#মধুবালা [২০]
#ফারজানা_আক্তার
আমরা দুজন একই ক্লাসে পড়তাম একই সাথে পরিক্ষা দিয়েছি আর একই সাথে ভালো মার্কেও পাস করেছি তাই বিয়ে হলেও এক সাথেই হবে। নয়তো আমি বিয়ে করবোনা।”
ছোঁয়ার কথা শোনে যেনো পুরো পরিবার থ মে’রে গেছে। হঠাৎ লিলির বিয়ের জন্য ছোঁয়া এমন করছে কেনো কেউ বুঝতে পারেনা। লিলি ভয়ে মাথা নিচু করে রেখেছে। ছোঁয়ার মনে যেনো কোনো ভয় নেই। শুভ্রর উপর ভরসা রেখেই ছোঁয়া কথাটা বলে দিয়েছে। আনজুমা খাতুন কিছু বলতে যাবে তার আগেই বেলাল মির্জা বলেন “কিন্তু এই ৪/৫ দিনে ভালো পাত্র পাবো কোথায়? সমান্য কারণে কী তোদের বিয়েটা পেছানো ঠিক হবে?”
“নাহ বড় আব্বু আমি বিয়ে পেছানোর কথা বলছিনা। বিয়েটা একসাথে হোক এটাই বলছি। বাকিটা আপনার ছেলে বলবে।”
সবাই এবার শুভ্রর দিকে কৌতুহলি দৃষ্টিতে তাকায়। শুভ্র কিভাবে কথা শুরু করবে বুঝতেছেনা। তবুও ছোঁয়ার চোখ রাঙানো দেখে শুভ্র বলা শুরু করলো “আসলে গতকাল ছোঁয়ার বান্ধবী তানহার বিয়ে শেষে সবাই মিলে ওদের কলেজে গিয়েছিলাম। লিলিও গিয়েছিলো। যখন লিলি আর ছোঁয়ার রেজাল্ট আসলো তখন রেজাল্ট ভালো দেখে ওরা আমার কাছে ট্রিট চাই। আমিও সাদামনে ওদের কে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে গেলাম। কিন্তু রেস্টুরেন্টে আমরা খাওয়া শুরু করার আগেই একটা ছেলে আসে। ফর্সা চেহারার খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির লম্বা একটা ছেলে। দেখতে মাশাআল্লাহ। ছেলেটা এসেই আমায় সালাম দিলো, আমিও সালাম নিলাম। তারপর ছোঁয়া ছেলেটাকে স্যার ডেকে বসতে বললো। ছেলেটাও বসলো। তারপর আমি পরিচয় চাইলে বলে একটা সরকারি কলেজের শিক্ষক পদে আছেন ছেলেটা। যতটুকু ছেলেটাকে দেখেছি ভদ্র ঘরের মনে হয়েছে আমার।
তারপর হুট করে ছোঁয়া আমায় আমার হাত ধরে ছেলেটার থেকে একটু দূরে নিয়ে গেলো। লিলি মাথা নিচু করে বসে ছিলো। তখনও আমি জানিনা সত্যি টা। ছোঁয়া আমায় ধীর কণ্ঠে বলে ছেলেটার নাম আলিফ আর লিলিকে সে ভালোবাসে। লিলিও ছেলেটাকে ভালোবাসে আর তারা দুজন বিয়ে করতে চাই। লিলি বলতে পারছিলোনা তাই ছোঁয়া বলে আমায়।”
তারপর একে একে শুরু থেকে সব খুলে বলে ছোঁয়া। কারণ শুভ্রকে গতকাল সব খুলে বলার সময় পাইনি সে। মধ্যবিত্ত পরিবার শুনে বেলাল মির্জা একটু অমত প্রকাশ করলো তখনই শুভ্র বললো “পরিবার যেহেতু হালকা সেহেতু একবার তাদের সাথে কথা বলে নেওয়া উচিত, লিলির কোনো সমস্যা না হলে আমাদের সমস্যা হওয়ার কথা না। সংসার যেহেতু লিলি করবে ওর পছন্দকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত আমাদের।”
ছোঁয়া আনজুমা খাতুন কে খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে রাজি করেন। আনজুমা খাতুন রাজি মানে পুরো পরিবার রাজি।
লিলিকে বলা হলো আলিফকে ওর পরিবার নিয়ে আগামীকাল সকালে আসার জন্য বলতে।
**********
রাত প্রায়ই ১১টা ছুঁই ছুঁই। শীতের রাতে ছোঁয়া তেমন একটা জেগে থাকেনা। কিন্তু আজ কেনো জানি ছোঁয়ার ঘুম আসছেনা। আয়নার সামনে বসে ছোঁয়া চুল আঁচড়াচ্ছে আর ভাবছে চুল গুলো কবে আগের মতো হবে যদিও এখন একটু লম্বা হয়েছে। ছোঁয়া আনমনা হয়ে বসে ছিলো আয়ানর দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ পেঁছন থেকে শুভ্রর কন্ঠ শোনে ছোঁয়া চমকে উঠে।
“আমায় ছেড়ে চুল নিয়ে বেশি চিন্তা করলে আবারও কে’টে একদম ঘাড়ে তুলে দিবো।”
“তুমি কিভাবে আসলে? আমি তো দরজা লক করেছিলাম আর দরজা এখনো লক করা আছে।”
“কেনো? সবসময় যেখান দিয়ে আসি সেখান দিয়েই আসছি সোনা, বেলকনি দিয়ে।”
“তুমি এমন কেনো গো? আমার শখের চুলগুলো এখন আর কোমরে নামেনা।”
“এতো মন খারাপ করার কি আছে এতে? আমার হিংসা হতো কলেজে গেলে ছেলেরা তোর চুলের দিকে তাকিয়ে থাকতো দেখে তাই এমনটা করেছিলাম। আমার মধুবালার সৌন্দর্য দেখার অধিকার শুধু আমারই আছে, আর কোনো দ্বিতীয় পুরুষের নেই। আমি যদি চুল কাটতে বাধ্য না করতাম তোকে তাহলে তুই কখনোই হিজাব করে বাহিরে বের হতিনা আর হিজাবে তোকে অনিন্দ্য সুন্দর লাগে।”
“আমায় বললেই তো হতো আমি হিজাব পরে যেতাম কলেজে কিন্তু তুমি তো চুলই কে’টে দিলে।”
“আরে এতে ন্যাকা কান্নার কি আছে? তখন বললে কী তুই শুনতি আমার কথা? তখন তো আমাদের সম্পর্ক টম এন্ড জেরির মতো ছিলো।”
“আর এখন?”
“এখন কেমন সেটা এখনই দেখাবো নাকি বিয়ের পরের জন্য জমা রাখবো?”
শুভ্র কিছুটা ছোঁয়ার দিকে এগিয়ে বলে কথাটা। ছোঁয়া একটু পিছিয়ে যায়। বেশ লজ্জা পাচ্ছে ছোঁয়া। লজ্জা পেলে যেনো একদম লজ্জাবতী গাছের মতো নুইয়ে যায় ছোঁয়া আর তা শুভ্রকে মুগ্ধ করে সবসময়ই। ছোঁয়া লজ্জা পাচ্ছে আর শুভ্র এক ধ্যানে ছোঁয়ার লজ্জায় লাল হওয়া মুখশ্রীতে আঁটকে গিয়েছে। মুহুর্ত টা ভীষণ সুন্দর লাগছে। ছোঁয়ার কেমন জানি এক ধরনের অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে শুভ্রর এভাবে তাকানোতে। হুট করে শুভ্র আবারও বলে উঠে “লজ্জা পেলে তোকে এতোটা সুন্দর লাগে যে ইচ্ছে করে আরেকটু লজ্জা দিতে। বিয়েটা কবে হবে মধুবালা? ধৈর্য যে হচ্ছে না আর। শুন্য বুক তোকে খুব করে ডাকে যে।”
*************
বেলাল মির্জা আনজুমা খাতুনের কাছে যায়। এতোরাতে ছেলেকে নিজের রুমে দেখে মোটেও অবাক হয়নি আনজুমা খাতুন। বেলাল মির্জার এই মুহুর্তে এই রুমে আসার কারণ যে তার অজানা নয়।
“আচ্ছা মা আমরা ঠিক করছি তো এমন মধ্যবিত্ত পরিবারে মেয়ের বিয়ে দিয়ে। আমার একটাই মেয়ে, চিন্তা হচ্ছে খুব। এমন বিলাশিতায় বড় হওয়া মেয়ে আমার মানিয়ে নিতে পারবে তো মধ্যবিত্ত পরিবারের জীবন?”
“দেখ এসব চিন্তা করে আমরা এই পরিবারের একমাত্র মেয়েকে হারিয়েছিলাম বহুবছর আগে। আরেকটা মেয়েকে আমরা হারাতে চাইনা তাই রাজি হয়ে গেলাম। আর যেখানে মেয়ে নিজেই পছন্দ করেছে সব জেনে সেখানে আমরা মেনে না নিলে হতে পারে বহু বছর আগে যেটা ঘটেছে সেটার পুনরাবৃত্তি আবারও। তারচেয়ে ভালো চুপচাপ মেয়ের খুশিতে নিজেকে খুশি কর।
আমার মেয়েটা বেঁচে আছে কিনা তা পর্যন্ত জানিনা। এতো অভিমান আমার মেয়েটার যে বাবার মৃত্যুতেও একটু আসেনি আমাদের দেখতে।”
মায়ের সাথে কথা বলে জীবন মির্জা নিজের রুমে চলে যান। মনটা কেমন জানি অদ্ভুত রকমের হয়ে আছে। আগামীকাল ছেলে পক্ষ আসলে কী হবে সেটা ভেবেই জীবন মির্জার মনটা ছ’ট’প’ট করছে খুব। নাজমা বেগম বলেন “শুধু শুধু চিন্তা করে কেনো নিজেকে অসুস্থ করে তুলছেন? এমনিতেই আপনাদের সব ভাইয়ের লো প্রেশারের সমস্যা আছে তারউপর আবার চিন্তায় থাকেন সবসময়ই। এতো চিন্তা করবেন না তো, যা হবে ভালোই হবে। আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন।”
বেলাল মির্জা কিছু বললেননা। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে চোখ দুটো বুঁজে নেন। নাজমা বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।
*************
সকাল ১০টা। মির্জা বাড়িতে আজ ভীষণ হৈচৈ। রান্না ঘরে চলছে মেহমানের জন্য বিভিন্ন আইটেম বানানোর ছুটাছুটি। আজ ছোঁয়াও রান্নায় সবাইকে সাহায্য করতেছে যদিও জায়েদা বেগম বারংবার ছোঁয়াকে নিষেধাজ্ঞা করছেন। ছোঁয়ার একটাই কথা “আজ আমার বোন+বেস্টফ্রেন্ড+ননদের শ্বশুড়বাড়ি থেকে প্রথম মেহমান আসতেছে তাকে দেখতে তাহলে কেনো কাজ করবোনা আমি। আমার সম্পূর্ণ দায়িত্ব এবং অধিকার আছে।”
ছোঁয়ার এই লজিক শুনে সবাই হেঁসে ফেলে কুটকুট করে।
লিলিকে লামিয়া সানিয়া আর ছোঁয়া মিলে তৈরি করতেছে।
*
বাড়ির গেটে পা রাখতেই আলিফের মা সুলতানা মির্জার পা থমকে যায়। তিনি আর সামনে এগুতে পারছেননা। বহু বছর আগে আলিফের বাবার হাত ধরে এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান তিনি আর আজ এই বাড়িতে আসতে হবে তা কখনোই কল্পনা করতে পারেননি সুলতানা মির্জা। আলিফের বাবার সাথে বিয়ে হওয়ার পর নিজের নামের থেকে মির্জা নামটা মুছে দেন চিরকালের জন্য। আর আজ এই বাড়ির গেটে নিজের ছেলের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেকে কি জবাব দিবে তা জানা নাই সুলতানা মির্জার কিন্তু এই বাড়িতে প্রবেশ করার সাহস সুলতানা মির্জার নেই। এই বাড়ির কারো চোখে চোখ রাখার মতো যে সাহস সুলতানা মির্জার হবেনা, তিনি যে ভুল করেছেন বহু বছর আগে তারজন্য যে তার পরিবারকে অনেক অপমানিত হতে হয়েছিলো সমাজের সামনে। কিভাবে সেই বাপ ভাই মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াবেন সেই সাহস তিনি পাচ্ছেননা।
আলিফ কিছুদূর সামনে এগিয়ে আবার পেঁছনে এসে মাকে উদ্দেশ্য করে বলে “কি হয়েছে আম্মু আসো ভেতরে।”
পাশ থেকেই আলিফের বোন আলিয়া বলে উঠে “দেখনা ভাই আম্মু এখানে এসে কেমন দাঁড়িয়ে থ মে’রে গেছে। আম্মু পাও নাড়াচ্ছেননা। আম্মুর শরীর অসুস্থ লাগছে মনে হয়।”
#চলবে_ইনশাআল্লাহ
#মধুবালা [২১]
#ফারজানা_আক্তার
সুলতানা মির্জা ঘরের সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। পুরো শরীর কাঁপছে তার। আলিফ কয়েকবার বলেছিলো আগে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্য কিন্তু সুলতানা মির্জা যায়নি। উনার যে ডাক্তার দেখানোর মতো অসুস্থতা হয়নি। এটা যে মনের অসুস্থতা। গেট থেকে কোনোমতে ধরে ধরে ঘরের দরজা পর্যন্ত এনেছে আলিয়া মাকে। আলিয়ার খুব ভালো লাগছে বান্ধবীর সাথেও এই উছিলায় দেখা হয়ে যাবে ভেবে। আলিফ খুব নার্ভাস আজ। প্রথমবার প্রিয়তমার পরিবারের সাথে দেখা করতে এসেছে, বুকের ভেতর অদ্ভুত রকমের অনুভূতি কাজ করছে।
সুলতানা মির্জা বোরকা নিকাব পরে এসেছে। তাই কিছুটা নিশ্চিত আছে যে কেউ তাকে হয়তো চিনবেনা এতোগুলো বছর পর আর। ওর চোখগুলোও বেশ পরিবর্তন হয়েছে এখন বয়সের ছাপে। তবুও বুকটা দুরুদুরু করছে বেশ।
আলিফ একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে কলিং বেল চাপ দেয়।
বাড়ির কাজের মহিলা রহিমের মা এসে দরজা খুলে দিলেন। বাড়ির ভেতরের সৌন্দর্য দেখে আলিফ আলিয়া দুজনেই বেশ অবাক। আলিফ মনে মনে নিশ্চিত হয়ে গেছে এই ঘরের মেয়ে কখনোই তার পরিবার ওর হাতে তুলে দিবেনা। হঠাৎ বুকে চাপা কষ্ট অনুভব করলো সে।
সুলতানা মির্জা চোখ বুলিয়ে পুরো ঘর একবার দেখে নেয়। বাড়ির দৃশ্য চেঞ্জ হয়েছে। আগের সেই সাদামাটা বাড়ি আর নেই, বেশ কালার ফুল হয়েছে হলরুম টা।
রহিমের মা চিৎকার করে সবাইকে ডাকলো মেহমান চলে এসেছে বলে।
ছোঁয়ার সেজু চাচি জায়েদা বেগম নাজমা বেগম সবাই এসে স্বাগতম জানিয়ে তাদেরকে সোফায় এনে বসালো। সুলতানা মির্জা বুকটা এখনো ধুপধাপ করেই চলেছে। চোখদুটো খোঁজে চলেছে মা বাবাকে।
মান্নান মির্জা জীবন মির্জা এসে সুলতানা মির্জার সাথে কৌশলবিনিময় করে বসেছে। আলিফ সবাইকে সালাম দিলো আলিয়াও দিলো। সুলতানা মির্জা এই শীতের মাঝেও ঘামছে। থরথর করে কাঁপছে হাতদুটো। মনে মনে চিন্তা করছে হয়তো মা বাবা আর বেঁচে নেই। পর্দার আঁড়ালে দুই ফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পরলো কিন্তু কেউই দেখলোনা।
বেলাল মির্জা আনজুমা খাতুনকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন। মাকে দেখেই যেনো দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে ইচ্ছে করলো সুলতানা মির্জার কিন্তু নিজের ইচ্ছে টাকে তিনি করব দিলেন। নিজের পরিচয় যে সুলতানা মির্জা দিতে চাইছেনা মনের ভয়ে।
কিন্তু বেলাল মির্জার দিকে চোখ তুলেও তাকানো প্রয়োজন করেনি সুলতানা মির্জা। বহুবছর আগে তার জেদের জন্যই মা বাবাকে ছাড়তে হয়েছিলো যে তাকে। বেলাল মির্জাই আলিফের বাবাকে মানতে নারাজ ছিলেন বলে মা বাবাও মেনে নেয়নি। আজও বড্ড অভিমান জমে আছে বেলাল মির্জার প্রতি সুলতানা মির্জার।
আলিফ আলিয়া তাদেরকেও সালাম করলো। সুলতানা মির্জা মায়ের সাথে কথা বলতে পারছেননা, কেমন জানি গলা ধরে আসছে তার। সবাই অবাক হচ্ছে সুলতানা মির্জার অবস্থা দেখে। আলিফ সরু কন্ঠে সবাইকে বললো তার মায়ের শরীর অসুস্থ কিছুটা।
সাথে সাথেই জায়েদা বেগম লেবুর শর্বত বানিয়ে এনে দিলেন। নিকাবের নিচে গ্লাস ঢুকিয়ে ঢকঢক করে সব খেয়ে নিলেন। কিন্তু জায়েদা বেগম কে চিনতে পারছেননা ঠিকমতো সুলতানা মির্জা। তার চোখ খোঁজে চলেছে সেলিনা পারভীন কে। সেলিনা পারভীনের সাথেই তার ভাব ছিলো বেশি। বান্ধবীর সম্পর্ক যাকে বলে।
সকাল ১১টা বাজলো। শুভ্রর ঘুম ভা’ঙ্গ’লো মাত্র। ঘুম ভা’ঙ্গ’তে’ই সময় দেখে শুভ্রর মাথা খারাপ হয়ে যায়। রাগ হয় ছোঁয়ার উপর। সে কী পারলোনা একবার ডেকে দিতে। শোয়া থেকে উঠে বেশ ক্ষো’ভ নিয়ে শুভ্র ছোঁয়াকে ডাকতে ডাকতে নিচে আসলো। ছোঁয়া রান্না ঘর থেকে শুভ্রর রাগি কন্ঠ শোনে ছুটে আসে। ছোঁয়ার পুরো শরীর ঘামে চুপচুপে হয়ে আছে। শীতের মাঝেও মেয়েটা ঘেমে-নেয়ে একাকার। প্রথমবার এতোকাজ করেছে বলে কথা।
ছোঁয়া শুভ্র দু’জনেই মেহমান দেখে অবাক। ছোঁয়া বেশ লজ্জা পেয়ে গেলো এভাবে সবার সামনে এসে, আলিফ একটুখানি চেয়ে ছোঁয়ার দিকে চোখ সরিয়ে নেয় আবার ওর থেকে। শুভ্র থ্রি কোয়াটার প্যান্ট পরে আছে বলে বেশ লজ্জা পেয়ে যায়। সুলতানা মির্জা অবাক চোখে দেখছে ওদের দু’জনকে।
আনজুমা খাতুন কিছুটা হেঁসে বলে উঠলো “কি ব্যাপার আমার নাতিটা যে বিয়ের আগেই আমার নাতনিটার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে।”
শুভ্র লজ্জা লজ্জা মুখ করে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে “ধুর দাদুনি কী বলো এসব তুমি? আসলে একটু কাজ ছিলো আমার।
মধুবালা একটু আমার রুমে আয় তো।”
“যাবোনা, দেখো না তুমি ঘামে ভিজে গেলাম আমি? গোসল করবো।”
“আসবি কিনা সেটা বল।”
“সেটাই তো বললাম, যাবোনা আমি।”
“দেখ বাড়াবাড়ি করিসনা, ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আছে আমার।”
“তো তোমার কাজ তুমি করো, আমি কী করবো সেখানে।”
শুভ্র আর কোনো কথা না বাড়িয়ে ছোঁয়ার হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় নিজের রুমে। আনজুমা খাতুন হাসে। উপস্থিত সবাই-ই মুচকি মুচকি হাসে। শুধু আলিফের ভালো লাগেনি ব্যাপারটা, শত হলেও ছোঁয়া আলিফের প্রথম পছন্দ ছিলো।
আনজুমা খাতুন একটু হেঁসে সুলতানা মির্জাকে বলেন আসলে শুভ্র আমার বড় ছেলের ছেলে আর ছোঁয়া আমার মেজু ছেলের মেয়ে। তাদেরও বিয়ে ঠিক হয়েছে, একে অপরকে ভালোবাসে খুব। আর আজ আপনারা এখানে আসতে পেরেছেন তাও ছোঁয়ার জন্য, ওর জেদ ছিলো ওর আর লিলির বিয়ে একসাথেই হতে হবে।”
এসবের মধ্যে জীবন মির্জার মনটা খারাপ হয়ে যায় খুব। কিন্তু কেউ খেয়াল করেনি সেটা জায়েদা বেগম ছাড়া। নিজের মেয়েকে সমাজের সামনে নিজের মেয়ে বলে পরিচয় দিতে না পারা যে কতটা কষ্টের তা জীবন মির্জা ছাড়া আর কেউই অনুভব করতে পারবেনা হয়তো।
***********
“আরে তুমি কী পাগল হলে? সবার সামনে থেকে এভাবে টেনে আনলে কেনো? কী ভাববে এখন লিলির শ্বশুড় বাড়ির লোকজনেরা।”
“কে কি ভাবলো তাতে আমার কিছু যায় আসেনা। তুই আর নিচে যাবিনা যতক্ষণ নাহ ওরা চলে যায়।”
“কেনো কেনো? এমন কেনো? আমি যাবো, আমি শুনবো সবাই কি কথা বলে।”
“দেখ মধুবালা বাড়াবাড়ি করিসনা।”
“সমস্যা কী তোমার?”
“ওই আলিফ নামের ছেলেটা তোর দিকে কেমন জানি নজরে তাকায়, আমার ভালো লাগেনা।”
“বোকা একটা! আলিফ স্যার লিলির হবু বর। শুধু শুধু সন্দেহ করো। যাও ফ্রেশ হয়ে আসো। আমি গোসল করবো।”
“চল একসাথে গোসল করবো আজ।”
“বলছি যে পাবনায় একটা সিট খালি আছে শুনছিলাম, ভাবছি তোমার ওই সিটটা প্রয়োজন। ”
“তবে রে….
শুভ্র এগিয়ে যেতেই ছোঁয়া এক ছুটে পালাই।
ছোঁয়াকে সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে দৌড়ে নামতে দেখে আনজুমা খাতুন বলেন ” কিরে কি হয়েছে আমার নাতির মধুবালার?”
“উফস্ দাদুনি তোমার নাতির মাথা গেছে পুরোটা। পাবনায় সিট বুকিং করতে যাচ্ছি। ”
নিজের রুমের দিকে ছুটতে ছুটতে ছোঁয়া বলে কথাটি। সবাই কুটকুট করে হেসে উঠে।
একটু পর লিলিকে এনে সবার সামনে বসানো হয়।
শুভ্রও এসে বসে। সুলতানা মির্জার বেশ পছন্দ হয় লিলিকে। কিন্তু বুক কাঁপনির জন্য তিনি কোনো কথায়-ই বলতে পারছেননা। তবুও দুই একটা কথা তো বলতেই হচ্ছে।
ছোঁয়া এসে শুভ্রর পাশে দাঁড়ায়। শুভ্র ছোঁয়ার কানে কানে বলে “তোকে তো কেউ দেখতে আসেনি, তবে কেনো এভাবে সেজেগুজে হাজির হলি তুই? নাকি আমাকে পাগল করার ধান্দা হু?
ভালোই ভালোই বলছি কিন্তু, আমার সামনে এভাবে সেজেগুজে আসবিনা, পুরোটা খেয়ে ফেলবো একদম।”
“ধুর তুমিওনা, সবার সামনেও লজ্জা দাও শুধু। ”
শুভ্র মুচকি হাসে ছোঁয়ার কথায়।
এদিকে লিলি আর আলিফের বিয়ের সব কথাবার্তা ঠিক হয়ে গেলো।
সুলতানা মির্জা হঠাৎ বলে উঠলেন “আপনারা এতো বড়লোক অথচ আমার কিছুই নাই। আমরা মধ্যবিত্ত। আমার স্বামীর পেনশনের টাকা আর আমার ছেলের সামান্য ইনকামেই আমাদের পরিবার টা চলে। বেলাল সাহেবের একমাত্র মেয়ের জন্ম হয়েছে সোনার চামচ মুখে নিয়ে, সে কি পারবে আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে?
আর বেলাল সাহেবের কী কোনো সমস্যা নেই এতো নিচু পরিবারের সাথে তার মেয়ে সম্পর্ক করতে যাচ্ছে? ”
সুলতানা মির্জার কথা শুনে সবাই অবাক। বেলাল মির্জা যে মন থেকে রাজি নেই সেটা সবাই-ই জানে। বেলাল মির্জা একটু গলা খাখারি দিয়ে বলেন “না বেয়াইন আমার কোনো সমস্যা নেই, আমার মেয়ের সুখটাই আমার কাছে সব।”
“বহুবছর আগে নিজের বোনের সুখ টা তো মেনে নিতে পারেননি তবে আজ নিজের মেয়ের বেলায় এমন চমৎকার কিভাবে হলো? বোনের কী কোনো অধিকার ছিলোনা নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার? সুখে থাকার? অথচ নিজের মেয়ের প্রেমকে ঠিকই মেনে নিচ্ছেন মধ্যবিত্ত পরিবার জেনেও। বাহ্ বেলাল মির্জা বাহ্।
মুখের নিকাব তুলে কথাগুলো বলেন সুলতানা মির্জা।
আনজুমা খাতুন সহ পুরো পরিবার যেনো বিস্ময়ের মধ্যে চলে গেছে শুধু বাড়ির ছোট রা ছাড়া। আনজুমা খাতুন একদম সরু কন্ঠে বললেন “আমার ছোট্ট রাজকন্যা টা।”
#চলবে_ইনশাআল্লাহ
ভুলত্রুটি মার্জনীয়।