#ভালো_লাগে_ভালোবাসতে
#পর্ব-১৫
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
কেমন আছে নিদ্র?ভালো আছে তো?ভালোবাসার মানুষকে ছাড়া সত্যিই কি ভালো থাকা যায়?
আমি যেমন এখানে পৃথকের যন্ত্রণায় ছটফট করছি,নিদ্রও কি এতটাই কষ্ট পাচ্ছে?যন্ত্রণা লাঘবের জন্য যে ঘৃণার বীজ আমি তার অন্তরে বপন করে এসেছি তা কি একটু হলেও কাজ করেছে?
প্রশ্নে ঝুরি বদ্ধ হওয়া শ্বাসরুদ্ধ মনকে হালকা করতে ট্যাক্সির জনালার কাঁচ নামিয়ে দিলাম।মাথাটা গাড়ির সাথে ঠেস দিয়ে সকালের ঝকঝকে পরিষ্কার আকাশ দেখতে লাগলাম।পাহাড়ী এলাকার আকাশ দেখতে একটু বেশিই সুন্দর।এখানে কোনো নির্ভেজাল থাকে না,থাকে না কলকারখানা,যানবাহনের বিষাক্ত কালো ধোঁয়া। শুধু থাকে চারিপাশ জুড়ে সবুজ প্রকৃতির স্নিগ্ধতা।জানালা দিয়ে মৃদু মৃদু শীতল বাতাস আসছে।আজ শীতলতাটা যেনো একটু বেশিই।চাদরটা আনমনে গায়ে আরেকটু টেনে নিলাম।হেমন্তের পাট চুকিয়ে প্রকৃতি এখন শীতের আগমনের অপেক্ষায় নিজেকে তৈরি করে নিচ্ছে।প্রকৃতির এই আকস্মিক পরিবর্তন মানুষ নিতে পারে না,জ্বর,ঠান্ডায় পড়ে অসুস্থ হয়ে পরে।
পরিবর্তন ব্যাপারটাই এমন।হঠাৎ করে হজম হতে চায় না।যেখানে প্রকৃতির অহরহ দেখা পরিবর্তনই মানুষ নিতে পারে না সেখানে পরিবর্তনটা যদি হয় হঠাৎ,অপ্রত্যাশিত তাহলে তো মানুষ সহ্যই করতে পারে না।চোখের সামনে হয়ে উঠে সব ধোঁয়াশা।সবকিছুকেই মিথ্যা মনে হয়।যেমনটি সেদিন হয়েছিল নিদ্রর।
চোখের সামনে আমার হঠাৎ এতবড় পরিবর্তন সেদিন উনিও মেনে নিতে পারেননি।যে মেয়েটি হালকা সাজে কখনো শাড়ি,সেলোয়ার কামিজ ছাড়া কিছু পরেনি সেই মেয়েটিই সেদিন একটু বেশিই আধুনিক ওয়েস্টার্ন পোশাকে তার সামনে এসেছিল।গাড় মেকআপের তলে নিজেকে ঢেকে তার ঈষৎ কোঁকড়া চুলগুলোও হেয়ার স্ট্রেইট মেশিনের বৈদ্যুতিক উত্তপ্ততায় পাল্টিয়ে ফেলেছিল।সকাল থেকে এক টানা সময় অফিসে কাটিয়ে ক্লান্ত মুখে পড়ন্ত বিকেলে বাড়ি ফিরেছিল সে।রুমে প্রবেশ করেই আমার এরূপ অবস্থা দেখে খয়েরী শার্টের গলায় ঝুলা টাই হাত দিয়ে টেনে একটু ঢিলা করে ফ্যাকাসে হাসি দিয়ে বলেছিল,
-‘সুপ্তি,তোমার চুলগুলো কি সোজা করে ফেলেছো নাকি?আগের ধরণটাই তো বেশি ভালো লাগতো।’
চেহারায় এক নীচ অহংকারী ভাব নিয়ে রুক্ষ গলায় আমি জবাব দিলাম,
-‘কেন এখন এটাও কি আপনার থেকে জেনে করতে হবে?আমার নিজের বলতে কি কোনো পছন্দ অপছন্দ থাকতে পারবে না।’
নিদ্র নরম গলায় বলল,
-‘আমি সেটা বলতে চাইনি।আমি তো জাস্ট…..
তার কথার মাঝেই আমি বলে উঠলাম,
-‘হ্যাঁ!আপনি তো জাস্ট নিজের মত গুলো অন্যের উপর জোড় করে চাপিয়ে দেন।আপনার কাছে তো আপনার নিজের স্বার্থ ছাড়া আর অন্য কোনো কিছুই যায় আসে না,তাই না!’
সে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থমথমে গলায় বলল,
-‘তোমার আজকে হয়েছে কি?কিসব বলছো,তোমার শরীর ঠিক আছে তো?’
তার মুখে “শরীর ঠিক আছে তো শুনে” আমার ভেতর থেকে কান্না বেড়িয়ে আসতে চাইলো কিন্তু নিজেকে সংবরণ করে পেছনে ঘুরে শক্ত হয়ে বললাম,
-‘এসব ফেক কেয়ার দেখানো বন্ধ করুন।যেটা করা দরকার সেটা তো কিছু করছেন না।আর কতদিন এমন মিথ্যা বিয়ের বোঝ আমাকে টানতে হবে।আপনার ঐ মেয়ে মানবে কি না মানবে সেসব নিয়ে তো আর আমি ঠ্যাকা না।আমার এই জঞ্জাল আর ভালো লাগছে না।’
সে হঠাৎ প্রচন্ড রেগে বেড সাইডে রাখা টেবিল ল্যাম্পটা তুলে মেঝেতে আছাড় মারল।ঝনঝন শব্দে ল্যাম্পটি চূর্ণ বিচূর্ন হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল।প্রচন্ড শব্দে আমি কেঁপে উঠে তার দিকে ঘুরে বললাম,
-‘এসব রাগ দেখিয়ে আবার আমাকে দমিয়ে রাখতে চাইছেন!আমার এখন এসবে কিছু যায় আসে না।’
নিদ্র দ্রুত আমার কাছে এসে তার দুই হাত আমার গালে রেখে ছলছল চোখে চোখ রেখে শক্ত মুখে বলল,
-‘সত্যিই কি তোমার কিছু যায় আসে না।তবে কি আমি যা বুঝেছিলাম সব ভুল ছিল?’
রাগ আর চাপা কষ্টে তার ক্লান্ত মুখটি লাল হয়ে গেছে।চোখ থেকে যেকোনো সময় অশ্রু বিন্দুটি গড়িয়ে পড়ল বলে।তাকে এভাবে দেখে খুব কষ্ট হচ্ছিলো আমার।ইচ্ছে করছিলো তার ক্লান্ত,কষ্টে বিবর্ণ মুখটা বুকে জড়িয়ে ধরি।সেই চোখের দিকে তাকিয়ে মিথ্যা বলা যে অসম্ভব।
তাই এক ঝটকায় নিজের থেকে তার হাত সরিয়ে দৃষ্টি ঘুরিয়ে বললাম,
-‘আপনি কি বুঝেছেন না বুঝেছেন তা আমি কি জানি!আমি শুধু এতটুকু জানি যে আমি হাঁপিয়ে উঠেছি এই ফেক ড্রামা করতে করতে।ব্যাস!এবার আমি আলাদা হতে চাই।’
আমার কথাটি শেষ হওয়ার সাথে সাথেই নিদ্র তার দুই হাত দিয়ে আমার কাঁধ খুব শক্ত করে ধরে এক ঝটকায় তার কাছে টেনে রাগে চোখ মুখ খিচে বলল,
-‘চুপ!একদম চুপ।একদম খুন করে ফেলবো আলাদা হওয়ার কথা বললে।’
-‘ভালো!এভাবে শুধু জোরই করতে থাকুন।প্রয়োজনে আমাকে বিয়ে করে আপনার সাথে থাকতে জোর করছেন,কাল হয়তো প্রয়োজনে জোর করে শরীরটাও ভোগ করে নিবেন!’
আমার কথায় নিদ্র চরম বিতৃষ্ণা ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে ছি! বলে আমাকে জোরে একটা ধাক্কা দিয়ে ছেড়ে হনহন করে রুম থেকে বের হয়ে গেল।তার ধাক্কায় আমার পা গিয়ে পড়ল ভাঙা ল্যম্পের টুকরোয়।
পা কেটে গর গর করে সেখান থেকে রক্ত বেরোতে লাগল।তবুও যন্ত্রণা তো হচ্ছে এই বুকের ক্ষতে,এর কাছে অতটুকু ক্ষত যে কিছুই না।
সোফার উপর পা গুটিয়ে বসে বসে কাঁদতে লাগলাম।সারাদিন পর মানুষটা ক্লান্ত মুখে বাড়ি ফিরেছিল।এখনো নিশ্চয়ই কিছুই খায়নি।আর আমার জন্য তাকে এখন বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হলো।আর কিই বা করতাম আমি।আমি যে নিরুপায়।ভাগ্য যে আমাকে নিয়ে নিষ্ঠুর খেলায় মেতেছে।কোনো দোষ না করেও সেই খেলার অংশীদার যে তাকেও হতে হবে।আমিও যে তাকে সেই নরক যন্ত্রণায় ফেলতে যাচ্ছি।আমি তা চাই না,কেনো পাবে নিদ্র এই শাস্তি কোনো অপরাধ না করেও?নিদ্রকে আমি জীবন্ত লাশ বানিয়ে রাখতে রেখে যেতে পারবো না।
আমি জানি,নিদ্র আমাকে ভালোবাসে,চরম মাত্রায় ভালোবাসে।আজ যদি আমি মরে যাই সেই ধাক্কা সে কখনোই সামলাতে পারবে না।তীব্র,তীক্ষ্ণ যন্ত্রণায় তাকে ভুগতে হবে আজীবন।ভালোবাসার পরিবর্তে এত বড় শাস্তি তাকে আমি দিতে পারবো না।তাই ঘৃণার আশ্রয় নিয়ে একটু হলেও যদি তার মন থেকে সরতে পারি।আমাকে ঘৃণা করে হলেও যদি সে আমাকে ভুলতে পারে,আবার সাজিয়ে নিতে পারে জীবন অন্য কারো সাথে।
‘আফা,এই সুন্দইরা ফুল নিতান?’
পাঁচ,ছয় বছরের পাহাড়ী একটি বাচ্চা মেয়ে জানালার দিকে হাত বাড়িয়ে পাহাড়ি এলাকার জংলী ফুলগুলো আমাকে সাধছে।পেটের দায়ে বন জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়ে হয়তো অন্যদের মতো আভিজাত্য ফুলগুলো এরা পায় না।জঙ্গলের তরতাজা ফুলগুলো সংগ্রহ করিয়েই ভাগ্যের জোড়ে বেড়িয়ে পড়ে,যদিও পেলে পায় দু একটি জংলী ফুল ক্রেতা।
আমি হাত বাড়িয়ে বেগুনি রঙের সুন্দর ফুলগুলো নিলাম।
-‘নাম কি তোমার?’
মেয়েটি তীক্ষ্ণ রোদের থেকে হাত দিয়ে চোখকে আড়াল করে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল,
-‘মিয়াংনু।’
-‘বাড়ি কোথায় তোমার?’
মেয়েটি তার ছোট্ট হাত বাড়িয়ে পুবের আকাশ ছোঁয়া পাহাড়ের দিকে ইশারা করলো।বুঝতে পারলাম মেয়েটির বাড়ি সেখানের কোনো এক পাহাড়ের গায়ে।সে রোজ সেখান থেকে শহুরে রাস্তায় নেমে আসে ফুল বিক্রির জন্য।
-‘স্কুলে যাও?’
মেয়েটি হাসি মাখা মুখে ঘাড় নাড়িয়ে না বলল।
-‘তোমার বাবা মাকে বলবে তোমাকে আলোর ঝর্ণা নামের সংগঠনের কাছে নিয়ে যেতে।সেখানে বিনা টাকায় তুমি পড়ালেখা করতে পারবে।’
-‘হাছা।’
আমি মাথা নাড়িয়ে মৃদু হেসে মেয়েটিকে আশ্বাস দিলাম।পার্স থেকে দুশো টাকা বের করে মেয়েটির হাতে গুঁজে দিলাম।মনে হল মেয়েটিকে বিরাট বিপাকে ফেলে দিয়েছি।সে শুকনো মুখে হাতের মুঠোয় খুচরো দুই,পাঁচ টাকার নোট নাড়াচাড়া করছে।আমি মৃদু হেসে বললাম,
-‘তোমাকে ভাংতি দিতে হবে না।তোমার ফুলগুলো আমার অনেক পছন্দ হয়েছে তাই বেশি পছন্দের জন্য বেশি টাকা। বুঝেছো?’
মেয়েটি খুশি মনে দ্রুত ঘাড় নেড়ে এক ছুটে সেখান থেকে সরে আবার অন্য গাড়ির কাছে গেল।গাড়ির সামনে ভেড়ার পাল চলে আসায় ছোটোখাটো জ্যাম লেগে গিয়েছিল।দু মিনিটের মধ্যেই আবার ছুটে গেল।ঢাকা শহর হলে এই জ্যাম ছুটতে অন্তত দু ঘন্টা লেগে যেত।গাড়ি আবার ধীর গতিতে চলতে শুরু করলে আমি হাতে থাকা খোলা পার্স টা লাগাতে নিলাম।কিন্তু পারলাম না,আমাকে থমকে যেতে হল।খোলা পার্সের মধ্য থেকে উঁকি দিচ্ছে একটি ছোট্ট নীল চিরকুট।এক কোণা বের করে নিজের উপস্থিতি জানিয়ে দিচ্ছে।বলতে চাইছে আমি আছি।
ছলছল চোখে চিরকুটটি বের করে তাতে লেখা শব্দগুলো মুহূর্তের মধ্যেই কয়েকবার পড়ে নিলাম।মুখস্ত হয়ে গেছে প্রতিটি শব্দ,তবুও বারবার পড়তে কতই না ভালো লাগে।কি যাদু মেশানো আছে এই শব্দে।দু লাইনের ছোট্ট নীল চিরকুট অসংখ্য বার পড়ে ফেলেছি তবুও যেনো হয়না পড়া।
নিদ্র আর আমার সেই দুটি গোলাপ ফুলের বাসর রাত।ঘুমে চোখ জড়িয়ে এলেও সেদিন ঠিক করেছিলাম সারা রাত ঘুমাবো না।পাছে সকালে তার ঘুম ভাঙতে দেরি না হয়ে যায়।তাকে যে সবার উঠে পড়ার আগেই চলে যেতে হবে।নয়তো কেউ দেখে ফেললে কি সাংঘাতিক ব্যাপার হয়ে যাবে!জানালার বাইরে ছিল মস্ত বড় পূর্ণিমার চাঁদ আর আমার চোখের সামনে ছিল একটি চাঁদপানা ঘুমন্ত মুখ।অপলক চোখে দেখতে দেখতে মাঝ রাত হয়ে গেলেও কিভাবে যেনো একসময় চোখটা লেগে এসেছিল।সেই চোখ খুললো সকালের তীব্র রোদের আলোয়।ধরফরিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে বসেছিলাম।রোদের তীব্রতা দেখেই অনুমান করে নিয়েছিলাম বেলা কতদূর।ভয়,আশঙ্কা নিয়ে চারপাশে চোখ বুলিয়ে যাকে খুঁজছিলাম তাকে আর নজরে পড়ল না।শুধু চোখে পড়ল মাথার কাছে সেই দুটি গোলাপের একটি গোলাপের নিচে ভার দিয়ে রাখা একটি নীল চিরকুট।হাত বাড়িয়ে নিয়ে কৌতুহলী চোখে কপাল ঈষৎ ভাঁজ করে চিরকুটটি পড়ে দেখলাম তাতে লেখা,
‘এই ঘুমকন্যা,তোমার বালিশে কি কোনো ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে রেখেছো?মাথা ছোঁয়াতেই ঘুম।নয়তো ঘুম কি তাতো এক ঘুম চোর আমাকে ভুলিয়েই দিয়েছিলো!’
লেখাটি পড়ে আনমনেই আমার ঠোঁটের কোণায় একটি মৃদু হাসি ফুটে উঠেছিল।হাত বাড়িয়ে সেই গোলাপটিও তুলে নিয়েছিলাম।একটি গোলাপ সে নিয়ে আমার জন্য আরেকটি রেখে গেছে।এমন অদ্ভুত অদ্ভুত ছোট ছোট ভালোবাসা মাখা পাগলামোগুলো তার মাথায় আসে কিভাবে কে জানে!
সে কি জানতো তার মতো আমিও সেই গোলাপটি সন্তর্পণে রেখে দিবো শুকিয়ে যাবার পরও?
যেমনটি সেও রেখেছো আমাদের বাসরের এই ক্ষুদ্র চিহ্ন তার ডায়েরীর ভাঁজে।
সত্যি!আমাকে সে আমার থেকেও বেশি জানতো।কিন্তু হয়তো সে এটা জানতো না আমি এই চিরকুটটিও রেখে দিবো।সেদিন সেই শুকনো ফুল আর নীল চিরকুট আমি কেনো আনমনে যত্ন করে রেখে দিয়েছিলাম জানি না।কিন্তু এখন এই দূরত্বে এই চিরকুটটি আমায় বড্ড সামলিয়ে রাখে।তার স্মৃতিতে বিভোর হয়ে তাকে কাছে পাওয়ার তুমুল অস্থিরতা যখন আমাকে গ্রাস করে ফেলে প্রচন্ড জ্বালাতে থাকে তখন এই ছোট্ট কাগজের টুকরোটিই আমার স্বস্তির অবলম্বন হয়ে দাঁড়ায়।কাগজের উপড়ে কালো কালিতে লেখা গোটা গোটা অক্ষরগুলো বারবার হাত দিয়ে ছুঁয়ে তার স্পর্শ অনুভব করতে থাকি।কখনো বুকে জড়িয়ে তো কখনো গালে ছুঁয়ে রেখে চোখের জল অনবরত ফেলতে থাকি।
আজ সাত সাতটা মাস আমাকে এভাবেই কাটাতে হয়েছে।শুনেছি মৃত্যুর কথা শুনলে সেই সময়গুলো নাকি খুব দ্রুত কেটে যায়।কিন্তু আমার সময়গুলো কেনো কাটতেই চায় না।এই সাত মাস আমার কাছে সাতটা বছরের মত মনে হয়েছে।এখন শুধু মনে হয় দ্রুত মৃত্যু এসে পড়ুক।আর ডক্টরও দেখায়নি আমি।নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও শুধু শুধু মিথ্যা আশা নিয়ে হসপিটালের দরজায় দরজায় ঘুরে নকল স্বান্তনা নিতে চাই না।
নিদ্রকে ছাড়া সময় কাটাতে যে খুব কষ্ট হয়।শরীরের অসুস্থতা আমি বুঝতেই পারি না,মনের অসুস্থতাই যে আমাকে মেরে ফেলছে।
কিন্তু যতই কষ্ট হোক নিদ্রর কষ্ট কম করার জন্য আমাকে এই কষ্ট ভোগ করতেই হবে।
সেদিন কাটা পা নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে কখন সোফায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না।সকালে ঘুম ভাঙলে দেখি আমার পায়ে ব্যান্ডেজ করা।বুঝতে আর বাকি রইলো না এই কাজটা কার।
তখনই বুঝতে পারলাম এই তীব্র ভালোবাসায় ঘৃণা কখনোই জায়গা করতে পারবে না।ঘৃণারও অত শক্তি নেই।আমাকে আরো বড় কিছু করতে হবে। তাই কোনো এক রাতের আঁধারে পাড়ি দিয়েছিলাম সবাইকে ছেড়ে কোনো অজানা পথে।আমার মৃত্যুটা কেউ না দেখুক।সেই ভয়ংকর বিভীষিকার সাক্ষী কোনো আপনজন না হোক।
নিজেকে লুকাতে এই সিলেটের পাহাড়ি এলাকায় এসে পৌঁছালাম।জীবন সত্যিই সবাইকে সব কিছু শিখিয়ে দেয়।সেই অবাক চোখে তাকিয়ে থাকা অবুঝ মেয়েটিও আজ অনেক কিছু বুঝতে শিখে গেছে।অপরিচিত শহরে নিজের একটা জায়গা করে নিয়েছে।এখানেই একটি আলোর ঝর্ণা নামের এনজিওতে এখন আমি জব করি।পাহাড়ি এলাকার গরীব বাচ্চাদের পড়াশোনার ক্ষেত্রে এই এনজিও টি কাজ করে।
খুব ভোরেই বের হয়ে এনজিওর হেড অফিসে যেতে হয়েছিলো একটা দরকারি কাজে।দু তিন ঘন্টা সেখানে পেরিয়ে এখন বাড়ির উদ্দেশ্যে যাচ্ছি।দেখতে দেখতে বাড়ির সামনে এসে পড়লাম।আমার বাসা শহরের শেষ প্রান্তের দিকে।
একটি ছোটো দুই রুমের বাসা ভাড়া নিয়ে আমি একা থাকি।
ট্যাক্সি থেকে নেমে ভাড়া চুকিয়ে কাঠের ভেজানো দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকে সামনে দৃষ্টি যেতেই আমার পা মেঝের সাথে আটকে গেলো।অস্ফুট স্বরে শুধু গলা দিয়ে বেরোলো “নিদ্র।”
সোফার উপর এক পায়ের উপর আরেক পা তুলে নীল শার্ট গায়ে শক্ত মুখে নিদ্র বসে ছিল।
আমার গলা থেকে বের হওয়া অস্ফুট আওয়াজে সে খুব স্বাভাবিক ভাবেই উঠে দাঁড়িয়ে আমার কাছে আসতে লাগলো।তাকে দেখে আমি পুরোই স্তব্ধ হয়ে গেছি।বলার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।খুশি আর শঙ্কার মিশ্র অনুভূতি নিয়ে শুধু ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম।
সে ধীর পায়ে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে আমার মুখের উপর কিছু কাগজ ছুঁড়ে মারলো।আমি হতভম্ব হয়ে কাগজগুলো মাটি থেকে কুঁড়িয়ে সম্পূর্ণটা পড়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম।কাগজগুলোর একটি আমার মেডিকেল রিপোর্ট আরেকটি হসপিটাল থেকে ক্ষমা চেয়ে লেখা একটি এপোলজি লেটার।
সেখানে লেখা আমার ব্রেইন টিউমার হয়নি।হসপিটালের অন্য পেশেন্টের সাথে আমার রিপোর্ট এক্সচেন্জ হয়ে যাওয়ায় এমন মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং তৈরি হয়েছে।হসপিটালের এতবড় অবহেলার জন্য তারা আন্তরিক ভাবে ক্ষমাপ্রার্থী।আমার আসল রিপোর্টে দেওয়া আমার মাথা ব্যাথা নরমাল মাইগ্রেইনের সমস্যাই ছিলো।
নিজের চোখকে আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।আমি স্বপ্ন দেখছি না তো!সত্যিই তো আমি তো এটা ভেবেই দেখিনি আমার সত্যিই ব্রেইন টিউমার হয়ে থাকলে এতদিনে তো আমার অবস্থা খুব খারাপ হবার কথা।মনের কষ্টেই আমি এতটা বিভোড় ছিলাম যে এসবে কোনো লক্ষ্যই রাখিনি।
এক মুহুর্তের জন্য খুশি হয়ে নিদ্রর দিকে তাকালাম।কিন্তু পরমুহুর্তেই তার কথা শুনে আমার সমস্ত খুশি উধাও হয়ে গেলো।পায়ের নিচ থেকে কেউ যেনো মাটি কেড়ে নিল।
কারণ সে বলল,
-‘হুট করে যে উধাও হয়ে গেছো,আমাকে ডিভোর্স দিয়ে আসোনি কেনো?তুমি বেঁচে থাকতে তো আর আমি আরেকটা বিয়েও করতে পারবো না।আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে,এবার আমাকে ডিভোর্স দিয়ে উদ্ধার করো!’
চলবে,,