#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_২
” হাই ইনু! ”
হাত নেড়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলো মেয়েটি। অপ্রত্যাশিত ভাবে ভাবীকে দেখে যথেষ্ট অবাক ইনায়া! ভাবী তাকে নিতে এসেছে! একগাল হেসে এগিয়ে গেল মেয়েটা। হৃদি হাসিমুখে ওকে উষ্ণ আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে নিলো। শুধালো,
” পরীক্ষা ভালো হয়েছে? ”
ইনায়া সরে ইতিবাচক মাথা নাড়ল,
” হাঁ ভাবী। আলহামদুলিল্লাহ্ বেশ ভালো হয়েছে। ”
” আলহামদুলিল্লাহ্! ”
হৃদি প্রসন্ন হলো। পেশ করলো এক প্রস্তাব,
” ইনু বেবি চলো। একটু ঘোরাঘুরি করে তারপর বাড়ি ফিরবো। এতদিন পড়ালেখা করে করে দুর্বল হয়ে পড়েছো। এখন একটু তরতাজা হওয়া দরকার। ”
ইনায়া হেসে আদুরে মুখ করে বললো,
” ঠিক আছে। চলো। আগে কিছু খাবো তারপর ঘুরবো। ক্ষুধার জ্বা’লায় পেটে চোঁ চোঁ করছে তো। ”
এ বিষয়টি ভুলেই গিয়েছিল। হৃদি অপ্রস্তুত হয়ে বললো,
” হাঁ হাঁ চলো। ইশ্! আমিও না। ভুলেই গিয়েছিলাম। চলো তো। আগে ভোজন এরপর অন্য কিছু। ”
ননদের হাত থেকে এক্সাম ফাইল নিলো হৃদি। দু’জনে অগ্রসর হলো রাস্তার এক পাশে অবস্থিত গাড়ির পানে।
•
দিবাবসুর দীপ্তিতে উজ্জ্বল বসুন্ধরা। ড্রেসিং টেবিলের সম্মুখে দাঁড়িয়ে হৃদি। হাতের নাগালে গুছিয়ে রাখছে স্বামীর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। ওর পেছনে দাঁড়িয়ে এমপি মহাশয়। চুলে চালনা করে চলেছে হেয়ারব্র্যাশ। বাহিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত সে। হৃদি পিছু ঘুরে দাঁড়ালো। স্বামীর বাড়িয়ে দেয়া হেয়ারব্র্যাশটি রেখে দিয়ে বললো,
” এই যে। আপনার সবকিছু গুছিয়ে রেখেছি। ”
ইরহাম ওর পাশ কাটিয়ে সম্মুখে গেল। প্রয়োজনীয় টুকটাক জিনিসপত্র একবার অবলোকন করে পুরে নিলো শুভ্র পাঞ্জাবির পকেটে। অতঃপর পিছু ঘুরলো। ঈষৎ রসিকতার স্বরে বললো,
” সব দিলে না যে! ”
হৃদি চমকালো! ড্রেসিং টেবিলের দিকে তাকিয়ে বললো,
” সবই তো দিয়েছি। কিছু বাদ পড়েনি তো। ”
ইরহাম ধীরপায়ে এগিয়ে এলো। দাঁড়ালো নৈকট্যে। হৃদি অবাক! বোঝার চেষ্টা করছে হাবভাব। বক্র হেসে মানুষটি স্বল্প ঝুঁকে গেল অর্ধাঙ্গীর পানে। ফিসফিসিয়ে বললো,
” বাদ পড়েছে তো। ”
” কি? সবই তো ঠিকঠাক দিয়েছি। ” জিজ্ঞাসু নয়নে তাকিয়ে হৃদি।
” বুস্টার দাওনি। ”
হৃদি অবাক নেত্রে তাকিয়ে,
” বুস্টার! কিসের বুস্টার? আপনি কি আমার সঙ্গে রসিকতা করছেন? ”
সরু চোখে তাকিয়ে মেয়েটি। ইরহাম তা অবলোকন করে মোহনীয় হাসলো। কপালে ঠেকে গেল কপাল। মুগ্ধ নয়নে সে হাস্য আভা অতি সন্নিকটে উপভোগ করে চলেছে মেয়েটি। মানুষটি দুষ্টু স্বরে বললো,
” লম্বা সময়ের জন্য বাহিরে থাকবো। অ্যানার্জি বুস্টার দেবে না? ”
” কিসের অ্যা.. ”
অসম্পূর্ণ রয়ে গেল প্রশ্নটি। লহমায় স্বামীর সুমিষ্ট বন্দিত্বে আটক হলো হৃদি। মানুষটি শক্তপোক্ত দু হাতে নিজের সনে আগলে নিলো সঙ্গিনীকে। গাঢ় হলো আর্দ্র ছোঁয়ার রঙ-তুলি! আবেশে মুদিত হলো দু’জনার আঁখি পল্লব। কিয়ৎক্ষণ পর মিললো মুক্তি। শ্বাস প্রশ্বাসের গতিবেগ দ্রুততর। প্রিয়তমার কপোলে লেপ্টে থাকা লজ্জালু আভাটুকু বিমোহিত নয়নে উপভোগ করলো ইরহাম! তবে তা স্থায়ী হলো না। যেতে হবে এবার। অন্যথায় দেরি হয়ে যাবে। ললাটে ওষ্ঠাধর ছুঁয়ে মৃদু স্বরে বললো,
” আসছি। আসসালামু আলাইকুম। ”
লাজুক কন্যা স্বামীর পানে একঝলক তাকিয়ে ক্ষীণ স্বরে সালামের জবাব দিলো,
” ওয়া আলাইকুমুস সালাম। সাবধানে থাকবেন। ”
মাথা নাড়িয়ে প্রস্থান করলো ইরহাম। মনে মনে মহান রবের নিকটে স্বামীর সুস্থতা ও সফলতা প্রার্থনা করলো হৃদি।
•
‘ আনন্দাঙ্গন ‘ এর লিভিং রুমে বিদ্যমান গাম্ভীর্য। ইরহাম ব্যতিত সকলে বসে সোফায়। এজাজ সাহেব কিছু বলবেন। সকলে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় তা শোনার জন্য। হৃদির বাম পাশে বসে ইনায়া। ইনায়া সকলের অলক্ষ্যে ফিসফিসিয়ে ভাবীকে প্রশ্ন করলো,
” ভাবী! আব্বু হঠাৎ জরুরি তলব করলো কেন? কি বলবে কিছু আন্দাজ করতে পারছো কি? ”
হৃদি ডান হাতের ইশারায় নেতিবাচক জবাব দিলো। ভাবুক হয়ে ননদ-ভাবী যুগল ভাবতে লাগলো কি বলবেন উনি। কিসের জন্য তলব? অবশেষে নীরবতা ভঙ্গ করে এজাজ সাহেব গলা খাঁকারি দিয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। সবাই উৎসুক নয়নে তাকিয়ে।
” সবাইকে ডেকে পাঠিয়েছি কারণ বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ। সবার জানা উচিত। ”
রাজেদা খানম চিন্তিত বদনে প্রশ্ন করে বসলেন,
” কি হইছে? কোনো সমস্যা? ”
মালিহাও চিন্তাগ্ৰস্থ হয়ে পড়লেন। কোনো সমস্যা হয়েছে কি? উনি এমন থমকে যাচ্ছেন কেন? এজাজ সাহেব মৃদু স্বরে বললেন,
” তেমন কিছু নয়। আসলে বিষয়টা ইনুকে নিয়ে। ”
নিজের নাম শুনে হকচকিয়ে গেল ইনায়া। ভীতসন্ত্রস্ত ভাব জড়িয়ে ধরলো আষ্টেপৃষ্ঠে। আব্বু এমন করে বলছে কেন? সে কি রাহি ভাইয়া বিষয়ক কিছু টের পেয়ে গেছে? নাকি রাহি ভাইয়া নিজেই বিচার দিয়েছে! বেশ ঘাবড়ে গেল কিশোরী কন্যা। হৃদি তা লক্ষ্য করে চমকালো বেশ! ইনায়া এত ভয় পাচ্ছে কেন? কি হয়েছে ওর? এনি প্রবলেম!
মালিহা কোমল কণ্ঠে স্বামীকে বললেন,
” ইনু! কি হয়েছে পুরোটা বলো। আমরা শুনছি। ”
” ইনুর জন্য খুব ভালো একটা সম্বন্ধ এসেছে। শিকদার ফ্যামিলি থেকে। ”
উপস্থিত সকলে হতবিহ্বল হলো! চক্ষু চড়কগাছ ইনুর। তার বিয়ের জন্য সম্বন্ধ এসেছে! মালিহা বিস্ময় প্রকাশ করে বলে উঠলেন,
” এসব কি বলছো? মাত্র দুই সপ্তাহ হলো ওর এইচএসসি শেষ হয়েছে। এত তাড়াতাড়ি বিয়ে! ”
এজাজ সাহেব মেয়ের পানে একপলক তাকিয়ে স্ত্রীকে বললেন,
” তুমি খুব ভালো করেই জানো এত ছোট মেয়েকে বিয়ে দেয়ার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। আমি ওনাদের তাই বলেছি। তবে মিস্টার শিকদার খুব করে বলছেন। ইনুকে ওনাদের বেশ পছন্দ হয়েছে। আমাদের লাস্ট পার্টিতে ওকে দেখেছে। ওনারাও এত ছোট মেয়েকে দিয়ে সংসার ধর্ম করাবেন না বলছেন। আপাতত এনগেজমেন্ট কিংবা আকদ করিয়ে রাখতে চাইছেন। বছর তিন-চার পর আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে নেবেন। ”
উপস্থিত সকলেই হতবাক! এজাজ সাহেব এসব কি বলছেন! মনোবেদনায় পীড়িত কিশোরী দ্রুত পায়ে লিভিং রুম হতে প্রস্থান করলো। সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল দোতলায়। হৃদি সেদিক হতে দৃষ্টি সরিয়ে শ্বশুরকে নম্র স্বরে বললো,
” পাপা তোমাদের কথার মাঝে ইন্টারফেয়ার করার জন্য ক্ষমা চাইছি। ইনু এখনো বেশ ছোট। সবে এইচএসসি দিয়েছে। ভর্তি পরীক্ষা অবধি দেয়নি। তুমি কি ওনাদের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেছো? ”
” আমি এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি। ভাবছি। দেখি কি করা যায়। ”
রাজেদা খানম কাট কাট স্বরে বললেন,
” বিয়া দেয়ার লাইগা হারা জীবন পইড়া আছে। ছুডু মাইয়া বিয়া দিওনের দরকার নাই। হ্যাগো মানা কইরা দে। ”
মালিহা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। নিষ্পলক তাকিয়ে রইলেন স্বামীর পানে। বোঝার চেষ্টা করছেন কি চলছে ওনার মনে। বরাবরের মতই ব্যর্থ হলেন। চিন্তার শিকল বেঁধে ফেললো ওনায়। কি হতে চলেছে এবার?
•
দিন কয়েক পরের কথা। নৈশভোজ সেরে বাড়ির প্রাঙ্গনে দাঁড়িয়ে মানুষটি। পড়নে নীলাভ টিশার্ট এবং কৃষ্ণবর্ণ ট্রাউজার। ট্রাউজারের পকেটে দু হাত গলিয়ে প্রকৃতি বিলাসে মগ্ন সে। সুঠামদেহে আঁটসাঁট টিশার্ট টি। গভীর ভাবনায় মশগুল সে। কিয়ৎক্ষণ বাদে ভাবনায় ছেদ পড়লো। পেছনে কারোর উপস্থিতি অনুধাবন করতে পারলো ইরহাম। পিছু ঘুরে তাকালো। চোখের পর্দায় দৃশ্যমান হলো বাবার অবয়ব। এজাজ সাহেব গম্ভীর মুখে বেতের সিঙ্গেল সোফায় বসলেন। পকেট হতে হাত বের করলো মানুষটি। ধীরপায়ে এগিয়ে এলো। বিপরীত দিকের সোফায় বসলো সে। বেতের তৈরি সেন্টার টেবিলের ওপর রাখা টি-পট। চায়ের কাপ। সুগার পট। সুদক্ষ হাতে টি-পট হতে চায়ের কাপে চা ঢেলে নিলো ইরহাম। দু কাপে চা ঢেলে নিলো। পূর্বের জায়গায় রেখে দিলো টি-পট। সুগার পট হতে দু’জনের পছন্দ মতো চিনি নিয়ে চায়ে মিশিয়ে নিলো। টি স্পুন রাখলো যথাস্থানে। অতঃপর বাবার পানে এককাপ চা বাড়িয়ে দিলো। এজাজ সাহেব এতক্ষণ চমকিত নেত্রে সবটা দেখছিলেন। পিতা-পুত্রের এমন মুহূর্ত এ প্রথমবার উদিত হলো বুঝি! পুত্রের হাত থেকে চায়ের কাপ নিলেন উনি। ইরহাম এককাপ চা নিয়ে আয়েশ করে বসলো। ধোঁয়া ওঠা গরম কাপে চেপে ধরল ওষ্ঠ। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো বাবার পাশে। উনিও চা পান করছেন। নীরবতা ভেদ করে ইরহাম প্রথমে কথা বললো,
” ইনুর বিয়ে দিতে চাইছো? ”
” হুঁ। ”
” শি ইজ অনলি এইটিন। ”
” এখুনি শ্বশুরবাড়ি পাঠাচ্ছি না। ”
একরোখা জবাবে অপ্রসন্ন হলো ইরহাম। গরম গরম চায়ের কাপ তখনো হাতে। গম্ভীর স্বরে বললো,
” আমি এই মূহুর্তে বোনের বিয়ে দিতে ইচ্ছুক নই। ”
এজাজ সাহেব চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন,
” ভাইয়ের আগে বাবার অধিকার। ”
ইরহাম ত্যা’ছড়া হাসলো,
” হাসালে। বাবা হও! ”
চায়ে চুমুক দিতে গিয়েও থেমে গেলেন উনি। অসন্তুষ্ট কণ্ঠে শুধোলেন,
” কোনো সন্দেহ যে আমি তোমাদের বাবা নই? ”
” না। আসলে জন্ম দিলেই তো বাবা হওয়া যায় না। কিছু রেসপনসিবিলিটি থাকে। সেগুলো তো আর তুমি..! থাক এসব কথা। মিস্টার শিকদারকে মানা করে দিয়ো। ইনুকে ও বাড়ি দিচ্ছি না। ”
চায়ের কাপে চুমুক বসালো ইরহাম। এজাজ সাহেব তৎক্ষণাৎ অসম্মতি প্রকাশ করলেন,
” ভাবনা চিন্তা করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ইনু ও বাড়িতে খুব ভালো থাকবে। জুনায়েদ ওয়েল এস্টাবলিসড্ ছেলে। উচ্চ শিক্ষিত। বাবার বিজনেসে জয়েন করেছে গত বছর। দেখতে শুনতে ভালো। আর কি চাই? ”
” ভালো ছেলে বলেই যে আমার বোন ভালো থাকবে এমনটা নয়। আমি চাইছি না এই মুহূর্তে বিয়েশাদী নামক কোনো ঝামেলায় ও জড়াক। এখন ভার্সিটির জন্য প্রিপারেশন নিচ্ছে। সেটাই করুক। অন্য কিছু নয়।”
এজাজ সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন,
” তোমার কথামতো সব হবে নাকি? ”
চায়ের কাপে শেষ চুমুক বসিয়ে উঠে দাঁড়ালো ইরহাম। টিশার্ট বিন্যস্ত করতে করতে বললো,
” সময়ই বলে দেবে। আসছি। ”
এক মুহুর্তও দাঁড়ালো না ইরহাম। প্রস্থান করলো সেথা হতে। অসন্তোষ প্রকাশ পাচ্ছে এজাজ সাহেবের মুখশ্রীতে। পুত্র ওনার এমন হলো কেন!
•
ঘড়ির কাঁটা তখন এগারোর কাছাকাছি। গৃহকর্ম সম্পাদনের পাশাপাশি ছেলের সঙ্গে ফোনালাপে লিপ্ত পল্লবী। মোবাইল রাখা সেন্টার টেবিলের কাঁচের আবরণে। লাউডস্পিকারে দেয়া। পল্লবী ঘরদোর সাফ করার পাশাপাশি কথা বলছেন।
” হ্যা রে বাবা! ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করছিস তো? দিন দিন কেমন শুকিয়ে যাচ্ছিস! ”
সশব্দে হেসে উঠলো রাহিদ।
” মা! এটা হলো গিয়ে তোমাদের মাদার সুলভ চিরপরিচিত ডায়লগ। ছেলে যদি হাতির মতো মোটা হয় তবুও মায়ের নজরে সে পাটকাঠির মতো শুকনা। ”
” যাহ্! যতসব বাজে কথা। ” মৃদু ধমকে উঠলেন উনি।
রাহিদ হাসতে লাগলো। কোনোমতে হাসি থামিয়ে শুধালো,
” পরশু নাকি আনন্দাঙ্গন যাচ্ছো? হঠাৎ? কোনো দাওয়াত আছে নাকি? ”
” ঠিক দাওয়াত না। কিন্তু বিশেষ দিন। ”
” মানে? ওদিন কারো জন্মদিন নাকি? ”
” আরে না। তেমন কিছু না। ওই ইনুকে দেখতে আসবে তো। তাই। ”
” ওহ্! ”
প্রথমে উপলব্ধি করতে না পারলেও পরক্ষণে বিষয়টি মস্তিষ্কে কড়া নাড়ল। চরম আশ্চর্যান্বিত হলো রাহিদ!
” হোয়াট! ”
” হাঁ। শিকদার ফ্যামিলি থেকে সম্বন্ধ এসেছে। ওনারা তোর বাবা, ফুফা দুজনেরই চেনাজানা। হাই স্যোসাইটি থেকে বিলং করেন। তোর.. ”
আর বলা হলো না। রাহিদ ব্যস্ত স্বরে বললো,
” মা এক ফ্রেন্ড ডাকছে। রাখছি এখন। আসসালামু আলাইকুম। ”
দ্রুততার সহিত সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলো রাহিদ। পল্লবী শোপিস পরিস্কার করছিলেন। চমকালেন এহন আচরণে! এটা কি হলো!
•
নিকষকৃষ্ণ রজনী। নিজস্ব কক্ষে বেডের হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে বসে ইরহাম। হাতে মোবাইল। তা স্ক্রল করে চলেছে সে। হৃদি টুলে বসে ড্রেসিং টেবিলের সম্মুখে। নৈশকালীন পরিচর্যা সেরে বিছানায় এলো সে। বসলো স্বামীর পাশে। উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করে বললো,
” যা হচ্ছে ঠিক হচ্ছে কি? ”
স্ত্রীর পানে তাকালো মানুষটি। নির্লিপ্ত স্বরে বললো,
” দেখতে আসলেই বিয়ে হয়ে যায় না। ”
মোবাইলে মনোনিবেশ করলো সে। হৃদি অপ্রসন্ন হলো,
” হাঁ জানি। তবুও এসবের কি দরকার ছিল? পাপাকে কত করে বললাম। সে শুনতে নারাজ। ”
” উনি শুনবেন না। যা করার করুক। আমিও তাই করবো যেমনটা বলেছি। ”
” ধ্যাৎ! শুধু শুধু মেয়েটা চিন্তায় শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। কি যে হচ্ছে! ”
বিরক্ত বোধ করছে হৃদি। এখন বিশ্রাম দরকার। পরশুর বিষয় পরশু ই দেখা যাবে নাহয়। বালিশ ঠিকঠাক করে সোজা হয়ে শুয়ে পড়লো মেয়েটা। পাশের জনকে বললো,
” আলোটা নিভিয়ে দিয়েন। ”
ইরহাম তপ্ত শ্বাস ফেলে মোবাইল রেখে দিলো। বেড সাইড টেবিলের ধারে কানেক্টেড সুইচ টিপে দিলো। নিভে গেল আলো। কক্ষ জুড়ে তখন শুধু ডিম লাইটের মৃদু মোহনীয় দ্যুতি। স্ত্রীর পাশে শয্যা গ্রহণ করলো ইরহাম। সময় এখন নিদ্রার রাজ্যে তলিয়ে যাওয়ার।
•
এমনিতেই পারিবারিক চিন্তায় মশগুল হৃদি। তন্মধ্যে ভার্সিটিতে ঘটে গেল এক অভাবনীয় কাণ্ড। সীমাহীন মুসিবতে ফেঁ’সে গেল মেয়েটি। এসব কি হচ্ছে!
চলবে.
#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৩
ঘটনাস্থলের নিয়ন্ত্রণ এখন পুলিশের হাতে। পুরো জায়গাটি তারা ঘিরে ফেলেছে। ক্রা-ইম স্পটে এখন সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষেধ। ভার্সিটির পেছন দিকে শুনশান নীরব স্থান এটি। ঘটনার প্রেক্ষিতে এখন আর নীরব নয়। সরব। একঝাঁক শিক্ষার্থী ক্রা ই ম স্পটের চারিদিকে দল বেঁধে দাঁড়িয়ে। তন্মধ্যে উপস্থিত হৃদি নিজেও। তার ভীতসন্ত্রস্ত, অস্থির মুখখানি নিবদ্ধ মাটিতে পড়ে থাকা নিথর দেহের পানে। এ সে-ই ছেলেটি যাকে মাঝেমধ্যে দেখতে পেতো সে। দু’বার তো কেমন সন্দেহজনক পরিস্থিতিতে দেখতে পেয়েছিল। জুনিয়র ছেলেটা সবে প্রথম বর্ষে পড়ছিল। এরমধ্যেই ওপর ওয়ালার ডাক চলে এলো! এ কি স্বাভাবিক মৃ ত্যু নাকি অপমৃ”ত্যু! কি করে মৃ ত্যু হলো এর!
বৃহদাকার এক বটবৃক্ষের নিচে পড়ে রয়েছে দেহটি। পাশেই ফরেনসিক বিভাগের সদস্যবৃন্দ প্রমাণ জোগাড় করতে ব্যস্ত। শার্ট ও জিন্স প্যান্ট পড়নে মৃ ত ছেলেটির। এলোমেলো চুল। পোশাকের যত্রতত্র লেপ্টে ধূলোকণা। বড় ম্লান মুখখানা। শুকিয়ে এতটুকুতে পরিণত হয়েছে যেন। হৃদি অনুভব করতে পারছে তার হৃদস্পন্দনের গতি স্বাভাবিক নয়। ভেতরে কম্পন সৃষ্টি হচ্ছে। ঝিমঝিম করছে মাথা। টলে উঠছে পদযুগল। এক সমুদ্র পানি পান করবার মতো তৃষ্ণায় কাতর সে। বিন্দু বিন্দু ঘাম চিবুক গড়িয়ে গ্ৰীবায় নেমে আসছে। ঝাপসা হয়ে আসছে নেত্র জোড়া। প্রথমবারের মতো এত কাছ থেকে মৃ”তদেহ দেখে সে কি চেতনা হারাতে চলেছে! ঘাবড়ে গেল মেয়েটি। শঙ্কায় পড়ে গেল। আশপাশে ঝাপসা নয়নে তাকালো। বন্ধুরা ওই তো ওপাশে দাঁড়িয়ে। লা শে র কাছাকাছি। আচ্ছা সে ডাকলে কি ওরা শুনতে পাবে? ওকে সবল হতে সহায়তা করবে? বোধহয় দূর হতে ডাক শুনতে পাবে না। তাহলে কি করবে ও? একাকী এখান থেকে প্রস্থান করবে! আর পারা যাচ্ছে না। যেকোনো মুহূর্তে দুর্বল হয়ে পড়ে যাবে বুঝি। নিরাপদ অবস্থানে চলে যাওয়া উচিত। যেই ভাবা সেই কাজ। আস্তে ধীরে ভীড় হতে বেরিয়ে এলো হৃদি। দুর্বল পায়ে হাঁটতে লাগলো। বেশিদূর যেতে পারলো না। ধপ করে বসে পড়লো এক বৃক্ষতলে। ব্যস্ত হাতে কাঁধে থাকা ব্যাগটি কোলে রাখলো। ব্যাগ খুলে বের করলো পানির বোতল। অল্প পানি অবশিষ্ট রয়েছে। দ্রুত বোতলের ছিপি খুলে ফেললো মেয়েটি। অসীম তৃষ্ণায় কাতর সে। ঢকঢক করে পুরোটা পানি একসাথে পান করে ফেললো। তবুও মিটলো না তৃষ্ণা। শরীরটা বড্ড খারাপ লাগছে। আস্তে ধীরে বোতলের ছিপি আটকে ফেললো। কোলে থাকা ব্যাগের ওপর পড়ে গেল বোতল। হৃদি ওড়নার একাংশ দিয়ে মুখে লেপ্টে থাকা স্বেদজল মুছে নিচ্ছে। বেশ ঘাম ছুটেছে। এভাবে হবে না। ওড়না নোংরা হয়ে যাচ্ছে। কম্পিত হাতে ব্যাগ হতে রুমাল বের করলো সে। রুমালের কোমল স্পর্শে যেই না স্বেদজল মুছে নেবে অমনি চমকালো!
কিছুটা দূরে মাটিতে পড়ে রয়েছে এক টুকরো কাগজ। মৃদুমন্দ হাওয়ায় নড়ছে তা। এমন নিরালায় নতুন চকচকে কাগজ পড়ে থাকতে দেখে কেমন কৌতূহল জন্ম নিলো। মুহুর্তের মধ্যেই ভুলে গেল দুর্বলতা। কোলে থাকা ব্যাগটি বাঁ পাশে রাখলো হৃদি। মাটিতে পড়ে গেল বোতল। আস্তে ধীরে উঠে দাঁড়ালো। শ্লথ পায়ে অগ্রসর হতে লাগলো কাগজটির পানে। এ জায়গাটি নীরব। সাধারণত তেমন কেউ এখানে আসে না। স্বাভাবিক ভাবেই এখানে ময়লা উচ্ছিষ্ট কিংবা পুরনো দলা পাকানো কাগজের দেখা মেলে। তাহলে এই নতুন চকচকে কাগজের টুকরো কি করছে এখানে? তা-ও আবার আজকের দিনে! মৃ”তদেহ হতে কাছাকাছি। এলোমেলো ভাবনাচিন্তা করে গন্তব্যে পৌঁছে গেল মেয়েটি। আস্তে ধীরে হাঁটু গেড়ে বসলো। তীক্ষ্ণ চোখে দেখতে লাগলো। কাগজটি হালকা দলা পাকানো। মুঠোবন্দী ছিল কি! কৌতূহলবশত কাগজটি হাতে নিতে গিয়েও থমকালো হৃদি! তার ভেতরকার সত্ত্বা সাবধানী বাণী স্মরণ করিয়ে দিলো। অসংখ্য সাসপেন্স থ্রিলার মুভি দেখা হৃদি সাবধানতা অবলম্বন করাই শ্রেয় মনে করলো। কি ভেবে হাতের বদলে রুমাল দিয়ে স্পর্শ করলো কাগজটি। সতর্ক ভঙ্গিতে দুই হাত দিয়ে কাগজটি মেলে ধরায় ব্যস্ত। ঠিক তখনই বেজে উঠলো তার মোবাইলের রিংটোন। শুনশান স্থানে আকস্মিক রিংটোনের ধ্বনিতে যথেষ্ট ভয় পেল মেয়েটি! এদিক ওদিক তাকিয়ে বুকে ফুঁ দিয়ে নিজেকে শান্ত করলো। কেমন ভূতুড়ে কাণ্ড! কাগজটি আর খুলে দেখা হলো না। রুমালে বন্দী কাগজ নিয়ে উঠে দাঁড়ালো হৃদি। পা বাড়ালো বৃক্ষতলে ব্যাগের কাছে। বাড়িতে গিয়ে নাহয় ধীরে সুস্থে দেখবে। তাড়াহুড়োর দরকার নেই। হতেই পারে কাগজটি গুরুত্বপূর্ণ। ভালোমতো নীরিক্ষা করা দরকার। সামান্য এক টুকরো কাগজ নিজের সঙ্গে নিয়ে তো নিলো মেয়েটি। স্বেচ্ছায় নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনলো না তো আবার!
•
সান্ধ্যকালীন প্রহর তখন। আরশির সম্মুখে দাঁড়িয়ে মিসেস চৌধুরী। পড়নে তার ব্লাশ পিচ রঙা পাকিস্তানি ডিজাইনার জর্জেট সালোয়ার কামিজ। কামিজের আবরণে আকর্ষণীয় কারুকাজ। মুখশ্রীতে কৃত্রিম প্রসাধনীর হালকা প্রলেপ। কারুকার্য খচিত দোপাট্টা ছেড়ে রাখা বাঁ কাঁধে। একাকী বকবক করতে করতে মানানসই হিজাব বেঁধে নিচ্ছে সে। আজকের এই আয়োজন সম্পূর্ণ তার অপছন্দনীয়। কি দরকার ছিল এসব করার? হুঁ! কত করে বললো। পাপা মহাশয় শুনলেন ই না! ধ্যাৎ! বিরক্ত হয়ে হিজাব পিন গেঁথে নিতে সমস্যা হচ্ছে। তখনই কর্ণপাত হলো,
” ছটফট না করে যা করছো তাতে মনোযোগ দাও। নাহলে পিনের গুঁতো খাবে নিশ্চিত। ”
হিজাবে পিন গেঁথে পেছনে ঘুরে দাঁড়ালো হৃদি। কটমট করে বললো,
” খেলে খাবো। কোনো অসুবিধা? ”
ইরহাম শব্দহীন হাসলো। বুঝতে পারছে ননদের শোকে বউ তার ক্ষ্যা পা ষাঁড়ে পরিণত হচ্ছে। একে লাল কাপড় না দেখিয়ে শান্ত করা দরকার। চোখে রিমলেস চশমা পড়ে নিকটে এসে দাঁড়ালো ইরহাম। হৃদি হিজাব ঠিকঠাক করে সে মুহূর্তে পিছু ঘুরে দাঁড়ালো। মানুষটি শান্ত নয়নে অর্ধাঙ্গীর পানে তাকিয়ে রইলো কয়েক পল। স্বয়ংক্রিয়ভাবে সে শান্ত-নিবিড় নয়ন জোড়া মেয়েটিকে সম্মোহিত করে ফেললো। ধীরে ধীরে হ্রাস পেল তেজস্বী ভাব। ফিরে এলো কোমলতা। আস্তে করে দৃষ্টি নত করে ফেললো হৃদি। নম্র স্বরে বললো,
” এসবের কি খুব দরকার ছিল ইরহাম? ইনু মোটেও খুশি নয়। মেয়েটার মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। ভয়ে নিজে থেকে পাপাকে কিছু বলতেও পারছে না। চুপচাপ টলারেট করে যাচ্ছে। কাঁদছে অবধি। ও তো.. ”
অসম্পূর্ণ রইলো বাক্য। ইরহাম বলে উঠলো,
” শান্ত হও হৃদি। একটু ভরসা রাখো। ইনশাআল্লাহ্ যা হবে ভালোই হবে। আমি জেনেশুনে আমার বোনকে আগুনে ফেলবো না। সে বিশ্বাস আছে তো আমার ওপর? ”
ইতিবাচক মাথা নাড়ল হৃদি। হাঁ স্বামীর প্রতি তার বিশ্বাস আছে। সামান্য ইতিবাচক সম্মতিতে বেশ প্রসন্ন হলো হৃদয়। ইরহাম মুচকি হেসে বললো,
” ব্যস এটাই চাই। একটু ধৈর্য ধরো। সব ঠিক হয়ে যাবে। দেখতে আসলেই বিয়ে হয়ে যায় না। ”
” হুম। এবার তাহলে চলুন। ওনারা এই এলো বলে। ”
এ বলে পিছু ঘুরে দাঁড়ালো হৃদি। কক্ষ হতে প্রস্থান করতে উদ্যত হতেই সহসা বাঁধাপ্রাপ্ত হলো। চমকালো সে! না দেখেও বলে দিতে পারবে এ বাঁধা প্রদানকারী অন্য কেহ নহে। তার মনরাজ্যের একমাত্র অধিপতি। তার হৃদয়ের রাজা। আলতো এ স্পর্শে লালাভ রঙ মেখে গেল রমণীর কপোলদ্বয়ে। পিছু ঘুরে তাকাতে ব্যর্থ। লহমায় এক জোরালো আকর্ষ! প্রশস্ত শক্তপোক্ত বক্ষপটে আছড়ে পড়লো কোমলকায়া। ধক করে উঠলো বক্ষপিঞ্জরের অন্তরালে লুকায়িত হৃদযন্ত্রটি। শ্বাস প্রশ্বাসের গতিবেগ দ্রুততর। পুরুষালি দু’টো হাতের বেষ্টনীতে বন্দী সে। দু’জনার মধ্যকার ব্যবধান প্রায় শূন্যের কোঠায়। মুখশ্রীতে আঁকিবুঁকি করে চলেছে তপ্ত শ্বাস। শিরশিরানি অনুভূত হচ্ছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। মুদিত হয়ে আসছে নেত্র পল্লব। রিমলেস চশমার আড়ালে থাকা চক্ষুদ্বয়ে তখন সীমাহীন মুগ্ধতা! অপলক নেত্রে তাকিয়ে স্ত্রীর পানে। জাগতিক হুঁশ হারিয়ে সে মগ্ন হৃদরাণীতে! স্বামীর চোখেমুখে মুগ্ধতার রেশ ঠিক অনুধাবন করতে পারলো হৃদি। লাজে রাঙা কপোল আরো র’ক্তিম হলো। কম্পিত অধরোষ্ঠ। প্রেমিক পুরুষটির হৃদয়ে তখন উদ্দাম প্রেমের আলোড়ন। নিজেকে সামাল দেয়া হয়ে উঠলো দুঃসাধ্য। নির্মেদ কটি দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করে স্বল্প ঝুঁকে গেল অর্ধাঙ্গীর পানে। অতি সন্নিকটে স্বামীর উপস্থিতিতে শিউরে উঠলো মেয়েটি। হিল্লোল আছড়ে পড়লো মানসপটে। লাজুক নয়নে স্থির হলো নে`শাতুর নয়ন জোড়া। একটু একটু করে ঘুচে গেল মধ্যকার সর্বশেষ ব্যবধান। ওষ্ঠ ঠেকালো সঙ্গিনীর শ্রবণেন্দ্রিয়ে। মোহাচ্ছন্ন স্বরে আওড়ালো,
” আমার হৃদরাণী! কৃপা করে এ অধমকে আপনার হৃদ রাজ্যে একটুখানি প্রবেশাধিকারের সুযোগ দিন। আমৃ`ত্যু কৃতজ্ঞ রইবে এ বান্দা। ”
অবর্ণনীয় মা-দকতায় আচ্ছন্ন এ শব্দগুচ্ছ! লহমায় মোহগ্ৰস্থ হলো মেয়েটি! আবেগী অশ্রু জমায়েত হলো নেত্রকোণে। পেলব দু হাতে আঁকড়ে ধরলো প্রশস্ত পৃষ্ঠ। মিশে গেল একান্ত জনের সনে। ধীরলয়ে কাছে এলো তারা। অদূরবর্তী দু’জনার ওষ্ঠাধর। একান্ত এ মুহূর্তে আকস্মিক বাঁধা। একজন গৃহপরিচারিকা দাঁড়িয়ে দরজার ওপাশে। অতিথিরা এসে পড়েছে। ওদের ডাক পড়েছে। ত্বরিত একে অপর হতে ছিটকে দূরে সরে গেল দু’জনে। এখনো বিদ্যমান ঘোর। ঘন শ্বাস ফেলে নিজেকে সামলাতে ব্যস্ত রমণী। ইরহাম কোনোমতে নিজেকে ধাতস্থ করে পরিচারিকাকে বিদায় করলো। একপলক স্ত্রীর পানে তাকিয়ে মুচকি হেসে প্রস্থান করলো কক্ষ হতে। লাজুক হেসে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো হৃদি।
.
শিকদার ফ্যামিলি এসেছে মিনিট বিশেক হবে। এ মুহূর্তে তারা বসে লিভিং রুমে। আলাপচারিতায় লিপ্ত চৌধুরীদের সঙ্গে। জহির সাহেবও রয়েছেন তন্মধ্যে। ইরহাম চৌধুরী বসে সিঙ্গেল সোফায়। দু হাত ঠেকে সোফার দুই হাতলে। নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে বসে তীক্ষ্ণ চাহনিতে অবলোকন করে চলেছে আগত অতিথিদের। প্রত্যেককে মেপে নিচ্ছে চোখের মাপকাঠিতে। হৃদি স্বামীর পেছনে দাঁড়িয়ে। সোফায় রাখা হাত। একত্রে চমৎকার দেখাচ্ছে দু’জনকে! সত্যিকারার্থে একে অপরের পরিপূরক লাগছে! মিসেস শিকদার পাত্রী অর্থাৎ ইনায়ার ডান পাশে বসে। হাস্যমুখে টুকিটাকি জিজ্ঞেস করছেন। আনত বদনে বসে ইনু। পড়নে শুভ্র-স্বর্ণালী মিশেলের আনারকলি। হিজাবে আবৃত কেশ। মুখে হালকা প্রসাধনীর ছোঁয়া। মৃদু স্বরে প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে মেয়েটি। সে মুহূর্তে সেথায় উপস্থিত হলো রাহিদ। নির্বিকার অভিব্যক্তি তার। সোফায় বসে থাকা মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। শুনতে পেল মৃদু মেয়েলি স্বর,
” জ্বি অ্যাডমিশন কোচিংয়ে ভর্তি হয়েছি। ”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইনায়া হতে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো রাহিদ। তাকালো ইরহাম ভাইয়ার দিকে। ভাইয়া অমন গোয়েন্দা চক্ষে কি দেখছে! সহসা ইরহাম ডান হাত নেড়ে স্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। তা লক্ষ্য করে স্বামীর পানে স্বল্প ঝুঁকে গেল হৃদি। মুখখানি ঠেকে স্বামীর ডান কাঁধ বরাবর। ইরহাম সম্মুখে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই ক্ষীণ স্বরে কিছু বললো। হৃদি জিজ্ঞাসু নয়নে স্বামীর পানে তাকিয়ে। প্রত্যুত্তরে কিছু বললো বুঝি। ইরহাম তার বিপরীতে কিছু একটা বললো। ইতিবাচক মাথা নেড়ে ধীরপায়ে সেথা হতে প্রস্থান করলো হৃদি। রাহিদ সবটাই দেখলো। কিন্তু বুঝলো না একবিন্দু।
.
পাত্রপক্ষ এখনো ‘ আনন্দাঙ্গন ‘ এ অবস্থান করছে। অতিথিদের ভীড় হতে মিললো মুক্তি। মনস্তাপে জর্জরিত মেয়েটি দোতলার করিডোর ধরে হেঁটে চলেছে নিজ কক্ষের উদ্দেশ্যে। আকস্মিক…
চলবে.
#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৩ ( বর্ধিতাংশ )
পাত্রপক্ষ এখনো আনন্দাঙ্গনে অবস্থান করছে। অতিথিদের ভীড় হতে অবশেষে মিললো মুক্তি। মনস্তাপে জর্জরিত মেয়েটি দোতলার করিডোর ধরে হেঁটে চলেছে নিজ কক্ষের উদ্দেশ্যে। আকস্মিক থমকে গেল পদযুগল। চক্ষুতারায় দৃশ্যমান হলো এক অবয়ব। তার আকাঙ্ক্ষিত অবয়ব! মুহুর্তের মধ্যেই চোখে জমলো বাষ্প। বেদনা খামচে ধরলো অন্তরে। রাহিদ সম্মুখে এসে দাঁড়ালো। পূর্ণ দৃষ্টিতে অবলোকন করলো ওকে। কেমন অদ্ভুত হেসে উঠলো,
” আনারকলি সেজেছিস? তোর সেলিম সাহেব তো দিওয়ানা হয়ে গেছে রে। চোখ ই ফেরাতে পারছিল না। পারবে কি করে? আফটার অল এত সুন্দর রূপে নিজেকে সাজিয়েছিস। লুকিং বিউটিফুল! ”
অন্তরে তখন অ-গ্নিকাণ্ড হচ্ছে। জ্ব’লে ছারখার সব। শুকনো ঢোক গিললো ইনায়া। অবনত হলো বদন (মুখ)। মিহি স্বরে বললো,
” প্রশংসা শেষ? আমি কি এখন যেতে পারি? ”
বক্র হাসির রেখা ফুটে উঠলো ছেলেটির অধরে,
” আরে বাহ্! পেয়ার খতম? দু’দিন আগে তো আমার সামনে আসার জন্য, আমায় একঝলক দেখার জন্য কত কি করতি। একাকী টিএসসি অবধি চলে গিয়েছিলি। আর আজ? সব শেষ? ভোল পাল্টে গেল?”
চোখ তুলে তাকালো ইনায়া। ক্লেশ স্পষ্ট মুখাবয়বে। দুঃখ ভারাক্রান্ত হেসে বললো,
” আমি তোমার জন্য কি করেছি দেখেছো তাহলে? জানা ছিল না। আমি তো ভেবেছিলাম আমার ক্ষেত্রে তুমি সব দেখেও অন্ধ। ”
” ইনু! ” ধমকে উঠলো রাহিদ। কেন ধমকে উঠলো নিজেও জানে না বোধহয়।
” হাঁ ইনু। আমি এখন আসছি বুঝলে? গা কেমন চিটচিট করছে। একটু ফ্রেশ হওয়া দরকার। একটু পর তো ওনারা চলে যাবেন। তখন বিদায় জানাতে হবে না? ”
ত্যাছড়া হাসলো রাহিদ,
” ভালোই তো। বিয়ে ঠিক হতে না হতেই শ্বশুরবাড়ির জন্য পিরিত উতলে উতলে পড়ছে। ”
ওষ্ঠাধর কামড়ে অশ্রু নিবারণে ব্যস্ত হয়ে পড়লো ইনায়া। নত হলো মস্তক। ক্ষীণ স্বরে বললো,
” তাই কি স্বাভাবিক নয়? ওনারাই তো আপনজন হতে চলেছেন। অন্য কেউ তো নয়। ”
আর এক মুহূর্তও নয়। দুরন্ত পায়ে করিডোর ধরে নিজের ঘরের দিকে ছুটে গেল ইনায়া। ওর গমন পথে শূন্য চাহনিতে তাকিয়ে রাহিদ। আকস্মিক শক্তপোক্ত এক ঘু ষি পড়লো দেয়ালে। কঁকিয়ে উঠলো অন্তঃস্থল। তবে বাহ্যিক দৃষ্টিতে সব স্বাভাবিক। কেন এমন হচ্ছে তাদের সঙ্গে? কেন?
.
বিভাবরীর কৃষ্ণাবরণে আচ্ছাদিত বসূধা। লেডি শার্লক হোমস রূপে অবতীর্ণ হয়েছে মিসেস হৃদি শেখ। পড়নে রাতপোশাক। কালো রঙা গ্লোভসের অন্তরালে ঢাকা পড়েছে দু হাত। দাঁড়িয়ে ডিভান সংলগ্ন। তীক্ষ্ণ চাহনিতে তাকিয়ে রয়েছে হাতে থাকা এক টুকরো ছোট কাগজে। গোটা গোটা অক্ষরে কালো কালিতে সেথায় লেখা রয়েছে,
‘ আব্বু আম্মু আমাকে ক্ষমা করে দিও ‘
চিন্তায় পড়ে গেল হৃদি। ভার্সিটিতে মৃ ত্যুবরণ করা জুনিয়র ছেলেটির নাম মুহিত। এ চিরকুটটি কি তবে তারই লেখা? তাই তো মনে হচ্ছে। একদিকে মুহিতের নিথর দেহ পাওয়া গেল। অপরদিকে এই চিরকুট। ক্ষমা চেয়ে। দুটোর মধ্যে কেমন সংযোগের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে! আসলেই কি তাই? নাকি সে ভুল ভাবছে? নারী মস্তিষ্ক ভাবনায় ডুবে গেল। একূল ওকূল কত কি ভাবতে লাগলো। আলোক প্রদর্শনীর ন্যায় চোখের পর্দায় ভেসে উঠছে মুহিতের সঙ্গে প্রতিটি সাক্ষাৎ। কখনো ছেলেটি অপ্রস্তুত অবস্থায়, কখনোবা সিনিয়র ভাই সজীবের সঙ্গে। কোথাও তো গড়বড় রয়েছে। কিন্তু ঠিক কোথায়? সেটাই তো বোধগম্য হচ্ছে না। আকস্মিক ওর ছেদ পড়লো ভাবনায়।
” হাতে ওটা কি? ”
পুরুষালি গমগমে স্বরে একপ্রকার আঁতকে উঠলো মেয়েটি। হাত ফসকে পড়ে গেল কাগজটি। ডিভানের নিচে গড়াগড়ি খেতে লাগলো। বুকে থু থু ছিটানোর ভান করে পিছু ঘুরে তাকালো হৃদি। অসন্তুষ্ট কণ্ঠে বলে উঠলো,
” আপনি কি মানুষ হাঁ? এভাবে কেউ ভয় দেখায়? ”
বাঁ ভ্রু উঁচু হলো মানুষটির। সামান্য এক প্রশ্নে তার ‘মানুষ’ পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন উঠছে! অদ্ভুত!
” আমি দেখাই। ”
” কি? ” হৃদি নিজেই ভুলে গেল প্রশ্ন।
” বললে না ভয় দেখানোর কথা? আমি ভ য় দেখাই। ”
থেমে থেমে কেমন ফিসফিসিয়ে বললো ইরহাম। ভয় জেঁকে বসলো কোমল হৃদয়ে। স্বামী নামক মানুষটি শুভ্র টিশার্ট পড়ে তাকে ভয় দেখাতে চাইছে নাকি? কিন্তু আফসোস! সে ভীতু নয়। তবে ভয় ভয় লাগছে কেন? কেমন ভূতুড়ে হিমশীতল শিহরণ বয়ে যাচ্ছে। শুকনো ঢোক গিললো মেয়েটি। আমতা আমতা করে বললো,
” আ আমি ভয় পাই না। ”
” হুম। হাতে কি ছিল? কি দেখছিলে? ”
হৃদি সত্যিটা বলতে গিয়েও বললো না। হঠাৎ মস্তিষ্কে হানা দিলো দুষ্টু বুদ্ধি। এমপি মহাশয়ের সঙ্গে মশকরা করার সুযোগ হাতছাড়া করতে ইচ্ছে করছে না। তাই তো হাসি চেপে প্রসন্ন চিত্তে বললো,
” চিঠি। ”
ঈষৎ চমকালো ইরহাম! তার একমাত্র বউয়ের হাতে কিসের চিঠি! ভ্রু কুঁচকে শুধালো,
” চিঠি? কিসের চিঠি? ”
হৃদি মেকি লজ্জিত হবার ভান করে দু হাত জড়ো করে ফেললো। স্বল্প দুলতে দুলতে মৃদু স্বরে বললো,
” একজন দিয়েছে। ভার্সিটিতে। ”
আ!গ্নেয়গিরির অ-গ্ন্যুৎপাত হলো মস্তিষ্কে। ক্ষে পে গেল অভ্যন্তরীণ সত্ত্বা। কোনোরূপ নিজেকে সংযত করে প্রশ্ন করলো,
” কে দিয়েছে? ”
কণ্ঠে কেমন তেজ প্রকাশ পাচ্ছে! তা অনুধাবন করে আস্তে ধীরে মুখ তুলে তাকালো হৃদি। আঁতকে উঠলো স্বামীর র’ক্তিম মুখখানা দেখে। ঢাকঢোল বাজতে লাগলো বুকের ভেতর। দ্রুত সাফাই দেয়ার চেষ্টা করলো সে,
” এই না না। আমি আমি মিথ্যা বলেছি। কেউ চিঠি দেয়নি। ওটা তো.. ”
আর বলা হলো না। লহমায় স্বামীর বলিষ্ঠ বেষ্টনে আবদ্ধ হলো মেয়েটি। গ্লোভস পরিহিত দু হাত ভারসাম্য বজায় রাখতে আঁকড়ে ধরলো চওড়া কাঁধ। নভোনীল নয়নে মিলিত হলো ভীতু নয়ন। কটিদেশের কোমল ত্বকে বিঁধে যাচ্ছে স্বামীর ডান হাতের আঙ্গুল। যন্ত্রণা হচ্ছে। তবুও টুঁ শব্দটি করলো না হৃদি। নিঃশব্দে স্বামীর নৈকট্যে দাঁড়িয়ে। তার চোখেমুখে আছড়ে পড়ছে তপ্ত শ্বাস প্রশ্বাস। নিভু নিভু আঁখি জোড়া। হিসহিসিয়ে নিজস্ব বক্তব্য পেশ করলো ইরহাম,
” পড়তে যাচ্ছো ওখানে। চিঠি নিতে নয়। আর একবার চিঠি নেয়ার কথা উচ্চারণ করলে পা ভেঙ্গে ঘরে রেখে দেবো। বুঝেছো? ”
অপ্রত্যাশিত চমকে অভিভূত হৃদি! কিয়ৎক্ষণ বাদে চমকের রেশ কাটিয়ে মৃদু হেসে রসিকতার স্বরে বললো,
” বাব্বাহ্! এমপি সাহেব দেখছি বেশ জেলাস! ”
গাঢ় হলো বন্ধন। স্বীকারোক্তি পেশ করলো মানুষটি,
” ইয়েস আই অ্যাম। ”
গ্লোভস পরিহিত দু হাত কাঁধ ছাড়িয়ে আস্তে ধীরে স্থাপিত হলো চওড়া পৃষ্ঠে। পেলব হাতে আঁকড়ে ধরলো স্বামীকে। তার প্রশস্ত বক্ষপটে এলিয়ে দিলো মাথা। আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে মিহি স্বরে বলে উঠলো হৃদি,
” ঈ’র্ষাকাতর হতে হবে না এমপি সাহেব। যতদিন বেঁচে আছি হৃদি শুধু আপনারই। আপনার হৃদ দিগন্তের কৃষ্ণবরণ মেঘপুঞ্জ সরিয়ে সেথায় এক চিলতে রোদ হয়ে ঝলমল করবো আম”রণ। ”
সাধারণ কিছু শব্দমালা! তবুও হৃদ জমিনে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে নেমে এলো। পুলকিত হলো তনুমন। সঙ্গিনীকে নিজের সনে আগলে নিলো ইরহাম। মেয়েটিকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করামাত্র সকল প্রকার দুশ্চিন্তা-ক্লেশ পলায়ন করে থাকে। অভ্যন্তরে অনুভূত হয় মনমাতানো শীতলতা। সঙ্গিনীর একটুখানি উষ্ণতা তার প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে যেন কার্যকরী টনিকের ন্যায় কাজ করে। ভেতরকার সকল অশান্তি, অস্থিরতা দূরীকরণ হয় স্বয়ংক্রিয় ভাবে। তৃপ্তিকর হাস্য আভায় আরেকটু গাঢ় আলিঙ্গনে নিজের সনে জড়িয়ে নিলো অর্ধাঙ্গীকে। নৈঃশব্দ্যে চক্ষু বুজে দু’জনে উপভোগ করতে লাগলো এ মধুময় মুহুর্ত।
_
ডিভানে বসে ইরহাম। হাতে সে-ই ছোট্ট এক টুকরো কাগজ। প্রখর চাহনিতে দেখে চলেছে লেখাটি। প্রতিটি শব্দের অন্তর্নিহিত অর্থ বোঝার চেষ্টা করছে। মনে মনে আওড়ে চলেছে বারংবার। সম্পূর্ণ মনোযোগ কালো কালিতে লেখা শব্দগুচ্ছে। মানুষটির বাম পাশেই বসে হৃদি। তাকিয়ে স্বামীর মুখপানে। বোঝার চেষ্টা করছে তার মনোভাব। সফল হলো কি? বোধহয় না। তাই আর নিশ্চুপ না থেকে বলে উঠলো,
” আমার মনে হচ্ছে এটা মুহিতের লেখা। ও হয়তো মৃ ত্যু আশঙ্কা করছিল। কিংবা সু-ইসাইড করবে বলে..! না না। দেখে তো সু-ইসাইড মনে হয়নি। ন্যাচারাল ডে থ মনে হচ্ছিল। শরীরের কোথাও কোনোরকম আঘাতের চিহ্ন ছিল না। একদম সাধারণ নিথর দেহ। ”
” কোথায় পেলে এটা? ” কাগজে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে শুধালো ইরহাম।
” লা শ থেকে অল্প দূরে। মাটিতে পড়ে ছিল। হয়তো বাতাসে উড়ে গিয়েছিল কিংবা.. ”
সাবধানী ভঙ্গিতে কাগজটি রাখলো ইরহাম। রুমাল দিয়ে ধরে ছিল কাগজটি। কাগজে ওদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট পড়ে গেলে সমস্যা হতে পারে। স্ত্রীর পানে ঘুরে বসলো ইরহাম। কিছুক্ষণ চুপচাপ ভাবলো। ভাবনা শেষে মৃদু স্বরে বলে উঠলো,
” কাল একবার পুলিশ স্টেশন যেতে হবে। এটা পুলিশে দেয়া দরকার। কাজে লাগতে পারে। ”
শুকনো ঢোক গিললো হৃদি। পুলিশের নাম শুনলে সাধারণ বাঙালী ভয় পাবে এটাই কি স্বাভাবিক নয়! শেষে কিনা যেচে পড়ে পুলিশের মুখোমুখি হতে হবে! ভীত হয়ে মিহি স্বরে শুধালো,
” আমাকেও যেতে হবে? ”
” হুম। কারণ কাগজটা তুমি পেয়েছো। ওরা হয়তো তোমাকে টুকটাক জিজ্ঞাসাবাদ করবে। একদম ভয় পাবে না। যা সত্যি তাই বলবে। আর.. ”
পুরুষালি হাতের মুঠোয় বন্দী হলো পেলব দু হাত। অর্ধাঙ্গীকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করে চলেছে ইরহাম। হৃদি তা মনোযোগ দিয়ে শুনছে। প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে ভয় দূরীকরণ করার। ইনশাআল্লাহ্ সে পারবে। তার অর্ধাঙ্গ থাকবে তো পাশে। অহেতুক ভয় কিসের? সমস্ত ভয় জয় করবে সে যদি পাশে থাকে এ মানুষটি। এ মানুষটি যে আস্ত এক পজিটিভ ভাইবস্ এর ভাণ্ডার। সে থাকতে দুশ্চিন্তা কিসের? তার স্বামী ঠিক সবটা সামলে নেবে। তাকে এবং পরিস্থিতি দুই ই। ভাবতেই প্রশান্তির পরশ বুলিয়ে গেল অন্তরে। জীবনসঙ্গীর প্রতি এতখানি অগাধ বিশ্বাস কবে জন্ম নিলো! টেরও পেলো না সে কন্যা।
•
পুলিশ স্টেশন। ঘড়ির কাঁটা তখন নির্দেশ করছে সকাল দশটা বেজে ত্রিশ মিনিট। প্রায় জনশূন্য পুলিশ স্টেশনটি। মাঝেমধ্যে দু একজন কনস্টেবল কিংবা চা ওয়ালা কিশোর ছেলেটাকে দেখা যাচ্ছে। সহসা শুনশান এ নীরবতা ভেদ করে সেথায় হাজির হলো এক টয়োটা প্রিমিও। আগে পিছে আরো দু’টো গাড়ি। ধূলো উড়িয়ে থামলো টয়োটা প্রিমিও টি। দৃষ্টি আকর্ষণ করলো সেথায় উপস্থিত দু’জন কনস্টেবলের। তারা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। কারা এরা? ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। টয়োটা প্রিমিও’র সামনে ও পেছনে দু’টো গাড়ি দাঁড়িয়ে। সে দু গাড়ির দ্বার উন্মোচন করে নেমে এলো কালো পোশাকধারী কয়েকজন। পেশাগত জীবনে তারা পরিচিত বডিগার্ড কিংবা দেহরক্ষী হিসেবে। প্রশিক্ষিত তারা। এমপি সাহেব এবং তার পরিবারের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সদা নিয়োজিত। একজন দেহরক্ষী টয়োটা প্রিমিও এর নিকটে পৌঁছে গেল। উন্মুক্ত করে দিলো গাড়ির দ্বার। বৈভব বজায় রেখে গাড়ি হতে নেমে এলো শুভ্র পোশাকে আচ্ছাদিত এমপি ইরহাম। ওপাশের দ্বার উন্মুক্ত করে বেরিয়ে এলো হৃদি। মিস্টার অ্যান্ড মিসেস চৌধুরী পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। পুলিশ স্টেশনের বাহিরে দণ্ডায়মান দু’জন কনস্টেবল অবাক চিত্তে তাকিয়ে রইল ওদের পানে! স্বামীর বিশ্বস্ত হাতের মুঠোয় বন্দী হলো পেলব হাতটি। নিঃশব্দে মানুষটি তার হাতের স্পর্শে সহধর্মিণীকে প্রদান করলো ভরসা। একত্রে নজরকাড়া লাগছে দুটিকে! কনস্টেবল দু’জন এদের বৈভব-চলনবলন দেখে উপলব্ধি করলো সাধারণের মধ্যেও অসাধারণ এরা। যেনতেন কেউ নয়। কোনো বড়সড় পরিচয় নিশ্চয়ই লুকিয়ে। ধীরপায়ে ইরহাম ও তার সহধর্মিণী প্রবেশ করলো পুলিশ স্টেশনের অন্দরে। পিছু পিছু দু’জন দেহরক্ষী। বাকিরা নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দাঁড়িয়ে রইল গাড়ি সংলগ্ন। পুরোটা সময় স্ত্রীর কোমল হাতটি আঁকড়ে ছিল এমপি সাহেব। ছাড়েনি এক মুহুর্তের জন্যও।
পেরিয়ে গেল আধ ঘন্টার মতো। দরকারি কথাবার্তা এবং জবাবদিহিতা সেরে পুলিশ স্টেশন হতে বেরিয়ে এলো ইরহাম, হৃদি। ফোনালাপে লিপ্ত মানুষটির হস্ত ইশারা বুঝে একটি গাড়িতে বসলো হৃদি। ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে সবচেয়ে দক্ষ দেহরক্ষী। ইরহামের আলতো মাথা নাড়ানো দেখে শব্দহীন অনুমতি পেল দেহরক্ষী টি। ফলস্বরূপ কালো রঙা গাড়িটি রওনা হলো ‘ আনন্দাঙ্গন ‘ এর পথে। ইরহাম তখনো ফোনালাপে ব্যস্ত। একজন রক্ষী গাড়ির দ্বার উন্মুক্ত করে দাঁড়িয়ে। কথোপকথন চলমান অবস্থায় প্রতিটি পদচারণায় আভিজাত্য বজায় রেখে টয়োটা প্রিমিও-তে বসলো ইরহাম। দ্বার বদ্ধ করে নিজেদের জন্য ব্যবস্থাকৃত গাড়িতে বসলো সে লোকটি। সম্মুখে টয়োটা প্রিমিও পেছনে রক্ষীদের গাড়ি। চলতে আরম্ভ করলো টয়োটা প্রিমিও। গন্তব্য এমপি সাহেবের কর্মস্থল।
ব্যস্ত সড়ক ধরে এগিয়ে চলেছে গাড়িটি। এসির শীতল পরশে মিলছে শান্তি। মোবাইলে একজনের সঙ্গে আলাপণে লিপ্ত ইরহাম।
” নাম জুনায়েদ। জুনায়েদ শিকদার। ওর পুরো বায়োডাটা আমার চাই। এভ্রি সিঙ্গেল ডিটেলস্। কিছু যেন বাদ না পড়ে। ”
ওপাশ হতে আশ্বস্ত করলো সে জন,
” চিন্তা করবেন না ভাই। ওর পুরো বিন্দুবিসর্গ পেয়ে যাবেন। ”
” তাই যেন হয়। রাখছি। ”
” আসসালামু আলাইকুম ভাই। ”
” ওয়া আলাইকুমুস সালাম। ”
সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলো ইরহাম। পাঞ্জাবির পকেটে পুরে নিলো মোবাইল। চোখ গেল জানালা গলিয়ে ব্যস্ত শহরে। পথঘাট, অসংখ্য গাড়ি, পথচারীদের পদচারণায় নিবদ্ধ তার চাহনি। অথচ মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে অজস্র চিন্তার বহর।
•
আনন্দাঙ্গনে বেডরুমে খাটের একাংশে বসে এজাজ সাহেব। নিরীক্ষণ করে চলেছেন অফিসিয়াল ফাইল। সম্মুখে দাঁড়িয়ে ইনায়া। পাশে মালিহা। ক্ষণিকের নীরবতা ভঙ্গ করে ইনায়া মুখ খুললো। ক্ষীণ স্বরে থেমে থেমে বললো,
” বিয়েতে আমি রাজি। ”
ইচ্ছে সত্ত্বেও খুশি হতে পারলেন না মালিহা। ওনার মনে জমলো চিন্তাগুচ্ছ। তবে এজাজ সাহেব? ওনার অধরে ফুটে উঠলো তৃপ্তিকর আভা। মেয়ে রাজি হলো তবে! মনে মনে খুশি হলেও শব্দমালায় তা প্রকাশ করলেন না। আস্তে করে শুধু মাথা নাড়লেন। সেথায় দাঁড়ানোর মতো আর ধৈর্যশক্তি অবশিষ্ট রইল না। সত্বর কক্ষ হতে বেরিয়ে গেল ইনায়া। অক্ষিকোলে জমায়েত অশ্রুবিন্দু পিতা-মাতার অগোচরেই রয়ে গেল।
চলবে.