ভুলোনা আমায় পর্ব-০৩

0
1616

#ভুলোনা_আমায়
#পর্ব-০৩
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

সোহান বাহিরে থেকে এসে দেখে বিছানার এক পাশে গুটিয়ে শুয়ে আছে টুসি।এখানে আসার পর থেকে রোকেয়া বেগম অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে সোহানের সাথে এক ঘরে থাকতে পাঠায় টুসি’কে। সেই থেকে এক ঘরে এক‌ই বিছানায় থাকে তারা। তবে তাদের মনের মিল এখনো হয়নি।কবে যে হবে,সে আল্লাহ তা’আলা ভালো জানেন।
.
.
আজকে দু’দিন হলো টুসি শহরে এসেছে,কিন্তু তার মন প্রাণ যেন গ্রামেই পরে আছে। আব্বু আম্মুর কথা মনে পরতেই চোখ দুটো পানিতে ঝাপসা হয়ে আসে। তবে সারাদিন সোহানের ফোন নিয়ে বসে থাকে সে। সেদিন ট্রেনে যখন সোহান কানিজ ফাতেমার কার্টুন দেখিয়েছিল, তখন সেই কার্টুন বেশ মনে ধরে টুসি’র। সেই থেকে সারাক্ষণ বসে বসে কার্টুন ই দেখে।

এদিকে রোকেয়া বেগম বিরক্ত বোধ করলেও মনের মধ্যেই পুষে রাখেন প্রকাশ করেন না। ভাইজান তার একমাত্র মেয়ে কে দুই হাত ভরে দিতে কৃপণতা করবেন না! সেটা খুব ভালো করেই জানেন রোকেয়া বেগম।তাই তো রাগ ক্ষোভ যা আছে সব গিলে খেতে হবে। তবে সোহান যদি জানতে পারে দেনা পাওনার কথা তাহলে তুলকালাম কাণ্ড ঘটবে!তাই এ ব্যাপারে সোহান কিচ্ছুটি জানে না। রোকেয়া বেগম ভেবে রেখেছেন যখন টুসির বাবা কিছু দিবেন তখন ছেলেকে বুঝিয়ে বলবেন যে,স্বপন তালুকদার খুশি হয়ে মেয়ে’কে দিচ্ছেন।এতে তো আমাদের আপত্তি করার কিছু নেই।
.
.
সোহান টুসি’র পাশে বসে আলতো হাতে চুলের ফাঁক বিলি কেটে দিতে দিতে বললো,
— টুসি ম্যাডাম? উঠোন, এই ভর সন্ধ্যে বেলায় কেউ ঘুমিয়ে থাকে?উঠো নাস্তা করবে।

টুসি নড়েচড়ে বললো,
— আর একটু ঘুমাতে দিন না?
— না আর একটুও না। এখন এতো ঘুমালে রাতের বেলা ঘুম আসবে না, তখন বুঝবে ঘুম না আসলে কতটা যন্ত্রনা হয়।

তারপর টুসি’র হাত ধরে টেনে তুলল সোহান। এদিকে সোহানের ছোট বোন মেহুল নাস্তা সাজিয়ে তার ভাই আর ভাবি’কে ডাকতে আসে। এসে দেখে সোহান ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করছে।মেহুল কোমরে হাত রেখে বললো,
— ভাইয়া সেই কখন তোমাকে পাঠিয়েছি ভাবী কে নিয়ে আসার জন্য,আর তুমি কিনা কাজ নিয়ে বসেছো?ভাবী কোথায়?
— ও বাথরুমে ফ্রেশ হতে গিয়েছে। তুই যা আমরা আসছি।
— ঠিক আছে তাড়াতাড়ি আসো।

কিছুক্ষণ পর,টুসি বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে হাত মুখ মুছে,ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে সাজগোজ প্রসাধনী ব্যবহার করে,খাটে বসে থাকে। সোহানের কাজের মাঝে কড়া পারফিউম এর সুবাস ঘ্রাণেন্দ্রিয় এসে ঠেকলো। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে টুসি বসে আছে, তখন জিজ্ঞাসা করলো,
— তুমি কি পারফিউম ব্যবহার করেছো?

টুসি মাথা উপর নিচ করে বোঝানো করেছে। তখন সোহান বললো,
— আর কখনো পারফিউম ব্যবহার করো না। কেননা পারফিউম ব্যবহার করে মেয়েদের বাহিরে বের হ‌ওয়া জায়েয নয়। কেননা এখানে তোমার মৃত্যু সমতুল্য দেবর আছে।

যেসব সাজসামগ্রী হালাল বস্তু দ্বারা তৈরি, যা দ্বারা আল্লাহর সৃষ্টি করা গঠনে কোনো বিকৃতি ঘটে না, তা ব্যবহার করা জায়েজ। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও সাজসজ্জা ইসলামি জীবনরীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইসলাম নির্দেশ দেয় যে, স্ত্রী যেন ঘরেও স্বামীর জন্য সর্বোত্তম সাজসজ্জা করে থাকে। স্বামীর উদ্দেশে সাজসজ্জা করা একটি ইবাদত। ‘আজীবনের সঙ্গী’ অথবা ‘সব সময় দেখছে’ বলে তার সামনে একেবারে অগোছালো থাকা ইসলামি শিক্ষাবিরোধী।[১]
পারফিউম তথা সুগন্ধি ব্যবহার করা আসলে সুন্নত। ইসলামে নারীদের জন্য পর্দার বিধান আর সুগন্ধি ব্যবহারের বিধান পরস্পরের পরিপূরক অর্থাৎ একই বিধান। অনেক বোন বাইরে বের হওয়ার সময় পর্দা করে বের হন বটে; কিন্তু সঙ্গে পারফিউম বা অন্য সুগন্ধি ব্যবহার করেন। নারীদের বাইরে বের হওয়ার সময় সুগন্ধি ব্যবহার করা নাজায়েজ। এতে পর্দা লঙ্ঘন হয়। শরয়ি পর্দা আদায় হয় না। হাদিস শরিফে ওইসব নারীর ওপর অভিসম্পাত করা হয়েছে, যারা সুগন্ধি মেখে বের হয়। পর্দার সঙ্গে হলেও নারীরা পারফিউম বা সেন্ট জাতীয় কোনো সুগন্ধি ব্যবহার করে বাইরে যেতে পারবে না। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক চক্ষুই ব্যভিচারী। আর কোনো নারী যদি (কোনো ধরনের) সুগন্ধি ব্যবহার করে কোনো (পুরুষের) মজলিসের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে, তবে সে ব্যভিচারিণী।[২]
এমনকি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার ইবাদত করার উদ্দেশ্যে মসজিদে যেতেও সুগন্ধি ব্যবহার করতে পারবে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর বান্দীদেরকে মসজিদে আসতে বারণ করো না, তবে তারা যেন খোশবু ব্যবহার না করে সাধাসিধাভাবে আসে।[৩]

টুসি ঠিক বলে রুমের বাহিরে চলে গেল।আর সোহান রকিং চেয়ারে হেলান দিয়ে ডান হাত টা কপালের উপর লম্বা করে রেখে গভীর ভাবনায় মগ্ন হলো….
দেড় বছর আগে,
সাবা নামের মেয়েটি,সোহানের ব্যাবহার করা সুগন্ধির প্রশংসা করলে সোহান মেহুল কে দিয়ে একটা আতরের শিশী পাঠিয়ে দেয় এবং প‌ই প‌ই করে সাবধান করে দেয় সাবা যেন সুগন্ধি ব্যবহার করে বাহিরে বের না হয়। কেননা
কোনো নারী যদি (কোনো ধরনের) সুগন্ধি ব্যবহার করে কোনো (পুরুষের) মজলিসের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে, তবে সে ব্যভিচারিণী।
সাবা আতর ব্যবহার করবে কি? সোহান দিয়েছে এতেই সে খুশীতে আত্মহারা। খুব যত্ন সহকারে তুলে রাখে আতরের শিশী খানা।যখন মনে হয় তখন বের করে ঘ্রাণেন্দ্রিয় দিয়ে সুবাস অনুভব করে।
এর পর থেকে শুরু হয় তার পাগলামী, সোহান কে লুকিয়ে দেখা যেন তার নৃত্য দিনের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।মেহুলের কাছ থেকে জানতে পেরেছে সোহান তার ভাই।তালবাহানা করে দুতলায় যায় এক বিন্দু দেখার জন্য সোহান কে। সাথে নিজেকে সাজসজ্জায় রাঙিয়ে তোলে যেন সোহানের চোখে নিজেকে আকর্ষণীয় করে তুলতে পারে।
আসলে বয়স টাই এরকম উল্টো পাল্টা লজিক ঘুরে বেড়ায় মাথায়।হিতাহিত জ্ঞান থেকে না। ভালো মন্দ বুঝার মত জ্ঞান খুবই কম থাকে।

তো একদিন সাবা নিজেকে পরিপাটি করে দরজায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে কখন সোহান আসবে, তাকে দেখে স্তব্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকবে।যখন সোহান অপেক্ষার প্রহর কাটিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে, তখন সাবা সামনে এসে দাঁড়ায়। এমনি করে হঠাৎ সামনে আসায়, চোখ বড় করে তাকায় সোহান। তাকিয়ে দেখলো তার সামনে এক সুন্দরী নারী দাঁড়িয়ে আছে। লম্বা কিছু চুল সামনে রেখে দিয়েছে তা ছাড়া আর কতো সাজসজ্জা! সোহান কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মাথা নিচু করে নেয়। তারপর পাশ কেটে চলে যেতে নিলে,সাবা আবার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়!এতে করে সোহান খুব রেগে যায় এবং ধমকে উঠে বলে,
— এই মেয়ে সমস্যা কি তোমার?একেই তো বে-পর্দায় এসে দাঁড়িয়েছো তার উপর এমন অসভ্যতা করেছো।ফারদার এরকম বে-পর্দা হয়ে আমার সামনে আসবে না বলে দিচ্ছি। না হয় আমি তোমার বাবার কাছে নালিশ দিতে বাধ্য হবো।

তারপর সাবা সরে দাঁড়ালে সোহান গটগট পায়ে প্রস্থান করে। এরপর থেকে সাবা নিজেকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করে, ঘরে বাইরে সব জায়গায় মাথা ঢেকে রাখে। সোহানের সামনে যায় না। তবে সোহান কে বড্ড ভালোবেসে ফেলে।যা ভোলার নয়, রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায় সোহানের কথা ভেবে ভেবে।

একদিন কলেজ থেকে ফিরার পথে, কালো মেঘে অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। কিছুদূর এগিয়ে যেতেই ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি বর্ষাতে শুরু হয়।সাবা এতো বৃষ্টির মাঝেই ভিজে ভিজে বাড়ী ফিরছে। তখন পিছন থেকে কেউ ডেকে বলে,
— এই মেয়ে এভাবে কাক ভেজা হচ্ছো কেন?জ্বর ঠান্ডা ভালো মন্দ কিছু হয়ে যাবে তো‌।এই নাও..

নিজের ছাতাটা সাবাকে নিতে বলে সোহান, কিন্তু সাবা মাথা নাড়িয়ে বোঝায় ছাতা লাগবে না তার। সোহান জোর করলে,অকষ্মিক সাবা বলে বসে,
— ভালোবাসি! কেন বোঝেন না? নাকি বোঝাতে চাইছেন না?
— বিয়ের আগে এসব সম্পর্ক কে ইসলাম হারাম বলেছে এটা জানো না তুমি?এমন অনেকেই আছে যারা হয়তো পাঁচ ওয়াক্ত সালাত পড়ে, রমজানে রোজা রাখে, দ্বীনের ব্যাপারেও খুব আগ্রহী। কিন্তু, একটা জায়গায় এসে আটকে গেছে— হারাম সম্পর্ক।
নবী-রাসুলের সময় থেকে এখন পর্যন্ত ইসলামের দৃষ্টিতে বিবাহ বহির্ভূত তথাকথিত রিলেশনশিপ বা প্রেমের সম্পর্ক সম্পূর্ণ হারাম । একে অপরের সঙ্গে কামনা-বাসনা সহকারে কথাবার্তা, নির্জনে দেখা-সাক্ষাত, ডেটিং, চ্যাটিং, স্পর্শ, হাসাহাসি, দুষ্টামি সবই ইসলামে নিষিদ্ধ।
এসব রিলেশনশিপ মূলত শয়তানের ফাঁদ। এই ফাঁদে পড়ে নারী-পুরুষ উভয়ে জেনার দিকে ধাবিত হয়-যার পরিনতি খুবই ভয়াবহ।
নারী-পুরুষ পরস্পরের প্রতি দৃষ্টি বিনিময়েও রয়েছে সুস্পষ্ট হুকুম। এ প্রসঙ্গে কুরআনে পাকে আল্লাহ তাআলা সুস্পষ্ট নীতিমালা ঘোষণা করেছেন।
পুরুষদেরকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেন- ‘(হে রাসুল! আপনি) মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা রয়েছে। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ তাআলা সে ব্যাপারে খবর রাখেন।[৪]

— তাহলে চলুন বিয়ে করবো!
— পাগল নাকি?বলা নেই কওয়া নেই বিয়ে করে নিব? বিয়ে শুধু দুটো মানুষের বন্ধন নয়, দুটো পরিবারের বন্ধন। সেখানে নিজেরা নিজেরা সিদ্ধান্ত নেয়া কোন বিবেচিত বিষয় নয়।
— পরিবার তো মেনে নিবে না, কিন্তু আমি যে আপনাকেই স্বামী হিসেবে চাই!
— আমি কথা বলবো আমার আম্মার সাথে!

সোহানের এমন সহজ কথায় খুশিতে কেঁদে দেয় সাবা….
_____________
রেফারেন্স:-
[১] আলমুফাসসাল ফি আহকামিল মারআ : ৩/৩৪৮
[২]আবু দাউদ, তিরমিজি, নাসায়ি, ইবনে হিব্বান, ইবনে খুযাইমাহ, হাকেম, সহীহুল জামে, ৪৫৪০ নং।
[৩] আহমাদ, আবু দাউদ, সহিহ জামে ৭৪৫৭
[৪] সুরা নুর: আয়াত ৩০
_________________

#চলবে… ইনশা আল্লাহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে