মনের অরণ্যে এলে তুমি পর্ব-০৭

0
1299

#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৭

প্রতিটি মেয়ের জীবনে একসময় এই দিনটির আগমন ঘটে। বড় বেদনাদায়ক সে লগ্ন। বুকের ভেতরটা পুরোদমে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দেয়। আপনজনকে ছেড়ে যাওয়ার ভয়ে জীর্ণশীর্ণ দশা অন্তঃপুরের। অক্ষিকোলে নোনাজলের অস্তিত্ব। শুধু গড়িয়ে পড়ার অপেক্ষা। আর দু দণ্ড দাঁড়ালে বুঝি গড়িয়েই পড়বে। রায়হান সাহেব আদরের কনিষ্ঠ কন্যাকে তুলে দিলেন জামাতার হাতে। দুঃখ ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বললেন,

” আমার মেয়েটা বড় সরল। অগোছালো। ওকে একটু মানিয়ে গুছিয়ে নিয়ো বাবা। ও হয়তো ছেলেমানুষী করবে। তুমি তো বুঝদার। ওকে মনের মতো গড়ে নিয়ো। ক কষ্ট পেতে দিয়ো না আমার মেয়েটাকে। ”

ইরহাম দ্বিতীয় পিতার হাতে ভরসাযোগ্য হাতটি রাখলো।

” চিন্তা করবেন না বাবা। ইনশাআল্লাহ্ হৃদি ভালো থাকবে। আমরা আছি তো। ”

সব পিতাই এমন ভরসার হাতখানি আশা করে। রায়হান সাহেবও তাদের ব্যতিক্রম নন। সুযোগ্য পাত্রের হাতে মেয়েকে দ্বারস্থ করে উনি আজ নিশ্চিত। তবে বুকের মধ্যিখানে সুক্ষ্ণ চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। জ্বলছে আঁখি যুগল। হৃদি ইরহামের হাতের মুঠো হতে নিজের হাতটি মুক্ত করে নিলো। মেহেদী রাঙা হাতে পরিহিত লেহেঙ্গা সামলিয়ে ছুটে গেল জন্মদাত্রীর পানে। দু হাতে মা’কে আলিঙ্গন করে অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগলো। সে কি কান্না! কান্নার তোপে কেঁপে কেঁপে উঠছে কায়া। এতক্ষণ কোনোমতে নিজেকে সামলিয়ে রেখেছিলেন ফারহানা। তবে বুকের মধ্যিখানে মেয়েকে উপলব্ধি করে আর সামাল দিতে পারলেন না। মেয়েকে আলিঙ্গন করে ক্রন্দনে লিপ্ত হলেন। কুণ্ডলী পাকিয়ে অশ্রু মালা প্রকাশিত হতে লাগলো। বাঁ হাতে মেয়ের পৃষ্ঠে স্নেহময়ী হাত বুলিয়ে চলেছেন উনি। ডান হাতটি আদর করে চলেছে মেয়ের মাথায়। মা-মেয়ের এমন কান্নার রোল দেখে খুদে সদস্য ফারিজাও আবেগতাড়িত হয়ে পড়লো। বাবার কোলে থাকা মেয়েটি দু হাতে বাবার গলা জড়িয়ে ধরলো। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো গলায় মুখ লুকিয়ে। সবাই কাঁদে কেন? তার দুঃখ পায় তো। হৃদি একে একে আপনজনদের জড়িয়ে কেঁদেই চলেছে। থামছে না সে অসহনীয় কষ্টদায়ক রোদন! ইরহাম একদৃষ্টিতে অবলোকন করে চলেছে বধূ সাজে সজ্জিত রমণীর অশ্রুভেজা মুখশ্রী। তার ভেতরে কি চলছে বোঝা দুষ্কর। নভোনীল আঁখি যুগল নিবদ্ধ নববধূতে। এমন দুঃখময় পরিস্থিতি সামাল দিতে এগিয়ে এলেন মালিহা এবং নাজরিন। ওনারা দুজন বলেকয়ে ধরাধরি করে নববধূকে গাড়িতে বসতে সহায়তা করলেন। হৃদিকে গাড়িতে বসিয়ে মালিহা বন্ধ করে দিলেন ডোর। তবুও থেমে নেই দুঃখ জর্জরিত রমণী। কার উইন্ডো দিয়ে মাথা গলিয়ে বাহিরে তাকালো সে। অশ্রুজলে সিক্ত হতে লাগলো কপোলদ্বয়ের ত্বক। আর’ক্ত আভা ছড়িয়ে পড়লো আঁখি জোড়ায়। তা লক্ষ্য করে পিতা-মাতার চোখেও ভীড় জমালো নোনাজল। ফারহানা আবেগী চাহনিতে কনিষ্ঠ কন্যার পানে তাকিয়ে। ইরহাম পরিস্থিতি অনুধাবন করে গুরুজনদের বিদায় জানিয়ে গাড়িতে বসলো। হৃদির ঠিক ডান পাশে। কনেপক্ষ বিদায় লগ্ন অনুধাবন করতে পেরে আবেগপ্রবণ ভঙ্গিতে বিদায় জানালো। নীতিকে জড়িয়ে অশ্রুপাত করতে লাগলো কিশোরী নিদিশা। রাঈশা একদৃষ্টিতে গাড়ির পানে তাকিয়ে। ভেজা তার অক্ষি যুগল।

চলতে আরম্ভ করলো বরযাত্রী বহনকারী গাড়িগুলো। উইন্ডো হতে মাথা গলিয়ে আপনজনদের দিকে অশ্রুসজল নয়নে তাকিয়ে মেয়েটি। হাত নেড়ে বিদায় জানাতে লাগলো। ক্রমশ দূরে চলে যাওয়া স্বজনরাও দুঃখকষ্ট গোপন করে বিদায় জানালো। সকলে দৃষ্টি সীমার বাহিরে চলে গেলেই মুখখানি ভেতরে নিয়ে নিলো হৃদি। অসহনীয়-দুঃখময় ক্রন্দনে দিশেহারা হলো। দু হাতের তেলোয় লুকিয়ে নিলো‌ মুখখানি। ক্ষণে ক্ষণে কম্পিত হতে লাগলো কায়া। সহসা হাতের উল্টো পিঠে পুরুষালি স্পর্শ অনুধাবন করে বিহ্বল হলো! দু হাতের তেলো হতে সরিয়ে নিলো বদন। ডানে তাকাতেই লক্ষ্য করলো স্বামীকে। হাঁ স্বামী। ঘন্টাখানেক পূর্বে তিন কবুল বলে যার সনে জুড়ে গিয়েছে আজীবনের জন্য। সে মানুষটির হাতে রুমাল। মুখশ্রী বরাবরে মতোই গম্ভীর। সে গম্ভীর মানব অতি যতনে রুমালের স্পর্শে ওর সবটুকু অশ্রু কণা মুছে দিতে লাগলো। সমস্ত ধ্যানজ্ঞান অশ্রু কণায়। এক ফোঁটা কণার অস্তিত্ব রইবে না এমন রূপে মুছে দিচ্ছে। ক্রন্দনে লিপ্ত রমণী অনাকাঙ্ক্ষিত এহেন আচরণে ক্রন্দন ভুলে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। মুখশ্রী হতে রুমালের স্পর্শ সরে যেতে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। এতক্ষণ যেন দম আটকে বসে ছিল। তবে উপলব্ধি করতে লাগলো মরুর ন্যায় শুকিয়ে কাঠ গণ্ডস্থল। একফোঁটা জলের জন্য ছটফটানি অনুভূত হচ্ছে। এ মুহূর্তে পানি না পেলে বুঝি তৃষ্ণার্ত-পীড়িত হয়ে ম”রণ আলিঙ্গন করবে। ঠিক সে মুহূর্তে পুনরায় অপ্রত্যাশিত আচরণ। পানির বোতল ওর মুখের সামনে ধরল সঙ্গী মানব। বোতলের ছিপি খোলা। শুধুমাত্র পানি পান করার অপেক্ষা। একপলক স্বামীর পানে তাকিয়ে বোতলের নাগালে মুখ নিলো মেয়েটি। একটুও বিলম্ব করলো না। তৃপ্তি সহকারে পানি পান করতে লাগলো। প্রায় অর্ধেক বোতলের বেশি পানি পান করলো। স্বস্তি মিললো শরীর মন উভয়ে। তপ্ত শ্বাস ফেললো হৃদি। ওর হাত থেকে বোতলটি নিয়ে ছিপি আটকে যথাস্থানে রেখে দিলো ইরহাম। অতঃপর মোবাইল বের করে তাতে মনোনিবেশ করলো। সবটুকু ধ্যান জ্ঞান সেথায় নিবদ্ধ। পাশে থাকা রমণী যেন অদৃশ্য, অস্পৃশ্য! এমন আচরণে অপ্রস্তুত হয়ে জানালার বাহিরে তাকালো মেয়েটি। উপভোগ করতে লাগলো রাতের শহরের সৌন্দর্য!
.

‘ আনন্দাঙ্গন ‘ এর দোরগোড়ায় এসে থামলো গাড়ি। একে একে গাড়িগুলো হতে বরযাত্রীর সদস্যরা বেরিয়ে এলো। সবশেষে ইরহাম, হৃদির পালা। ইরহাম বিনা বাক্যে গাড়ির দ্বার উন্মুক্ত করে বেরিয়ে গেল। এটাই প্রত্যাশিত ছিল। তাই হতাশ না হয়ে দ্বার উন্মুক্ত করে বের হতে উদ্যত হলো মেয়েটি। তখনই আরো একবার ঝটকা! ওর পাশের দ্বার উন্মুক্ত করে দিলো এক মানব। বরবেশে সে দাঁড়িয়ে। গম্ভীর মুখো মানবের হাতটি বাড়িয়ে দেয়া ওরই উদ্দেশ্যে। তা বুঝতে একটুও অসুবিধে হলো না। হৃদি একবার বাড়িয়ে দেয়া হাত তো আরেকবার গম্ভীর বদনে তাকালো। বুঝলো না এমনতর আচরণের মূল হেতু। তাই চুপটি করে পুরুষালি হাতের মাঝে নিজ হাতটি রাখলো। হালাল সঙ্গীর যত্নশীল স্পর্শে শিউরে উঠলো সারা কায়া। শক্ত রূপে ওর পেলব হাতটি মুঠোবন্দী হলো শুষ্ক হাতের মাঝে। সযতনে ওর হাতটি ধরে বেড়োতে সহায়তা করলো ইরহাম। বদ্ধ করলো দ্বার। তাঈফ এবং রাহিদ স্বল্প দূরত্বে দাঁড়িয়ে। মিটিমিটি হাসছে। ইনায়া তো বেশ উৎফুল্ল ভাইয়ের নয়া রূপ দেখে। মালিহা মনেপ্রাণে এ দুটির জন্য দোয়া করলেন।

অর্ধাঙ্গের হাতে হাত রেখে নতুন গৃহে, নতুন নীড়ে প্রবেশ হলো নববধূর। আজ থেকে এই আনন্দাঙ্গন ই মিসেস হৃদি শেখের নয়া বাস। নতুন ঠিকানা।

নতুন কক্ষ। নয়া ঠিকানা। ওয়াশরুমের নব মোচড় দিয়ে উন্মুক্ত করলো দ্বার। জলের অস্তিত্বে সতেজতার খোঁজ পেয়েছিল মেয়েটি। তাই তো সবটুকু ক্লান্তি দূরীকরণ করার প্রয়াস চালালো। অতঃপর ওয়াশরুম হতে বেরিয়ে এলো হৃদি। পড়নে তার নীলাভ রঙা জামদানি শাড়ি। সিক্ত দীঘল কালো কেশ। চোখেমুখে বিন্দু বিন্দু পানির কণা। বিয়ের সাজসজ্জা ধুয়েমুছে সাফ। তোয়ালে দিয়ে সিক্ত মুখশ্রী মোছার ফাঁকে নতুন কক্ষ দেখতে লাগলো নববধূ। বিশালাকার প্রশস্ত জায়গা জুড়ে কক্ষটি। কক্ষের মাঝ বরাবর দেয়াল ঘেঁষে মাস্টার বেড। পেছনে আকর্ষণীয় হেডবোর্ড। বেডের ডান পার্শ্বে দেয়াল নয় বরং বৃহদাকার জায়গা জুড়ে জানালার মেলা। পাশাপাশি ছোটোখাটো ছ’টি জানালা। জানালা সংলগ্ন বড় একটি শুভ্র রঙা সোফা। দু পাশে দুটি সিঙ্গেল সোফা। মধ্যখানে আয়তাকার ক্ষুদ্র টেবিল। বেডের বিপরীত দিকে বড় ডিভান। বাঁ পাশে ওয়াল কাবার্ড এবং ড্রেসিং টেবিল। গোটা কক্ষটি সুসজ্জিত এবং শুভ্র রঙে ছেয়ে। দেখতেই শান্তি অনুভূত হয়। প্রশান্তি বয়ে যায় তনুমনে।

” বাহ্! রুমটা তো বেশ ফিটফাট! গোছানো। পুরুষ মানুষের রুম দেখে মনেই হচ্ছে না। মনে হচ্ছে রুপকথার কোনো রাজকন্যার ঘর। শ্বশুরবাড়ির বদলে ভুল করে এখানে চলে এসেছি। ”

একাকী হেসে উঠলো মেয়েটি। ঠিক সে মুহূর্তে ভেজানো দ্বার উন্মুক্ত করে কক্ষে প্রবেশ করলেন মালিহা এবং ইনায়া। ওনার হাতে খাবারের প্লেট। পুত্রবধূকে একাকী হাসতে দেখে উনিও মৃদু হাসলেন।

” কি রে মা! একাকী হাসছিস কেন? ”

আকস্মিক ওনার কণ্ঠ শুনে থতমত খেল মেয়েটি। সুন্দর রূপে তোয়ালে হাতে নিয়ে বললো,

” কিছু না মা। এই ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। রুমটা খুব সুন্দর করে গোছানো কিনা! ”

ইনায়া প্রসন্ন চিত্তে বলে উঠলো,

” জানো ভাবি? ভাইয়া না খুব গোছানো স্বভাবের। সবকিছু ফিটফাট চাই তার। তবে একটু এদিক থেকে ওদিক হলেই.. ”

” কি? ”

উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে শুধালো হৃদি। চিন্তা হচ্ছে খুব। লোকটা রেগেমেগে ভূত হয়ে যায় না তো?

” আরে ভয় পেয়ো না ভাবী। ভাইয়া আমার রাগী হলেও জাতে ভালো। কেয়ারিং আছে। ”

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো হৃদি। যাক বাবা বাঁচা গেল। সে তো আর গোছানো স্বভাবের নয়। বড্ড অগোছালো। রুমের অবস্থা তো অ্যামাজন জঙ্গল ফেইল। হাহ্! কি যে হতে চলেছে এবার? গোছানো মানবের ভাগ্যে কিনা অগোছালো রমণী! মন্দ নহে। মালিহার স্পর্শে ভাবনায় ছেদ পড়লো। শাশুড়ি মা ওর হাতটি ধরে বিছানায় বসিয়ে দিলেন।

” অনেক কথা হলো। এবার বস তো মা। খাবারটা খেয়ে নে। সে-ই কোন বেলায় খেয়েছিস। নে নে খেয়ে নে। ”

খাবার! একদম সঠিক সময়ে আগমন হয়েছে। খিদের জ্বালায় পেটে তো পাখপাখালির দল কানামাছি খেলা শুরু করে দিচ্ছিল।

” মা। খাচ্ছি খাচ্ছি। এত ব্যতিব্যস্ত হতে হবে না। আগে বলো তোমরা খেয়েছো? ”

পুত্রবধূর প্রশ্নে খুশি হলেন উনি। সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বললেন,

” হাঁ রে মা। আমরা খেয়েছি। এবার তুইও খেয়ে নে। ”

হৃদি মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে যেই না প্লেট হাতে নিতে উদ্যত হলো ওমনি,

” দাঁড়া। তোকে কষ্ট করে খেতে হবে না। এমনিতেই ক্লান্ত শরীর। আজ বরং আমি ই খাইয়ে দিচ্ছি। হা কর তো। ”

প্রত্যাশিত আচরণে মেয়েটি বেশ খুশি হলো। যা পরিলক্ষিত হচ্ছে মায়াবী চেহেরায়। মালিহা যত্ন সহকারে কন্যাসম পুত্রবধূকে নিজ হাতে খাইয়ে দিলেন। ইনায়া মায়ের পাশেই বসে ছিল। দুষ্টু হেসে বললো,

” বাহ্! বাড়িতে তাহলে আমার নতুন প্রতিদ্বন্দ্বি চলেই এলো? ”

মালিহা হেসে মেয়ের বাহুতে চাপর মে রে দিলেন। খাবার মুখে হাসলো হৃদি নিজেও। খুনসুটিতে অতিবাহিত হলো ভোজন পর্ব। মালিহা এঁটো প্লেট হাতে উঠে দাঁড়ালেন। কোমল স্বরে পুত্রবধূকে বললেন,

” তাহলে মা তুই থাক। আমরা আসছি। কেমন? গুড নাইট। ”

” গুড নাইট। ” মুচকি হেসে বললো হৃদি।

ইনায়া ভাবীর সঙ্গে দুষ্টুমি করে বললো,

” ভাবীজান। তাহলে মিষ্টি মধুর অপেক্ষায় থাকো। তোমার বরকে এখনই পাঠিয়ে দিচ্ছি। ঠিক আছে? ”

বর! তার আগমনী সংবাদে না চাইতেও উৎকণ্ঠিত হলো কোমল হৃদয়। শুকনো ঢোক গিললো মেয়েটি। ইনায়া চোখ টিপে দ্রুত পায়ে মায়ের পিছুপিছু কক্ষ ত্যাগ করলো। একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো মেয়েটি। ভাবনায় তলিয়ে গেল এক লহমায়।
.

করিডোর ধরে হেঁটে যাচ্ছে ইরহাম। মৌমাছির ন্যায় দু পাশে ভনভন করছে তাঈফ এবং রাহিদ। অভিজ্ঞ ব্যক্তির ন্যায় উপদেশ দিয়ে চলেছে তাঈফ,

” বন্ধু। অলরেডি তিনের কোঠা পাড় করে বিয়া করছো। আর দেরি কইরো না। প্রথম রাতেই বিড়াল মাইরা ভূত বানাইবা। ঠিক আছে? ”

মামাতো ভাই রাহিদ বললো,

” ভাইয়া এত সুন্দর বউ পেয়েছো। এখন একটু ভাবস্ দেখানো ছাড়ো। সুন্দরী বউ। আদরে সোহাগে ভরিয়ে রাখো। বুঝলে? ”

তাঈফ অসন্তুষ্ট কণ্ঠে বললো,

” ব্যা টা এখন তো একটু রোমান্টিক হ। নইলে দেখা যাইবো নতুন বউ দুইদিন পর নারী অধিকার কমিশনে অভিযোগ করছে। ”

” কিংবা নতুন বউপাখি ফুরুৎ। উড় গাড়া। ”

দু হাতে উড়ে যাওয়ার ভঙ্গিমা করে দেখালো রাহিদ। এ দেখে খ্যাক খ্যাক হাসলো তাঈফ। শেষোক্ত এই কথাটা বেশ গায়ে লাগলো। তাই তো ওদের মুখের ওপর বাসরঘরের দরজা বদ্ধ করে দিলো নতুন বর‌। দু’জনেই হতবাক-হতবিহ্বল! পরক্ষণে সশব্দে হেসে উঠলো। হাই ফাইভ করলো দু’জনে।
.

বিছানার ধারে চিন্তামগ্ন ছিল নববধূ। আকস্মিক দরজা বন্ধ করার জোরালো শব্দে হকচকিয়ে উঠলো। ভীত স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো,

” কে কে? চো..র! ”

” শাট আপ! ” ধমকে উঠলো ইরহাম।

পুরুষালি ভারিক্কি কণ্ঠস্বরে বড়সড় ধমক! তা-ও বিয়ের প্রথম রাতে। মুখ ফুলিয়ে তাকালো হৃদি। সেসবে ধ্যান না দিয়ে ইরহাম লক্ষ্য করলো বিছানার ওপর ভেজা তোয়ালে। ব্যাস। শুরু হলো নৈশকালীন লেকচার।

” এসব কি হাঁ? ”

বুঝতে না পেরে মেয়েটি শুধালো,

” ক্ কি? ”

” বুঝতে পারছো না? তোয়ালে কোথায় রাখতে হয় জানা নেই? ”

” আ ছে তো। ”

” তাহলে? যাও। জায়গামতো রেখে আসো। ”

মেজাজ খারাপ হলো রমণীর। বিয়ের প্রথম রাতেই এমন মেজাজ দেখানো! অথচ বিয়ের আগে তো ভিন্ন কিছু বলেছিলেন। অহেতুক আদেশ গায়ে সইলো না। তবুও কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করে মেয়েটা ভেজা তোয়ালে হাতে নিলো। অগ্রসর হলো বেলকনির পানে। সেথায় ভালোমতো মেলে দিলো ভেজা তোয়ালে। অতঃপর কক্ষে ফিরে এলো। ততক্ষণে ইরহাম ওয়াশরুমে। সেদিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকালো মেয়েটা। কোনোমতে শাড়ি সামলিয়ে হাঁটি হাঁটি পায়ে বিছানার কাছে গেল। শুয়ে পড়লো বিছানায়। ডান পার্শ্বে। আরামের সহিত। কিয়ৎক্ষণ বাদে ওয়াশরুম হতে বেরিয়ে এলো ইরহাম। পড়নে শুভ্র রঙা টি শার্ট এবং কৃষ্ণবর্ণ ট্রাউজার। স্বল্প সিক্ত কেশে হাত বুলাতে বুলাতে ধীরপায়ে সুইচবোর্ডের কাছে গেল। নিভিয়ে দিলো কক্ষের আলো। শুধুমাত্র ডিম লাইটের আলো ছড়িয়ে কক্ষে। মানুষটি বিছানার ধারে চলে এলো। শয্যা গ্রহণ করলো হালাল সঙ্গিনীর বাম পার্শ্বে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো ডান পাশে। ড্রিম লাইটের আলোয় লক্ষ্য করলো স্বল্প দূরত্বে নববধূ তার। ক্লান্তির দরুণ নিদ্রায় তলিয়ে। কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে রইল ঘুমন্ত কন্যার পানে। অতঃপর দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। ওষ্ঠাধর গোলাকার করে তপ্ত শ্বাস ফেললো। বুঁজে গেল আঁখি পল্লব। ঘুমানোর দোয়া এবং আয়াতুল কুরসি পাঠ করে আস্তে ধীরে নিদ্রায় মগ্ন হলো।

দিবাবসুর দীপ্তিতে উজ্জ্বল বসুধা। গভীর নিদ্রায় তলিয়ে মেয়েটি। সূর্য মামার কিরণ উপেক্ষা করে ঘুমিয়ে চলেছে অবিরাম। আকস্মিক…

চলবে.

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে