#মনের গহীনে সে❤️
#পর্ব-১৮
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
মেহেভীন অনুভব করছে কোন পুরুষ তার শক্ত হাতজোড়া দিয়ে মেহেভীনকে দেয়ালে চেপে ধরেছে সিড়ির নীচে থাকা ছোট্ট কামড়াতে। যেখানে কারো তেমন আসা যাওয়া নেই। মেহেভীনের গলাতে তার তীব্র নি:শ্বাস আচড়ে পরছে। মেহেভীন বুঝতে পারছে না, তাকে কেন এইভাবে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে তাও সকলের অগোচরে? সেই আগুন্তক অদ্ভুদ এক কাজ করে বসলো, সে তার পকেট থেকে একখানা কাপড় বের করে,মেহেভীনের চোখে বেঁধে দিলো। মেহেভীনের হাতজোড়া তার দখলে ছিলো বিধায়, মেহেভীন কোনরুপ বাঁধাও দিতে পারেনি। সে শুধু মোচড়ামোচড়ি করে যাচ্ছে সাপের ন্যায়। আরহাম তা দেখে আলতো হাঁসলো। হ্যা সেই আগুন্তক স্বয়ং আরহাম। আরহাম তার ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট অন করে, তার প্রেয়সীকে এক পলক দেখে নিলো। হলুদ এক গরজিয়াস লেহেংগা পরিধান করে আছে মেহেভীনের। মুখস্রীতে হাল্কা সাঁজের প্রলেপ। কি অপরুপ সেই সৌন্দর্য। আরহাম বারংবার তার প্রেয়সীর মুগ্ধতায় একপ্রকার বিলিন হয়ে যাচ্ছে। শত বাঁধা থাকা সত্ত্বেও, তার অবাধ্য আখিজোড়া তার হলুদপরীকে দেখার লোভ সামলাতে পারেনি। তার প্রেয়সীর পিঠ ছুইছুই কালো কেশ সমানতালে উড়ে যাচ্ছে, বেসামালা ভাবে
মেহেভীনের গোলাপী অধরজোড়া সমানতালে কাঁপাকাঁপা করছে, আরহান তা দেখে যেন একপ্রকার নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলছে। সে আলতো করে মেহেভীনের অধরজোড়া হাত দিয়ে ছুইয়ে দেয়, সঙ্গে সঙ্গে মেহেভীন তীব্র নি:শ্বাস ফেলতে থাকে। আরহাম এবং মেহেভীনের হৃদয়ের স্পন্দন একইসঙ্গে স্পন্দিত হচ্ছে। আরহামের খুব করে বলতে ইচ্ছে করলো, ‘ প্রেয়সী তোমাকে খুব করে ছুঁইয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। চন্দ্রের ন্যায় সুন্দর তুমি। তাইতো তোমার কাছে যাওয়ার সাধ্য নেই, দেখো এতো কিছু করেও তোমাকে নিজের করে আকড়ে ধরে বাঁচতে পারলাম না।’
আরহাম চাইলেও তার মনের গহীনে থাকা তীব্র যন্ত্রনা গুলো প্রকাশ করতে পারলো না, নিষ্চুপ থেকেই মেহেভীনকে আলতো করে ললাটে তে চুমু খেলো। মেহেভীন কেঁপে কেঁপে উঠলো। আরহাম নিজেকে সামলিয়ে,নিজের আখিজোড়া মুছে মেহেভীনের আখিজোড়ার বাঁধন খুলে, দ্রুত বেড়িয়ে গেলো। আরহাম বেড়িয়ে যেতেই, মেহেভীন তৃপ্তির হাঁসি দিলো। সে আরহামকে না দেখে কিংবা তার কন্ঠ না শুনেও আরহামের স্পর্শে আরহামকে অনুভব করেছে তীব্রভাবে। তাকে দেখতে স্বয়ং তার আরহাম সাহেব এসেছিলো। তৎক্ষনাৎ চারিদিকে আলোকিত হয়ে উঠে। বিদ্যুৎ চলে এসেছে। সকলে মেহেভীনকে খুঁজতে শুরু করে দেয়। মেহেভীনকে দেখতে না পেয়ে, অভ্রের মনে ভয় ঢুকে যায়। মেহেভীন কোথায় গেলো? এইসব লোড শেডিং কোনভাবে আরহাম করে নি তো? মনের সেই ভয় থেকে অভ্র নীচে গিয়ে, মেহেভীনকে নিজ মনে হাসতে দেখে, ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করে, ‘ মেহেভীন তুমি এখানে? এখানে কি করে এলে তুমি? ‘
অভ্রকে দেখে হাঁসি থামিয়ে, মেহেভীন কিছুটা থতমত খেয়ে উত্তর দেয়, ‘ আসলে, অভ্র ভাইয়া হুট করে সব অন্ধকার হয়ে গেলো, তোমাকেও খুঁজে পাচ্ছিলাম না, তাই ভয় পেয়ে খুঁজতে খুঁজতে নীচে চলে এসেছিলাম। ‘
অভ্র সংদেহ নিয়ে কিছুক্ষন মেহেভীনকে পর্যবেক্ষন করলো, মেহেভীনের উত্তর তার কাছে গ্রহনযোগ্য হলো না। মেহেভীন কিছুটা তাড়া নিয়ে উপরের দিকে চলে গেলো। অভ্র থুত্নিতে হাত রেখে খানিক্ষন ভাবলো আরহাম কী কোনভাবে এসেছিলো মেহেভীনের কাছে? সেই বিষয়টিই কি মেহেভীন লুকিয়ে যাচ্ছে? অভ্র হাত মুঠো করে উপরের দিকে চলে যায়। মেহেভীন সেখানে সকলের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। যেন সে এক বড় চিন্তা থেকে মুক্ত। তার মনের কুঠিরে থাকা বড় পাথর যেন নিমিষেই সরে গিয়েছে আরহামের আগমনে। অভ্রের দুশ্চিন্তার মাঝেই, অভ্রের মা এসে ছেলের কাছে গাঁয়ে হলুদের বাটি দিয়ে বললেন,
‘ যা সবার আগে, তুই গিয়ে মেহেভীনকে হলুদ লাগিয়ে আয়। ‘
‘ কিন্তু, তোমরা দিবে না মা?’
তখনি অভ্রের কিছু মেয়ে কাজিন পাশে থেকে একসঙ্গে বলে, ‘ যার হবু বউ, তারই উচিৎ সবার আগে হলুদ লাগানো তাইনা খালা? ‘।
অভ্রের মাও তাল মিলিয়ে বললেন, ‘ যা গিয়ে তাড়াতাড়ি লাগিয়ে দেয়। বাকিরাও পরে লাগাবে তখন। ‘
অভ্র মায়ের কথা শুনে কিছুটা খুশি হয়ে স্টেজে তার কাজিনদের সঙ্গে যায়। সেখানে তার কাজিনরা বলে উঠে,
‘কিরে অভ্র ভাই? দেরী করছিস কেন? ভাবিকে হলুদ ছুইঁয়ে দেয়। ‘
তাদের কথা শুনে, মেহেভীন ভ্রু কুচকে অভ্রের দিকে তাঁকায়। মুখশ্রীতে বিরক্তি এক ভাব দৃষ্টিমান হয়ে থাকে। অভ্রের দৃষ্টিঅগোচর হয়নি তা,তবুও অভ্র হলুদ মেহেভীনের ললাটে ছুঁইয়ে দিতে চাইলে, মেহেভীন সঙ্গে সঙ্গে তার হাত ধরে, কিছুটা অনুনয়ের সুরে বলে, ‘ আমার হলুদে এলার্জি আছে অভ্র ভাইয়া। আমি না হয় নিয়মরক্ষার্থে গালে এক চিমটি নিজে নিজেই ছুইয়ে দিচ্ছি। ‘
কথাটি বলেই, মেহেভীন এক চিমটি হলুদ নিয়ে নিজের গালে ছঁইয়ে দেয়। অভ্র রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। মেহেভীন প্রতাক্ষানের নামে একপ্রকার তাকে সকলের সামনে অপমান করে দিলো। অভ্রের সাথে অন্য কেউ এমন অবাধ্যতা করলে, তাকে এতোক্ষনে ঠা/টিয়ে চ/র বসিয়ে দিতো কিন্তু মেহেভীনের বেলায় সে তা করতে পারলো না। একপ্রকার গভীর ক্ষোভ নিয়ে সে স্টেজ থেকে নেমে গিয়ে রেলিং এর সাথে ঘেষে দাঁড়ালো। অত:পর কপালে আলতো করে স্লাইড করতে করতে, রাগান্বিত সুরে বলে উঠলো,
‘ একবার শুধু বিয়েটা হোক তারপর তুমিও আমার আসল রুপ দেখবে। তোমার এতো ঝাঁঝ কীভাবে কমাতে হয় সেটা আমিও দেখে নিবো মেহেভীন। জাস্ট আর একটা দিন ওয়েট করো বেইবি। ‘
কথাটি বলেই অভ্র বাঁকা হাসি দিলো।
অপরদিকে… আরহাম তার রুমের পাশে থাকা ছোট্ট পুলে পা ভিজিয়ে, একটা ওয়াইনের গ্লাস হাতে নিয়ে, আকাশের পানে চেয়ে রইলো। একটার পর একটা বোতল শেষ করছে। আখিজোড়া বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পরছে। নিজেকে চাইলেও নিয়ন্ত্রন করতে পারছে না। মেহেভীন তার সাথে থাকলে কখনো শত্রুদের হাত থেকে বাঁচবে না। তবুও সে তার প্রেয়সীকে দেখার লোভ সামলাতে পারলো না। তাই তো ছুটে গিয়েছিলো। আরহাম নিজেকে সামলাতে পারছে না। বুকের ভেতরটা যন্ত্রনায় ছাড়খাড় হয়ে যাচ্ছে। আরহাম নিজের ফোন বের করে, মেহেভীনের ঘুমন্ত ছবিখানা দেখে আলতো হেসে বলে উঠে,
‘ যাকে ঘিড়ে আমার জীবন শূন্যতায় পরিপূর্ন, সে রয়েছে আমার মনের গহীনে। হ্যা প্রেয়সী তুমিই আছো আমার মনের গহীন। ‘
কথাটি বলেই আরহাম বুকের সাথে ছবিখানা জাপ্টে ধরে রাখে।নি:শব্দে আরিয়ান গিয়ে আরহামের পাশে বসে। কারো উপস্হিতি টের পেয়ে আরহাম চট জলদি নিজের অশ্রু মুছে, নিজেকে সামলাতে ব্যাস্ত হয়ে পরে। কোনরকম ধীর কন্ঠে শুধায়,
‘এতো রাতে হঠাৎ? কোন দরকার আছে? ‘
আরিয়ান চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলো। আশে-পাশে ওয়াইনের বোতলে ভরপুর। একটা ওয়াইনের বোতল হাতে নিয়ে কিছূটা কেশে বললো,
‘ তা গরীবের দেবদাস, কালকে বউয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে বলে, নেশার জগতে ডুবে গেলে নাকি? তা দেবদাস জ্বী! বউয়ের বিয়ে হয়ে গেলে দেবদাসের মতো তার শ্বশুড় বাড়ির সামনে গিয়ে ছ্যাকাখোরের মতো ম/রে টরে যাওয়ার প্লান করছিস নাকি? তখন তোদের নিয়েও মানুষ ফেসবুকে ভিডিও দিবে ‘এই যুগের দেব-পারু আহা , ভালোবাসা এখনো বেঁচে আছে। তখন খুব মজা হবে তাইনা?’
‘কিসব যাতা বলছিস তুই? যা তো আমার সত্যি ভালো লাগছে না। ‘
আরহাম কথাটি বলেই মুখ ঘুড়িয়ে ফেললো। আরিয়ান আরহামের কাঁধে হাত রেখে বললো,
‘ সিংহের মতো তোকে সবসময় দেখেছি, আজ তুই কিনা বিড়াল হয়ে গেলি কিছু সামান্য গুন্ডাদের ভয়ে? ছিহ, ভাই! আমি ভাবতেও পারছি না। তুই না ক্রাইম অফিসার? ‘
আরহাম উঠে দাঁড়িয়ে গম্ভীর সুরে শুধালো,
‘ তুই জানিস, নিজের বিপদ দেখে তোর ভাই কখনো পিছে হটে যায়নি। নিজের জীবনে বাজি রেখেও বড় বড মিশন কম্পলিট করেছে, কিন্তু এইবার ব্যাপারটা আলাদা। আমার শত্রুরা আমাকে নয়, আমার ভালোবাসার মানুষের দিকে হাত বাড়িয়েছে। তার কিছু হয়ে গেলে আমি কি নিয়ে থাকবো?’
‘অথচ তাকে অন্য পুরুষের সাথে সহ্য করতে পারবি? যাকে ছোটবেলা থেকে ভালোবেসে গিয়েছিস, তাকে এক পলকেই অন্য কেউ বিয়ে করে ফেলবে, অন্য কেউ তাকে ছুইয়ে দেখবে….’
বাকিটূকু আরিয়ান বলতে পারলো না, তার আগেই
আরহাম আরিয়ানের গালে থা/প্পড় বসিয়ে দিলো। রাগে থরথর করে তার শরীর কাঁপছে। আরহামের থাপ্প/ড় খেয়ে টাল সামলাতে না পেরে পরতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেয় আরিয়ান, তবুও তার অধরে ফুটে উঠে মুচকি হাসি। সে নিজের অধরে হাত ছুইয়ে বলে, ‘ এতটুকু কথাই সহ্য করতে পারছিস না ভাই? অথচ কালকে যখন মেহুকে অন্য কেউ বিয়ে করে ফেলবে তখন কীভাবে তা সহ্য করবি? ‘
আরহাম অসহায় হয়ে আরিয়ানের দিকে তাঁকায়। সে কি করবে বুঝতে পারছে না। সে অভ্রের সাথে মেহেভীনকে সহ্য করতে পারবে না অপরদিকে তার সাথে থাকলে, মেহেভীনের জীবনের সংশয়। আরিয়ান তার ভাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
‘ ভাই আর কিছু ভাবিস না। আমাদের জন্যে মা হোক, অন্তত মায়ের কথা ভাব। মায়ের শরীরের অবস্হাতে, তার উপর কতটা বাজে প্রভাব পরবে তুই ভাবতে পারছিস? মেহুকে ছাডা তুই কখনো ভালো থাকবি না। আর তুই নিজের উপর ভরসা রাখ, তুই থাকতে মেহুকে কেউ কিছু করতে পারবে না। আর ভুল করিস না ভাই। মেহুর বিয়ে যে করেই হোক আটকাতে হবে। ‘
আরিয়ানের কথা শুনে বেশ কিছুক্ষনের জন্যে নিরব হয়ে যায় আরহাম। তার মষ্তিষ্কে ঘুড়ছে অন্য এক পরিকল্পনা।
______________
অপরদিকে মেহেভীনকে অন্তুসহ পার্লারের মেয়ে বধুরুপে সাঁজাতে ব্যাস্ত হয়ে রয়েছে। আজ মেহেভীন এবং অভ্রের বিয়ে। কিছুক্ষনের মধ্যেই, অভ্ররা বরযাত্রি নিয়ে চলে আসবে। পার্লারের মেয়েরা মেহেভীনকে সাঁজিয়ে চলে যায়। লাল টুকটুকে শাডিতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে মেহেভীনকে। অন্তুকে মেহেভীনের কানে ফিসফিসিয়ে বলে,
‘ কিছুক্ষনের মধ্যেই বরযাত্রি চলে আসবে। বিয়েটা আটাকাবি কী করে? তোর কি মনে হয় না? এইবার তুই একটু বেশিই রিষ্ক নিয়ে ফেলেছিস? ‘
মেহেভীন আলতো হেসে জবাব দেয়, ‘ একদমই নয়। আমি জানি উনি আসবে। আর জীবনে একটু আক্টু রিস্ক না নিলে, সেই জীবনের মজাই হারিয়ে যাবে। ‘
চলবে কি?