ভুল সত্য পর্ব-১০

0
299

ভুল সত্য

১০

বাড়ীর পরিবেশ বেশ থমথমে। রাত এগারোটা বেজে গেছে এখনো কারো খাওয়া হয়নি। আমার শাশুড়ি সাধারণত সারে নয়টার দিকে আমাকে ডাকেন। আমি খাবার গরম করে দিলে দশটা নাগাদ আমরা তিনজন খেতে বসি। দুপুরে মুকুল থাকে না বলে রাতের খাবারটা সবাই একসঙ্গে খাই। এটাই নিয়ম। কিন্তু আজ তার ব্যতিক্রম হল। আমি কয়েকবার নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে দেখলাম তার ঘরের দরজা বন্ধ। দশটা নাগাদ একবার শেষ চেষ্টা করলাম। ভয়ে ভয়ে তার ঘরের দরজা ধাক্কা দিলাম। ভেতর থেকে বাজখাই কন্ঠ ভেসে এল
কে?
আমি মিনমিন করে বললাম
আমি
জ্বালাইতাস কেন? বিদাই হও।
খাবেন না?
ওই গুয়ের খাওন খাইতে চাই না। তোমরা খাও।
বুঝলাম নাজু আপার খাওয়ার বর্ণনা দেয়া হচ্ছে। তবু আমি শেষ চেষ্টা করতে বললাম
আমি রান্না করে দিচ্ছি, খেয়ে নিন।
রাইত বিরাইতে রং দেহায়ো না। কাইককা থেকা রাইন্দো, খামু নে।
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। হঠাত করে আমার রান্না অমৃত সুধা হয়ে গেল কি করে বুঝলাম না। যাই হোক এই সরাবান তহুরাই কাল থেকে তাকে খাওয়াবো এই প্রতিজ্ঞা করে ঘরে ফিরে এলাম।

ঘরে ফিরে এসে ঘুমানোর আয়োজন করতে লাগলাম। মুকুল প্রতিদিন রাতের খাবারের পর ছদে গিয়ে সিগারেট খায়। আজ সন্ধ্যা থকেই ছাদে গিয়ে বসে আছে। ভালোই হয়েছে। ও আসার আগে ঘুমিয়ে পরতে পারলেই রক্ষা। অনেকক্ষণ এপাশ ওপাশ করলাম ঘুম এল না। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বোধহয় বৃষ্টি নামবে। বাতাসে ঠান্ডা ভাব। একটু ঝরের আভাস ও পেলাম। জানালার কপাট শব্দ করে আছড়ে পড়ছে। আমি উঠে জানালা বন্ধ করে ঘড়ি দেখলাম। সোয়া এগারোটা। মুকুলের এখনো নামার কোন লক্ষণ নেই। আবার ঝর জলে ঠাণ্ডা জর বাধানোর ধান্দা। ভালো লাগে না আর। কি দরকার এই সব করার। রাত হয়েছে নেমে এলেই হয়। মা ছেলে দুইজন মিলেই জালিয়ে মারল।

আমি আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে গেলাম। মুকুলকে দেখা যাচ্ছে রেলিঙ ধরে ঝুকে দাড়িয়ে আছে। হাতে জলন্ত সিগারেট। আমাকে দেখে ও কেমন চমকে উঠল। কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল
তুমি এখানে?
আজ রাতে কি এখানেই থাকবেন?
আমার কথা শুনে ও হেসে ফেলল। বলল
থাকতে পারলে তো ভালোই হত
থাকতে চাইলে বলেন, বিছানা করে দেই
মুকুল কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না। নিজেকে সংযত করে নিল। তারপর বলল
তুমি রাতে খেয়েছ?
না। আপনাকে খাবার কথা জিজ্ঞেস করতেই এলাম
আমার আর খেতে ইচ্ছা করছে না। তুমি খেয়ে শুয়ে পর
চা খাবেন?
মুকুল একটু অবাক হয়ে বলল
চা?
হ্য। নাম শোনেননি আগে?
তুমি খাবে?
খাওয়া যায়
এবার আমাকে অবাক করে দিয়ে ও চিলেকোঠার ঘরের দরজা খুলল। আমি উকি দিয়ে দেখলাম। ঘরের ভেতর পুরানো সাইকেল থেকে শুরু করে আলমারি বইয়ের তাক সবই আছে। অনেকগুলো ঝুড়ি ভর্তি খেলনা। বোধহয় এখানে ওর ছোটবেলার জিনিসপত্র রাখা। কোনার দিকের একটা ছোট টেবিলে একটা ইলেকট্রিক কেটলি আর চায়ের সরঞ্জাম। মুকুল দুই মগ চা বানিয়ে একটা আমার হাতে দিল। আমারা আবার ফিরে এসে রেলিং ঘেঁষে দারালাম।

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আমি চমকে গেলাম। এত ভালো চা অনেকদিন খাইনি।
মুকুল হালকা গলায় বলল
চা ঠিক আছে?
হু, খুব ভালো হয়েছে। আপনাকে কয়েকটা কথা বলব
বলো
আমার জন্য এত ঝামেলা নেয়ার দরকার নেই
কি ঝামেলা?
আমার মাস্টার্স করা নিয়ে বাড়িতে অহেতুক ঝামেলা হচ্ছে। এত ঝামেলা করে আমি পড়াশোনা করতে চাই না
মুকুল এতক্ষণ বেশ মন দিয়ে আমার কথা শুনছিল এবার স্কুলের মাস্টারদের মতন বোঝানোর ভঙ্গিতে বলল
বিষয়টা মাস্টার্সের না। পুরো সেট আপটা ঠিক হওয়া দরকার। এখন তুমি ক্লাসে যাচ্ছ এটা নিয়ে সমস্যা হচ্ছে এরপর পাশ করে চাকরি করবে তখন আবার একই পরিস্থিতি হবে। এর চেয়ে বরং এখনই সব………
চাকরি? আমি চাকরি করব?
কেন? তুমি চাকরি করতে চাও না?
মুকুল আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি কি জবাব দেব বুঝতে পারছি না। এসব নিয়ে অনেক বছর কারো সঙ্গে কথা হয় না। কথা বলতে ইচ্ছা ও করে না। মনবিজ্ঞান নিয়ে পড়াটা আমার শখ ছিল। ক্যরিয়ারের কথা চিন্তা করলে হয়ত অন্য কোন বিষয় নিয়ে পড়তাম। বরাবরই আমার অন্য কিছু করার ইচ্ছা কিন্তু এই নিয়ে কখনো কারো সঙ্গে আলাপ হয়নি। শুধু একবার একজনের সঙ্গেই কথা হয়েছিল।
আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে মুকুল আবারো বলল
তুমি কি চাকরি না করে অন্য কিছু করতে চাও?
জি
সেটা কি? কোন রকম বিজনেস?
অনেকটা সেই রকমই
ও কৌতূহল নিয়ে বলল
কি রকম?
আমার হঠাত করেই আজ কেন যেন ওকে সবটা বলতে ইচ্ছা হল
আমার আসলে খুব শখ একটা রুফটপ রেস্টুরেন্ট করার। ঠিক রেস্টুরেন্ট না, কফিশপ বা চা বার বলতে পারেন।
মুকুল চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল
ইন্টারেস্টিং! কি রকম বলতো
ছাদের উপর একপাশে ছাউনি দিয়ে রান্নার ব্যবস্থা থাকবে। চা, সিঙ্গারা, লুচি আলুর দম, পিয়াজু, ছোলা ঝালমুড়ি এই সব দেশীয় খাবার পাওয়া যাবে। মাটির পাত্রে সব খাবার দেয়া হবে।
বাহ! এটা তো খুবই ভালো আইডিয়া।
আমার কেমন একটু লজ্জা করতে লাগল। মুকুল আমার সব ছেলেমানুষি ইচ্ছে গুলোকে অনেক গুরুত্ব সহকারে নেয়। ও আবারো বলল
তুমি আগে পড়াশোনা শেষ কর তারপর আমারা এটা নিয়ে কাজ শুরু করব।
কি কাজ?
লোনের ব্যবস্থা করতে হবে, লোকেশন দেখতে হবে। আমি তোমার জন্য চমৎকার একটা বিজনেস প্ল্যন করে দেব কেমন?

মুকুল আরো কিসব যেন বলছে। আমি কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। আমার সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। বহুবছর আগে ঠিক এই কথাগুলোই কেউ আমাকে বলেছিল। সেই ভয়াবহ স্মৃতি হঠাত করেই বহুবছর পর ফিরে এসেছে।

তখন আমি সবে ক্লাস এইটে উঠেছি। স্কুলে ক্লাস সেইভাবে শুরু হয়নি বলে হাতে অফুরন্ত সময়। বাবা কদিন আগে আমাকে একটা ছোট ইলেকট্রিক অভেন কিনে দিয়েছে। আমি প্রতিদিনই কেক পিজা ব্রাউনি সহ নানান মজার মজার খাবার বানাচ্ছি। চুলা না জালিয়ে মাইক্রো ওয়েভে চা বানাচ্ছি। আমার রান্নার সবচেয়ে বড় ভক্ত আশরাফ চাচা প্রতিদিনই বাড়িতে আসতেন। সময় অসময়ে তার চলে আসাটা নতুন কিছু না। উনি বাবার কলেজের বন্ধু। একই মেডিকেল থেকে দুজনে পাশ করেছেন। বাবা ঢাকা মেডিকেলে কাজ করেন আর উনি মিডফোরড হাসপাতালে। প্রায় প্রতিদিনই সন্ধ্যা বেলা চাচা চলে আসতেন। সেদিন সকাল সকালই চলে এসেছিলেন। মা ততখনে স্কুলে বেরিয়ে গেছে। বাবাও যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। চাচাকে বলাতে উনি বললেন চা খেয়ে বের হবেন। বাবাও বেরিয়ে গেল। আমি তাকে পিরিচে করে ব্রাউনি দিলাম। উনি মুখে দিয়ে আয়েশে চোখ বুজে বললেন
দারুণ! চা দেবে না প্রিন্সেস?
আমি মাইক্রো ওয়েভে চা বসিয়ে ফিরে এসে দেখলাম উনি মজা করে ব্রাউনি খাচ্ছেন। আমাকে দেখে বড় সোফাটার একপাশে সরে গিয়ে আমাকে বসার জায়গা করে দিলেন। আমি একটু অস্বস্তি নিয়ে বসলাম। চাচা হঠাত করেই আমার গাঁ ঘেঁষে বসে এক হাতে কোমর জড়িয়ে ধরলেন। আমার সমস্ত শরীর কাঠ হয়ে গেল। আমি আমার পাজরে তার আঙ্গুলের নড়াচড়া টের পাচ্ছিলাম। হঠাত করেই ভীষণ কান্না পেল। ঠিক যে মুহূর্তে টের পেলাম তার হাত উপরের দিকে উঠছে আমি কান্নাটা গিলে ফেলে ঝট করে উঠে দাঁড়ালাম তারপর মধুর হাসি দিয়ে বললাম
চা টা নিয়ে আসি?
উনি চোখ টিপে ইশারায় বোঝালেন ঠিক আছে।
আমি দ্রুতই চা নিয়ে ফিরে এলাম। আশরাফ চাচা হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। আমি মগটা উনির হাতে না দিয়ে ফুটন্ত চা টা উনার প্যন্টের উপর যায়গা মত ঢেলে দিলাম। উনি বাবা গো মাগো বলে চিৎকার করে উঠলেন। আমি এই সুযোগে মগটাও সেখানে ফেলে দৌড়ে বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। ভেতর থেকে শুনছি উনি সমানে চিৎকার করে যাচ্ছেন। অকথ্য ভাষায় আমাকে যা নয় তাই বলে যাচ্ছেন। বাথরুমের লাইটের সুইচ বাইরের দিকে। তাড়াহুড়ায় লাইট জালাতে ভুলে গেছি। বাইরে তখনো উনি একইভেবে গর্জন করে যাচ্ছেন। ভয়ে আমার সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। মনে হচ্ছে এই বোধহয় উনি দরজা ভেঙে ভেতরে এসে আমার উপর ঝাপিয়ে পরবেন।

আমি অজ্ঞান হলাম না। স্পষ্ট চেতনা নিয়ে ভয়ে কাঠ হয়ে ভেতরে বসে রইলাম। বাইরের শব্দ বন্ধ হয়ে যাবার পরেও দরজা খোলার সাহস পেলাম না। এরও প্রায় চার পাঁচ ঘন্টা পর বাবা মা এসে আমাকে ভেতর থেকে বের করল। আমি দৌড়ে গিয়ে মায়ের বুকের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলাম। এতক্ষণে মনে হল আমি বোধহয় জ্ঞান হারাচ্ছি। মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল
কিচ্ছু হয়নি, কিচ্ছু হবে না। আমি আছি তো
আমি মুখ তুলে মায়ের চেহারাটা দেখার চেষ্টা করতে লাগলাম। মাকে এত অচেনা লাগছে কেন? এতো মা নয়, অন্য কেউ। তবে যেই হোক তার চোখেও মায়ের মতই গভীর মায়া। সে দুই হাতে আমাকে বুকের মধ্যে টেনে নিল। আমি তাকে চিনতে পারার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম।

চলবে………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে