#মনের_গহীনে_সে 💝
#পর্ব-১৪
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
মেহেভীনের হবু শ্বাশুড়ির সামনে এসে তার বর্তমান স্বামী আরহাম তাকে একপ্রকার সকলের সামনে টানতে টানতে কক্ষের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো। মেহেভীনসহ, মায়রা এবং অভ্রের মা একপ্রকার থ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেহেভীনকে তার ঘরে এনে, দরজা কিছুটা ভিড়িয়ে দিয়ে, মেহেভীনের সামনে রক্তচক্ষু নিয়ে দাঁড়ায় আরহাম। আরহাম যেন চোখ দিয়েই আজ ভৎস করে ফেলবে মেহেভীনকে। মেহেভীন কিছুটা অস্বস্হি নিয়েই বললো, ‘ এইসব কি করছেন আরহাম সাহেব? এইভাবে সকলের সামনে আমাকে ঘরে টেনে নিয়ে এলেন, সবাই কি ভাব্বে? ‘
মেহেভীনকে থামিয়ে, আরহাম হুট করে মেহেভীনের বাহু শক্ত করে চেপে ধরে বলে, ‘ জাস্ট স্টপ ইট স্টুপিড মেয়ে। কে কি ভাবলো! কে কি করবে, এইসব ভাবতে ভাবতে আমি জাস্ট পাগল হয়ে যাচ্ছি। কিসব শুরু করেছো তোমরা? আর নিচে কিসব হচ্ছে এগুলো?’
মেহেভীন শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে গম্ভীর সুরে জবাব দেয়, ‘ আমার এবং অভ্র ভাইয়ের বিয়ের কেনাকাটার জন্যে আন্টি এসেছেন, আমাকে যেতে হবে। ‘
‘ কিসের বিয়ের কেনাকাটা? তুমি এখনো আমার স্ত্রী…’
আরহামের কথার মাঝে মেহেভীন ভ্রু কুচকে জবাব দেয়, ‘ স্ত্রী? কিসের স্ত্রী? তিন মাসের সময় শেষ হতে বেশি দেরী নেই। তারপরেই আমাদের এই সম্পর্কের ইতি। আপনি আপনার বউকে নিয়ে সুখে থাকবেন। আর আমি আমার ভালোবাসার মানুষের কাছে ফিরে যাবো। এইটাই তো আমাদের মাঝে কথা হয়েছিলো। রাইট? তখন কিন্তু আপনি আপত্তি করেন নি। ‘
মেহেভীনের কথা শুনে দমে যায় আরহাম। আরহাম কিছুক্ষন চুপ থেকে, মেহেভীনের বাহু আকড়ে ধরে, মেহেভীনকে কিছুটা নিজের দিকে টেনে নেয়। অশ্রুসিক্ত নয়নে অসহায় কন্ঠে প্রশ্ন করে,
‘ তুমি কি অভ্রকে ভালোবাসো? সত্যি করে বলো না?’
মেহেভীন আরহামের সেই অশ্রুসিক্ত আখিজোড়ার দিকে তাঁকিয়ে, নিজের আখিজোড়া বন্ধ করে ফেললো। সেই আখিজোড়ার দিকে তাঁকানোর সাহস হলো না তার। আরহাম ফের প্রশ্ন করলো,
‘ আমার চোখের দিকে তাঁকিয়ে উত্তর দাও মেহেভীন। তুমিতো অভ্রকে ভালোবাসো, তাহলে সেইটা আমার চোখের দিকে তাঁকিয়ে বলছো না কেন? ‘
মেহেভীন জবাব দেয় না। নেত্রপল্লব আবেশে বন্ধ করে রাখে। আরহাম তা দেখে ফের মুগ্ধ গলায় শুধায়,
‘ মানুষের সবথেকে সুন্দর হচ্ছে তার আখিজোড়া। সেই আখিজোড়া নিবদ্ধ থাকলেও বুঝি কাউকে এতোটা স্নিগ্ধ লাগে, তোমাকে না দেখলে বুঝতাম না মেয়ে। ‘
মেহেভীন চট করে আখিজোড়া খুলে ফেলে, কিন্তু আরহামের দিকে তাঁকানোর সাহস হলো না তার। দৃষ্টি তার মেঝেতেই আবদ্ধ।
‘ আরহাম আসবো? ‘
বাইরে থেকে মায়রার আওয়াজ শুনে মেহেভীন হাত উচিয়ে নিজের বাহু থেকে আরহামের হাত সরিয়ে ফেললো। আরহাম হাক ছেড়ে ‘ কাম ইন ‘ বললো। আরহামের অনুমতি পেয়ে, মায়রা প্রবেশ করলো। মায়রার পিছনে পিছনে আরিয়ানও প্রবেশ করলো। মায়রা আরহামের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ অভ্রের মা, মানে আন্টি, অনেকক্ষন যাবত, নিচে অপেক্ষা করছেন। তোমার হুট করে এইভাবে মেহেভীনকে নিয়ে আসায়, বোধহয় তিনি অসন্তুষ্ট হয়েছেন। ‘
‘ তো আমি কি করবো তাতে? মেহেভীন আমার স্ত্রী। আমার এখন কাকির পারমিশনে নিজের স্ত্রীকে ডাকতে হবে? ‘
কিছুটা উত্তেজিত হয়েই আরহাম জবাব দেয়। বর্তমান স্ত্রীর সামনে নিজের পূর্বের স্ত্রীকে ‘স্ত্রী’ সন্মোধন করলে, যেকোন স্ত্রীর খারাপ লাগবে। হয়তো মায়রাও খারাপ লাগছে, সেই কথা ভেবে মেহেভীন আরহামের থেকে দূরত্ব অতিক্রম করে, গম্ভীর গলায় শুধায়, ‘ আমি যাচ্ছি, যতই হোক, তিনি আমার হবু শ্বাশুড়ি। তার অবজ্ঞা আমি কিছুতেই করবো না। ‘
কথাটি বলে মেহেভীন বেড়োতে নিয়ে, আরহামের কানে ফিসফিসিয়ে বললো, ‘ খেলাটা যখন আপনি শুরু করেছেন,সেই খেলা যত্ন সহকারে শেষ করাটাও আমার দায়িত্ব। ‘
কথাটি বলেই মেহেভীন তৎক্ষনাৎ বেড়িয়ে যায়। আরহাম অবাক হয়ে যায় মেহেভীনের কথা শুনে। মেহেভীন কি বুঝাতে চাইলো?মায়রা আরহামকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘ আরহাম তোমার কি মনে হচ্ছে না, তুমি বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলছো। এইভাবে তো আমাদের প্ল্যান টা ফ্লপ হয়ে যাবে। ক্রিমিনালটা মেহেভীনের ক্ষতি করে ফেলবে। হাতে কিন্তু সময় নেই। তিন মাসের সময়টা শেষ হয়ে যাচ্ছে। ‘
‘তো ভাইয়া এখন কি করবে? ক্রিমিনাল টার ভয়ে নিজের বউয়ের বিয়ে হয়ে যেতে দেখবে? ‘
আরিয়ান ভ্রু কুচকে মায়রাকে প্রশ্ন করে। আরিয়ানের প্রশ্ন মায়রা বিরক্ত হয়ে যায়। তার সবকিছুতে বাঁধা দেওয়াটা যেন ছেলেটার অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে।
‘ আমি সেই কথা একবারও বলেনি আরিয়ান। ‘
আরিয়ান হাত ভাজ করে ক্ষিপ্ত গলাতে বলে,
‘ তুমি সেইটাই মিন করেছো মায়রা। আর থার্ড পারসেনের মতো বার বার মেহু আর ভাইয়ের সম্পর্কের মাঝে জড়াচ্ছো। ‘
মায়রা আরহামের পাশে দাঁড়িয়ে পালটা জবাব দিয়ে বলে,
‘ ওয়াট? আমি থার্ড পারসন হয়ে জড়াচ্ছি? আরহাম তোমার ভাইকে এইবার চুপ করতে বলো। মাত্রাধিক কথা
বলছে সে এখন। ‘
‘ আমি যে ভুল বলছি না, তা তুমি খুব ভালো করেই জানো মায়রা। ‘
আরিয়ান এবং মায়রার কথা কাটাকাটির মাঝে, আরহাম বাঁধ সেধে বলে, ‘ উফফ! তোমরা চুপ করবে? আপাতত প্লিয আমাকে একা থাকতে দাও। আমাকে ভাবতে দাও একটু। সো প্লিয লিভ!’
আরহামের কথা শুনে মায়রা এবং আরিয়ান ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়। মেহেভীন নীচে নামতেই, অভ্রের মা মেহেভীনের হাত ধরে প্রশ্ন করে, ‘ আরহাম তোমাকে নিয়ে কোথায় গিয়েছিলো? কি বলেছে? ‘
মেহেভীন কিছু বলার পূর্বেই, শিরিন বেগম নীচে নামতে নামতে বললেন, ‘ ছোট তুই হঠাৎ এই বাড়িতে? ‘
‘ আসলে ভাবি, তিন মাসের সময় শেষ হতে দেরী নেই। তাই ভাবলাম ছেলে এবং ছেলের বউকে নিয়ে শপিং শুরু করে দেই। বিয়ের কি কম কেনাকাটা। আমার একটা মাত্র ছেলের বিয়ে বলে কথা। ‘
অভ্রের মায়ের কথা শুনে, শিরিন বেগমের মুখশ্রী গম্ভীর হয়ে যায়। তিনি মেহেভীনের দিকে তাঁকিয়ে গম্ভীর গলায় বলেন, ‘ তা তুমি এখন, তোমার বিয়ের কেনাকাটা করতে যাবে? ‘
মেহেভীন মাথা নিচু করে ফেলে। শিরিন বেগম ফের বললেন, ‘ শ্বাশুড়ি উপস্হিত থাকা সত্ত্বেও, তার সামনে নিজের দ্বিতীয় বিয়ের কেনাকাটা করতে যাচ্ছো। তালুকদার বাড়িতে আর কত কিছু দেখতে হবে? ‘
মেহেভীন আলতো হেসে জবাব দেয়, ‘ এই বাড়িতে তো কত কিছুই দেখতে হয়। নিজের প্রথম স্ত্রীকে একপ্রকার বন্দী রেখেই, দিনের পর দিন নিজের দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে সংসার করছে আপনার ছেলে। তখন মনে হয়নি ফুপি আমার উপর দিয়ে কি যাচ্ছে? আমার মনের অবস্হা তখন তোমরা কেউ বুঝার চেষ্টা করেছো ফুপি? ‘
শেষের কথাটি বলতে গিয়ে একফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরে মেহেভীনের নেত্রপল্লব থেকে। মেহেভীন তার দ্রুত মুছে ফের বলে, ‘ হ্যা আরহাম সাহেবকে আমি স্বামী হিসেবে মেনে নেই নি, তাই বলে এমন শাস্তি? যতই হোক সে আমার স্বামী। তার সাথে অন্য কেউ দিনের পর দিন সংসার করছে, তা স্ত্রী হয়ে সহ্য করাটা কতটা যন্ত্রনাদায়ক, তা আমি উপলব্ধি করেছি ফুপি। অন্য কেউ আমার কষ্ট বুঝবে না। ‘
মেহেভীনের কথা শুনে শিরিন বেগম চুপ হয়ে গেলো।
‘ এখন আমি অভ্র ভাইকে বিয়ে করতে চাইছি সেইটা দোষের হয়ে গেলো? আমার বুঝি সুখে থাকার অধিকার নেই? যাক গে, চলুন আন্টি। অভ্র আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। ‘
মেহেভীনের কথায় অভ্রের মা সায় দিয়ে, মেহেভীনকে নিয়ে বেড়িয়ে গেলেন।মেহেভীনের প্রতিটি কথা উপর থেকে শুনেছে আরহাম। সত্যিই তো মেহেভীনকে বাঁচাতে গিয়ে, মিথ্যে বিয়ের নাটক করে সে নিজের অজান্তে হোক, কিংবা ইচ্ছেতে বিরাট বড় কষ্ট দিয়ে ফেলেছে মেহেভীনকে। তাদের সম্পর্ক তৈরি হওয়ার পূর্বেই, অদৃশ্য এক শত্রুর প্রভাবে তা নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে। আরহামের চিন্তায় একপ্রকার নাজেহাল অবস্হা। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। সে যথেষ্ট চেষ্টা করছে মেহেভীনকে নিরাপদ রাখার, কিন্তু সেই অজানা শত্রু যদি মেহেভীনকে টার্গেট করে ফেলে তখন কি করবে আরহাম? আরহামের ভাবনার মাঝেই, আরহামের অফিস থেকে কল আসে। আরহাম জানতে পারে, মেহেভীন যেই শপিং মলে গিয়েছে সেখানে মেহেভীনের উপর এটাক হতে পারে। আরহাম দ্রুত মায়রার নাম্বারে টেক্সক পাঠিয়ে ফোর্স রেডি করতে বলে, নিজেও একপ্রকার তাড়াহুড়ো করে বেড়িয়ে যায়। তার প্রেয়সীর বিপদ!
______________
অপরদিকে অভ্র এবং অভ্রের মায়ের সাথে শপিংমলে এ নিজেদের বিয়ে শপিং এ এসেছে মেহেভীন। অভ্র নানান ছুতোয় মেহেভীনের ঘনিষ্ট হতে চাইছে কিন্তু বার বার মেহেভীন তাকে অবহেলা করছে। অভ্রের মা লেহেংগা দেখতে সাম্নের স্টোরে যান। সেই সুযোগে অভ্র মেহেভীনকে একপ্রকার টেনে নিয়ে সাইডে নিয়ে যায়। মেহেভীনের হাত ধরে, বিরক্তি গলায় বলে, ‘ কি করছো মেহেভীন? তুমি এমন বিহেভ করছো যেন আমি অপরিচিত কেউ। কয়েকদিন পর আমাদের বিয়ে। আমরা একজন আরেকজন ভালোবাসি। অথচ তুমি আমার সাথে আনকর্মফোরটেবল ফিল করছো।’
মেহেভীন নিজের হাত ছাড়াতে ছাড়াতে ক্ষিপ্ত গলায় বলে, ‘ অভ্র ভাই ভুলে যাবেন না। আমাদের বিয়ে এখনো হয়নি। আমার হাত ছাড়ুন বলছি। ‘
‘ না আমি ছাড়বো না। তুমি তো আগে এমন ছিলে না মেহেভীন। এখন এমন করছো কেন? আমার দিকে তাঁকাও মেহু। তুমি তো আমাকে ভালোবাসো তাইনা? ‘
অভ্র মেহেভীনের গালে হাত রেখে বলতে থাকে কথাগুলো বার বার। মেহেভীন কিছুটা অনুনয়ের সুরেই বলে, ‘ আমার ভালো লাগছে না অভ্র ভাই। আমাকে ছাড়ুন আপনি। ‘
‘ উপ্স! খুব খারাপ লাগছে বুঝি? আরহাম ধরলে তো তখন ঠিকই ভালো লাগে৷ আমি স্পর্শ করলেই বুঝি তখন খারাপ লাগে?
অভ্রের নোংরা কথা শুনে নিজেকে জোড় করে ছাড়িয়ে, অভ্রের দিকে আঙ্গুল তাক করে মেহেভীন উচু গলায় বলে,’ নিজের সাথে আরহাম সাহেবের তুলনা করবেন না। তিনি আমার হাজবেন্ড। ‘
কথাটি বলে মেহেভীন চলে যেতে নিলে, পিছন থেকে অভ্র ফের মেহেভীনের হাত ধরে, চেঁচিয়ে বলে, ‘ হাজবেন্ড মাই ফুট! সে তো ঠিকই নিজের দ্বিতীয় বউকে নিয়ে সুখে আছে। আর তুমি এখনো তাকে নিজের হাজবেন্ড ভাবছো। হাউ ফুল ইউ আর মেহেভীন! ‘
তখনি সেখানে আবির্ভাব ঘটে…….
চলবে কি?