#ভুল
২+৩
#jannat_Nur
২য় পর্ব
সুফিয়া বেগম অনেকক্ষণ ধরে অঝোরে কান্না করলেন তার মনে আজ পাহাড়সম কষ্ট হচ্ছে। যে স্বামী তাকে এত ভালোবাসতো সেই স্বামী আজ তাকে নষ্টা দুশ্চরিত্রা বলে গালি দিলো! ভাই-বোনদের কথা বিশ্বাস করল। সে তার স্ত্রী সাথে অনেক বছর সংসার করা সত্ত্বেও আজকে আমিরুল ইসলাম তাকে বিশ্বাস করে নাই বিধায় সুফিয়া বেগমের কষ্টটা বেশি হচ্ছে। মায়ের কান্না দেখে শিশু ছেলে সিরাত এদিক ওদিক তাকাচ্ছে আর ভাবছে তার মা কেন এত কান্না করছে। অনেকক্ষণ ধরে তাকে সুফিয়া বেগম কোলে নিচ্ছেন না। সিরাত আস্তে আস্তে মায়ের কাছে গেল, মায়ের কোলের উপর বসে চোখের পানি মুছে দিচ্ছে হাত দিয়ে। ছোট্ট শিশুর হাতের ছোঁয়া পেয়ে সুফিয়া বেগম আরো জোরে কান্না করে দিলেন। ছেলেকে বুকের সাথে জড়িয়ে বলতে শুরু করলো, বাবারে তোর মা কখনো কোন অন্যায় করেনি! তোর মা নির্দোষ। কেন আমার নামে তারা এরকম বদনাম ছড়াচ্ছে, তোর বাবা বলছে দেশে এসে আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দেবে। আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিলে তোকে তো রেখে দিবে! তোকে ছাড়া আমি বাঁচবো কিভাবে, এই দুনিয়াতে একমাত্র তুই আমার ভরসা আমি কখনো তোকে ছাড়া বাঁচবো না! আমি মরে যাব, না হয় পাগল হয়ে যাবো তোকে ছাড়া। কথাগুলো বলছে আর সিরাতের কপালে চুমু খাচ্ছে সুফিয়া বেগম। ছেলেকে হারাতে হবে এটা ভাবতে সুফিয়া বেগমের কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছে। কি করে সে স্বামীকে বুঝাবে সে কোন পাপ করেনি, সবকিছু তার বিরুদ্ধে বানোয়াট। সুফিয়া বেগমের মনে হল শাশুড়ির কথা, সে তো অনেক বছর ধরে শাশুড়িকে সেবা যত্ন করে আসছে! শাশুড়ি মাকে গিয়ে বুঝালে তার ছেলেকে যদি বলে তার ছেলে মায়ের কথা রাখতে পারে। সিরাতকে কোলে নিয়ে সুফিয়া বেগম শাশুড়ি মায়ের রুমে গেল, শাশুড়ি মায়ের কানে আগেই কথাটা তুলে দিয়ে আসছে তার ছোট মেয়ে রুমা। যখন সুফিয়া বেগম তার শাশুড়ির কাছে গিয়ে বসলো, শাশুড়ি তার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল তার বড় ছেলের বউ অনেক কান্নাকাটি করেছে! চোখ একদম ফোলে গিয়েছে। সুফিয়া বেগমের শাশুড়ি বললেন, বৌমা আমি শুনেছি কালকে রাতের ঘটনা আর আজকে আমাদের বাড়িতে চেয়ারম্যান সাহেবকে ডাকা হয়েছিল। আমাদের বাড়িতে অন্য কেউ এসে বিচার করবে এটা কখনো আমি ভাবতে পারিনি, তোমার শ্বশুর থাকলে এটা সহ্য করতে পারত না।
মা আমি কোন অন্যায় করিনি আমার ঘরে কোন পর পুরুষ ঢোকেনি! এগুলো বানোয়াট, কিসের জন্য দুলাভাই এমনটা বলছে আর সবাই নাকি দেখেছে একটা লোক আমার ঘরের সামনে থেকে বের হয়ে গিয়েছে। আমি কোন কিছু জানিনা আপনি বিশ্বাস করেন, আপনার ছেলেকে বলেছি সে বিশ্বাস করেনি! সে বলছে এসে আমাকে নাকি বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিবে। মা আমার দ্বারা কোন পাপ হয়নি, আপনি আমাকে বিশ্বাস করুন মা। আমাকে যদি তাড়িয়ে দেয় আমার ছেলেকে ছাড়া আমি বাঁচবো না মরে যাব।
শাশুড়ি মা বললেন তুমি আমার কাছে বস আগেই এত চিন্তিত হয়ো না! আমিরুল ইসলাম আসুক আমি তাকে বুঝিয়ে বলব, আমার কেন জানি বিশ্বাস হচ্ছে না তুমি এই কাজটা করতে পারো। হয়তো চোর আসতে পারে তোমার রুমের ওইদিকে থেকে বের হতে দেখেছে ঘরে ঢুকতে পারেনি। আর তারা সন্দেহ করে নিয়েছে অন্যকিছু। তুমি আমাকে যে আদর ভালোবাসা দিয়েছো তোমার মন আমি বুঝতে পারি, তোমার মনটা অনেক ভালো! তুমি এমন পাপ করতে পারো না। শাশুড়ীর কথায় সুফিয়া বেগমের মনে কিছুটা সান্ত্বনা আসলো। একজন তো তাকে বিশ্বাস করেছে আর তার শাশুড়ি যদি তার স্বামীকে বুঝিয়ে বলে হয়তো তার স্বামী থাকে এ বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিবেন না। এগুলো ভাবতে ভাবতে ছেলেকে নিয়ে তার রুমে গেল।
আজকে সারাদিন তার খাওয়া হয়নি এখন প্রায় সন্ধ্যা। কেউ একবার বলেনি তাকে খাবার খেতে। ধীর পায়ে সে রান্না ঘরের দিকে গেল খাবার নিয়ে আসতে। তখনই তার ছোট দেবরের বউ শাপলা এগিয়ে এসে বলল, ভাবী রান্না ঘরে কি করছেন? সুফিয়া বেগম বলল কি করছি মানে? সারাদিন আমি খাইনি আমাকে খিদা লাগে না নাকি। একবারও তো কেউ আমার খবর নিলে না।
আপনার খবর নেওয়ার জন্য কেউ প্রয়োজন বোধ করেনি। আর রান্নাঘরে ঢুকা আপনার নিষেধ।
তুমি কি বলতে চাও, আমি না খেয়ে থাকবো! নিষেধ কে দিয়েছে?
কে আবার দিবে মেজ ভাই সেজ ভাই।
তখনই সুফিয়া বেগমের সেজ দেবর এসে বললেন, ভাবী আপনার রুমে যান তুলি আপনাকে ভাত দিয়ে আসবে।
তুলি এই বাসার কাজের মেয়ে, তুলিকে দিয়ে সুফিয়া বেগমের জন্য ভাত পাঠিয়ে দেওয়া হলো। সুফিয়া বেগমকে রান্না ঘরে ঢুকতে দিলো না তার দেবর এবং দেবরের বউ। তুলি ভাত নিয়ে এসে রেখে বলল,
ভাবী আপনার সাথে ওরা যা করছে এটা মস্ত বড় অন্যায়! আমারও বিশ্বাস হচ্ছে না আপনি এমনটা করতে পারছেন। মানুষে এর চেয়ে কত কিছু অন্যায় করে তারপরেও কি তাকে না খাইয়ে রাখে? এই মানুষগুলো সারাদিন আপনাকে খাবার দিল না, খোঁজখবর নিল না। এদের জন্য আপনি কতটা বছর রান্না করলেন কত আদর যত্ন করে খাওয়ালেন আর শেষে কিনা আপনাকে নির্দয়ের মতো ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে।
সুফিয়া বেগম তুলি কে বলল থাক তুমি চুপ করে থাকো! আমার পক্ষ নিয়ে কথা বলছো শুনলে তোমাকে কাজ থেকে তাড়িয়ে দিবে।
তাড়িয়ে দিলে দিক আমি ভয় করিনা, অন্যখানে কাজ করে খাব! তবে এদের মতো মানুষের বাসায় চুপ করে থাকবো না। আপনার মত একজন ভালো মানুষের সাথে তারা এরকম ব্যবহার করছে।
আচ্ছা তুমি যাও আমি খাবার খাই খুব খিদে পেয়েছে, শরীরটা দুর্বল লাগছে।
সুফিয়া বেগমের কথা শুনে তুলি রুম থেকে বের হয়ে গেল। সুফিয়া সিরাতকে কাছে নিয়ে তার মুখে ভাত তুলে দিচ্ছে, সে নিজেও খাচ্ছে, আর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে, চোখের পানি মুছে আবার খাওয়া শুরু করছে। এমন দিন কখনো আসবে সে ভাবেনি, কত সম্মানের সহিত ছিল সে স্বামীর কাছে! এ সংসারের প্রতিটা মানুষ আজ তার বিরুদ্ধে, এলাকার মানুষ তাকে দুশ্চরিত্র বলে ভাবছে শুধু এই রফিকের কারণে। রফিকের ষড়যন্ত্রের কারণেই জীবনটা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে ভাবতে ভাবতে খাবার খাচ্ছে সুফিয়া বেগম।
সে শুধু ভয় পাচ্ছে তার ছেলেটাকে নিয়ে, যদি থাকে বাসা থেকে তাড়িয়ে দেয় তার একমাত্র সন্তান তাকে ছাড়া সে কিভাবে থাকবে।
চারদিন পরে আমিরুল ইসলাম চলে আসলো তার বাড়িতে। বাড়িতে আসার পর সুফিয়া বেগমের সাথে একটি কথাও বলছে না। স্বামীর কাছে গিয়ে বলল তুমি আমাকে যা নিয়ে কসম করতে বলো আমি কসম করতে পারবো আমি এমন মেয়ে না তুমি জানো! আমার বিরুদ্ধে এটা রফিকের ষড়যন্ত্র।
একদম চুপ থাকবে তুমি আমার বোন জামাইয়ের উপর মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছো! এখন সব দোষ চাপাতে চাচ্ছ রফিক মিয়ার উপর? কারণ সে দেখে ফেলেছে তাই দোষটা এখন তার হচ্ছে। এত চালাকি করবেনা আমার সাথে! আমি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাই হবে।
আমি তোমার সাথে চালাকি করছি না, মাস দেড়েক আগে রফিক আমার রুমে এসে আমার হাত ধরে ফেলে। আমাকে কুপ্রস্তাব দেয় আমি তার প্রস্তাবে রাজি হয়নি এবং অপমান করে তাড়িয়ে দেই। সেটার শোধ নিতেই রফিক মিয়া আজ আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছে।
আমিরুল ইসলাম এবার রেগে উঠলো,
এই তোকে না বলছি তুই আর একটা কথা বলবি না! তোকে যদি রফিক মিয়া আগে হাত ধরে থাকে কুপ্রস্তাব দিয়ে থাকে তুই আমাকে বললি না কেন? কেন বললি না! এখন যখন পর পুরুষের সাথে ধরা পড়েছিস এখন আমার বোন জামাইয়ের নাম দিচ্ছিস।
আগে কেন বলিনি সেটাই তো ভুল হয়েছে, এটাই আমার জীবনে মস্ত বড় ভুল। ভাবছিলাম যদি এটা তোমাদের বলি, রুমার সংসার ভেঙে যাবে। আমি ভাবছিলাম রফিককে যে কথা বলে অপমান করেছি তারপরে দ্বিতীয়বার সে এমন কাজ করবে না। কিন্তু তা হলো না, মিথ্যা অপবাদ দিয়ে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সর্বনাশ করে দিচ্ছে রফিক। তুমি বিশ্বাস করো আমি এমন করিনি।
আমিরুল ইসলাম সন্ধ্যার পর তার তিন ভাই, বোন জামাই ও বোনদের নিয়ে বসলো। রফিক মিয়াকে জিজ্ঞেস করল তুমি যা দেখেছো তা কি সত্যি? দেখো একদম মিথ্যা বলবে না। আমি যদি বুঝতে পারি তুমি মিথ্যা বলছো বা অন্যকিছু তাহলে তোমাকে আমি ছাড়বো না।
ভাইয়া আমি কেন মিথ্যা বলব আমার কি লাভ আপনার সংসার ভেঙে দিয়ে। আমি তখন বাথরুম যাবার জন্য উঠেছিলাম, দেখি ভাবীর রুম থেকে দরজা খুলে একজন বের হলো। আমি বললাম কে লোকটা তখন তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছিল! আমার একার কথা কেউ বিশ্বাস করবেন না তাই আমি সঙ্গে সঙ্গে রুমাকে ডাক দেই। রুমা উঠে দেখতে পারে লোকটা চলে যাচ্ছে! আমি দাঁড়িয়ে থেকে রুমাকে বললাম ভাইয়াদের ডাক দিতে। তারা তখন উঠে দেখে ওই বড় রাস্তার ওই পারে লোকটা দৌড়ে চলে যাচ্ছে। এখানে শুধু আমি নয় রুমা এবং মেজ ভাই সেজ ভাই দেখেছে।
আমিরুল ইসলাম তার ভাইদের জিজ্ঞেস করল, তোরা কি দেখেছিস সত্যি বলবি।
আমিরুল ইসলামের দুই ভাই বললো রুমা আমাদের ডাক দিলে লোকটা অনেক দূরে চলে গেছে, তখন আমাদেরকে দেখায় বলে ওই দেখ লোকটা চলে যাচ্ছে। আমরা তখন দুইজন তাকে ধরার জন্য গিয়েছিলাম কিন্তু ততক্ষণ এসে চলে গিয়েছে। আর আমাদের কি লাভ তোর বউয়ের নামে মিথ্যা বলে। তোর কি মনে হয় আমরা চাই তোর সংসারটা ভেঙে যায়? এতদিন পর তোর একটা ছেলে হয়েছে ছেলের বয়স মাত্র তিন বছর, এই ছেলেটা ইয়াতিম হোক এটা কি আমরা চাইবো নাকি। এখন তুই ভেবে দেখ যদি অসতী স্ত্রী নিয়ে সংসার করতে চাস করতে পারিস! কিন্তু আমরা কেউ তোর সঙ্গে থাকবো না, তোরা আলাদা থাকবি।
তোরা কি আমাকে পাগল পেয়েছিস আমি এমন স্ত্রী নিয়ে সংসার করবো। আমার ছেলের বয়স তিন বছর হয়েছে তো কি হয়েছে, আমি তাকে আমার কাছে নিয়ে রাখবো! আমি তাকে আয়া রেখে লালন পালন করব। তবু এমন কলঙ্কিনী মায়ের কাছে আমার ছেলেকে রেখে মানুষ করবো না। তাকে আমি কালকে ডিভোর্স দেবো।
আমিরুল ইসলামের কথা শোনার সাথে সাথে সুফিয়া বেগম এসে আমিরুল ইসলামের পায়ে জড়িয়ে ধরল।
না তুমি এটা করবেন না, তুমি আমাকে ছাড়তে পারো না। আমি কোথায় যাব? আমার বিরুদ্ধে এগুলো সব ষড়যন্ত্র! আমাকে সন্তানহারা করো না, তুমি আমাকে ডিভোর্স দিও না।
আমিরুল ইসলাম সুফিয়াকে ধাক্কা মেরে তার পা ছাড়িয়ে নিলো।
তুই কোথায় যাবি সেটা আমি জানিনা,আমি যা বলেছি তাই হবে।
সুফিয়া বেগম তখন কেঁদে কেঁদে শাশুড়ির কাছে গেলো। মা আপনি আপনার ছেলেকে বুঝান সে নাকি আমাকে ডিভোর্স দিবে, আমার ছেলেটা ইয়াতিম হয়ে যাবে! আমি কিন্তু মরে যাবো আমার ছেলেকে ছাড়া। নয়তো পাগল হয়ে যাব।
সুফিয়া বেগমের কান্না দেখে শাশুড়ি বলল আমার এই সোনার সংসারটায় কি একটা ঝামেলা শুরু হয়ে গেল! কেন এমন হলো বুঝতে পারছি না। সুফিয়ার শাশুড়ি তুলিকে বললেন, ছেলে আমিরুলকে ডেকে আনতে।
তুলি আমিরুলের কাছে গিয়ে বলল ভাইজান খালাম্মা আপনাকে ডাকছে, এখনই আপনাকে যেতে বলছে।
আচ্ছা তুই যা মাকে বল আমি আসতেছি।
কিছুক্ষণ পর আমিরুল ইসলাম তার মায়ের কাছে আসলো, মা তুমি আমাকে ডেকেছো?
দেখ বাবা তুই নিজের চোখে কিছু দেখিস নি, আমার মনে হয় না বৌমা এমন কিছু করছে! তুই তাকে ডিভোর্স দিস না। ছেলেটাকে এই বয়সে মা হারা করিস না,বৌমা অনেক ভালো।
সে অনেক ভালো এতদিন আমার এই বিশ্বাসটা ছিল! শুধু যদি একজন মানুষ দেখতো আমি না হয় বিশ্বাস করতাম না। রফিক পরের ছেলে কিন্তু আমার ভাই বোন তারা তো আমার আপন, তারা তিনজন মিথ্যা বলতে পারেন না! আমি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাই হবে।
চলবে….
#ভুল ৩য় পর্ব
#jannat_Nur
ডিভোর্স পেপারে জোর করে সাইন করাতে চাচ্ছে সুফিয়া বেগমকে দিয়ে! সে কিছুতেই সাইন করতে চাচ্ছে না। এত পরিমানের কান্না করছে তার চোখ মুখ ফোলে একাকার। এ বাড়ির কারো তার প্রতি দয়া হচ্ছে না। সুফিয়ার কোল থেকে সিরাতকে কেড়ে নিলো আমিরুল ইসলামের বোন রুমা। অবশেষে তাকে জোর করে ডিভোর্স পেপারে সাইন করানো হলো। পাগল প্রায় সুফিয়া বেগম দিব্বিদিক শূন্য হয়ে চিৎকার করছে, তার প্রতি কারো মায়া হচ্ছে না। দূরে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্যটা দেখছে এ বাসার কাজের মেয়ে তুলি। তারও চোখ দিয়ে পানি পড়ছে এই বাড়ির মানুষগুলোর নির্দয় আচরণ দেখে।
আমিরুল ইসলাম সুফিয়া বেগমকে বললেন তুই এখনই বাড়ি থেকে চলে যা, তোর সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই।
সুফিয়া বেগম বললেন আমি তোমাদেরকে ছাড়বো না বিনা দোষে আমাকে সন্তানহারা করলে, ডিভোর্স দিলে। কোন কিছু না ভেবে সুফিয়া বেগম ২ গ্রাম পরে তার ভাইয়ের বাড়িতে গেল। ভাইকে গিয়ে বলল তাকে নিয়ে থানায় যেতে! ভাই তাকে না করে দিল।
আমি পারবো না থানায় যেতে, আমি ছারপোষা মানুষ কাজ করে খাই থানা পুলিশ করার মত আমার সামর্থ্য নেই! এখনকার পুলিশরা স্বার্থ ছাড়া কোন কিছুই করে না,তাই তাদের কাছে গিয়ে কোন লাভ হবেনা।
ভাই এর কাছে অনেক কান্নাকাটি করে কোন লাভ হলো না! সুফিয়া বেগম নিজে থানায় চলে আসলো। গেইটে কনস্টেবল দাঁড়িয়ে ছিল সুফিয়া বেগমকে দেখে বললেন, কি হয়েছে আপনার সমস্যা কি?
সুফিয়া বেগম বললেন, আমার সন্তানকে ওরা জোর করে রেখে দিয়েছে! আমাকে ডিভোর্স দিয়েছে আমার স্বামী। আমি নিরুপরাধ আমার উপর মিথ্যা অপবাদ দিয়ে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে, আমি এটার বিচার চাই।
কনস্টেবল বললেন ঠিক আছে আপনি ওই রুমে যান, এসআই আছে তার সাথে কথা বলেন।
সুফিয়া বেগম এসআই মনিরুল ইসলামকে সমস্ত ঘটনা বললেন, সব শুনে মনিরুল ইসলাম বললেন সব সাক্ষী প্রমান তো আপনার বিরুদ্ধে? সবাই আপনাকে দেখেছে আপনি পরপুরুষের সাথে রাত কাটিয়েছেন। এখন এটা আমি কি করতে পারি আপনার স্বামী আপনাকে নিয়ে সংসার করবে না! আর ছেলেকে আপনার কাছে দিবে কেন আপনি তো তার ছেলেকে ভালো করে মানুষ করতে পারবেন না।
এসআই মনিরুল ইসলামের কথা শুনে সুফিয়া বেগম অবাক হয়ে গেল, সে ভাবতে পারছে না আইনের লোক এমন কথা বলছে।
আপনি এগুলো কি বলছেন? আমি কোন অন্যায় করিনি তারা আমার নামে মিথ্যা ষড়যন্ত্র করছে। আমার স্বামী বিদেশ ছিল, এসে তার ভাইবোনের কথা শুনে আমাকে ডিভোর্স দিলো। আমাকে জোর করে ডিভোর্স পেপারে সাইন করালো, আমার ছেলের বয়স মাত্র তিন বছর সেই ছেলে আইনগতভাবে আমার কাছে থাকবে, আমার ছেলেকে জোর করে রেখে দিয়েছে। আপনি যাই বলেন না কেন আমার সাথে যেতে হবে আপনাকে এখনি।
সুফিয়া বেগমের কথায় এসআই মনিরুল ইসলাম রেগে গেলেন, তাকে বললেন আপনি এখনি থানা থেকে বের হয়ে যাবেন।
সুফিয়া বেগম বললেন, না আমি যাব না আপনি আমার সাথে যাবেন! আমার ছেলেকে তাদের কাছ থেকে নিয়ে দিবেন! আমার সাথে যারা অন্যায় করেছে তাদের ধরবেন।
এসআই মনিরুল ইসলাম আর সুফিয়া বেগমের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়ে গেল, তর্ক বিতর্ক শুনে অন্যান্য পুলিশরা রুমের ভেতর উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে। তখন ওসি আব্দুল বাতেন তাদের তর্ক-বিতর্ক শুনতে পেয়ে রুমে এসে সুফিয়া বেগমের কাছে ঘটনা শুনেন, এবং এসআই মনিরুল ইসলামকে বলেন সরেজমিনে যেয়ে তদন্ত করে আসতে। এবার বাধ্য হয়ে এসআই মনিরুল ইসলাম সুফিয়া বেগমকে সঙ্গে নিয়ে আমিরুল ইসলামের বাড়িতে আসে। এসআই মনিরুল ইসলাম এতক্ষণ কেন আসতে চাইনি সেটার কারণ হলো আমিরুল ইসলাম আগেই এসআই মনিরুল ইসলামের সাথে কথা বলেছে, তার পকেট গরম করে দিয়েছে। এ কারণে ই এসআই মনিরুল ইসলাম সুফিয়া বেগমকে ধমকিয়ে থানা থেকে বের করে দিতে চাইছিলেন। পুলিশ নিয়ে সুফিয়া বেগম আমিরুল ইসলামের বাড়িতে আসায় আমিরুল ইসলামের বাড়ির মানুষজন এবং আশেপাশের লোকজন অবাক হয়ে গেল। সবাই বলাবলি করছে দেখো কত বড় সাহস অন্যায় করছে আবার বুক ফুলিয়ে থানায় গিয়ে পুলিশ নিয়ে আসছে। এই মহিলা লজ্জা শরম বলতে কিছু নেই।
দুইএকজন অবশ্যই সুফিয়া বেগমের এমন অবস্থায় তার পক্ষে কথা বলছে কিন্তু সেটা হাতে গোনা। এসআই মনিরুল ইসলাম আমিরুল ইসলামকে বললেন সুফিয়া বেগম থানায় গিয়ে হট্টগোল শুরু করে দিয়েছে! ওসি সাহেব আমাকে আসার জন্য তাগাদা দিলো তাই আসতে হলো।
আমিরুল ইসলাম বললেন ঠিক আছে আপনি যখন এসেছেন আমি চেয়ারম্যান সাহেবকে আর এলাকার কমিশনারকে ডাক দেই, আপনি তাদের সাথে কথা বলেন! আর রিপোর্ট লিখে নিয়ে যান।
চেয়ারম্যান আর কমিশনার আসলো তাদের সাথে কথা বলে আর এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে সুফিয়া বেগমের দোষ প্রমাণিত হলো এসআই মনিরুল ইসলামের চোখে । আমিরুল ইসলাম টাকাওয়ালা মানুষ সে চাইলে অনেক কিছুই হবে সেটা তো বুঝা যাচ্ছে! সুফিয়া বেগমের কাছে এক টাকাও নেই সে চাইলেও কিছু করতে পারবে না।
কয়েকদিন ধরে থানায় ঘোরাঘুরি করছে সুফিয়া বেগম বিচারের আশায়। আর এই ফাঁকে আমিরুল ইসলাম সিরাতকে নিয়ে আমেরিকা চলে গিয়েছে। সুফিয়া বেগমের কানে এই খবর যাওয়ার সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল রাস্তার পাশে। রাস্তার মানুষেরা তাকে ধরাধরি করে একটা বাড়িতে নিয়ে মাথায় পানি ঢাললো! জ্ঞান ফেরার পর হতে সুফিয়া বেগম চিৎকার করে বলছে আমার ছেলেকে এনে দাও আমি তাকে ছাড়া বাঁচবো না। একজন সুফিয়া বেগমের ভাইকে চিনতেন, সে গিয়ে সুফিয়া বেগমের ভাইকে খবর দিলেন। সুফিয়া বেগমের ভাই গিয়ে তাকে নিয়ে আসলো, সুফিয়া বেগমের মুখে এক কথা আমার ছেলেকে এনে দাও আমি তাকে ছাড়া বাঁচবো না। এভাবেই বিলাপ করে কাটলো কয়েকদিন, তার বিলাপ থামল। কিন্তু সে যদি কারো কাছে ছোট বাচ্চা দেখে তাহলে সে বাচ্চাকে কেড়ে নিয়ে তার ছেলে মনে করে বাচ্চাকে আর দিতে চায়না। তার পাগলামি দিন দিন বেড়েই চলে। এটা দেখে সুফিয়া বেগমের ভাবী বললেন তোমার বোনকে আমার বাড়িতে রাখতে পারব না সবাই শুধু বিচার নিয়ে আসে ছোট বাচ্চা দেখলেই সে তাদের কোল থেকে কেড়ে নেয়! যদি বাচ্চা কিছু করে ফেলে সেই ভয়ে লোকজন অস্থির, আমি এত কিছু সহ্য করতে পারবো না, তাকে তুমি আমার বাড়ি থেকে চলে যেতে বল।
সুফিয়া বেগমের ভাই মিরাজ তার স্ত্রীকে বলে সুফিয়ার মাথায় সমস্যা হয়েছে, স্বামী সংসার সন্তান হারিয়ে! এমন অবস্থায় আমি তাকে কোথায় তাড়িয়ে দেবো?
তুমি কি করবে না করবে সেটা আমি জানি না তোমার বোন আমার বাড়িতে থাকতে পারবে না। মানুষে বিচার নিয়ে আসবে অশান্তি করবে সেটা আমার সহ্য হবে না! তোমার যদি দরদ লাগে তোমার বোনকে নিয়ে তুমি আমার বাড়ি থেকে চলে যাও, বোনকে নিয়েই থাকো।
স্ত্রীর কথা শুনে মিরাজ চুপ হয়ে গেল, মিরার শ্বশুর বাড়িতে ঘর জামাই থাকতো! বাড়ি করার জন্য জমিটা তার স্ত্রীর বাবা দিয়েছে। সেকারণেই তার স্ত্রী এত বড় কথা বলতে পারছে। মিরাজ তার বোনকে বললেন, তোর ছেলেকে নিয়ে আমিরুল আমেরিকা চলে গেছে! তুই অন্য মানুষের বাচ্চা কেড়ে নিয়ে পাগলামি করিস, তোর ভাবী তোকে এখানে থাকতে দিবে না, ভালো হয়ে থাকলে থাক! নাহলে চলে যা। মিরাজের কথাগুলো শুনে সুফিয়া বেগম বলল, আমার ছেলেকে খুঁজতে যাব! আচ্ছা ভাইয়া খুঁজতে যেতে হলে তো আমেরিকায় যেতে হবে? আমেরিকা তো বিমান দিয়ে যেতে হয়। আমি এয়ারপোর্টে যাবো! এয়ারপোর্ট যেতে হলে ঢাকায় যেতে হবে। আমাকে কিছু টাকা দিবে?
মিরাজ বোনের কথায় চুপ করে রইলেন। সুফিয়া আর কিছু বললেন না, মাথা চুলকে কি যেন ভাবল তারপর মিরাজের বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। সে বড় রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঢাকার বাসে উঠবে, তাকে যেভাবে হোক ঢাকা যেতে হবে! তার মাথায় একটাই ভাবনা সে এয়ারপোর্টে যাবে তারপর যেভাবে হোক বিমানে করে আমেরিকা চলে যাবে। তারপর তার ছেলেকে খুঁজে নিয়ে আসবে। কিন্তু মানসিকভাবে অসুস্থ বলে সে এটা বুঝতে পারছেনা টাকা ছাড়া পাসপোর্ট ছাড়া সে কিভাবে আমেরিকা যাবে।
আমিরুল ইসলাম সিরাতকে নিয়ে আমেরিকায় চলে আসছে। আমেরিকার নিউ জার্সিতে আমিরুল ইসলাম থাকে, সেখানেই তার বিজনেস। সিরাত তার মায়ের জন্য এক নাগাড়ে কান্না করে যাচ্ছে কিছুতেই কান্না থামাতে পারছে না আমিরুল ইসলাম। আমিরুল ইসলামের বন্ধু সাবের আহমেদ পরামর্শ দিলেন ছেলেকে এভাবে রাখতে পারবি না, তার জন্য আয়া রাখার ব্যবস্থা কর! আয়ারা নিজের সন্তানের মত লালন পালন করে, তাহলে সিরাত তার মাকে ভুলতে পারবে।
এখন আয়া আমি কোথায় পাব, আমিরুল ইসলাম বন্ধু সাবের আহমেদকে বললেন।
আচ্ছা আমি ব্যবস্থা করে দেবো আমার পরিচিত একজন মানুষ আছে, যাদের আয়ার দরকার হয় আয়া দিয়ে হেল্প করে।
আমার ছেলের জন্য এমন একজন আয়া এনে দে,
যে সিরাতকে নিজের মায়ের মত আদরযত্ন করবে।
চলবে….