#ভালোলাগে ভালোবাসতে
#পর্ব-২
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
আশ্চর্য পরিমাপের যদি কোনো থার্মোমিটার থাকতো তবে আমার ক্ষেত্রে পারদের মাত্রা সর্বোচ্চ ঘর ছাপিয়ে উপরে উঠে যেত।আমি চরম আশ্চর্য হলাম যখন জানতে পারলাম নিদ্র ভাইয়ের এই সাজাকে সবাই মজা বলছে।ভার্সিটির সবচাইতে হ্যান্ডসাম ছেলের সর্বদা সান্নিধ্যে থাকার চেয়ে বড় ভাগ্য নাকি আর কিছুই হতে পারে না।তাকে দেখলেই এখন ভয়ে আমার হাত পা কাঁপতে থাকে আর তার সাথে সাথেই থাকতে হবে শুনে যেখানে আমার অবস্থা খারাপ সেখানে কিছু মেয়ে আফসোসে শেষ হয়ে যাচ্ছে তারা কেনো এই পানিশম্যান্ট পেলো না।
চিন্তার অথৈ সাগরে ডুবে একাকার হয়ে আমি বিছানায় বসে ওড়নার প্রান্ত কুট কুট করে কামড়ে শেষ করে দিচ্ছি।
আর এদিকে সোমা আপু হেসে খুন হয়ে যাচ্ছে।
-‘আপু তুমি হাসছো।আমি তোমার দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র রুমমেট।আর তার দুঃসময়ে তোমার হাসি পাচ্ছে!’
-‘তো আর কি করব সুপ্তি?শেষমেষ তুই কিনা নিদ্র ভাইয়ার সাথে ফেঁসে গেলি।তোদের দুজনকে দেখলে আমার সিংহ ইঁদুরের ঐ গল্পটা মনে পড়ে যায়।তোর অবস্থা এখন সেই ধরা পড়া ইঁদুরের মত লাগছে।’
-‘আচ্ছা তোমাদের ঐ নিদ্র ভাইয়া কোন ইয়ারে পড়ে?’
-‘মাস্টার্সে।কেনো?’
-‘তার মানে তাকে আমার পুরো একবছর সহ্য করতে হবে!হায় আল্লাহ আর একবছর এদিকসেদিক হলেই তো হত!আজকেই আমি বাবাকে ফোন করে বলব আর একবছর পর বিয়ে করলে তাদের কি এমন হয়ে যেত।বরং আমি বেঁচে যেতাম ঐ ধলা লম্বুশ ডেভিলটার হাত থেকে।’
-‘চুপ থাক নটাঙ্কি, নিদ্র ভাইয়া মোটেও ডেভিল নয়।আমি ভাইয়ার দুই বছরের জুনিয়র।কত দিন ধরে তাকে দেখছি,হি ইজ এ রিয়েল জেন্টেলম্যান।কত জুনিয়রদের পড়ার খরচ দিয়ে সে সাহায্য করেছে।সব মেয়েরা তার জন্য পাগল অথচ সে কারো দিকে ফিরেও তাকায় না।তুই জানিস নিদ্র ভাইয়ার জন্যই এই ভার্সিটির মেয়েদের কোনো ছেলে টিজ করতে পারে না।এই ভার্সিটি সবথেকে পপুলার হলে কি হবে এর রেগিং ইতিহাস খুব খারাপ ছিল।নিদ্র ভাই এসে এসব বন্ধ করিয়েছে।রেগিং তো বলতে গেলে হয়ই না,তুই তো ভাইয়াকে থাপ্পড় মেরে ক্ষ্যাপিয়ে তুললি।ভাইয়া এমন কিই বা তোকে করতে বলেছে!কত মেয়ে আছাড় খেয়ে পড়ে তার সাথে একটু কথা বলার জন্য।আর তুই তো বাম্পার অফার পেয়ে গেছিস!’
-‘যারা আছাড় খেয়ে পড়ে তাদেরই করতে বলো।আমার জায়গায় থাকলে না বুঝতা।’
-‘হুম, এখন এসব বাদ দিয়ে খেতে চল।সাড়ে নয়টার পর কিন্তু আর খাবার পাবি না।’
হোস্টেলের এই একটি নিয়ম আমার অসহ্য লাগে।এখন আমার একটুও খেতে ইচ্ছে করছে না।কোথায় বিছানায় আরেকটু গড়াগড়ি করে নিজের শোক পালন করব!কিন্তু না!এখানে এখনই খেতে হবে মানে এখনই খেতে হবে।নো হেরফের।এদের কি মন বলতে কিছু নেই।ধূর!
বাংলা ব্যাকরণের মত বিরক্তিকর ক্লাসে আমি শত চেষ্টা করেও মনোযোগ বসাতে পারছি না।গালে হাত দিয়ে শুধু হাম দিয়ে যাচ্ছি।মধ্যবয়স্কের প্রফেসরটি নাকের ডগায় রাখা চশমার ফাঁকে তীক্ষ্ণ চোখে বারবার আমায় দেখে যাচ্ছে।এই বুঝি ধমক দিল বলেই!
কিন্তু তার আগেই ক্লাস শেষের ঘন্টা পড়ে গেল।কালকের ঘন্টাটা আমার আনুকূল্যে না হলেও আজকের ঘন্টায় আমার সুবিধা হওয়ায় আমি খুশিতে আবেগে আপ্লুত হয়ে গেলাম।ঠিক তখনই আননোন নাম্বার থেকে ফোন আসল।
-‘হ্যালো কে বলছেন?’
-‘তোমার নামের অর্থের মিতা।’
এমনি সময় হলে এমন প্যাচানো কথার আমি কিছুই বুঝতে পারতাম না।কিন্তু আজ তার গাম্ভীর্য্য গলার আওয়াজেই বুঝে গেলাম কে।একটি ঢোক গিলে বললাম,
-‘আপনি আমার নাম্বার কোথায় পেলেন?’
একটু হেসে বলল,’আরিয়ান ইসলাম নিদ্র সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণাও নেই।এখন চট করে ক্যান্টিনে চলে আসো তো।বাদাম খাবো।’
খুব নরম স্বরেই বললাম,’ভাইয়া আপনি বাদাম খাবেন আমি কি করব?’
-‘আমার বাদাম খেতে ইচ্ছে করছে খোসা ছাড়াতে নয়।তুমি খোসা ছাড়িয়ে দিবে আমি খাবো।’
সে ফোন কেটে দিলে আমি মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলাম।এর থেকে তো সেই স্যারের বোরিং ক্লাসটাও ভালো ছিল।আমার এই অবস্থা আর আমার নেমকহারামী বান্ধবী সাফা পাশে বসে মিটিমিটি হাসছে।সত্যি বিপদে পড়লে সব পর হয়ে যায় এখন তার প্রমাণ হাতে নাতে পেলাম।
ক্যান্টিনের মাঝারি ধরণের গোলাকার টেবিলের এক প্রান্তে নিদ্র ভাইয়া এক হাত টেবিলে উপর রেখে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে রয়েছে আর তার বিপরীত প্রান্তে আমি খুব মনোযোগ সহকারে বাদামের খোসা ছাড়িয়ে দিচ্ছি।দুই আঙ্গুলের মাঝে বাদাম রেখে মৃদু চাপ দিতেই খোসা ছুটে যাচ্ছে।তার মধ্যে থেকে বাদাম বের করে এনে তার উপরের খয়েরি রঙের আবরণটা দু হাতের মাঝখানে রেখে একটু পিষে দিতেই সব আলগা হয়ে যায়।মুখ দিয়ে ফু দিয়ে সেই আলগা আবরণ ফেলে দেওয়ার কাজটা আমার কাছে যথেষ্ট মজার লাগে।অনেকক্ষণ ধরেই মাথা নিচু করে নিজের মত করে যাচ্ছি।অনেকগুলো একসাথে জমা হওয়ার পর মাথা উঁচু করে তার হাতে বাদামগুলো দিতে গিয়েই দেখলাম সে আমাকে এক নজরে দেখে যাচ্ছে।আমার সাথে চোখে চোখ পড়তেই একটু ইতস্তত বোধ করে অন্যদিকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল।আমার দেওয়া বাদাম একটি একটি করে মুখে পুরে খেতে লাগল।বাদামের মতই আজ সে বাদামি রঙের শার্ট পড়ে এসেছে।
আমি বললাম,’ভাইয়া এখন যাই।আমার ক্লাস আছে।’
-‘এখন তো তোমার অফ পিরিয়ড।আরো চল্লিশ মিনিট থাকতে পারবে।’
আমি মনে মনে রেগে বললাম,’আমার একেবারে সবকিছু জেনে বসে আছে।অসহ্য!’
একটি বারো তেরো বছরের ছেলে এসে বলল,
-‘ভাই আপনার কফি।’
নিদ্র ভাইয়া বলল,’ছোটকু তুই স্কুলে যাস নাই?’
-‘যাই তো ভাই,আইজ ইশকুল বন্ধ।আপনের টেকা দিয়া বই কিনছি,জামা কিনছি ভাই।নতুন বইয়ের গন্ধ খুব ভালা লাগে।’
নিদ্র ভাইয়া পিঠ চাপড়ে বলল,’টাকা লাগলে আবার বলবি,বুঝলি!আমাকে যেনো জিজ্ঞেস করতে না হয়।’
ছোটকু বত্রিশটি দাঁত বের করে হেসে বলল,’আইচ্ছা।’
আমি অবাক নয়নে তাকিয়ে দেখছিলাম তাদের দুজনকে।এক অদ্ভুত ভালোলাগায় মন ছেঁয়ে গেল।
গরম গরম ধোঁয়া উঠা কফির মগ মুখের কাছে নিয়ে সে নিচের ঠোঁট আলতো করে চেঁপে ধরে তার ঘন কালো ভ্রু ঈষৎ ভাঁজ করে ঘ্রাণ নিতে লাগল।
আহা! কি সুন্দর দৃশ্য।যেনো এই সুদর্শন যুবকের ঘ্রাণ নেওয়ার এই অপূর্ব মুখভঙ্গির জন্যই কফির সৃষ্টি।কফিও তার জন্মের সার্থকতা লাভ করতে পেরে প্রথম আলতো চুমুকেই তার ঠোঁটের কোণে লেগে রইল।
আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে চোখ দিয়ে ইশারা করল কি!
আমি তাকে ইশারায় ঠোঁট দেখিয়ে বললাম।
সে শার্টের বুক থেকে সানগ্লাস বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে বলল,’ধরো তো একটু।’
মনে মনে বললাম,’এখন এটাও আমায় করতে হবে।’
সবাই নতুন ক্যাম্পাসে ঘুরে ঘুরে দেখছে আর আড্ডা দিচ্ছে আর আমি কিনা এখানে বসে ফুট ফরমায়েশ খাটছি।
আমি মুখ ফুলিয়ে সানগ্লাস ধরে রাখলাম আর সে সানগ্লাসের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট মুছতে লাগল।
সে বলল,’এভাবে মুখ ফুলিয়ে রেখেছো কেনো?
তোমার নিজের জন্যই এখন এখানে বসে থাকতে হচ্ছে।’
-‘আমি আবার কি করলাম?’
-‘সেদিন যে হিরোইন স্টাইলে আমার গায়ের উপর পড়ে গেলে আর শার্টের বারোটা বাজিয়ে দিলে তার জন্য জানো আমি কত ইম্পর্টেন্ট একটা কাজ মিস করে ফেলেছি।সেই কাজ কভার করে প্লাস একরাতের মধ্যে অ্যাসাইমেন্ট কমপ্লিট করতে আমার কত খাটতে হয়েছে।এখন রিল্যাক্স এর জন্য আমার এতটুকু প্রয়োজন।’
আমার পেটের ভেতর কথা সুড়সুড় করছে।বলতে ইচ্ছে করছে তাহলে আপনি কেনো আমাকে কাঁদা পানিতে ভিজিয়ে দিলেন?সেখান থেকেই তো সব শুরু।কিন্তু কিছুই বলতে পারলাম না।শুধু মুখ ভার করে বললাম,’হ্যাঁ এখন তো চাঁদ মামা দিনে কেনো উঠে না তাতেও আমার দোষ!’
আমার কথা বলার ভঙ্গিতে তিনি হেসে দিলেন।
আমার বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠল।এই প্রথম তাকে হাসতে দেখলাম।একটা মানুষের হাসিতে কতটা সৌন্দর্য্য লুকিয়ে থাকে তা হয়তো তাকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না।এই বুঝি সেই হাসি যে হাসিতে পুরো পৃথিবী বিক্রি করে ফেলা যায়।সে যে কম হাসে তাই ঠিক করে,নাহলে সে তো হাসি দিয়ে খুনও করে ফেলতে পারে।হৃদয়ের খুন। অতিরিক্ত সৌন্দর্য্য মানুষের হজম হয় না।একধরণের বিষন্নতা এনে দেয়।
বিষন্নতা ছাপিয়ে যাওয়ার আগেই সেখানে নিদ্র ভাইয়ার পুরো গ্যাং উপস্থিত।তামিম ভাইয়া বলল,
-‘কি খবর স্লিপিং কুইন আমাদের স্লিপিং কিং কে ভালো মতো সেবা করছো তো?তা তোমার সেই সাফা আফা কই?’
সবাই হো হো করে হেসে দিল।সাফা এখানে উপস্থিত থাকলে তার নামের বারতি যোগ করা অংশটুকু শুনে নিশ্চিত কেঁদে দিত।
তাদের মধ্যে থেকে একটি মেয়ে বলে উঠল,
-‘এই সেই মেয়ে?বাহ্! দেখতে তো দারুন মিষ্টি।’
আরেকটি ছেলে বলল,’তানিয়া রে!নিদ্রর মত সুন্দরী মেয়েদের থাপ্পড় খেয়ে এই সুবিধাজনক লাভ আমারো পেতে ইচ্ছে করছে।’
তানিয়া আপু হেসে বলল,’সোহেল,সুন্দরী মেয়েদের থাপ্পড় খেতেও না যোগ্যতা লাগে।তোর মতো বান্দরের তা নেই।’
-‘তাই নাকি!নাঈম শালা এখনো আসছে না কেনো?তোর হাতে তো ও ভালোই মাইর খায়।তাকে জিজ্ঞাসা করতাম পেত্নীদের হাতের থাপ্পড় খেতেও কি যোগ্যতা লাগে নাকি!’
-‘তবে রে!’
বলে তানিয়া আপু সোহেল ভাইয়াকে মারতে লাগল।
আমার ভীষণ লজ্জা লাগলো তানিয়া আপুর মত এত সুন্দরী মেয়ে নাকি আমাকে সুন্দর বলছে।আমি তো বেশি ফর্সাও না।
এই ফাঁকে রাফি ভাইয়া নিদ্র ভাইয়ার হাত থেকে খোসা ছাড়া বাদাম নিতে ধরলেই নিদ্র ভাই চট করে হাত সরিয়ে বলে,
-‘একদম না।খেতে হলে ওখান থেকে খোসা ছাড়িয়ে খা।এর ভেতর একদম স্পর্শ করবি না।’
-‘হায় রে দোস্ত!দে না একটা।খোসা ছাড়াতে ইচ্ছে করছে না।’
নিদ্র ভাইয়া নিজে খোসা ছাড়িয়ে রাফি ভাইকে দিতে লাগল তবুও আমার দেওয়া বাদামগুলো দিল না।এটা দেখে সবাই একে অপরের সাথে চোখাচোখি করে মুচকি হেসে মুখ দিয়ে হুম করে অদ্ভুত সাউন্ড করতে লাগলো।
ইতিমধ্যে নাঈম ভাইয়া হন্তদন্ত হয়ে এসে তানিয়ে আপুকে বলল,’স্যরি জানু।এখন তুমি মুখ ভার করে থাকলেও তোমার রাগ ভাঙাতে পারবো না।’
তারপর নিদ্র ভাইয়াকে ডেকে বলল,’নিদ্র তোকে প্রিন্সিপাল স্যার ডাকছে,মে বি নবীন বরণ নিয়ে কথা বলবে।’
তারা সবাই একসাথে চলে গেল।নিদ্র ভাইয়া দু কদম যেয়ে আবার পিছিয়ে এসে হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আমাকে বলল,’ডোন্ট ওয়ারি,দশ মিনিট পরে কভার করে নিব।’
তারপর সানগ্লাসটা চোখে দিয়ে একটু মুচকি হেঁসে চলে গেল।
এমন ভাব করলো যেনো দশ মিনিট আগে যাওয়ার আফসোসে আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি।আমার বয়েই গেছে তার জন্য আফসোস করার।আমি তো আরো হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।
চলবে,