ভুল পর্ব-১০+১১

0
1131

#ভুল ১০ম পর্ব
#jannat_Nur

একটা অন্ধকার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে সিরাত! চারপাশে তাকিয়ে দেখে কোথাও কেউ নেই। কোন রাস্তা দেখতে পাচ্ছেনা, কিভাবে কোথায় যাবে সেটাও বুঝতে পারছে না সিরাত! ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। এমন সময় একজন বয়স্ক লোক তার সামনে এসে দাঁড়ালো, তাকে বলল ভয় পাচ্ছিস? তখন সিরাত ভয়ে জড়সড় হয়ে বলল, হ্যাঁ আমি খুব ভয় পাচ্ছি বাট আমি এখানে কেন? কিভাবে এই অন্ধকারে আসলাম।

তুই তো সবসময় অন্ধকারেই আছিস, তোর চারপাশে কখনোই আলো ছিল না।

আপনি কি বলছেন, আপনার কথার মানে আমি বুঝতে পারছি না, সিরাত লোকটাকে বলল।

তোর সম্বন্ধে কি তুই ঠিকমতো জানিস?কখনো কি জানতে চেয়েছি তুই অতীত সম্পর্কে। তুই একটা মায়ের গর্ভ থেকে দুনিয়াতে এসেছিস, সে কেমন আছে বেঁচে আছে না কি মরে গেছে, ভালো আছে না খারাপ আছে কখনো এই প্রশ্ন তোর মনে জাগেনি? তুই তো সন্তান হিসেবে অযোগ্য! এই গভীর অন্ধকারে তোর ডুবে যাওয়া উচিত।
কথাগুলো বলে সিরাতের হাত ধরে সেই বয়স্ক লোকটা গভীর অন্ধকারের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সিরাত চিৎকার করে যাচ্ছে আর বলছে আমাকে ছেড়ে দেন আমার ভয় লাগছে! আমি তো অন্ধকারে হারিয়ে যাব।

এত ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখার সাথে সাথে সিরাত চিৎকার দিয়ে উঠে বসলো। তার চিৎকার শুনে আমিরুল ইসলাম দরজার পাশে এসে ডাক দিচ্ছে, সিরাত কি হয়েছে এত রাতে এভাবে চিৎকার দিয়েছিস কেন? কিছুক্ষণ পর দীপা এবং তার স্বামী দুজনেই উঠে আসলো, তারা বুঝতে পারছে না সিরাতের কি হয়েছে।

সজাগ হয়ে সিরাত ভয়ে এখনো কাঁপছে, সে কেন এমন স্বপ্ন দেখল সেটাই ভাবছে। সত্যিই তো তার যে মা তাকে জন্ম দিয়েছে তার সম্পর্কে সে কিছুই জানার চেষ্টাই করেনি কখনো। তার বাবা সবসময় বলে এসেছে তার মা তাকে দেখে অন্য কারো সাথে চলে গিয়েছে! এটাই বিশ্বাস করছে, কখনো জানতে চায়নি এটা সত্যি না কি মিথ্যা। সত্য মিথ্যা জানতে হলে অবশ্যই তাকে বাংলাদেশে যেতে হবে এমনটাই ভাবছে সিরাত।
এত ভয়ঙ্কর স্বপ্ন কেন সে দেখলো এই বৃদ্ধ লোকটা তাকে এভাবে অন্ধকারে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল কেন, আর তাকে বলছিল তুই তো অন্ধকারে ডুবে আছিস আবার অন্ধকারে কিসের ভয়! সত্যি কি আমি অন্ধকারে ডুবে আছি আমাকে মিথ্যা বলা হয়েছে? ভাবতে ভাবতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল সিরাত বাংলাদেশে আসবে, যেভাবেই হোক তাকে সত্যিটা জানতে হবে। যদি তার মা তাকে রেখে চলে যেয়ে থাকে এটা জানতে পারে তাহলে তো বাবার কথাই সত্যি, আর যদি তার মায়ের সাথে কোন অন্যায় করা হয় সে তার বাবাকে ছাড়বে না।

দরজার ওপাশে আমিরুল ইসলাম দীপা এবং দীপার স্বামী ডেকে যাচ্ছে, সিরাত এসে দরজা খুলে দিলো।

কি হয়েছে তোমার এভাবে চিৎকার করলে কেন? কিছু হয়েছে তোমার। সবাই একসঙ্গে প্রশ্ন করছে?

না কিছু হয়নি, আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি স্বপ্নটা দেখে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম! তাই চিৎকার করছি।

তাহলে আমি তোমার সঙ্গে থাকি, রাতে একা একা আবার ভয় পাবে! আমিরুল ইসলাম বললেন।

না পাপা তোমার থাকতে হবে না, আমি একাই থাকতে পারবো, তোমরা এখন যাও! এটা বলে দরজ বন্ধ করে দিলো সিরাত। সে রাতে আর ঘুম হলো না ভাবতে থাকলো অবশ্যই তাকে বাংলাদেশের যেতে হবে। মনে মনে ভাবলো রোদকে সে ভালোবাসে তাকে বিয়ে করে নিয়ে বাংলাদেশে যাবে, কালকে রোদকে বিয়ের প্রস্তাব দেবে। সিরাতের মনে হয় রোদ তাকে পছন্দ করে, সেটা সে এতদিনে বুঝতে পারছে। সকাল হলে সিরাত রোদের সাথে দেখা করতে চলে গেল! এই সকাল সকাল সিরাত কেন তার সাথে দেখা করতে চাইছে রোদ জানতে চাইলো।

তোমাকে আমি পছন্দ করি সেটা তুমি অবশ্যই জানো! মুখে কখনো বলা হয়নি তোমাকে কতটা ভালোবাসি, আমি বিশ্বাস করি তুমি আমাকে ভালোবাসো! আর জানো আমি কেমন ছেলে আমি শোয়াইবের মত ছেলে না, আমি তোমাকে যথেষ্ট পরিমাণে শ্রদ্ধা সম্মান করি এবং এতদিন আমাদের বন্ধুত্ব টিকিয়ে রেখেছি, ভয়ে বলতে পারেনি তুমি যদি আমাকে ফিরিয়ে দাও, আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হবে। বাট আজকে তোমাকে বলতেই হবে কারণ আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি বাংলাদেশে চলে যাব, তারপরে এখানে আমি ফিরব কি ফিরবো না সেটা শিওর না। আমি তোমাকে হারাতে চাই না তাই আজ সরাসরি বলছি আমি তোমাকে প্রচন্ড পরিমাণ ভালোবাসি, এবং জীবন সঙ্গী করতে চাই! তুমি কি আমাকে বিয়ে করতে রাজি আছো।

সত্যি বলতে তোমাকে বিয়ে করতে আমিও চাই মনে মনে। কখন যে তোমার প্রতি দুর্বল হয়ে গেছি সেটা বুঝতে পারিনি। শোয়াইবের কাছ থেকে ধোঁকা খেয়ে তোমার সাথে ফ্রেন্ডশিপ করার পর ভাবছিলাম কখনো তোমার প্রেমে পড়বো না, কিন্তু কি করবো বলো মনকে তো আর মানানো যায় না। তুমি যখন বলতেছ বিয়ের কথা তাহলে আমার বাবার সাথে কথা বল! চলো তোমাকে নিয়ে এখন আমি গির্জায় যাব।

সিরাতকে নিয়ে রোদ তার বাবার কাছে আসলো। রোদের বাবা এতক্ষণ প্রার্থনায় মগ্ন ছিল, রোদ আর সিরাত কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর মিস্টার ক্লাক মেয়ের সামনে আসলো।

হ্যাঁ বল কিসের জন্য অপেক্ষা করছিস, আর এই ছেলে কে? তোর বন্ধু নাকি।

বাবা তার নাম সিরাত ইসলাম, আমাকে সে অনেক ভালোবাসে আমাকে বিয়ে করতে চায়! আমিও তাকে ভালোবাসি তাই তোমার কাছে নিয়ে আসলাম, আর একটা কথা সিরাত কিন্তু মুসলিম! বাবা তুমি এটার জন্য বাধা দিও না।

মিস্টার ক্লাক সিরাতের দিকে তাকিয়ে তাকে প্রশ্ন করলেন তুমি কি আমার মেয়েকে অনেক ভালোবাসো? তাকে সত্যি সত্যি বিয়ে করতে চাও?

হ্যাঁ আঙ্কেল আমি চাই রোদকে বিয়ে করতে, তাকে আমি অনেক ভালোবাসি।

সেটা যদি হয় তাহলে প্রমাণ দিতে পারবে তুমি তাকে অনেক ভালোবাসো, তাকে কখনো ছাড়তে চাইবে না।

আপনি কি প্রমাণ চান? আমার মন প্রাণ জুড়ে শুধুই রোদ, আমার লাইফের প্রথম ভালবাসায় আপনার মেয়ে! তাকে ছাড়া তো আমি কোন কিছুই ভাবতে পারিনা। আমি চাচ্ছি বাংলাদেশে যেতে রোদকে হারাতে চাই না বলেই বাংলাদেশের যাবার আগে তাকে বিয়ে করতে চাচ্ছি।

ঠিক আছে আমি তোমার সাথে বিয়ে দিতে রাজি আছি, কিন্তু তোমার খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করতে হবে! তুমি যদি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করতে পারো তাহলে তুমি আমার মেয়ের জামাই হতে পারবে। আমি আমার মেয়েকে মুসলিম হতে দিতে চাইবো না কখনো, এত কষ্ট করে বড় করেছি অন্য ধর্মে চলে যেতে নয়।

মিস্টার ক্লাকের কথা শোনার সাথে সাথে সিরাতের মুখ কালো হয়ে গেল, সে ভাবতে পারেনি রোদের বাবা এমন প্রস্তাব দিবে। এটা কিভাবে সম্ভব নিজ ধর্ম ত্যাগ করে সে খ্রিস্টান হয়ে যাবে, এটা অসম্ভব সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম ইসলাম, সেটা কিভাবে ত্যাগ করবে সে।
সিরাতের মুখে কোন কথা নেই দেখে মিস্টার ক্লাক আবার বললেন,

আমি বুঝতে পারছি তুমি তোমার ধর্ম ত্যাগ করতে রাজি নয়! বললে তো অনেক ভালোবাসো যদি অনেক ভালোবেসে থাকো ধর্ম ত্যাগ করতে পারতে। তুমি কি চাও আমার মেয়ে খ্রিস্টান ধর্ম ত্যাগ করে মুসলিম হয়ে তোমাকে বিয়ে করবে? তুমি যদি তোমার ধর্ম না ছাড়তে পারো আমার মেয়ে কেন তার ধর্ম ছাড়বে।

সিরাত রোদের দিকে তাকালো, রোদের চোখে পানি! সে তার বাবাকে বলল, বাবা তুমি এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিও না, সিরাতকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে দিও না এমন একটা শর্ত দিয়ে।

তাহলে কি তুমি তার ধর্ম গ্রহণ করবে, মুসলিম হয়ে বিয়ে করবে তাকে? রোদকে প্রশ্ন করলেন মিস্টার ক্লাক।

রোদ কি উত্তর দেবে ভাবতে পারছেন না।

মিস্টার ক্লাক আবার বললেন, আমি একজন পাদ্রী জীবন কাটিয়ে দিলাম ইশ্বরের সেবা করে! কখনো বিয়ে থা করিনি, তোমাকে আমি এতিম অসহায় অবস্থায় রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনেছিলাম, নিজ ধর্মে দীক্ষিত করে বড় করেছি। আমি আশা করিনি তুমি আমার অবাধ্য হবে কখনো, যদি আমার প্রতিদান দিতে চাও তুমি কখনোই ধর্ম ত্যাগ করে একজন মুসলিমকে বিয়ে করবে না। সিরাত যদি তার ধর্ম ত্যাগ না করতে পারে তুমি কেন তোমার ধর্ম ত্যাগ করবে। তার ভালোবাসা তোমার প্রতি বেশী না হলে তোমার কেন এত ভালোবাসা থাকবে তার প্রতি। তুমি এখনই সিদ্ধান্ত নেবে তুমি আমার কথা রাখবে, না কি সিরাতকে বিয়ে করবে মুসলিম হবে।

রোদ পড়ে গেল কঠিন হিসাব নিকাশে, ভাবতে থাকলো আমাকে যদি এতিম অসহায় অবস্থায় এনে বড় করে এ পর্যন্ত লেখাপড়া করায় তার প্রতিদান আমি কিভাবে না দেই। আর আমিও তো কখনো ভাবিনি আমার নিজের ধর্ম ছেড়ে অন্য ধর্মেচলে যাবো। রোদ সিরাতের দিকে তাকিয়ে বলল তুমি যদি আমাকে ভালোবাসো তাহলে চলে এসো আমার ধর্মে। সিরাত আমি তোমাকে হারাতে চাই না, আমি চলে যেতাম তোমার ধর্মে কিন্তু পারছি না বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে।

সিরাত কিছু উত্তর না দিয়ে বের হয়ে আসলো গির্জা থেকে, তার মনে হচ্ছে সে এটা কখনো পারবে না। ভালোবাসা জীবন মরণ সবকিছুর ঊর্ধ্বে তার ধর্ম, সে শেষ নবীর উম্মত, মুসলিম হিসেবে তার জন্ম হয়েছে এটাই তার সবচেয়ে পরম পাওয়া। সে কিভাবে তার ধর্মকে ছেড়ে ভালোবাসার জন্য অন্য ধর্মে চলে যাবে। যতই কষ্ট হোক রোদকে ছেড়ে আসতে হবে, ভুলে থাকতে হবে। রোদ পিছন থেকে অনেকবার ডেকেছে কিন্তু সিরাত আর পিছন ফিরে তাকায়নি। দুঃখ-ভরাক্লান্ত মন নিয়ে সে বাসায় চলে আসলো, এবং তার বাবাকে বলল আমরা একেবারে বাংলাদেশে চলে যাব! এখানে আর থাকবো না তুমি সবকিছু ব্যবস্থা করো। সিরাজের এমন কথা শুনে তার বাবা যেন অবাকের চেয়ে বেশি অবাক হয়ে গেল। যে ছেলে বাংলাদেশে কখনো বেড়াতে যেতে চায়নি আর আজকে বলছে বাংলাদেশে একেবারে চলে যাবে। কারণ কি সেটা জানার জন্য ছেলেকে প্রশ্ন করল,

কি হয়েছে, কেন বাংলাদেশে যেতে চাচ্ছো।বাংলাদেশের যেয়ে আমরা কি করব?
এখানে আমাদের বিজনেস বাংলাদেশ যাবার কোন দরকার নেই। তোমার কি হল তুমি বাংলাদেশে কেন চলে যেতে চাও, কখনো তো বেড়াতে যেতে চাওনি এতদিন।

যেতে চাইনি সেটাই তো আমার ভুল ছিল, কেন আমার জন্মভূমি বাংলাদেশে আমি যেতে চাইলাম না সেটাই অনেক বড় ভুল। এখানে থেকে আর ভালো লাগছে না, আমি এখন আমার দেশে ফিরে যেতে চাই। তুমি যদি না যাও আমাকে ব্যবস্থা করে দাও আমি সেখানে চলে যাব। আর বিজনেস করতে চাইলে বাংলাদেশেও করা যাবে, বাংলাদেশে বিজনেস করে অনেকে জীবনযাপন করছে। টাকা থাকলে সবখানে বিজনেস করা যায়! সেটার জন্য সমস্যা হবে না। আমার মনে হয় তুমি বাংলাদেশে বসবাস করতে ভয় পাও, সেখানে থাকতে তোমার কিসের ভয়।

সিরাতের এমন কথা শুনে আমিরুল ইসলামের বুক কেঁপে উঠলে, সত্যিই তো সে বাংলাদেশে যেতে ভয় পায়। সবসময় ভয় পায় তার ছেলে যদি চলে যায় তার মায়ের কাছে। কি আর করা ছেলে যখন বলেছে আমিরুল ইসলামের না করার কোন উপায় নেই, বাংলাদেশে যেতেই হবে। তারা বাবা ছেলে চলে আসবে বাংলাদেশে দীপা রয়ে যাবে তার স্বামীর কাছে, কিছুদিন পর দীপাও বাংলাদেশে চলে আসবে।

সিরাত শুধু অপেক্ষা করছে সে বাংলাদেশে যাবে এবং তার মায়ের সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবে! অবশ্যই কেউ না কেউ আছে তাকে সত্যিটা বলতে পারবে। সে মনে করে স্বপ্নটা তাকে সত্যি জানার জন্য আগ্রহী করে তুলেছে, এতদিন তার ভিতরে এগুলো নিয়ে কোন প্রশ্ন ছিল না।

চলবে….

#ভুল ১১তম পর্ব
#jannat_Nur

আমিরুল ইসলাম একেবারে বাংলাদেশের চলে আসবে সেটা তার পরিবারের কেউ ভাবতে পারেনি! বিশেষ করে রফিক মিয়া খুবই চিন্তিত হলেন। ভাবনায় পড়ে গেলেন এখন যদি আমিরুল ইসলাম তাকে তার ফ্ল্যাট ছেড়ে দিতে বলে কোথায় যাবে, তাই তার স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করলেন রফিক মিয়া।

বড় ভাইজান তো দেশে ফিরে আসছে তুমি তার সাথে এবং সিরাতের সাথে অনেক ভালো ব্যবহার করবে, আদর যত্ন করবে! তাদের খাবার-দাবার তুমি রান্না করে দিবে, যেন কোন কিছু কমতি না হয়।

আমার মনে হচ্ছে তুমি ভয়ে আছো, ভাবছো ভাইয়া বাসা থেকে বের করে দিবে? এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই, তার কি পরিবারে আরো লোক আছে নাকি। তারা বাপ ছেলে দুইজন থাকবে তাদের তো দুই রুম হলেই হয়ে যাবে। আর দুই সাইডে দুইটা ফ্ল্যাটে ছয়টা রুম তাহলে তুমি সেই ভয় পাচ্ছ কেন।

তার পরেও মানুষের মন বলা যায় না, যদি বলে এতদিন থেকেছো, এখন আমরা আসছি তোমরা চলে যাও। আমাদেরই তো বেশি রুম দখল করা, আমার ছেলে ছেলের বউ মেয়ে সবাইকে নিয়ে সপরিবারে আমরা থাকছি। সিরাতকে যদি বিয়ে করায় তখন তো তাদের রুম লাগবে আরো বেশি।
আচ্ছা শোনো থেকে অবন্তীকে বলবে সিরাতের সাথে মিশতে, ভালো ব্যবহার করতে। অবন্তী যদি সিরাতকে হাতের মুঠোয় নিতে পারে, তাহলে বড় ভাইজানকে রাজি করিয়ে সিরাতের সাথে অবন্তীকে বিয়ে দেওয়া যাবে কোন সমস্যা হবে না।

রফিক মিয়ার কথা শুনে রুমা বললেন, আমি ভাইয়ের সাথে এটা নিয়ে কথা বলব! আমি চাই সিরাতের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে হোক, ছেলেটা কিন্তু মাশাল্লাহ অনেক সুন্দর, অনেক ভদ্র আছে।

আমার মেয়েও কিন্তু অনেক সুন্দর এবং ভদ্র, সেও দেখতে শুনতে কম নয়। অবন্তীকে বল যেভাবেই হোক সিরাতকে হাতের মুঠোয় নিতে! আমার মনে হয় কি জানো, রবিনের মেয়েকে সিরাতের কাছে বিয়ে দেওয়ার জন্য প্ল্যান করতেছে রবিনের বউ।

আরে না না, সিরাত রবিনের মেয়েকে পছন্দ করবে না! বৃষ্টি কিন্তু অনেক মোটা দেখতে, আমার অবন্তীর মত সুন্দর নয়। আমার মন বলেছে সিরাত বৃষ্টিকে পছন্দ করবে না, করলে আমার মেয়েকে পছন্দ করবে, কথাগুলো বললেন রুমা আক্তার।

বাংলাদেশে আসার পর থেকে সিরাত ভাবছে কাকে জিজ্ঞেস করলে তার মায়ের ব্যাপারে জানতে পারবে। তার মামার বাড়ি কোথায় সেটাও সে জানে না, যে সেখানে তার মায়ের খুঁজে যাবে। সিরাত তার রুমা ফুপির এত আদর আপ্যায়ন দেখে তাকেই জিজ্ঞেস করলো তার মায়ের সম্বন্ধে।

আচ্ছা আমার মা কেন চলে গিয়েছে সেটা তুমি সত্যি করে বলতো, সে চলে গেছে নাকি তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে?

এটা শুনে রুমা আক্তার ভাতিজার মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হবার ভঙ্গি করে বললেন, তুমি এখনো জানো না তোমার মায়ের পরপুরুষের সাথে সম্পর্ক ছিল? তোমাকে তিন বছরের রেখে চলে গিয়েছে।

এটা নতুন কিছু নয়, ছোট থেকে শুনে আসছি।
যা সত্যি তা আমি শুনতে চাই! আমার কেন জানি বিশ্বাস হয় না আমার মা এমনটা করেছে। আমি আশা করব তুমি সত্যিটা বলবে।

রুমা আক্তার বললেন, আমি যা বলছি তাই সত্যি! তোমার কেন বিশ্বাস হচ্ছে না,আমরা কেন মিথ্যা বলব তোমার সাথে।

আচ্ছা ঠিক আছে এখন বল আমার মায়ের বাবার বাড়ি কোথায় ছিল, মানে আমার নানুর বাড়ি।

রুমা আক্তারের মুখটা কালো হয়ে গেল সিরাত কেন তাকে এত প্রশ্ন করছে, সে বুঝতে পারছে না! রুমা আক্তার নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন।

তোমার নানা নানি কেউ বেঁচে নেই, তাদের বাড়ি কোথায় সেটা এখন আমার জানা নেই।

আমার মামা খালা অবশ্যই আছে, আমার মায়ের বাবার বাড়ি কোথায় ছিল সেটা ফুপি তুমি ঠিকই জানো! বাট আমাকে বলবেনা সেটা আমি বুঝতে পারছি।

আরে বাবা আমি জানিনা, শুনেছিলাম তাদের বাড়িঘর কিছু নেই। তোমার মামা খালা কখনো এখানে আসেনি, তাদের সম্পর্কে আমি কিছু জানি না। জানলে তোমার বাবা জানতে পারে তাকে প্রশ্ন করো এগুলো, সেই সঠিক তথ্য দিতে পারবে। সত্যি বাবা আমি এগুলো কিছুই জানিনা।

সিরাত বুঝতে পারলো তার ফুপি এ বিষয়ে কিছুই বলবে না তাকে। তিন চাচীকে জিজ্ঞেস করেও একই উত্তর শুনতে হয়েছে সিরাতকে। সে বুঝতে পারল এই ফ্যামিলির মানুষগুলো সবাই এক পক্ষ রয়েছে কেউ তাকে সত্যি বলবেনা। আশেপাশের কারো কাছ থেকে জানতে হবে তাকে, তাই গ্রামের বাড়িতে যেতে হবে! কিন্তু গ্রামের বাড়ির আশেপাশের কাউকে তো চিনেনা কিভাবে কি জিজ্ঞেস করবে সেই ভাবনায় সিরাত। সন্ধ্যেবেলা ছাঁদে বসে এক কাপ কফি হাতে নিয়ে ভাবনায় ডুবে আছে সিরাত, তার পাশে এসে দাঁড়ালো অবন্তী। সিরাত অবন্তীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কিছু বলবে।

আসলে আপনি আসার পর থেকে দেখি চুপচাপ আছেন, কথা বলেন না তেমন! কারণ কি জানতে পারি?

আসলে কারণ কিছুই না আমি একটা ভাবনার মধ্যে আছি, সত্যিটা জানতে চাই, কিন্তু সত্যিটা আমি জানতে পারছি না। আচ্ছা তুমি আমাকে একটা কথা বলবে সত্যি বলবে কিন্তু, আমি আশা করি তোমার কাছ থেকে সত্যিটাই জানতে পারবো।

অধিক আগ্রহ নিয়ে অবন্তী সিরাতকে জিজ্ঞেস করলো বলেন কি জানতে চান, আমি যদি সত্যি জানি তাহলে আপনাকে অবশ্যই বলব! মিথ্যা কথা বলা আমি কখনো পছন্দ করি না।

তুমি আমার মায়ের সম্পর্কে কিছু জানো, যদি জেনে থাকো সত্যিটা বল।

আসলে আমার জন্মের আগেই তো বড় মামিকে এই বাসা থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে! তাই তার সম্বন্ধে আমি কিছু জানিনা, আম্মুর মুখে এবং মামিদের মুখ থেকে এমনটাই শুনেছি।

কি বললে আম্মুকে বাসা থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে? কিন্তু কি কারণে।

হ্যাঁ আমি এটাই শুনেছি সে যেতে চায়নি নাকি, তাকে বড় মামা জোর করে তাড়িয়ে দিয়েছে। বড় মামি নাকি খুব বড় অন্যায় করেছিল, তাই মামা তার সাথে সংসার করেনি ডিভোর্স দিয়ে তাড়িয়ে দেয়।

কি অন্যায় করেছিল সেটা কি তুমি শুনেছ।

মামা তখন আমেরিকায় থাকতো, আর আপনাকে নিয়ে বড় মামি থাকতো গ্রামের বাড়িতে। একদিন রাতে নাকি আব্বু ওয়াশরুমে যাবার জন্য উঠে তখন দেখে বড় মামির রুম থেকে একটা পুরুষ মানুষ বের হয়ে যাচ্ছে। আব্বু সাথে সাথে আম্মুকে ডাক দেয় এবং আম্মু উঠে লোকটাকে দেখতে পেয়ে মামাদের ডাক দেয়। তারা সবাই লোকটাকে দেখে, মেজ মামা সেজ মামা যখন লোকটাকে ধরার জন্য যায়, লোকটা তখন দৌড়ে পালিয়ে যায়। এ কথা জানানো হয় মামাকে, মামা আমেরিকা থেকে এসে মামিকে ডিভোর্স দেয়। মামি নাকি বারবার বলেছিল সে এমন অন্যায় কাজ করেনি! আপনাকে রেখে মামিকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়, মামি পুলিশ নিয়ে এসেছিল আপনাকে তার কাছে নেবার জন্য। তবু মামা আপনাকে দেয়নি, তারপর আপনাকে নিয়ে কয়েক দিনের মধ্যে ই আমেরিকা চলে যায়। আপনাকে নিয়ে যাবার পর মামি নাকি একবার এসেছিল তখন তার অবস্থা খুবই খারাপ পাগল প্রায় এমন টাইপ ছিল। তারপর থেকে আর কখনো আসেনি, বড় মামি।

সিরাতের মনে অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, তাকে বলা হয়েছে তার মা তাকে রেখে অন্যজনের সাথে পালিয়ে গিয়েছে। কিন্তু অবন্তীর কথাতে বুঝা যাচ্ছে তার মা অন্য জনের সাথে পালিয়ে যায়নি, তার জন্য থানা থেকে পুলিশ পর্যন্ত নিয়ে আসছে! তবু ছেলেকে কাছে না পেয়ে হতাশ হয়ে পাগল প্রায় হয়ে গেছে একজন মা। সে মা কিভাবে অন্য জনের সাথে পালিয়ে যাবে, এখনো কি তার মা বেঁচে আছে ভাবতে ভাবতে কান্না করে দিলো সিরাত। কেন সে এতদিন তার মায়ের খোঁজ করতে চাইলো না, এতদিন শুনে আসছে তার মা অন্য জনের সাথে পালিয়ে গেছে। আজকে অবন্তীর কাছ থেকে শুনতে পেল সবাই দেখেছে তার মায়ের রুম থেকে কে যেন বের হয়ে গিয়েছে। অবন্তী যা বলল এ কথাটা তার ফুপি চাচিরা কেন তাকে বলল না। এখানে অবশ্যই কোন রহস্য আছে তার মায়ের সাথে ষড়যন্ত্র করা হয়েছে।

অবন্তী সিরাতের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি বুঝতে পারছি আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে! শৈশবকাল থেকে আপনি মা হারা, কখনো মায়ের মুখ দেখতে পারেননি। মা যেমনই হোক তবু সন্তানের কাছে ভালো, সন্তান যদি খারাপ হয় মা কখনো ফেলতে পারে না! আবার মা যদি কোন অন্যায় করে তবু সন্তান তাকে ফেলতে পারেন না।

অবন্তী তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ তুমি আমাকে যা জানালে সেটা আমি দীর্ঘ ২৩ বছরে জানতে পারিনি। আমাকে জানানো হয়েছিল আমার আম্মু আমাকে রেখে অন্য কারো সাথে পালিয়ে গিয়েছে। আর এখন জানতে পারলাম অন্য ঘটনা, আমার সাথে কেন এমনটা বলা হয়েছে আমি বুঝতে পারছি না।

অবন্তী সিরাতকে বলল সেটা আমিও তো বুঝতে পারছি না। আমি ছোট থেকে এ ঘটনাটাই শুনে এসেছি, আপনার সাথে কেন এমনটা বলা হয়েছে। আমি আম্মুকে জিজ্ঞেস করবো কেন আপনার সাথে এমনটা বলল তারা।

সিরাত অবন্তীর হাতটা ধরে বলল, তুমি যেটুকু বলেছ সেটা যথেষ্ট এখন তুমি তোমার আম্মুর সাথে কিছু বলবে না! তুমি আমাকে কথা দাও এ বিষয়ে তুমি তোমার পরিবারের কাউকে বলবে না।

অবন্তী সিরাতকে দেখার পর থেকে তার প্রতি দুর্বল হয়ে গেছে। অবন্তীর মনে হয় সিরাত যতই অর্থ সম্পদের মধ্যে বড় হোক তার মনে খুব কষ্ট। মা হারা সন্তানের মনের সব সময় একটা হাহাকার থাকে সেটা অবন্তী বুঝতে পারছে, তাই সিরাতের প্রতি তার ভালো লাগা তৈরি হয়েছে।

সিরাতকে কথা দিল ঠিক আছে আমি কাউকে কিছু বলবো না।

আর একটা হেল্প করতে পারবে তুমি আমাকে?

যদি আমার সাধ্যের মধ্যে হয় অবশ্যই হেল্প করবো।

আচ্ছা এই আমাদের বাসায় যে কাজের মানুষগুলো আছে এগুলো কি আমাদের গ্রামের নাকি অন্য জায়গার।

ছোট মামীর কাজের মহিলা আমাদের গ্রামের, সবাই তাকে শাপলার মা বলে ডাকে।

ওকে, তুমি তাকে জিজ্ঞেস করবে সে কত বছর ধরে আমাদের গ্রামের বাড়িতে কাজ করেছে! তার আগে কি অন্য কেউ কাজ করতো, এ বিষয়ে ইনফরমেশন তুমি আমাকে এনে দিবে তার কাছ থেকে। আর কি বললাম এ কথা কাউকে বলবে না, আমি সত্যিটা বের করতে চাই। আমার খুব জানার ইচ্ছা আমার মা কেন আমাকে রেখে চলে গিয়েছে।

ঠিক আছে আমি শাপলার মায়ের সাথে কথা বলবো! সে তো আমাদের গ্রামের বাড়িতে কাজ করতো, আমি ছোট থেকে দেখেছি সে আমাদের বাড়িতে আছে।

ঠিক আছে তাহলে তুমি আমাকে হেল্প টা করো।

অবন্তী ভাবতে থাকলো সে যদি সিরাতকে এ ব্যাপারে সাহায্য করে সিরাত তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে। ভালোলাগার মানুষকে সাহায্য করতে পারলে তারও ভালো লাগবে।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে