#ভালোবাসি_শুধু_তোমায় ?❤
#পর্ব : ১১
#লেখিকা : Aye Sha (Koyel Banerjee)
” আমি মীরা কে ডিভোর্স দেবো। ”
আমানের কথা শুনে আমি স্থির দৃষ্টিতে ওনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। চোখের পানি শুকিয়ে গেছে আজ আমার। উনি আম্মুর দিকে তাকিয়ে কথাটা বলতেই আম্মু ওনার কাছে গিয়ে ওনার গালে হাত রেখে বললেন,
— আমি জানতাম আমার ছেলে আমার কথা ফেলতে পারবে না। আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোনো কাজই করবে না আমার ছেলে।
আমান আম্মুর হাত নামিয়ে একবার আমার দিকে তাকিয়ে অফিসের জন্য বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। আমান বেরিয়ে যেতেই আম্মু আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে বললেন,
— আমি বলেছিলাম না আমার ছেলে আমার কথার খেলাফ কিছুতেই করবে না। ব্যাগ গুছিয়ে নাও কাল সকাল হতেই তোমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বিদায় করে দেবো এই বাসা থেকে এবং আমানের মনের থেকে।
আম্মুর কথা শুনে সুমি রেগে বললো,
— ওহ প্লিজ! আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন এই বাসাটা মীরার।
আমি সুমি কে থামিয়ে দিয়ে বললাম,
— সুমি চুপ কর।
আম্মু সুমির কথায় রহস্যজনক হাসি দিয়ে বললেন,
— দেখাই যাবে সেসব কিছু কাল সকালে।
আম্মু কথাটা বলেই বেরিয়ে গেলেন। আমি গিয়ে আস্তে করে বেডে বসে সারা ঘরটা দেখতে লাগলাম। সুমি আমার পাশে বসে বললো,
— মীরা তুই কেন বলতো এতোদিন এতো অপমান সহ্য করে এখানে পরে রইলি? শেষে ডিভোর্স নিয়ে বেরিয়ে আসার জন্য?
— আমি আমার ভুলের করা শাস্তি চেয়েছিলাম যা আমি পেয়ে গেছি। হয়তো সারাজীবন পাবো। আমান কে আমি ধ্বংস করে দিয়েছি এটা ও নিজ মুখে বলেছে। ওনার ধ্বংস আমি আর চাই না রে। উনি ভালো থাকলেই ভালো থাকবো আমি। ঠিকই বলেছিলেন উনি জোর করে না পাওয়া যায় ভালোবাসা আর না পাওয়া যায় সুখ।
— তার মানে তুই হার মেনে নিলি? আর আন্টী এটা কি বললো? তোর বাসা থেকে তোকেই ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দেবে?
— হ্যাঁ। আজ আমি হার মেনে নিয়েছি। এতদিনেও যে ওনার মন জয় করতে পারিনি আজ বুঝে গেছি। তাই আর জোর করবো না। আর রইলো বাকি এই বাসার কথা। কি করবো এই বাসা নিয়ে? এখানে বরং উনিই থাকুক, আমি তোর সাথে থাকবো। থাকতে দিবি না আমায়?
— বাজে কথা বললে না ঠাস করে এক চড় লাগাবো।
সুমির কথায় আমি সামান্য হাসলাম। সুমি আমার দিকে একটা ওষুধ এগিয়ে দিয়ে বললো,
— এটা খেয়ে নে তো চটপট।
— ইচ্ছে করছে না।
— খেতে যখন বলেছি তখন খাবি ব্যাস।
আমার না চাওয়া সত্বেও সুমি আমায় জোর করে ওষুধ খাইয়ে দিলো। ওষুধটা খাওয়ার পরেই চোখে ঘুম নেমে এলো, আমানের মুখটা চোখে ভাসছিল যা আস্তে আস্তে আবঝা হয়ে গেলো আর আমি ঘুমে তলিয়ে গেলাম।
ইসমি রাস্তা দিয়ে হেঁটে বাসায় ফিরছে। আজ গাড়ি নিয়ে আসেনি, আমানের খবর পেতেই ছুটে গেছে মীরার বাসায়। মীরা কে ঘুম পাড়ানোর কারণ টা ইসমির চাইতে ভালো আর কেউ জানে না। ইসমির মনে যে চিন্তা বাসা বেঁধেছে তা কিছুতেই যাওয়ার নয়। ইসমি ভাবছে,
— কালকে কি হবে কিছুই তো বুঝতে পারছি না। মীরা কি করে এতটা শান্ত রয়েছে তা তো মাথাতেই আসছে না আমার। ওর মাথার যন্ত্রণাটা আশা করছি ঘুমালে কমে যাবে। আজ থেকে গেলেই হতো মীরার কাছে কারণ সকালেই তো আবার যেতে হবে। সত্যি কি আমান জিজু ডিভোর্স দিয়ে দেবেন? আমি জানি আমিই মীরা কে নীহা আর জিজুর কথা বলেছিলাম কিন্তু বিয়ের আগে জিজুই তো নীহা কে পার্টিতে মখ্যম জবাব দিয়েছিলেন। তাহলে কেন উনি নীহার সাথে বিয়ের পরে সম্পর্ক তৈরী করলেন? আমান জিজু মীরা কে ডিভোর্স দেবেন, উনি মীরা কে ভালোবাসেন না এটা ভাবতেই পারছি না আমি। যে মানুষটা এতো টা এফোর্ট দিয়েছিল মীরার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য, নিজের আত্ম-সন্মান কে মূল্য না দিয়ে মীরার পিছনে ছুটে বেরিয়েছিল সে মীরা কে ভালোবাসে না? এমনটা যদি সত্যি হয় তাহলে ভালোবাসার উপর থেকে বিশ্বাসটাই উঠে যাবে আমার। কারণ মীরা যা ভুল করেছে তার উপযুক্ত শাস্তি ও পেয়েছে, ইনফ্যাক্ট এখনও পাচ্ছে। মানুষ যখন ভুল বুঝতে পারে তখন তাকে ক্ষমা করে দেওয়া উচিত আর এক্ষেত্রে তো আমান জিজু মীরা কে ভালোবাসেন। উফফ আমি কিছুই ভেবে উঠতে পা….আহহহহ!
ইসমির কথা শেষ হওয়ার আগেই কেউ ইসমিকে ধাক্কা মেরে রাস্তার ধারে ফেলে দিলো। ইসমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই কেউ ওর হাত টান দিয়ে উঠে দাঁড় করালো। ইসমি কিছু বলতে যাবে তার আগেই সে বললো,
— মাঝরাস্তা দিয়ে এভাবে অন্ধের মতো হেঁটে যাচ্ছো কেন? মরার ইচ্ছে হয়েছে নাকি হ্যাঁ?
ইসমি হকচকিয়ে গেলো অর্নিল কে দেখে। অন্য সময় হলে পাল্লা দিয়ে এর জবাব দিতো কিম্তু আজ কেন জানো ইসমির শরীর চলছে না। খারাপ করছে শরীরটা, কারণটা অবশ্য ইসমির জানা। ইসমি শান্ত গলায় অর্নিল কে উত্তর দিলো,
— নাহ আসলে আমি খেয়াল করিনি গাড়িটা।
অর্নিল রেগেই উত্তর দিলো,
— তা খেয়াল করবে কেন? সব সময় তো আপন মনে হেঁটে চলেছো। নয় বকবক করতে করতে আর না হয় অন্যমনুস্ক হয়ে। আমার সামনে এসেই তোমাকে সব কিছু করতে হয় তাই না? ডিসগাস্টিং!
ইসমির অর্নিলের কথায় খারাপ লাগলেও কিছু বললো না। আজ আর কোনো কিছুই ভালো লাগছে না। ইসমি অর্নিল কে হাত জোড় করে বললো,
— ধন্যবাদ আমাকে বাঁচানোর জন্য আর এতোদিন আমার বকবক শোনার জন্য। এবার থেকে নিজের খেয়াল রাখবো আর চেষ্টা করবো আপনার সামনে না আসার। আমি আসছি।
ইসমি কথাগুলো বলে পা বাড়ালো রাস্তার দিকে। এদিকে চোখে মুখে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে অর্নিল। অর্নিল ভাবছে,
— এ কেমন আশ্চর্যকর ঘটনা! যেই মেয়েটা সারাক্ষন কথা বলে, কেউ একটু যদি কথা শোনায় তাকে দ্বিগুণ কথা শোনায় আর আজ পুরো শান্ত? এভাবে হাঁটছে কেন ও? শরীর খারাপ নয় তো? নাহলে একটা ঘটনা এতটা পরিমান এফেক্ট করতে পারে না।
অর্নিল কথাটা মনে মনে ভেবেই এগিয়ে গেলো ইসমির দিকে। ইসমির পিছনে পিছনে গিয়ে ইসমির হাত টেনে ধরে ওকে দাঁড় করাতেই ইসমি কঁকিয়ে উঠলো,
— আহহহ!
অর্নিল ইসমির কুঁকীয়ে ওঠায় ঘাবড়ে গেলো। ইসমির হাত সামান্য ছিলে গেছে পরে গিয়ে। তা দেখে অর্নিল উত্তেজিত হয়ে পরলো ইসমিকে নিয়ে।
— এটা কি আমার ধাক্কা দেওয়ার ফলে হয়েছে?
— তেমন কিছু হয়নি। আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে আমায় যেতে দিন। আমি যেতে পারবো।
— হ্যাঁ আমি খুব ভালো ভাবেই দেখতে পাচ্ছি তুমি কেমন যেতে পারবে।
অর্নিল কথা শেষ করে ইসমি কে কোলে তুলে নিলো, ইসমি জানো অবাকের সপ্তম পর্যায়। অর্নিল ইসমির অবাক হওয়া দেখে মনে মনে হাসলো আর ওকে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে বসিয়ে দিলো। অর্নিল ইসমির পাশে ড্রাইভিং সিটে বসতেই ইসমি শান্ত গলায় প্রশ্ন করলো,
— আপনার গাড়ি আছে তা আগে বলেননি তো?
— আমি বলতে না কাজে করে দেখাতে পছন্দ করি। আজ সুযোগ হয়েছে তাই দেখতে পেলে যে আমার গাড়ি আছে। আর এই গাড়িটা আছে বলেই তোমায় তাড়াতাড়ি তোমার বাসায় পৌঁছে দিতে পারবো।
— জি।
ইসমির এই ছোট্ট উত্তর পেয়ে অর্নিলের কেন জানো খারাপ লাগলো। অর্নিলের মনে হচ্ছে আজ ইসমি অর্নিলের সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক নয়। এড়িয়ে যাচ্ছে বারে বারে। তবুও অর্নিল ইসমিকে জিজ্ঞেস করলো,
— তোমার কি শরীর খারাপ করছে? সামান্য পরে যাওয়ায় তো এতটা শরীর খারাপ করার কথা নয় ইসমি।
ইসমি কিছুক্ষণ চুপ করে সিটে মাথা ঠেকিয়ে জানলার বাইরে তাকিয়ে রইলো। শরীরটা কেমন ছেড়ে দিয়েছে। নিজের শরীরে শক্তি সঞ্চয় করে বললো,
— আমার একটা যমজ বোন আছে। আমরা একসাথে হয়েছি। আমি ওর থেকে ৪ মিনিটের বড়। ছোটবেলা থেকেই ওর যদি শরীর খারাপ হয় তাহলে আমারও সামান্য শরীর খারাপ হয় আবার আমার শরীর খারাপ হলে ওর ও সামান্য পরিমান হলেও শরীর খারাপ করে।
— ইয়াহ! আমি এই ব্যাপারটা শুনে ছিলাম। আজকে দেখেও নিলাম। তো তোমার বোনের কি শরীর খারাপ?
— হ্যাঁ। মাথা যন্ত্রণার জন্য আমি ওকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে এসেছি। ও দুর্বল হয়ে পরেছে তাই হয়তো আমারও শরীর ঠিক লাগছে না। কাল সকালের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে আশা করছি।
— বাসায় গিয়ে রেস্ট নাও বেশি চিন্তা না করে।
ইসমি এইবার অর্নিলের দিকে তাকালো। অর্নিল ও ইসমির চোখে চোখ রেখে বললো,
— কিছু বলবে?
ইসমি এতক্ষণে অর্নিলের কথাটা খেয়াল করলো। খেয়াল করায় আরো বেশি অবাক হয়ে গেলো কারণ অর্নিল ওকে “তুমি” করে সম্বোধন করছে। ইসমি আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো অর্নিল কে,
— আপনি আমায় “তুমি” করে সম্বোধন কবে থেকে করছেন?
অর্নিল ইসমির কথায় হেসে উত্তর দিলো,
— যেদিন থেকে তুমি আমায় “আপনি” করে সম্বোধন করছো। সোয়াইপ করলাম আর কি। তুমি “আপনি থেকে তুমি” তে গেলে দেখে আমিও “আপনি থেকে তুমি” তে গেলাম। বুঝলে?
ইসমি প্রতি উত্তরে সামান্য হাসলো। আজ অর্নিলের ব্যবহারে এতো পরিবর্তন কিভাবে ইসমি বুঝে উঠতে পারছে না। যেই ছেলেকে হাজার টা প্রশ্ন করলে একটা উত্তর দেয়, আজ সেই ছেলে এতো কথা বলছে? নিজে থেকে বাসায় পৌঁছে দিচ্ছে? এসব ভাবতে ভাবতেই ইসমির বাসা এসে পরায় ইসমি অর্নিলের হাতে হাত রাখলো। ইসমি ইশারায় গাড়ি থামাতে বলছে বুঝতে পেরে অর্নিল গাড়ি সাইড করে দাঁড় করালো। দাঁড় করিয়ে নিজে নেমে গিয়ে ইসমি কে নামতে সাহায্য করলো। ইসমি নিজের বাসার দিকে যাবে ঠিক সেই সময় অর্নিল ইসমির হাত শক্ত করে নিজের হাতের মাঝে নিয়ে বললো,
— আমি পৌঁছে দিই?
ইসমি অর্নিলের চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বললো না, চোখ নামিয়ে নিয়ে অর্নিলের হাতটা শক্ত করে ধরলো। অর্নিল গাড়ির দরজা দিয়ে ইসমির এক হাত শক্ত করে ধরলো আরেক হাতে কাঁধে রাখলো। ইসমি কে পুরো বাসায় রেখে এসে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে নিজের ফোন বের করে মেসেজ করে দিলো কাওকে। তারপর ইসমির বাসার দিকে তাকিয়ে সামান্য হাসলো আর গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলো।
অন্যদিকে,
— আমার সহ্যের সীমা এবার পেরিয়ে গেছে মীরা! আর নয়। অনেক কষ্ট সহ্য করেছি, দিনের পর দিন সহ্য করেছি। এইবার আমার সব কিছু ফিরিয়ে দেওয়ার পালা। এবার আমান খানের পাল্টা জবাব দেওয়ার পালা। তুমি তো তোমার বোনের কাছে কেঁদে নিজের মন হাল্কা করেছো কিন্তু আমি? আমি তো তা পারিনি। নিজের ভালোবাসা কে নিজের থেকে দুরে সরানোর কষ্ট তুমি বুঝবে না। সাড়ে তিন বছর আগে তোমার অবহেলা কষ্ট দিয়েছিল আর এই ছয় মাস ধরে তোমার কাছে আসা কষ্ট দিয়েছে। তুমি ঠিক বলেছিলে মীরা, “তোমার কাছে গেলে আমি বরবাদ হয়ে যাবো।” সত্যি তুমি আমাকে বরবাদ করে দিয়েছো, তোমার ভালোবাসায় তুমি আমাকে বরবাদ করে দিয়েছো। তোমাকে ভালোবেসে বার বার মরেছি আমি। আমার রাগ-অভিমান সব কিছু তোমার সামনে নগণ্য। এই চার বছরে তুমি যেমন বিরহের জ্বালায় জ্বলেছো তেমন আমিও জ্বলেছি। এইবার সবটা শেষ হওয়ার পালা।
?
?