতল আরশির মধ্য দিয়ে মুগ্ধ নয়নে তা অবলোকন করে চলেছে ইরহাম। বিগত কিছুদিনের দুশ্চিন্তা, গ্লানি, অস্থিরতা সব যেন এক লহমায় পলায়ন করেছে। এ মুহূর্তে ঘরজুড়ে শুধু অফুরন্ত প্রশান্তির বসবাস। স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল মানুষটি। মুচকি হেসে বললো,

” চুপ হয়ে গেলে যে? বললে না তো.. ”

অসম্পূর্ণ রইলো বাক্য। কেননা প্রসঙ্গ বদলাতে দ্রুততার সহিত হৃদি প্রশ্ন করে বসলো,

” আপনি কি ডিনার করে এসেছেন? নাকি খাবার রেডি করবো? ”

বলে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বিছানা ছেড়ে নেমে যেতে উদ্যত হলো মেয়েটি। তখনই গম্ভীর স্বরে এক ধমক,

” একদম নামবে না। ”

হকচকিয়ে গেল হৃদি। দু চোখে বিস্ময়! তাকিয়ে স্বামীর পানে। মানুষটি হঠাৎ গম্ভীর রূপ ধারণ করলো কেন? সে কি কোনো অন্যায় করে ফেলেছে! ধীরপায়ে ইরহাম সন্নিকটে এলো। বিছানা ছেড়ে স্বল্প নেমে আসা কোমল দু’টো পা ধরে বিছানায় উঠিয়ে দিলো। দেহে জড়িয়ে দিলো পাতলা কাঁথা। আদেশের সুরে বললো,

” ইয়্যু নিড রেস্ট। চুপটি করে বিশ্রাম নাও। আমি খেয়ে এসেছি। তিড়িংবিড়িং করতে হবে না। ”

তৎক্ষণাৎ মৃদু স্বরে আপত্তি জানালো হৃদি,

” আমি তিড়িংবিড়িং করি? ”

” তা নয়তো কি? বাড়িতে আসতে না আসতেই ফুল ফর্মে ফিরে এসেছো। ডক্টর কি বলেছে আর তুমি কি করছো? ”

আদুরে গলায় বললো হৃদি,

” আমি রেস্ট নিয়েছি। বেশি কিছু করিনি। বিশ্বাস করুন। ”

” করতে পারলাম না বলে স্যরি। ” ত্যাড়া জবাব।

হৃদি মুখ বাঁকালো। শুরু হয়েছে ‘ মাস্টার দ্য ইরু বেপ্পি ‘ এর মাস্টারি! হুহ্! ইরহাম ঠিক লক্ষ্য করলো বউ তার ক্ষে’পেছে। তবুও ভ্রুক্ষেপ করলো না। বরং কড়া স্বরে বললো,

” আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। এক পা-ও যেন নিচে না নামে। ”

কাবার্ড থেকে পোশাক নিয়ে ইরহাম ওয়াশরুমে গেল। ঘরে রইলো একাকী হৃদি। বসে থাকতে আর ভালো লাগছে না। কেমন ঘুম ঘুম পাচ্ছে। আঁখিপল্লবেরা আদরে বুজে যেতে চাইছে। ডান হাতের উল্টো পিঠে ওষ্ঠাধর আড়াল করে হাই তুললো। আধশোয়া অবস্থা হতে সোজা হয়ে শুলো মেয়েটি। বালিশে এলিয়ে মাথা। ব্যস্ত দিনের শেষে জড়িয়ে আসছে অক্ষিপল্লব। বাঁ কাত হয়ে শুয়ে হৃদি। ধীরে ধীরে তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব ঘিরে ফেললো তাকে। অতিবাহিত হলো কিছু মুহূর্ত। কিয়ৎক্ষণ বাদে অকস্মাৎ শিউরে উঠলো কায়া। শিহরিত তনুমন। পেশিবহুল দু হাতের অভেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ সে। তন্দ্রা ভাব লহমায় হারিয়ে গেল। ভালোলাগার সাত রঙা প্রজাপতি উড়াল দিলো মনের অরণ্যে। অতি সন্নিকটে মানুষটি। তার উদোম বক্ষপটে মিশে ওর কোমল কায়া। শক্তপোক্ত দু’টো হাত আবদ্ধ করে নিয়েছে কটিদেশ। কয়েক সহস্র মিনিট বাদে সে-ই চিরচেনা সান্নিধ্য। নাসিকা গ্ৰন্থিতে পৌঁছাচ্ছে মানুষটির নিজস্ব সুবাস। গাত্রে ছুঁয়ে তার শিহরণ জাগানো উষ্ণতা। আবেগী হৃদির চোখে অশ্রু জমলো। ভিজে গেল দু কপোল। অতি সন্নিকটে থাকায় প্রিয়তমার মনোভাব বুঝতে অসুবিধা হলো না ইরহামের। তার মনেও যে একই অনুভূতি খেলে বেড়াচ্ছে। প্রায় দশ-বারো দিন বাদে অর্ধাঙ্গীকে নিজ বাহুডোরে আবদ্ধ করা। এই কোমল, পবিত্র অনুভূতিটুকু অবর্ণনীয়। অত্যন্ত মধুময়, পবিত্র। হৃদয়ের অন্তরীক্ষে আজ কালো মেঘ সরে ঝলমলে রৌদ্র হেসে চলেছে। বুকের ভেতর চলমান অস্থিরতা-ভয় পালিয়েছে দূর দিগন্তে। আরেকটু শক্ত বাঁধনে নিজের সনে জড়িয়ে নিলো ইরহাম। মুখ লুকালো প্রিয়তমার ডান কাঁধে। সহসা ঘুরে শুলো হৃদি। পেলব দু হাতে আলিঙ্গন করলো তার একান্ত পুরুষ। স্বামীকে। প্রশস্ত উদোম বক্ষে মুখ লুকিয়ে নিঃশব্দ ক্রন্দনে ভেঙে পড়লো মেয়েটি। বাঁ হাতে খামচে ধরলো একান্ত পুরুষের বুকের ডান পাশ। লৌহ কঠিন হৃদয়ের অধিকারী মানুষটিও আজ আবেগতাড়িত। কালবিলম্ব না করে সঙ্গিনীকে জড়িয়ে নিলো নিজের সনে। দু’জনের চোখে অবিরাম শ্রাবণ ধারা। হৃদয়ে বিচ্ছেদ শেষে মিলনের সুরধ্বনি। একে অপরকে প্রগাঢ় রূপে আঁকড়ে ধরলো হৃ’হাম। যেন ঝড়ের শেষে এ-ই বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। এক চিলতে আশার আলো। আবেগী দু’জন প্রিয়জনের সান্নিধ্যে সুখময় অশ্রু বিসর্জন দিলো। উষ্ণ পরশ ছুঁয়ে গেল একটুআধটু। একসময় তারা পাড়ি জমালো ঘুমের রাজ্যে।
.

মধ্যরাত তখন। ঘুমের ঘোরে নড়েচড়ে উঠলো ইনায়া। বিনা কারণে অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। একসময় নিদ্রা ভঙ্গ হলো। বিরক্তিতে কুঁচকে গেল চোখমুখ। হাই তুলে সোজা হয়ে শুলো। অবেলায় ঘুম ভেঙ্গে গেল। এখন করবে টা কি? রাতদুপুরে নৃত্য করবে! বিরক্তিকর দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো বামে। স্বামীর পানে। সহসা চাহনিতে পরিবর্তন এলো। রাহিদ সজাগ! এত রাতে মানুষটি জাগ্রত কেন? স্বামীর পানে কাত হয়ে শুলো ইনায়া। আঁধার মাঝেও দেখতে পেল স্বামীর চোখে অশ্রুজল। বিচলিত ইনায়া ডেকে উঠলো তাকে,

” অ্যাই তোমার কি হয়েছে? কাঁদছো কেন? শুনছো? ”

ইনুর কণ্ঠে হুঁশ ফিরলো। দ্রুত হস্তে চোখের পানি মুছে নিলো রাহিদ। মুখে মিথ্যা হাসির রেখা ফুটিয়ে তুললো। তাকালো স্ত্রীর পানে। দুষ্টুমির ছলে বললো,

” রাতদুপুরে বিল্লি হয়ে আউলাঝাউলা দেখছিস? কোন সুখে কাঁদবো রে? একদম উল্টোপাল্টা অভিযোগ করবি না। জানিস না পুরুষ মানুষের কাঁদতে মানা? ”

দুষ্টুমিতে মোটেও প্রসঙ্গ বদল হলো না। বরং আধশোয়া হয়ে বসলো ইনায়া। স্বামীর গালে লেপ্টে থাকা সরু অশ্রুরেখা আলতো স্পর্শে মুছে দিলো। শিউরে উঠলো রাহিদ। মুখ ফিরিয়ে নিলো। চোখের জল দেখাতে অনিচ্ছুক সে। তবুও ধরা পড়ে গেল। ইনায়া স্বামীর দু গালে হাত রেখে মুখখানা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো। কোমল স্বরে শুধালো,

” মায়ের জন্য মন কেমন করছে? ”

অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। আকস্মিক কেমন শিশুর ন্যায় ক্রন্দনে ভেঙে পড়লো ছেলেটা। বিচলিত ইনায়ার বুক কেঁপে উঠলো। এ কি দৃশ্য দেখছে সে! তার রাহি কাঁদছে! দু’চোখে বর্ষণ। কেঁপে কেঁপে উঠছে ওষ্ঠাধর। আর’ক্ত আভা ছড়িয়ে মুখে। কোমল হৃদয়ের অধিকারিণী কন্যা আর সইতে পারলো না। কোনোরূপ ভাবনা বিহীন স্বামীকে কাছে টেনে নিলো ইনু। অর্ধাঙ্গীর বুকে মিললো ঠাঁই। পুরুষালি দু হাতের আলিঙ্গনে আবদ্ধ কটিদেশ। ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে রাহিদ। ইনায়া স্বামীর মাথায় এক হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আরেক হাত আদর করে চলেছে পৃষ্ঠদেশে। নিজের চোখেও অশ্রু কণা। তার স্বামী কাঁদছে কেন? বুকের ভেতর খুব বেশিই জ্বা’লাপো’ড়া করছে? কষ্ট হচ্ছে! কেন কাঁদছে সে! এ মানুষটির আবেগী রূপ যে অভাবনীয়। অকল্পনীয়। তেমনভাবে কখনো দেখেনি সে। আজ প্রথমবারের মতো এই রূপ দর্শন। কিছুক্ষণ আবেগতাড়িত মুহূর্ত অতিবাহিত হলো। একটুখানি ধাতস্থ হয়ে সরে গেল রাহিদ। মাথা এলিয়ে দিলো বালিশে। ইনায়া আরেকটু সন্নিকটে এলো। পেলব দু হাতে মুছে দিলো চোখের পানি। প্রথমবারের মতো অভাবনীয় এক কাণ্ড করে বসলো। স্বামীর ললাটে চুমু এঁকে দিলো মেয়েটি। অপ্রত্যাশিত আদুরে পরশে কম্পিত হলো চিত্ত। রাহিদ তাকালো স্ত্রীর পানে। নয়নে মিলিত হলো নয়ন। স্বামীকে শান্ত হবার জন্য সময় দিলো ইনু। আস্তে ধীরে শান্ত হলো রাহিদ। স্ত্রীর হাত ধরে কাছে টেনে নিলো। স্বামীর চওড়া বুকে মিললো ঠাঁই। চুপটি করে শুয়ে ইনায়া। শ্রবণেন্দ্রিয়ে পৌঁছাচ্ছে হৃদস্পন্দনের ধুকপুক ধুকপুক ধ্বনি। আনমনে বলে চলেছে রাহিদ,

” মায়ের জীবনটা এত কষ্টের হলো কেন? একটুখানি সুখ কি আমার মা ডিজার্ভ করে না? হ্যাঁ রে ইনু? ওই লোকটা আমার মায়ের জীবনে কেন এলো? কেন ভালোবাসা নামক সর্বগ্রাসী জালে আমার মা’কে ফাঁ:সালো? আমার মা তো ভালো ছিল। সুখে ছিল। ওই লোকটার আগমনে সব শেষ হয়ে গেল। সব। আপনজন হারালো মা। সবাইকে ছেড়ে ওই নির্দয় লোকটার হাত বেছে নিলো। বিনিময়ে পেল কি? দুঃখ কষ্ট আর বিশ্বাসঘা:তকতা। মায়ের জীবনটা পুরো শেষ হয়ে গেল। এক নারীর জীবনে তার স্বামীর স্থান কতটা গুরুত্বপূর্ণ, আপন জানিস? সেই স্বামী যখন হৃদয়ের কাঠগড়ায় আসামি হয়… সেই কষ্টটা! বলার মতো নয়। বড় যন্ত্রণাদায়ক! ”

ইনায়া নিঃশব্দে স্বামীর বুকে শুয়ে। শুনে চলেছে তার দুঃখ ভারাক্রান্ত শব্দমালা,

” মা’কে আমি কতবার বলেছি। ইরু ভাইয়া বলেছে। মা শুনলো না। অন্ধবিশ্বাস করে গেল। একবার না দুইবার না শতবার ওই লোকটাকে বিশ্বাস করলো। শুধরে যাওয়ার সুযোগ দিল। কি পেল বিনিময়ে? র-ক্তাক্ত প্রতিদান। হাহ্! অনেক হয়েছে আর না। চোখের সামনে আমি আমার জন্মদাত্রী মা’কে র-ক্তাক্ত অচেতন অবস্থায় দেখেছি। তাকে এই দুই হাতে নিয়ে হাসপাতালে ছুটেছি। প্রথমবারের মতো মা’কে হারানোর ভয়ে বুক কেঁপেছে। ফালাফালা হয়েছে ভেতরটা। আর না। ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিয়েছি ওই লোকটার কাছে। মা সাইন করে দিয়েছে। অশ্রুসজল চোখে একদিন সাইন করে ওই লোকটার সাথে জড়িয়েছিল। জীবনের এই দুঃখজনক পরিস্থিতিতে আরেকটি সাইন করে তার থেকে মুক্তি চাইছে। জীবনটা বড় বৈচিত্র্যময় তাই না রে? মা কখনো ভেবেছিল একদিন এমন কষ্টদায়ক মুহূর্ত দেখতে হবে? সইতে হবে? ভাবেনি। তাকদীরে ছিল রে। তাই তো আজ মায়ের এই দুর্দশা। আমি ছেলে হয়েও ব্যর্থ। কিচ্ছুটি করতে পারলাম না। কিচ্ছু না। ”

শেষের কথাটিতে সহমত পোষণ করতে পারলো না ইনায়া। স্বামীর বুকে হাত বুলাতে বুলাতে কোমল কণ্ঠে বললো,

” তুমি ভুল ভাবছো। মামীর গর্ব তুমি। তুমি একা নও। তোমরা দুই ভাই-বোন ই তার গর্ব। সুখের ফোয়ারা। তোমাদের মুখ চেয়েই মামী অনেকসময় অনেক কিছু সহ্য করেছে। কাউকে জানতে দেয়নি। বুঝতে দেয়নি। কাকেই বা বলবে? আপনজন তো থেকেও নেই। তারা যে ত্যাজ্য করেছে। কোথায় যাবে সে? তার স্ত্রী সত্তা তাকে বাঁধা দিয়েছে বারবার। মাতৃ সত্তা শাসন করেছে। ফলস্বরূপ আজ এই দিন দেখতে হচ্ছে। দুঃখ পেয়ো না গো। যা হওয়ার হয়ে গেছে। এবার আমাদের আগামী নিয়ে ভাবতে হবে। অনেক তো হলো। ইনশাআল্লাহ্ এখন থেকে মা আর কাঁদবে না। দুঃখের অশ্রু নয় সুখের অশ্রু বিসর্জন দেবে সে। বলো আমরা সেটা নিশ্চিত করতে পারবো না? পারবো না মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে? বলো? ”

অর্ধাঙ্গীকে বুকে মিশিয়ে নিলো রাহিদ। চুলে মুখ গুঁজে অস্ফুট স্বরে ইতিবাচক সম্মতি জানালো,

” পারবো। পারতেই হবে। আবার হাসবে মা। ”

অশ্রুভেজা কণ্ঠে আত্মবিশ্বাস। ইনায়াও তার রাহিকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে নিলো। দু’জনের অন্তরে বিশ্বাস,

‘ আবার হাসবে মা। ইনশাআল্লাহ্। ‘

সময়ের চক্রাকার ঘূর্ণিতে অতিবাহিত হলো বেশ কিছুদিন। বন্দী জীবন হতে মিললো মুক্তি। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলো হৃদি। তা সহজ ছিল না বটে। শত্রুদের প্ররোচনায় চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল মিথ্যে গুজব ‘হৃদি পালিয়েছে তার দেহরক্ষীর সঙ্গে। ‘ আমাদের সমাজে আজও কিছু মানুষ বসবাস করে। যারা সত্য মিথ্যা বাছবিচার বিনা মিথ্যা শব্দমালা বিশ্বাস করে নেয়। ভুলভাল অপবাদ দেয়। তেমনই কিছু মানুষের বাক্যবাণে বি দ্ধ হতে হয়েছে হৃদি’কে। তাকে মানসিকভাবে বিধ্ব-স্ত করতে লেগে পড়েছিল লোকগুলো। তন্মধ্যে পাড়া প্রতিবেশী, ভার্সিটির কিছু শিক্ষার্থী অন্যতম। জমিলা বানুও বাদ যাননি। অবিরাম কটূক্তি করে যাচ্ছিলেন। যার ফলাফল পেলেন এক সন্ধ্যায়…
_

সান্ধ্যকালীন প্রহর। মাগরিবের সালাত আদায় করে লিভিংরুমে একত্রিত হয়েছে পরিবারের সদস্যরা। শুক্রবার বিধায় এজাজ সাহেব বাড়িতে। ইরহাম কিয়ৎক্ষণ পূর্বে ফিরেছে। লিভিংরুমে নারী সদস্যরা উপস্থিত। হৃদি মা ও দাদির হাতে চায়ের কাপ তুলে দিলো। ওনারা বিনিময়ে মুচকি হাসি উপহার দিলেন। হৃদিও মুচকি হাসলো। চায়ের কাপ হাতে তাকালো জমিলা বানুর পানে। মনটা কেমন করে উঠলো। এই বৃদ্ধা নারী ওকে মোটেও পছন্দ করে না। সুযোগ পেলেই কটুবাক্য শুনিয়ে দেয়। সম্মান প্রদর্শনের জন্য হৃদি চুপ থাকে। কয়েকদিনের অতিথি। সময় হলে চলে যাবেন। অহেতুক সম্পর্কে বিরূপতা আনার প্রয়োজন নেই। তবুও অবাধ্য মনে কালো মেঘ জমে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হৃদি এগিয়ে গেল। চায়ের কাপ বাড়িয়ে বললো,

” দাদি আপনার চা। ”

সোফায় বসে সুপারি কাটছিলেন জমিলা বানু। অপছন্দের মেয়েটার কণ্ঠ শুনে চোখ তুলে তাকালেন। এমন দৃষ্টিতে তাকালেন যেন চোখের চাহনিতেই ভ’স্ম করে দেবেন। হৃদি দ্বিধান্বিত চোখে তাকিয়ে। ভাবসাব সুবিধার ঠেকছে না। কাপ কি ফিরিয়ে নেবে!

” বেশরম মাইয়া! লজ্জা শরম নাই তোমার? কোন সাহসে ওই অপবিত্র হাত দিয়া আমারে চা দাও? হুঁ? আমি তোমার থে চা চাইছি? চুপ কইরা আছো ক্যা? চা চাইছি আমি? ”

মালিহা ও রাজেদা খানম হতবাক! ইনি আবার শুরু করেছে! এমনিতেই বাড়িতে ইরহাম উপস্থিত। হৃদি আমতা আমতা করে কিছু বলার পূর্বেই বদলে গেল পরিবেশ। কর্ণপাত হলো ভারিক্কি গম্ভীর কণ্ঠস্বর,

” আমার স্ত্রীকে অপবিত্র বলছেন কোন সাহসে? ওর পিউরিটি সার্টিফিকেট দেয়ার আপনি কে? ”

থমকে গেল পরিবেশ। সকলের দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো সিঁড়ি বরাবর। সিঁড়ির ধারে দাঁড়িয়ে গোমড়ামুখো মানুষটি। থমথমে মুখশ্রী। পড়নে ঘরের পোশাক। ধূসর রঙা টি-শার্ট ও ট্রাউজার। মালিহা ও রাজেদা খানম সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। হৃদি দ্রুত টেবিলের ওপর চায়ের কাপ রেখে দিলো। স্বামীকে কিছু বলার পূর্বেই শুনতে পেল জমিলা বানু ব্যাঙ্গ করে বলে উঠেছেন,

” বাহ্! তোমার বউ অপবিত্র হইতে পারে আর মাইনষে হেইডা কইতে পারবে না? ”

বৃদ্ধা মহিলা খোঁচা মে রে বললেন। একেবারে জায়গামতো আঘাত করেছেন উনি। এবার কি বলবে ইরহাম? মিটিমিটি হেসে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন জমিলা বানু। বক্র হাসি ফুটে উঠলো মানুষটির অধরকোণে। ধীরপায়ে এগিয়ে গেল। মুখোমুখি দাদি-নাতি। তার পানে স্বল্প ঝুঁকে গেল ইরহাম। চোখে চোখ রেখে বক্র হেসে টেনে টেনে বললো,

” আমার বউ পবিত্র আছে না অপবিত্র সেটা আমার চেয়ে ভালো কে জানবে দাদিজি? ”

চরমভাবে বোকাবনে গেলেন বৃদ্ধা নারী। বেশরমের মতো এসব কি বলছে ছেলেটা!

” ছিঃ ছিঃ ছিঃ! লাজ শরমের মাথা খাইছো নি? নির্লজ্জ পোলা কোথাকার। ”

সোজা হয়ে দাঁড়ালো ইরহাম। গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললো,

” এ বাড়িতে কম তো কটূক্তি করলেন না। এবার ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে। বিপদের সময় এসেছেন। আপনার মূল্যবান সময় ব্যয় করে আমাদের অনে-ক উপকার করেছেন। আশা করি এরকম উপকার দ্বিতীয়বার আর দরকার পড়বে না। টিকিট কেটেছি। আগামীকাল রাতের বাস। তৈরি হয়ে থাকবেন। ”

কাট-কাট কণ্ঠে বলা প্রতিটি শব্দ ওনার কর্ণ গহ্বরে ধাক্কা দিলো। বাকশূন্য হয়ে পড়লেন জমিলা বানু। আজ অবধি কোনো আত্মীয় ওনায় মুখের ওপর এভাবে অপমান করেনি। শেষে দু’দিনের এই ছোকড়া কিনা..! ইরহাম স্মরণ করিয়ে দিলো,

” আগামীকালের টিকিট। সময়মতো ব্যাগপ্যাক গুছিয়ে ফেলবেন। ”

আর দাঁড়ালো না ইরহাম। অসন্তুষ্ট চাহনিতে তাকালো স্ত্রীর পানে। হৃদি করুণ চোখে তাকিয়ে। কিইবা করতো সে! বয়স্কা নারীর পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করতো! স্বামী নামক মানুষটি তা বুঝলে তো। সিঁড়িতে দণ্ডায়মান বাবার পাশ কাটিয়ে দোতলায় চলে গেল ইরহাম। জমিলা বানু খিটখিটে মেজাজের সহিত অতিথি কক্ষের দিকে অগ্রসর হলেন। আর থাকবেন না এই বাড়িতে। অনেক অপমান সহ্য করেছেন। আর না। কালই চলে যাবেন।

চলবে.

#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_২৪ ( শেষাংশ )

বন্দিদশা হতে ফিরে আসার পর হৃদির জীবনটা সহজ ছিল না। প্রতিনিয়ত পাড়া প্রতিবেশী, সহপাঠী এমনকি সম্মানীয় শিক্ষকদের কটূক্তির শিকার হতে হয়েছে তাকে। মানুষগুলো কেমন অদ্ভুত চাহনিতে তাকিয়ে ওকে ক্ষতবিক্ষত করে যাচ্ছিল। আ’ক্রমণ করছিল দূষিত শব্দ বাণে। সে সময় পাশে থেকে মনোবল বৃদ্ধি করেছে পরিবার, বন্ধুবান্ধব। তার একান্ত পুরুষ। শিরায় শিরায় ছড়িয়ে দিয়েছে ইতিবাচক উদ্দীপনা। তেমনই এক স্মরণীয় প্রহর, ইরহাম ও হৃদির প্রথম বিবাহবার্ষিকী। অচেনা দু’জন হতে হৃদয়ের সিংহাসনে আধিপত্য বিস্তার। দেখতে দেখতে অতিবাহিত হলো বিবাহিত জীবনের বারো মাস। বায়ান্ন টি সপ্তাহ। পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে ঘটা করে কোনো বড় আয়োজন করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করলো ইরহাম। বিষয়টিতে মনোক্ষুণ্ন হলো হৃদির। এই দিনটি যে তাদের জন্য অত্যন্ত মধুময়, স্মরণীয় এক দিন। বিবাহিত জীবনের প্রথম বর্ষ অতিক্রম। দিনটিকে কেন্দ্র করে কত কি পরিকল্পনা! আকাঙ্ক্ষা। সবটা বিনা কারণে ধূলিসাৎ হবে! কোনোরূপ বিশেষ আয়োজন থাকবে না? এ কেমন কথা? লহমায় কালো মেঘে ঢাকা পড়লো সুশ্রী বদন। বিবাহবার্ষিকীর আগের রাত থেকেই অভিমানী কন্যার অভিমান পাহাড় ছুঁই ছুঁই। রাতে স্বামীর সঙ্গে ভালোমন্দ স্বাভাবিক কথা অবধি বললো না। অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে শুলো। কিন্তু এমপি সাহেব তা বরদাস্ত করলে তো! তার ভাষ্যমতে,

‘ যত মান অভিমান দিনের মধ্যেই মিটিয়ে নেবে। রাতটুকু একান্ত আমাদের। সেখানে বিন্দুমাত্র দূরত্ব বরদাস্ত করার মতো মহানুভব নয় এই ইরহাম। ‘

ব্যাস। স্ত্রীর অভিমান অগ্রাহ্য করে তাকে বাহুডোরে আগলে নিলো ইরহাম। ছটফট করতে লাগলো মেয়েটি। ব্যর্থ নিজেকে ছাড়াতে। শক্তপোক্ত দু’টো হাতের ঘেরাটোপে বন্দী অবস্থা। রূদ্ধ শ্বাস প্রশ্বাস। হাঁসফাঁস করে উঠলো হৃদি,

” উফ্! ছাড়ুন না। ”

ছাড়লো না ইরহাম। তবে মৃদু আলগা হলো বন্ধন। স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল হৃদি। এদিকে নি-ষ্ঠুর মানবের ন্যায় স্বল্প সময়ের মধ্যেই নিদ্রায় তলিয়ে গেল ইরহাম। এমনতর রূপ সত্যিই অপ্রত্যাশিত ছিল। দুঃখে কষ্টে অশ্রুবিন্দু জমলো চোখে। আধ ঘন্টার মতো জোরপূর্বক অশ্রু বিসর্জন দিলো হৃদি। তার ইরহাম এতটা বর্বর কি করে হতে পারে! স্ত্রীর দুঃখকষ্টের বিন্দুমাত্র পরোয়া না করে এভাবে ঘুমিয়ে পড়লো! অভদ্র, নি:ষ্ঠুর, পঁচা লোক! আরো কত কি সম্বোধন! মিনিট ত্রিশেক বাদে বাম হাতের উল্টো পিঠে অক্ষিকোলে আগত বিন্দু বিন্দু নোনাজল মুছে ফেললো মেয়েটা। ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে স্বামীর বুকেই মাথা এলিয়ে দিলো। পাড়ি জমালো ঘুমের রাজ্যে। যত যাই হোক না কেন। এই পঁচা মানুষটির প্রশস্ত বক্ষপট ই তার পরম শান্তির আশ্রয়স্থল। ভরসার আচ্ছাদন।

.

দিনমণির কিরণে উজ্জ্বল ধরিত্রী। সৃষ্টিকর্তার নিয়ম মোতাবেক আগমন হলো এক নতুন দিনের। সকাল হতেই দুই পরিবারের সদস্যরা হৃদিকে বিবাহবার্ষিকীর শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। কেউ সরাসরি কেউবা ফোনালাপে। মালিহা পুত্রবধূর ললাটে চুমু এঁকে দোয়া করলেন ওদের সুখী সুন্দর দাম্পত্য জীবনের জন্য। দীর্ঘায়ুর কামনা করে।

” থ্যাংকস অ্যা লট মা। ”

হৃদি আহ্লাদী হয়ে শাশুড়ি মা’কে আলিঙ্গন করলো। চুপটি করে অনুভব করতে লাগলো মাতৃ সুবাস। দিনটা নিঃসন্দেহে চমৎকার ছিল! বর নামক বর্বর লোকটি যদিওবা নিস্প্রভ আচরণ করছিল। সে তো সকাল হতেই রাজকার্য করতে বাইরে বেরিয়েছে। হৃদি একাকী ছিল। ইনুটাও নেই। নিজ সংসারে ব্যস্ত। দুপুর দু’টো নাগাদ হৃদি রওনা হলো বাবার বাড়ির উদ্দেশ্যে। নীতি ও নিদিশা ফোন করে যেতে বলেছে। সেখানে গিয়ে বেশ সুন্দর করে সময় কাটলো। ফারহানা ও রায়হান দম্পতি কনিষ্ঠ কন্যাকে নিউ কালেকশনের পোশাক উপহার দিলেন। বাকিরাও টুকটাক উপহার দিলো। সানন্দে তা গ্রহণ করলো হৃদি। বাবার বাড়ি দুর্দান্ত সময় কাটিয়ে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা নাগাদ ‘ আনন্দাঙ্গন ‘ ফিরে এলো। ফিরেই হলো হতবিহ্বল!

” হ্যাপি অ্যানিভার্সারি! ”

মধুরতম কলরবে মুখরিত পরিবেশ। জমকালো আয়োজনে উজ্জ্বল গোটা ঘর। লিভিং রুমে নিকটাত্মীয়দের উপস্থিতি। সমস্বরে ওকে বিবাহবার্ষিকীর শুভেচ্ছা জানাচ্ছে তারা। চারিধারে মনের মতো সাজসজ্জা। কৃত্রিম আলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে গাত্র। আবেগে আপ্লুত হৃদির তৃষ্ণার্ত চক্ষু জোড়া খুঁজে বেড়াচ্ছে একান্ত জনকে। এতসব আয়োজন কখন করলো তার বর্বর বরটি? কোথায় লুকিয়ে সে! ব্যর্থ হলো চক্ষুদ্বয়। খুঁজে পেল না তারে। হৃদির নিকটে এগিয়ে এলো ইনায়া, রায়না। আদুরে ভাবীকে নিয়ে দোতলায় চলে গেল। অতিবাহিত হলো কিছু মুহূর্ত। ‘ আনন্দাঙ্গন ‘ এ পৌঁছালো হৃদির পরিবার। মালিহা ও পল্লবী তাদের সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন। হলো কুশল বিনিময়। অতঃপর এলো সে-ই কাঙ্ক্ষিত লগ্ন। সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো হৃ’হাম! সিঁড়ি বেয়ে পাশাপাশি নেমে আসছে ইরহাম ও তার হৃদরাণী। হৃদির পড়নে আজ ল্যাভেন্ডার শিমার সিল্ক জর্জেট। স্টোনস, সিকুইনস, রেশম জরি থ্রেড এমব্রয়ডারি স্ক্যালপ বর্ডারযুক্ত শাড়ির আবরণ। থ্রি কোয়ার্টার ব্লাউজটি সিল্কের কাঁচা বেগুনি রঙা। কৃষ্ণবর্ণ কেশ আবৃত ল্যাভেন্ডার রঙা হিজাবের অন্তরালে। মুখশ্রীতে কৃত্রিম প্রসাধনীর ছোঁয়া। পাশেই তার জীবনসঙ্গী ইরহাম। একান্ত মানবের পড়নে অফ হোয়াইট রঙের কুর্তা। যার ম্যান্ডারিন কলার। ফুল স্লিভ। প্রশস্ত বক্ষপটে জড়িয়ে এমব্রয়ডারিযুক্ত রৌপ্য বর্ণের হাফ স্লিভ নেহেরু জ্যাকেট। সাথে একই বর্ণের পাজামা। নভোনীল চক্ষু জোড়া আড়াল হয়েছে রিমলেস চশমায়। আপনজনদের চোখ জুড়িয়ে গেল দু’জনকে পাশাপাশি দেখে। মালিহা দূর হতে আদুরে চুমু এঁকে দিলেন। দোয়া করলেন মহান স্রষ্টার নিকটে।

হৃদি কিছু চেয়েছে এবং তা সাধ্যের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও পূরণ করবে না ইরহাম, এ যে অসম্ভব। তাই তো হৃদরাণীর ছোট্ট আবদারটুকু নিভৃতে পূরণ করলো। কতদিন পর একত্রিত হলো আপনজনেরা। বাহিরের লোক হাতেগোনা কয়েকজন উপস্থিত। সকলের উপস্থিতিতে আনন্দঘন মুহুর্ত অতিবাহিত হলো। অর্ধাঙ্গীর অধরকোলে লেপ্টে মোহনীয় দ্যুতি। স্বল্প দূরত্বে দাঁড়িয়ে ইরহাম। বিমোহিত নয়ন যুগল। দৃষ্টি ফেরানো যে আজ দুষ্কর। লাজুক কন্যার দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি বিষয়টি। তাই তো আর’ক্ত আভা ছড়িয়ে দু গালে। ওষ্ঠপুটে লজ্জালু রেখা। সকলের অগোচরে হলো তাদের চোখে চোখে আলাপণ। চোখের চাহনিতেই অসীম মুগ্ধতা প্রকাশ করলো মানুষটি। লজ্জা মিশ্রিত হাসি উপহার দিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো হৃদি।

এ কেমন হৃদয় হরণকারী চাহনি যা ছুঁয়ে যায় হৃদয়ের অলিগলি!

সর্বদা পরিকল্পনা মাফিক সবকিছু সংঘটিত হয় না। তাই তো বহিরাগত অতিথিদের যথাসম্ভব এড়িয়ে যাওয়া সত্ত্বেও কটূক্তির শিকার হলো হৃদি। সে-ই পুরনো আলাপচারিতা। অপ:হরণকালীন সময় নিয়ে শব্দের ভ-য়ঙ্কর কাটাছেঁড়া। নিমিষেই মুখে আঁধার ঘনিয়ে এলো। ভায়রা ভাই ফাহিমের সঙ্গে কথা বলছিল ইরহাম। কিন্তু দৃষ্টি নিবদ্ধ অর্ধাঙ্গীর পানে। ফলস্বরূপ সহজেই লক্ষ্য করলো হৃদির পরিবর্তিত মুখশ্রী। বুদ্ধিদীপ্ত মানুষটির বিষয়টি অনুধাবন করতে সময় লাগলো না। সহজেই মিলে গেল উত্তর। শক্ত হলো চোয়াল। আর বিলম্ব করলো না। পার্টি সমাপ্ত ঘোষণা করা হলো। একে একে প্রস্থান করলো অতিথিবৃন্দ। অনুরোধ করা সত্ত্বেও রইলো না রায়হান শেখ ও তার পরিবার। তারাও হাসিমুখে বিদায় নিলো। অতঃপর এক মুহুর্ত বিলম্ব না করে স্ত্রীর সন্নিকটে এলো ইরহাম। আঁকড়ে ধরলো কোমল হাতটি। চমকিত নেত্রে তাকিয়ে হৃদি! সকলের উপস্থিতিতে এসব কি করছে ইরহাম! অস্ফুট স্বরে কিছু বলার পূর্বেই শ্রবণেন্দ্রিয়ে পৌঁছালো গম্ভীর স্বর,

” রুমে চলো। ”

স্ত্রীর কোমল হাতটি ধরে সকলের দৃষ্টি অবজ্ঞা করে ঘরের উদ্দেশ্যে হাঁটতে আরম্ভ করলো ইরহাম। দ্বিধাগ্রস্ত হৃদি পথ অনুসরণ করে স্বামীর সঙ্গে চলতে লাগলো। মালিহা ও পল্লবী একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছেন। বুঝে উঠতে পারলেন না ছেলের এমনতর আকস্মিক আচরণের মূল হেতু কি! অবুঝ রায়না ইরহাম ভাইয়ের এমন অপ্রত্যাশিত আচরণের ভিন্ন অর্থ উদঘাটন করলো। পাশে দাঁড়িয়ে ইনায়া। ফিসফিসিয়ে তার কানে কানে বললো,

” ভাবীর গর্জিয়াস লুক দেখে ভাইয়া বোধহয় আউট অফ কন্ট্রোল! এজন্যই তড়িঘড়ি করে রুমে ছুটলো। ”

রায়না হাতের তেলোয় ওষ্ঠাধর লুকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। তবে চিন্তিত ইনায়া। ওর দৃষ্টিতে বিষয়টি ভিন্ন কিছু। কিন্তু কি?

.

নিকষকৃষ্ণ রজনী। বিছানায় বসে ইরহাম, হৃদি। দু’জনের সাজসজ্জা অনেকাংশ দূরীভূত। নেহেরু জ্যাকেট , হিজাব পড়ে রয়েছে ডিভানে। মুখশ্রীতে কৃত্রিম প্রসাধনীর প্রলেপ প্রায় বিলুপ্ত। মুছে ফেলা হয়েছে। মানুষটির চশমাও অনুপস্থিত চোখে। মুখোমুখি বসে তারা দু’জন। পুরুষালি হাতে বন্দী পেলব দু’টো হাত। নয়নে মিলিত নয়ন। কোমল স্বরে বলে চলেছে ইরহাম,

” জানো আমাদের সমাজে দুই ধরনের লোক থাকে। যারা আমাদের জন্য হানিকারক। একপক্ষ থাকে তারা অতি মিষ্টিমধুর কথায় আমাদের মন কেড়ে নেয়। ভালোমন্দ সবেতে প্রশংসা। কখনো ভুলত্রুটি শুধরে দেয়ার চেষ্টা করে না। বরং তোমাকে ভুলে ভরপুর পথে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। এরা কখনো আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী হতে পারে না। এদের মধুর কথাবার্তা আসলে বি;ষের চেয়েও বেশি আ-ক্রমণাত্মক। ক্ষতিকর। বুঝতে পারছো আমি কি বলছি? ”

ইতিবাচক মাথা নাড়ল হৃদি। হ্যাঁ সে বুঝতে পারছে। আমাদের সমাজে এমন ছদ্মবেশী শত্রুর আনাগোনা অধিক। এরা আসলেই ক্ষতিকারক। এদের সঙ্গ লাভে ভালোর চেয়ে ক্ষতি বেশি হয়ে থাকে। হৃদি মনোযোগ দিলো স্বামীর কথায়,

” দ্বিতীয়ত সে-ই শ্রেণীর লোক। এদের মুখনিঃসৃত প্রতিটি শব্দ বি-ষাক্ত। এরা কারোর ভালো সহ্য করতে পারে না। কারোর সফলতায় খুশি হতে পারে না। সবসময় অন্যকে আঘাত করার অজুহাত খুঁজে বেড়ায়। কটূক্তি করে বিপরীত দিকে থাকা মানুষটিকে বি;ধ্বস্ত করে তোলে। সবসময় মনে রাখবে হৃদি। জীবনে যদি সফলকাম হতে চাও, সুখী হতে চাও এই দুই শ্রেণীর লোকেদের থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখবে। এরা বিপদজ্জনক। তোমায় এমন রূপে নিঃশেষ করে দেবে যে তুমি টেরও পাবে না কবে কখন কিভাবে তোমার অস্তিত্বটা মাটিতে মিশে গেল। ”

হৃদি মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় শ্রবণ করে চলেছে প্রতিটি শব্দ। কি দারুণ, অর্থপূর্ণ শব্দমালা! একজন মানুষকে যথার্থভাবে অনুপ্রাণিত, উদ্দীপ্ত করার জন্য কিছু শক্তিশালী শব্দ ই যথেষ্ট। একজনকে ঘোর অমানিশা হতে ছিনিয়ে আনতে পারে কিছু ইতিবাচক শব্দ। তেমনিভাবে নেতিবাচক শব্দগুচ্ছ আঁধার অতল গহ্বরে ডুবিয়ে দিতেও পারে। এখন তুমি আলোর হাতছানি আঁকড়ে বাঁচবে নাকি তলিয়ে যাবে আঁধারে, সম্পূর্ণ তোমার ওপর নির্ভর করছে‌। তোমার মানসিক শক্তির ওপর নির্ভর করছে।

” হৃদি! ”

অত্যন্ত কোমল-হৃদয়স্পর্শী সেই ডাক! উপেক্ষা করার বিন্দুতুল্য সাধ্য নেই মেয়েটির। প্রেমময় চাহনিতে তাকালো হৃদি। চোখে চোখ রাখলো। ছুঁয়ে গেল অন্তরের গহীনে। স্ত্রীর বাঁ গালে হাতটি স্থাপন করলো ইরহাম। আবেশে মুদিত হলো মেয়েটির আঁখি পল্লব। স্বামীর হাতের সঙ্গে আরেকটু গাঢ় করে মিশিয়ে নিলো গাল।

” কথা দাও। কখনো কারোর বাজে মন্তব্যে ভেঙ্গে পড়বে না! তুমি জানো, আমি জানি, আল্লাহ্ জানে তুমি পবিত্র। নিষ্কলঙ্ক। শত্রুর কু ছায়া অবধি তোমায় ছুঁতে পারেনি। তবে কেন লোকেদের কথায় কান দেবে? পাছে লোকে কত কি বলে। সব শোনা তো আমাদের জন্য আবশ্যক নয়। তাহলে কেন শুনবো আমরা? ওরা দু’টো বাজে বকলে আমরা তিনটে ভালো বলবো। বুক ফুলিয়ে সত্য বলবো। কারণ আমরা জানি আমরা সঠিক। ভুল নই। তবে কেন পাছে লোকে ভয়? বি স্ট্রং। গোটা দুনিয়া ভার মে যাক। জেনে রেখো তোমার স্বামী ও পরিবার রয়েছে তোমার পাশে। উই আর অলওয়েজ উইথ ইয়্যু মাই গার্ল। ডোন্ট বি উইক। ”

স্বামীর মুখনিঃসৃত প্রতিটি অনুপ্রেরণাদায়ক শব্দমালা হৃদয় ছুঁয়ে মস্তিষ্কে গেঁথে গেল। সীমাহীন ভালোলাগায় বক্ষপিঞ্জরের অন্তরালে লুকায়িত প্রণয় উদ্যান হতে মিষ্টিমধুর গুঞ্জন ভেসে আসছে। চোখেমুখে উজ্জ্বলতা। এক বুক গর্ব জীবনসঙ্গীর জন্যে। আবেগে আপ্লুত তনুমন। কম্পিত ওষ্ঠাধর। অক্ষিকোল গড়িয়ে অশ্রু নামলো গালে। বিন্দুমাত্র কালক্ষেপণ না করে স্বামীর প্রশস্ত বক্ষপটে আছড়ে পড়লো আগ্রাসী ঢেউয়ের ন্যায়। পেলব দু হাত আঁকড়ে ধরলো পিঠ। পুরোপুরি মিশে যেতে চাইছে বক্ষস্থলে। প্রবেশ করতে চাইছে স্বামীর মনের অরণ্যে। সেথায় অসংখ্য প্রেমময় বৃক্ষরাজির ভীড়ে সাজাবে এক ছোট্ট সুখের আবাসন। ইরহামও নিজের সনে আঁকড়ে ধরলো স্ত্রীকে। উষ্ণ আলিঙ্গনে আবদ্ধ কপোত-কপোতী। আবেগের আতিশয্যে স্বামীর কাঁধে ক্ষুদ্র পরশ অঙ্কন করলো হৃদি। শিউরে উঠলো ইরহাম। অনুভূতির স্ফু’লিঙ্গ জ্ব’লে উঠলো মনের অরণ্যে।

চলবে.

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে