ভালোবাসি_শুধু_তোমায় পর্ব-০৫

0
2971

#ভালোবাসি_শুধু_তোমায় ?❤
#পর্ব : ৫
#লেখিকা : Aye Sha (Koyel Banerjee)

” আরুশের অবস্থা খুব একটা ভালো নয় মীরা। কিছুক্ষণ আগেই ও ঠিক ছিল কিন্তু নাইট ক্লাব থেকে বেরুনোর পরেই ওর একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। ”

ফোনে বান্ধবীর কথা শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম এই তো কিছুক্ষণ আগে আরশ টিপছিল তাহলে হঠাৎ কি হল আমি ঘুরিয়ে ওকে প্রশ্ন করলাম,

— কি হয়েছে আরুশের একচুয়ালি? ও ঠিক আছে তো? কোন নার্সিংহোমে ভর্তি আমাকে অ্যাড্রেস দে আমি কালকে দেখা করে আসবো।

— দুই হাত ভেঙে গেছে আর পায়ে এবং কোমরে ফ্র্যাকচার হয়েছে।

আমি চমকে উঠলাম আমার বান্ধবীর উত্তরে এটা কি করে সম্ভব একসাথে দুই হাত ভেঙে গেছে আবার পায়ে ও কোমরে চোট। ওহ গড! আমি নিজেকে সামলে উত্তর দিলাম,

— ঠিক আছে তুই আমাকে অ্যাড্রেসটা মেসেজ করে দে আমি কালকে ওর সাথে গিয়ে দেখা করবো।

ফোনটা কেটে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম হঠাৎ করে মুহূর্তের মধ্যে এমন একটা খবর আমি আশা করিনি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত তিনটে বাজে, আমি যখন নাইট ক্লাবে গিয়েছিলাম তখন রাত বারোটা আর নাইট ক্লাব থেকে বেরিয়েছি একটা নাগাদ। দুই ঘন্টার মধ্যে এত বড় এক্সিডেন্ট? আর আমার যতদূর মনে হয় আরো অনেক পরে আরুশ বেরিয়েছে, প্রায় দুটো বাজবে ওরম সময়। আমিতো জানি আরুশ ওই সময় নাইট ক্লাব থেকে বেরোয়। তার মানে এক ঘন্টা!? এক ঘণ্টার মধ্যে এত বড় অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে গেল? আমার কেন যেন কিছু ঠিক লাগছে না। কথাগুলো ভাবছিলাম সে সময় হঠাৎই আমার চোখ গেলো আমানের উপর আর তৎক্ষণাৎ আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো ভার্সিটিতে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা। আমি ভয়ে একটা শুকনো ঢোঁক গিললাম তারপর আমানকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলাম,

— আ..আপনি আমাকে কখন বাসায় এনেছেন?

আমান আমার দিকে না তাকিয়ে ল্যাপটপের মধ্যে মুখ গুঁজেই বললো,

— দেড়টা!

— আপনি কি তখন থেকে ঘরেই আছেন আমার সাথে?

— থাকি আর না থাকি, তুমি কি অজ্ঞান হয়ে তা দেখতে পেতে?

আমি এবার ভয় কাটিয়ে বলে দিলাম,

— আরুশ কে কেন এভাবে আঘাত করলেন আপনি?

এইবার উনি সঙ্গে সঙ্গে ল্যাপটপে উনার চলা আঙ্গুলগুলো থামিয়ে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে থেকে ল্যাপটপ বন্ধ করে দিলেন তারপর আমার দিকে কড়া চাহনি নিয়ে তাকিয়ে উত্তর দিলেন,

— ডোন্ট ক্রস ইউর লিমিট মীরা! তোমার নাইট ক্লাবের আশিক কে আমি কেন মারতে যাবো? ও যদি মরে যায় তাহলে তোমার কি হবে?

— আমি তো মেরে ফেলার কথা বলিনি, আঘাত করার কথা বলেছি।

আমার কথায় আমান একটু অস্বস্তিতে পরে গেলো, ল্যাপটপ পাশে রেখে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,

— যেখানে তোমার উপর আর তোমার কাজ-কর্ম, কথা-বার্তার উপর আমার কোনো ইন্টেরেষ্ট নেই। সেখানে তোমার আশিকের উপর আঘাত কেন করবো আমি? লজিক নিয়ে কথা বলো মীরা।

— সত্যি আমার উপর আপনার কোনো ইন্টেরেষ্ট নেই? তাহলে তো রাস্তায় ছেড়ে আসতে পারতেন! বাসায় নিয়ে এলেন কেন? রাস্তায় পরে থাকলে মরে যেতাম না নিশ্চ…

আমার কথা শেষ করার আগেই উনি জোরে ধমক দিয়ে উঠলেন,

— শাট আপ! এই জন্যেই বলে লোকের ভালো করতে নেই। আমারই ভুল তোমাকে অজ্ঞান অবস্থায় বাসায় নিয়ে আসাটা। তাই জন্যে এখন রাত-বিরেতে কথা শুনতে হচ্ছে। জাস্ট ডিসগাস্টিং!

কথাটা বলেই উনি দরজার দিকে হাঁটা ধরলেন, আজ আবারও ওনার কথাগুলো আমার বুকে গিয়ে বিঁধলো। আমি চোখ মুছে দরজার দিকে ফিরতেই দেখলাম উনি এখনও দাঁড়িয়ে আছেন, আচমকা আমি কিছু বোঝার আগেই উনি আমাকে এসে নিজের বাহু-বন্ধনে নিয়ে নিলেন। বেশ শক্ত করে নিজের সাথে মিশিয়ে আমার ঘাড়ে চিবুক রেখে আছেন। আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে থাকায় আমি অনুভব করছি ওনার শরীর কাঁপছে। এটা অনুভব করার পর আমি নিজের দু-হাত উনার পিঠে রাখতেই উনি ঝট করে সরে গেলেন আর এক মুহুর্ত দাঁড়ালেন না বেড়িয়ে গেলেন ঘর থেকে। আমি পুরোই বোকা বনে গেলাম! কিছুক্ষণ আগে খারাপ ব্যবহার করে এখন আবার ভালো ব্যবহার করলেন। এই প্রথম উনি আমাকে বিয়ের পর নিজে থেকে জড়িয়ে ধরলেন। বিড়বিড় করে বললাম,

— আমান খান নাকি তুফান খান আল্লাহ মালুম!

বেশ একটা ভালো লাগা কাজ করছে মনে কিন্তু সঙ্গে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। আমান কাঁপছিলেন কেন? কি হয়েছিল উনার? আর এরকম ভাবে হুট করে বেরিয়ে গেলেন কেন ঘর থেকে? ধুর! আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। কিন্তু আমার মন বলছে আরুশের অ্যাক্সিডেন্টের পিছনে আমানই আছে আর এটা নিছক একটা অ্যাক্সিডেন্ট নয়। কারণ এমন ঘটনা আমার চোখের সামনে ভার্সিটিতে ঘটেছিল,

— ওই দেখ! আজকে মহারানির পা মাটিতে পরেছে। চল একটু মজা নিতে হবে তো?

— মজা নেবো মানে? ওকে মজা দেখাবো আগে। ওর কাছে হবে সাজা আর আমাদের কাছে মজা। আমাদের কে অপমান করার সাধ মিটিয়ে দেবো।

আমি ভার্সিটি যাচ্ছিলাম এমন সময় কয়েকটা বখাটে ছেলের এসব আজে বাজে কথা শুনে ওদের দিকে তাকালাম। দেখলাম আমার উদ্দেশ্যেই কথাগুলো বলছে, কারণ আমি একবার ওদের অন্য মেয়েদের সাথে অসভ্যতামি করার শাস্তি দিয়েছিলাম। কিন্তু আজ একটু ভয় লাগছে কারণ আমি গাড়ি নিয়ে আসিনি, পায়ে হেঁটে আসছি আর আমার সাথে সুমিও নেই। আমি আজ পুরো একা! তাই ওদের কথায় পাত্তা না দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলাম কিন্তু হঠাৎই ওরা আমার পথ আটকে বললো,

— কি ব্যাপার মিস রণচন্ডী! আজকে তোমার সেই রুপ, সেই তেজ কোথায় গেলো?

— আমার পথ ছাড়ুন! যেতে দিন আমায়।

— কেন? আমাদের অসভ্যতামির শাস্তি দেবে না? ভয় পাচ্ছো নাকি আজকে?

কথাটা বলেই একজন আমার হাত টেনে ধরলো আমি ঝাড়া মেরে হাত ছাড়িয়ে উল্টো দিকে হাঁটতে গেলে পিছন থেকে আমার ওড়নায় টান পরে। আমি সঙ্গে সঙ্গে সামনে ঘুরে ছেলেটার গালে সজোরে থাপ্পড় বসিয়ে দিই। ছেলেটা রাগী চোখে আমার দিকে তাকায় আর অন্য একজন বলে,

— খুব সাহস তোর তাই না? আজ দেখবো কতো সাহস দেখাতে পারিস আমাদের সাথে।

— আপনিই সেই ব্যক্তি না যে কিছুদিন আগে আমাদের ভার্সিটি তে ভাষণ দিচ্ছিলেন রেপ করা, নারী নির্যাতন করা, ইভটিজিং করা অপরাধ। রাস্তায় যে ছেলে কে দেখবেন এমনটা করতে তাকেই উপযুক্ত শাস্তি দেবেন? বলেছিলেন না?

আমার কথায় ছেলেটি চুপ করে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো, যাকে চড় মেরেছি তার উদ্দেশ্যে বললাম,

— আপনার বোন তো আমার থেকে দু-বছরের জুনিয়র। সেদিনকেই ওর মুখে শুনছিলাম আপনি নাকি খুব ভালো! মেয়েদের নাকি খুব সন্মান করেন। যেই মেয়েকে রাস্তায় হেনস্থা করা হয় তাকে রক্ষা করেন। এগুলো কি সব মিথ্যে বলছিল আপনার বোন?

আমার কথা শেষে কেউ কোনো কথা বলছিল না দেখে আমি আবার বললাম,

— আসলে আপনার বোন মিথ্যে বলেনি। বলেছেন আপনি! নিজের বোনের সামনে একটা মিথ্যে মুখোশ পরে আছেন। আর আপনি! আপনি সমাজের সামনে মুখোশ পরে আছেন। একদিকে বলছেন মেয়েদের বাঁচাও আরেকদিকে সেই মেয়েদের কেই অত্যাচার করছেন। যারা রক্ষক, তারাই ভক্ষক। এই আপনাদের জন্যই যারা ভালো ছেলে তাদের বদনাম হচ্ছে তারা চেয়েও নারীদের বাঁচাতে পারছে না।

— তোরা কি ওর এসব বাণী শুনবি নাকি দাঁড়িয়ে?

আমার কথা শেষ হতেই অন্য একটা ছেলে কথাটা বলে উঠলো। সামনে আসতেই চিনতে পারলাম এটা সেই ছেলে যার সাথে ভার্সিটির সবার প্রায় ঝগড়া। মিস্টার আমান খানের তো সব চেয়ে বড় শত্রু! এ এখানে কি করছে?

— কি হলো চুপ করে আছিস কেন তোরা? ওর কথায় ভুলে গেলি নাকি? তোরা ভুললেও আমি ভুলবো না।

এই বলেই ছেলেটি এগিয়ে এসে আমার ওড়নায় হাত দিতে যাবে ঠিক সে সময় কেউ একজন আমার পিছন থেকে ছেলেটার হাত ধরে ফেললো। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম আমান!

— আমান আ..আপনি?

আমান আমার উত্তর না দিয়ে আমার সামনে এসে আমাকে গার্ড করে দাঁড়ালেন। সেই দেখে ছেলেটা নিজের হাত ছাড়িয়ে বললো।

— তুই এখানেও চলে এসেছিস নিজের মহানগিরি দেখাতে?

— সাহস কি করে হলো ওর দিকে হাত বাড়ানোর?

আমানের কন্ঠস্বর শুনে আমি কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম, এছাড়া চোখ-মুখ দেখে বুঝতে পারছি বেশ রেগে আছেন। কিন্তু আজ কেন জানো লোকটার উপর রাগ উঠছে না, ভালোই লাগছে। এটা কি স্বার্থপরতা? উনি আমাকে সেভ করছেন এই জন্য এমনটা হচ্ছে নাকি উনি, ওনার কাজ-কর্ম, কথা-বার্তা আমার অভ্যেস হয়ে গেছে? গতরাতেও এই ভেবে আমি ঘুমাতে পারিনি আর আজ ওনাকে দেখে আবারও এই প্রশ্ন মাথায় ঘুরছে আমার। আমার ঘোর কাটলো ওই ছেলেটার কথায়,

— ওহ হো! আমি তো ভুলেই গেছিলাম এটা সেই বড়লোকের ঘরের অহংকারী মেয়ে যে কি না তোর মতো ভিখারি কে পাত্তা দেয় না। হা হা হা হা! তো কেন ঘুরছিস ওর পিছনে? টাকার জন্য নাকি….

ছেলেটা কথা শেষ হওয়ার আগেই আমান ছেলেটা কে মারতে শুরু করলো। বেধড়ক মারার কারণে ছেলেটার নাক-মুখ থেকে রক্ত বেরিয়ে গেছে কিছুক্ষণের মধ্যে। ছেলেটা কে দম নেওয়ার সুযোগ দিচ্ছেন না আমান। আমি কি করবো বুঝতে না পেরে আমান কে আটকানোর জন্য পিছন থেকে ওনাকে টেনে নিয়ে এলাম, কিন্তু উনি আরো এগিয়ে গিয়ে মারতে যাচ্ছেন, আমি ধমক দিয়ে বললাম,

— আমান কি করছেন টা কি আপনি!? মাথা খারাপ হয়ে গেছে আপনার!? মরে যাবে তো ছেলেটা!

উনি প্রতি উত্তরে চিৎকার করে বললেন,

— যাক মরে! সাহস কি করে হলো তোমার দিকে হাত বাড়ানোর? জানে মেরে ফেলবো আমি ওকে!? এখানেই জ্যান্ত পুতে দেবো!? আর কোনদিন যাতে তোমার মুখটাও মনে না করতে পারে তার ব্যবস্থা করবো!

আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম ওনার কথায় কোনোরকম ওনাকে আটকে রেখে পুলিশ কে ফোন করে জানালাম। ততক্ষণে ওই ছেলে দুটো ওনাকে আটকে রেখেছিলেন। পুলিশ আসার সময় উনি শান্ত হয়ে গেছিলেন, সবশেষে ছেলেটি কে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাওয়ার পর অন্য ছেলে দুটি আমায় এসে বললো,

— আমি যা যা ভার্সিটি তে বলেছিলাম এবার থেকে তা পালন করার চেষ্টাই করে যাবো।

— আমার বোনকে আর কোনো মিথ্যে আশ্বাস নিয়ে থাকতে হবে না। ও নিজের ভাই কে যেমনটা মনে করে তেমনই হবে ওর ভয় এরপর থেকে।

কথাগুলো বলায় আমি সামান্য হাসলাম, ওরা চলে যেতেই মাথা ঘুরিয়ে আমান কে খুঁজতে লাগলাম কারণ তিনি উধাও হয়ে গেছেন। ঠিক করেছি আজ থেকে আর ওনার সাথে খারাপ ব্যাবহর করবো না।

সেদিনের ঘটনা আমার মনে আমানের প্রতি শ্রদ্ধ্যা বাড়িয়ে দিয়েছিল সঙ্গে আমার মনে যেই অনুভূতি টা তৈরী হয়েছিল আমান কে নিয়ে, যেই অনুভূতির জন্য আমার রাতের ঘুম উড়ে গেছিলো তাও নাম পেয়েছিল। ধীরে ধীরে ভালোবাসতে শুরু করে ছিলাম আমি আমান কে আর সেই কথা জানানোর আগেই একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেলো যার জন্য আজও আমি পশ্তাই। নাহ নাহ নাহ! আমি কিছুতেই সেই ঘটনা মনে করতে চাই না। কিন্তু আজ? আজ যেটা আরুশের সাথে ঘটল সেটা কি সত্যি অ্যাক্সিডেন্ট?

____ইট ইজ জাস্ট অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট মীরা!

হঠাৎই পিছন থেকে আমানের কন্ঠস্বর ভেসে উঠলো, আমি দেখলাম আমান দরজায় হেলান দিয়ে ডান হাতে কফি আর বাম হাত পকেটে গুঁজে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি উঠে দাঁড়াতেই উনি আমার দিকে এগিয়ে এলেন আর বললেন,

— এটা খেয়ে নাও আর অ্যাক্সিডেন্ট এর কথাটা মাথা থেকে বাড় করে ফেলো, গুড ফর ইউ। গুড নাইট!

আমার হাতে কফির কাপ ধরিয়ে উনি গিয়ে ঘুমিয়ে পরলেন, খেয়ে বুঝলাম এটা স্ট্রং কফি যেটার প্রয়োজন ছিলো আমার। মাথাটা ভার হয়েছিল সকালে অতক্ষণ শাওয়ারের কারণে। আমি কফিটা খেয়ে চুপচাপ ওনার পাশে শুয়ে ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই।

?
?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে