#ভেজা_চুলে
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্ব-১
“এক সময় যাকে নিজের স্ত্রী হিসেবে পেতে চেয়েছিলাম আজ তাকে ভাবীমা বলে ডাকতে হচ্ছে। এর থেকে গা ঘিনঘিনে ব্যপার আর কী হতে পারে?”
কথাটা বলে সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়া আকাশে উড়িয়ে দিলো সামনে থাকা সুদর্শন ব্যক্তিটা৷ বিয়ে বাড়ির ঝলমলে আলোয় তার আবছা আলোয় তার বেদনা সুস্পষ্ট। সিগারেট টা আংগুলের ফাকে রেখে বেদনা মিশ্রিত আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমাদের গল্পটা শুরু হয়েছিল ঠিক কোনো এক বিয়ে বাড়িতেই। মনে পড়ে আপনার সেদিনের কথা?”
————————————————————————-
“বর্ষাকালে পুরুষ ব্যাঙ স্ত্রী ব্যাঙ কে বলে।ওই দেখা যায়
এই বিল আমার, ওই বিল আমার, ওটা আমার। আর স্ত্রী ব্যাঙ বলে,
তোমার খালি গপ্প, গপ্প আর গপ্প। ”
বরের ভাইদের হচ্ছে সেই অবস্থা। ব্যাঙের মতোন গলা ফুলিয়ে কী আর হাতি হওয়া যায়?”
দাম্ভিকতার সাথে হেসে মেয়েটি কথা বলে পাশের চেয়ারে বসে। মেয়েটির চুল গুলো ভেজা। টুপটুপ করে পানি ঝরছে চুল থেকে।
হয়তো সবে মাত্র গোসল সেরে বেরিয়েছে। পরণে কালো রঙের এক শাড়ি৷
হাতে চুড়ি নেই,নাকে ফুল নেই,কানে দুল নেই অথচ মুখে রয়েছে আলাদা এক মাধুর্যতা৷
মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ইনহান বার দুয়েক ঢোক গিলল।দৃষ্টি সামনে দাড়িয়ে থাকা চার রমনীর দিকে।
“তার মানে কী আপনারা টাকা দিচ্ছেন না?”
কনে পক্ষের আরেকজন বলে উঠল কথাটা।
আহরার হাত ঘড়িটা ঢিল করতে করতে বলল,
“শোনো বাচ্চারা, তোমরা এসেছো চার জন। আমরা তাই চার দ্বিগুণে আট টাকা দিয়েছি।”
আরহার কথা শুনে পত্রী রেগে গিয়ে বলল,
“সামনে যে খাবার দিয়েছি সেটা কী আট টাকার খাবার?”
ওয়াহেদের কাধে হাত দিয়ে শয়ন বলল,
“ভাই জানতাম না তো! তোমার বিয়ে বাড়ি এসে টাকা দিয়ে খাবার কিনে নিতে হবে?
তাহলে তো আমরা রেস্টুরেন্টে খেয়ে নিতে পারতাম।”
শয়নের কথায় যেন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে খুশবু জবাব দিলো,
“আপনাদের মাথায় কমনসেন্সের বড্ড অভাব। না হলে কী আর এ কথা বলতেন?”
চেয়ারে বসে থাকা মেয়েটি উঠে দাড়িয়ে আবার ফিরে এলো।তাকে আসতে দেখে বাকী তিনজন সাইড হয়ে দাড়িয়েছে।কালো শাড়ি পরিহিতা মেয়েটা
কোনো কথা না বলেই সে ওয়াহেদের হাত নিয়ে খুব সাবধানে ধুয়ে দিলো। দুলাভাইয়ের হাত ধুয়ে দেওয়া শালীদের অধিকার। এবং সে অধিকারের টাকা আটকে দেওয়া বর পক্ষের বন্ধু ও ভাইদের বিয়েগত অধিকার। এখানে এই বিয়েগত অধিকার নিয়েই চলছিলো এতক্ষণের বাকবিতন্ডা।
মেয়েটির চুলগুলো এখনো খোলা।টুপটুপ করে ঝরা পানিগুলো ঠাই নিয়েছে কোমরে। আহরারের দৃষ্টি সেদিকে স্থির হয়ে আছে।বিন্দু বিন্দু জল জমেছে তার কোমরের দিকটায়।যেনো এক অমোঘ টানে টানছে তাকে।
মেয়েটি আর কারো হাত না ধুইয়ে দিয়েই চলে যাচ্ছিলো।তখন আহরার বলে উঠল,
“এই যে মিস ভেজা চুল, আমরাও তো আছি ভাই।আমাদের হাত কে ধুইয়ে দিবে।”
মেয়েটি মুচকি হেসে এগিয়ে এসে বলল,
“খোদা দুই হাত দিয়েছেন মি.ল্যাডা ব্যাঙ। নিজেদের হাত নিজেরা ধুয়ে নিন।”
শয়ন উচ্চস্বরে বলল,
“হাত না ধুইয়ে দিলে খাইয়ে দিতে হবে।”
“আপনাদের বাড়িতে গরু আছে তাই না? আপনার বাবা গরু পালে?”
“না কেনো বলুন তো! ”
“পালে তো। এই যে আপনি, নাম্বার ওয়ান বলদ।”
মেয়েটির কথায় উচ্চস্বরে হেসে উঠেছে সবাই।অঘোষিত ভাবে ছেলে পক্ষের নাম হয়ে গেলো,
ল্যাডা ব্যাঙের দল।
আজ আকদ হচ্ছে ওয়াহেদ এবং অর্ণির।চারিদিকে মানুষের হৈচৈ। সেই হৈচৈ এর মাঝেই কনে পক্ষের করা হালকা ঝাপসা অপমান সহ্য করে মুরগী রানে কামড় দিয়ে ইনহান বলল,
“এই অপমান কী ভাই সহ্য করা যায়? কিছু একটা করতেই হবে।”
এক রাজার দুই রানী, দুও আর সুও। রাজবাড়িতে সুওরানীর বড়ো আদর, বড়ো যত্ন। সুওরানী সাতমহল বাড়িতে থাকেন। সাতশো দাসী তাঁর সেবা করে, পা ধোয়ায়, আলতা পরায়, চুল বাঁধে। সাত মালঞ্চের সাত সাজি ফুল, সেই ফুলে সুওরানী মালা গাঁথেন। সাত সিন্দুক-ভরা সাত-রাজার-ধন মানিকের গহনা, সেই গহনা অঙ্গে পরেন। সুওরানী রাজার প্রাণ।
আর দুওরানী— বড়োরানী, তাঁর বড়ো অনাদর, বড়ো অযত্ন। রাজা বিষ নয়নে দেখেন। একখানি ঘর দিয়েছেন— ভাঙাচোরা, এক দাসী দিয়েছেন— বোবা-কালা। পরতে দিয়েছেন জীর্ণ শাড়ি, শুতে দিয়েছেন— ছেঁড়া কাঁথা। দুওরানীর ঘরে রাজা………
মাধুর্যের কাধে হাত রেখে অর্ণি দীর্ঘশ্বাস ফেলল।মেয়েটা কাঁদছে।অর্ণির বলা এই ক্ষীরের পুতুল গল্পটাকে এক সময় মাধুর্য সত্যি ভাবতো। আজ বিয়ের পর যে স
বড্ড একা হয়ে যাবে মাধুর্য । এই সুওরানী, দুওরানীর গল্প যে তার জীবনের গল্প।তার মায়ের গল্প।
“থাক আর বলতে হবে না।”
“হুম।”
“আমি আজ চলে যাচ্ছি না।”
“হুম।”
“কাঁদিস না।তোর জন্য রাজপুত্তুর আসবে তো।”
“ঘুটে কুড়োনিদের রাজ পুত্তুর জুটে না।”
“তাহলে বিয়েটা না করি?
” প্রার্থনা করি, তুমি সুখী হও আপু।”
দুচোখ ভর্তি টলমলে পানি নিয়ে মাধুর্য বেরিয়ে এলো।আর অর্ণি চোখের পানি ফেলছিল তার মেহেদী রাঙা হাতে।
বিয়ে নামক এই পবিত্র বন্ধনে বড্ড ভয় মাধুর্যের।
মামার বাড়ি মানুষ হওয়া এই মেয়েটার রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই।
ইচ্ছে হলেই সে স্বপ্ন দেখে না।কারণ মৃত্যু যেখানে অবধারিত স্বপ্ন সেখানে বিলাসপ্রিয়তা।
আজ অর্ণির বিয়ের পর সে আবার একা হয়ে যাবে। যেমনটা বাবার দ্বিতীয় বিয়ে এবং মায়ের মৃত্যুর পর হয়েছিল।
পৃথিবীতে সবার সবাই আছে তবে মাধুর্যদের কেউ নেই,কোথাও কেউ নেই।তারা বড্ড নিঃসঙ্গ।
অর্ণি যখন কবুল বলছিল মাধুর্য তখন চুপচাপ বসেছিল তার পাশে।
ওয়াহেদের পাশে অর্ণিকে বেশ মানিয়েছে বটে।
তারপর যখন ওদের অন্দরমহলে নিয়ে যাওয়া হলো পায়েস খাওয়ানোর জন্য তখন নানী-দাদীরা হাসি তামাশায় মশগুল তখন একটা ঝামেলা হলো।ইনহানের হাত লেগে মাধুর্যের পায়ের কাছটায় সম্পূর্ণ পায়েস সমেত বাটি পড়ে গেলো।মুহূর্তেই হৈচৈ থেমে গেছে।নীরবতা ভাংলো যখন কেউ একজন চেচিয়ে উঠলো।
এক ঘর মানুষ, বরপক্ষের সামনে অর্ণির দাদী বললেন,
“এই মাইয়্যারে সরাও এন থেন। এডা এনে কী করে?জন্মের পর মায়েরে খাইছে, বাপে রাখে নাই ওরে ক্যান এসবে রাখো?
শুভ কাজে ওগো থাকা ঠিক না।আর এই মাইয়্যারেও কই
এই ছেড়ি তোর কী শরম নাই?
তুই আইলেই দেহস ঝামেলা বাজে তাইলে ক্যান আসিস?”
কথাগুলো বলেই সবার সামনে দিয়ে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে বের করে দিলেন মাধুর্যকে।বাহিরে তখন ভীষণ বৃষ্টি। মাধুর্য এক সমুদ্র অপমান যেন গিলছিল বৃষ্টির পানির সাথে।
চলবে
#ভেজা_চুলে
#পর্ব-২
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
স্বামীর করা অনবরত আঘাতে ফ্লোরে নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে লতা।নয় মাসের ভরা পেটে শেষ লাথি দেওয়ায় রক্তের স্রোত নামছিল।
ফ্লোরে রক্ত জমে রক্তের আস্তরণ পড়েছে। মানুষের রক্তের আলাদা গন্ধ। সেই রক্ত খুব সহজেই কালচে বর্ণ ধারণ করেছে।
বন্ধ ঘরে, আলো নেই, বাতাস নেই সেই এক ঘুপচি ঘরে নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকা লতার পাশে তার শাড়ির আঁচলে শুয়ে হাত-পা নেড়ে কেঁদে চলেছে নবজাতক।
এখন অবধি নাভীর নাড় কাটা হয়নি।
লতার চোখ ধীরেধীরে বন্ধ হয়ে আসছিলো। ক্লান্তি? না কী প্রাণ বায়ু বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে?
বাচ্চাটা অন্ধকারে অনবরত কেঁদেই চলেছে। কোত্থেকে এক কুকুর এসে গড়গড় আওয়াজ করছিল।এই অন্ধকার ঘরে কুকুর এলো কীভাবে?তারপর হঠাৎ মনে হলো এ তো তার স্বামীর পোষা কুকুর ভুলু।মাংসের প্রচন্ড ক্ষুধা ভুলুর।
লতার মনে হচ্ছে এই বুঝি তার সন্তানকে ভুলু কামড়ে খাবে ।
বাচ্চাটা অন্ধকারে এক ঝলক আলো দেখে চুপ হয়ে গেলো।হাত নেড়ে কাছে ধরার চেষ্টা করছে মনে হচ্ছে।
হঠাৎ ভুলু দৌড়ে এসে এক থাবা বসাচ্ছে বাচ্চার গায়ে।
মাধুর্যের ঘুম ভেঙে গেছে। ঘামে জবজব করছে তার শরীর। ছোট মামী বসে পাখা দিয়ে বাতাস করছে, আর মামা হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো তার চুলে ।ক্লান্ত মাধুর্য মামার উরুতে মাথা রেখে তার পেটে মুখ গুঁজে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে।
এতক্ষণ যা স্বপ্নে দেখছিল এমনটাই না কী হয়েছিল মাধুর্যের জন্মের সময়। কুকুর থাবা দেওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে জানালা ভেঙে ঘরে প্রবেশ করে মাধুর্যের মামারা৷
তারপর যম-দূতে টানাটানি হয় ১৫ দিন মাধুর্যের মা লতা কে নিয়ে।
মারা যান লতা বেগম।মাত্র ১৮ বছর বয়সে সন্তান জন্ম দিয়ে নয়, সন্তানকে বাঁচাতে নিজে মারা যান।
অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, জরায়ুতে ক্ষত সৃষ্টি থেকে ইনফেকশন হয়ে মৃত্যু বরণ করেন।
ছোট মামা তখন বিয়ে করেনি।সেই যে মাধুর্যকে পাতলা গেঞ্জিতে করে তার বাবার বাড়ি থেকে আগলে এনেছিল, আর দেয়নি।
দুহাতে আগলে রেখেছে, মানুষ করেছে।
মাধুর্যের ছোট মামীও তাকে নিয়েই টিকে আছে। সন্তান হলে যদি মাধুর্যের প্রতি টান কমে যায় তাই সন্তান নেয়নি দীর্ঘ আট বছর। পরবর্তীতে সবার কথায় এবং মাধুর্যের আবদার পূরণের জন্যই হয়তো এক ছেলেকে জন্ম দিয়েছেন তারা।
মাধুর্য এমন জেদ করেছিল কারণ তার মাম্মাই কে যে সবাই বাজ,আটখোরা, বাঞ্জা বলতো।
যারা তাকে নতুন সুখ দিয়েছে তাদের অসুখের কারণ কী করে হবে সে?
“মা! উঠো খেয়ে নিবে। আর চুল এতো ভেজা কেনো?”
“বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম।”
এই মুহুর্তে মামী প্রায় ঝাঝালো গলায় বললেন,
“যদি জ্বর আসে, মাইর একটাও মাটিতে পড়বে না।”
“দিতে পারবে?তোমার কলিজায় কুলাবে তো?”
“সময় হলেই বুঝবে। নাও এবার দুই ভাই-বোনে খেয়ে আমাকে উদ্ধার করো।”
বেহালায় সুর উঠেছে। করুণ সুর। বাহিরে ঝুমঝুমির বৃষ্টির সাথে এই বেহালার সুর বাধ্য করছে ইনহান কে জানালা দিয়ে উঁকি দিতে। তখন বেহালায় সুর উঠেছে,
“শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা”
বারান্দার বসে থাকা অবয়বটির দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইনহান।এই মেয়েটা আজ তার জন্য একঘর মানুষের সামনে অপমান হয়েছে। তার হাতের ধাক্কা লেগেই মেয়েটার পায়ের কাছে পায়েস পড়ে যায়।কালো শাড়ি পরিহিতার নাম কী?
“ভাইয়ারা আসুন। আপনাদের জন্য চা নিয়ে এসেছি।”
পত্রীর ডাকে উঠে বসে শয়ন,আহরার তখন ফোনে ব্যস্ত। ইনহান ভিতরে আসতে আসতে বলল,
“চা খাওয়ার পয়সা নেই ভাই।এমনি দিবে?”
“ওটা আমাদের হক ছিল আপনারা দেন নি। এটা আমাদের অতিথিপরায়ণতা। নিন চা নিন।”
শয়ন পত্রীর হাত থেকে চা নিতে নিতে বলল,
“বেয়াইন সাহেবা ভায়োলিন কে বাজাচ্ছে?”
“মাধু আপু।”
আহরার শয়নের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলল,
“কালো শাড়ি?ভেজা চুল?”
“হুম।কেনো ক্রাশ খেলেন না কী?”
“নাহ্ ক্রাশ কেনো খাবো?এসব উটকো ঝামেলা আমার নেই।”
খুশবু ইনহানের দিকে চা’য়ের কাপ বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“আপনিও কী ক্রাশ খান না?”
“খাই’ত। খেয়ে আবার হজম করে ফেলি।”
“কেনো?”
“বেশি ক্রাশ খাওয়ায় যদি মনের ডায়রিয়া হয়?”
তাদের কথোপকথনের মাঝেই আহরার এসে বারান্দায় দাড়িয়েছে। মাধুর্য নামের মেয়েটির চুল এখনো ভেজা।বৃষ্টির ছাট এসে ভিজে যাচ্ছে চুল। তার দিকেই তাকিয়ে চা’য়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে আহরার।
ভেজা চুলের এই মেয়েকে নিয়ে সেরাতে বেশ অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল আহরার।
নোনতা স্বাদের বিষাক্ত চুমু এই ভেজা চুলের মেয়েটির ঠোঁটে হঠাৎ এমন কেনো মিষ্টি লাগছে?
কেনোই বা সে এত গভীর চুমুতে আবদ্ধ এই ভেজা চুলের মেয়েটির সাথে?
#ভেজা_চুলে
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্ব-৩
“বাসর ঘরে ঢুকে অর্ণির জন্য ওয়াহেদের প্রথম কথাই ছিল,
“এই তুমি কামিজের সাথে পেটিকোট পরেছো কেনো?”
ওয়াহেদের কথায় তার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অর্ণি।
এমন কথাও কেউ বলতে পারে?একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অর্ণি বলল,
“এটা পেটিকোট না।এটা প্লাজো।”
“দেখতে তো একদম পেটিকোটের মতোন লাগছে।”
“পেটিকোটের মতোন লাগলেও এটা পেটিকোট না।”
“এটার পিছনে অবশ্যই ইতিহাস আছে। আচ্ছা বলো দেখি এই পোশাকের পিছনের ইতিহাস।”
অর্ণির ইচ্ছে করছে দৌড়ে এখান থেকে পালিয়ে যেতে। কোন কপালে সে এই ইতিহাস এর প্রফেসর কে বিয়ে করবে বলে মত দিয়েছিল? এখন কী তাকে সারা জীবন পরীক্ষা দিয়ে যেতে হবে?
আচ্ছা একটু পরে তো সে আবার জিজ্ঞেস করবে না? বাসর রাতের পিছনের ইতিহাস কী?
“কী হলো? বলো, না কী জানো না?”
“হুম?হুম!”
“প্রথমেই ধরতে পেরেছিলাম পারো না।আচ্ছা তোমার প্রিয় সাবজেক্ট কী?”
“উম?হুম!”
অর্ণির মনে হচ্ছে সে ভাইবা বোর্ডে পরীক্ষা দিচ্ছে।পাশে থাকা এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে গিলে অর্ণি পাশের টেবিলে গ্লাস রেখে বলল,
“১৯৩০-১৯৪০ সালের দিকে অ্যাভান্ট-গার্ডি ফ্যাশনের এই পোশাক বেশ পরিচিতি লাভ করে। তৎকালীন বিখ্যাত কিছু অভিনেত্রী এই পোশাক পরিধান করেছিলেন।১৯৬০ দশকের শেষ এবং ১৯৭০ এর গোড়ার দিকে এটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠে। মাঝে ভাটা পড়েছিল তবে ইদানীং কালে আবার বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে৷”
“বাহ্ বেশ জানো’ত। এবার বলো। তুমি কী শিউর? ১৯৩০ দশকের দিকেই এর উদ্ভাবন হয়? ”
অর্ণির ইচ্ছে হচ্ছে খাট টা উঠিয়ে সামনে বসে থাকা এই স্বামী নামক যন্ত্রের মাথায় একটা দিতে।
ভাইবা এক্সাম হচ্ছে না কী?
“জানি না। দয়া করুন। আমি ঘুমাবো।”
“এই তোমাদের মত ছাত্রীদের এক দোষ। পড়া না পারলেই বাহানা।না জানলে শিখতে পারবে না।”
“হুম।বলুন শুনছি।”
এই বলে অর্ণি বালিশ হেলান দিয়ে বসে। আর ওয়াহেদ হাত নেড়ে এমন ভাবে কথা বলছিল যেন সে ক্লাস নিচ্ছে খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
“বুঝলে তুমি ঠিক বলোনি।এর শুরু মূলত ১৯২০ সালে। ১৯২০ সালে ফরাসি ফ্যাশন ডিজাইনার ও শ্যানেল ব্র্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা কোকো শ্যানেলের হাত ধরে উপরে চাপা নীচে ঢোলা প্যান্ট প্রথম জনপ্রিয়তা পায়।তারপর……..
এটুক বলে ওয়াহেদ অর্ণির দিকে তাকিয়ে দেখল অর্ণি ঘুমিয়েছে। ততক্ষণে তার মনে হলো
” এ’ত তার সদ্য বিয়ে করা বউ।কোনো ছাত্রী নয়।আহারে বেচারি।”
তারপর তার গায়ে কাথা টেনে দিয়ে, কপালে আলতো চুমু খেলো ওয়াহেদ। আর অর্ণি? সে যেন এই বৃষ্টির রাতে হালকা উষ্ণতা পেয়ে সেধিয়ে গেলো ওয়াহেদের বুকে।
“আপনাকে যদি আমি ল্যাডা ব্যাঙ বলে ডাকি তাহলে কী আপনি রাগ করবেন?”
“আপনাকে যদি আমি ধানী লংকা বলে ডাকি তাহলে কী আপনি রাগ করবেন?”
ইনহান এবং মাধুর্য একে অপরের কথায় হেসে উঠলো।
সকাল সকাল ইনহান বেরিয়েছিল গ্রাম দেখতে। শহরে জীবনে সে বেশ ক্লান্ত। লেখাপড়া শেষ করে ইচ্ছে ছিল স্বাধীন জীবনের। তা আর হলো কই?বড় আপুর হঠাৎ মৃত্যুতে মা ভেঙে পড়লেন,বাবাও এক প্রকার অসুস্থ। একমাত্র ছেলে হিসেবে বোনের তিলতিল করে গড়ে তোলা শাড়ির বিজনেস তাকেই হাতে নিতে হলো।এসবের মাঝে নিজেকে নিয়ে ভাবার কোনো সময় আর কোথায়। ব্যবসা বাকী সময় মা-বাবা। ব্যক্তিগত জীবন বলতে কিছুই নেই৷ কারণ কেউ সম্পর্কে আগায় না যখন শুনতে হয় তাকে দায়িত্ব নিতে হবে তার মানসিক ভাবে অসুস্থ মায়ের।
সকালে যখন হাটছিল দূর থেকে কালো শাড়ির সেই মেয়েকে দেখতে পায়। হাতে তার অনেকগুলো কুমড়োর হলুদ ফুল।
ফুল তুলছে আর পাশে ঝুড়িতে রাখছে।
ইনহান এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“মাধুর্য নামটা ছেলে ছেলে মনে হয় না?”
তার দিকে না তাকিয়েই মাধুর্য জবাব দিলো,
“ইনহান?এ আবার কেমন নাম?গ্রামের মানুষ বলে
এই হানে আন মানে এখানে আনো। সেই থেকেই ইনহান?”
ইনহান একটা ফুল তুলতে তুলতে বলল,
“আপু নাম রেখেছিল ইহান তবে ডাকতো ইনহান বলে। কেনো জানি না।”
“তো এখন জেনে আসুন।কল দিয়ে জেনে নিন।”
“পরপারে ফোন নেই। থাকলে জেনে নিতাম।”
“দুঃখিত।”
“সমস্যা নেই। আপনি তো জানতেন না।”
কথা বলতে বলতে ওরা বাড়ির কাছাকাছি আসতেই দেখতে পায়,
ওয়াহেদ বসে আছে মুখ গোমড়া করে পাশে তার অনেক গুলো শালিকা। যারা তাকে নাস্তানাবুদ করে রেখেছে। এদের মধ্যে খুশবু জিজ্ঞেস করছে
“দুলাভাই? বাত্তি নিভাইয়া গান কে গাইলো?আপনি?না।আপু?”
ওয়াহেদ বলল,
“তোমরা বড্ড ইঁচড়েপাকা। জানো কতটা সংগীত সম্পর্কে?”
পত্রী হাসতে হাসতে জবাব দিলো
“যতটা আপনাদের ল্যাডা ব্যাঙ দল জানেন কিপ্টামি করতে। আজ আমাদের টাকা শোধ না করতে পারলে আপনার ব্রাশ করা, খাওয়া, ঘুম সব বাদ। আপনার অন্য ব্যাঙ কুমারদের এক অবস্থাই হবে। হুহ্।”
“আমার বৌ আমি নিবো। টাকা কেনো দিবো?”
“আমার বোন খালি খালি ক্যান দিবো?পয়সা ছাড়ো তামাশা দেখো।”
ওয়াহেদ মনে মনে ভাবতে লাগলো,
“এই জন্য বোধ হয় মানুষ ফেসবুকে পোস্ট করে
” পুরুষের দুই জাত। জীবিত আর বিবাহিত।”
চলবে