ভালো লাগে ভালোবাসতে
পর্ব-৪
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
আচ্ছা কচুপাতা রঙের কি কোনো নাম নেই?
নাকি একে শুধু কচুপাতার রঙই বলে।অদ্ভুত সুন্দর এই রঙ,না একে টিয়া বলা যায় না সবুজ।যা মনকে দোটানায় বেঁধে রেখেও এক স্নিগ্ধতা দিয়ে চোখকে ধাঁধিয়ে রাখে।অনেকটা নিদ্র ভাইয়ার মতো।তার প্রতি নিজের অনুভূতিও আমি
ধরতে পারি না।পারি না সেই অনুভূতিকে নাম দিয়ে বাঁধতে।ভালো লাগা আর বিরক্তির দোটানার মাঝে তাকে ঠাঁই ঠিয়ে বুঝে উঠতে পারি না কিছুই।দ্বিধাগ্রস্তে বিরাজ করাই যেহেতু আমার স্বভাব তাই দোটানায় গা ছেড়ে দিয়ে আমিও ভাসতে লাগলাম।কারণ যখন কিছুই বোঝা যায় না তখন কিছু না বোঝার চেষ্টা করেই পালের হাওয়ায় তাল মেলানোই ভালো।
চোখ ধাঁধানো সেই স্নিগ্ধতাকে উন্মুক্ত করে দিয়ে জড়িয়ে নিলাম গায়ে।বাঙালীপ্রাণ আমার মনকে প্রাধান্য দিয়েই কচুপাতা রঙের শাড়ির সাথে মানিয়ে পড়ে নিলাম হাতে একগুচ্ছ লাল চুড়ি।কানে ঝুমকো কানের দুল আর চোখে লাগিয়ে দিলাম এক চিমটি মেঘবরণ কাজল।সামনের চুলগুলো পিছনে ঠেলে পিঠ বেয়ে উন্মুক্ত করে দিলাম ঈষৎ কোঁকড়া কালো কেশ।
ভার্সিটির গেটের কাছে এসে মনে হল হয়তো একটু বেশিই তাড়াতাড়ি এসে পড়েছি।বেশি কাউকে দেখা যাচ্ছে না।চলতে থাকা ধীর পদক্ষেপ থামিয়ে দিতে হল সামনে তাকিয়ে।নিদ্র ভাইয়া নীল রঙের পান্জাবী আর সাদা পায়জামা পড়ে গেটের সামনে লেডারে দাঁড়িয়ে গাঁদা ফুলের লম্বা ঝোলন লাগাচ্ছে গেটে।পান্জাবীর হাতা কনুই পর্যন্ত ফোল্ড করে তার সেই ঘন কালো ভ্রু ঈষৎ ভাঁজ করে খুব মনোযাগ দিয়ে বেঁধে যাচ্ছে।কিছু মুহূর্তের জন্য চোখ আটকে গেল তার দিকে।
অতিরিক্ত সুন্দরী মেয়েদের অপ্সরা,বেহেশতের
হুর বলে সম্বোধন করা হয় কিন্তু অতিরিক্ত সুন্দর ছেলেদের ঠিক কি বলা হয়?তাকে কোনো শব্দ দিয়ে বিশেষন করা যাচ্ছে না।সবই কম মনে হচ্ছে। সে এখন ফুলের লম্বা ঝোলনটা খাটো করে মুখ দিয়ে কামড়ে ধরে রেখেছে।
নাহ!আর তাকিয়ে থাকা যাচ্ছে না।দ্রুত চোখ নামিয়ে নিলাম।মনকে বোঝালাম সে আমার সিনিয়র।সিনিয়ররা বড় ভাইয়ের মত।আড়চোখে আরেকবার তাকাতেই তার আমার উপর নজর পড়ল।আমাকে দেখেই তার মুখ থেকে ফুলের ঝোলন পড়ে গেল।সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইল হা করে।এবার আমার অস্বস্তি লাগছে। এভাবে তাকিয়ে রয়েছে কেনো!সে সম্বিৎ ফিরে পেল লেডার ধরে রাখা ছেলের ডাকে।
সে নিচে নেমে এলো।ছেলেটি বলতে থাকল,
-‘নিদ্র ভাই থ্যাংকস।কতক্ষণ ধরে চেষ্টা করেছি।কিছুতেই লাগাতে পারছিলাম না।’
ছেলেটি একনাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছে কিন্তু নিদ্র ভাইয়ার সেখানে কোনো হুঁশ নেই।আমার দিকে তাকিয়ে আছে তো আছেই।
আমিও কিছু না বলে মাথা নিচু করে পাশ দিয়ে চলে আসলাম।ভেতরে গিয়ে দেখি শুধু ছেলেরাই এসেছে মেয়েরা এখনো একজনও আসেনি,সব নিশ্চয়ই সাজতে ব্যস্ত।ফাংশন শুরু হবে দুপুরের পর থেকে।আর আমি দুপুরের আগেই চলে এসেছি।বেশ বিরক্ত লাগছে,কেন যে সোমা আপুর সাথে আসলাম না।আমি ভাবলাম সোমা আপুর সাজতে অনেক দেরি হবে তাই আগেই চলে যাই।আর সাফার তো আরো দেরি লাগে।
চারপাশে ছেলেরা হাঁটা চলা করছে।আমি মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে ফোন ঝাঁকিয়ে চারপাশের সাজগোছ দেখছি।
হঠাৎ নিদ্র ভাই আমার হাত টেনে মাঠের সাইডে নিয়ে গেল।আমি ঘটনার আকস্মিকতায় চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলাম।
সে বলল,’একেবারে মাঠের মাঝখানে গিয়ে যে দাঁড়িয়ে রয়েছো,সব ছেলেরা যে তোমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে সেদিকে কোনো খেয়াল আছে।আমি তো জানতাম মেয়েদের সাজতে অনেক সময় লাগে।এতো তাড়াতাড়ি চলে এলে কি করে?’
-‘দেখুন মেয়েদের সাজতে সময় লাগাটা স্বাভাবিক।আর আমার বেশি সময় লাগেনি কারণ আমি বেশি সাজগোছ করি না।’
সে একটু মুচকি হেসে বলল,
-‘তোমার এই জিনিসটাই আমার বেশি ভালো লাগে।তুমি সবসময় ন্যাচরাল থাকো।তোমরা মেয়েরা খুব বোকা যার কারণেই যুগের সাথে তাল মেলানোর জন্য চুল কালার,হাতে নেইলপলিশ,গাঢ় লিপস্টিক,মেকআপ এসব লাগিয়ে আসল সৌন্দর্য্যই হারিয়ে ফেলছো।আসলে কিন্তু ন্যাচরালটাই বেশি ভালো লাগে।চুলের রঙ যেমন কালোই বেশি মানায় তেমনি নেইলপলিশ বিহীন পরিষ্কার হাত দেখতেই বেশি ভালো লাগে।’
একটি সুদর্শন ছেলের মুখে নিজের প্রশংসা শুনে আমি মনে মনে ফুলতে লাগলাম।এর মধ্যে সাফা এসে বলতে লাগল,’ভাইয়া আপনি তো দেখি পাম দিয়ে ওঁকে আরো সেকেলে বানিয়ে দিচ্ছেন।ভার্সিটি লাইফে যেখানে আমরা সবাই টপস জিন্স ছাড়া কিছু পড়ি না সেখানে ম্যাডাম সবসময় সেলোয়ার কামিজ,শাড়ি এসবই পড়ে।’
আমি সাফার কাঁধে মৃদু থাপ্পড় মেরে বললাম,’তো! সবদেশেরই যেমন নিজস্ব সংস্কৃতি আছে তেমনি আমাদের দেশের সংস্কৃতি তো এটাই।বাঙালী মেয়েদের ওয়েস্টার্ন ড্রেসে যতই ভালো লাগুক না কেনো শাড়ির মতো সুন্দর আর কোনো পোশাকেই লাগে না।আর শালীনতা এসব পোশাকেই বজায় থাকে বেশি।’
নিদ্র ভাইয়া বলল,’একদম ঠিক।মেয়েদের এভাবে দেখতেই বেশি লাগে।’
পিছন থেকে তানিয়া আপু হেসে বলে উঠল,’নিদ্র তুই মেয়েদেরকে যাই পড়তে বলবি মেয়েরা চোখ বন্ধ করে তাই পড়বে।তোর জন্য যেমন পাগল!’
নিদ্র ভাইয়া বিরক্ত হয়ে বলল,’চুপ কর তো।’
সাফা বলে উঠল,’যাক সুপ্তি তুই তোর স্বপ্নের রাজকুমার না পেলেও অন্তত একজনের মুখে তোর বাঙালী গেটআপের প্রশংসা তো শুনলি।’
তানিয়া আপু কৌতুহলী হয়ে প্রশ্ন করলো,’স্বপ্নের রাজকুমার?’
সাফা হাসতে হাসতে বলল,’সবার যেমন লাইফে একটি গোল থাকে তেমনি সুপ্তির লাইফের গোল হলো একজন ভালোবাসার মানুষ পাওয়া।সুন্দর একটি চটপটা লাভ স্টোরি হওয়া।’
আমি চিমটি দিয়ে সাফাকে থামালাম।তবে হ্যাঁ,ও যা বলছে একদম সত্যি।আমি চাই আমার একটি সুন্দর লাভ স্টোরি হোক।আরে! বুড়ো বয়সে যদি নাতি নাতনিকে নিজের রোমাঞ্চকর লাভ স্টোরিই না শোনাতে পারি তবে ইয়াং থেকে করছি টা কি!
রাফি ভাইয়া হাসতে হাসতে বলল,’সে ব্যাপারে তোমাকে আর চিন্তা করতে হবে না সুপ্তি।আমাদের নিদ্র…..
এতটুকু বলতেই নিদ্র ভাইয়া তার মুখ চেপে ধরে নিয়ে গেলেন।আর রাফি ভাইয়া তার হাত ছাড়িয়ে বলার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।তারা সবাই চলে গেল।
সাফা অবাক হয়ে বলল,’নিদ্র ভাইয়ার আবার কি হল?’
আমিও মুখ বাকিয়ে কি জানি বললাম।
বিরক্তি হওয়ারও একটি সীমা থাকে।
এই মুহুর্তে আমি আর নিদ্র ভাইয়া দুজনেই চরম বিরক্ত।কাল এত ঘুরেফিরে যে ফুলের বন্দোবস্ত করা হয়েছিল সে ফুল এখনও এসে পৌছায়নি।অগত্যা আর কি করার,আমাদের আবারো গিয়ে দেখতে হবে সেখানে।সেকারণেই তো নিদ্র ভাইয়ার সাদা দামী গাড়ি ছুটিয়ে আমরা চলছি।আজ আর কালকের মত ভুল করেনি।তাই সাথে গাড়ি নিয়েই যাচ্ছে।নিদ্র ভাইয়া সামনে তাকিয়ে ড্রাইভ করছে আমি গাড়ির জানালা নামিয়ে হালকা মুখ বের করলাম।বাতাসে আমার চুলগুলো উড়ছে।চোখ বন্ধ করে তা অনুভব করতে লাগলাম।নিদ্র ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার চুলগুলোও মৃদু উড়ছে।
তাকে জিজ্ঞাসা করলাম,’আচ্ছা আপনি না একবার বলেছিলেন আপনি একটা মেয়েকে পছন্দ করেন?’
-‘পছন্দ করি না,ভালোবাসি।’
-‘ঐ তো।সেই মেয়েটাকে বলেছেন?’
-‘তাকে বলে বোঝাতে গেলে আমার মাথার চুল পেকে যাবে।’
-‘তাহলে এখন কি করবেন?’
-‘কি আর করব,তার থেকে বেশিদিন আমি দূরে থাকতে পারবো না।একদিন হুট করে জোর করেই বিয়ে করে ফেলবো।’
তার কথা শুনে আমার চোখ বড় বড় হয়ে অটোমেটিক হাত মুখে চলে গেল।কি সাংঘাতিক কথা!জোর করে বিয়ে করবে মানে?আমি তো আগেই জানতাম পলিটিক্স করা সিনিয়ররা এমনই হয়।শুধু শুধু কি আর ভয় পাই। ঐ সাফাকে এই কথা শোনাতে পারলে ভালো হতো।ও তো নিদ্র ভাই এই নিদ্র ভাই সেই নানা প্রশংসায় ভরিয়ে রাখে।
না জানি কোন মেয়ে ফেঁসে গেল!
ফুলের দোকানে গিয়ে দেখলাম তারা এখনই ফুল পাঠাতো।সব ঠিক করে রেখেছে।তাই আমরাও অপেক্ষা করতে লাগলাম ফুল নিয়ে একসাথেই যাব।সেই সময় জোহরের আযান দিয়ে দিল।আমরা বাঙালি মেয়েরা অন্য সময় মাথায় কাপড় থাকুক আর না থাকুক আযানের সময় ঠিকই উড়নার কোনা তুলে মাথায় দিয়ে নিব।না হলে মনে হয় পুরো মাথাটাই যেন শিরশির করতে থাকে।আমিও শাড়ির কোনা মাথায় তুলে নিলাম।একেবারে নতুন শাড়ি প্রথম ভাঁজ ভেঙে পড়ায় মাথায় কাপড় থাকছে না পড়ে যাচ্ছে।তাই বুকের কাছে শাড়ির কোনা দুটো একসাথে হাত দিয়ে ধরে রাখলাম।নিদ্র ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,’তোমাকে তো একদম বউ বউ লাগছে!’
আমাকে দেখে তার কেমন লেগেছে জানি না কিন্তু তার পৃথিবী বিক্রি করার মতন হাসি আর মুখের বউ শব্দটা শুনে আমার কেমন যেন লাগল।আবার সেই বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠল।
ফুলের দোকানে দেখলাম নিদ্র ভাইয়া বারবার ঘুরেফিরে সরাসরি আড়চোখে আমাকেই দেখে যাচ্ছে।আমি উদ্বগ্ন হয়ে ভাবতে লাগলাম আমার চেহারায় কি অস্বাভাবিক কিছু হয়েছে এত দেখছে কেনো!
ফিরে যাবার সময় সে আমার হাত পিছন থেকে টেনে ধরে মিনতির স্বরে বলল,
-‘সুপ্তি প্লিজ তোমার চুলগুলো একটু বেঁধে নিবে।’
সে এমনভাবে বলল আমি আর না করতে পারলাম না।যেন এই মুহুর্তে আমার খোলা চুল থাকলে তার আর নিস্তার নেই।
তাকে কি শুধু শুধুই আমি বুঝতে পারি না!
এই তো কিছুদিন আগে আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে করিডোরে দাঁড়িয়ে ছিলাম।আমার চুল ছিল চুলের কাঠি দিয়ে খোঁপা করা।কোথা থেকে নিদ্র ভাই এসে পিছন থেকে আমার চুলের কাঠি খুলে দিয়ে আমার ঘন কালো চুলগুলো পিঠ ভরে উন্মুক্ত করে দিল।আমি চমকে উঠে পিছনে ঘুরে তাকালাম।
কিছু বলার আগেই তিনি ব্যাপক মুড নিয়ে বলে উঠলেন,’কাঠিটা আমার লাগবে।’
আমি অবাক হয়ে বললাম,’চুলের কাঠি দিয়ে আপনি কি করবেন?’
-‘তুমি প্রশ্ন খুব বেশি করো।আমি তোমার সিনিয়র এটা কি মাথায় থাকে না?’
এতটুকু বলায় এতকথা শুনে আমি মুখ ফুলিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলাম।সে আবার সেই হাসি দিয়ে বলল,’খোলা চুলেই তো বেশি ভালো লাগে তবুও এদের উড়তে না দিয়ে বেঁধে রেখেছো কেনো?’
আমি তার হঠাৎ এত আবেগী সুর শুনে অবাক চোখে তার দিকে তাকালাম।সে ধীর পায়ে গুন গুন করতে করতে সেখান থেকে চলে গেল।আর আমি তাকিয়ে রইলাম তার যাওয়ার পথে।
সেই দোকান থেকেই একটি বেলি ফুলের মালা এনে সে আমার হাতে দিল।তার হাতের সানগ্লাসের দিকে তাকিয়ে আমি মাথায় খোঁপা করে বেলি ফুলের মালাটি খোপার চারপাশে পেঁচিয়ে কাটা ক্লিপ মেরে নিলাম।খোঁপা করা হয়ে গেলে তার দিকে তাকিয়ে বললাম,’ঠিক হয়েছে?’
সে আমার দিকেই তাকিয়ে ছিল,আমি তাকানোর পর একটু ইতস্তত করে মাথা চুলকিয়ে হুম বলল।
গাড়িতে উঠে বসলাম।গাড়ির আয়নায় নিজেকে আরেকবার দেখে বললাম,’এই আয়না দেখেই তো খোঁপা করতে পারতাম,দেখেছেন একদম খেয়াল ছিল না!’
সে আমার কথায় কান না দিয়ে গাড়ির সিটবেল্ট লাগাতে থেকে আনমনে বলতে থাকল,’যার জন্য বললাম কিছুই হল না।বরং আরো বেড়ে যেয়ে আমাকে জ্বালাচ্ছে।’
আমি হা করে তার কথা শুনে সামনে তাকিয়ে মুখে হাত দিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠলাম।সে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল আমার দিকে।তার মাথা বোধহয় পুরোপুরিই গেছে।কি বলে না বলে তার কোনো ঠিক নেই।
আমি বললাম,-‘আচ্ছা আপনি যে বললেন সেদিন কোন মেয়ে দেখতে যাবেন।সেই মেয়েটিই কি আপনার পছন্দ করা মেয়ে?’
সে মুচকি হেসে বলল,’তোমার দেখি আমার প্রতি ব্যাপক ইন্টারেস্ট।ব্যাপার কি?’
আমি লজ্জায় রাগে চুপসে গিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম।আমি তো শুধু এমনিই জানতে চেয়েছি।একটা ছেলের মুখে এই ধরণের কথা শুনলে কেমন লাগে!
ভার্সিটিতে পৌছে দেখলাম সবাই এসে পড়েছে।মেয়েরা শাড়ি আর ছেলেরা পান্জাবী পড়ে ঘুর ঘুর করছে।কেউ আবার সেলফি তোলায় নিমগ্ন।আমি গিয়ে সাফা আর সোমা আপুর পাশে দাড়লাম।
তখন তামিম ভাই এসে বলল,’হাই গাইস।’
আমরাও মিষ্টি হেসে হ্যালো বললাম।
তামিম ভাইয়া সাফাকে দেখে বলল,’আজকে তোমাকে আফা বলা যাবে না।’
তার এতটুকু কথায় সাফার দিকে তাকিয়ে দেখি ও একেবারে লজ্জায় লাল টুকটুক করছে।এত লজ্জা পাওয়ার কি হল!
আমি মজা করে বললাম,’কেন বলা যাবে না?’
-‘কারণ আজকে বলতে হবে অ্যান্টি।’
সাফা মুখটা কাঁদো কাঁদো করে রাগ দেখিয়ে চলে গেল।তামিম ভাই আমাকে বলল,’বেশি বলে ফেললাম বোধহয়।’
এই বলে সেও চলে গেল সাফার পিছু পিছু স্যরি বলতে বলতে।তাদের কান্ড দেখে আমি হাসতে হাসতে শেষ।
তানিয়া আপু এসে আমার কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে বলল,এত হেসো না মায়াবতী,তোমার হাসির খপ্পরে পড়ে একজনের দম আটকে যায় যায় অবস্থা।কথাটা বলে সোমা আপুকে একটা চোখ মেরে দিল।
আমি হাসি থামিয়ে বললাম,’মানে?’
তানিয়া আপু একটু কাশি দিয়ে বলল,’মানে আবার কি?দেখছো না কত ছেলেরা তোমাকে দেখছে,তাদের কথাই বলছি।তোমাকে যে আজ কি মারাত্মক সুন্দর লাগছে তা কি তুমি জানো!’
তানিয়া আপুর কথায় বেশ লজ্জা পেলাম।বললাম,যান আপু!কি যে বলেন।আপনারা তো আমার থেকেও বেশি সুন্দর।
তানিয়া আপু আফসোসের সুরে বলল,’ঐ,ধলা চামড়াটাই আছে।শ্যামাবতীর মতো চেহারায় মায়া তো নেই!’
নাঈম ভাইয়া বলল,’হুম।’
তানিয়া আপু কটমট করে বলল,’হুম মানে?তুমি হুম হুম করছো কেনো!তার মানে আমাকে সত্যিই দেখতে ভালো লাগছে না।’
নাঈম ভাইয়া কানে ধরতে ধরতে বলল,’জানু আমি ওটা বুঝাতে চাই নাই।তুমি নিজেই তো বললে।’
-আমি বললেই তুমি বলবা।এখন তো ভালো লাগবেই না,পুরাতন হয়ে গেছি না।’
তাদের এই কথার মাঝেই মাইকে শোনা গেল নিদ্র ভাইয়ার গলা।নাঈম ভাইয়া মুচকি হেসে বললো,’সবাই চলো ওখানে।আওয়ার হিরো ইজ ব্যাক অন স্টেজ।’
আমরা সবাই গিয়ে স্টেজের সামনে সবার ভীড়ে গিয়ে দাঁড়ালাম।সবাই নিদ্র নিদ্র করে চেয়ার আপ করছে।পাশ থেকে আরেকজন মাইকে বলছে,
‘আমাদের সবার প্রিয় নিদ্র ভাইয়ার কাছে আমরা আবারো লাস্ট ইয়ারের মতো সালমান খান স্টাইলে “ওহ ওহ জানে জানা”গানে ডান্স পারফরমেন্স চাই।’
তারপর তিনি দুই লাইন গেয়ে উঠলেন।
“ওহ ওহ জানে জানা,ঢুন্ডে তুঝে দিওয়ানা
সাপনোমে রোজ আয়ে,য়া জিন্দেগীমে আনা”
নিদ্র ভাইয়া মুচকি হেসে মাইকে বলল,’এখন আর সেই গান গাওয়ার প্রয়োজন নেই।’
সামনে দাঁড়ানো রাফি ভাইয়া মুখে হাত দিয়ে সিটি বাজিয়ে হেসে বলল,’এখন আমাদের হিরো গাইবে
” দ্যাশ বাহানে কারকে লে গেয়ে দিল।”
সবাই মুখ দিয়ে হো করে চিৎকার করে শব্দ করতে লাগল।ফাংশন খুব ভালোই জমে উঠেছে।
হোস্ট করা ছেলেটা বলল,’নিদ্র ভাই সবাই খুব অধীর আগ্রহে আছে আপনার মুখ থেকে কিছু শোনার জন্য।আপনি অন্তত আপনার মনের ভাব একটি গান গেয়ে শোনান।’
নিদ্র ভাইয়া কাঁধে তার কালো গিটার ঝুলিয়ে সামনে তাকিয়ে গিটারের টোনের সাথে মিলিয়ে মুখে সুর তুলল।গাইতে লাগল,
আমার অজানায়,হলো কি
তোমাকে তা কখনো বুঝতে দেবো না
বৃষ্টির পানে আকাশ চেয়ে তোমাকে
আমি খুঁজবো না…
আকাশের পানে চেয়ে চেয়ে
ভালোবাসি তা বলবো না।
তুমিও কি আমার মতো করে
একটু ভালোবাসবে না?
তুমিও কি আমার মতো করে
একটু কাছে ডাকবে না?
তার গানে শুনে আমি পুরো বিমোহিত হয়ে গেলাম।এত সুন্দর গান গায়!মুখ দিয়ে বেড়িয়ে আসলো,’কি সুন্দর গান গায়!’
আমার কথা শুনে পাশ থেকে তানিয়া আপু বলে উঠল,’হুম,নিদ্র খুব সুন্দর গান গায় আর খুব ভালো গিটার বাজাতে পারে।’
আর কি বলবো খুঁজে পেলাম না।তার গান আবার টেনে নিল ছন্দে ঘেরা সুরের জগতে।
শুক্রবার মানেই এক্সট্রা ঘুমের দিন।আমিও শান্তিতে ঘুমিয়ে আছি উপুড় হয়ে।কিন্তু এই ফোন নামের পদার্থটা হয়তো আমার শান্তির ঘুম সহ্য করতে পারে না।জোড়ে আওয়াজ করে কারো আমায় স্মরণ করার কথা জানিয়ে দিচ্ছে।চোখ না খুলেই একরাশ বিরক্তি নিয়ে ফোন হাঁতড়ে বালিশের পাশ থেকে খুঁজে বের করে কানে দিয়ে বললাম,’হ্যালো।’
ওপাশ থেকে কেউ উফ!করে উঠল।তারপর বলল,’মেরে ফেলতে চাও?’
আমি হালকা চোখ খুলে কপাল ভাঁজ করে বললাম,’কে?’
ওপাশ থেকে সেই চিরচেনা গলায় ভেসে আসল,’তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও।’
এতক্ষণে ফোনের ওপাশে থাকা মানুষটিকে বুঝতে পেরে আমি বললাম,’ভাইয়া আজকে তো শুক্রবার।ভার্সিটি বন্ধ।’
-‘আমি জানি ভার্সিটি বন্ধ।তুমি এখন ভার্সিটিতে না তার পাশে কাজী অফিসে চলে আসো।’
চলবে,,