#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_২২
রৌদ্রোজ্জ্বল তপ্ত এক দিন। নির্বাচনের শেষ মুহূর্তের প্রচারণায় ব্যস্ত মনোনীত প্রার্থীবৃন্দ। ভোট চাইতে উপস্থিত হচ্ছেন দ্বারে দ্বারে। প্রশস্ত এক সড়ক। রাস্তার দু ধারে সারি সারি পোস্টার। মাথার উপরিভাগেও শোভা পাচ্ছে পোস্টারের রকমারি সমারোহ। এই সড়কে যানবাহন চলাচল আপাতত বন্ধ। দলীয় নেতা-কর্মীদের পথপ্রদর্শক রূপে সড়কে হেঁটে চলেছে ইরহাম। জনগণের সঙ্গে কুশল বিনিময়, লিফলেট বিতরণ ইত্যাদি চলমান। রাস্তার আনাচে কানাচে চৌধুরীর জয়গান। দলের কর্মীরা উচ্চস্বরে তাদের মনোনীত প্রার্থীর প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। দোকানে দোকানে লোকজন দাঁড়িয়ে দেখছে এ দৃশ্য। কিছু কিছু বাসার বেলকনি, জানালা কিংবা ছাদও বাদ নেই। আগ্রহ সহকারে প্রচার অভিযান দেখছে মানুষজন। শুভ্র রঙা পাঞ্জাবি পরিহিত সুঠামদেহী মানুষটি কুশলাদি বিনিময় করছে সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে। মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত কোনো শ্রেণী ভেদাভেদ নয়। কম-বেশি অনেকেই ঠাঁই পেল তার সুঠাম বক্ষপটে। হাসিমুখে সরলতার সহিত মিশে যাচ্ছে মানুষটি। করমর্দন করছে কারো কারো সঙ্গে। সহসা তাদের প্রচারণায় ছেদ পড়লো। উপস্থিত সকলের দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো সড়কের বিপরীত পথে। সে পথ ধরে এগিয়ে আসছে আজগর সাহেব এবং তার দলবল। তারাও প্রচার অভিযানে লিপ্ত। শুভ্র রঙা শার্ট পরিহিত আজগর সাহেব ডান হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে এক জনদরদী নেতার ন্যায় জনগণের দৃষ্টি আকৃষ্ট করছেন। ওনার দলবল অনবরত তাদের নেতাজীর জয়গান গেয়ে চলেছে। তাদের প্রতি আকৃষ্ট করছে জনগণকে। পথ চলতে চলতে একসময় মুখোমুখি চৌধুরী এবং আজগর। নয়নে নয়ন স্থির হলো দু’জনার। চোখের ভাষায় কা’ঠিন্যতা। যেন চক্ষু জোড়ার দ্র’ঢ়িমায় চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন আজগর সাহেব। নৈঃশব্দ্য লড়াইয়ের দা’মামা বেজে উঠল। এ লড়াইয়ের সূত্রপাত আজ হতে নয়। নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমা দেবার পর হতেই আরম্ভ হয়েছে। আজো চলমান তা। এ শব্দহীন লড়াইয়ের অন্ত কোথায়? জানা নেই।
বীরদর্পে গৌরবের সহিত মাথা উঁচু রেখে আজগর সাহেবের পানে অগ্রসর হলো ইরহাম। ওনার চোখেমুখে অবাকতার রেশ! কি করতে চাইছে এই চৌধুরী? ওনাকে চরম আশ্চর্যান্বিত করলো ইরহাম! মুচকি হেসে উষ্ণ আলিঙ্গন করলো প্রবীণ এ তুখোড় রাজনীতিবিদ -কে। উনিও পরিস্থিতি অনুধাবন করে মেকি হেসে ওকে আগলে নিলেন। উষ্ণ আলিঙ্গনে আবদ্ধ তারা দু’জন। তবে ভেতরে বিরাজমান ঠাণ্ডা লড়াই। এক অদ্ভুত শীতলতা! ইরহামের কর্ণে অধর ঠেকিয়ে আজগর সাহেব মধুরতম বি-ষাক্ত কণ্ঠে বললেন,
” এখনো সময় আছে চৌধুরী। পিছিয়ে এসো। ”
মুচকি হেসে ইরহাম রসিকতার স্বরে জবাব দিলো,
” ক্ষমা করবেন নেতা সাহেব। পিছপা হওয়া যে এই চৌধুরীর ডিকশনারিতে নেই। থাকলে আমি হয়তো.. পিছপা হতাম। আফটার অল আমার জন্য বুড়ো এক ব্যক্তির বিপি হাই হয়ে যাচ্ছে। যাই যাই অবস্থা। কি করে সহ্য করতাম বলুন? ”
ভেতরকার ক্রো ধ দমন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আজগর সাহেব। ইরহাম মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে আলিঙ্গন মুক্ত হলো। চোখের ভাষায় ক্রো ধে র একাংশ প্রকাশ করলেন আজগর সাহেব। তা দেখে বিন্দুমাত্র দমে গেল না মানুষটি। বরং করে বসলো আরেক অপ্রত্যাশিত আচরণ! ইরহাম সকলের উদ্দেশ্যে মধুর হাসি উপহার দিলো। উঁচু স্বরে জনগণের মাঝে করে বসলো অভাবনীয় আচরণ!
” নেতাজী! নেতাজী! ”
দু হাত দুই দিকে বাড়িয়ে ওপর নিচ করতে লাগলো। সাথে উঁচু স্বরে আজগর সাহেবের পক্ষে প্রচার বাণী উচ্চারণ করলো ইরহাম। দৃষ্টি আকর্ষণ করে জনগণের মাঝে আজগর সাহেবের পক্ষে বিনামূল্যে প্রচারণা চালিয়ে দিলো। অনবদ্য এক স্টাইল! শৌর্য প্রকাশ পাচ্ছিল মানুষটির ব্যক্তিত্বে। চোখেমুখে উজ্জ্বলতা। অবাক নেত্রে তাকিয়ে উপস্থিত সকলে। দলীয় নেতা-কর্মী, জনগণ সকলেই অবাক! ইরহামের ইশারায় এবার উপস্থিত সকলেই ‘ নেতাজী ‘ স্লোগানে মুখরিত হলো। ইরহামের দলীয় কর্মীরা এহেন কাণ্ডে বিদ্রুপের আভাস পেল বুঝি! তারা বিদ্রুপের স্বরে নেতাজীর নামে স্লোগান গাইতে লাগলো। এতে আগুন জ্বলে উঠলো আজগর সাহেবের অন্তরে। ক্ষ্যা পা ষাঁড়ের ন্যায় ফুঁসছেন উনি। এত লোকজনের মাঝে মুখ বুজে সহ্য করতে বাধ্য। অন্যথায়..! হাসি হাসি মুখে দু হাত নামিয়ে আজগর সাহেবের দিকে তাকালো ইরহাম। শক্ত হলো ক্ষি প্ত আজগর সাহেবের চোয়াল। দু’দিনের এই নিব্বা’কে ছাড়বেন না উনি! ইরহামও যেন চোখের ভাষায় বুঝিয়ে দিলো এ নিব্বা’কে এত হেয় করে দেখবেন না নেতা সাহেব! এখনো আমায় চিনতে অনেক বাকি!
.
সান্ধ্যকালীন প্রহর। চিন্তিত বদনে লিভিংরুমে উপস্থিত হলো হৃদি। সোফায় বসে থাকা মালিহার কাছে এসে বললো,
” মা! সন্ধ্যা হয়ে এলো। ইনু তো এখনো এলো না। ওর এত দেরী হচ্ছে কেন? ফোনটাও সুইচড্ অফ বলছে। ”
মালিহা তখন মোবাইল হাতে মেয়েকে কল করার বৃথা চেষ্টা করছিলেন। পুত্রবধূর কথা শুনে ওর দিকে তাকালেন। উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে বললেন,
” আমার খুব চিন্তা হচ্ছে রে মা। দিনকাল তো ভালো না। মেয়েটা কেন যে এত দেরী করছে! ও তোকে কিছু বলে গিয়েছিল? ”
মায়ের পাশে বসলো হৃদি। নেতিবাচক জবাবে বললো,
” না মা। রোজকার স্ক্যাজিউল ই তো। বিশেষ কিছু তো বলেনি। ”
মাতৃহৃদয় অজানা ভয়ে শিউরে উঠছে। স্বেদজল উপস্থিত মুখশ্রীতে। ক্রমবর্ধমান হারে স্পন্দিত হচ্ছে হৃদযন্ত্র। মায়ের পরিস্থিতি অনুধাবন করতে পারছে মেয়েটি। হৃদি সোফা ছেড়ে উঠে পড়লো। মোবাইল হাতে দাঁড়ালো কিঞ্চিৎ দূরত্বে। দ্বিধাগ্রস্ত ভঙ্গিতে কল করলো স্বামীর নম্বরে। রিং হচ্ছে। ধরছে না মানুষটি। দ্বিতীয়বার কল করলো হৃদি। রিং হয়ে এবারো কেটে গেল। দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল মেয়েটি। নির্বাচন আর মাত্র ক’দিন পর। স্বাভাবিকভাবেই ব্যস্ত মানুষটি। এই গুরুত্বপূর্ণ কলটি কি আদৌ রিসিভ করবে! আর ইনু? কোথায় রয়েছে মেয়েটি? এখনো ফিরছে না কেন? কোনো বিপদাপদ! না না। এ কি ভাবছে সে? আল্লাহ্ সহায় আছেন। ইনশাআল্লাহ্ সহি সালামতে ফিরে আসবে ইনায়া।
.
মৃদু আঁধারে তলিয়ে বসুন্ধরা। গণসংযোগে ব্যস্ত ইরহাম। দলীয় কর্মীরা পুরোদমে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। নিশ্চিত করতে চাইছে তাদের মনোনীত প্রার্থীর বিজয়। সকলের ভীড় ঠেলে একটু নিরালায় এলো ক্লান্ত ইরহাম। ক্লান্তি দূরীকরণ করতে মাঝারি আকৃতির এক চায়ের দোকানে এলো। বসলো কাঠের বেঞ্চে। দোকানদার ওকে দেখে খুশিতে গদগদ হয়ে উঠলেন। চৌধুরী তার দোকানে! এ যে ওনার বড় সৌভাগ্য! খুশিমনে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে দোকানদার বলতে লাগলেন কত কি। ইরহাম মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে কুশল বিনিময় করলো। এক বোতল পানি চাইলো। দোকানদার দ্রুততার সহিত বোতল এগিয়ে দিলেন। ইরহাম মুচকি হেসে শুকরিয়া আদায় করলো। বোতল হতে পানি পান করছে এবং হাতে মোবাইল। মোবাইল স্ক্রল করতে গিয়ে চমকালো! থ্রি মিসড্ কল ফ্রম হৃদি! আবার মেসেজও রয়েছে। সাইলেন্ট মোডে থাকায় টেরই পায়নি। ইরহাম চিন্তিত হয়ে মেসেজ ওপেন করলো। পড়তে লাগলো খুদেবার্তাটি,
‘ ইনু এখনো বাড়ি ফেরেনি ইরহাম। মা খুব চিন্তা করছে। আপনি একটু কাউকে দিয়ে খোঁজ নেবেন? বুঝে উঠতে পারছি না কি করবো। আমি কি একবার গিয়ে দেখবো?’
পানির বোতল পাশে রেখে মোবাইলের কন্টাক্ট লিস্টে গেল ইরহাম। খুঁজে পেল কাঙ্ক্ষিত নম্বর ‘ রাহিদ ‘. নম্বরে কল করলো সে। রিং হচ্ছে। অপেক্ষা রিসিভ হবার।
.
আঁধারে নিমজ্জিত সরু গলি। দু পাশে দালানের সারি। সে সরু গলিতে চিন্তিত ইনায়া যথাসম্ভব দ্রুত পায়ে হেঁটে চলেছে। পড়নে তার কলেজের পোশাক। কাঁধে ব্যাগ। পাশে হাঁটছে এক যুবক। যুবকটি কথা বলে চলেছে ওর সঙ্গে। ইনায়া বাধ্য হয়ে টুকটাক জবাব দিচ্ছে। ওর মনে বিরাজমান চিন্তার পাহাড়। হাতঘড়িতে সময় দেখলো মেয়েটি। ঘড়ির কাঁটা আটের কাছাকাছি। ওহ্ শিট! ইনায়া হাঁটার গতি আরো বাড়িয়ে দিলো। তা লক্ষ্য করে যুবকটি বললো,
” হেই আস্তে হাঁটো। পড়ে যাবে তো। ”
বলতে না বলতেই পড়ে যাচ্ছিল ইনায়া। যুবকটি সহায়তার উদ্দেশ্যে ওকে ধরার আগেই নিজেকে সামলাতে সক্ষম হলো ইনায়া। যুবকটি উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে বললো,
” বি কেয়ারফুল। পড়ে যাচ্ছিলে। ”
” আমি ঠিক আছি ভাইয়া। ” আমতা আমতা করে বললো ইনায়া।
আকস্মিক দু’জনেই চমকালো! দ্রুত গতিসম্পন্ন একটি বাইক ঠিক তাদের সম্মুখে এসে থামলো। যুবকটি রাগান্বিত স্বরে বাইক আরোহীকে বললো,
” অন্ধ নাকি? আরেকটু হলেই তো মেয়েটার গায়ে উঠিয়ে দিচ্ছিলেন! ”
বাইক আরোহী শ্লথ গতিতে হেলমেটের কাঁচ নামালো। চেহারা চিনতে পেরে আঁতকে উঠলো ইনায়া। অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,
” রা হি ভাইয়া! ”
লালচে বর্ণ ধারণ করেছে রাহিদের দু চোখের সফেদ অংশ। শুকনো ঢোক গিললো মেয়েটি। ইনায়ার সঙ্গে থাকা যুবকটি জবাব না পেয়ে পুনরায় বলে উঠলো,
” কিছু বলছেন না কেন? বোবা নাকি? ”
এবার মুখ খুললো রাহিদ। অতি গম্ভীর স্বরে বলল,
” কাজিন হই ওর। নিতে এসেছি। ”
যুবকটি অবাক নেত্রে ইনায়ার দিকে তাকালো! ওকে শুধালো,
” সত্যি তোমার কাজিন? ”
অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে মেয়েটি। ইতিবাচক মাথা নাড়ল। স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল যুবক। বললো,
” ওহ্ ভালোই হলো। তাহলে তুমি যাও। আমি আসছি। ”
রাহিদের দিকে তাকিয়ে মেকি হেসে,
” স্যরি ভাই চিনতে পারিনি। ডোন্ট মাইন্ড। ওকে? ”
হাসিমুখে বিদায় জানিয়ে পুনরায় গলির মাঝে হারিয়ে গেল যুবকটি। রাহিদ থমথমে মুখে বসে। ভীতসন্ত্রস্ত ইনায়া আরো জড়োসড়ো হয়ে গেল। ভয়ে লাব ডাব করছে হৃৎপিণ্ড। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে মুখে।
” বস। ”
ভারিক্কি কণ্ঠস্বরে আঁতকে উঠলো ইনায়া। মানুষটির রাগ দমন করতে কৈফিয়ত দিতে লাগলো,
” আমি আমি আসলে ইচ্ছে করে ক রি নি। বিশ্বাস করো। আমি বাধ্য হয়ে.. ”
রাহিদ গমগমে স্বরে বললো,
” বসতে বলেছি। ”
কিশোরী কন্যার নেত্রকোণে জমায়িত হলো অশ্রু বিন্দু। ভেজা কণ্ঠে বললো,
” ভাইয়া ভুল বুঝছো আমাকে। আমি জবা’র.. ”
” শাট আপ! ”
বজ্রকণ্ঠে ধমকে উঠলো রাহিদ। আতঙ্কিত ইনায়া পিছপা হলো কয়েক কদম। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আঁকড়ে ধরলো পোশাকের একাংশ। কপোল ছুঁয়ে গড়িয়ে পড়লো দু ফোঁটা অশ্রু। রাহিদ ওর পানে তাকালো। আদেশের স্বরে বললো,
” চুপচাপ উঠে বস। আর একটা কথা বললে থা প ড়ে গাল ফা’টিয়ে দেবো। ”
এ বলে সম্মুখে তাকালো রাহিদ। আবেগতাড়িত ইনায়া গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এলো। ভয়ে কম্পমান তনুমন। ধীরজ ভঙ্গিতে বাইকের পেছনাংশে বসলো মেয়েটা। দু’জনের মধ্যে ব্যাগ। ডান হাতে ব্যাগ আঁকড়ে ধরে বাম হাতে ধরলো বাইকের পেছনের অংশ। ইনায়া ঠিকঠাক ভাবে বসেছে উপলব্ধি করে বাইক চালু করলো রাহিদ। রাগে আর’ক্ত তার মুখখানা। পেছনে বসে থাকা মেয়েটির চোখে ভরপুর নোনাজল। অন্তরে দহন।
.
‘ আনন্দাঙ্গন ‘ এ ইনায়ার হাত ধরে টানতে টানতে প্রবেশ করলো রাহিদ। যেন কোনো পশুরহাট হতে পশু ক্রয় করে নিয়ে এসেছে। এমনই অমানবিক লাগছে দৃশ্যটি। ইনায়ার দু চোখে জল। আবেগপ্রবণ মেয়েটি নিজেকে ছাড়ানোর ব্যর্থ প্রয়াস অবধি করছে না। যেমনভাবে টেনে আনছে, চলে আসছে। কোনো অসম্মতি নেই।
” ফুপি! এই নাও তোমার মেয়ে। ”
মৃদু ধাক্কায় ইনায়াকে সম্মুখে দাঁড় করালো রাহিদ। মালিহা, হৃদি এবং রাজেদা খানম চিন্তিত বদনে সোফায় বসে ছিলেন। ওনারা স্তব্ধ হলেন রাহিদের আচরণে! উঠে দাঁড়ালেন ত্বরিত। মালিহা আবেগী হয়ে পড়লেন কন্যাকে সুস্থ সবল দেখে।
” ইনু! ”
এগিয়ে এসে মেয়েকে আলিঙ্গন করে আবেগতাড়িত হয়ে পড়লেন মালিহা। মা মেয়ে দু’জনের চোখেই নোনাজল। ভিন্ন ভিন্ন কারণে। হৃদি স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল ননদকে দেখে। চক্ষু বুজে শুকরিয়া আদায় করলো মহান রবের। রাজেদা খানম সোফা ধরে উঠে দাঁড়ালেন। উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে বললেন,
” দাদুভাই এতক্ষণ কই আছিলা? আমগো চিন্তা হইতাছিল তো। ”
ইনায়া কিছু বলতে পারলো না। অবনত মস্তকে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে চলেছে। রাহিদ ফুপির দিকে তাকিয়ে বললো,
” ফুপি আমার দায়িত্ব শেষ। আমি আসছি। মেয়েকে একটু বুঝদার হতে বলো। দিনকাল তো বেশি ভালো না! আসছি। আসসালামু আলাইকুম। ”
মালিহাকে কিছু বলবার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত পায়ে বিদায় নিলো রাহিদ। ওর গমন পথে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে ইনায়া। অন্তর্দাহ বৃদ্ধি পেল বুঝি!
.
বিছানায় মুখোমুখি বসে হৃদি, ইনায়া। ইনায়ার পাশে বসে মমতাময়ী মা। নৈশভোজ সেরে এখানে হাজির হয়েছে তারা। ইনায়ার ঘর এটি। হৃদি ননদকে শুধালো,
” ননদিনী এবার বলো তো কি হয়েছিল? এত দেরী হলো কেন? ”
অনুতাপে দৃষ্টি নত মেয়েটির। মৃদু স্বরে বলতে লাগলো,
” কোচিং শেষ হয়েছিল বিকালে। আমরা কোচিং থেকে বের হয়েছি ঠিক সেসময় জবা অসুস্থ হয়ে পড়লো। জবা আমার ফ্রেন্ড। ও সারাদিনে ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করেনি। প্রেশার ফল করেছে। তাই অচেতন হবার দশা। ওকে ধরাধরি করে আমরা একটা রেস্টুরেন্টে গেলাম। টুকটাক খাইয়ে দিলাম ওকে। এবার বাড়ি যাওয়ার পালা। ও খুব দুর্বল ছিল। একা যেতে পারতো না। তাই ওর বাড়িতে কল করি। কিন্তু কেউ ফোন তুলছিল না। বাধ্য হয়ে আমি আর সুমা জবা’র সাথে যাই। ওকে বাড়িতে পৌঁছে দেই। জবার আম্মু প্রতিবেশীদের বাসায় ছিল। তাই মোবাইলের রিংটোন টের পায়নি। আমরা গেলে উনি খবর পেয়ে ছুটে এলেন। জবার ভাইয়াও এলো বাইরে থেকে। ওকে বকলো এমন অযত্ন করার জন্য। সুমার বাসা জবা’র বাসার কাছেই। ও একাই চলে গেল। কিন্তু আন্টি আমাকে একা ছাড়লেন না। সাথে জবার ভাইয়াও এলেন। আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেয়ার জন্য। তখনই রাস্তায় রাহি ভাইয়ার সঙ্গে দেখা। ”
মালিহা স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে বললেন,
” সবই বুঝলাম মা। তুই বান্ধবীকে হেল্প করতে গিয়েছিলি। তাই বলে আমাদের একবার ফোন করে জানাবি না? আমরা কতটা চিন্তা করছিলাম জানিস? শেষে ইরু ফোন করে রাহিকে পাঠালো। ছেলেটা তোর খোঁজে কলেজ গেল। সেখানে কোনো খবর না পেয়ে কোচিংয়ে গেল। ওখানকার দারোয়ানের কাছে জানতে পারলো তুই নাকি জবার সাথে গিয়েছিস। এরপর কোনোমতে জবার অ্যাড্রেস বের করে তোর খোঁজে গেল। এমনটা কেউ করে মা? ”
ইনায়া অনুতপ্ত স্বরে বললো,
” স্যরি আম্মু। আমার মোবাইলের ব্যাটারি ডেড ছিল। বুঝতে পারিনি এতটা দেরী হয়ে যাবে। বুঝলে… ”
হৃদি কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল। কক্ষে প্রবেশ করেছে ইরহাম। মানুষটা মাত্র ফিরেছে বাহির হতে। এখনো বাহিরের পোশাক পড়নে। ইরহাম এগিয়ে এলো বোনের কাছে। বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে স্নেহশীল কণ্ঠে বললো,
” আর কখনো এমনটা করিস না বোন। পরোপকার নিঃসন্দেহে মহৎ গুণ। তাই বলে বাড়ির সবাইকে চিন্তায় ফেলতে হবে এমনটা না। কোথাও গেলে অন্তত বাড়িতে ইনফর্ম করে নিবি। ঠিক আছে? ”
ইতিবাচক মাথা নাড়ল ইনায়া। মানুষটি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে হাতটি সরিয়ে নিলো। মা ও সহধর্মিণীর উদ্দেশ্যে বললো,
” ওকে আর প্রেশারাইজ্ড করো না। যা হওয়ার হয়ে গেছে। ”
হৃদি সম্মতি জানিয়ে মা’কে বললো,
” হাঁ মা। আর দুশ্চিন্তা করো না। শরীর খারাপ করবে। ইনু সেফলি ফিরে এসেছে তো। ”
মালিহা আবেগী চাহনিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। বড় ভয় পেয়েছিলেন উনি। স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লেন অবশেষে। ইনায়াকে একাকী ছেড়ে কক্ষ ত্যাগ করলো ওরা তিনজন। একাকী কক্ষে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লো কিশোরী মেয়েটি। অশ্রু জমলো অক্ষিকোলে। রাহি ভাইয়া ভুল বুঝেছে খুব! ওর কথাটি অবধি শুনলো না। এতটা রেগে সে!
চলবে.