#মনের_গহীনে_সে 🤍
#পর্ব- ৫
#Jannatul_ferfosi_rimi (লেখিকা)
রাতে নিজের প্রাক্তন স্বামীকে নিজ কক্ষে দেখে চিৎকার করতে গিয়েও থেমে যায়। আরহামকে দেখে কিঞ্চিৎ সময়ের জন্যে থমকে থাকে তার চাহনী। বেড়ে যায় হৃদস্পন্দন। কেমন শ্বাসরুদ্ধ অবস্হা! সামনে সাদা শার্ট পরিহিত টকটকে ফর্সা যুবক। যার
কালো কুচকুচে মনিজোড়া অস্হিরতার সহিত মেহেভীনকে পরখ করে নিচ্ছে। মেহেভীন মাথা নুইয়ে নিলো, সরে আসতে চাইলো আরহামের থেকে। আরহাম তাকে সরে যেতে দিলো না, মেহেভীনকে হেচকা টান দিলো, টানের ফলে বেগতিক ভাবে মেহেভীনের মাথা এসে আরহামের সুঠোম দেহের মধ্যখানে থাকা বুকে এসে আলতো করে ধাক্কা খায়। চমকে যায় আরহাম। মেহেভীনের পিঠে হাত রাখতে গিয়েও, নিজের হাত সরিয়ে, মেহেভীনের বাহু শক্ত করে ধরে মেহেভীনকে নিজের বুক থেকে সরিয়ে নিজ বরাবার সামনা সামনি বসায়। মেহেভীন আরহামকে কিছু বলতে চাইলে, আরহাম দ্রুত উঠে মেহেভীনের রুমের কক্ষের আলো জ্বালিয়ে দেয়। মেহেভীন নিজের দিকে ভালো করে তাকিয়ে, দ্রুততার সাথে নিজের ওড়না ঠিক করে, তা দেখে আরহাম বাঁকা হাসে আলতো করে। আরহামের হাসি দেখে মেহেভীনের শরীর যেন রাগে জ্ব/লে যাচ্ছে। সে ক্ষিপ্ত গলায় প্রশ্ন করে, ‘ সেদিন তো আমাকে কমনসেন্সের অনেক বড় বড় ডায়লগ দিলেন, তো আপনি কি জানেন না? একটা অবিবাহিত মেয়ের ঘরে এইভাবে হুট করে প্রবেশ করা যায়না? তাও রাতের বেলায় যখন সে নিদ্রাচ্ছন্ন অবস্হায় রয়েছে। ‘
আরহাম মেহেভীনের কাছে চলে আসে হুট করে। মেহেভীন ঘাবড়ে যায়। আরহাম মেহেভীনের দিকে তাকিয়ে রুক্খ গলায় শুধায়, ‘ তা তুমি কি জানো?
রাতের দরজা লক করে ঘুমাতে হয়। এই ম্যানারস টুকুও নেই তোমার? এইভাবে দরজা খুলে ঘুমালে, আমি কেন যে কেউ সুযোগ নিতে চলে আসবে। ‘
আরহামের শেষের কথায় ঘৃণায় মুখ ঘুড়িয়ে নেয় মেহেভীন। মেহেভীনের কান্ডে কিছুটা ক্ষিপ্ততার সাথেই আরহাম বলে, ‘ আর কে অবিবাহিত তুমি?এইটাও বোধহয় তুমি জানো না, মিসেস আরহাম হাসান তালুকদার, ডিভোর্স কার্যকর হয় তিন মাস পর। আমাদের ডিভোর্সের প্রসেসিং চলছে এখনো,কিন্তু পুরোপুরি ডিভোর্স হয়ে যায়নি। সো তোমার উপর আমার এখনো রাইটস আছে। ‘
‘ মিসেস আরহাম হাসান তালুকদার ‘ ডাকটি শুনে মনে এক অজানা শান্তির স্রোত বয়ে গেলো মেহেভীনের। হ্যা এইটা তো ঠিক তাদের ডিভোর্স কার্যকর হতে এখনো তিনমাস সময় লাগবে। জটিল প্রসেস! পরক্ষনে মেহেভীন কি ভেবে যেন আরহামের দিকে ঘুড়ে গম্ভীর সুরে বললো, ‘ তাই বুঝি তিন মাসের জন্যে আমাকে আপনার বাড়িতে রেখেছেন?’
আরহাম চমৎকারভাবে হেসে জবাব দেয়, ‘ আজ্ঞে জ্বী!। তিনমাসের ডিভোর্সের প্রসেসিং টা ভালোভাবে হয়ে যাক, তারপর তুমি তোমার কাছে অভ্রের কাছে ফিরে যেও, আমি তোমাকে আটকাবো না। ‘
আরহামের কথা শুনে মেহেভীন খুশি হয়ে বলে,
‘ সত্যি? তিন মাস পর আমি আমার অভ্রের কাছে ফিরে যেতে পারবো? ‘
আরহামের মুখস্রীতে গম্ভীরতার রেশ লক্ষ্য করা যায়। সে মাথা নাড়িয়ে দিয়ে ‘হ্যা ‘ সূচক জবাব দেয়। মেহেভীন পরক্ষনেই প্রশ্ন করে ফেলে, ‘ কিন্তু, এতো রাতে আপনি আমার ঘরে কি করছেন? তাও নিজের স্ত্রীকে ফেলে। ‘
‘ নিজের অধিকার ফলাতে। ‘
আরহামের জবাবে চমকে যায় মেহেভীন।
___________________
অভ্রের বাবা ইকবাল সাহেবের একটি বদ অভ্যাস হচ্ছে, রাতে চা না খেলে ঘুমালে তার ঠিক করে ঘুম আসে না। নিজের হাতেই রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে চা তৈরি করছেন। এক কাপ চা নিজের স্ত্রীর জন্যেও করেছেন। স্ত্রীর মুখের উপর কথা বলার সাধ্য নেই তার। আরহামের বাবা মা/রা যাওয়ার পরে, অভ্রের মা যখন সিদ্বান্ত নিলেন, তারা আলাদা হয়ে নিজেদের মতো সংসার করবেন, তখন অভ্রের মায়ের বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারেননি অভ্রের বাবা। নিজের সদ্য পিতা হারানো দুই ভাইপো এবং ভাবিকে তালুকদার বাড়িতে রেখে, আলাদায় বাড়িতে চলে এসেছিলেন তারা। সেই বাড়িও আরহামের বাবা নিজের টাকায় করা, যা তিনি তার একমাত্র ছোট ভাইকে দিয়ে গিয়েছিলেন। এমনকি বিসনেজের অর্ধেক পার্টনারশিপ অভ্রকে দিয়ে গিয়েছেন, যার ফলে অভ্র এখন তাদের বিসঞ্জের অস্ট্রেলিয়ার ব্রাঞ্চ সামলাচ্ছে। আরহামের বাবা কখনো কাউকে বঞ্চিত করেননি। নিজের ভাইয়ের করা উপকারের কথা মনে পড়তেই দুফটো চোখের জল গড়িয়ে পরলো ইকবাল সাহেবের নেত্রপল্লব থেকে, তার বিপরীতে কখনো তিনি কিছুই করতে পারেন নি, কিন্তু যখন নিজের ভাবির শেষ ইচ্ছের কথা জানতে পারলেন, তিনি মেহেভীনকে নিজের ছেলের বউ হিসেবে চাইছেন তখন অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিজের হবু বউমাকে আরহামের হাতে তুলে দিয়েছিলেন তিনি। অভ্রের মায়ের প্রথম থেকেই মেহেভীনকে তেমন পছন্দ ছিলো না, তাই তিনিও দিরুক্তি দেখান নি, অভ্র নিষ্চুপ থাকলেও, নিজের ছেলের আচরণে স্পষ্ট টের পেয়েছেন, বাবার এমন কাজে তার ছেলে যথেষ্ট কষ্ট পেয়েছে। তাইতো বাবাকে আগের মতো ফোনও করে না সে। চা হাতে নিয়ে নিজের কক্ষের সামনে গিয়ে শুনতে পেলেন, নিজের স্ত্রীর ফোনালাপ। তিনি ছেলেকে বলছেন, ‘ আর কত রাগ করে থাকবি বাপ? তুই আমাদের একমাত্র সন্তান। এইবার তো দেশে ফিরে আয়। কতদিন এইভাবে দূরে থাকবি? কতদিন মন ভরে দেখিনা তোকে। আরেকটা খবর জানিস বাপ? ওই মেয়ের তো ডিভোর্স হয়ে গেছে। ‘
মেহেভীনের ডিভোর্সের খবরে অভ্রের খুশি ফোনের অপাশ থেকেই খুব ভালো করে উপলব্ধি করতে পারলেন অভ্রের মা। অভ্র তার মায়ের বিপরীতে এমন কিছু বললো, তা শুনে অভ্রের মা চটজলদি ফোনটা রেখে, তার স্বামীর হাত ধরে উৎফল্লিত হয়ে বললেন,
‘ ওগো শুনেছো? আমাদের অভ্র দেশে ফিরছে। ‘
___________________
‘ নিজের অধিকার ফলাতে মানে? ‘
মেহেভীনকে চমকে দিয়ে নিজের পিছনে থাকা হাতজোড়া সামনে নিয়ে এলো আরহাম। মেহেভীন আরহামের হাতে দুধের গ্লাস দেখে তার নেত্রজোড়া বড় বড় করে বললো, ‘ দুধের গ্লাস দিয়ে হবে? ‘
‘ তুমি এখন সম্পূর্ন দুধের গ্লাস শেষ করবে। এজ সুন এজ পসিবল। ‘
‘ আর কেউ ক্রেজি? আমি দুধ, ছিহ! কখনো না। দুধ দেখলেই আমার বমি পায়। ‘
কথাটি বলেই মেহেভীন বমির করার মতো মুখটা বিকৃত করলো।
মেহেভীনকে দেখে আরহাম বিরক্তির সহিত বললো, ‘ তুমি কি ছোট বাচ্চা? শরীর খারাপ লাগছে দুধ খেয়ে নাও, ভালো লাগবে। নিজের শরীরের দিকে তাকিয়েছো প্রতিদিন এক গ্লাস করে দুধ খাবে। এখন থেকে। ইটস মাই ওর্ডার। ‘
‘ না, না আমি দুধ খাবো না। আচ্ছা আমার শরীর খারাপ করলেও আপনার কি? আপনি আমাকে জোড় করতে পারেন না। ‘
‘ একশোবার পারি। ওইযে বললাম এখনো আমাদের সম্পূর্ন ডিভোর্স হয়ে যায় নি। সেই অধিকার থেকেই বলছি, আমি চাইলেই কোন স্টাফকে দিয়ে তোমার ঘরে দুধটা পাঠিয়ে দিতে পারতাম, কিন্তু তুমি যা ঘাড়/ত্যা/ড়া স্টুপিড মেয়ে। আমি ছাডা এই কাজ কেউ পারবে না। ‘
মেহেভীন দরজার দিকে নিজের আঙ্গুল তাক করে আরহামকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘ এখুনি বেড়িয়ে যান, আমি কিছুতেই খাবো না। আপনার বউকে গিয়ে খাওয়ান। আমি খাবো না মানে খাবো না। ‘
আরহামের জেদ এইবার চরম খারাপ অবস্হায় পৌঁছে যায়। সে মেহেভীনকে টেনে মেহেভীনের মুখ চেপে দুধের গ্লাস টুকে মুখে দিয়ে কিছুটা দুধ খায়িয়ে দেয়। মেহেভীন কাশতে থাকে। আরহাম মেহেভীনের থেকে সরে গিয়ে, গম্ভীর সুরে বলে,
‘ চুপচাপ খেয়ে নাও মেহেভীন। আমাকে রাগিও না। নাহলে সব টুকু আমি এইভাবেই খায়িয়ে দিবো। ‘
মেহেভীন অসহায় ভাবে কিছুক্ষন চেয়ে থাকে, আরহামের দিকে তাকিয়ে বলে ‘ আরে মায়রা আপু তুমি? ‘
মেহেভীনের কথা শুনে আরহাম পিছনের দিকে তাকাতেই, মেহেভীন ভৌ দৌড় দেয়। আসলে মায়রা সেখানে ছিলোই না। আরহাম দুধের গ্লাস হাতে নিয়ে মেহেভীনের পিছনে দৌড়াতে দৌড়াতে, রাগে চেচিয়ে বলে, ‘ আজকে সবটুকু দুধ তোমাকে খায়িয়ে ছাড়বো স্টুপিড মেয়ে কোথাকার। ‘
মেহেভীন দৌড়াতে দৌড়াতেই জবাব দেয়, ধরতে পারলে তো। আগে আমাকে ধরে দেখান দেখি। ‘
_______________
অপরদিকে
মজনু বাগানের কেয়ারটেকার, নিরিবিলি একা বাগানে বসে আছে। মজনুকে একা এতো রাতে বাগানে দেখে রাহেলা এগিয়ে আসে মজনুর কাছে,যিনি আরহামের মায়ের পার্সোনাল কাজের লোক, কাজের লোক হলেও পরম আদরের শিরিন বেগমের। মজনুর পাশে বসে রাহেলা খেয়াল করে,কোন এক কারণে মজনুর মন খারাপ। রাহেলা প্রশ্ন করে, ‘ আপনার কি হইছে মজনু ভাই? ‘
‘ আর কইয়ো না বুয়া, বহুত কষ্টে আছি। ৫ম নাম্বার প্রেরেম টাও টিকলো না। ছেমড়ির বিয়ে হয়ে গেছে। ‘
মজনুর কথা শুনে মনে মনে খুশি হয় রাহেলা। অনেক আগে থেকেই মজনুকে পছন্দ করে সে। পরক্ষনে মেজাজ দেখিয়ে বলে, ‘ আপনাকে আগেও বলছি আমারে বুয়া কইবেন না, আমি কি আপনার বাড়ির বুয়া? আমার এত্তো সুন্দর নাম, আমারে রাহেলা বানু কইয়া ডাকবেন। ‘
মজনু মুখ ঘুড়িয়ে জবাব দেয়, ‘ মাথা গরম করবা না বুয়া। মেজাজ বহুত খারাপ। অনেক দু:খে আছি।
বি/ষ খাইয়া ওই ছেমড়ি আর ছেমড়ির জামাইয়ের নামে সুই/সাইড নোট লেইখা যামু বুঝলা? ‘
‘ আমি বি/ষ আইনা দেই মজনু ভাই? টাকা দেন। আমার কাছে এহন টাকা নাই। ‘
রাহেলার উত্তরে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকে মজনু। রাহেলা শব্দ করে হেঁসে ফেলে। তাদের কথার মাঝে কোথা থেকে মেহেভীন এসে পরে, পিছন পিছন আরহাম ও দৌড়াতে থাকে। মেহেভীন থেমে যায়। আরহাম ও থেমে গিয়ে মেহেভীনের হাত ধরে ফেলে বলে, ‘ এখন কোথায় পালাবে তুমি? চটজলদি সব দুধ শেষ করো। ‘
মজনু এবং রাহেলা ফ্যালফ্যালে দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আরহাম এবং মেহেভীনের দিকে। মেহেভীন দুধের গ্লাস হাতে নিয়ে খেতে গিয়েও, পরক্ষনে তা ছুড়ে ফেলে আবারোও দৌড় দেয়। সেই দুধ গিয়ে সম্পূর্ন মজনুর গাঁয়ে গিয়ে পরে। মজনুর সারা শরীরে
দুধের মাখামাখি। আরহাম চিৎকার করে বলে,
‘ উফফ! জাস্ট আ রিডিকিউলাস। স্টুপিড মেয়ে।’
ঘটনাটি বুঝতে মজনুর কিছুক্ষন সময় লাগে। আসলে কি থেকে কি হলো সে নিজেও বুঝতে পারছে না।
রাহেলা উঠে দাঁড়ায়। মজনু তার শরীরের দিকে তাকিয়ে অসহায় ভাবে কান্নার সুরে বলে উঠে,
‘ বাবারে! আমার সাথেই কেন হয় এমন?’
চলবে কি?
কেমন হয়েছে জানবেন কিন্তু।