তত#ভালো_লাগে_ভালোবাসতে
#পর্ব-১৮(শেষ পর্ব)
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
ঝিম ধরা মাথায় চোখটা আধো খুলতেই ক্যামেরার ফ্লাসে আমার চোখ আবার বন্ধ হয়ে এলো।কানে ভেসে এলো ‘এই জ্ঞান ফিরেছে,জ্ঞান ফিরেছে’ শব্দের একরাশ হৈ হুল্লোড়।ঘোর কাটিয়ে চোখ পুরোপুরি খুলতেই দেখলাম কতগুলো একত্রিত উৎফুল্ল মুখ আর তাদের হাতের অ্যান্ড্রয়েড ফোনগুলোর ফোকাস সব আমার বেহুঁশ হয়ে থাকা মুখের দিকেই।এরা কি ছবি তোলার আর কিছু পেলো না,আমার অজ্ঞান মুখের ছবিই তুলতে হবে।খোলা আকাশের নিচে গার্ডেনের বিশাল চত্বরের চারিদিকে ঝলমল আলো আর সাজসজ্জায় ভরপুর লোকজনের ভীড় দেখে আমি খানিকটা চমকে উঠলাম।আরো চমক লাগলো যখন নিজের গায়ে সেই সাধারণ সুতি শাড়ীর পরিবর্তে লাল বেনারসি শাড়ি আর গা ভর্তি গয়না দেখতে পেলাম।গায়ে হাত দিয়ে চমকে উঠে পাশে চোখ যেতেই দেখি নিদ্র আমার সাথেই সিংহাসন টাইপ সোফায় গোল্ডেন কালারের সেরোয়ানী পড়ে বর বেশে পাশে বসে আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে যাচ্ছে।আমি পুরোপুরি চোখ খুলে বড় বড় করে তার দিকে তাকাতেই সামনে থাকা ভীড়ের সকলেই হাততালি দেওয়া শুরু করলো আর বলতে লাগলো ‘বউয়ের জ্ঞান ফিরে গেছে,জ্ঞান ফিরে গেছে’।আমি চমকে ঈষৎ নড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পরলাম।হচ্ছে কি এসব!
-‘মিসেস আরিয়ান নিদ্রর জ্ঞান এতক্ষণে ফিরলো তবে!’
আমি পুনরায় চমকে উঠে নিদ্রর দিকে তাকালাম।সে আমার পাশে দাঁড়িয়ে শুধু দুষ্ট হাসি দিচ্ছে। তার না আজকে রাইশার সাথে বিয়ে হয়ে গেছে।সেকারণেই তো আমি জ্ঞান হারালাম।তাহলে এসব কি!আমি বউয়ের সাঁজে স্টেজে নিদ্রর পাশে কি করছি?রাইশা কোথায়?আর সবাই এভাবে হাত তালিই বা দিচ্ছে কেন?
আমার এভাবে হাবার মতো চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকায় নিদ্র বলল,
-‘কি,এখনো বুঝতে পারলে না?জানি বুঝবে না।’
বিশাল স্টেজের সাইড দিয়ে তামিম ভাইয়া,রাফি ভাইয়া,সাফা,সোমা আপু,তানিয়া আপু আর রাইশা উঠে এসে আমার পাশে দাঁড়ালো। রাইশার পড়নে সবার মতোই অন্য পোশাক।
তানিয়া আপু বললো,
-‘উফ!সুপ্তি ভাগ্যিস তোমার জ্ঞানটা ফিরলো!সবাই সেই একঘন্টা যাবৎ এখানে স্টেজের সামনে বসে তোমার দিকে মনোযাগ সহকারে ঝুঁকে আছে।কখন বউয়ের জ্ঞান ফিরবে আর কখন সব অনুষ্ঠান শুরু হবে।আজ পর্যন্ত কারো জ্ঞান ফিরায় হয়তো এতো মানুষ একসাথে খুশি হয়নি যতটা তোমার জ্ঞান ফিরায় হলো।হি হি হি!’
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
আমি তাদের কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না।তারা এসব কি বলছে!
সাফা আমাকে একটা ঝাঁকি দিয়ে বললো,
-‘এতো অবাক হতে হবে না,গাধী!নিদ্র ভাইয়া অন্য কাউকে বিয়ে করেনি।তুই নিদ্র ভাইয়ার বউ ছিলি,আছিস আর আজীবন থাকবি।’
তামিম ভাইয়া বললো,
-‘তোমার নিদ্র তোমারই আছে সুপ্তি।নিদ্র আবার থাকবে সুপ্তিকে ছাড়া! এও কি কোনোদিন সম্ভব!’
রাফি ভাইয়া বললো,
-‘কাভি নেহি।যেখানে আল্লাহ বানিয়ে দিয়েছে তোমাদের দুজনকে জোড়ায়,সেখানে ঘুম থেকে ঘুমকে আলাদা করার আর সাধ্য কার।’
সোমা আপু বললো,
-‘এবার বুঝতে পারলি বুদ্ধু!আজকের বিয়ের অনুষ্ঠানটা তোদের দুজনেরই।নিদ্র ভাইয়া শুধু তোকে একটু বোকা বানালো।’
চারপাশ থেকে সবার কথা শুনে আমি এখনো হতভম্ব হয়ে আছি।কেনো যেনো বিশ্বাসই হচ্ছে না।মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি।’
রাইশা বললো,
-‘ভাবী তোমার সাথে এবার আসল পরিচয়টা করে নেই।আমি তোমার ননদ,নিদ্রর কাজিন।বলতে গেলে বন্ধুর মতোই।’
রাইশা এবার নিদ্রর দিকে তাকিয়ে বললো,
-‘নিদ্র, ভাগ্যিস এই নাটকীয় জটটা তাড়াতাড়ি খুলে দিলি নয়তো ভাবী প্রতি সেকেন্ডে সেকেন্ডে আমার দিকে যেভাবে চোখ গরম করে তাকাচ্ছিলো আরেকটু হলে হয়তো আমাকে গিলেই ফেলতো।’
সবাই রাইশার কথায় অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো।আমি খুশিতে টলমল চোখে নিদ্রর দিকে ঘুরে তাকালাম।সে মুচকি হেসে পলক ফেলে আমাকে বিশ্বস্ত করলো।আমি ঝপ করে তার বুকে মুখ লুকিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলাম।
-‘আমি স্বপ্ন দেখছি না তো!’
নিদ্র মৃদু হেসে আমাকে আগলে ধরে বলল,
-‘না স্বপ্ন না,এসব সত্যি,সব সত্যি।পাগলী!এবার কান্না থামাও।যেভাবে জড়িয়ে রেখেছো সামনে কিন্তু সিনিয়র সিটিজেনরাও আছে।’
নিদ্র আর আমার বাবা মা একটু খুকখুক করে কেশে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে মুখ টিপে হাসতে লাগলো।আমি খানিক লজ্জা পেয়ে তাকে ছেড়ে মৃদু হেসে চোখের পানি মুছে নিলাম।
আমার অবস্থা প্রকাশ করার মতো না।এই হাসছি তো এই চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।খুশিতে কি করবো বুঝতেই পারছি না।হঠাৎ এই অপ্রত্যাশিত অবাধ আনন্দ আমি সামলাতেই পারছি না।
নিদ্র হঠাৎ পেছন থেকে তার কাঁধ দিয়ে আমাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল,
-‘কবুল বলার জন্য তৈরি আছেন তো?’
-‘কবুল বলবো মানে!বিয়ের সময় কবুল তো একবার বলেছিলামই।’
নিদ্র একটু মৃদু হেসে কিছু না বলে হাতের তুড়ি বাজিয়ে কাউকে কিছু ইশারা করলো।তারপর নাঈম ভাইয়া এসে আমার আর নিদ্রর হাতে দুটো মাউথ স্পিকার দিয়ে গেল।
নিদ্র মাউথ স্পিকারে বলতে লাগলো,
-‘জীবনের অন্তিম মুহুর্ত পর্যন্ত তবে একটা চুক্তি হয়ে যাক।আজ একবার এই হাত ধরলে কিন্তু আর কখনোই ছেড়ে দেওয়া যাবে না।হাঁটতে হাঁটতে একজন এগিয়ে পড়ুক বা পিছিয়ে পড়ুক হাতের একটা টান কিন্তু সবসময়ই থাকবে।সবসময় সাথে করে চলার টান।মুষ্টিবদ্ধ দুটি হাত কখনোই উন্মুক্ত হতে পারবে না।’
কাজী সাহেব নীচ থেকে বলে উঠলেন,
-‘যদি রাজী থাকো তাহলে মা বলো কবুল।’
আমি লাজুক মুখে মাইক মুখের কাছে নিয়ে বললাম,
-কবুল।’
নিদ্র বলল,
-‘যখন যেই সমস্যাই আসুক না কেনো কখনই নিজে একা একা সামলানো যাবে না।জীবনসঙ্গী তো একারণেই হয় তাই না যে সমস্যাগুলোকে ভাগ করে নিয়ে বোঝটা হালকা করে নেওয়ার জন্য।যতটা সুখের ভাগীদার ততটাই দুঃখের।তাই এরপর থেকে যাই হয়ে যাক না কেনো সব সমস্যাগুলো একসাথেই লড়তে দিতে হবে।’
কাজী সাহেব বললেন,
-‘যদি রাজী থাকো তাহলে মা বলো কবুল।’
আমি বললাম,
-‘কবুল।’
-‘দুজনের মধ্যে কখনোই কোনো কথা লুকানো থাকবে না।দুজন দুজনের জন্য হতে হবে একটি উন্মুক্ত বই।যেখানে মন চাইলেই বারবার ডুব দেওয়া যায়।আর এখন বাকীটা হয়তো বলার প্রয়োজন হবে না।কারণ ভালোবাসা শব্দটার মধ্যেই তো লুকিয়ে আছে সহস্র প্রতিশ্রুতি।ভালোবাসা মানেই সেসব মেনে চলা।আর ম্যাম এবার কিন্তু বুঝে শুনে কবুল বলবেন এই চুক্তিটার কিন্তু কোনো রিনিউয়্যাল অপশন নেই।’
কাজী সাহেব বলতে নিলেন ‘যদি রাজী থাকো….
তার আগেই আমি একফোঁটা খুশির অশ্রু ঝড়িয়ে বলে দিলাম, কবুল,কবুক,কবুল।’
আকাশে অনবরত আতশবাজি ফুটতে লাগলো আর আমাদের মাথার উপর দিয়ে হতে লাগলো লাল গোলাপের পাঁপড়ির অবিরাম বর্ষণ।
নিদ্র একটু মুচকি হেসে বলল,
-‘তবে কথা দেওয়া থাক,গেলে যাবি চোখের বাইরে না।’
আমিও হেসে ফেললাম আর মাথা নাড়িয়ে সায় দিলাম।
সোহেল ভাইয়া বলে উঠল,
-‘শুধু কি আমাদের ভাবীই একা কবুল বলে যাবে নাকি!শালা তুই বলবি না?’
নিদ্র বলল,
-‘আমাকে তোর ভাবীর দেওয়া কোনো চুক্তি দিতে হবে না।এই ঘুমকন্যার সকল চুক্তিতেই আমি না শুনেই বলে দিলাম,কবুল,কবুল,কবুল।
মাইকে তার চেঁচিয়ে বলা কবুল শব্দ রাতের ঝিকিমিকি তারা ভরা আকাশ অব্দিও যেনো পৌছে গেলো।আকাশে আবারও আতশবাজি ফুটতে লাগলো।
সেই মুহুর্তেই দুটি বৃহৎ রূপার থালায় দুটি ফুলের মালা নিয়ে আসা হল।নিদ্র মুচকি হেসে ফিসফিস করে আমাকে বলল,
-‘এই যে মিসেস আরিয়ান নিদ্র আজকে কিন্তু গলায় মালা ভালো করে পড়াতে হবে।আগেরবারের মতো আমি নিজে গিয়ে মালার মধ্যে ঢুকতে পারবো না।’
আমি মুচকি হেসে মাথা নিচু করলাম।থালা থেকে ধীর হাতে মালা তুলে নিদ্রর দিকে বাড়িয়ে ধরলাম।নিদ্র তার সেই হৃদয় খুন করা হাসি দিয়ে আমার হৃদয়কে আরো একবার খুন করে দিল।মালার ভেতর দিয়ে তার হাসি মুখটা দেখতে কি সুন্দরই না লাগছে।
সোমা আপু বলে উঠল,
-‘একই এভাবেই মালা পড়ানো হবে নাকি!সাজেদ ভাইয়ার বিয়ের মতো একটু দুজনকে উপড়ে তুলে হয়রানি করানো হবে না?’
রাফি ভাইয়া বললো,
-‘হয়রানি!আমরা এখন ওঁকে মালা পড়ানোতে এক বিন্দু হয়রানি করলে দেখা যাবে আমাদের বিয়েতে শালায় মালাই পড়াতে দিলো না।সেভাবে মালা হাতে থাকতে থাকতে মালা শুকাইয়া ছাড়বে।এই আইফেল টাওয়ারের সাথে আমরা আবার পারবো!’
তাদের কথা আর একটু হাসির গুঞ্জন শেষ হলে আমি গভীর আবেগে তার দিকে তাকিয়ে তার গলায় ধীরে ধীরে মালাটা পড়িয়ে দিলাম।নিদ্রও তার হাতের মালাটা আমার গলায় পড়িয়ে দিল।
আমি এক মুহুর্তের জন্য চোখ বন্ধ করে সেই সুখ অনুভূতিটা অনুভব করছিলাম।খুশিতে আমার চোখে পুনরায় পানি এসে পড়ল।তারপর আমাদের দুজনকে সোফায় বসিয়ে আমাদের সম্মুখে একটি গোলাকার বৃহৎ সুন্দর কারুকার্য খচিত আয়না ধরা হলো।সাথে সাথে দুজনের মাথার উপর একটি বড় নেটের পাতলা লাল ওড়না দিয়ে ঢেকে দেওয়া হলো।আমি লজ্জামাখা দৃষ্টি নিয়ে আয়নায় নিদ্রর চাঁদমুখটা আড়চোখে দেখতে লাগলাম।নিদ্রও আয়নায় আমার চেহারা দেখে একটি চোখ টিপ দিল।তাতে আমি লজ্জায় মাথা নিচু ফেললাম।
আমরা দুজন স্টেজের সামনে সোফায় বসে আছি।আর স্টেজে নিদ্রর বন্ধুরা মিলে সবাই পারফর্ম করছে।রাফি ভাই হঠাৎ মাইক নিয়ে বলতে লাগলো,
-‘আমাদের বন্ধু সবকিছুই ব্যাতিক্রম করে।তাই আমরাও তার বিয়ের অনুষ্ঠানে একটু ব্যাতিক্রমের ছোঁয়া আনতে চাই।আমরা অনেকবারই দেখেছি গানের মাধ্যমে নিদ্রকে তার অনুভূতি ব্যক্ত করতে।কিন্তু সুপ্তি আই মিন আমাদের ভাবীকে এখনো দেখা হয়নি।তাই আমরা আজ আমাদের ভাবীর মুখে একটা গান শুনতে চাই।নিদ্রর জন্য তার অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ।’
রাফি ভাইয়ার মুখে এই কথা শুনে সবাই আগ্রহে হাত তালি দেওয়া শুরু করলো আর এদিকে আমি ঘাবড়ে গেলাম।কোনোদিন দশজন মানুষের সামনেও গান গাইনি আর আজ এত মানুষের সামনে গাইবো।নিদ্রর দিকে তাকাতেই সে আমার দিকে তাকিয়ে হাতের উপর হাত রেখে একটি ভরসা মাখা মৃদু হাসি দিল।সাথে সাথে আমার সব জড়তা কোথায় কেটে গেল।তার সেই মুগ্ধকর হাসিতে আমি আরেকবার তার মধ্যে হারিয়ে গেলাম।ধীর পায়ে স্টেজে উঠে মাইক হাতে নিলাম।উজ্জ্বল আলোগুলো সব বন্ধ করে হালকা নীল,গোলাপী আলো দেওয়া হলো।পাশ থেকে গিটারে সুর দেওয়া হলো।লজ্জায় লাল আভায় দীপ্তময় হয়ে আমি ধীরে ধীরে গাইতে লাগলাম,
ভালো লাগে তোমাকে,কাছাকাছি পেলে
ভালোবেসো তুমিও কাছাকাছি এলে,
অন্য তখন চোখের ধরণ
অন্য রকম পায়ের চলন।
হঠাৎ নিদ্র পাশ থেকে স্টেজে উঠে এসে আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে গাইতে লাগলো,
তুমি আশেপাশে ছায়া হয়ে মায়ায় জড়ালে
তুমি একই মেশে ভালোবেসে আমায় বাঁচালে
তুমি একলা রাতে একটা চিঠি আমায় পাঠালে।
আমি খুশি হয়ে নিদ্রর দিকে তাকিয়ে গাইলাম,
ভালো লাগে তোমাকে কাছাকাছি পেলে
ভালোবেসো তুমিও কাছাকাছি এলে
♪♪♪♪♪♪
আমি গাইলাম,
তোমায় নিয়ে ব্যস্ত যখন
অন্য কিছু আমি শুনতে না পাই।
নিদ্র আমার গালে দু হাতে রেখে চোখে চোখ রেখে গাইলো,
তোমার হাতে বাচন মরণ
আমার পাশে শুধু তোমাকে চাই
তুমি আশেপাশে ছায়া হয়ে মায়ায় জড়ালে
তুমি একই মেশে ভালোবেসে আমায় বাঁচালে
তুমি একলা রাতে একটা চিঠি
আমায় পাঠালে……
আমি আমার গালে রাখা তার হাতকে বাম হাত দিয়ে ধরে গাইলাম,
ভালো লাগে তোমাকে কাছাকাছি পেলে
ভালোবেসো তুমিও কাছাকাছি এলে।
পেছন থেকে গানের সফট মিউজিক বাজতেই লাগলো।নিদ্র আমার গালে হাত দিয়ে কপালে আলতো করে একটি ভালোবাসার পরশ ঠোঁট দিয়ে ছুঁয়ে দিল।আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম।উপর থেকে অনবরত ফুলের বর্ষণ হতে লাগলো।নিদ্র গভীর আবেগে তার বুকে আমাকে টেনে নিল।আমিও অনাবিল প্রশান্তিতে আমার প্রিয় শান্তির নীড়ে ঠাঁই নিলাম।
স্টেজ থেকে নিচে নেমে আমি আর নিদ্র মা বাবা আব্বু আম্মুর দোয়া নিতে গেলাম।আব্বুকে কিছু না বলে শুধু জড়িয়ে ধরে রাখলাম।কতো অভিমান হয়েছিল আব্বুর উপর।আর আব্বু তো আমাকে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহারটাই ফিরিয়ে দিচ্ছিলো।আব্বু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতে লাগলো,
-‘আমার আম্মু,সোনা,মামুনিটার অভিমান হয়েছিল আমার উপর তাই না?আরে পাগলি,তোকে আমরা কখনো কষ্ট দিতে পারি!
আর আরেকটা কথা,কখনো এমন বোকামি আর করবি না ঠিকাছে?পরিবার থাকেই তো এই জন্য যাতে আমরা আমাদের সব দুঃখ,কষ্ট,সমস্যাগুলো পরিবারের সাথে ভাগাভাগি করে হালকা হতে পারি।মনে থাকবে?’
আমি চোখ মুছে হেসে মাথা নাড়িয়ে সায় দিলাম।
পাশে তাকিয়ে দেখলাম স্নিগ্ধ মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে আছে।আমি ওর গাল টেনে বললাম,
-‘কিরে তোর আবার কি হলো?’
স্নিগ্ধ বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে মুখে একটা গম্ভীর ভাব এনে বললো,
-‘এটা কি হলো ভাবু!তোমার একটা ছোট বোন টোনও নেই।এখন আমি পার্টনার খুঁজবো কিভাবে?’
আমি চোখ কপালে তুলে বললাম,
-‘তুই পার্টনার খুজবি মানে?’
-‘আরে!ভাইয়ার বিয়ে হয়ে গেল।এখন লাইনে তো আমিই আছি।তাহলে আমাকে আগের থেকে খুঁজে রাখতে হবে না।কিন্তু এখানে তো কেউ আমার সমান নেই।হায় রে!একটা বেয়াইনও পেলাম না।তাই আমার মুড অফ।’
নিদ্র ওর কান মলে বলল,
-‘তবে রে!এই বয়সে এত পাকনামি কথা।তোর পার্টনার খোঁজা আমি বের করছি।’
স্নিগ্ধ জিহ্বায় কামড় দিয়ে দাঁড়িয়ে হাসতে লাগলো।কান ছাড়িয়ে এক ছুটে দৌঁড়ে চলে গেল।
কাকু হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেয়ে বলল,
-‘হা হা হা।আই লাইক ইট,নিদ্র তোমার ভাইও তোমার মতো সব গুছিয়ে করার চেষ্টা করে।তাইতো এতো ভালো লাগে।আই লাইক ইট,আই লাইক ইট।আগে থেকেই খুঁজে রাখা ভালো,কথাটা মজার ছিলো।হা হা হা।’
আমি বললাম,
-‘কাকু লাইক ইট,লাইক ইট যে করছো,তোমার তো পঁয়তাল্লিশ বছর হয়ে গেল তুমি এখনো একজন পার্টনার আনলে না কেনো?’
-‘এটা তুই কি বললি সুপ্তি?বউ না থাকতেই মাথার চুল সব পড়ে গেল আর বউ থাকলে যে কি হতো আমি তো সেই চিন্তায়ই মরি।হা হা হা।’
কাকুর অট্টহাসির মাঝেই সাফার বাবা মুখটাকে মহা বিরক্তির কারখানা বানিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে এলো।আব্বু গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
-‘কি হয়েছে ভাই সাহেব?’
-‘আরে বলবেন না ঐ সাজেদের একটা শালা আছে না কি জানি নাম তামিম না লামিম,ঐ ছেলেটা এত তুড়তুড় করে না!খাবার দিতে গিয়ে আমার পান্জাবীতে ঝোল ভরিয়ে দিল।এখন এই ঝোলের দাগ কি সহজে যাবে?’
সাফা এসে আমার পাশে মুখ কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে রইলো আর তামিম ভাইও এগিয়ে এসে একটা সাবান এনে দিল।তার মুখেও ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।
আঙ্কেল থমথমে মুখে বলল,
-‘দেখেছেন মাথায় বুদ্ধি!এনেছে সাবান,আরে এখন পানি ছাড়া সাবান লাগালে তো এই দাগ আরো গাঢ় হয়ে যাবে।এই ছেলে তে মনে হয় তাই চায়!’
আব্বু বলল,
-‘থাক ভাই,ছোটো মানুষ না বুঝে করে ফেলেছে।মাফ করে দিন।’
-‘না না এদেরকে মাফ করা ঠিক না।শাস্তি দেওয়া দরকার,কঠিন শাস্তি।আর সেই কঠিন শাস্তি হলো শ্বশুড় হয়ে সারাজীবন জ্বালিয়ে মারা।’
আমরা সবাই অবাক হয় থমকে রইলাম।আর আঙ্কেল হঠাৎ পেট ফাটিয়ে হাসতে হাসতে বলতে লাগলেন,
-‘কি সবাইকে চমকে দিলাম তো!মজা কি শুধু তোমরা ইয়াং জেনারেশনই করতে পারো।হা হা।’
আঙ্কেল কি মজাটাই না করলো!আমরা তো তার থমথমে মুখ দেখেই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম না জানি কি হয়!সাফা লজ্জা পেয়ে আমার পেছনে মুখ লুকালো আর তামিম ভাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লাজুক মুখ নিচু করে মাথা চুলকাতে লাগলো।
আঙ্কেল আবার তামিম ভাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-‘এই ছেলে কালকেই আমার বেয়াই বেয়াইনকে আমাদের বাড়ি পাঠাবে।লুকিয়ে লুকিয়ে যে রাস্তা থেকে ব্যালকনিতে কাগজ ঢিল মারতে সে সব কয়টা তো পড়ত আমার মুখে।সেদিকে কোনো হুঁশ আছে?কই নিদ্রর মতো প্রেমের আগে সোজা বিয়ে করে ফেলবে তা না!সুপ্তি মামুনিকে কি সুন্দর দু দুইবার বিয়ে করে ফেললো আর সুপ্তি বুঝলোই ন।একেই বলে ইনটেলিজেন্ট।এমন সাহসী ছেলের বন্ধু হয়েও হবু শ্বশুড়ের থেকে শিক্ষা নিতে হয়?’
কাকু বলল,
-‘ভাই দারুণ একটা মজা করেছেন।আই লাইক ইট,আর এটাও ঠিক বলেছেন,নিদ্রর জবাব নেই।সুপ্তটা যেমনই হয়েছে হাঁদা,জামাই পেয়েছে একটা সেই রকম ইনটেলিজেন্ট ছেলে!হা হা হা।
আমি হা হয়ে নিদ্রর দিকে তাকালাম।ইনি তো দেখি আমাকে বোকা বানিয়ে বিয়ে করে ভালো নাম কামিয়ে ফেলেছে।মজা তো উড়াচ্ছে সবাই আমার!
নিদ্র আমার দিকে তাকিয়ে একটা গর্বিত হাসি দিয়ে কলার ঠিক করতে লাগলো।আমি চোখ কুন্চিত করে তাকিয়ে রইলাম।
রাত বারোটা ত্রিশ।নিদ্রর রুমে তৈরী করা রীতিমত একটি ফুলের বাগানের মধ্যে আমি বসে আছি।মুখ খানিকটা ফুলানো।আর ফুলবেই বা না কেনো?আমাকে এই দুই দিন কি বোকাটাই না বানালো!শুধু কি দুইদিন সেই প্রথম থেকেই তো বোকা বানিয়ে আসছে।আমি কি সাংঘাতিক ভয়ে ছিলাম এই দুই দিন।আরেকটু হলে তো হার্ট অ্যাটাকই হয়ে যেত।দু দুইবার আমাকে বোকা বানিয়ে বিয়ে করে নিল।আর আমি কিছুই করতে পারলাম না।সবাই মিলে মজা করে গেছে আর আমাকে জ্বালিয়ে গেছে।আগে থেকে কি কেউ একটু আভাস দিতে পারলো না।ছবিগুলোও ভালোমতো তুলতে পারলাম না।আজকে আসুক সে তারপর মজা দেখাবো,সবসময় শুধু আমাকে বোকা বানানো!
ভাবতে ভাবতেই উনি এসেও পড়লেন।দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে পিছনে ঘুরতেই আমি তার দিকে হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে গিয়ে তার বুকে ইচ্ছেমতো কিল ঘুষি দিতে লাগলাম।তিনি হেঁসে আমার হাত ধরে বললেন,
-‘ওরে বাবা এতো দেখি ডাকাত বউ।বাসরঘরে স্বামীকে সালাম না করে ডাইরেক্ট মারছে।সেই ভার্সিটির প্রথম দিনের সিনিয়রকে থাপ্পড় মারা সেই সাহসী ঘুমকন্যা আবার ফিরে এলো নাকি!’
-‘চুপ!আপনি খুব পচাঁ।আমাকে কি ভয়টাই না পাইয়ে দিয়েছিলেন।আগে থেকে বললে কি হতো? একটু ভালোমতো ছবি তুলতে পারলাম না।আমার গায়ে হলুদও তো হলো না!’
উনি দুষ্ট হাসি দিয়ে হেসে বলল,
-‘কে বলেছে গায়ে হলুদ হয়নি।তোমার কোমড়ে এতো রোমান্টিক ভাবে যে আমি হলুদ লাগিয়ে দিলাম সেটা ভুলে গেছো?’
আমি চোখ বড় বড় করে বললাম,
-‘সেটা আপনি লাগিয়েছেন?’
-‘ইয়েস ম্যাম,আর ছবির কথা বলছো!আমাদের ছবি মানে তোমার সেই চোখ বড় বড় করা অবাক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকাই তো আমাদের সিগনেচার পোজ।আর সেটাই পারফেক্ট।’
কথাটি বলে তিনি আমাকে ঘুরিয়ে বিছানার উপরের দেয়ালের দিকে হাত দিয়ে ইশারা করলেন।সেখানে দেখতে পেলাম আমাদের সেই কাজী অফিসে বিয়ের একটা দেয়ালজুড়ে বড় ছবি।যেখানে আমার হাতের মালা গলায় পড়ে তিনি দাঁত কেলিয়ে আমাকে মালা পড়াচ্ছেন আর আমি চোখ কপালে তুলে বড় বড় করে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি।কি সুন্দর ছবিটা!
আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম,
-‘আচ্ছা আমাদের বিয়ের রেজিস্ট্রি তো আগেই করা আছে তাহলে আমি তখন কোন কাগজে স্বাক্ষর করলাম?’
নিদ্র একটি চোখ টিপ দিয়ে বলল,
-‘ওটা আমাদের হানিমুনে সুইজারল্যান্ড যাওয়ার কাগজপত্রে স্বাক্ষর করেছো।বাব্বাহ!যেই ভাবে জ্ঞান হারিয়েছিলে!তারপর যে তোমাকে শাড়ি গয়না পড়িয়ে সাজগোজ করানো হলো তাতেও জ্ঞান ফিরলো না।কত কষ্ট হয়েছে ওভাবে সাজাতে!’
আমি হঠাৎ হকচকিয়ে বললাম,
-‘আমার শাড়ি পাল্টিয়ে বিয়ের শাড়ি পড়ালো কে?’
নিদ্র দাঁত কেলিয়ে হেঁসে একটা চোখ টিপ দিয়ে বললো,
-‘কেনো আমি পড়িয়েছি!’
আমি চোখ বড় বড় করে জোড়ে বললাম,
-‘কিহ?’
নিদ্র জোরে জোরে হেঁসে বললো,
-‘থাক এতো ঘাবড়াতে হবে না।শাড়ি তোমার বান্ধবীই পড়িয়ে দিয়েছে।কিন্তু এতো অবাক হলে কেন?আমি পড়িয়ে দিলে কি খুব বেশি অসুবিধা হয়ে যেতো?ম্যাম এখন থেকে অভ্যাস করে নিন,আমি কিন্তু খুবই রোমান্টিক একজন হাজবেন্ড হতে চলেছি।’
আমি লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে বললাম,
-‘ছি!আপনি একটা লুচু।’
-‘কি আমি লুচু।এতদিন ধরে বিয়ে করে তোমার অবুঝ হওয়ার জন্য এখনও বিবাহিত ব্যাচেলর হয়ে থাকছি আর আমি এখন লুচু হয়ে গেলাম।’
-‘দোষটা তো আপনারই।এমন প্যাচ গোছ করে কাজ করেন কেন?কেনো!আমাকে কি সরাসরি প্রপোজ করা যেতো না সরাসরি হুট করে বিয়ে করলেন কেনো?এমন প্যাচের কান্ড করলে আমি বুঝবো কিভাবে?এন্ড পয়েন্ট বি নোটেড,আপনি কিন্তু এখনো আমাকে নিজের মুখে ভালোবাসি বলেননি।’
-‘সম্পর্কটা যেখানে আত্মার সেখানে মুখ ফুটে বলাটা অনর্থক।আর কথা যদি হুট করে বিয়ে করার বলো তবে বিয়ে করবো না তো কি করবো!তোমার বোঝার আশায় বসে থাকলে আমার মাথার চুল সব পেকে সাদা হয়ে যেত তবুও তুমি বুঝতে পারতে না।তাই কোনো রিস্ক না রেখে বিয়ে করে নিলাম তারপর যা হবার হবে।আর এবার এই কাজটা করা হয়েছে কারণ এটা তোমার শাস্তি।আমি তো জানি এই দুইদিন তুমি প্রচুর ভয় পাবে,কষ্ট পাবে,টেনশনে শেষ হয়ে যাবে আর সেটাই তোমার পানিশম্যান্ট।তুমি যা করেছো তার কাছে এতটুকু কিছুই না।আর আমাদের সবকিছু এমন অদ্ভুত ভাবে করলাম কারণ তুমিই তো বলেছিলে তোমার একটা চটপটা রোমান্টিক লাভ স্টোরি চাই।যাতে বুড়ো বয়সে নাতি নাতনিদের শোনাতে পারো।নাও এখন তো পেয়ে গেলে একদম আনকমন মসলাদার রোমান্টিক লাভ স্টোরি।আমাদের নাতি নাতনিরা মুখ হা করে শুনবে তাদের দাদা বা নানা তাদের দাদী বা নানীকে কিভাবে বারবার বোকা বানিয়েছিলো।’
কথাটি বলে তিনি অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন।
আমি দাঁত কিড়মিড়িয়ে মুখ ফুলিয়ে বললাম,
-‘কিহ আমি বোকা! যান আপনার সাথে আমি সংসার করবো না।’
কথাটি বলে আমি অন্য দিকে ফিরে বুকে হাত গুজে মুখ ঘুড়িয়ে রাখলাম।
তিনি ভ্রু কুঁচকে আমার সামনে এসে বললো,
-‘বললেই হলো করবো না!বলেছিলাম না অপেক্ষা করতে হবে,আজকে সেই আমার অপেক্ষার প্রহরের সমাপ্তি ঘটলো।এতদিন ধরে ধৈর্য্য ধরে তোমার না বোঝার কারণে বিবাহিত হয়েও সিংগেল এর মতো বেঁচে আসছি আর এখন বাসর ঘরে বললেই আমি শুনবো!এই এবার একটা ছোট্ট কিউট তন্দ্রাকে ঘুমপুত্র ঘুমকন্যার রাজ্যে এনে ঘুমের ফুল প্যাকেজ কমপ্লিট করে ফেলি কি বলো!’
আমি কিছু না বলে মুখ ফুলিয়েই আবার অন্য দিকে ঘুরে দাঁড়ালাম।তিনি তার কুঞ্চিত ভ্রু আরেকটু কুঞ্চিত করে তাকালেন।সাথে সাথে লোডশেডিং হয়ে আকাশে আতশবাজি,পটাকা ফোটানোর প্রচন্ড আওয়াজ হতে লাগলো।
আমি ভয় পেয়ে চমকে উঠে নিদ্রকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।নিদ্রও ব্যাপক খুশি হয়ে আমাকে শক্ত করে আগলে ধরে বলল,
‘যাক!বান্দরগুলা এই প্রথম একটা ভালোর মতো ভালো কাজ করলো।বাসর রাতে আমাকে উত্ত্যক্ত করতে গিয়ে আরো সুবিধে করে দিল।’
তারপর চেঁচিয়ে বললো,
-‘লাভ ইউ দোস্ত।’
সেই রাতের মতো আজ রাতেও আকাশে একটি বিশাল পূর্ণিমার চাঁদ তার শুভ্র আলোয় চারিপাশ মায়াবী করে রেখেছে।তবে আজ শুধু দুটি লাল গোলাপ নয় সহস্র লাল গোলাপ যেন উদাস চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে কারণ আমার লাজুক লাল মুখের কাছে তাদের একত্রিত লাল রঙও যে ফ্যাকাসে হয়ে আছে।ধীরে ধীরে রাত গভীর হতে লাগলো তার সাথে গাঢ় হতে লাগলো আমাদের ভালোবাসার রঙও।আমার আকাশ জুড়ে আজ অবিশ্রান্ত নিদ্রর ভালোবাসার বর্ষণ হয়ে চলেছে যেই বৃষ্টিতে আজ আমিও উজাড় হয়ে ভিজে যাচ্ছি,আমার নিদ্রতে।
চারিদিকে রঙ বেরঙের ফুলে সুরভিত হয়ে আছে আজ পবন।প্রজাপতিরা মনের সুখে উড়ে বেড়াচ্ছে এই ফুল থেকে ঐ ফুলে।কোকিলের মিষ্টি কুহু কুহু ডাক সর্বত্র জানান দিয়ে যাচ্ছে,বসন্ত এসে গেছে।ফাল্গুনের রঙিন বৈচিত্র্যময় সাজে প্রকৃতি এখন নিজেকে সাজাতে ব্যস্ত যেমন আমি ব্যস্ত আমার নিদ্রকে দেখতে।পড়ন্ত বিকেলে বাগানে মাঝখানে দোলনায় বসে আকাশী রঙের একটি শার্ট পড়ে নিদ্র তার সেই সুন্দর অদ্ভুত মুখভঙ্গি করে কফি খেয়ে যাচ্ছে।তার পাশে বসে আমিও কফির মগ হাতে তার মতো মুখভঙ্গি করার গভীর চেষ্টায় মগ্ন হয়ে আছি।চোখটাকে ঈষৎ কুঞ্চিত করে ভ্রু যুগল হালকা ভাঁজ করে নিচের ঠোঁটটাকে আলতো চেঁপে ধরে মুখের সামনে কফির মগ তুলে ধরে…না না হচ্ছে না।কফির মগটা থেকে প্রথমে ঘ্রাণ নিতে হবে…..আর আর…এই পর্যায়ে আমার দিকে নিদ্র ভ্রু কুঁচকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ইশারা করল কি!
আমি বাচ্চামো একটি মিষ্টি হাসি দিয়ে মাথা নাড়িয়ে ইশারায় বললাম কিছু না।
হঠাৎ তার ফোনে মেসেজ আসায় সে হাতের মগটা আমাদের মাঝখানে রেখে পকেট থেকে ফোন বের করে চেক করতে লাগল।আর আমি এই সুযোগে তার কফির মগটা হাতে নিয়ে কালো লাল পাড়ের সাদা শাড়িসহ পা দোলনার উপড়ে গুটিয়ে তুলে একটু সরে দোলনার বাম সাইডের হাতলে ঠেস দিয়ে তার দিকে সরাসরি মুখ করে বসলাম।আর ঝটপট মুচকি হেসে তার খাওয়া কফি খেতে লাগলাম।তিনি ফোন রেখে আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আমার দিকে ঘেঁষে এসে আমার হাতসহ কফির মগ ধরে বলল,
-‘এবার আমি খাবো।’
কথাটা বলে তিনি আমার হাতসহ কফির মগ ধরেই কফি খেতে লাগলেন।কিছুক্ষণ পর আমি পা ঝুলিয়ে সোজা হয়ে বসে বললাম,
-‘একটা জিনিস খেয়াল করেছেন?আমাদের যেদিন প্রথম দেখা হয়েছিলো সেদিন আপনার
পরণে ছিল সাদা রঙের শার্ট আর আমার পরণে ছিল আকাশী রঙের কামিজ।আর আজ আপনি পরে আছেন আকাশী রঙের শার্ট আর আমি পড়ে আছি সাদা রঙের শাড়ী।অদ্ভুত মিল না!’
নিদ্র বলল,
-‘হুম।আমাদের প্রথম দেখার রঙের কম্বিনেশনটা ছিল পুরো আকাশের মতো।আকাশের সীমাহীন ভালোলাগা রঙ তার মতোই সীমাহীন ভালোবাসা এনে দিয়েছিল।আর বৃষ্টির ছোঁয়াও তো ছিল।’
আমি অবাক হয়ে বললাম,
-‘বৃষ্টির ছোঁয়া?’
-‘হুম।ঐ যে তোমাকে আমি বৃষ্টিতে জমে থাকা কাঁদা পানিতে ভিজিয়ে দিলাম।’
তারপট গালে হাত দিয়ে বলল,
-‘তারপরই তো যেই একটা থাপ্পড় খেয়েছিলাম।’
আমি খিলখিল করে হাসতে হাসতে বললাম,
-‘একটা কথা বলবো,আমার কিন্তু আপনাকে থাপ্পড় মারতে বেশ মজা লেগেছিল।প্রথম কোনো ছেলেকে ঠাস করে চড় মেরেছিলাম।হি হি হি!’
নিদ্র আমার দিকে কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আমার কোমড়ে হাত দিয়ে কাছে টেনে বলল,
-‘এই ব্যাপার।’
কথাটা বলে আমার ঘাড়ে তার খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা মুখ মৃদু ঘষে দিল।তার খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির ছোঁয়ায় এক অদ্ভুত শিহরণে আমি শিউরে উঠে তাকে কাঁধ দিয়ে ঈষৎ ধাক্কা দিয়ে লাজুক হাসি দিয়ে বললাম,
-‘ধূর!কি করছেন?সুড়সুড়ি লাগে।’
এই কথায় নিদ্র দোলনায় গা এলিয়ে দিয়ে নকল আফসোসের সুরে বলল,
-‘হায়রে আমার কপাল!এমন একটা বউ পেয়েছি রোমান্স করলে বলে সুড়সুড়ি লাগে!’
আমি তার আফসোসের ভঙ্গি দেখে মুখ টিপে হাসতে লাগলাম।
সে তার পা দিয়ে আমার পা চেপে ধরে হাত দিয়ে আমার গাল চেপে ধরে গালে একটা শক্ত গভীর চুমো দিয়ে বলল,
-‘মানা করেছিনা এভাবে হাসতে।’
পড়ন্ত বিকেলের রক্তিম সূর্য আকাশ থেকে বিদায় নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।নীল দিগন্তে ছড়িয়ে দিয়েছে তার লাল আভা।নিদ্রর কাঁধে মাথা রেখে আমি তাই গভীর মনোযোগে প্রদক্ষিণ করতে লাগলাম।কিছুক্ষণ পর অস্ফুট স্বরে বললাম,
-‘নিদ্র।’
-‘হুম।’
-‘ভালোবাসি।
সে মৃদু হেসে বলল,
-‘হুম।’
আমি কাঁধে মাথা রেখেই তার দিকে চোখ উঁচু করে তাকিয়ে বললাম,
-‘হুম কি?আপনিও বলুন।’
সে নিচের ঠোঁট আলতো চেপে ধরে বলল,
-‘হুম।’
এবার আমি ক্ষেপে গিয়ে একটা চিমটি দিয়ে বললাম,
-‘আবারও হুম!তাড়াতাড়ি বলুন।আমাকে কি শুধু জ্বালাতেই আপনার ভালোলাগে?’
-‘নিদ্র আমার পেছন দিয়ে কাঁধে হাত রেখে আরেকটু নিজের সাথে জড়িয়ে বলল,
-‘হুম ভালো লাগে,অনেক অনেক ভালোলাগে।ভালোবাসি বলেই ভালোলাগে।’
আমিও মুচকি হেসে আবারও তার কাঁধে মাথা রেখে পরম শান্তিতে ডুবন্ত সূর্যটিকে দেখতে লাগলাম।দিনশেষে ঘরে ফেরা ঝাঁক বাঁধা পাখিরা সেই লাল আভায় রাঙানো রক্তিম আকাশের বুক দিয়ে উড়তে থাকার সময় একটু যেন অদ্ভুতভাবে থমকে থমকে ঘুরে যেতে লাগলো।কিন্তু কেনো?
কে জানে!হয়ত তাদেরও বসন্তের থেকেও প্রগাঢ ভালোবাসার রঙে রঙিন হয়ে থাকা সিক্ত প্রেম যুগলকে দেখতে ভালো লাগে।
★★সমাপ্ত★★