#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_১৪
” হাতটা ধরো মেয়ে। ওঠো। নিজেকে বাঁচাও। ওঠো। ”
সম্মোহনী এক স্বর তাকে উদ্দীপ্ত করে চলেছে। ধূলোর মাঝে দেখা মিলছে এক পুরুষালি অবয়বের। তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে চলেছে। এত তারকার ভীড়ে একজন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে। হৃদি বড় উদগ্রীব হয়ে উঠলো। দেখতে চাইছে সে মানবের মুখখানা। তাই তো ডান হাতটি পুরুষালি হাতের পানে বাড়িয়ে দিয়েও উঠছে না। ধূলোয় ঝাপসা অক্ষি জোড়া ছটফট করছে সে মানবকে দেখার জন্য। মেয়েটি ব্যর্থ হয়ে বাঁ হাতে চোখ কচলাতে লাগলো। বারকয়েক তা করার পর অবশেষে হলো সফল। চক্ষুতারায় দৃশ্যমান হলো সাহায্যকারী মানবের মুখখানা।
” ই র হা ম! ”
আচমকা শিউরে উঠলো ঘুমন্ত কন্যা। ঘুমের ঘোরে ছটফট করতে লাগলো। এ কি দেখলো সে! এ স্বপ্নের প্রকৃত অর্থ কি! জানা নেই। ঘুমের ঘোরে ছটফট করে আস্তে ধীরে পুনরায় নিদ্রায় তলিয়ে গেল। তখনই ঘুমন্ত কন্যার ডান পার্শ্বে এসে দাঁড়ালো ইরহাম। সদ্য বাহির হতে আগমন ঘটেছে তার। এসেই এমন দৃশ্য অবলোকন করলো। খারাপ লাগলো সহধর্মিণীকে এলোমেলো রূপে ঘুমোতে দেখে। তাই তো নিজে সতেজতায় গা ভাসিয়ে বিনা অর্ধাঙ্গীতে মনোনিবেশ করলো। আস্তে করে ওর বক্ষস্থল হতে বইটি সরিয়ে নিলো। রাখলো বালিশের পাশে। অগোছালো ওড়না শালীনতার সহিত দেহের উপরিভাগে জড়িয়ে দিলো। অতঃপর পা বাড়ালো কাবার্ডের ধারে। পরিধেয় পোশাক নিয়ে অগ্রসর হলো ওয়াশরুমের দিকে।
.
তমসায় আচ্ছাদিত ভূলোক। ঘড়ির কাঁটা তখন বারোর কাছাকাছি। দরকারি কর্ম সম্পাদন করে বিছানার ধারে এলো ইরহাম। শয্যা গ্রহণ করলো হালাল সঙ্গিনীর বাঁ পাশে। নরম বালিশে মাথা এলিয়ে দিতেই ক্লান্তি দূরীকরণ হলো। ভাবনায় উদিত হলো আজকের সমাবেশ। তরুণ প্রজন্মের জন্য সমাবেশটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ, অনুপ্রেরণাদায়ী ছিল। সঠিক পথনির্দেশিকার অভাবে আজকালকার তরুণ সমাজ বিপথগামী। ন্যায় অন্যায়ের পার্থক্য ভুলে যাচ্ছে তারা। যুক্ত হচ্ছে অ-পরাধ জগতে। তাদের জন্য অনবরত সঠিক পথনির্দেশিকার প্রয়োজন। প্রয়োজন তাদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটানো। এতে দেশ ও দশের মঙ্গল। একদিন এরাই হবে দেশের সুযোগ্য কা”ণ্ডারী। দেশনায়ক! দেশমাতৃকার ভাবনা শেষে মানুষটির দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো ডানে।
ইরহামের দিকে কাত হয়ে ঘুমিয়ে মেয়েটি। একদম শান্ত, স্থির। স্নিগ্ধতায় মোড়ানো। মুখের একাংশ এলোকেশে ঢেকে। স্বল্প ফোলা কপোলদ্বয়। মায়ায় ভরপুর মুখখানি দেখতে দেখতে বিমুগ্ধ হলো নভোনীল আঁখি জোড়া! স্মরণে এলো বিকালের ঘটনা। তখন সমাবেশ শেষে একটুখানি বিশ্রামে লিপ্ত ছিল সে। সে মুহূর্তে বিপ বিপ শব্দে আলোড়ন সৃষ্টি করলো ক্ষুদ্র যন্ত্রটি। পকেট হতে মোবাইল বের করে হাতে নিতেই ঈষৎ চমকালো! হৃদি কলিং! মেয়েটা তো সাধারণত ফোন করে না। তবে আজ! কোনোরূপ অসুবিধা হলো কি? ভাবনা ত্যাগ করে কল রিসিভ করলো সে। এরপর? চঞ্চল মেয়েটি বকবক করলো কতক্ষণ। তাকে অভিনন্দন জানালো। টেলিভিশনের পর্দায় ওর সমাবেশটি দেখেছে নাকি। বেশ ভালো লেগেছে। তাই কতক্ষণ প্রশংসা করলো। টুকটাক এলোমেলো উপদেশ প্রদান করলো। যেন সে এক অভিজ্ঞ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ত্ব! হাহ্! বিকেলের ভাবনা ভেবে মুচকি হাসলো ইরহাম। ইশ্! হৃদি যদি জাগ্রত থাকতো তবে কেমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতো এ মুহূর্তে! উৎফুল্ল চিত্তে বকবক করতো নাকি বিহ্বল হয়ে বাকরুদ্ধ হতো! ইরহাম ওর পানে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। দেখতে লাগলো এক জীবন্ত চ্যাটারবক্স। সারাক্ষণ ধরে কলকলিয়ে কথোপকথনে লিপ্ত থাকে মেয়েটা। একটুও বিরাম নেই। কখনো শাশুড়ি মা, কখনো ননদিনী কখনোবা দাদি শাশুড়ি। কারো না কারোর সঙ্গে আলাপণে ব্যস্ত। মুখ ব্যথা হয় না! এত কথা কি করে বলে! বোধগম্য হলো না গম্ভীর মুখো মানবের। সে এ মুহূর্তে জানে শুধু মুগ্ধতার নিঃশব্দ ভাষা। যে মুগ্ধতা চক্ষু ছাড়িয়ে রন্ধ্রে রন্ধ্রে পৌঁছে যায়। শিহরণ জাগায় তনু ও মনে।
•
সান্ধ্যকালীন প্রহর। ‘ আনন্দাঙ্গন ‘ এর লিভিং রুমে সোফায় বসে এজাজ সাহেব। হাতে টেলিভিশনের রিমোট। দৃষ্টি নিবদ্ধ সম্মুখে অবস্থিত স্মার্ট টিভিতে। বিজনেস নিউজ দেখছেন। মালিহা এলেন সেথায়।
” এই যে তোমার চা। ”
চায়ের কাপ তুলে দিলেন স্বামীর পানে। এজাজ সাহেব একপলক ওনার দিকে তাকিয়ে কাপ হাতে নিলেন। চুমুক বসালেন কাপে। মালিহা কর্ম ব্যস্ততা থাকায় দাঁড়ালেন না। প্রস্থান করলেন সেথা হতে। এজাজ সাহেব কাপে দ্বিতীয় চুমুক বসালেন। ঠিক তখনই সোফা কাঁপিয়ে বসলো একজন। উনি হকচকিয়ে ডানে তাকালেন। ধমকে উঠলেন,
” অ্যাই মেয়ে এগুলো কেমন বিহেভিয়ার? ঠিক করে বসতে পারো না? ”
হৃদি সেসবে পাত্তা না দিয়ে চট করে ওনার হাত থেকে রিমোট কেড়ে নিলো। বিস্ময়ে অভিভূত এজাজ সাহেব! এতবড় দুঃসাহস! হৃদি চ্যানেল পরিবর্তন করে কাঙ্ক্ষিত চ্যানেলে পৌঁছে গেল। জনপ্রিয় কার্টুন সিরিজ ‘ চার্লি চ্যাপলিন ‘ হচ্ছে। বাকশূন্য কার্টুন। উনি দাঁত চিবিয়ে বললেন,
” রিমোটটা ফেরত দাও। দাও বলছি। ”
হৃদি মেকি বিরক্তি প্রকাশ করে বললো, ” উফ্ পাপা! চার্লি দেখছি। মনোযোগ নষ্ট করো না তো। ”
” আমি বিরক্ত করছি? ” আশ্চর্যান্বিত উনি!
হৃদি ওনার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি উপহার দিলো। মৃদু স্বরে বললো,
” নাহ্! বাবারা কখনো বিরক্তির কারণ হতে পারে না। ”
সাধারণ এক বাক্য। তাতেই মোহাচ্ছন্ন হলেন এজাজ সাহেব! ওনার চোখেমুখে ফুটে উঠলো তৃপ্তিকর আভা! হৃদি কার্টুন দেখতে দেখতে হাসছে। হাসতে হাসতে ওনার দিকে একপলক তাকিয়ে হৃদি স্মরণ করিয়ে দিলো,
” পাপা চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। খেয়ে নাও। ”
সন্তোষজনক চাহনিতে তাকিয়ে এজাজ সাহেব। আস্তে করে দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন। চায়ের কাপে চুমুক বসিয়ে তাকালেন টেলিভিশনের পর্দায়। চার্লির বোবা কাণ্ড দেখাচ্ছে। তাতে হেসে কুটিকুটি হৃদি। মালিহা এবং ইনায়া স্বল্প দূরত্বে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। বিস্ময় মিশ্রিত তাদের অভিব্যক্তি। ইনায়া মৃদু স্বরে মা’কে শুধালো,
” আম্মু এসব কি হচ্ছে? আব্বু এমন নিশ্চুপ! তবে কি সত্যিই বদলে যাচ্ছে? ”
মালিহা আশাবাদী নয়নে স্বামীর পানে তাকিয়ে। ইতিবাচক মাথা নাড়লেন উনি। ওনার চোখে অশ্রু, ঠোঁটে হাসির রেখা। সত্যিই বদলে যাচ্ছে ওনার স্বামী।
•
দিবাবসুর দীপ্তিতে আলোকিত বসূধা। চারতলা এক দালানের নিম্নে কিশোর কিশোরীদের সমারোহ। দালানটির চিটচিটে রঙ অনেকটাই ম্লান। বহু বছর ধরে নতুন রঙের ছোঁয়া লাগেনি দেখেই বোঝা যাচ্ছে। সে দালান হতে জনে জনে বেরিয়ে আসছে শিক্ষার্থীদের দল। কাঁধে বই ভর্তি এডুকেশনাল ব্যাগ। অন্যদের মতোই ভীড় ঠেলে কোচিং সেন্টার হতে বেরিয়ে এলো ইনায়া। সঙ্গে দু বান্ধবী। রাস্তার ফাঁকা স্থানে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো তারা। এতক্ষণ যেন দমবন্ধকর অবস্থা ছিল।
” উফ্ বাঁচা গেল। সব্বাইকে এক টাইমে ছুটি দেয়। আর আমাদের হয় ম র ণ! বাবা গো! ”
বান্ধবীর কথায় সহমত পোষণ করলো ইনায়া।
” ঠিক বলেছিস রে। ছুটির টাইম একটু এদিক ওদিক হলে ভালো হতো। ”
আরেক বান্ধবী মুখ বাঁকিয়ে বললো,
” আর ভালো! আমাদের ভালো যেন ওনারা কত ভাবেন? ”
এহেন কথায় আপত্তি জানাতে উদ্যত হলো ইনায়া। তখনই ডান পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বান্ধবী হঠাৎ করেই উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়লো। তড়িঘড়ি করে ওদের বিদায় জানালো।
” অ্যাই আজ আমি আসছি রে। ও এসে পড়েছে। বাই বাই। ”
দ্রুত পায়ে রাস্তার ওপারে গেল মেয়েটি। হাজির হলো এক তরুণের মুখোমুখি। দু’জনে মিষ্টি আলাপণে লিপ্ত হলো। ইনায়া এবং সাথে বান্ধবী ঠিক তা লক্ষ্য করলো। ইনায়া বিস্ময় চাপিয়ে রাখতে না পেরে শুধালো,
” ছেলেটা কে রে? ও এভাবে ছুটে গেল কেন? ”
” আরে বুঝলি না? নতুন বফ হয়। ”
” কিহ্! দু সপ্তাহ আগে না ওর ব্রেকআপ হলো? ”
” তাতে কি হয়েছে? নতুন পিস জুটিয়ে ফেলেছে। নর্থ সাউথ এর স্টুডেন্ট। সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। ”
ইনায়া হেসে উঠলো।
” এ তো নি’ব্বা। ”
” তো? ওর জন্য ঠিক আছে। ”
” সে আর বলতে? ” হাসছে ইনায়া।
হঠাৎ ওর বান্ধবী কৌতুহল দমাতে না পেরে ওকে প্রশ্ন করলো,
” হাঁ রে ইনু। একটা সত্যি কথা বলবি? ”
” হাঁ বলার মতো হলে নিশ্চয়ই বলবো। ”
বান্ধবী আচমকা ওর পানে ঝুঁকে গেল। ফিসফিসিয়ে শুধালো,
” তোর লাইফে কেউ আছে নাকি? হুঁ? বফ? ”
অবাক চোখে তাকিয়ে ইনায়া। কি বলবে ভাববার পূর্বেই পাশে এসে দাঁড়ালো গাড়ি। ওর জন্য পাঠানো। ইনায়া দ্রুত বিদায় নিয়ে গাড়িতে বসলো। একপ্রকার পলায়ন করলো যেন। আসলেই কি তাই?
.
আঁধারে তলিয়ে ধরণী। কথোপকথনে লিপ্ত ননদ ভাবী যুগল উপস্থিত হলো লিভিংরুমে। পাশাপাশি বসলো সোফায়। বিপরীত দিকে বসে ছিলেন রাজেদা খানম। উনি মুখে পান পুরে নাতনিকে জিজ্ঞেস করলেন,
” হাঁ রে ছে*মড়ি! তোর ভাই বলে আইজ তাড়াতাড়ি আইবো। তা কই? দেখলাম না তো। ”
ইনায়া কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো,
” সে আমি কি জানি? ভাইয়া যে বিজি পারসন। কোথায় না কোথায় আটকে পড়েছে। ”
দাদি এবার উঁচু কণ্ঠে কিচেনে থাকা পুত্রবধূকে বললেন,
” বৌমা তোমার ইরু কিন্তু আইজকাল মিথ্যা কথা কইতে হিগছে। এইডা কিন্তু ভালা লক্ষণ না। ”
মালিহা কিচেন হতে বেরিয়ে এলেন শাড়ির আঁচলে ভেজা হাত মুছতে মুছতে।
” কেন মা? ইরু কি করেছে? ”
রাজেদা খানম এবং মালিহা আলাপচারিতায় লিপ্ত হয়ে পড়লেন। তবে এসবের ভিড়ে বিহ্বল হৃদি শেখ! অস্ফুট স্বরে আওড়ালো,
” ইরু! ”
আচমকা নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ হয়ে ফিক করে হেসে উঠলো মেয়েটা। ইরু! ইরহাম চৌধুরী যখন শর্টকাটে ইরু! আহা! মন্দ নহে। এমন আদুরে বাবুসোনা মার্কা সম্বোধন জানা ছিল না তো। মিটিমিটি হাসতে লাগলো মেয়েটা। ইরু ও ইরু…
চলবে.