ভুল সত্য পর্ব-০৪

0
348

ভুল সত্য

৪.

তুলি, এই তুলি। কি হয়েছে? এমন করছ কেন?

আমি চোখ মেলে তাকালাম। আমার মুখের ওপর যে মানুষটা ঝুকে আছে তার দৃষ্টি ভয়ার্ত। আমি তাকিয়ে রইলাম। খুব চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু তার তাকিয়ে থাকার ধরনটা ভীষন অচেনা। আমি প্রায়শই দুঃস্বপ্ন দেখে ভয়ে চিৎকার করে জেগে উঠি। চোখ মেলে নানান সময় অনেককেই দেখেছি। তাদের দৃষ্টি অন্য রকম। আজ যাকে দেখছি তার মতো নয়। ওর চখে ভয়, বিস্ময়কে ছাপিয়ে আছে এক গভীর মমতা। সে কিছু বলছে। আমি শুনতে পারছি না। মাথায় ভিতর অজস্র মৌমাছি ভনভন করছে। ওর কথা গুলো দেখতে পাচ্ছি। বর্ণ গুলো ঘরের বাতাসে ইতস্তত ভেসে বেড়াচ্ছে। কিছু কিছু বর্ণ জুড়ে আবার শব্দ তৈরী হচ্ছে কিন্তু এলোমেলো শব্দগুলো জুড়ে বাক্য তৈরী করতে পারছি না। আমি সেই চেষ্টা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। ঘুমের ঘোরে টের পেলাম কেউ একজন আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আমি চেষ্টা করেও সেই স্পর্শ এড়িয়ে যেতে পারলাম না কিংবা বলা ভালো চাইলাম না।

সারারাত এলোমেলো স্বপ্ন দেখলাম। ভাঙ্গা ভাঙ্গা, টুকরো টুকরো, ছাড়া ছাড়া স্বপ্ন কিন্তু প্রতিটাই অত্যন্ত বীভৎস। ধূসর আকাশ আর বালুকাময় প্রান্তর। আমি প্রাণপণ চিৎকার করছি। আশেপাশে কেউ নেই। কতগুলো বীভৎস প্রানী আমার দিকে এগিয়ে আসছে ধীর গতিতে। তাদের তিন জোড়া পা। মাথায় বিশাল এন্টেনা কিন্তু মুখ গুলো মানুষের মত। সেই মুখগুলো আমার ভীষণ চেনা। তাদের ঠোটের কোল বেয়ে কষ গড়াচ্ছে। কিছুক্ষণ পরপর তাদের লকলকে জিভ বেরিয়ে আসছে, সেই জিভের ডগাটা চেড়া, অনেকটা সাপের মতন। আমি থেকে থেকে শিউরে উঠছি। চেষ্টা করেও এক পা নড়তে পারছি না। আমার পেছনে গভীর খাঁদ। আর এক পা পিছালেই……

আমি হুড়মুড় করে উঠে বসলাম। সমস্ত ঘর জুড়ে রোদের হুটোপুটি। আমি চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম। প্রথমটায় ঠিক চিনতে পারলাম না। আমি সাধারনত নিজের ঘরটা অন্ধকার করে রাখতাম। জানালায় ভারী পর্দা দেয়া থাকত। এমনিতেও আমার ঘরটা ছিল পশ্চিম কোনে। আর এই ঘরটা বোধহয় দক্ষিণ পূর্ব কোনে। বিকেলের দিকে বেশ ঠান্ডা বাতাস দেয় আর সকাল হলেই রোদ।

আমি আশেপাশে কোথাও মুকুলকে দেখতে পেলাম না। মাটিতে পা ফেলতে গিয়ে টের পেলাম শরীর খুব ভারী মনে হচ্ছে। মধ্যাকর্ষণ আমার উপর ভীষণভাবে চেপে বসেছে। কষ্ট করে উঠে দাঁড়িয়েছি তখন দেখলাম মুকুল দরজা ঠেলের ভেতরে ঢুকছে। আমাকে উঠতে দেখে এগিয়ে এসে বলল
তুমি ঠিক আছো তুলি?

আমি জবাব না দিয়ে আস্তে করে মাথা নেড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলাম। সাধারণত এরকম একটা দুঃস্বপ্নময় রাতের পর আমার প্রচন্ড মাথা ব্যথা করে। আমি তখন শাওয়ার খুলে অনেকক্ষণ নিচে দাঁড়িয়ে থাকি। আজ ও তাই করলাম। যতক্ষণ না শরীরে কাঁপুনি ধরে গেল দাড়িয়েই রইলাম। এরপর খেয়াল হল জামা কাপড় নিতে ভুলে গেছি; এমনকি একটা তোয়ালে পর্যন্ত নেই। আমি বোকার মত এদিক ওদিক তাকালাম। নিজের বাসায় হর হামেশাই এমন হত; কারন আমি ঘরের দরজা লক করে গোসল করি। একবার গোসল শেষে বেরিয়ে দেখেছিলাম আশরাফ আঙ্কেল ঘরে বসে আছেন। আমাকে দেখে একান ওকান হাসি হেসে বলেছিলেন
প্রিন্সেসকে তো আজ জলপরীর মতো লাগছে।
এরপর থেকে এই ব্যবস্থা নিয়েছিলাম। সে যাই হোক, কিন্তু এখানে কি করব? আমি ভেজা কাপড়ে দরজা খুলে উকি দিয়ে ঘরে কাউকে দেখতে পেলাম না। একটু জোড়েই বললাম
কেউ আছেন? একটু দরকার
মুকুল হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকল। দরজার কাছের পাপোষে পা পিছলে আবার ড্রেসিং টেবিলের কোনা ধরে কোনমতে সামলে ও নিল। এমন অবস্থাতেও আমি না হেসে পারলাম না। ও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল
কি? জামাকাপড় নিতে ভুলে গেছ?
হু
মুকুল আর কথা না বাড়িয়ে জামা কাপড় তোয়ালে সব আমার হাতে দিয়ে মাথা নিচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। যাবার সময় আবার দরজাটা বাইরে থেকে টেনে বন্ধ করেও দিয়ে গেল। আমি একটু দুশ্চিন্তায় পরে গিয়েছিলাম। সাধারণত নববিবাহিত দম্পতিদের ক্ষেত্রে এ ধরনের দৃশ্য খুব সাধারণ। নাটক সিনেমায় অনেক দেখেছি। নায়ক নিজেও দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে সাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে পড়ে। কিছু প্রেমময় দৃশ্যের অবতারণা হয়। এরপর হঠাৎ করেই নায়ক-নায়িকাকে দেখা যায় তুষারাবৃত পাহাড়ের উপর নাচানাচি করতে। একদিকে নায়িকা হার কাঁপানো ঠান্ডার মধ্যেই শিফনের শাড়ির আঁচল উড়িয়ে কোমর দুলিয়ে নাচতে থাকে অন্যদিকে নায়কও গলায় সোয়েটার বেঁধে তার আশেপাশে লম্ফঝম্প করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

আমাদের ক্ষেত্রে তেমন কিছুই হলো না। আমি তড়িঘড়ি পোশাক পাল্টে নিচে চলে গেলাম।। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলাম। কি সর্বনাশ! রেবার মানে আমার না সকালে নাস্তা বানানোর কথা।
নিচের পরিবেশ বেশ থমথমে। মুকুলকে দেখলাম নাস্তার টেবিলে প্লেট সাজাচ্ছে। আমার শাশুড়ি রান্নাঘরে ব্লেন্ডারে কিছু ব্লেন্ড করছে। এত সকালবেলা ব্লেন্ডারে কি ব্লেন্ড করছে ঠিক বুঝতে পারলাম না। সাতসকালে ফ্রুট স্মুদি খাওয়ার মত আধুনিক ওনাকে আমার মনে হয়নি। যদিও যখন বেরিয়ে এলেন আমি পরাজয় মেনে নিলাম শতভাগ। উনাকে যতটা আধুনিক ভেবেছিলাম উনি তার থেকেও বেশি আধুনিক। উনার হাতের ছোট্ট ট্রেটাতে এক কাপ বুলেট কফি। গতকাল সকালে উনাকে ডিম সিদ্ধ, বাদাম ভাজা আর শসা খেতে দেখেছিলাম। তখন বুঝতে পারিনি আজ ব্যাপারটা ক্লিয়ার হল। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুকুল বলল

বসে পড়ো তুলি

আমি ওর পাশের চেয়ারটাতে বসে পড়লাম আমার শাশুড়ির মুখোমুখি। উনি চোখ তুলে আমার দিকে তাকলেন ও না। বুঝলাম এই মৌনতা ঝড়ের পূর্বাভাস। যাক ঝড় যখন আসবে দেখা যাবে ; আপাতত ঝরের আগের সুশীতল বাতাস উপভোগ করি। মুকুল নিজে থেকেই বলল

স্টার কাবাব থেকে নান রুটি আর নেহারি এনেছি,বুঝেছো। সঙ্গে ডাল সবজি ও আছে। তোমাকে কি দেব?
সবই দিন।
আমার শাশুড়ি একবার চোখ তুলে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য ভরে হাসলেন। আমি উনাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে খাবারে মনোযোগী হলাম। যা হবে দেখা যাবে। আমাকে আগ্রহ নিয়ে খেতে দেখে মুকুল বলল
ফিরনী ও এনেছি, খাবে?
অবশ্যই খাব। চা আনেননি?
এনেছি। ফ্লাস্কে আছে।
আমি দ্রুত ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে চুমুক দিলাম। আহ! এই মালাই চা ছাড়া সকালটা জমছিল না।

খাওয়া শেষে মা ছেলে দুজনেই উপরে চলে গেল। আমি টেবিলে গুছিয়ে রেখে আরেক কাপ চা ঢেলে নিলাম। একটু পরে মুকুল নেমে এসে বলল
আমাকে আজকে অফিসে যেতে হবে। আসলে তিন দিনের ছুটিই পেয়েছিলাম। তবে আজ বৃহস্পতিবার তাড়াতাড়ি চলে আসতে পারবো।
আমি আস্তে করে জানতে চাইলাম
কখন আসবেন?

আড়াইটার মধ্যে চলে আসব। একসঙ্গে লাঞ্চ করবো। কেমন?
আমি মাথা নিচু করে ঘাড় কাত করলাম
মুকুল চলে যাবার ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যেই আমার শাশুড়ি নিচে নেমে এলেন। যা ভেবেছিলাম তাই। কদিন ধরে পোলাও কোরমা খাওয়া হচ্ছে তাই আজ স্বাস্থ্যকর কিছু রান্না করার ফরমাইস জারি করা হলো। রান্নাঘরে ঢুকে দেখলাম টাটকা বাজার আনা হয়েছে। রান্নার মেনু দেয়া হয়ে গেছে
১ শোল মাছ দিয়ে লাউ
২ বেগুন ভর্তা
৩ পটল ভাজি
৪ পটলের খোসা দিয়ে চিংড়ি মাছের ভর্তা
৫ সাদা ভাত
৬ ঘন করে মুগ ডাল

আমি বিগলিত স্বরে জিজ্ঞেস করলাম, স্যলাড করবো না?
উনি ভাবলেশহীন মুখ করে বললেন, মন চাইলে করবা।

রান্নাঘরে এসে ঘড়ি দেখলাম। সাড়ে নটা বাজে। এই রান্না গুলো করতে আমার বড়জোর তিন ঘন্টা লাগবে। সাথে কোন হেল্পিং হ্যন্ড নেই, তাই সময় আর একটু বেশি লাগতে পারে।
আমি মনে মনে একটু হাসলাম। এই ভদ্রমহিলা বোধহয় আমার ব্যাপারে ভালো মতন খোঁজখবর নেননি। ছোটবেলা থেকেই বাবা-মা দুজনেই চাকরি করতেন বলে রান্না বান্না করার ভালই অভ্যাস হয়েছে আমার। তাছাড়া রান্না করাটা আমার কাছে শখের একটা কাজ। বেলা দুইটার মধ্যেই সব রেডি করে টেবিলে দিয়ে দিলাম।

এরপর তাড়াতাড়ি উপরে গিয়ে পোশাক পাল্টে একটা পুরনো রঙ চটে যাওয়া সুতির জামা পরে নিলাম। রেবা আমাকে সেদিন বলেছিল মপ দিয়ে ঘর মোছা হয়। আমি ইচ্ছা করেই ন্যাকড়া বালতি নিয়ে নিচের হল ঘরটা মুছতে আরম্ভ করলাম।

দরজায় তালা খোলার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। মুকুল ভেতরে ঢুকে থমকে দাঁড়ালো। আমার অসম্ভব আফসোস হচ্ছে। কেন আমার মাছির মতো অনেক গুলো চোখ হল না? মুকুলের হতভম্ব মুখটা দেখতে ভীষণ ইচ্ছা করছে।

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে