গল্পঃ- ভালোবাসি
লেখকঃ-সাব্বির আহমদ
পর্বঃ- ০৬
আমি অবাক হয়ে বললাম,
-২ বছর আগে আমার কোন পিক দেখেছিলেন?
-সেদিন সাবার বার্থডে ছিল.ও বেশ কিছু পিক পাঠিয়েছিল আমাকে তার মধ্যেই একটা পিক আপনার আর ওর.আপনি কালো রঙের শাড়ি পরে ছিলেন.প্রথম আপনাকে সেদিনই দেখেছিলাম তাও কালোতে.জানেন তো কালো রংটাকে আমি বেশি একটা পছন্দ করতাম না.আমার কাছে কালো মানেই আধার.কালো মানেই নিজেকে অন্ধকারের মাঝে বিলিয়ে দেওয়া.তবে আপনাকে যেদিন কালোতে দেখি সেদিন মনে হয়েছিল যে কালোতে কাউকে এতটা প্রানোচ্ছল কি করে লাগতে পারে.সেই দিন থেকে আমারও সেই রংটার প্রতি অদ্ভুত একটা মায়া তৈরী হয়ে যায়.আর আজকে আবারোও আপনাকে কাল রঙে দেখে সেই মায়াটা আরো বেড়ে গেলো.
‘
আমান আমার সাথে কথা বলে যাচ্ছে কিন্তু সেই কথাগুলো আমার মস্তিষ্ক অবধি পৌঁছাচ্ছে না.কারণ আমার মন আর মস্তিষ্ক এখন সম্পূর্ণ রূপে মনোযোগ দিয়ে আছে আমাদের ঠিক সামনে বসে থাকা এক মধ্যবয়স্ক কাপলের উপর.যাদেরকে দেখা মাত্র আমার সারা শরীরে রাগের বন্যা বয়ে যাচ্ছে.আমি উঠে দাঁড়িয়ে পড়ি .আমাকে দাঁড়াতে দেখে আমান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
-কি হয়েছে প্রত্যাশা?কোনো সমস্যা?
উনার প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে আমি সোজা ওই কাপলদের টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়.আমানও আমার পিছু পিছু আসে।আমাকে এইভাবে উনাদের সামনে এসে দাঁড়াতে দেখে.সেখানে ভদ্র মহিলাটি বলে উঠলো ,
-কি ব্যাপার!কে তুমি?
আমি উনার দিকে একবার তাকিয়ে উনার পাশে থাকা ভদ্র লোকটির দিকে তাকাই.তারপর তাচ্ছিল্লের হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করি ,
-কেমন আছেন মি. এনামুল হক?
আমার প্রশ্নে তিনি অনেক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
-তুমি কি আমাকে চেনো মা?
আমি তাচ্ছিল্লের হাসি দিয়ে বললাম ,
-মা.কে মা ?
-তুমি তো আমার মেয়েরই মতো.মেয়েকে তো মা বলা যায়ই
উনার প্রতিটা কথায় রাগে আমার শরীর কাঁপছে.নিজেকে শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে বললাম ,
-হুম মেয়েরই মতো.কিন্তু মেয়ে না
.
তারপর আমানের দিকে তাকিয়ে বললাম ,
-দেখেছেন আমান,উনি কি বলছেন আমি নাকি উনার মেয়ের মতো কিন্তু মেয়ে না.
আমার কথায় আমান কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করে
-কি হয়েছে প্রত্যাশা.আপনি কি উনাকে চেনেন?
আমি সামনের লোকটির দিকে তাকিয়ে শক্ত মুখে বললাম
-কেন চিনবো না .খুব ভালো করে চিনি এনাকে.কখনো ভুলবো না.সারাজীবন উনার কথা আমার মনে থাকবে আমার।
ততক্ষনে লোকটি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে তারপর অস্ফুটন শব্দে বলে উঠে,
-প্রত্যাশা!
উনার মুখে আমার নাম শুনে আমার চোখের কোনায় পানি জমে.কিন্তু সেই পানিকে গড়িয়ে পড়তে না দিয়ে নিজেকে শক্ত করে উনাকে প্রশ্ন করি.
-কি করে চিনলেন আমায় মি . এনামুল হক ?
উনি উনার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছিলো আমার মাথায় হাত রাখার জন্য কিন্তু আমি কিছুটা দূরে সরে গিয়ে বলি ,
-বাহ্!এখনো তো দেখছি ভালোই এক্টিং করছেন.আপনি কি ভেবেছেন আপনার এই ভালো মানুষের মুখোশটা আমি ধরতে পারবো না?
উনি কিছুটা ভেজা স্বরে বলে ,
-কেমন আছিস মা ?
আমি এবার রেগে গিয়ে চিৎকার করে বলি ,
-খবরদার আমাকে মা ডাকবেন না.আমি আপনার মতো একটা লোকের মুখে মা ডাকটা শুনতে চাই না.
আমাকে এভাবে রেগে যেতে দেখে আমান আমার হাত ধরে বলে ,
-কি হয়েছে আপনার প্রত্যাশা .আর উনিই বা কে?এত রেগে যাচ্ছেন কেন?
আমি আমানের দিকে তাকিয়ে বলি ,
-উনিই সেই মানুষ আমান যার জন্য আমি বিয়ে করতে ভয় পাই.উনি সেই মানুষ যিনি ৭ বছর বয়সে আমাকে আমার ভাই আর মাকে ফেলে রেখে অন্য একটা মহিলার কাছে চলে আসে.উনিই সেই মানুষ আমান যার হাতে একটা সময় আমার মা দিনের পর দিন মার খেয়েছে.জানেন আমান আমি তখন খুব ছোট.তবে বুঝতি পারতাম আমার মার কষ্টটা.যখন দেখতাম আমার মা রক্তাক্ত অবস্থায় নিচে পরে আছে.তখন ধীরে ধীরে মায়ের সামনে বসে মায়ের মাথার রক্ত.ঠোঁটের কিনারার রক্ত গুলো হাত দিয়ে মুছে দিতাম.একদিন কি হয়েছে জানেন আমার মাকে যখন এই লোকটা জানোয়ারের মতো মারছিলো তখন আমার ভাই দৌড়ে গিয়েছিলো মাকে বাঁচাতে কিন্তু এই লোকটা তখন আমার ভাইকেও নির্মমভাবে আঘাত করে.আর সেই দিনই আমার মা প্রতিবাদ করেছিল.উনাকে আটকিয়েছিলো যার ফলে উনি মাকে গরম খুঁটির ছেকা দেয়.এবং বাসা থেকে বেরিয়ে যায় তারপর আর উনি বাসায় ফেরেননি.আমরা বেঁচে আছি না মরে গেছি তা একটা বারের জন্যও কখনো জানতে আসেননি.সেইদিন থেকেই না আমার মনে খুব ভয় ঢুকে গিয়েছিলো যদি আমার সাথেও এমন হয়.যদি আমাকে আমার মার মতো কষ্ট সহ্য করতে হয়.তাই আমি বিয়ে করতে চাইনি।
‘
আমার চোখ থেকে অঝোরে পানি পড়ছে.আজ যেন চোখের পানি গুলো কোনো বাধা মানবে না.তারা যেন কোনো প্রতিযোগিতায় নেমেছে কে কত বেশি বয়ে চলতে পারে.নিজেকে কোনোভাবেই শান্ত করতে পারছিলাম না .ফুঁপিয়ে কেঁদেই চলছি.আমার কান্না দেখে আমান আমাকে আলতো হাতে জড়িয়ে ধরে বলে ,
-শান্ত হন প্রত্যাশা .আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করেন.আপনাদের ভালোর কথা ভেবেই আল্লাহ উনাকে আপনাদের জীবন থেকে সরিয়ে দিয়েছিলো .আমি জানি আমি আপনার কষ্টটা বুঝবো না.কিন্তু আপনার কষ্টের অংশীদার তো হতে পারবো .কান্না বন্ধ করুন প্লিজ.আর একবার আপনার মার কথা ভাবুনতো যিনি কিনা এত কিছু সহ্য করে নিয়েও কখনো হতাশ হননি .উনি আপনাকে আর আপনার ভাইকে হাড় ভাঙা পরিশ্রম দিয়ে মানুষের মানুষ তৈরী করেছে কেন জানেন যাতে করে এই মানুষটার সামনে দাঁড়ালে আপনারা কখনো দুর্বল হয়ে না পড়ুন বরং রুখে দাঁড়াতে পারেন .আপনার কাছে কি নেয় সেটা নিয়ে আফসোস করবেন না বরং আপনার কাছে যা আছে তা নিয়ে গর্ব করুন.নিজেকে শক্ত করুন।
‘
আমানের কথাই বুঝতে পারলাম কাঁদলে কিছুই হবে না .বরং নিজের কষ্টটাই বাড়বে.তারচেয়ে সব কিছুকে পেছনে ফেলে আমাকে এগিয়ে যেতে হবে .ভুলে যেতে হবে এই মানুষটাকে যেমনটা করেছিল আমার মা.কিন্তু আদৌ কি মা উনাকে ভুলে গিয়েছে .এখনতো দেখি উনার ছবিটা লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে আর কাঁদে.ভালোবাসা বুঝি এমনই হয়.হায় কেউ ভালোবাসা পায় না তো কেউ ভালোবাসার মূল্য বুঝে না .কথা গুলো ভেবে নিজেকে শক্ত করলাম .হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছে সামনে থাকা আমার জন্ম দাতাকে বললাম ,
-ভালো থাকবেন মি এনামুল হক ।
কথাটা বলে আর এক মুহূর্তও দেরি না করে বেরিয়ে যায় সেখান থেকে.
‘
চুপচাপ আমানের গাড়িতে বসে আছি .দৃষ্টি জানলার বাইরে.আমাকে চুপ থাকতে দেখে আমান বললো,
-প্রত্যাশা আমার মনে হয় এখন আপনার নিজেকে স্বাভাবিক করা উচিত .আর আজকের এই কথা গুলো ও আপনার আম্মুকে বলবেন না নাহলে উনিও কষ্ট পাবেন.
আমি জানলার বাইরেই দৃষ্টি রেখেই বললাম ,
-জানেন আমান আমার আম্মু এখনো ওই লোকটাকে ভালোবাসে .আমি এখনো আম্মুকে ওই লোকটার ছবি হাতে কাঁদতে দেখি ,
আমান ছোট একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলে,
-ভালোবাসা কখনো কমে না প্রত্যাশা .ভালোবাসার মানুষটা যতই কষ্ট দিক না কেন তবু তাকে ভালোবাসতেই মন চায়.যেটা আপনার আম্মুর ক্ষেত্রেও.উনি আপনার বাবাকে সত্যিকারের ভালোবাসতেন তাই এতো অত্যাচারের পরও এখনো উনাকেই ভালোবাসেন.
আমানের কথায় আমি রেগে গিয়ে বললাম ,
-ওই লোকটা আমার বাবা না.আমার বাবা যদি কাউকে বলতেই হয় সেটা হলো আমার ভাই .আমার জীবনে আমার মা আর আমার ভাইই আমার সব আর কারো কোনো জায়গা নেয় বিশেষ করে ওই লোকটার তো না ই
-ঠিক আছে .তবে আপনিও আর রেগে থাকবেন না নিজেকে শান্ত করুন .
আমি শান্ত গলায় উত্তর দিলাম ,
-না আমি রেগে নেয়.ঠিক আছি আমি .
‘
৮.০০তার দিকে বাড়ি পৌঁছায় .আমান আমাকে নামিয়ে দিয়েই উনার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে চলে যান.আজকের বিকেলটা যতটা ভালো কাটে সন্ধ্যাটা তার থেকেও বেশি খারাপ কাটে.কি দরকার ছিল আল্লাহ আবার এই লোকটার মুখোমুখি করানোর .পুরোনো আঘতে আজ আবার রক্তক্ষরণ হয়েছে .কিন্তু এইসব কিছু আম্মুকে বুঝতে দিলে চলবে না .কিন্তু আম্মু তো আমার মুখ দেখলেই সব কিছু বুঝে ফেলে .আল্লাহ দেখো আজ যেন কিছু টের না পায় .ভয়ে ভয়ে বাসার দরজার কলিং বেল চাপি ..
চলবে ..