#ভালোবাসি_শুধু_তোমায় ?❤
#পর্ব : ১২
#লেখিকা : Aye Sha (Koyel Banerjee)
” মীরা! জলদি সাইনটা করে ফেল, দেরী করিস না। ”
ফুপির কথায় আমার টনক নড়লো। আজ এই মুহুর্তে আমি আমানের পাশে বসে আছি। সামনে বসে আছেন উকিল আর সেন্টার টেবিলে রাখা ডিভোর্স পেপার। ফুপি, সুমি (ইসমি) দুজনেই এসেছে। আব্বু-আম্মু বেঁচে থাকলে হয়তো তারাও আসতো। আব্বু-আম্মু কোনদিনই চাইত না আমার কোনো কষ্ট হোক কিন্তু আজ দেখো? সেই আমারই কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। আমাকেই আগে সাইন করতে বলা হয়েছে। আমি চুপ করে বসেছিলাম দেখে ফুপি আমায় তাড়া দিলো। মাথাটা কেমন ঘুরছে, চোখে সব ঝাপসা দেখছি আমি। পেন হাতে নিতেই হাতটা কাঁপতে শুরু করলো আমার। অনেক কষ্টে নিজের বুকে পাথর চেপে সাইনটা করে দিলাম। সাইনটা করে আমানের দিকে তাকাতেই দেখলাম উনি বসে বসে গেম খেলছেন ফোনে। আমি অবাক হয়ে গেলাম। আজ আমাদের ডিভোর্স তারজন্য কি একটুও কষ্ট হচ্ছে না আমানের? নাহ! হচ্ছে নাহ বলেই তো কি সুন্দর ফুরফুরে মেজাজে রয়েছেন। আমি একটা তাচ্ছিল্য হাসি দিলাম আমানের দিকে তাকিয়ে তারপর মাথা নিচু করে নিলাম। ফুপি আমান কে উদ্দেশ্য করে বললেন,
— আমান! এইবার তুমি সাইন করে দাও। মীরা সাইন করে দিয়েছে ডিভোর্স পেপারে।
আমি চোখ বন্ধ করে নিলাম কথাটা শুনে। আর পারছি না নিজের চোখের পানি ধরে রাখতে। কিন্তু ফুপির তীক্ষ কন্ঠস্বরে চোখ খুলতে বাধ্য হলাম,
— কি হলো আমান? সাইন টা করো? এখন কি গেম খেলার সময়?
আমি আমানের দিকে তাকাতেই দেখলাম ফোনে ব্যস্ত এখনও। আমি আস্তে করে আমান কে ডাকলাম,
— আমান!
আমান ঘাড় ঘুরিয়ে আমার চোখে চোখ রেখে বললেন,
— কিছু বলবে মীরু?
আমানের এই ব্যবহারে আমি অবাক হয়ে গেলাম। আমিসহ হয়তো উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে গেলো। আমানের আম্মু ঝাঁঝালো কন্ঠে আমান কে বললেন,
— আমান! তোমাকে সাইন করতে বলা হচ্ছে সেটা কানে যাচ্ছে না? সাইনটা করো জলদি।
ফুপি বললো,
— সাইনটা করে উদ্ধার করো আমাদের।
আমি বুঝতে পারছি না ফুপি কেন এতো উত্তেজিত হয়ে পরছেন আমানের সাইন না করায়। আমান ফুপির দিকে তাকিয়ে বললেন,
— আসলে কি বলুন তো আমি না একদম শুনতেই পাইনি আপনার কথা। অ্যাকচুয়লী শোনার প্রয়োজন মনে করিনি।
ফুপি রাগান্বিত কন্ঠে বললেন,
— কিইই? এতো বড়ো সাহস তোমার তুমি আমায় অপমান করো? তুমি জানো আমি কে?
আমান স্বাভাবিক ভাবে ফোন টেবিলে রেখে উত্তর দিলেন,
— হ্যাঁ আমার ওয়াইফ মীরুর ফুপি আর আমার ফুপি শ্বাশুরি। কেন আপনি কি মীরুর খালা? আমি কি ভুল জানতাম এতোদিন? মীরু? তুমি আমাকে ফুপি বলেছিলে নাকি খালা?
উনি আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ঠিকই করলেন কিন্তু আমি কোনো উত্তর দিতে পারলাম না নিজের বিস্ময়তা কাটিয়ে। অবাক হয়ে যাচ্ছি ওনার ব্যবহারে আজ আমি। এমনিতেই চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে আসছে আমার। ফুপি দাঁতে দাঁত চেপে আমান কে বললো,
— কি হচ্ছে টা কি আমান? তোমাকে সই করতে বলা হচ্ছে তো নাকি?
আমান ফুপির দিকে তাকালেন তারপর ডিভোর্স পেপারটা হাতে নিয়ে বললেন,
— আমি আমার মীরু কে ডিভোর্স দেবো না। আর কিছু বলার আছে আপনার?
কথাটা বলেই উনি পেপার্সগুলো ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেললেন। আমার যে কি খুশি লাগছে তা আমি বোঝাতে পারবো না কিন্তু হঠাৎই ফুপির চিৎকারে আমি কেঁপে উঠলাম,
— আমানননন!! কি করলে তুমি এটা? তুমি কি ভুলে যাচ্ছো তোমার জীবন ধ্বংস হয়ে যেতে পারে এর জন্য?
আমান বললেন,
— নাহ! আমি কিছুই ভুলছি না। আমার মেমরি ভীষণ স্ট্রং! অ্যাকচুয়লী আম্মু ছোট থেকে ব্রেনলিয়া খাইয়েছে তো তাই।
আমানের এমন হাস্যকর কথায় আমানের আম্মু রেগে আমানের দিকে তেড়ে এসে বললেন,
— তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে? তুমি তোমার আম্মুর কথা অমান্য করছো আমান?
কথাটা শেষ হতেই আমানের রুপ বদলে গেলো। আমান হুংকার দিয়ে বলে উঠলো,
— শাট আপ! জাস্ট শাট আপ! অনেক ড্রামা করেছেন আর এসবের কোনো দরকার নেই। আর কিছুক্ষণ পর জেলে গিয়ে এই ড্রামা দেখাবেন।
আমি আর সুমি (ইসমি) অবাক হয়ে যাচ্ছি আমানের কথা বার্তায়। আমি তো নির্বাক হয়ে গেছি আর সুমি আমানকে সামান্য ভয় পেয়ে প্রশ্ন করলো,
— জিজু এমন ব্যবহার কেন করছেন আপনি আন্টীর সাথে?
আমান সুমির (ইসমি) কথার উত্তর দেবে তার আগেই আমার ফুপি বলে উঠলো,
— এর পরিণাম কিন্তু ভালো হবে না আমান। তোমাকে কিন্তু অনেক চওড়া দাম দিতে হবে এর জন্য।
আমি ফুপিকে জিজ্ঞেস করলাম,
— এমন কথা কেন বলছো তুমি ফুপি? তুমি কি চাও না আমি আমার স্বামীর সাথে ঘর করি? কিসের ভয় দেখাচ্ছ তুমি ওনাকে বার বার?
আমার প্রশ্নে ফুপি চুপ করে গেলেন। আমান আমাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বললেন,
— অনেক কিছু তোমাকে জানতে হবে এখন মীরু। মানুষের আসল রুপ তোমার সামনে আসবে। যাকে নিজের মনে করে এসেছো সেই যে তোমার ক্ষতি করতে চেয়েছে তা জানতে হবে। তুমি তৈরী তো এসব শোনার জন্য?
আমি আমান কে ধরে ওনার চোখে চোখ রেখে বললাম,
— কি বলছেন এসব আপনি? আমার মাথায় তো কিছুই আসছে না। “যাকে বিশ্বাস করেছি সে ক্ষতি করতে চেয়েছে?” এই কথার মানে কি আমান?
আমান আমার প্রশ্নের উত্তর দেবে এমন সময় ফুপি শান্ত গলায় বলে উঠলেন,
— ভেবে চিন্তে উত্তর দিয়ো আমান। কথায় আছে জানোতো? ” ভাবিয়া চিন্তা করিয়ো কাজ, করিয়া ভাবিয়ো না।”
ফুপি কথা শেষ করে কেমন জানো রহস্যময় হাসি দিলেন। আমি আমানের দিকে তাকাতেই দেখলাম আমান চোয়াল শক্ত করে নিলেন তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
— তুমি বারবার আমার কাছে জিজ্ঞেস করতে না আমি কেন তোমাকে নিজের থেকে দুরে সরাচ্ছি? আমি কেন তোমাকে ক্ষমা করে আগের মতো ভালোবেসে কাছে টেনে নিচ্ছি না? এইসব প্রশ্নের একটাই উত্তর মীরু! তোমার ফুপি।
আমার মাথায় জানো আকাশ ভেঙ্গে পরলো, আমি ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম,
— এসব কি বলছেন আপনি? আমার ফুপি? আমার ফুপি এসব…
— হ্যাঁ তোমার ফুপি। আজ থেকে ছয় মাস আগে যখন তুমি আমায় দেখেছিলে আর বাসায় গিয়ে সুমি কে সবটা বলেছিলে তখন তোমার ফুপি সবটা শুনে নেয় আর প্ল্যানিং করে ফেলে। কিসের প্ল্যানিং জানো? সম্পত্তির!
— স..স..সম্পত্তি?
— হ্যাঁ মীরু সম্পত্তি। সম্পত্তি পাওয়ার লোভে তোমার ফুপি আমার কাছে আসে আর আমাকে এসে বলে যে তোমার আব্বু-আম্মু তোমার আর সুমির নামে কোনো সম্পত্তি লিখে যায়নি। লিখে গেছে তোমাদের আর তোমাদের স্বামীর নামে। তোমাদের বিয়ের পর যৌথ মালিক হবে এই সম্পত্তির।
সুমি বললো,
— হ্যাঁ জিজু। এটা তো আব্বু-আম্মু আমাকে আর মীরা কে বলে গেছিলো। কিন্তু ফুপি জানলো কীভাবে?
— উইল দেখে। যেখানে তোমার আব্বু-আম্মুর তৈরী করা উইল আছে এবং যে উকিল সেই উইল তৈরী করেছে তার থেকে জেনেছেন। তোমার মুখে আমার কথা শুনে তোমার ফুপি আমার কাছে এসে বলে যে আমি তো তোমাকে ভালোবাসি না তাই আমাকে একটা কনট্রাক্ট ম্যারেজ করতে। ছয় মাস পরে আমি তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে দেবো আর নিজের ইচ্ছায় সব সম্পত্তি তোমার ফুপির নামে করে দেবো। আর এই সম্পত্তি থেকে কিছু অংশ আমি পাবো আমার এই পরিশ্রমের ফলে। আমি না করে দিই ব্যাপারটা শুনে। কিন্তু তোমার জোরাজুরি আর পার্টির ওই ঘটনা আমায় বাধ্য করেছিল তোমাকে বিয়ে করতে। বিয়ের দিন রাতে আমি জানতে পারি নীহা পার্টি তে ইচ্ছে করে তোমায় বদনাম করেছিল আমায় বিয়েতে রাজি করানোর জন্য। অর্থাৎ ওটা তোমার ফুপির প্ল্যান ছিলো। এই যেই ডিভোর্স পেপার্স টা আমি ছিড়ে ফেললাম, এর নিচে আরেকটা কাগজ ছিলো ওখানে লেখা ছিলো আমি আর তুমি নিজের ইচ্ছায় আমাদের ভাগের সম্পত্তি তোমার ফুপির নামে করে দিচ্ছি। এইটা নিচে রাখা ছিলো কারণ বাই এনি চান্স তুমি এটা পড়ে নিলে সমস্যা হয়ে যাবে। কিন্তু যখন কোর্টে জমা দেঅযা হবে তখন সম্পত্তির কাগজ আগে তার প্রায় অনেকদিন পর আমাদের ডিভোর্স পেপার জমা দেওয়া হতো যাতে বোঝা না যায় এটা প্ল্যান মাফিক করা।
— নীহা? নীহা এসবে যুক্ত?
— হ্যাঁ। নীহা তোমার ফুপির কথায় সব করেছে এতোদিন। বিয়ের পর তোমার ফুপি জানতে পারে যে আমি তোমাকে অনেক আগে থেকে ভালোবাসতাম আর সেসময় তুমি আমাকে রিজেক্ট করেছিলে। সাড়ে তিন বছর আগে ঘটে যাওয়া সব ঘটনাই তোমার ফুপি জানতে পারে আর শুরু হয় আমাকে ব্ল্যাকমেইল। ডিল হয়েছিল আমি তোমার কাছে কোনদিন আসতে পারবো না বিয়ের ছয় মাসে কিন্তু যেহেতু আমি তোমাকে ভালোবাসতাম অনেক আগে থেকে এটা জেনে যাওয়ায় উনি আমার আম্মু কে কিডন্যাপ করেন রাতারাতি।
— কিইই? ফুপি যদি আপনার আম্মু কে কিডন্যাপ করেন তাহলে ইনি কে?
আমি আমানের আম্মুর দিকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্নটা করতেই আমান হাসলেন আর হেসে উত্তর দিলেন,
— ইনি আমার আম্মু নন। ইনি তোমার ফুপির সাজানো একজন অভিনেত্রী। যে কি না দিনের পর দিন আমার আম্মু হওয়ার অভিনয় করে এসেছেন। তুমি কি দেখেছো একদিনও আমাকে এনাকে আম্মু বলে সম্বোধন করতে?
— ন..নাহ।
— আমার আম্মু হলে তো সম্বোধন করবো। ইনি তো একজন ফেইক। আর এতোদিন যে আমি নীহার সাথে নাটক করেছি তাও তোমার ফুপির কথায়। দিনের পর দিন উনি আমাকে ব্ল্যাকমেইল করে এসেছেন আমার আম্মু কে নিয়ে। বাধ্য করেছেন আমাকে তোমার থেকে দুরে সরে থাকতে।
— এসব কি বলছেন আমান? এসব কি সত্যি ফুপি? তুমি সত্যি শুধুমাত্র সম্পত্তির লোভে এমনটা করেছো? দিনের পর দিন আমান কে আর আমাকে আলাদা রেখেছো, তাও আবার আমানের আম্মু কে কিডন্যাপ করে ওনাকে ব্ল্যাকমেইল করে?
আমি ফুপির দিকে এগিয়ে ফুপিকে কথাগুলো জিজ্ঞেস করলাম। আমান আমাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে আমার গালে হাত রেখে বললেন,
— এটা সত্যি আমি সাড়ে তিন বছর পর তোমায় দেখে খুশি হওয়ার সাথে অভিমান করে ছিলাম। কিন্তু তুমি যখন আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলে তুমি আমায় ভালোবেসে ফেলেছো, সাড়ে তিন বছর ধরে আমার অপেক্ষা করেছো তখনই আমার সব অভিমান গলে গেছিলো। আমি তোমাকে দুরে সরিয়ে চলে এসেছিলাম সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য। তোমাকে জানাবো আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি তার আগেই তোমার ফুপির প্রপোসাল আসে আর আমি সঙ্গে সঙ্গে সেটা রিজেক্ট করে দিই। তাই তো তোমাকে দুরে সরিয়ে রাখতাম অফিসে। এদিকে তোমার ফুপি বুঝে গেছিলো তুমি শুধুমাত্র আমাকেই বিয়ে করবে বিয়ে করার হলে তাই নীহা কে দিয়ে ওই জঘন্য কান্ড টা ঘটিয়ে ছিলেন। উনি খুব ভালোভাবেই জানতেন ওই ঘটনার পর তোমার নাম খারাপ হবে আর আমি রাজি হয়ে যাবো। তোমার ফুপি মোটামুটি আমার নামে খোঁজ নিয়ে জেনে ছিলেন আমি খুব একটা খারাপ ছেলে নয়। আমার কারণে কোনো মেয়ের চরিত্রে দাগ পরবে তা আমি কিছুতেই মানবো না। তাই এই ঘটনা ঘটিয়ে ছিলেন আর এরপরে আরো খোঁজ নেওয়ার পর জানতে পারেন আমি তোমাকে আগে থেকেই ভালোবাসতাম, সেসময় আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে তাই আমি যদি তোমার কাছে চলে আসি, তোমাকে ডিভোর্স না দেই তাহলে তো ওনার সম্পত্তি হাসিল হবে না তাই উনি আমার আম্মু কে কিডন্যাপ করেন। আর এনাকে আমার আম্মু সাজিয়ে রাখেন। হোয়াট আ প্ল্যান!
আমি সবটা শুনে আমানের বুকে মাথ রেখে কেঁদে ফেলি আর আমান বলেন,
— তুমি একা কষ্ট করোনি এই ছয় মাস। আমিও তিলে তিলে শেষ হয়ে গেছি তোমাকে কষ্ট দিয়ে। তুমি তো সুমি কে মনের কথা বলতে বাট আমার তো শেয়ার করার মতো কেউ ছিলো না। কিন্তু আর নয়! এইবার না তোমাকে কষ্ট পেতে দেবো আর না আমি কষ্ট পাবো।
ফুপি আমানের দিকে তাকিয়ে শয়তানি হাসি হেসে বললেন,
— তাই নাকি আমান? তাহলে তুমি যখন মা আর স্ত্রীর লড়াইয়ে স্ত্রী কে বেছে নিলে তখন তোমার মা কে শেষ করে দিই কি বলো?
?
?