ভালো লাগে ভালোবাসতে-পর্ব ৯

2
2459

#ভালো লাগে ভালোবাসতে
#পর্ব-৯
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

খুব ভোরে ঘুম একটু হালকা হতেই মনে হল যেন কোনো এক শক্ত বাঁধন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে আমায়।চোখ খুলে খুব কাছ থেকে দেখলাম নিদ্রর ঘুমন্ত মুখ।তার উষ্ণ নিঃশ্বাসে তপ্ত হয়ে উঠছে আমার আঁখি প্রশস্ত ললাট।নিজেকে ছাড়ানোর কিঞ্চিৎ চেষ্টা করলাম।কিন্তু এই শক্ত বাঁধন থেকে মুক্ত হওয়া যে দায়।
অনেক কষ্টে তার হাত ছাড়িয়ে উঠে বসলাম।আড়মোড়া ভেঙে সে চোখ মেলে চাইলো।আমি স্মিত বিস্মিত হয়ে বললাম,’আপনি ঘুমানো ছিলেন না!তাহলে আমাকে এভাবে ধরে রেখেছিলেন কেনো?’
দু হাত মাথার নিচে দিয়ে ঈষৎ ভ্রু ভাঁজ করে সে বলল,’বারে!তুমি স্বেচ্ছায় আমাকে ধরতে পারো আর আমি ধরলেই দোষ!’
আমি মুখ ভেংচি দিয়ে চলে গেলাম বাথরুমে।এই ছেলেকে কি আর কথা দিয়ে কখনো জব্দ করা যায়!নেহাত কাল রাতে একটু ভয় পেয়ে হয়ত ধরেছিলাম তার জন্য এত কথা!

বাথরুম থেকে আমি বের হলে নিদ্র ঢুকে গেল।
আমি চোখ বুলিয়ে তার রুমটা দেখতে লাগলাম।কাল রাতে অতো খেয়াল করা হয়নি।বৃহৎ প্রশস্ত রুমে আসবাবপত্র কম।হয়তো সে ছিমছামই পছন্দ করে।হোয়াইট বেড শিটে ঢাকা নরম বিছানা ঘেষা দেয়ালটির রঙ হালকা আকাশি। বাকি দুই দেয়ালে সাদা রঙ করা হয়েছে।রুমের সাথে বারান্দার সংযোগস্থল দেয়ালটি পুরো কাচের।পুরোটা জুড়ে টেনে রাখা হয়েছে সাদা পর্দা।বিছানা থেকে নামার সম্মুখে ফ্লোরে রাখা একটি সাদা পশমের নরম তুলতুলে কার্পেট।কার্পেটের রঙটি এতো সাদা যে পা রাখতেও ইচ্ছে করে না।মনে হয় ময়লা হয়ে যাবে।বেডের পাশে রাখা ছোট্ট বেড সাইড টেবিল।তার পাশে হালকা আকাশি রঙের পাতলা পর্দায় আবৃত খোলা প্রশস্ত জানালা।জানালার কোন ঘেষে রাখা হয়েছে মাঝারী সাইজের সাদা রঙে আবৃত কাঠের টেবিল।আর আছে খুব সুন্দর একটি বড় সাদা আলমারি,বৃহৎ ড্রেসিংটেবিল আর আকাশি রঙের সোফা।সাদা আকাশি রঙের কম্বিনেশনের রুমটিতে কেমন একটা শান্তি শান্তি ভাব বিরাজমান।
আমি ধীরপায়ে নিচে নেমে এলাম।কেমন যেন একটু জড়তা কাজ করছে।আমাদের জন্য ভনিতা হলেও সবার কাছে তো এই সম্পর্ক সত্যি।সেই সূত্রে তো এটা আমার শ্বশুরবাড়ি।মেয়েদের বিয়ের পর খুব বিরাটভাবেই জীবনে পরিবর্তন নেমে আসে এই সত্যতা সম্পর্কে আমিও অবগত।এখনই কি একঝাঁক দায়িত্ব আমার উপর জেঁকে বসবে?তবে কি জীবনের সহজ সরল ধারাটা হারিয়ে ফেললাম বাস্তবতার ভীড়ে।
রান্নাঘরে গিয়ে চায়ের জন্য পানি চড়াতেই অ্যান্টি হন্তদন্ত হয়ে এসে থমথমে গলায় বলল,’সুপ্তি,এসব কি হচ্ছে?’
আমি সচকিত হয়ে খুঁজতে লাগলাম কোথাও কোনো ভুল করে ফেললাম না তো!
আমতা আমতা করে বললাম,’অ্যান্টি সবার জন্য একটু চা বানাচ্ছিলাম।’
অ্যান্টি বলল,’তোকে কে বলেছে চা বানাতে।শোন,যতদিন তোর পড়ালেখা শেষ হবে না এই রান্নাঘর তোর জন্য নিষিদ্ধ।বাড়িতে কাজের লোকের কি কম পড়েছে নাকি যে আমাকে আমার বাচ্চা বউ দিয়ে কাজ করাতে হবে।আর আমাকে কি তোর বুড়া শ্বাশুড়ি মনে হয় যে বউকে একা খাটিয়ে খাবো।তোর পড়ালেখা শেষ হোক তারপর আমি নিজে তোকে সব শিখিয়ে দেব তার আগে কিচ্ছু করতে হবে না,যা রুমে যা।আমি তোর জন্য চা পাঠিয়ে দেব আর নিদ্রর জন্য কফি।নিদ্র কিন্তু শুধু কফি খায়,চা খায় না।
আমি মুচকি হেসে মনে মনে বললাম,হুম,তার জন্যই তো কফির সৃষ্টি।এত সুন্দর করে যে কফি খায় সে কফি ছাড়া আর অন্য কিছু কেনো খাবে?

আমি জ্বি অ্যান্টি বলে চলে যেতে ধরলেই অ্যান্টি আবার থামিয়ে বলল,’সুপ্তি,অ্যান্টি কিরে! মা বলবি মা।’
আমি মুচকি হেসে মা বলে চলে আসলাম।মা আসলেই কত ভালো।শ্বাশুড়ির মত তো একদম লাগে না,মায়ের মতই লাগে।আর কি সুন্দর তুই করে কথা বলে একদম আপন করে নেয়।

একটি রুম থেকে আসা ভাঙাচোরার আওয়াজ শুনতেই আমি থমকে দাঁড়ালাম।দরজার কোণায় দাঁড়িয়ে একটু উঁকি দিতেই দেখতে পেলাম একটি তেরো কি চৌদ্দ বছরের সুন্দর ছেলে একটি রিমোট কন্ট্রোল কার ভেঙে ভেতরের অংশ নিয়ে নাড়াচাড়া করছে।ছেলেটির পরনে লাল টি শার্ট মাঝখানে ব্যাট ম্যানের ছবি দেওয়া।চুলগুলো জেল দিয়ে খাড়া করা।আমি কৌতূহল নিয়ে ভেতরে গেলাম।ভেতরে গিয়ে চোখে পড়ল প্রায় সবগুলো গাড়ির একই অবস্থা।আমি বিস্ময় নিয়ে বললাম,’এসব কি করেছো?’
ছেলেটি গাড়ি থেকে মুখ না তুলেই বলল,’ইনভেনশন করছি।’
-‘এত সুন্দর গাড়ি ভেঙে কিসের ইনভেনশন?’
-‘এই গাড়ির মোটর আমি আমার বানানো হেলিকপ্টারে লাগাবো।’
এই বলে সে আমার সামনে প্লাস্টিক আর মোটা কাগজে বানানো অনেকটা হেলিকপ্টারের মত দেখতে কিছু একটা তুলে ধরল।
আমি বিস্ময় ভরা চোখে বললাম,’এই মোটর লাগালেই এটা উড়বে?’
-‘উড়বে না কেনো?আমি এর আগেও এমন করে একটি সি-বোট বানিয়েছি।’
ছেলেটির মাথায় তো দেখি ভালো বুদ্ধি।আমি উৎসুক হয়ে বললাম,’তুমি যখন উড়াবে আমাকেও ডাক দিয়ো ঠিকাছে।’
ছেলেটি ‘ওকে’ বলে মুখ তুলে তাকিয়ে বলল,’তুমিই কি আমার ভাবু?’
আমি অবাক হয়ে বললাম,’ভাবু আবার কি?’
ছোটো ছেলেটি ব্যাপক মুডে বলল,’ ভাবীর ভা আর বাবুর বু।আমি আরিয়ান ইসলাম নিদ্রর একমাত্র ছোটো ভাই আরশান ইসলাম স্নিগ্ধ।তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে তাই আমি তোমাকে বাবু বলেও ডাকবো।
আমি হেসে ছেলেটির গাল টিপে বললাম,’তুমি তো দেখি অনেক কিউট!’
ছেলেটি গাল ডলে বলল,’কিউট না বলো হ্যান্ডসাম।’
আমি শুধু দেখছি আর অবাক হচ্ছি দুই ভাই একই ক্যাটাগরির।বাচ্চা ছেলে তবুও দেখো কি গাম্ভীর্য্য নিয়ে কথা বলে!
এর সামনে মনে হচ্ছে আমিই এর থেকে ছোটো।
স্নিগ্ধ তার গাড়ি নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কথাবার্তা আমার সাথে করতে লাগলো।আমি তো মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না।তবুও ঘাড় নাড়িয়ে ভাব করছি যে সবই বুঝতে পারছি।
আমি স্নিগ্ধকে সাহায্য করার নাম করে একটি গাড়ির স্প্রিং জাতীয় কিছু টান দিতেই সেটা ভেঙে আমার মুখে ছিটকে পড়লো।আমি থতমত খেয়ে গেলাম।
স্নিগ্ধ হাসতে হাসতে লুটোপুটি খেয়ে বললো,’তুমি তো ভালো বোকা।এটা এভাবে ধরে টান দেয় নাকি!’
আমি একটু কনফিডেন্স নিয়ে তোতলিয়ে বললাম,’হ্যাঁ।তা তো জানি।আমি তো এমনিই একটু ট্রাই করে দেখছিলাম যে এভাবে করলে কেমন হয়।’
ও হাসতে হাসতেই বলল,’হুম আমি সবই বুঝি,এমা কি বোকা!
আমি একটু অপমানিত বোধ করলাম।একটি বাচ্চা ছেলের সামনেও বোকা বনে গেলাম।আর এই বাচ্চা ছেলে এতটুকু বয়সে এত ভাব নেয় কেনো।হাত দিয়ে ওর চুলগুলো এলোমেলো করে মুখ ভেংগিয়ে চলে আসলাম।
এই দুই ভাই কি খায় কে জানে।মাথার ভেতর বুদ্ধি ঠেসে ঠেসে ভরা।

নিদ্রর রুমে যাওয়ার আগে কাজের মহিলা আমার হাতে তার কফি ধরিয়ে দিল।আমি চা নিচেই খেয়ে এসেছি।আমি কফি নিয়ে ভেতরে ঢুকতেই সে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো টাওয়েল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে শুধু একটি থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পড়ে।পানিতে ভিজে লেপ্টে থাকা তার লোমশ বুকটি দেখে আমার শরীরে একটি ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো।আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম।
কি ভয়ংকর ব্যাপার!এভাবে একটি মেয়ের সামনে সে চলে আসবে!তার কি লজ্জা শরম বলতে কিছু নেই।কফির মগ হাতে সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম।না চাইতেও বেহায়া চোখ বারবার সেখানে চলে যাচ্ছে।হঠাৎ হাতের কাঁপুনিতে মগ থেকে হালকা কফি ঝলকে পরলো আমার হাতে।আমি মৃদু শব্দে আহ্ করে উঠলাম।
সে টাওয়েল ছুঁড়ে ফেলে উদ্বিগ্ন মুখে আমাকে সোফায় বসিয়ে তার ঠান্ডা হাতে আমার হাত ধরে দেখে বলতে লাগলো কি হয়েছে।
এভাবে খালি গায়ে তার একদম আমার কাছ ঘেঁষে বসায় আমার শরীরে এক অন্যরকম শিহরণ বইতে লাগলো।আমি একটু একটু করে সরে বসতে চাইলাম।কিন্তু সে ততই আরো ঘেঁষে বসতে লাগল।
আমি বিরক্তি ছাপিয়ে হাত ছাড়িয়ে বললাম,’আপনি একটু প্লিজ সরে বসবেন।’
সে আমার দিকে কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে দুষ্টুমি ভরা হাসি দিয়ে আরো ঘেঁষে বসলো।আমি আবারো তোতলিয়ে একই কথা বললাম।সে এবার সোফার ব্যাকসাইড আর কর্ণারে হাত রেখে একটু একটু করে আমার দিকে আগাতে লাগলো আর বলতে লাগলো,’কেনো সরে বসবো,সামথিং সামথিং ফিল হয়?’
দু পাশে তার দুহাতের বেড়া জালে বন্দি হয়ে আমি পিছনে ঘেষতে লাগলাম।একসময় সোফার হাতলে আমার মাথা ঠেকে গেলে আমার পিছানো বন্ধ হয়ে গেল কিন্তু তার আগানো আর বন্ধ হলো না।নিচের ঠোঁট কামড়ে মুখে দুষ্টু হাসি নিয়ে সে আমার দিকে এগিয়েই যাচ্ছে।খুব কাছে চলে এলে অজানা শঙ্কায় ঢোক গিলে আমি চোখ মুখ কুঁচকে বন্ধ করে ফেললাম।আমার গালে তার ভেজা খোঁচা খোঁচা দাড়ির আলতো পরশ দিয়ে হাত বাড়িয়ে আমার পেছন থেকে তার শার্ট টেনে নিয়ে ফট করে উঠে গেল।আমি চোখ মেলে তাকাতেই সে মুচকি হেসে আবার বাথরুমে চলে গেল।আমি উঠে বসে বুকে হাত দিয়ে একবার জোড়ে শ্বাস নিলাম।
এই ছেলে তো দেখি ভালো লুচু।অন্য মেয়েকেও পছন্দ করে আবার আমার সাথেও কেমন করে!
শার্ট নেওয়ার ছিলো বললেই তো হতো এভাবে আগানোর কি দরকার ছিলো।আমি কি সাংঘাতিক ঘাবড়ে গিয়েছিলাম!

এতো বেলা হয়ে গেছে আর বারান্দার পর্দা এখনো টানা।আমি উঠে গিয়ে পর্দা সরিয়ে দিলাম।এক ঝলক সকালের রোদ আমার মুখে এসে পড়লো।রোদের ঝলকানিতে মৃদু চোখ বন্ধ করে আবার আধো খুলতেই সামনে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেলাম।কাঁচের দরজা টেনে সরাতেই সকালের স্নিগ্ধ হাওয়া আর মৃদু ফুলের সুভাস আমার ঠোঁটের কোণায় আনমনেই একটি হাসি টেনে আনল।
কোনো বাড়ির এত সুন্দর বারান্দা আমি কখনো দেখিনি।পুরো মেঝেতে কাঠের পাটাতন।দুপাশের সাইড দেয়ালের রঙ হালকা সবুজ।দেয়ালের বাম সাইডের কর্ণারে একটি শেগুন কাঠের টেবিল।তার পাশে দেয়ালের সাথে সংযুক্ত বই ভর্তি বিশাল বুকশেলফ।বুকশেলফটি এমন ভাবে সাজানো যে দেখে মনে হয় একটি বটগাছের ডালে সারি সারি ফুল।বারান্দাটাও বিশাল।মাথার উপরের ছাদ অর্ধেক পর্যন্ত গিয়ে পুরো খোলা।টবে লাগানো বিভিন্ন ধরণের ফুল ফুটে রয়েছে।ডান পাশে একটি ঝুলা টাইপ গোল দোলনা।সামনের কাঠের রেলিং সোজা গিয়ে কর্ণারে এসে থেমে গেছে।সেখানে আবার সরু কাঠের সিড়ি সোজা বাড়ির পেছনে বাগানে গিয়ে নেমেছে।যেখানে বাহারী ফুলের মেলার মাঝে বড় একটি দোলনা।এতো দেখি পুরো স্বর্গপুরী!নিদ্রর রুমের ভেতরটা যেমনই মনে আকাশের অনুভূতি জাগ্রত করে তেমনি বারান্দাটা ফুটিয়ে তোলে সবুজ প্রকৃতির স্নিগ্ধতা।
টেবিলের দিকে তাকিয়ে একটি বস্তুতে আমার চোখ আটকে গেল।ধীর পায়ে এগিয়ে কলমদানী থেকে তা বের করলাম।আমার সেই চুলের কাঠি।নিদ্র এখনো এটা কলমদানীতে এত যত্ন করে রেখেছে কেনো!


মাঝে মাঝে কিছু করার না থাকলে জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করতে আমার ভালো লাগে।নিদ্রর আলমারীটা তাই ঘাটাঘাটি করছিলাম।হঠাৎ চোখ পড়ল সাইডে আলাদা করে রাখা একটি সাদা শার্টের উপর।এটা সেই শার্ট যেটা নিদ্র আমাদের প্রথম দেখার দিন পড়ে ছিল,যেদিন আমি তাকে থাপ্পড় মেড়েছিলাম।যেই থাপ্পড়ই সবকিছুর সূচনা।
শার্টের ভাঁজ খুলে মেলতেই আমি অবাক হয়ে গেলাম।সেদিনের আমার থেকে লাগা কাঁদার দাগ এখনো লেগে রয়েছে।মনে হচ্ছে সেদিনের পর শার্টের অবস্থা যেমন ছিল নিদ্র সেভাবেই খুলে রেখে দিয়েছে।আমি ভাবনায় পড়ে গেলাম এর পেছনের কারণ কি হতে পারে।সে আবার রাগবশত এটা ফেলে রাখেনি তো!
শার্টটাকে ধুতে আমার প্রায় দেড়ঘন্টা লাগলে।
আট নয় মাসের পুরনো কাঁদার দাগ,সহজে কি আর উঠে।আমি দাগ ভরিয়েছি তাই আমিই ধুয়ে দিলাম।বারান্দায় হেঙ্গারে ঝুলিয়ে রোদে শুকাতে দিলাম।

বিকেলের দিকে নিদ্র বাড়ি ফিরল।আমি তখন সোফায় বসে উপন্যাস পড়ছিলাম।ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় গিয়ে সে একটা হুংকার দিল।আমি দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে দেখতে পেলাম সে শুকিয়ে যাওয়া শার্ট হাতে বড় বড় চোখ করে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম,’কি হয়েছে?’
সে থমথম মুখ করে বলল,’এটা কে ধুয়েছে?’
-‘আমি ধুয়েছি।এটা আপনি এখনো ধুয়ে দেননি কেনো?যাক!আমি নষ্ট করেছি তাই আমিই ধুয়ে দিলাম।’
আমার কথা শেষ হতেই সে রাগে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে পরনের টি শার্টটি খুলে ফেলে সাদা শার্টটি গায়ে দিল।তারপর আমার হাত টানতে টানতে সিঁড়ি বেয়ে বাগানে নিয়ে দাঁড় করালো।আর একটা পানির পাইপ নিয়ে এসে আমার সামনের কিছু মাটি ভিজিয়ে কাঁদা বানিয়ে দিয়ে হাওয়া হয়ে গেল।আমি তো শুধু হা হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি এসব কি করছে।
কিছু মুহুর্ত পর সে ফিরে এলো বাইক চালিয়ে।আমার সামনে দিয়ে যেয়ে আমার গায়ে পুরো কাঁদা ছিটিয়ে দিল।তার অদ্ভুত কান্ডে আমার চোখ বড় বড় হয়ে গেল।তারপর বাইক থেকে নেমে কাছে এসে ফট করে আমাকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে।আমি তো একেবারে শকড হয়ে রইলাম।
আমাকে ছেড়ে গায়ের সাদা শার্টটিতে আবারো লেগে যাওয়া কাঁদার দাগ দেখে নিজে নিজে বলল,’এবার ঠিক আছে।’
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল,’এই দাগ যেনো ভুলেও না উঠে।’
এই বলে সে চলে গেল।আর আমি আবারো গায়ে এক গাঁদা কাঁদা নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম,এই ছেলে কি পাগল!


খুব ভোরেই আমার ঘুম ভেঙে গেল।গায়ে একটি সাদা চাদর জড়িয়ে বারান্দায় চলে এলাম।বাইরে ঢাকা কুয়াশার চাদর দেখে খুব হাঁটতে ইচ্ছে করলো।শিশির ভেজা ঘাসে খালি পায়ে হাঁটতে আমার খুব ভালো লাগে।কুয়াশা এতটাই প্রকট যে দু হাত সামনের বস্তুও দেখা যাচ্ছে না।।সকালের স্নিগ্ধ হাওয়ায় এক অদ্ভুত জাদু থাকে।মনের যাবতীয় জঞ্জাল দূর করে দেয়।
হঠাৎ কুয়াশার চাদর ভেদ করে নিদ্র এল।গায়ে একটি পাতলা সবুজ রঙের শার্ট আর কালো ট্রাউজার।এসেই দাঁড়িয়ে একটি মৃদু হাসি দিল।

বাহ্!প্রকৃতি যেন সঠিক সময়ে আরো একটি সঠিক সৌন্দর্য্যের প্রকাশ ঘটালো।
আরো কিছুক্ষণ দুজনে হাটাহাটি করে বারান্দায় ফিরে এলাম।আজকে মনটা কেমন যেন কাব্যিক হয়ে আছে।খেয়াল হল যে নিদ্র শুধু একটি পাতলা শার্ট পড়ে আছে।তার অবস্থা দেখে যেন আমার আরো শীত লেগে গেল।চাদরের নিচে হাত ঢুকিয়ে বললাম,’আপনার শীত করছে না।’
সে শুধু মৃদু হাসলো কিছু বললো না।আমি বললাম,একটি গান শুনান না।’
সে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে বসে পাশে রাখা গিটারটা কোলে তুলে নিল।আর এলোমেলো টুন বাজাতে লাগল।
টবে ফুটন্ত একটি লাল গোলাপ আমার দৃষ্টি কেড়ে নিল।হাত বাড়িয়ে আমি গোলাপটিকে স্পর্শ করলাম।গোলাপের গায়ে বিন্দু বিন্দু জমে থাকা শিশিরকণা আমার আঙ্গুলে লেগে গেল।এই গাছের গোলাপগুলো যেন একটু বেশিই লাল।এর লাল রঙ খুব আকর্ষিত করে আমায়।হাতদুটো চাদরের নিচে গুটিয়ে নিয়ে একটু চোখ বন্ধ করে সবকিছু উপভোগ করলাম।আজকের সকালটা এত সুন্দর কেনো।নিদ্রর দিকে না তাকিয়েই বললাম
-‘এই গোলাপের রঙ কি সুন্দর তাই না!আমার খুব ভালো লাগে।আপনার কেমন লাগে?’
-‘জানি না।পৃথিবীর সেরা সৌন্দর্য্যে চোখ আটকে গেছে আমার,অন্য সৌন্দর্য্য এখন আর আমাকে আকর্ষণ করতে পারে না।’
আবারো তার কথার আগা মাথা কিছু বুঝতে না পেরে আমি চোখ গোল গোল করে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।সে মৃদু হেসে গিটারের তারে গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠল,

তোমার অবাক দিক
দেখে মুগ্ধ চারিদিক,
দেখে মুগ্ধ ঐ আকাশ
মুগ্ধ ভোরের বাতাস।
করি সেখানে খোঁজ
যেথা স্বপ্ন মেশে রোজ,
যেথা তুমি আড়ালে
হেসে দাঁড়ালে।

আজকের দিনটা কি শুধুই সৌন্দর্য্য উপভোগের দিন।এক সাথে এত সৌন্দর্য্য সইবে তো!


চায়ের কাপের চুমুকে শুরু হল আমাদের বিকেলের আলাপচারণ।আমার শ্বাশুড়িমার সাথে আমি এখন পুরো বন্ধুর মতো মিশে গেছি।প্রতিদিনই বাগানে রাখা গোলাকার টেবিলে চলে আমাদের দুজনের বিকেলের এই চা ভোজন।মাঝে মাঝে যোগ দেয় স্নিগ্ধ।স্নিগ্ধর সাথে আমার এখন হয়ে গেছে বাজাবাজির সম্পর্ক।একদম ছোটো ভাই বোনদের মত।সারাদিন একজন আরেকজনের পেছনে লেগে থাকা আর ভেতরে ভেতরে কলিজা।
স্নিগ্ধকে পেয়ে আমার এতদিনে ছোটো ভাইয়ের অভাব ঘুচল।স্নিগ্ধ এখনো চায়ের টেবিলে বসে হাতের ঘড়ি খুলে নাড়িয়ে চারিয়ে দেখছে।এই ছেলে কি সোজাসোজি কিছু পড়তে পারে না।সবকিছু নিয়েই ইনভেনশন করতে চায়!
আজকে আমাদের চা পর্ব একটু শর্ট করতে হবে কারণ আমরা তিনজন আজ শপিংয়ে যাবো।আমার কিছু কেনার নেই,মা কিনবে,আমি যাচ্ছি পছন্দ করায় সাহায্য করতে।
আমার সামনে মুখোমুখি একটি চেয়ার টেনে নিদ্র হাত দিয়ে চোখ কঁচলে বসে পড়ল।দুপুরে ঘুমিয়ে ছিল,এখনো চোখে ঘুম ঘুম ভাব বিরাজমান।পরনে একটি হোয়াইট টি শার্ট আর ব্রাউন থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে।
নাহ! বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যাচ্ছে না।অতি সুন্দর মানুষদের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে বুকের ভেতর চিন চিন ব্যাথা করে।
মা আর স্নিগ্ধর চা খাওয়া হয়ে গেছে।আমার এখনো অর্ধেকও হয়নি।মা বলল,’সুপ্তি,তোর দেখি এখনও শেষ হয়নি।আমরা গাড়িতে গিয়ে জিনিসপত্র উঠাচ্ছি।তুই চা খেয়ে আয়।’
আমি ঘাড় নাড়িয়ে হ্যাঁ বললাম।
মা আর স্নিগ্ধ চলে গেলে নিদ্র আমার চায়ের কাপ টেনে একটা চুমুক দিল।আমি সচকিত হয়ে বললাম,’আপনি আমার চা খাচ্ছেন কেনো?আপনি না চা খান না?’
সে হালকা ভ্রু কুঁচকে আমার কথার কোনো তোয়াক্কা না করে আরেক চুমুক দিয়ে ঘুম ঘুম চোখে বলল,’কোথায় যাবে?’
-‘মার্কেটে।’
-‘যাওয়া লাগবে না।’
-‘যাবো না মানে!’
-‘যাবা না মানে যাবা না।আমি একা থাকবো নাকি!’
এর মাঝে স্নিগ্ধ আর মা আবার আমাকে ডাকতে আসে।আমি উঠতে যাবো ঠিক তখনই নিদ্র টেবিলের নিচ দিয়ে তার পা দুটো দিয়ে আমার পা আঁকড়ে ধরলো।আমি উঠতেও পারছি না আবার কিছু বলতেও পারছি না।মিনতি ভরা চাহনি নিয়ে নিদ্রর দিকে তাকিয়ে রইলাম।কিন্তু সে চায়ের কাপের দিকে তাকিয়ে থেকে নির্বাক।
আর এদিকে মা বারবার তাড়া দিয়ে উঠতে বলছে।আমিও শুধু কাঁচুমাচু করে যাচ্ছি।সে কিছুতেই পা ছাড়ছে না।
হঠাৎ স্নিগ্ধর হাত থেকে ওর ঘড়ি পড়ে গেল।সেটা উঠাতে ও নিচে ঝুকলো।
মা আবার বলল,’কিরে উঠ।’
স্নিগ্ধ মাটিতে ঝুঁকে থেকেই বলে উঠল ,’মা ভাইয়া ভাবুর পা ধরে রেখেছে।ভাবু উঠবে কিভাবে।’
ওর কথায় নিদ্র ঝট করে আমার পা ছেড়ে দিল।আমরা দুজনেই লজ্জায় থতমত খেয়ে গেছি।
মা একটু মুচকি হেসে স্নিগ্ধর হাত ধরে বলল,
-‘চল।’
স্নিগ্ধ বলল,’ভাবু যাবে না?’
-‘না।’
মা আর স্নিগ্ধ চলে যাচ্ছে আর আমি লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছি।এই দুই ভাই আমাকে পাগল করে দিল!

চলবে,,

2 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে