গল্প- মধ্যরাতের বৃষ্টি
লেখক- নাইমুল হাসান নিলয়
পর্ব- ১
তখন রাত প্রায় দুইটা বাজে। আমার বাবা এই গভীর রাতে আমাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে বলে চল বৃষ্টিতে ভিজি। আমি রাজি হলাম না। মা-কে বলে দেয়ার ভয় দেখালাম কিন্তু তাতে হিতের বিপরীত হলো। বাবা আমার মুখ চেপে ধরে আমাকে কোলে করে নিয়ে গেলো উঠোনে। ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আমি আধো ঘুম চোখে নিয়ে অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে বাবাকে দেখছি। খুব জেদ হচ্ছে বাবার উপর। বাবা আকাশের দিকে মুখ করে আছে কিন্তু চোখ বন্ধ। হঠাৎ বাবা বললো চল কাদা মাটিতে শুয়ে পড়ি। এরপর আকাশের দিকে তাকিয়ে হা করে বৃষ্টির পানি খাবো। আমি বললাম না আমি ঘরে যাবো। বাবা বললো এবারই শেষ। বাবার এমন করুণ অনুরোধ আমি ফেলতে পারলাম না। এরপর আমি আর বাবা একসাথে মাটিতে শুয়ে পড়লাম এই ঝুম বৃষ্টির মধ্যে। তাও গভীর রাতে। ব্যাপারটা প্রথমে আমার বিরক্ত লাগলেও আস্তে আস্তে আমার ভালো লাগতে শুরু করলো। একটা সময় আমি আর বাবা প্রতিযোগিতা শুরু করে দিলাম কে কয় ফোঁটা বৃষ্টির পানি খেতে পারে। এরপর প্রায় অনেকক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজি আমরা। লুকিয়ে লুকিয়ে ঘরে ঢুকে জামা কাপড় বদলে ফেলে শুয়ে পড়লাম। এরপর থেকে প্রায় প্রতি রাতেই আমি বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করতাম৷ কেনো অপেক্ষা করতাম, কি জন্য করতাম আমি জানি না। সপ্তাহখানেক পর একদিন আবার এমন গভীর রাতে বৃষ্টি আসলো। আমি সাথে সাথে বাবার কাছে গেলাম। বাবা ঘুমাচ্ছিলো তখন। তাই আর জাগালাম না। আমি একা একাই ভিজলাম, একা একাই কাদা মাটিতে শুয়ে বৃষ্টির পানি খেলাম৷ আমার মধ্যে অন্য রকম এক ভালো লাগা কাজ করলো তখন। মানুষ যদি অনুভূতির যথাযথ বহিঃপ্রকাশ করতে পারতো তাহলে এতদিনে পৃথিবী হয়ত আরও অনেক অসাধারণ বই পেত। অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ করতে পারিনি বলেই সেদিন আমি সুখী ছিলাম। ঠিক তখনই আবিষ্কার করলাম আমি আসলে সুখী মানুষ। বৃষ্টিতে ভেজা শেষে আমি চুপিচুপি ঘরে ঢুকলাম কিন্তু ঘরে ঢুকে দেখি বাবা তোয়ালে হাতে দাঁড়িয়ে আছে। বাবা আমাকে ফিসফিস করে বললো,
– আমাকে ডাকলি না কেনো?
– তুমি ঘুমাচ্ছিলে তাই ডাকিনি।
– তুইও তো সেদিন ঘুমাচ্ছিলি তাও তো আমি ডেকেছিলাম।
– বাবা একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
– জিজ্ঞেস কর কিন্তু তার আগে জামা কাপড় বদলে নে। ভেজা শরীরে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে অসুখ করবে। পরে সে-ই আমাকেই ছোটাছুটি করা লাগবে।
আমি জামা কাপড় বদলে বাবার সামনে এলাম। বাবা তখন চা বানাচ্ছে। মা-কে লুকিয়ে বাবা প্রায়ই রাতে পা টিপে টিপে রান্না ঘরে এসে চা বানিয়ে খায়৷ বাবার এই অদ্ভুত স্বভাব গুলো মাঝে মাঝে আমার বেশ ভালো লাগে আবার মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগে কিন্তু যত যা-ই হোক আমি বাবার এসব কর্মকান্ড কিছুই মা-কে বলি না৷ তবে আমার ধারণা মা সবই বুঝতে পারে কিন্তু তাও বাবাকে কিছু বলে না। বাবা চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে চোখ বন্ধ করে৷ একটা চুমুক দেয়ার পর কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। এরপর আবার চুমুক দেয়। আমি বাবাকে আর ডাকলাম না। বাবা হয়ত চা খাওয়া শেষ করে চোখ খুলবে। এরপর কিছুক্ষণ বৃষ্টি দেখবে। বৃষ্টির পানি দিয়ে মুখ ধুবে। এরপর আমার রুমে এসে দেখবে আমার গায়ের কাঁথাটা ঠিকঠাক মত আছে কি না৷ ফ্যান বেশি জোরে চলছে কি না বা বেখেয়ালে জানালা খুলে রেখেছি কি না৷ এই সব কিছু বাবা ঘুমানোর আগেও একবার করে এসে দেখে যায় এরপর মধ্য রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে আবার এসে দেখে যায়। এরপর চুপচাপ নিজের জায়গায় গিয়ে শুয়ে যায়। বাবাকে একটা প্রশ্ন করার ছিলো আমার। প্রশ্নটা করা হয়নি। বাবাকে এমন হাজারটা প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে কিন্তু এরপর বাবার অদ্ভুত সব উত্তরে আমি হতভম্ব হই। একটা ঘটনা বলি। আমি আর বাবা একবার মা-কে রেখে নানা বাড়ি যাই। আসতে আসতে আমাদের সন্ধ্যা পার হয়ে যায়৷ মায়ের সাথে ফুফু থাকায় বাবার তাগাদা কম ছিলো৷ মফস্বলের রাস্তা। সন্ধ্যার পরপরই সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়৷ আমরা যখন একটা কবরস্থানের পাশ ঘেঁষে হাঁটছিলাম ঠিক তখন বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করলো আমি ভয় পাচ্ছি কি না৷ আমি অন্ধকারেই মাথা নাড়লাম। হঠাৎ বাবা আমার পাশ থেকে উধাও হয়ে গেলো। আমি বাবা, বাবা বলে ডাকি কিন্তু বাবার কোনো সাড়া পাই না৷ আমি পা টিপে টিপে এগোই। প্রথমে মনে ধারণা গেলো বাবা হয়ত আমার আসে পাশেই আছে, আমার সাথে মজা করছে কিন্তু যতই এগোই ততই যেন বাবা দূরে সরে যাচ্ছে। আমি ভয়ে আধমরা হয়ে যাওয়ার অবস্থা। তাও মনে সাহস রেখে সামনের দিকে এগোতে থাকলাম। একটা সময় হাঁটতে হাঁটতে আমি বাসায় চলে গেলাম৷ বাসায় গিয়ে দেখি বাবা খুব আয়েশ করে পানের খিলি মুখে দিচ্ছে৷ আমি বাবাকে কিছু বললাম না কিন্তু বাবা তার চলে আসার কারণ আমার কাছে ব্যাখ্যা করলো। বাবা বললো আমি তোকে ইচ্ছে করেই সেখানে একা রেখে এসেছি। কারণ তোর মনের মধ্যে যে ভয় বাসা বেঁধেছিলো সেই ভয় ভাঙাতে হলে আরেকটা ভয়ের দরকার ছিলো। ভয়ে ভয়ে কাটাকাটি আর আরেকটা ব্যাপারও ছিলো। সেটা হচ্ছে বিশ্বাস। বিশ্বাস একটা মানুষের জীবনে খুবই মূল্যবান একটা সম্পদ। তোর মনে বিশ্বাস ছিলো যে হয়ত আমি তোর আসে পাশেই আছি বা সামনে আছি আর এই বিশ্বাস থেকেই তুই সামনে এগোতে পেরেছিস। আপন মানুষদের জন্য এই বিশ্বাসটা জীবনে থাকা খুবই প্রয়োজন। আপন মানুষদের প্রতি বিশ্বাস না থাকলে দুনিয়া অর্থহীন মনে হবে।
বাবার কথা গুলো আমি নির্বিকার ভঙ্গিতে শুনে গেলাম৷ পাশ থেকে মা বাবাকে রাগান্বিত গলায় বললো,
– এভাবে একটা বাচ্চা ছেলেকে কেউ ভয় দেখায়? দেখেন না আফা আপনার এই পাগল ভাইটার কান্ড দেখেন৷
বাবার কথা শুনে ফুফু বেশ মজা পাচ্ছিলো কিন্তু পরোক্ষনেই মায়ের সাথে তাল মিলিয়ে ফুফু বাবাকে একটা ঝাড়ি দিয়ে আমাকে তার বুকে টেনে নিলো। গ্রামে একটা প্রথা আছে। কেউ যদি খুব ভয় পায় তাহলে তাকে পাতিলের কালি আর লবণ মিশিয়ে খাইয়ে দিলে তার ভয় কেটে যায়। ফুফুও আমাকে লবণ কালি খাওয়ালো৷ রাতে আমি ফুফুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমালাম৷
চলবে……